ধারাবাহিক উপন্যাস : এক
আবুল কাসেম
এক.
কিয়োটোর টেরামাচি লেন। এখানে একটি বাড়িতে মুরাসাকি শিকিবুরা থাকে। মুরাসাকি শিকিবু বলে আমরা যাকে জানি তার আসল নাম ফুজিওয়ারা নো তাকাকু। তার লেখা গেঞ্জি মনোগাতারি উপন্যাসের চরিত্র মুরাসাকির নাম অবলম্বনে পরবর্তীতে তার নাম হয়ে যায় মুরাসাকি। নামের দ্বিতীয় অংশ শিকিবুটা এসেছে বাবার কর্মস্থল উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের নাম অনুসারে। বাবা ফুজিওয়ারা নো তামেতোকি সম্রাটের দরবারে উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান। বাবা তাকে তাকাকু নামে ডাকেন।
হেইয়ান সাম্রাজ্যে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা আলাদাভাবে থাকার নিয়ম রয়েছে। এ নিয়মে সন্তানেরা মায়ের সঙ্গে এবং মায়ের অবর্তমানে নানার বাড়িতে থাকে। উত্তরের ফুজিওয়ারা অভিজাত গোত্রে মুরাসাকির মায়ের জন্ম। মা সম্প্রতি মারা গেছেন। তবে তার আগেই প্রচলিত নিয়মনীতি ভঙ্গ করে তাকাকু তার বাবার কাছে চলে আসে।
বাবার কাছে ছোটভাই নোবুনোরি আছে একই নিয়ম ভঙ্গ করে। কারণ বাবা তাকে সঙ্গে রেখে সম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উচ্চাভিলাষী হর্তাকর্তা হবার শিক্ষা দেবেন। এই শিক্ষার প্রথম পাঠ হচ্ছে চায়নিজ ক্লাসিক্যাল ভাষা শিক্ষা। এটি হেইয়ান সম্রাটের দরবারের (রাজকীয়) ভাষা; যা শুধু ছেলেরাই শিখতে পারে মেয়েরা নয়।
একজন গৃহশিক্ষক নোবুনোরিকে বাড়িতে চায়নিজ ক্লাসিক শিক্ষা দিতে আসেন। ছেলেটার মাথায় গোবর। তার ভাষা শিক্ষা তাই প্রত্যাশিত মাত্রায় এগোচ্ছে না। বাবা হতাশ। এই ছেলেকে ঘিরে তার রাজ্যের স্বপ্ন। একদিন বড় হয়ে সে দরবারি আভিজাত্যের সুউচ্চ শিখরে উঠবে, সম্রাটের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবে- এই তার আশা।
এরকম আশা-প্রত্যাশা ও স্বপ্ন দেখার বাস্তব কিছু কারণ আছে। উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগে চাকরি তার। সম্রাটের দরবারের অমাত্য-আমলা কর্মকর্তাদের চোট-পাটে তাকে তটস্থ থাকতে হয়। তাদের বিলাসী আর জাঁকজকমপূর্ণ জীবন। পদবিবেচনায় আত্মসচেতন। পান থেকে চুন খসলেই সমস্যা। তাই তাদের মন রক্ষা করে চলাই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
অথচ গত শতাব্দী থেকে তাদের অভিজাত ফুজিওয়ারা গোত্রের লোকজনই সম্রাটের দরবারে মন্ত্রিপরিষদ ও অমাত্য হিসেবে দরবারকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। এমনকি অন্তঃপুরের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। সম্রাটের ঘরে-বাইরে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব প্রতিপত্তি তাদেরই। ফুজিওয়ারা ললনারা হয়ে আসছেন সম্রাটদের সম্রাজ্ঞী। এক মিচিনাগাই তার চার কন্যাকে সম্রাটদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সম্রাটদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছেন।
মুরাসাকি শিকিবুর প্রপিতামহ ফুজিওয়ারা নো কানেসুকে সম্রাটের দরবারে প্রভাব প্রতিপত্তি এবং অভিজাত্যের চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি শুধু সম্রাটের দরবারে অমাত্য হিসেবেই নয়, কবি এবং সাহিত্যামোদী হিসেবেও সম্মানজনক স্থান লাভ করেছিলেন। তার তেরটি কবিতা অভিজাত কবিদের একুশতম রাজকীয় সংকলনে জায়গা করে নিয়েছে। ছয়ত্রিশজন বিখ্যাত কবির কবিতা রয়েছে তাতে। তখনকার বিখ্যাত জনপ্রিয় কবি কি নো সুরেইয়োকি তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন।
মুরাসাকি শিকিবুর পিতামহ কবিতা লিখে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেলেন। তবে রাজকীয় প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তার সময় থেকে ভাটা পড়তে শুরু করে। তিনি আমলা বা অমাত্য সুখের চাইতে কবিতার সুখ বেশি পছন্দ করতেন। এজন্য রাজকীয় প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এ সূত্রেই তার সঙ্গে তাদের পরবর্তী প্রজন্মও সম্রাট দরবারের কেন্দ্রীয় ক্ষমতাবলয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
শিকিবুর বাবা তামেতোকির কবিতা লেখার ঝোঁক আছে। অভিজাত কবিদের সংকলনে তার কবিতা স্থান পেয়েছে। চীনা ধ্রুপদী সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতায় তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য। রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির তিনি সম্মানিত সদস্য। এসবের পরও সম্রাটের অমাত্য নন বলে মনে বেশ কষ্ট। সেই কষ্ট থেকেই ছেলেকে দিয়ে স্বপ্ন দেখা। ছেলেটা মেধাবী নয় বলে যত দুঃখ।
তামেতোকি সেদিন বিকেলবেলা একা একা কবিতা পড়ছিলেন। গৃহশিক্ষক ছেলেকে চীনা ভাষা শেখাচ্ছেন। পাঠ গ্রহণের সময় দেখা গেল ছেলেটি পাড়ছে না। শিকিবু আড়াল থেকে বলে দিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। কোথাও আটকালো না পর্যন্ত।
বাবা এবং গৃহশিক্ষক খুব অবাক হলেন। বাবা বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার। কীভাবে শিখলে তুমি?
বাবা আমি ওদের মুখে শুনে শুনে শিখে ফেলেছি।
তার মানে তুমি চীনাটা জানো।
আড়াল থেকে শুধু হাসির শব্দটাই শোনা গেল।
তুমি যদি আমার ছেলে হতে আমার কোনো দুঃখই থাকত না। কিছুক্ষণ পর বাবা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললেন, তুমি এই ভাষাটা জানো, তা বাইরে জানাবার দরকার নেই। এটা শুধুই সম্রাটের দরবারে অমাত্যদের ভাষা, নারীদের নয়।
রাজভাষা নারীরা জানবে না বাবা?
তোমার এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই।
ফুজিওয়ারা নারী হলেও নয়?
না, নয়। বলে আরেকবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন বাবা।
গৃহশিক্ষক বললেন, কারণটাও তার জানা থাকা দরকার, তামেতোকি সান।
আপনিই বলুন।
নারীরা কর্মে অসমর্থ এবং বুদ্ধিতে অপরিপক্ব- তাই।
বাবা তামেতোকি বললেন, তাকাকুকে দেখে তা মনে হয় না। তাকাকু বলল, গৃহশিক্ষকের কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি একদিন সত্যিই প্রমাণ করব, মেয়েদের দ্বারা এমন কর্মও সম্ভব, যা পুরুষের দ্বারা সম্ভব হয় না।
বাবা বললেন, এখন তুমি গৃহাভ্যন্তরে যাও। তুমি বড় হয়ে যাচ্ছো।
অভিজাত হেইয়ান ভদ্র মহিলাদের জন্য এই এক সমস্যা, তাদের জনবিচ্ছিন্নভাবে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে হয়। বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে শুধু পরিবারের সদস্য এবং নিকটাত্মীয়দের সঙ্গেই কথা বলা সম্ভব। শিকিবু পুরুষ বলতে বাবা এবং ভাইয়ের সঙ্গেই শুধু কথা বলতে পারে। অন্য কারো সঙ্গে নয়। তার সমপর্যায়ের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে বাধা নেই।
সময় কাটাবার জন্য বাল্যকাল থেকে কবিতা আর মনোগাতারি পাঠে মনোযোগী হতে হয় তাকে। প্রপিতামহ-পিতামহ এবং পিতার লেখা কবিতা, কবিতা সংকলন যাতে আছে অন্য কবিদেরও কবিতা এবং প্রপিতামহের লেখা ‘ইয়ামাতো মনোগাতারি’ পড়ে সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা জন্মে তার। মাঝে-মধ্যে সেই কবিতা এবং মনোগাতারি পাঠ করে উচ্ছ্বাসপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং তা ছোটভাই ও মাঝেমধ্যে বাবার কাছে প্রকাশ করে।
একদিন নিজেই একটা কবিতা লিখে ফেলে। কিন্তু কাকে শোনাবে সে। বাবা কবি। সংকোচের মাথা খেয়ে কিছুদিন পর বাবাকেই শুনিয়ে দিল।
বাবা মৃদু হাসলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। বাবার কাছে জাপানের অনেকের লেখা কবিতার সংকলন, মনোগাতারি এবং ডায়েরির কপি রয়েছে। তিনি তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং রাজকীয় সাহিত্য-আকাদেমি থেকে পাণ্ডুলিপি এনে মেয়ের হাতে দেন। এসব পাণ্ডুলিপির মধ্যে চায়না ভাষার উঁচুদরের সাহিত্যও রয়েছে।
শিকিবু যেন দুনিয়ার সকল ধনরত্ন হাতে পেয়ে গেছে, তেমনি উচ্ছ্বাস তার। জাপানের অভিজাত সমাজে সাহিত্যজ্ঞান, সাহিত্যচর্চা এবং কাব্যচর্চার সম্মান অনেক উচ্চপর্যায়ের। কানা তাদের নিজস্ব লেখ্য ভাষা। নারী কবি লেখকদের জন্য নির্ধারিত, পুরুষ কবি-লেখকেরা কানা চায়না উভয় ভাষাই ব্যবহার করতে পারে।
কিয়োটোর টেরামাচি লেনে অভিজাত ফুজিওয়ারাদের বাস। জীবনযাপনের জৌলুস এবং চাকচিক্য এখানে প্রবল। তাদের মধ্যে বিলাসিতা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতাও আছে। এ প্রতিযোগিতার চিত্রটা টেরামাচি থেকে সম্রাটের প্রাসাদ বা দরবার পর্যন্ত বিস্তৃত। হেইয়ান সাম্রাজ্য ঐশ্বর্য আর আভিজাত্যে ভরপুর। কিয়োটো তার রাজধানী।
এ ঐশ্বর্যের মধ্যে বড় হচ্ছে শিকিবুরা। তার বাবার চাকরি শুরু সম্রাট প্রাসাদে, উৎসবের আলোক সাজসজ্জা বিভাগে। হেইয়ান সম্রাটদের প্রাসাদে সারা বৎসরই নানা উৎসব লেগে থাকে। তাই বিভাগটা গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে রাজ-কর্মচারীদের ভালো পদোন্নতি লাভ ঘটে। এরা অনেকেই প্রদেশগুলোয় গভর্নর নিযুক্ত হয়ে যান। টেরামাচি লেনে বেশিরভাগ এদেরই বসবাস। শিকিবু
(১০-এর পৃষ্ঠার পর)
একটা বাড়ির পরেই থাকে ইজোমি শিকিবুরা। তার বাবাও সম্রাটের উৎসব আয়োজন এবং সাজসজ্জা বিভাগে চাকরি করেন। তার নামের শিকিবু অংশও সেখান থেকে পাওয়া। তার বাবা ওয়ে নো মাসামুনের সঙ্গে তাকাকুর বাবার কাজ করার সুবাদে তাদের মধ্যে পরিচিতি এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে। এরা সমবয়সী এবং দুজনেই কবিতা লেখে। ইঝোমি অস্থির এবং চঞ্চল। কিছুটা আত্মঅহংকার আছে। কারণ তার মাতামহ তাইরা নো ইয়াসোহিরা ইতচু প্রদেশের গভর্নর।
আকাঝোমি ইমনরা থাকেন কয়েকটা বাড়ি পরে। তার বাবা তাইরা নো কানেমুরি। মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর মায়ের দ্বিতীয় স্বামী আকাঝোমি তোকিমোচির সংসারে থাকেন। মানুষ জানে যে, তিনি তোকিমোচির মেয়ে। তার নামটাও তোকিমোচির নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা। শান্ত ও সুস্থির প্রকৃতির বুদ্ধিমতি নারী। বয়সে তাকাকু বা মুরাসাকির চাইতে ১৫-২০ বছরের বড়। তিনিও কবি।
পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা এবং কথা বলার সুযোগ না থাকলেও এরা নিজেদের মধ্যে উৎসব অনুষ্ঠানে কথাবার্তা বলে এবং পত্রকবিতা চালাচালি করে। মুরাসাকিদের প্রপিতামহ থেকে কবিতার চর্চা হয়ে আসছে। বনেদি কবি পরিবার হিসেবে একটা সম্মানও আছে। চায়না ধ্রুপদী ভাষা শেখার কারণে বাবার সঙ্গে চায়না-সাহিত্য নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। পরিবেশটা কাব্য বা সাহিত্য চর্চার অনুকূল।
তবে আকাঝোমি ইমন কিংবা ইঝোমি শিকিবুর পরিবারে আগে কেউ কাব্য বা সাহিত্য চর্চা করেনি। সেদিক থেকে সরাসরি শিকিবুর রক্তে রয়েছে কাব্য বা সাহিত্য। তাই আকাঝোমি ইমনের কাছে গুরুত্ব রয়েছে তার।
দুই
ইমনের বিয়ে হয়েছে ওয়ে নো মাসাহিরার সঙ্গে। কিন্তু প্রেমের কবিতা বিনিময় হতো ফুজিওয়ারা নো মিচিতাকার সঙ্গে। তিন বছর কবিতাপত্র বিনিময় এবং লুকিয়ে দেখা সাক্ষাতের পর প্রেমটা ভেঙ্গে গেল। মনে কষ্ট নিয়ে বাবার সাহায্যে মিনামোতো নো মাসানোবুর অধীনে কাজ নিলেন। কাজের মধ্যেই কষ্ট ভুলে থাকা যাবে।
বিয়ের পর স্বাভাবিক হয়ে আসতে সময় লাগলো বটে। তবে স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে নিলেন। স্বামী মাসাহিরা কনফুসিয়াস স্কলার এবং কবি। ওয়াকা এবং কানশি-দু’রকম কবিতাই লেখেন। সবাই তাদের মনে করে ওসিদোরি ফুফু (লাভবার্ডস)।
মুরাসিকির পরিবারও তা জানে। তাই এখানে ইমনের আসা যাওয়া অবারিত। ইমন এখানে আসেন এই পরিবারে তিন পুরুষের কবিখ্যাতির প্রতি শ্রদ্ধাবশত। মুরাসাকিরও পছন্দ তাকে।
আজ এসেছেন একটা আনন্দ গৌরব নিয়ে। মিসিতসুনা নো হাহার কাগেরো নিক্কির পা-ুলিপির কপি সংগ্রহ করতে পেরেছেন।
মুরাসাকি বলল, আমি এর নাম শুনেছি। মিসিত সুনার মাতা বলে পরিচিত। তার নাম তিনি গোপন রেখেছেন।
তুমি ঠিক বলেছ। ডায়েরিটা পড়ে মনে হলো কেন তিনি তার নাম গোপন করেছেন।
কেন?
ডায়েরিটার নাম রেখেছেন ‘উত্তপ্ত ঢেউ’। নিজের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা বলেছেন তাতে। তার স্বামী প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী ফুজিওয়ারা নো কানেই তাকে তো সময় দেননি।
সময় দেননি কেন?
তার বউ আটটি। তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
ছেড়ে চলে আসতে পারতেন।
প্রথা তা অনুমোদন করে না। ক্ষমতাশালী মানুষ স্বামী।
তাই আপন মনে পুড়েছেন। ডায়েরিটি আমি পড়তে চাই আপু। কোন ভাষায় লেখা?
কানা ভাষায়। ওয়াকা কবিতা আছে। মনে হয় তা উত্তাপ ধরে রাখে এবং ছড়ায়। বাকিটা গদ্যের হা-পিত্যেস।
ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
হ্যাঁ, অদ্ভুতই। তবে তোমার বয়সে তা পড়া উচিত কিনা ভাবছি।
কী মনে হয় আপনার?
পড়তে পার এক শর্তে।
কী শর্ত?
এসব যন্ত্রণা মনে পুষে রাখবে না এবং পরিবারের বাইরে কাউকে বলবে না এ ডায়েরির কথা।
ঠিক আছে।
তবে তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল মা।
কেমন?
তিনি সংসার বিরাগী হতে চেয়েছিলেন। প্যাগোডা এবং ধর্মীয়ভাবে পুণ্যময় পাহাড়-পর্বতে ঘুরেছেন। পরে মত বদলালেন। ধর্মীয় বৈরাগ্য ছেড়ে পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসার ধর্মে মনোযোগী হলেন।
সেই ভালো।
শুধু ভালো না। খুবই ভালো। তবে ভদ্রমহিলা ছিলেন বেশ অনুভূতিপ্রবণ। আবেগের মহাপ্লাবন যেন বইয়ে দিয়েছেন পুরো ডায়েরি জুড়ে। যখন তার স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছেন আর তিনি একা, তখন আবেগ যেন বাঁধ মানছে না।
লেখার ধরন কেমন আপু?
নতুন ধরনের। এখানে তার আত্ম-প্রকাশ মনস্তাত্বিক দর্শনের পথে হেঁটেছে। তার বিশ্লেষণ ও মনস্তাত্ত্বিক কঠিন স্বীকারোক্তি দেখে দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। প্রতিকৃতি আঁকার মধ্যে রয়েছে নির্ভেজাল সত্যি। কোথাও কোথাও রয়েছে সহজ স্বীকারোক্তি।
যেমন?
এক জায়গায় লিখেছেন- ‘যে একাকিত্ব, বেদনা এবং দুঃখ আমি নদীপথে ভ্রমণকালে অনুভব করেছি, তার তুলনা হয় না। তিনি নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে, অন্যের দুঃখের কথা ভাববার সময় নেই তার।’
আমি তোমাকে ডায়েরিটি দেব। তার জীবনের কষ্টটা নেয়ার দরকার নেই, রচনা শৈলিটা রপ্ত করার চেষ্টা করো। আমার ভালো লেগেছে, তোমারও লাগবে।
আপনি আজকে আমাকে একটা দারুণ সংবাদ দিলেন। আমি আপনাকে কবিতা লিখে পাঠাব।
তুমি জবাবও পাবে ওয়াকা কবিতায়।
ইমন চলে যাবার পর মুরাসাকি ভাবলো ডায়েরি লেখিকা সম্পর্কে। প্রশ্ন জাগলো মনে, রাজপ্রাসাদের প্রিন্সদের জীবন এমন? তা হলে কি কেউ সুখে নেই? তার বাবাও চাকরি করছেন সম্রাটের প্রাসাদে। মায়ের মৃত্যুর পর অন্য নারীর প্রতি কোনো আসক্তি দেখেনি, বিয়েও করেননি। এটা অবশ্যই বড় বিষয়। সবাইকে একরকম ভাববার দরকার নেই। লেখিকার ভাষাটাই খারাপ। তা হলে সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে?
ইঝোমি শিকিবু কম বয়সেই বেশ বেপরোয়া। চাঞ্চল্যের পাশাপাশি কাউকে হিসেব না করে চলার মানসিকতা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেদের সে এখনই কবিতা পাঠায়।
ইমন উঠে যাবার পরপরই সে মুরাসাকির বাড়িতে এসেছে। মুরাসাকি মনে মনে ভাবলো, যে ভালো সময়টা ইমনের সঙ্গে কেটেছে, তার শোধ নিতে বুঝি ইঝোমির আবির্ভাব।
ইঝোমি মুরাসাকিকে দেখেই বলল, একটা ঘটনা ঘটে গেছে, বুঝলে?
মুরাসাকি চুপ করে আছে। কারণ সে জানে সে কিছু জানতে না চাইলেও রেকর্ডটা বাজতেই থাকবে। ইঝোমি আবার বলল, তোমাকে বলেছিলাম না ছেলেটার কথা, ও আমাকে, আমাকে কাছে পেয়ে ঠিক ঠোঁটের ওপর একটা ইয়ে বসিয়ে দিল।
কী! বিস্ময় মুরাসাকির।
ইঝোমি বলল, এখনো রোমাঞ্চিত আমি। বিশ্বাস করবে না কী অবস্থা আমার। আলোড়নটা যেন থামছেই না। তাই তোমার কাছে ছুটে এলাম।
স্বগতভাবে মুরাসাকি বলল, বড় বাজে অভিজ্ঞতা।
কিছু বললে?
না।
এরকম সবারই হয়, না?
আমি ঠিক জানি না।
তুমি বুদ্ধু একটা। আরে জীবনকে উপভোগ কর।
ইমন আপা এসেছিলেন।
লাভবার্ডসের একজন?
কাগেরো নিক্কির পাণ্ডুলিপির এক খণ্ড পেয়েছেন।
কী হবে ওটা দিয়ে? আমি শুনেছি বেচারি লেখিকা বিলাপ করতে করতে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।
ইঝোমি সম্মান করে কথা বলো।
আমি ভাই কাঁদতে পারব না। মেয়েদের এত অস্ত্র থাকতে (হাত দিয়ে দেখায় ) পরাজিত হবে কেন? আমি নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোয় বিশ্বাসী। শিকারই হবে আমার পেশা।
ইঝোমি তোমার বয়স আমার মতোই।
তুমি ভদ্র, শান্ত- তা-ই থাকো। জাপান বদলে যাচ্ছে তুমি দেখতে পাচ্ছো না।
তুমি বদলে যাচ্ছো, জাপান না। সত্যিকার জাপানকে বদলাতে সহায়তা করছে ইমন আর কাগেরো নিক্কির লেখিকারা।
নিজের নাম পর্যন্ত গোপন করেছেন তিনি। আমি যদি অশ্লীলও কিছু লিখি আমার নামেই লিখব। সে সাহস থাকতে হবে। একটু থেমে আবার বলল, ছেলেটা আমাকে পাগল করে দিল রে। আমি তার কথাও লিখে দেব ওয়াকায়।
কী সর্বনাশ! এটি তুমি কখনো করবে না।
নতুন কিছু লিখেছ? তোমার ছেলেদের কাছে কবিতা পাঠানো উচিত। আমাকে পাঠানো কবিতা পানসে মনে হয়। ছেলেদের পাঠানো কবিতাই উত্তেজনাকর এবং ভারি মজার।
মৃদু হেসে মুরাসাকি বলল, আমার কাছে প্রেরিত তোমার কবিতা কৌতুকাবিষ্ট মনে হয়।
তাতো হবেই। আমি তো তোমার কাছে লেখা কবিতা ছেলেদের কাছে লেখা প্রেমের কবিতার মতো কিছু পাঠাতে পারি না।
তাহলে ঠিক আছে।
ঠিক আছে কি? আমি ঐ অভিজাত ছেলেগুলোর মাথা খাবই।
আর ওরা তোমার দেহ নিয়ে খেলবে।
আমার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হবে না।
যাক, তাহলে বেচারা ছেলেগুলো আইনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
আমি বুঝতে পারি না তুমি আমাকে নিয়ে ভাবছ না কেন? ভাবছো হাবলা ছেলেগুলোকে নিয়ে।
তোমার কথা ভাবি না তা ঠিক না। তোমার কথাই আমাকে বেশি ভাবতে হয়। আর প্রতিবারই মনে হয় তুমি কী অদ্ভুত। একটা কাজ করো, তুমি মায়ের কাছ থেকে বাবার কাছে চলে যাও।
প্রথা ভঙ্গ করে?
আমি করছি না?
আমিও করছি প্রথা ভঙ্গ, তবে তা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণীর নিষিদ্ধ প্রেম। একটি নয়, অনেকগুলো। বলে খুব হাসল ইঝোমি।
তোমার বাবা ইচিঝেন প্রদেশের গভর্নর। জীবনটা সেখানে বেশ উপভোগ্য হবে।
এসব জানতে পারলে বাবা ঠেঙানিও দেবে। দরকার নেই বাবা, উদার উদাসীন, আরেক গভর্নরের মেয়ে মায়ের কাছে বেশ ভালোই আছি। তাইরা নো ইয়াসহিরা গভর্নর, তার কাছ থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা পাচ্ছি। তারা তো আর সম্রাটের কেন্দ্রীয় হোমরা চোমরা নয় যে, সোনার চামচ মুখে পাব। এ নিয়েই থাকতে হবে। মুরাসাকি ভাবলো বলে কী মেয়েটা!
(ক্রমশ...)
ধারাবাহিক উপন্যাস : এক
আবুল কাসেম
বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১
এক.
কিয়োটোর টেরামাচি লেন। এখানে একটি বাড়িতে মুরাসাকি শিকিবুরা থাকে। মুরাসাকি শিকিবু বলে আমরা যাকে জানি তার আসল নাম ফুজিওয়ারা নো তাকাকু। তার লেখা গেঞ্জি মনোগাতারি উপন্যাসের চরিত্র মুরাসাকির নাম অবলম্বনে পরবর্তীতে তার নাম হয়ে যায় মুরাসাকি। নামের দ্বিতীয় অংশ শিকিবুটা এসেছে বাবার কর্মস্থল উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের নাম অনুসারে। বাবা ফুজিওয়ারা নো তামেতোকি সম্রাটের দরবারে উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান। বাবা তাকে তাকাকু নামে ডাকেন।
হেইয়ান সাম্রাজ্যে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা আলাদাভাবে থাকার নিয়ম রয়েছে। এ নিয়মে সন্তানেরা মায়ের সঙ্গে এবং মায়ের অবর্তমানে নানার বাড়িতে থাকে। উত্তরের ফুজিওয়ারা অভিজাত গোত্রে মুরাসাকির মায়ের জন্ম। মা সম্প্রতি মারা গেছেন। তবে তার আগেই প্রচলিত নিয়মনীতি ভঙ্গ করে তাকাকু তার বাবার কাছে চলে আসে।
বাবার কাছে ছোটভাই নোবুনোরি আছে একই নিয়ম ভঙ্গ করে। কারণ বাবা তাকে সঙ্গে রেখে সম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উচ্চাভিলাষী হর্তাকর্তা হবার শিক্ষা দেবেন। এই শিক্ষার প্রথম পাঠ হচ্ছে চায়নিজ ক্লাসিক্যাল ভাষা শিক্ষা। এটি হেইয়ান সম্রাটের দরবারের (রাজকীয়) ভাষা; যা শুধু ছেলেরাই শিখতে পারে মেয়েরা নয়।
একজন গৃহশিক্ষক নোবুনোরিকে বাড়িতে চায়নিজ ক্লাসিক শিক্ষা দিতে আসেন। ছেলেটার মাথায় গোবর। তার ভাষা শিক্ষা তাই প্রত্যাশিত মাত্রায় এগোচ্ছে না। বাবা হতাশ। এই ছেলেকে ঘিরে তার রাজ্যের স্বপ্ন। একদিন বড় হয়ে সে দরবারি আভিজাত্যের সুউচ্চ শিখরে উঠবে, সম্রাটের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবে- এই তার আশা।
এরকম আশা-প্রত্যাশা ও স্বপ্ন দেখার বাস্তব কিছু কারণ আছে। উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগে চাকরি তার। সম্রাটের দরবারের অমাত্য-আমলা কর্মকর্তাদের চোট-পাটে তাকে তটস্থ থাকতে হয়। তাদের বিলাসী আর জাঁকজকমপূর্ণ জীবন। পদবিবেচনায় আত্মসচেতন। পান থেকে চুন খসলেই সমস্যা। তাই তাদের মন রক্ষা করে চলাই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
অথচ গত শতাব্দী থেকে তাদের অভিজাত ফুজিওয়ারা গোত্রের লোকজনই সম্রাটের দরবারে মন্ত্রিপরিষদ ও অমাত্য হিসেবে দরবারকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। এমনকি অন্তঃপুরের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। সম্রাটের ঘরে-বাইরে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব প্রতিপত্তি তাদেরই। ফুজিওয়ারা ললনারা হয়ে আসছেন সম্রাটদের সম্রাজ্ঞী। এক মিচিনাগাই তার চার কন্যাকে সম্রাটদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সম্রাটদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছেন।
মুরাসাকি শিকিবুর প্রপিতামহ ফুজিওয়ারা নো কানেসুকে সম্রাটের দরবারে প্রভাব প্রতিপত্তি এবং অভিজাত্যের চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি শুধু সম্রাটের দরবারে অমাত্য হিসেবেই নয়, কবি এবং সাহিত্যামোদী হিসেবেও সম্মানজনক স্থান লাভ করেছিলেন। তার তেরটি কবিতা অভিজাত কবিদের একুশতম রাজকীয় সংকলনে জায়গা করে নিয়েছে। ছয়ত্রিশজন বিখ্যাত কবির কবিতা রয়েছে তাতে। তখনকার বিখ্যাত জনপ্রিয় কবি কি নো সুরেইয়োকি তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন।
মুরাসাকি শিকিবুর পিতামহ কবিতা লিখে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেলেন। তবে রাজকীয় প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তার সময় থেকে ভাটা পড়তে শুরু করে। তিনি আমলা বা অমাত্য সুখের চাইতে কবিতার সুখ বেশি পছন্দ করতেন। এজন্য রাজকীয় প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এ সূত্রেই তার সঙ্গে তাদের পরবর্তী প্রজন্মও সম্রাট দরবারের কেন্দ্রীয় ক্ষমতাবলয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
শিকিবুর বাবা তামেতোকির কবিতা লেখার ঝোঁক আছে। অভিজাত কবিদের সংকলনে তার কবিতা স্থান পেয়েছে। চীনা ধ্রুপদী সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতায় তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য। রাজকীয় সাহিত্য আকাদেমির তিনি সম্মানিত সদস্য। এসবের পরও সম্রাটের অমাত্য নন বলে মনে বেশ কষ্ট। সেই কষ্ট থেকেই ছেলেকে দিয়ে স্বপ্ন দেখা। ছেলেটা মেধাবী নয় বলে যত দুঃখ।
তামেতোকি সেদিন বিকেলবেলা একা একা কবিতা পড়ছিলেন। গৃহশিক্ষক ছেলেকে চীনা ভাষা শেখাচ্ছেন। পাঠ গ্রহণের সময় দেখা গেল ছেলেটি পাড়ছে না। শিকিবু আড়াল থেকে বলে দিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। কোথাও আটকালো না পর্যন্ত।
বাবা এবং গৃহশিক্ষক খুব অবাক হলেন। বাবা বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার। কীভাবে শিখলে তুমি?
বাবা আমি ওদের মুখে শুনে শুনে শিখে ফেলেছি।
তার মানে তুমি চীনাটা জানো।
আড়াল থেকে শুধু হাসির শব্দটাই শোনা গেল।
তুমি যদি আমার ছেলে হতে আমার কোনো দুঃখই থাকত না। কিছুক্ষণ পর বাবা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললেন, তুমি এই ভাষাটা জানো, তা বাইরে জানাবার দরকার নেই। এটা শুধুই সম্রাটের দরবারে অমাত্যদের ভাষা, নারীদের নয়।
রাজভাষা নারীরা জানবে না বাবা?
তোমার এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই।
ফুজিওয়ারা নারী হলেও নয়?
না, নয়। বলে আরেকবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন বাবা।
গৃহশিক্ষক বললেন, কারণটাও তার জানা থাকা দরকার, তামেতোকি সান।
আপনিই বলুন।
নারীরা কর্মে অসমর্থ এবং বুদ্ধিতে অপরিপক্ব- তাই।
বাবা তামেতোকি বললেন, তাকাকুকে দেখে তা মনে হয় না। তাকাকু বলল, গৃহশিক্ষকের কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি একদিন সত্যিই প্রমাণ করব, মেয়েদের দ্বারা এমন কর্মও সম্ভব, যা পুরুষের দ্বারা সম্ভব হয় না।
বাবা বললেন, এখন তুমি গৃহাভ্যন্তরে যাও। তুমি বড় হয়ে যাচ্ছো।
অভিজাত হেইয়ান ভদ্র মহিলাদের জন্য এই এক সমস্যা, তাদের জনবিচ্ছিন্নভাবে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে হয়। বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে শুধু পরিবারের সদস্য এবং নিকটাত্মীয়দের সঙ্গেই কথা বলা সম্ভব। শিকিবু পুরুষ বলতে বাবা এবং ভাইয়ের সঙ্গেই শুধু কথা বলতে পারে। অন্য কারো সঙ্গে নয়। তার সমপর্যায়ের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে বাধা নেই।
সময় কাটাবার জন্য বাল্যকাল থেকে কবিতা আর মনোগাতারি পাঠে মনোযোগী হতে হয় তাকে। প্রপিতামহ-পিতামহ এবং পিতার লেখা কবিতা, কবিতা সংকলন যাতে আছে অন্য কবিদেরও কবিতা এবং প্রপিতামহের লেখা ‘ইয়ামাতো মনোগাতারি’ পড়ে সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা জন্মে তার। মাঝে-মধ্যে সেই কবিতা এবং মনোগাতারি পাঠ করে উচ্ছ্বাসপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং তা ছোটভাই ও মাঝেমধ্যে বাবার কাছে প্রকাশ করে।
একদিন নিজেই একটা কবিতা লিখে ফেলে। কিন্তু কাকে শোনাবে সে। বাবা কবি। সংকোচের মাথা খেয়ে কিছুদিন পর বাবাকেই শুনিয়ে দিল।
বাবা মৃদু হাসলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। বাবার কাছে জাপানের অনেকের লেখা কবিতার সংকলন, মনোগাতারি এবং ডায়েরির কপি রয়েছে। তিনি তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং রাজকীয় সাহিত্য-আকাদেমি থেকে পাণ্ডুলিপি এনে মেয়ের হাতে দেন। এসব পাণ্ডুলিপির মধ্যে চায়না ভাষার উঁচুদরের সাহিত্যও রয়েছে।
শিকিবু যেন দুনিয়ার সকল ধনরত্ন হাতে পেয়ে গেছে, তেমনি উচ্ছ্বাস তার। জাপানের অভিজাত সমাজে সাহিত্যজ্ঞান, সাহিত্যচর্চা এবং কাব্যচর্চার সম্মান অনেক উচ্চপর্যায়ের। কানা তাদের নিজস্ব লেখ্য ভাষা। নারী কবি লেখকদের জন্য নির্ধারিত, পুরুষ কবি-লেখকেরা কানা চায়না উভয় ভাষাই ব্যবহার করতে পারে।
কিয়োটোর টেরামাচি লেনে অভিজাত ফুজিওয়ারাদের বাস। জীবনযাপনের জৌলুস এবং চাকচিক্য এখানে প্রবল। তাদের মধ্যে বিলাসিতা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতাও আছে। এ প্রতিযোগিতার চিত্রটা টেরামাচি থেকে সম্রাটের প্রাসাদ বা দরবার পর্যন্ত বিস্তৃত। হেইয়ান সাম্রাজ্য ঐশ্বর্য আর আভিজাত্যে ভরপুর। কিয়োটো তার রাজধানী।
এ ঐশ্বর্যের মধ্যে বড় হচ্ছে শিকিবুরা। তার বাবার চাকরি শুরু সম্রাট প্রাসাদে, উৎসবের আলোক সাজসজ্জা বিভাগে। হেইয়ান সম্রাটদের প্রাসাদে সারা বৎসরই নানা উৎসব লেগে থাকে। তাই বিভাগটা গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে রাজ-কর্মচারীদের ভালো পদোন্নতি লাভ ঘটে। এরা অনেকেই প্রদেশগুলোয় গভর্নর নিযুক্ত হয়ে যান। টেরামাচি লেনে বেশিরভাগ এদেরই বসবাস। শিকিবু
(১০-এর পৃষ্ঠার পর)
একটা বাড়ির পরেই থাকে ইজোমি শিকিবুরা। তার বাবাও সম্রাটের উৎসব আয়োজন এবং সাজসজ্জা বিভাগে চাকরি করেন। তার নামের শিকিবু অংশও সেখান থেকে পাওয়া। তার বাবা ওয়ে নো মাসামুনের সঙ্গে তাকাকুর বাবার কাজ করার সুবাদে তাদের মধ্যে পরিচিতি এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে। এরা সমবয়সী এবং দুজনেই কবিতা লেখে। ইঝোমি অস্থির এবং চঞ্চল। কিছুটা আত্মঅহংকার আছে। কারণ তার মাতামহ তাইরা নো ইয়াসোহিরা ইতচু প্রদেশের গভর্নর।
আকাঝোমি ইমনরা থাকেন কয়েকটা বাড়ি পরে। তার বাবা তাইরা নো কানেমুরি। মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর মায়ের দ্বিতীয় স্বামী আকাঝোমি তোকিমোচির সংসারে থাকেন। মানুষ জানে যে, তিনি তোকিমোচির মেয়ে। তার নামটাও তোকিমোচির নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা। শান্ত ও সুস্থির প্রকৃতির বুদ্ধিমতি নারী। বয়সে তাকাকু বা মুরাসাকির চাইতে ১৫-২০ বছরের বড়। তিনিও কবি।
পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা এবং কথা বলার সুযোগ না থাকলেও এরা নিজেদের মধ্যে উৎসব অনুষ্ঠানে কথাবার্তা বলে এবং পত্রকবিতা চালাচালি করে। মুরাসাকিদের প্রপিতামহ থেকে কবিতার চর্চা হয়ে আসছে। বনেদি কবি পরিবার হিসেবে একটা সম্মানও আছে। চায়না ধ্রুপদী ভাষা শেখার কারণে বাবার সঙ্গে চায়না-সাহিত্য নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। পরিবেশটা কাব্য বা সাহিত্য চর্চার অনুকূল।
তবে আকাঝোমি ইমন কিংবা ইঝোমি শিকিবুর পরিবারে আগে কেউ কাব্য বা সাহিত্য চর্চা করেনি। সেদিক থেকে সরাসরি শিকিবুর রক্তে রয়েছে কাব্য বা সাহিত্য। তাই আকাঝোমি ইমনের কাছে গুরুত্ব রয়েছে তার।
দুই
ইমনের বিয়ে হয়েছে ওয়ে নো মাসাহিরার সঙ্গে। কিন্তু প্রেমের কবিতা বিনিময় হতো ফুজিওয়ারা নো মিচিতাকার সঙ্গে। তিন বছর কবিতাপত্র বিনিময় এবং লুকিয়ে দেখা সাক্ষাতের পর প্রেমটা ভেঙ্গে গেল। মনে কষ্ট নিয়ে বাবার সাহায্যে মিনামোতো নো মাসানোবুর অধীনে কাজ নিলেন। কাজের মধ্যেই কষ্ট ভুলে থাকা যাবে।
বিয়ের পর স্বাভাবিক হয়ে আসতে সময় লাগলো বটে। তবে স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে নিলেন। স্বামী মাসাহিরা কনফুসিয়াস স্কলার এবং কবি। ওয়াকা এবং কানশি-দু’রকম কবিতাই লেখেন। সবাই তাদের মনে করে ওসিদোরি ফুফু (লাভবার্ডস)।
মুরাসিকির পরিবারও তা জানে। তাই এখানে ইমনের আসা যাওয়া অবারিত। ইমন এখানে আসেন এই পরিবারে তিন পুরুষের কবিখ্যাতির প্রতি শ্রদ্ধাবশত। মুরাসাকিরও পছন্দ তাকে।
আজ এসেছেন একটা আনন্দ গৌরব নিয়ে। মিসিতসুনা নো হাহার কাগেরো নিক্কির পা-ুলিপির কপি সংগ্রহ করতে পেরেছেন।
মুরাসাকি বলল, আমি এর নাম শুনেছি। মিসিত সুনার মাতা বলে পরিচিত। তার নাম তিনি গোপন রেখেছেন।
তুমি ঠিক বলেছ। ডায়েরিটা পড়ে মনে হলো কেন তিনি তার নাম গোপন করেছেন।
কেন?
ডায়েরিটার নাম রেখেছেন ‘উত্তপ্ত ঢেউ’। নিজের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা বলেছেন তাতে। তার স্বামী প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী ফুজিওয়ারা নো কানেই তাকে তো সময় দেননি।
সময় দেননি কেন?
তার বউ আটটি। তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
ছেড়ে চলে আসতে পারতেন।
প্রথা তা অনুমোদন করে না। ক্ষমতাশালী মানুষ স্বামী।
তাই আপন মনে পুড়েছেন। ডায়েরিটি আমি পড়তে চাই আপু। কোন ভাষায় লেখা?
কানা ভাষায়। ওয়াকা কবিতা আছে। মনে হয় তা উত্তাপ ধরে রাখে এবং ছড়ায়। বাকিটা গদ্যের হা-পিত্যেস।
ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
হ্যাঁ, অদ্ভুতই। তবে তোমার বয়সে তা পড়া উচিত কিনা ভাবছি।
কী মনে হয় আপনার?
পড়তে পার এক শর্তে।
কী শর্ত?
এসব যন্ত্রণা মনে পুষে রাখবে না এবং পরিবারের বাইরে কাউকে বলবে না এ ডায়েরির কথা।
ঠিক আছে।
তবে তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল মা।
কেমন?
তিনি সংসার বিরাগী হতে চেয়েছিলেন। প্যাগোডা এবং ধর্মীয়ভাবে পুণ্যময় পাহাড়-পর্বতে ঘুরেছেন। পরে মত বদলালেন। ধর্মীয় বৈরাগ্য ছেড়ে পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসার ধর্মে মনোযোগী হলেন।
সেই ভালো।
শুধু ভালো না। খুবই ভালো। তবে ভদ্রমহিলা ছিলেন বেশ অনুভূতিপ্রবণ। আবেগের মহাপ্লাবন যেন বইয়ে দিয়েছেন পুরো ডায়েরি জুড়ে। যখন তার স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছেন আর তিনি একা, তখন আবেগ যেন বাঁধ মানছে না।
লেখার ধরন কেমন আপু?
নতুন ধরনের। এখানে তার আত্ম-প্রকাশ মনস্তাত্বিক দর্শনের পথে হেঁটেছে। তার বিশ্লেষণ ও মনস্তাত্ত্বিক কঠিন স্বীকারোক্তি দেখে দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। প্রতিকৃতি আঁকার মধ্যে রয়েছে নির্ভেজাল সত্যি। কোথাও কোথাও রয়েছে সহজ স্বীকারোক্তি।
যেমন?
এক জায়গায় লিখেছেন- ‘যে একাকিত্ব, বেদনা এবং দুঃখ আমি নদীপথে ভ্রমণকালে অনুভব করেছি, তার তুলনা হয় না। তিনি নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে, অন্যের দুঃখের কথা ভাববার সময় নেই তার।’
আমি তোমাকে ডায়েরিটি দেব। তার জীবনের কষ্টটা নেয়ার দরকার নেই, রচনা শৈলিটা রপ্ত করার চেষ্টা করো। আমার ভালো লেগেছে, তোমারও লাগবে।
আপনি আজকে আমাকে একটা দারুণ সংবাদ দিলেন। আমি আপনাকে কবিতা লিখে পাঠাব।
তুমি জবাবও পাবে ওয়াকা কবিতায়।
ইমন চলে যাবার পর মুরাসাকি ভাবলো ডায়েরি লেখিকা সম্পর্কে। প্রশ্ন জাগলো মনে, রাজপ্রাসাদের প্রিন্সদের জীবন এমন? তা হলে কি কেউ সুখে নেই? তার বাবাও চাকরি করছেন সম্রাটের প্রাসাদে। মায়ের মৃত্যুর পর অন্য নারীর প্রতি কোনো আসক্তি দেখেনি, বিয়েও করেননি। এটা অবশ্যই বড় বিষয়। সবাইকে একরকম ভাববার দরকার নেই। লেখিকার ভাষাটাই খারাপ। তা হলে সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে?
ইঝোমি শিকিবু কম বয়সেই বেশ বেপরোয়া। চাঞ্চল্যের পাশাপাশি কাউকে হিসেব না করে চলার মানসিকতা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেদের সে এখনই কবিতা পাঠায়।
ইমন উঠে যাবার পরপরই সে মুরাসাকির বাড়িতে এসেছে। মুরাসাকি মনে মনে ভাবলো, যে ভালো সময়টা ইমনের সঙ্গে কেটেছে, তার শোধ নিতে বুঝি ইঝোমির আবির্ভাব।
ইঝোমি মুরাসাকিকে দেখেই বলল, একটা ঘটনা ঘটে গেছে, বুঝলে?
মুরাসাকি চুপ করে আছে। কারণ সে জানে সে কিছু জানতে না চাইলেও রেকর্ডটা বাজতেই থাকবে। ইঝোমি আবার বলল, তোমাকে বলেছিলাম না ছেলেটার কথা, ও আমাকে, আমাকে কাছে পেয়ে ঠিক ঠোঁটের ওপর একটা ইয়ে বসিয়ে দিল।
কী! বিস্ময় মুরাসাকির।
ইঝোমি বলল, এখনো রোমাঞ্চিত আমি। বিশ্বাস করবে না কী অবস্থা আমার। আলোড়নটা যেন থামছেই না। তাই তোমার কাছে ছুটে এলাম।
স্বগতভাবে মুরাসাকি বলল, বড় বাজে অভিজ্ঞতা।
কিছু বললে?
না।
এরকম সবারই হয়, না?
আমি ঠিক জানি না।
তুমি বুদ্ধু একটা। আরে জীবনকে উপভোগ কর।
ইমন আপা এসেছিলেন।
লাভবার্ডসের একজন?
কাগেরো নিক্কির পাণ্ডুলিপির এক খণ্ড পেয়েছেন।
কী হবে ওটা দিয়ে? আমি শুনেছি বেচারি লেখিকা বিলাপ করতে করতে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।
ইঝোমি সম্মান করে কথা বলো।
আমি ভাই কাঁদতে পারব না। মেয়েদের এত অস্ত্র থাকতে (হাত দিয়ে দেখায় ) পরাজিত হবে কেন? আমি নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোয় বিশ্বাসী। শিকারই হবে আমার পেশা।
ইঝোমি তোমার বয়স আমার মতোই।
তুমি ভদ্র, শান্ত- তা-ই থাকো। জাপান বদলে যাচ্ছে তুমি দেখতে পাচ্ছো না।
তুমি বদলে যাচ্ছো, জাপান না। সত্যিকার জাপানকে বদলাতে সহায়তা করছে ইমন আর কাগেরো নিক্কির লেখিকারা।
নিজের নাম পর্যন্ত গোপন করেছেন তিনি। আমি যদি অশ্লীলও কিছু লিখি আমার নামেই লিখব। সে সাহস থাকতে হবে। একটু থেমে আবার বলল, ছেলেটা আমাকে পাগল করে দিল রে। আমি তার কথাও লিখে দেব ওয়াকায়।
কী সর্বনাশ! এটি তুমি কখনো করবে না।
নতুন কিছু লিখেছ? তোমার ছেলেদের কাছে কবিতা পাঠানো উচিত। আমাকে পাঠানো কবিতা পানসে মনে হয়। ছেলেদের পাঠানো কবিতাই উত্তেজনাকর এবং ভারি মজার।
মৃদু হেসে মুরাসাকি বলল, আমার কাছে প্রেরিত তোমার কবিতা কৌতুকাবিষ্ট মনে হয়।
তাতো হবেই। আমি তো তোমার কাছে লেখা কবিতা ছেলেদের কাছে লেখা প্রেমের কবিতার মতো কিছু পাঠাতে পারি না।
তাহলে ঠিক আছে।
ঠিক আছে কি? আমি ঐ অভিজাত ছেলেগুলোর মাথা খাবই।
আর ওরা তোমার দেহ নিয়ে খেলবে।
আমার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হবে না।
যাক, তাহলে বেচারা ছেলেগুলো আইনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
আমি বুঝতে পারি না তুমি আমাকে নিয়ে ভাবছ না কেন? ভাবছো হাবলা ছেলেগুলোকে নিয়ে।
তোমার কথা ভাবি না তা ঠিক না। তোমার কথাই আমাকে বেশি ভাবতে হয়। আর প্রতিবারই মনে হয় তুমি কী অদ্ভুত। একটা কাজ করো, তুমি মায়ের কাছ থেকে বাবার কাছে চলে যাও।
প্রথা ভঙ্গ করে?
আমি করছি না?
আমিও করছি প্রথা ভঙ্গ, তবে তা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণীর নিষিদ্ধ প্রেম। একটি নয়, অনেকগুলো। বলে খুব হাসল ইঝোমি।
তোমার বাবা ইচিঝেন প্রদেশের গভর্নর। জীবনটা সেখানে বেশ উপভোগ্য হবে।
এসব জানতে পারলে বাবা ঠেঙানিও দেবে। দরকার নেই বাবা, উদার উদাসীন, আরেক গভর্নরের মেয়ে মায়ের কাছে বেশ ভালোই আছি। তাইরা নো ইয়াসহিরা গভর্নর, তার কাছ থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা পাচ্ছি। তারা তো আর সম্রাটের কেন্দ্রীয় হোমরা চোমরা নয় যে, সোনার চামচ মুখে পাব। এ নিয়েই থাকতে হবে। মুরাসাকি ভাবলো বলে কী মেয়েটা!
(ক্রমশ...)