alt

সাময়িকী

শামসুজ্জামান খান

এক খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তক

এম আবদুল আলীম

: বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিচ্ছেন শামসুজ্জামান খান। পাশে বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানা

শামসুজ্জামান খান ধীমান গবেষক-প্রাবন্ধিক। ছয় দশকের অধিক সময় বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শেকড়ের সন্ধান করেছেন। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। চেতনার মর্মমূলে গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। একই সঙ্গে ছিলেন মুক্তমনা, প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক। বিজ্ঞানমনষ্ক ও উদ্ভাবনাময় এই চিন্তাবিদ বিচিত্র বিষয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। ফোকলোর, বাংলা সন, রসরচনা, শিশুসাহিত্য, জীবনী, ক্রীড়া, ভ্রমণকাহিনি, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে গভীর অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসমূহে। চর্বিত-চর্বণ নয়; সম্পূর্ণ নতুন পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি এবং যুক্তিশীল বিশ্লেষণ দ্বারা সবকিছু মূল্যায়ন করেছেন। জ্ঞানবিশে^র সর্বসাম্প্রতিক তথ্য-তত্ত্বের যৌগিক পাঠের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রজীবনকে। বাংলার ফোকলোরবিদ্যার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর গভীর অনুধ্যান লক্ষ করা যায়। এ দেশের ফোকলোর-সাধনার সনাতন কাঠামো ভেঙে একে সম্পৃক্ত করেছেন আধুনিক বিশ্ব-ফোকলোরধারার সঙ্গে।

শামসুজ্জামান খানের আবির্ভাবের কাল ছিলো ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ছয়চল্লিশের দাঙ্গা, সাতচল্লিশের দেশভাগ এসব ঘটনা-দুর্ঘটনায় তাঁর শৈশবের কাল ছিলো অস্থির, যা তাঁর শিশুমনে প্রভাব ফেলে। ঐ সময় তিনি কাটিয়েছেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার চারিগ্রামের নির্মল প্রকৃতির বুকে।

শামসুজ্জামান খান পারিবারিকভাবে পেয়েছিলেন শিক্ষা-সংস্কৃতির বিশাল উত্তরাধিকার। উনিশ শতকের রেনেসাঁসের আলো ঠিকরে পড়া এক প্রাগ্রসর পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রপিতামহ এলাহদাদ খান (১৮৩৪-১৮৯৭) ছিলেন মীর মশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যিনি ফরিদপুরের ডেপুটি স্কুল ইন্সপেক্টর থাকাকালে সম্পাদনা করেছিলেন ‘ফরিদপুর দর্পণ’ নামক পাক্ষিক পত্রিকা। শুধু তাই নয়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা ভগবান চন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলা স্কুল। প্রপিতামহের ভাই আদালত খান (১৮৪৪-১৯৯৪) ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একমাত্র বাঙালি মুসলমান মুন্সি অধ্যাপক। তিনি বহুভাষী পণ্ডিত ছিলেন; তুলসী দাসের ‘রামায়ণ’ এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’র ইংরেজি অনুবাদ করেন।

বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, তাকে তিনি সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে

বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, তাকে তিনি সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে বাংলা শিক্ষক এ এইচ আনিসুর রহমানের প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল অসামান্য। ঐ শিক্ষক নিজে কবিতা লিখতেন এবং শামসুজ্জামানকে নানাভাবে উৎসাহ দিতেন। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্য তিনি প্রথম দেখেছিলেন ঐ শিক্ষকের হাতে। চারিগ্রাম শাহাদত আলী হাইস্কুলে ভর্তি হয়েই ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার মুকুলের মাহফিলের সদস্য হন এবং গল্প-কবিতা মকশো শুরু করেন। এই স্কুলের বাংলার শিক্ষক খলিলুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী রোকাইয়া সুলতানা এবং প্রধান শিক্ষক ফজলুল করিম, উর্দু শিক্ষক আবুল হাসনাত ও উর্দু মৌলভি মুহম্মদ ওমরের উৎসাহ-প্রেরণায় সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। ঐ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখের লেখা অনেক বই পড়েন। শিক্ষকগণ অবসর পেলেই সিলেবাসের বাইরের নানা বিষয়ে জ্ঞান দিতেন। সাহিত্য ও রাজনীতির নানা বিষয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন। ঐ সময় শামসুজ্জামান খান ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’ এবং ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ প্রভৃতি পত্রিকা নিয়মিত পড়তেন। বাংলার শিক্ষক খলিলুর রহমান তাঁকে দায়িত্ব দেন ‘পূর্বাভাষ’ নামক হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনার। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয় সাহিত্য-সংস্কৃতির অবারিত ভুবন। এখানে এসে সান্নিধ্য লাভ করেন অনেক গুণী শিক্ষকের। বেশি প্রভাবিত হন অজিতকুমার গুহ, হাসান হাফিজুর রহমান, শৈলেন ভদ্র এবং আবদুল মতিনের দ্বারা। উপাধ্যক্ষ রেবতিমোহন চক্রবর্তীর দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হন। অজিত কুমার গুহের অনুপম বক্তৃতাশৈলী, হাসান হাফিজুর রহমানের জলদ-গম্ভীর আবৃত্তি এবং শৈলেন ভদ্রের পাঠদানের নাটকীয় ও নান্দনিক ভঙ্গি তাঁকে আপ্লুত ও চমৎকৃত করে। এসব শিক্ষকের প্রভাব তাঁর জীবনে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এমন এক ঝাঁক জ্যোতির্ময় শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেন, যাঁরা তাঁকে দিয়েছিলেন মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রেয়বোধের দীক্ষা। এই শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান সারওয়ার মুরশিদ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, এ কে নাজমুল করিম, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, গিয়াসউদ্দিন প্রমুখ। এঁদের দীক্ষায় শামসুজ্জামান হয়ে ওঠেন নবযুগের অভিযাত্রী।

পাকিস্তান আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হলেও হাইস্কুলের পড়ার সময়ই সে মোহ কেটে যায়। এই মোহভঙ্গে কাজ করেছিলো বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম শহিদ রফিকউদ্দিন আহমদের বাড়ি ছিলো শামসুজ্জামান খানের জন্মস্থান চারিগ্রামের পাশর্^বর্তী পারিলে। রফিকউদ্দিনের শহিদ হওয়ার খবর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং এলাকার সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই তুঙ্গ মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে শামসুজ্জামান খান লিখেছেন : ‘১৯৫২ সালে আমি চারিগ্রাম শাহাদৎ আলী খান হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ছাত্র-হত্যার সংবাদে আমরা বিক্ষুব্ধ হই। মিছিল করি, বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলি থানার বিভিন্ন গ্রামে। রফিকের মৃত্যুতে গোটা এলাকা উত্তাল হয়ে ওঠে।’ ভাষা-আন্দোলন পূর্ববঙ্গের মানুষের চেতনায় জন্ম দেয় ধর্মীয় ভাবধারার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ। এই চেতনা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে শামসুজ্জামান খানের কিশোরমনকে, যা ক্রমে বিকশিত হয়ে স্থায়ী রূপ লাভ করে তাঁর চেতনা-মননের জগতে। রফিকউদ্দিনের শহিদ হওয়ার ঘটনা তাঁর মনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিলো যে, শামসুজ্জামান খান ১৯৫৭ সালে ‘লাল শার্ট’ নামে একটি গল্প লেখেন, যার উপজীব্য ছিলেন ভাষাশহিদ রফিকউদ্দিন। গল্পের বিষয় ছিলো রফিকউদ্দিনের বিয়ে উপলক্ষ্যে তাঁর ছোট ভাইয়ের লাল শার্টের আবদার; যে শার্ট আসেনি, এসেছিল শহিদ রফিকের রক্তভেজা শার্ট। গল্পটি ‘দৈনিক আজাদ’-এর মুকুলের মাহফিলে প্রকাশিত হয়। এরপর আর থামতে হয়নি তাঁকে। একে একে রচনা ও সম্পাদনা করেন শতাধিক গ্রন্থ।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শামসুজ্জামান খান পাকিস্তানি শাসকদের শাসন-শোষণ আর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বাধিকার-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। প্রথমে বামপন্থায় দীক্ষা নিলেও পড়ে যুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। সিরাজুল আলম খান এবং শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঢাকা হল ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে তিনি ভিপি প্রার্থী ছিলেন। সেটা ১৯৬১ সালের কথা। ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কাউন্সিলে তিনি ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। পরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সড়ে আসেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্তদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সেরা সাংস্কৃতিক সংগঠক। স্বীয় মেধা-মননের পরিশীলনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির সাধনায় তিনি পরিণত হন একজন খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তকে। লেখায়, কর্মে এবং চিন্তায় সারাজীবন এই আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, উদার মানবতাবাদ, ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং কুসংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত আধুনিক ভাবধারা শিরোধার্য করে পথ চলেছেন। বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি যখন সঙ্কটাপন্ন তখন তিনি সেগুলোর অন্বেষণ-অনুসন্ধিৎসা এবং সংরক্ষণে ব্রতী হয়েছেন। বাঙালির চিরকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা-আন্দোলন, স্বাধিকার-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ বিবিধ বিষয়ে লেখনী সঞ্চালন করেছেন।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালি সংস্কৃতির যে অভিযাত্রা তার ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত রূপায়ন ঘটেছে তাঁর গ্রন্থগুলোতে। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং গৌরবের যাঁরা ধারক-বাহক তাঁদের জীবন ও কর্ম তিনি নবমূল্যায়ন করেছেন। এক্ষেত্রে কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, দার্শনিক সকলেই তাঁর অনুসন্ধিৎসার বিষয় হয়েছে। মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের রাজনৈতিক দর্শন এবং চিন্তাকর্ম কীভাবে বাঙালির জাতীয়তাবোধ পরিপুষ্ট করেছে, তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় পাওয়া যায়। বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষাকেও তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। তাঁর গ্রন্থগুলোর উৎসর্গপত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক এবং লালনকারীদের স্থান দিয়েছেন। কবি আবদুল হাকিম, লালন ফকির, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, এস ওয়াজেদ আলী, মুহম্মদ এনামুল হক, অজিত গুহ, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, মযহারুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আহমদ শরীফ, মমতাজুর রহমান তরফদার, হায়াৎ মামুদ, কবীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ প্রমুখকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে তিনি বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে রাজনীতির গতিধারার দিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান রূপকার। মওলানা ভাসানীকে বলেছেন, গণমানুষের বিপ্লবী কণ্ঠস্বর। বাঙালি দীর্ঘকালের গৌরব, শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস পর্যালোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দুই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ বলে অভিহিত করেছেন। বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষার স্পর্শে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা কীভাবে শাণিত হয়েছে, তার বয়ানও তিনি তুলে ধরেছেন। লালন শাহ, হাসন রাজা, গুরুসদয় দত্ত চন্দ্রকুমা দে, জসীম উদ্দীন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শাহ আবদুল করিম, তোফায়েল আহমদ, আবদুল লতিফ, মযহারুল ইসলাম, বিনয় বাঁশি জরদাস, মোহাম্মদ সাইদুর প্রমুখের সাধনাকে তিনি নানামাত্রিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে করেছেন এবং তাঁদের বাঙালি সত্তার স্বরূপ নির্ণয় করেছেন। বাঙালির চিরায়ত উৎসব-পার্বণ কীভাবে যুগ যুগ ধরে এই জাতিকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে তারও বয়ান অনেক প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। গভীর দেশপ্রেম থেকেই শামসুজ্জামান খান বাঙালির যুগযুগান্তরের লোকচৈতন্যের গভীরতম পরিচয় ও বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষার স্বরূপ-সন্ধান করেছেন।

বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, তাকে তিনি সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ধর্মের নামে হানাহানি দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। বাংলার জাগরণে লোকায়ত ধর্ম এবং লোকজ সংস্কৃতির ভূমিকাকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। বাঙালির জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূল হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে। এও বলেছেন, ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সুদৃঢ় করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনেতিক শোষণ-বঞ্চনা। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্যই বাঙালি শেষপর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে চূড়ান্ত লড়াইয়ে এবং কঠিন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীন বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ঝাণ্ডা হাতে আজীবন পথ চলেছেন শামসুজ্জামান খান।

আজীবন তিনি যে লোকজীবনের সংস্পর্শে থেকে লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির সাধনা করেছেন, শহরের কোলাহল থেকে দূরে সেই নিভৃত লোকালয় চারিগ্রামেই তিনি অনন্ত শয্যা গ্রহণ করেছেন। তিনি চিরঘুমে শায়িত হলেও সদা জাগরূক থাকবে তাঁর চিন্তা ও কর্ম। সেগুলো বাঙালিত্বের দীপ্ত শপথে জাতিকে পথ দেখাবে এবং যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখবে।

স্বীয় মেধা-মননের পরিশীলনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির সাধনায় তিনি পরিণত হন একজন খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তকে। লেখায়, কর্মে এবং চিন্তায় সারাজীবন এই আদর্শে অবিচল থেকেছেন

দুই.

শামসুজ্জামান খানের শিক্ষাজীবন শুরু নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ গ্রহণ করেন চারিগ্রামের শাহাদত আলী খান হাইস্কুলে। এখান থেকে ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যৌবনের স্বপ্নভরা দিনগুলো অতিবাহিত করেন দুঃশাসন-কবলিত পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায়। ঐ সময় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাগ্রহণ করেন জগন্নাথ কলেজ থেকে। ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ১৯৬২ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনের প্রথম পর্যায় কাটে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ (১৯৬৪), জগন্নাথ কলেজ (১৯৬৪-১৯৬৮), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৮-১৯৭৩) অধ্যাপনা করে। পরে থিতু হন বাংলা একাডেমিতে। এখানে উপ-পরিচালক (১৯৭৩-১৯৮১) এবং পরিচালক (১৯৮১-১৯৯৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (১৯৯৬-১৯৯৭) এবং জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক (১৯৯৭-২০০১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পরপর তিন মেয়াদে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক (২০০৯-২০১৮) ছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন অধ্যাপক (১৯৯৯-২০০০) এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক (২০১৮-২০২১) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি। সবশেষে অলঙ্কৃত করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি পদ। এসব দায়িত্ব পালনকালে স্বীয় কর্মনিষ্ঠা, দক্ষতা, মেধা-মনন ও কর্তব্যপরায়ণতা দ্বারা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন।

তিন.

শামসুজ্জামান খানের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- প্রবন্ধ-গবেষণা-স্মৃতি : নানা প্রসঙ্গ (১৯৮৩), গণসঙ্গীত (যৌথ, ১৯৮৫), মাটি থেকে মহীরুহ (১৯৯৪), বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা (১৯৯৫), আধুনিক ফোকলোর চিন্তা (২০০১), মীর মশাররফ হোসেন : নতুন তথ্যে নতুন ভাষ্যে (২০০৪), ফোকলোর চর্চা (২০০৬), নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০৯), বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও বর্তমান বাংলাদেশ (২০০৯), দিনলিপি (২০১০), মুক্তবুদ্ধি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমকাল (২০১০), কালের ধুলোয় স্বর্ণরেণু (২০১০), তর্ক-তদন্তে পাওয়া রবীন্দ্রনাথ (২০১২), বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্র : পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (২০১২), জাদুঘর ও অবস্তুগত উত্তরাধিকার (২০১৩), বাংলাদেশের উৎসব (২০১৩), সাম্প্রতিক ফোকলোর ভাবনা (২০১৩), রাষ্ট্র ধর্ম ও সংস্কৃতি (২০১৫), বাংলার গণসংগীত (২০১৫), বাঙালির বহুত্ববাদী ফোকলোর মনীষা (২০১৬), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০১৭), শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা (২০১৮), লেখক বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য (২০১৯), সংস্কৃতি রাজনীতি ও নব-বাস্তবতা (২০২১), সৃজনভুবনের আলোকিত মানুষেরা, বাংলাদেশ : সংস্কৃতির সন্ধানে, বর্ধমান হাউসে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, মুক্তবুদ্ধি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমকাল, সাম্প্রতিক ফোকলোর ভাবনা, দূর-দূরান্তরে : রাশিয়া ও জাপান ভ্রমণ, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষাণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ প্রভৃতি; রম্য-রচনা : ঢাকাই রঙ্গরসিকতা (২০০১), গ্রামবাংলার রঙ্গরসিকতা (২০০৪), গ্রামবাংলার রঙ্গগল্প (২০০৪), রঙ্গরসের গল্পসমগ্র (২০১২) প্রভৃতি; শিশুসাহিত্য : দুনিয়া মাতানো বিশ্বকাপ (১৯৮৭), দৈত্য ও নাপিতের গল্প (২০১০), কালো মানিকের গল্প ও অন্যান্য (২০১৪), কোলা ব্যাঙ যাবে হিমালয় চূড়ায় (২০১২), লোভী ব্রাহ্মণ ও তেনালিরাম (২০০৯), মেঘমল্লার (২০১০, সম্পাদিত কিশোর রূপকথার গল্প সংকলন), সূর্যমুখী (২০১১, সম্পাদিত কিশোর গল্প সংকলন); জীবনী : মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী (১৯৮৫); সম্পাদিত গ্রন্থ : আফ্রিকার কবিতা : লিউপোল্ড সেংঘর (১৯৭৭), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ স্মারকগ্রন্থ (যৌথ, ১৯৮৫), ছোটদের অভিধান (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৮৫), চরিতাভিধান (যৌথ, ১৯৮৫), বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য (১৯৮৬), Bibliography on Folklore of Bangladsh (যৌথ, ১৯৮৭) একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৮৯), Folklore of Bangladesh (Vol. 1 1987, Vol 2 1989), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯২), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯৩), বাংলাদেশের লোকসংগীত সমীক্ষা : কেন্দুয়া অঞ্চল (১৯৯৩), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯৪), বাংলা সন ও তার ঐতিহ্য (১৯৯৪), চন্দ্রকুমার দে অগ্রন্থিত রচনা (১ম খণ্ড ১৯৯৪, ২য় খণ্ড ১৯৯৫), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯৫) সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান (যৌথ, ১৯৯৬), ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা (যৌথ, ১৯৯২), কবি মঈনুদ্দীন স্মারকগ্রন্থ (২০০০), মুক্তিযুদ্ধের গল্প-১ (যৌথ সম্পাদনা, ২০০৯), মুক্তিযুদ্ধের গল্প-২ (২০০৯), সুবর্ণরেখার আলপনা : আবুল আহসান চৌধুরী সংবর্ধনাগ্রন্থ (যৌথ, ২০০৩), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী : আত্মজীবনী (২০০৪), Festivals of Bangladesh (যৌথ, ২০০৫), বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য (১ম খণ্ড ২০০৬), বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য (২য় খণ্ড ২০০৮), বাংলাদেশ : সংস্কৃতির সন্ধানে (২০০৮), শামসুর রহমান স্মারক গ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা ২০১০), ক্লদ লেভিস্ত্রোস : বিভিন্ন পাঠ (২০১১), খান সারওয়ার মুরশিদ সংবর্ধনাগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ২০১২), মোহাম্মদ সাইদুর স্মারক গ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা ২০১২), Dhaka-Capital of Islamic Culture in the Asian Region for 2012 Album (†hŠ_ m¤úv`bv, 2012), Cultural diversity in Asia-Pacific Region Album (যৌথ সম্পাদনা, ২০১২), সাম্প্রতিক দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ (২০১৩), বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস (যৌথ সম্পাদনা ২০১৩), অভিবাদন শহীদ কাদরী (২০১৬), বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাসণ : একটি গোলটেবিল আলোচনা (২০১৬), বঙ্গবন্ধু : নানা রঙে নানা রেখায় (২০১৯), দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার রচনাসমগ্র (অখণ্ড) প্রভৃতি। তিনি কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। জিজ্ঞাসা ও জবাব (২০১২) এবং কথায় কথায় (২০১৬) নামে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাক্ষাৎকার। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক অভিধান, ৬৪ খণ্ডে বাংলাদেশের লোকজ-সংস্কৃতি-গ্রন্থমালা এবং ১১৪ খণ্ডে ফোকলোর সংগ্র গ্রন্থমালা সম্পাদনা ও প্রকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচনাবলি তিনখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক অনেক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা এবং কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার এবং একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

শামসুজ্জামান খান

এক খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তক

এম আবদুল আলীম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিচ্ছেন শামসুজ্জামান খান। পাশে বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানা

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১

শামসুজ্জামান খান ধীমান গবেষক-প্রাবন্ধিক। ছয় দশকের অধিক সময় বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শেকড়ের সন্ধান করেছেন। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। চেতনার মর্মমূলে গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। একই সঙ্গে ছিলেন মুক্তমনা, প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক। বিজ্ঞানমনষ্ক ও উদ্ভাবনাময় এই চিন্তাবিদ বিচিত্র বিষয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। ফোকলোর, বাংলা সন, রসরচনা, শিশুসাহিত্য, জীবনী, ক্রীড়া, ভ্রমণকাহিনি, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে গভীর অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসমূহে। চর্বিত-চর্বণ নয়; সম্পূর্ণ নতুন পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি এবং যুক্তিশীল বিশ্লেষণ দ্বারা সবকিছু মূল্যায়ন করেছেন। জ্ঞানবিশে^র সর্বসাম্প্রতিক তথ্য-তত্ত্বের যৌগিক পাঠের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রজীবনকে। বাংলার ফোকলোরবিদ্যার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর গভীর অনুধ্যান লক্ষ করা যায়। এ দেশের ফোকলোর-সাধনার সনাতন কাঠামো ভেঙে একে সম্পৃক্ত করেছেন আধুনিক বিশ্ব-ফোকলোরধারার সঙ্গে।

শামসুজ্জামান খানের আবির্ভাবের কাল ছিলো ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ছয়চল্লিশের দাঙ্গা, সাতচল্লিশের দেশভাগ এসব ঘটনা-দুর্ঘটনায় তাঁর শৈশবের কাল ছিলো অস্থির, যা তাঁর শিশুমনে প্রভাব ফেলে। ঐ সময় তিনি কাটিয়েছেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার চারিগ্রামের নির্মল প্রকৃতির বুকে।

শামসুজ্জামান খান পারিবারিকভাবে পেয়েছিলেন শিক্ষা-সংস্কৃতির বিশাল উত্তরাধিকার। উনিশ শতকের রেনেসাঁসের আলো ঠিকরে পড়া এক প্রাগ্রসর পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রপিতামহ এলাহদাদ খান (১৮৩৪-১৮৯৭) ছিলেন মীর মশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যিনি ফরিদপুরের ডেপুটি স্কুল ইন্সপেক্টর থাকাকালে সম্পাদনা করেছিলেন ‘ফরিদপুর দর্পণ’ নামক পাক্ষিক পত্রিকা। শুধু তাই নয়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা ভগবান চন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলা স্কুল। প্রপিতামহের ভাই আদালত খান (১৮৪৪-১৯৯৪) ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একমাত্র বাঙালি মুসলমান মুন্সি অধ্যাপক। তিনি বহুভাষী পণ্ডিত ছিলেন; তুলসী দাসের ‘রামায়ণ’ এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’র ইংরেজি অনুবাদ করেন।

বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, তাকে তিনি সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে

বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, তাকে তিনি সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে বাংলা শিক্ষক এ এইচ আনিসুর রহমানের প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল অসামান্য। ঐ শিক্ষক নিজে কবিতা লিখতেন এবং শামসুজ্জামানকে নানাভাবে উৎসাহ দিতেন। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্য তিনি প্রথম দেখেছিলেন ঐ শিক্ষকের হাতে। চারিগ্রাম শাহাদত আলী হাইস্কুলে ভর্তি হয়েই ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার মুকুলের মাহফিলের সদস্য হন এবং গল্প-কবিতা মকশো শুরু করেন। এই স্কুলের বাংলার শিক্ষক খলিলুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী রোকাইয়া সুলতানা এবং প্রধান শিক্ষক ফজলুল করিম, উর্দু শিক্ষক আবুল হাসনাত ও উর্দু মৌলভি মুহম্মদ ওমরের উৎসাহ-প্রেরণায় সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। ঐ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখের লেখা অনেক বই পড়েন। শিক্ষকগণ অবসর পেলেই সিলেবাসের বাইরের নানা বিষয়ে জ্ঞান দিতেন। সাহিত্য ও রাজনীতির নানা বিষয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন। ঐ সময় শামসুজ্জামান খান ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’ এবং ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ প্রভৃতি পত্রিকা নিয়মিত পড়তেন। বাংলার শিক্ষক খলিলুর রহমান তাঁকে দায়িত্ব দেন ‘পূর্বাভাষ’ নামক হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনার। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয় সাহিত্য-সংস্কৃতির অবারিত ভুবন। এখানে এসে সান্নিধ্য লাভ করেন অনেক গুণী শিক্ষকের। বেশি প্রভাবিত হন অজিতকুমার গুহ, হাসান হাফিজুর রহমান, শৈলেন ভদ্র এবং আবদুল মতিনের দ্বারা। উপাধ্যক্ষ রেবতিমোহন চক্রবর্তীর দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হন। অজিত কুমার গুহের অনুপম বক্তৃতাশৈলী, হাসান হাফিজুর রহমানের জলদ-গম্ভীর আবৃত্তি এবং শৈলেন ভদ্রের পাঠদানের নাটকীয় ও নান্দনিক ভঙ্গি তাঁকে আপ্লুত ও চমৎকৃত করে। এসব শিক্ষকের প্রভাব তাঁর জীবনে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এমন এক ঝাঁক জ্যোতির্ময় শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেন, যাঁরা তাঁকে দিয়েছিলেন মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রেয়বোধের দীক্ষা। এই শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান সারওয়ার মুরশিদ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, এ কে নাজমুল করিম, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, গিয়াসউদ্দিন প্রমুখ। এঁদের দীক্ষায় শামসুজ্জামান হয়ে ওঠেন নবযুগের অভিযাত্রী।

পাকিস্তান আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হলেও হাইস্কুলের পড়ার সময়ই সে মোহ কেটে যায়। এই মোহভঙ্গে কাজ করেছিলো বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম শহিদ রফিকউদ্দিন আহমদের বাড়ি ছিলো শামসুজ্জামান খানের জন্মস্থান চারিগ্রামের পাশর্^বর্তী পারিলে। রফিকউদ্দিনের শহিদ হওয়ার খবর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং এলাকার সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই তুঙ্গ মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে শামসুজ্জামান খান লিখেছেন : ‘১৯৫২ সালে আমি চারিগ্রাম শাহাদৎ আলী খান হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ছাত্র-হত্যার সংবাদে আমরা বিক্ষুব্ধ হই। মিছিল করি, বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলি থানার বিভিন্ন গ্রামে। রফিকের মৃত্যুতে গোটা এলাকা উত্তাল হয়ে ওঠে।’ ভাষা-আন্দোলন পূর্ববঙ্গের মানুষের চেতনায় জন্ম দেয় ধর্মীয় ভাবধারার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ। এই চেতনা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে শামসুজ্জামান খানের কিশোরমনকে, যা ক্রমে বিকশিত হয়ে স্থায়ী রূপ লাভ করে তাঁর চেতনা-মননের জগতে। রফিকউদ্দিনের শহিদ হওয়ার ঘটনা তাঁর মনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিলো যে, শামসুজ্জামান খান ১৯৫৭ সালে ‘লাল শার্ট’ নামে একটি গল্প লেখেন, যার উপজীব্য ছিলেন ভাষাশহিদ রফিকউদ্দিন। গল্পের বিষয় ছিলো রফিকউদ্দিনের বিয়ে উপলক্ষ্যে তাঁর ছোট ভাইয়ের লাল শার্টের আবদার; যে শার্ট আসেনি, এসেছিল শহিদ রফিকের রক্তভেজা শার্ট। গল্পটি ‘দৈনিক আজাদ’-এর মুকুলের মাহফিলে প্রকাশিত হয়। এরপর আর থামতে হয়নি তাঁকে। একে একে রচনা ও সম্পাদনা করেন শতাধিক গ্রন্থ।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শামসুজ্জামান খান পাকিস্তানি শাসকদের শাসন-শোষণ আর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বাধিকার-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। প্রথমে বামপন্থায় দীক্ষা নিলেও পড়ে যুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। সিরাজুল আলম খান এবং শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঢাকা হল ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে তিনি ভিপি প্রার্থী ছিলেন। সেটা ১৯৬১ সালের কথা। ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কাউন্সিলে তিনি ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। পরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সড়ে আসেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্তদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সেরা সাংস্কৃতিক সংগঠক। স্বীয় মেধা-মননের পরিশীলনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির সাধনায় তিনি পরিণত হন একজন খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তকে। লেখায়, কর্মে এবং চিন্তায় সারাজীবন এই আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, উদার মানবতাবাদ, ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং কুসংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত আধুনিক ভাবধারা শিরোধার্য করে পথ চলেছেন। বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি যখন সঙ্কটাপন্ন তখন তিনি সেগুলোর অন্বেষণ-অনুসন্ধিৎসা এবং সংরক্ষণে ব্রতী হয়েছেন। বাঙালির চিরকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা-আন্দোলন, স্বাধিকার-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ বিবিধ বিষয়ে লেখনী সঞ্চালন করেছেন।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালি সংস্কৃতির যে অভিযাত্রা তার ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত রূপায়ন ঘটেছে তাঁর গ্রন্থগুলোতে। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং গৌরবের যাঁরা ধারক-বাহক তাঁদের জীবন ও কর্ম তিনি নবমূল্যায়ন করেছেন। এক্ষেত্রে কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, দার্শনিক সকলেই তাঁর অনুসন্ধিৎসার বিষয় হয়েছে। মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের রাজনৈতিক দর্শন এবং চিন্তাকর্ম কীভাবে বাঙালির জাতীয়তাবোধ পরিপুষ্ট করেছে, তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় পাওয়া যায়। বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষাকেও তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। তাঁর গ্রন্থগুলোর উৎসর্গপত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক এবং লালনকারীদের স্থান দিয়েছেন। কবি আবদুল হাকিম, লালন ফকির, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, এস ওয়াজেদ আলী, মুহম্মদ এনামুল হক, অজিত গুহ, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, মযহারুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আহমদ শরীফ, মমতাজুর রহমান তরফদার, হায়াৎ মামুদ, কবীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ প্রমুখকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে তিনি বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে রাজনীতির গতিধারার দিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান রূপকার। মওলানা ভাসানীকে বলেছেন, গণমানুষের বিপ্লবী কণ্ঠস্বর। বাঙালি দীর্ঘকালের গৌরব, শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস পর্যালোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দুই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ বলে অভিহিত করেছেন। বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষার স্পর্শে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা কীভাবে শাণিত হয়েছে, তার বয়ানও তিনি তুলে ধরেছেন। লালন শাহ, হাসন রাজা, গুরুসদয় দত্ত চন্দ্রকুমা দে, জসীম উদ্দীন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শাহ আবদুল করিম, তোফায়েল আহমদ, আবদুল লতিফ, মযহারুল ইসলাম, বিনয় বাঁশি জরদাস, মোহাম্মদ সাইদুর প্রমুখের সাধনাকে তিনি নানামাত্রিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে করেছেন এবং তাঁদের বাঙালি সত্তার স্বরূপ নির্ণয় করেছেন। বাঙালির চিরায়ত উৎসব-পার্বণ কীভাবে যুগ যুগ ধরে এই জাতিকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে তারও বয়ান অনেক প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। গভীর দেশপ্রেম থেকেই শামসুজ্জামান খান বাঙালির যুগযুগান্তরের লোকচৈতন্যের গভীরতম পরিচয় ও বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষার স্বরূপ-সন্ধান করেছেন।

বাঙালির জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, তাকে তিনি সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ধর্মের নামে হানাহানি দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। বাংলার জাগরণে লোকায়ত ধর্ম এবং লোকজ সংস্কৃতির ভূমিকাকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। বাঙালির জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূল হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে। এও বলেছেন, ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সুদৃঢ় করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনেতিক শোষণ-বঞ্চনা। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্যই বাঙালি শেষপর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে চূড়ান্ত লড়াইয়ে এবং কঠিন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীন বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ঝাণ্ডা হাতে আজীবন পথ চলেছেন শামসুজ্জামান খান।

আজীবন তিনি যে লোকজীবনের সংস্পর্শে থেকে লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির সাধনা করেছেন, শহরের কোলাহল থেকে দূরে সেই নিভৃত লোকালয় চারিগ্রামেই তিনি অনন্ত শয্যা গ্রহণ করেছেন। তিনি চিরঘুমে শায়িত হলেও সদা জাগরূক থাকবে তাঁর চিন্তা ও কর্ম। সেগুলো বাঙালিত্বের দীপ্ত শপথে জাতিকে পথ দেখাবে এবং যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখবে।

স্বীয় মেধা-মননের পরিশীলনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির সাধনায় তিনি পরিণত হন একজন খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তকে। লেখায়, কর্মে এবং চিন্তায় সারাজীবন এই আদর্শে অবিচল থেকেছেন

দুই.

শামসুজ্জামান খানের শিক্ষাজীবন শুরু নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ গ্রহণ করেন চারিগ্রামের শাহাদত আলী খান হাইস্কুলে। এখান থেকে ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যৌবনের স্বপ্নভরা দিনগুলো অতিবাহিত করেন দুঃশাসন-কবলিত পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায়। ঐ সময় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাগ্রহণ করেন জগন্নাথ কলেজ থেকে। ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ১৯৬২ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনের প্রথম পর্যায় কাটে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ (১৯৬৪), জগন্নাথ কলেজ (১৯৬৪-১৯৬৮), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৮-১৯৭৩) অধ্যাপনা করে। পরে থিতু হন বাংলা একাডেমিতে। এখানে উপ-পরিচালক (১৯৭৩-১৯৮১) এবং পরিচালক (১৯৮১-১৯৯৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (১৯৯৬-১৯৯৭) এবং জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক (১৯৯৭-২০০১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পরপর তিন মেয়াদে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক (২০০৯-২০১৮) ছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন অধ্যাপক (১৯৯৯-২০০০) এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক (২০১৮-২০২১) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি। সবশেষে অলঙ্কৃত করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি পদ। এসব দায়িত্ব পালনকালে স্বীয় কর্মনিষ্ঠা, দক্ষতা, মেধা-মনন ও কর্তব্যপরায়ণতা দ্বারা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন।

তিন.

শামসুজ্জামান খানের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- প্রবন্ধ-গবেষণা-স্মৃতি : নানা প্রসঙ্গ (১৯৮৩), গণসঙ্গীত (যৌথ, ১৯৮৫), মাটি থেকে মহীরুহ (১৯৯৪), বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা (১৯৯৫), আধুনিক ফোকলোর চিন্তা (২০০১), মীর মশাররফ হোসেন : নতুন তথ্যে নতুন ভাষ্যে (২০০৪), ফোকলোর চর্চা (২০০৬), নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০৯), বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও বর্তমান বাংলাদেশ (২০০৯), দিনলিপি (২০১০), মুক্তবুদ্ধি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমকাল (২০১০), কালের ধুলোয় স্বর্ণরেণু (২০১০), তর্ক-তদন্তে পাওয়া রবীন্দ্রনাথ (২০১২), বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্র : পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (২০১২), জাদুঘর ও অবস্তুগত উত্তরাধিকার (২০১৩), বাংলাদেশের উৎসব (২০১৩), সাম্প্রতিক ফোকলোর ভাবনা (২০১৩), রাষ্ট্র ধর্ম ও সংস্কৃতি (২০১৫), বাংলার গণসংগীত (২০১৫), বাঙালির বহুত্ববাদী ফোকলোর মনীষা (২০১৬), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০১৭), শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা (২০১৮), লেখক বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য (২০১৯), সংস্কৃতি রাজনীতি ও নব-বাস্তবতা (২০২১), সৃজনভুবনের আলোকিত মানুষেরা, বাংলাদেশ : সংস্কৃতির সন্ধানে, বর্ধমান হাউসে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, মুক্তবুদ্ধি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমকাল, সাম্প্রতিক ফোকলোর ভাবনা, দূর-দূরান্তরে : রাশিয়া ও জাপান ভ্রমণ, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষাণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ প্রভৃতি; রম্য-রচনা : ঢাকাই রঙ্গরসিকতা (২০০১), গ্রামবাংলার রঙ্গরসিকতা (২০০৪), গ্রামবাংলার রঙ্গগল্প (২০০৪), রঙ্গরসের গল্পসমগ্র (২০১২) প্রভৃতি; শিশুসাহিত্য : দুনিয়া মাতানো বিশ্বকাপ (১৯৮৭), দৈত্য ও নাপিতের গল্প (২০১০), কালো মানিকের গল্প ও অন্যান্য (২০১৪), কোলা ব্যাঙ যাবে হিমালয় চূড়ায় (২০১২), লোভী ব্রাহ্মণ ও তেনালিরাম (২০০৯), মেঘমল্লার (২০১০, সম্পাদিত কিশোর রূপকথার গল্প সংকলন), সূর্যমুখী (২০১১, সম্পাদিত কিশোর গল্প সংকলন); জীবনী : মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী (১৯৮৫); সম্পাদিত গ্রন্থ : আফ্রিকার কবিতা : লিউপোল্ড সেংঘর (১৯৭৭), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ স্মারকগ্রন্থ (যৌথ, ১৯৮৫), ছোটদের অভিধান (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৮৫), চরিতাভিধান (যৌথ, ১৯৮৫), বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য (১৯৮৬), Bibliography on Folklore of Bangladsh (যৌথ, ১৯৮৭) একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৮৯), Folklore of Bangladesh (Vol. 1 1987, Vol 2 1989), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯২), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯৩), বাংলাদেশের লোকসংগীত সমীক্ষা : কেন্দুয়া অঞ্চল (১৯৯৩), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯৪), বাংলা সন ও তার ঐতিহ্য (১৯৯৪), চন্দ্রকুমার দে অগ্রন্থিত রচনা (১ম খণ্ড ১৯৯৪, ২য় খণ্ড ১৯৯৫), একুশের স্মারকগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ১৯৯৫) সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান (যৌথ, ১৯৯৬), ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা (যৌথ, ১৯৯২), কবি মঈনুদ্দীন স্মারকগ্রন্থ (২০০০), মুক্তিযুদ্ধের গল্প-১ (যৌথ সম্পাদনা, ২০০৯), মুক্তিযুদ্ধের গল্প-২ (২০০৯), সুবর্ণরেখার আলপনা : আবুল আহসান চৌধুরী সংবর্ধনাগ্রন্থ (যৌথ, ২০০৩), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী : আত্মজীবনী (২০০৪), Festivals of Bangladesh (যৌথ, ২০০৫), বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য (১ম খণ্ড ২০০৬), বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য (২য় খণ্ড ২০০৮), বাংলাদেশ : সংস্কৃতির সন্ধানে (২০০৮), শামসুর রহমান স্মারক গ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা ২০১০), ক্লদ লেভিস্ত্রোস : বিভিন্ন পাঠ (২০১১), খান সারওয়ার মুরশিদ সংবর্ধনাগ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা, ২০১২), মোহাম্মদ সাইদুর স্মারক গ্রন্থ (যৌথ সম্পাদনা ২০১২), Dhaka-Capital of Islamic Culture in the Asian Region for 2012 Album (†hŠ_ m¤úv`bv, 2012), Cultural diversity in Asia-Pacific Region Album (যৌথ সম্পাদনা, ২০১২), সাম্প্রতিক দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ (২০১৩), বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস (যৌথ সম্পাদনা ২০১৩), অভিবাদন শহীদ কাদরী (২০১৬), বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাসণ : একটি গোলটেবিল আলোচনা (২০১৬), বঙ্গবন্ধু : নানা রঙে নানা রেখায় (২০১৯), দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার রচনাসমগ্র (অখণ্ড) প্রভৃতি। তিনি কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। জিজ্ঞাসা ও জবাব (২০১২) এবং কথায় কথায় (২০১৬) নামে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাক্ষাৎকার। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক অভিধান, ৬৪ খণ্ডে বাংলাদেশের লোকজ-সংস্কৃতি-গ্রন্থমালা এবং ১১৪ খণ্ডে ফোকলোর সংগ্র গ্রন্থমালা সম্পাদনা ও প্রকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচনাবলি তিনখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক অনেক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা এবং কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার এবং একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।

back to top