alt

সাময়িকী

মুরাকামির কল্পধাম

মিলটন রহমান

: বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১

হারুকি মুরাকামি

হারুকি মুরাকামির বয়স এখন বাহাত্তর বছর। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা সম্ভবত চৌদ্দটি। আর ছোটগল্প গ্রন্থ ছিলো পাঁচটি। তবে ৬ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ষষ্ঠ গল্পগ্রন্থ ‘দি ফার্স্ট পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’। এক মলাটে আটটি গল্প। গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিশ্বের তাবৎ পত্রিকাগুলো আলোচনায় মেতে আছে।

মুরাকামি বিশ্বাস করেন গ্রন্থ সংখ্যা একজন লেখকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির শিল্পমূল্য ও গভীরতা। তিনি এক একটি উপন্যাসকে পাঠকের জন্য মানসিক নিরাময় (ড্রাগ) বলে মনে করেন। প্যারিস রিভিউতে ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি প্রতি তিন-চার বছরে একটি উপন্যাস রচনা করি। পাঠক আমার উপন্যাসের জন্য অপেক্ষা করে। একসময় আমি জন আরভিং-এর একটি সাক্ষাৎকার করেছিলাম, তাতে তিনি বলেছিলেন, ভালো একটি গ্রন্থ পাঠ করাটাই আসল কথা। একজন পাঠক যখন ভালো গ্রন্থ পাঠে আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন সে আরেকটি ভালো গ্রন্থের জন্য অপেক্ষা করবেই।’ এই যে মুরাকামির আত্মবিশ্বাস, তা একজন লেখককে সৃজনের শীর্ষে নিয়ে যেতে নিয়ামক হিশেবে কাজ করে।

হারুকি মুরাকামির কোন উপন্যাস এবং ছোটগল্প পাঠোত্তর চিন্তার কোষ আর স্থির থাকে না। কিছুদিন আগে পাঠ করেছিলাম ছোটগল্প ‘সুপার ফ্রগ সেভস টোকিও’। এমন গল্প আমি আগে কখনো পাঠ করি নি, তা আমার মনে হয়েছে। মুরাকামি কল্পজগতের কোথায় বাস করেন তার খবর পাওয়া গেলো এ গল্পে। সেখান থেকে আমি তাঁর তূণের খবরে ব্যাপ্ত হলাম। এছাড়া তাঁর ‘নরওয়েজিয়ান উড’, ‘হিয়ার দি সংস অব দ্য উইংস’, ‘হানালি বে’,-সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ রচনাতো রয়েছেই। তিনি অত্যন্ত কম এবং নির্বাচিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সভা-সেমিনারেও খুব পরিমিত কথা বলেন। সেসব পরিমিতিবোধ থেকে কিছু পরিণত চিন্তা আমি ধরার চেষ্টা করেছি। তাতে করে কিছুটা জানতে পারলাম জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামিকে। প্রত্যেক লেখকেরই লেখালেখির একটি কুটির রয়েছে। সেখানে থাকে কল্পনার মণিমুক্ত, নদী-সমুদ্র, রাজ্য ও রাজার দরবার, প্রকৃতি ও তার বহুবিস্তারি সৃষ্টি ইত্যাদি। মুরাকামির সেই কুটিরটি অন্য রকম। তিনি কিভাবে উপন্যাস কিংবা ছোট গল্প রচনা করেন, কোথায় এর উৎস, চিন্তা ও কল্পনার ডিপকলটা কত গভীরে স্থাপন করতে হয় তা জানা গেলো।

প্রত্যেক লেখকেরই লেখালেখির একটি কুটির রয়েছে। সেখানে থাকে কল্পনার মণিমুক্তা, নদী-সমুদ্র, রাজ্য ও রাজার দরবার, প্রকৃতি ও তার বহুবিস্তারি সৃষ্টি ইত্যাদি। মুরাকামির সেই কুটিরটি অন্য রকম

দি নিউ ইয়র্কারে ২০১৯ সালের ১০ ফ্রেব্রুয়ারি মুরাকামির একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। ডেবোরা ট্রেইসম্যানকে দেয়া সে সাক্ষাৎকারে, উপন্যাস রচনার জন্য স্বপ্ন দেখা কতটুকু জরুরি সে বিষয়ে আলোকপাত করলেন এভাবে, ‘লেখালেখি আমার কাছে স্বপ্নের মতো। যখন আমি লিখি, তখন ইচ্ছে করে কল্পনা করি। আমি যদি ইচ্ছে করি বিরামহীন কল্পনায় ডুবে যেতে পারি, ইচ্ছে করলে যেতে পারি থেমে, এভাবে পরের দিন পর্যন্ত কল্পনায় কাটিয়ে দিতে পারি। যখন তুমি ঘুমাচ্ছো এবং সুন্দর স্বপ্ন দেখছো, দেখছো বিয়ার পান করছো কিংবা কোন সুন্দরী রমণীর সাথে সময় কাটাচ্ছো, যেই ঘুম থেকে জাগলে তোমার ঘুম শেষ, সব শেষ, কিন্তু আমার স্বপ্ন দেখা পরের দিন পর্যন্ত চলে।’ এই হলো মুরাকামি। ঘুমে নয় একজন লেখককে জেগে স্বপ্ন দেখাটাই যে জরুরি তা জানিয়ে দিলেন। ২০০৪ সালে প্যারিস রিভিউকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এ কল্পনা-মাদসাকক্তির বিষয়টি আরো খোলাসা করেছিলেন- ‘চমৎকার বিষয় হলো কি জানো, যখন একটি উপন্যাস রচনা করছো তখন তুমি জেগে স্বপ্ন দেখতে পারো। যদি সেটি সত্যিকারের স্বপ্ন হয় তাহলে তাকে তুমি রুদ্ধ করতে পারবে না। একটি বই রচনার সময় তুমি জেগে থাকো, তুমি সুবিধামতো সময় নির্ধারণ করতে পারো, পারো এর দীর্ঘ কত হবে তা নিশ্চিত করতে।’

অন্যদিকে যদি তাকাই দেখি, পাঠকের কাছে একটি উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প কীভাবে সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে, গদ্যেও যে কাব্য কিংবা গানের সুষমা থাকা জরুরি তা তিনি উদ্ধৃত করেছেন নিজের প্রবন্ধ ‘জাজ ম্যাসেঞ্জার’-এ। বলেছেন, ‘তা গান কিংবা উপন্যাস হোক, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘রিদম’। তোমার রচনার স্টাইলে চমৎকার, প্রাকৃতিক ছন্দ থাকতে হবে, তা না হলে তোমার রচনা কেউ পাঠ করবে না। আমি ছন্দের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা নিয়েছি ‘মিউজিক’ থেকে- সরাসরি যদি বলি তা হলো ‘জাজ’। এর পরে আসে সুরের প্রসঙ্গ। সাহিত্যে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয় যথাযথ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে- যাতে রচনায় নেচে ওঠে ছন্দ। যদি রচনায় শব্দ প্রয়োগ ছন্দময় এবং স্বাচ্ছন্দ হয়, তাহলে তোমাকে আর কিছুই করতে হবে না। এর পরে আসে সাদৃশ্য- যা হৃদয়স্থিত রক্তশিরায় বাহিত হয়ে শব্দ তৈরি করে। এবার আসা যাক রচনার অভ্যন্তরে। এখানেই চিন্তার কিছু ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, যেখান কল্পনার তলদেশ থেকে স্বাচ্ছন্দে উঠে আসবে কাহিনী। যখন মনে হবে তুমি এমন একটি জায়গায় উপনীত হয়েছো তা নতুন। এই গল্প আর কেউ বলেনি। যার রয়েছে অর্থবাচকতা। এখন তুমি সে গল্প তোমার পাঠকের জন্য প্রকাশ করতে পারো। এটা হচ্ছে অত্যন্ত মার্গীয় একটি পথ, যা অন্য কোনভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না।’ এই প্রবন্ধেই মোরাকামি থিলনিয়াস মঙ্ক নামের একজন জাজ পিয়ানিস্টের কথা উল্লেখ করেছেন। মঙ্ককে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি পিয়ানোর বাইরের বিশেষ শব্দ এখানে পেলে কী করে! মঙ্ক পিয়ানোর রিডে হাত রেখে বলেন, এটা নতুন কোন নোট নয়, তুমি যদি কী বোর্ডের দিকে তাকাও দেখবে সব নোট সেখানে রয়েছে। কিন্তু তুমি যদি মনে করো একটি নোট যথেষ্ট তাহলে তার শব্দ হবে ভিন্ন, তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে কোন নোটটি তোমার প্রয়োজন।’ হারুকি মোরাকামি লেখার সময় মঙ্কের কথাগুলো স্মরণ করেন। তার কথাকে সত্যি বলে মানেন। মনে করেন, ‘নতুন কোন শব্দ নেই। আমাদের কাজই হচ্ছে সাধারণ শব্দকে নতুন অর্থ ও মাধুর্য দেয়া।’

উপন্যাস লেখার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি আবশ্যক বলেই মানেন মুরাকামি। এ বিষয়ে অত্যন্ত সংযমী তিনি। ২০০৪ সালে জন রে-র কাছে প্যারিস রিভিউর জন্য দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছিলেন-‘যখন আমি একটি উপন্যাস লেখার ঘোরে থাকি-তখন ভোর চারটায় ঘুম থেকে জেগে উঠি। লিখি পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা। দুপুরে দশ কিলোমিটারের মতো দৌঁড়াই বা পনেরশ মিটার সাতার কাটি। কখনো কখনো দু’টোই করি। এরপর কিছুক্ষণ বই পড়ি ও গান শুনি। ঘুমোতে যাই রাত ন’টার মধ্যে। আমার এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না কোনদিন। নিয়মের পুনরাবৃত্তি এক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়-এটি হচ্ছে সম্মোহনের একটি ধাপ। আমি নিজেকে এভাবে সম্মোহিত করতে থাকি চিন্তার গভীরে প্রবেশ করার জন্য। দীর্ঘ সময়, ছয় মাস থেকে এক বছর এর ধারবাহিকতা বজায় রাখতে হলে প্রয়োজন মানসিক ও শারিরীক সুস্থতা। সে অর্থে উপন্যাস লেখা হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ। তাই সৃজনশীল কাজের জন্য শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা জরুরি।’ আমি মুরাকামির এই মেডিটেশনের অনুসারী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমরা একজন লেখক বা কবি ‘অসংযমি’ হয় এমন মন্তব্য করে থাকি। কিন্তু মুরাকামি বলছে না একজন লেখককে অবশ্যই নির্দিষ্ঠ নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বিশ্বসাহিত্যের অনেক আলোচিত কবি-সাহিত্যিক আছেন যারা নির্দিষ্ঠ নিয়ম মেনে চলেছেন। মায়া এঞ্জেলো তো অফিসে যাওয়ার মতই সকালে ঘুম থেকে জেগে চলে যেতেন একটি হোটেল কক্ষে। সেখানে আটটা থেকে টানা দুপুর দুইটা পর্যন্ত লিখতেন। তারপর বাসায় এসে রান্না-বান্না করতেন, সংসার সামলাতেন।

লেখকের একটি নির্দিষ্ঠ জগত থাকে। যেখানে থাকে কেবল ওই লেখকের বিচরণ। এ ক্ষেত্রেও মুরাকামি ভিন্ন। তিনি একটি লেখা শুরু করার আগে কল্পনার এতো মার্গে পৌঁছান যে, সেখানে একটি ভিন্ন জগত তৈরি হয়। নিজের লেখা শুরু কথা ২০১৯ সালে দি নিউ ইয়র্কারে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-‘যখন লেখা শুরু করি, তখন আমি অন্য কোথাও চলে যাই। দরজা খুলে সে স্থানে প্রবেশ করি এবং দেখি সেখানে কী হচ্ছে। আমি হয়তো জানি না-কিংবা জানলেও পাত্তা দিই না যে বাস্তব জগতে আছি নাকি অবাস্তবে। আমি গভীর থেকে গভীরে যেতে থাকি, অনুভব করি ভূগর্ভের কোথাও বসে লিখছি। সেখানে আমি অদ্ভুত কিছুর মুখোমুখি হই। যখন তাদের দেখি, মনে হয় তারা প্রাকৃতিক। আর সেখানে যদি কোন অন্ধকার থাকে, আর তা যদি আমার দিকে ধেয়ে আসে, সম্ভবত তা কোন বার্তা বয়ে আনে। আমি সে বার্তা ধরার চেষ্টা করি। এভাবে ধীরে ধীরে পৃথিবীর দিকে তাকাই এবং বর্ণনা করি আমি যা দেখেছি। এরপর ফিরে আসি, ফিরে আসাটাই গুরুত্বপূর্ণ। যদি তুমি ফিরে আসতে না পারো তা হবে ভয়ংকর। আমি পেশাদার, ফিরে আসতে পারি’। ঘোরে বিলিন হয়ে যাওয়া একজন লেখকের জন্য আবশ্যকীয়। লেখার শুরুতে ‘সুপার ফ্রগ সেভস টোকিও’ গল্পটির কথা বলেছি, মুরাকামি যে কল্পনার কথা বলছেন তাতে বুঁদ হতে না পারলে এমন গল্প তৈরি প্রায় অসম্ভব!

আবার উপন্যাস লেখাকে মুরাকামি একটি অনুষ্ঠান আয়োজকের ভূমিকাই মনে করেন। যাদের ভালো লাগবে তারা অনুষ্ঠানে থাকবেন আর যাদের ভালো লাগবে না তারা চলে যাবেন। একজন লেখকের পক্ষে সব পাঠককে খুশি করা সম্ভব নয়। সব পাঠকওতো আবার সব উপন্যাস পাঠের জন্য যোগ্য কিংবা প্রস্তুত নয়। অতএব প্রত্যেক লেখক জানেন কোন ঘরানার পাঠকের জন্য তিনি লেখেন। মুরকামি মনে করেন, এমন স্বকীয় চিন্তা থেকেই উপন্যাস নিজস্ব গতি অর্জন করে। এমন মুক্ত চিন্তার পাশাপাশি আবার কঠিন কসরতের দিকেও ইঙ্গিত দেন তিনি। বলেন, ‘উপন্যাস লেখা মানে একটি খাড়া পাহাড়ের উপরে ওঠা। হোঁচট খেতে খেতে হাল না ছেড়ে একসময় পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানো।’ পাঠক বা সমালোচক একটি উপন্যাস পাঠের পর, গল্প বা ঘটনার সময়কাল এবং তা উপস্থাপনে লেখকের পরিপক্কতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। হতে পারে ঔপন্যাসিক নব্বইয়ের দশকে বসে লিখছেন উপন্যাস। সে উপন্যাসে যে গল্প তিনি উপস্থাপন করছেন তার সূচনা সত্তরের দশক থেকে। এই যে নব্বইয়ে বসে সত্তরে ফিরে যাওয়া এবং সেই সময় ও পরিপার্শ্বকে নিখুঁত তুলে আনাই হচ্ছে ঔপন্যাসিকের মুন্সিয়ানা। এ বিষয়েও হারুকি মুরাকামি অত্যন্ত সতর্ক। বলেন, তিনি যখন পনের বছর বয়সী কোন তরুণ চরিত্র নির্মাণ করেন, তখন তিনি নিজের পনের বছর বয়সে ফেরত যান। অনেকটা টাইম মেশিনের মতো। ২০০৫ সালে সানডে ক্যারালন্ডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি সব কিছুই মনে করতে পারি। আমার সেই বয়সের সব হাওয়া বাতাস ও তার গন্ধ পাই, অত্যন্ত সতর্ক এবং স্পষ্টভাবে।’ ফেলে আসা অতীতে তিনি এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টি বিস্তার করে এসেছেন যে তিনি ঘাড় ঘুরালেই দেখতে পান শৈশব। সে সময়ের খেলার মাঠ, পাঠশালা, বন্ধুর মুখ কোন কিছুই তার কাছে থেকে দূরে যেতে পারে না। যা বিশেষ করে একজন লেখকের জন্য স্মৃতি আর্কাইভ হয়ে থাকে। হারুকি মুরাকামির সেটি আছে।

একটি উপন্যাস লেখার জন্য লেখককে প্রথমেই চিন্তা করতে হয় ‘প্লট’। অসংখ্য উপন্যাস রচিত হয়েছে নানান ভাষায়। প্রতিটি উপন্যাস গল্প বা অখ্যান নির্ভর। আজকে যে লেখক উপন্যাস লিখতে চান তার পক্ষে বিষয় নির্বাচন করার সত্যি একটি দুরূহ কাজ। বিষয় খুঁজতেও লেখককে এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়। ফলে অনেক উপন্যাসই তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না বিষয় বৈচিত্র্যে স্বতন্ত্র না হওয়ার কারণে। এ বিষয়টিকেও সহজ করে দিয়েছেন মুরাকামি। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি বহু বছর আগে দেখা স্টীভেন স্পিলবার্গের সাইন্স ফিকশন ধর্মী চলচ্চিত্র, ‘ই. টি দি এক্সট্রা টেরিসটরিয়াল’-এর কাহিনীর অবতারণা করেন। বলেন, ‘সেই চলচ্চিত্রে ই.টি তার গাড়ির গ্যারেজে ফেলে রাখা আবর্জনা দিয়ে একটি সম্প্রচার যন্ত্র আবিষ্কার করে! সেই ছবিটি আমি একটি থিয়েটারে দেখেছিলাম। দেখার পর একটি বড় ধরনের ধাক্কা অনুভব করি। বুঝলাম একটি উপন্যাসের প্লট বা উপন্যাস রচনা করাটাও ঠিক একই রকম। মূল কথা হচ্ছে তুমি কোথা থেকে বিষয় তুলে আনছো তা কতটুকু গুনসম্পন্ন সেটি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়-সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘ম্যাজিক’। তোমার মধ্যে তা থেকে থাকলে নিজের ভাষায় অত্যন্ত অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নেচে উঠবে শব্দ ও সুরের গমকে।’ মোরাকামির এ কথাটি প্রতিটি ঔপন্যাসিকের জন্য অত্যন্ত ইঙ্গিতবহ ও গুরুত্বপূর্ণ। লেখক তো সময়কেই কাটাছেঁড়া করতে করতে এগিয়ে যায়। সেখানে বহুবিধ বিষয় ছড়ানো ছিটানো থাকে। শৌখিন কোন জীবনের চেয়ে ভেঙে পড়া কুটিরের একজন সুবিধাবঞ্চিত মানুষই একজন ঔপন্যাসিক বা গল্পকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

মোরাকামি নানানভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন একজন ঔপন্যাসিক হিশেবে। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি নিজেকে একজন ভিডিও গেম নির্মাতা হিশেবেও ভেবেছেন- ‘যখন লিখি কখনো কখনো নিজেকে আমার ভিডিও গেম নির্মাতা মনে হয় এবং একই সাথে খেলোয়াড়ও। ধরো আমি একটি ভিডিও গেম তৈরী করছি এবং এর মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি। বাম হাত জানে না ডান হাত কি করছে। এটা এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। এক ধরনের বিভক্তির অনুভূতি।’ মুরাকামি একজন ঔপন্যাসিকের মানসিক প্রস্তুতির যে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে তা বর্ণনা করতে গিয়ে নানান প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। যার সবই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। তিনি সম্ভবত ঝিনুক রান্না এবং খেতে পছন্দ করেন। এর সাথেও তিনি উপন্যাস রচনার যোগ খুঁজে পেয়েছেন। বলছেন, ‘ঝিনুক রান্না করা এক ধরনের আনন্দ, কিন্তু তা একেবারে নিজস্ব অভিজ্ঞতা। যা অনেকটাই একাকিত্ব এবং স্বাধীনতার মধ্যকার সম্পর্কের মতো। তুমি খুঁজছো অভ্যন্তরে কী রয়েছে। তুমি তার প্রতিটি শব্দ অবিষ্কার করার চেষ্টা করছো। এটা অনেকটা নিজের ভেতরে নিজের সেঁধিয়ে যাওয়ার মতো কাজ। উপন্যাস লেখাও ঠিক ঝিনুক রান্নার মতো একটি ব্যপার। তুমি এ কাজটি করছো, কারণ তুমি এটি করতে পছন্দ করো। যখন আমার মানসিক চাপ বাড়ে, যখন ভাবি আমি উপন্যাস লিখছি, তখন ভাবি আমিতো ঝিনুক রান্না করছি। তাতে আমি ফুরফুরে হয়ে উঠি, কোন চাপ অনুভব করি না।’

আবার লেখালেখি অন্যকে আকর্ষণ প্রচেষ্টার মতোই একটি একনিষ্ঠ কাজ বলে মনে করেন হরুকি মুরাকামি। এক্ষেত্রে লেখালেখি মানে কোন একজন রমণীর দৃষ্টি আকর্ষণ চেষ্টা হিশেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এটি নিরন্ত চর্চার বিষয়, কিন্তু এ চেষ্টা অনেকটাই সহজাত।’

হারুকি মুরাকামির লেখার যে কল্পধাম তাতে ঠাসা কল্পনা। কল্পনারও যে বিভিন্ন স্তর আছে তাও পাওয়া গেলো সেখানে। আবার কেবল কল্পনা থাকলেইযে উপন্যাস হয়ে যাবে তাও কিন্তু নয়। তাকে পাঠকের জন্য বিলিয়ে দেয়ার যে প্রস্তুতি বা প্রক্রিয়া তাও একজন লেখককে নির্মাণ করতে হবে। বলার ভঙিতে হৃদম, সুর এবং যাদুর ব্যঞ্জনা একাকার হলে তবেই একজন পাঠক একজন ঔপন্যানিকের নতুন গ্রন্থের জন্য চণ্ডীদাসের মতো অপেক্ষা করবে!

তথ্যসূত্র:

জাজ মেসেঞ্জার-হারুকি মুরাকামি

দি নিউ ইয়র্কার ইন্টারভিউ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

হারুকি মুরাকামি, দি আর্ট অব ফিকশন, প্যারিস রিভিউ-২০০৪

দি আর্ট ডেস্ক, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

মুরাকামির কল্পধাম

মিলটন রহমান

হারুকি মুরাকামি

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল ২০২১

হারুকি মুরাকামির বয়স এখন বাহাত্তর বছর। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা সম্ভবত চৌদ্দটি। আর ছোটগল্প গ্রন্থ ছিলো পাঁচটি। তবে ৬ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ষষ্ঠ গল্পগ্রন্থ ‘দি ফার্স্ট পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’। এক মলাটে আটটি গল্প। গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিশ্বের তাবৎ পত্রিকাগুলো আলোচনায় মেতে আছে।

মুরাকামি বিশ্বাস করেন গ্রন্থ সংখ্যা একজন লেখকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির শিল্পমূল্য ও গভীরতা। তিনি এক একটি উপন্যাসকে পাঠকের জন্য মানসিক নিরাময় (ড্রাগ) বলে মনে করেন। প্যারিস রিভিউতে ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি প্রতি তিন-চার বছরে একটি উপন্যাস রচনা করি। পাঠক আমার উপন্যাসের জন্য অপেক্ষা করে। একসময় আমি জন আরভিং-এর একটি সাক্ষাৎকার করেছিলাম, তাতে তিনি বলেছিলেন, ভালো একটি গ্রন্থ পাঠ করাটাই আসল কথা। একজন পাঠক যখন ভালো গ্রন্থ পাঠে আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন সে আরেকটি ভালো গ্রন্থের জন্য অপেক্ষা করবেই।’ এই যে মুরাকামির আত্মবিশ্বাস, তা একজন লেখককে সৃজনের শীর্ষে নিয়ে যেতে নিয়ামক হিশেবে কাজ করে।

হারুকি মুরাকামির কোন উপন্যাস এবং ছোটগল্প পাঠোত্তর চিন্তার কোষ আর স্থির থাকে না। কিছুদিন আগে পাঠ করেছিলাম ছোটগল্প ‘সুপার ফ্রগ সেভস টোকিও’। এমন গল্প আমি আগে কখনো পাঠ করি নি, তা আমার মনে হয়েছে। মুরাকামি কল্পজগতের কোথায় বাস করেন তার খবর পাওয়া গেলো এ গল্পে। সেখান থেকে আমি তাঁর তূণের খবরে ব্যাপ্ত হলাম। এছাড়া তাঁর ‘নরওয়েজিয়ান উড’, ‘হিয়ার দি সংস অব দ্য উইংস’, ‘হানালি বে’,-সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ রচনাতো রয়েছেই। তিনি অত্যন্ত কম এবং নির্বাচিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সভা-সেমিনারেও খুব পরিমিত কথা বলেন। সেসব পরিমিতিবোধ থেকে কিছু পরিণত চিন্তা আমি ধরার চেষ্টা করেছি। তাতে করে কিছুটা জানতে পারলাম জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামিকে। প্রত্যেক লেখকেরই লেখালেখির একটি কুটির রয়েছে। সেখানে থাকে কল্পনার মণিমুক্ত, নদী-সমুদ্র, রাজ্য ও রাজার দরবার, প্রকৃতি ও তার বহুবিস্তারি সৃষ্টি ইত্যাদি। মুরাকামির সেই কুটিরটি অন্য রকম। তিনি কিভাবে উপন্যাস কিংবা ছোট গল্প রচনা করেন, কোথায় এর উৎস, চিন্তা ও কল্পনার ডিপকলটা কত গভীরে স্থাপন করতে হয় তা জানা গেলো।

প্রত্যেক লেখকেরই লেখালেখির একটি কুটির রয়েছে। সেখানে থাকে কল্পনার মণিমুক্তা, নদী-সমুদ্র, রাজ্য ও রাজার দরবার, প্রকৃতি ও তার বহুবিস্তারি সৃষ্টি ইত্যাদি। মুরাকামির সেই কুটিরটি অন্য রকম

দি নিউ ইয়র্কারে ২০১৯ সালের ১০ ফ্রেব্রুয়ারি মুরাকামির একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। ডেবোরা ট্রেইসম্যানকে দেয়া সে সাক্ষাৎকারে, উপন্যাস রচনার জন্য স্বপ্ন দেখা কতটুকু জরুরি সে বিষয়ে আলোকপাত করলেন এভাবে, ‘লেখালেখি আমার কাছে স্বপ্নের মতো। যখন আমি লিখি, তখন ইচ্ছে করে কল্পনা করি। আমি যদি ইচ্ছে করি বিরামহীন কল্পনায় ডুবে যেতে পারি, ইচ্ছে করলে যেতে পারি থেমে, এভাবে পরের দিন পর্যন্ত কল্পনায় কাটিয়ে দিতে পারি। যখন তুমি ঘুমাচ্ছো এবং সুন্দর স্বপ্ন দেখছো, দেখছো বিয়ার পান করছো কিংবা কোন সুন্দরী রমণীর সাথে সময় কাটাচ্ছো, যেই ঘুম থেকে জাগলে তোমার ঘুম শেষ, সব শেষ, কিন্তু আমার স্বপ্ন দেখা পরের দিন পর্যন্ত চলে।’ এই হলো মুরাকামি। ঘুমে নয় একজন লেখককে জেগে স্বপ্ন দেখাটাই যে জরুরি তা জানিয়ে দিলেন। ২০০৪ সালে প্যারিস রিভিউকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এ কল্পনা-মাদসাকক্তির বিষয়টি আরো খোলাসা করেছিলেন- ‘চমৎকার বিষয় হলো কি জানো, যখন একটি উপন্যাস রচনা করছো তখন তুমি জেগে স্বপ্ন দেখতে পারো। যদি সেটি সত্যিকারের স্বপ্ন হয় তাহলে তাকে তুমি রুদ্ধ করতে পারবে না। একটি বই রচনার সময় তুমি জেগে থাকো, তুমি সুবিধামতো সময় নির্ধারণ করতে পারো, পারো এর দীর্ঘ কত হবে তা নিশ্চিত করতে।’

অন্যদিকে যদি তাকাই দেখি, পাঠকের কাছে একটি উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প কীভাবে সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে, গদ্যেও যে কাব্য কিংবা গানের সুষমা থাকা জরুরি তা তিনি উদ্ধৃত করেছেন নিজের প্রবন্ধ ‘জাজ ম্যাসেঞ্জার’-এ। বলেছেন, ‘তা গান কিংবা উপন্যাস হোক, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘রিদম’। তোমার রচনার স্টাইলে চমৎকার, প্রাকৃতিক ছন্দ থাকতে হবে, তা না হলে তোমার রচনা কেউ পাঠ করবে না। আমি ছন্দের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা নিয়েছি ‘মিউজিক’ থেকে- সরাসরি যদি বলি তা হলো ‘জাজ’। এর পরে আসে সুরের প্রসঙ্গ। সাহিত্যে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয় যথাযথ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে- যাতে রচনায় নেচে ওঠে ছন্দ। যদি রচনায় শব্দ প্রয়োগ ছন্দময় এবং স্বাচ্ছন্দ হয়, তাহলে তোমাকে আর কিছুই করতে হবে না। এর পরে আসে সাদৃশ্য- যা হৃদয়স্থিত রক্তশিরায় বাহিত হয়ে শব্দ তৈরি করে। এবার আসা যাক রচনার অভ্যন্তরে। এখানেই চিন্তার কিছু ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, যেখান কল্পনার তলদেশ থেকে স্বাচ্ছন্দে উঠে আসবে কাহিনী। যখন মনে হবে তুমি এমন একটি জায়গায় উপনীত হয়েছো তা নতুন। এই গল্প আর কেউ বলেনি। যার রয়েছে অর্থবাচকতা। এখন তুমি সে গল্প তোমার পাঠকের জন্য প্রকাশ করতে পারো। এটা হচ্ছে অত্যন্ত মার্গীয় একটি পথ, যা অন্য কোনভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না।’ এই প্রবন্ধেই মোরাকামি থিলনিয়াস মঙ্ক নামের একজন জাজ পিয়ানিস্টের কথা উল্লেখ করেছেন। মঙ্ককে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি পিয়ানোর বাইরের বিশেষ শব্দ এখানে পেলে কী করে! মঙ্ক পিয়ানোর রিডে হাত রেখে বলেন, এটা নতুন কোন নোট নয়, তুমি যদি কী বোর্ডের দিকে তাকাও দেখবে সব নোট সেখানে রয়েছে। কিন্তু তুমি যদি মনে করো একটি নোট যথেষ্ট তাহলে তার শব্দ হবে ভিন্ন, তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে কোন নোটটি তোমার প্রয়োজন।’ হারুকি মোরাকামি লেখার সময় মঙ্কের কথাগুলো স্মরণ করেন। তার কথাকে সত্যি বলে মানেন। মনে করেন, ‘নতুন কোন শব্দ নেই। আমাদের কাজই হচ্ছে সাধারণ শব্দকে নতুন অর্থ ও মাধুর্য দেয়া।’

উপন্যাস লেখার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি আবশ্যক বলেই মানেন মুরাকামি। এ বিষয়ে অত্যন্ত সংযমী তিনি। ২০০৪ সালে জন রে-র কাছে প্যারিস রিভিউর জন্য দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছিলেন-‘যখন আমি একটি উপন্যাস লেখার ঘোরে থাকি-তখন ভোর চারটায় ঘুম থেকে জেগে উঠি। লিখি পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা। দুপুরে দশ কিলোমিটারের মতো দৌঁড়াই বা পনেরশ মিটার সাতার কাটি। কখনো কখনো দু’টোই করি। এরপর কিছুক্ষণ বই পড়ি ও গান শুনি। ঘুমোতে যাই রাত ন’টার মধ্যে। আমার এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না কোনদিন। নিয়মের পুনরাবৃত্তি এক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়-এটি হচ্ছে সম্মোহনের একটি ধাপ। আমি নিজেকে এভাবে সম্মোহিত করতে থাকি চিন্তার গভীরে প্রবেশ করার জন্য। দীর্ঘ সময়, ছয় মাস থেকে এক বছর এর ধারবাহিকতা বজায় রাখতে হলে প্রয়োজন মানসিক ও শারিরীক সুস্থতা। সে অর্থে উপন্যাস লেখা হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ। তাই সৃজনশীল কাজের জন্য শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা জরুরি।’ আমি মুরাকামির এই মেডিটেশনের অনুসারী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমরা একজন লেখক বা কবি ‘অসংযমি’ হয় এমন মন্তব্য করে থাকি। কিন্তু মুরাকামি বলছে না একজন লেখককে অবশ্যই নির্দিষ্ঠ নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বিশ্বসাহিত্যের অনেক আলোচিত কবি-সাহিত্যিক আছেন যারা নির্দিষ্ঠ নিয়ম মেনে চলেছেন। মায়া এঞ্জেলো তো অফিসে যাওয়ার মতই সকালে ঘুম থেকে জেগে চলে যেতেন একটি হোটেল কক্ষে। সেখানে আটটা থেকে টানা দুপুর দুইটা পর্যন্ত লিখতেন। তারপর বাসায় এসে রান্না-বান্না করতেন, সংসার সামলাতেন।

লেখকের একটি নির্দিষ্ঠ জগত থাকে। যেখানে থাকে কেবল ওই লেখকের বিচরণ। এ ক্ষেত্রেও মুরাকামি ভিন্ন। তিনি একটি লেখা শুরু করার আগে কল্পনার এতো মার্গে পৌঁছান যে, সেখানে একটি ভিন্ন জগত তৈরি হয়। নিজের লেখা শুরু কথা ২০১৯ সালে দি নিউ ইয়র্কারে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-‘যখন লেখা শুরু করি, তখন আমি অন্য কোথাও চলে যাই। দরজা খুলে সে স্থানে প্রবেশ করি এবং দেখি সেখানে কী হচ্ছে। আমি হয়তো জানি না-কিংবা জানলেও পাত্তা দিই না যে বাস্তব জগতে আছি নাকি অবাস্তবে। আমি গভীর থেকে গভীরে যেতে থাকি, অনুভব করি ভূগর্ভের কোথাও বসে লিখছি। সেখানে আমি অদ্ভুত কিছুর মুখোমুখি হই। যখন তাদের দেখি, মনে হয় তারা প্রাকৃতিক। আর সেখানে যদি কোন অন্ধকার থাকে, আর তা যদি আমার দিকে ধেয়ে আসে, সম্ভবত তা কোন বার্তা বয়ে আনে। আমি সে বার্তা ধরার চেষ্টা করি। এভাবে ধীরে ধীরে পৃথিবীর দিকে তাকাই এবং বর্ণনা করি আমি যা দেখেছি। এরপর ফিরে আসি, ফিরে আসাটাই গুরুত্বপূর্ণ। যদি তুমি ফিরে আসতে না পারো তা হবে ভয়ংকর। আমি পেশাদার, ফিরে আসতে পারি’। ঘোরে বিলিন হয়ে যাওয়া একজন লেখকের জন্য আবশ্যকীয়। লেখার শুরুতে ‘সুপার ফ্রগ সেভস টোকিও’ গল্পটির কথা বলেছি, মুরাকামি যে কল্পনার কথা বলছেন তাতে বুঁদ হতে না পারলে এমন গল্প তৈরি প্রায় অসম্ভব!

আবার উপন্যাস লেখাকে মুরাকামি একটি অনুষ্ঠান আয়োজকের ভূমিকাই মনে করেন। যাদের ভালো লাগবে তারা অনুষ্ঠানে থাকবেন আর যাদের ভালো লাগবে না তারা চলে যাবেন। একজন লেখকের পক্ষে সব পাঠককে খুশি করা সম্ভব নয়। সব পাঠকওতো আবার সব উপন্যাস পাঠের জন্য যোগ্য কিংবা প্রস্তুত নয়। অতএব প্রত্যেক লেখক জানেন কোন ঘরানার পাঠকের জন্য তিনি লেখেন। মুরকামি মনে করেন, এমন স্বকীয় চিন্তা থেকেই উপন্যাস নিজস্ব গতি অর্জন করে। এমন মুক্ত চিন্তার পাশাপাশি আবার কঠিন কসরতের দিকেও ইঙ্গিত দেন তিনি। বলেন, ‘উপন্যাস লেখা মানে একটি খাড়া পাহাড়ের উপরে ওঠা। হোঁচট খেতে খেতে হাল না ছেড়ে একসময় পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানো।’ পাঠক বা সমালোচক একটি উপন্যাস পাঠের পর, গল্প বা ঘটনার সময়কাল এবং তা উপস্থাপনে লেখকের পরিপক্কতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। হতে পারে ঔপন্যাসিক নব্বইয়ের দশকে বসে লিখছেন উপন্যাস। সে উপন্যাসে যে গল্প তিনি উপস্থাপন করছেন তার সূচনা সত্তরের দশক থেকে। এই যে নব্বইয়ে বসে সত্তরে ফিরে যাওয়া এবং সেই সময় ও পরিপার্শ্বকে নিখুঁত তুলে আনাই হচ্ছে ঔপন্যাসিকের মুন্সিয়ানা। এ বিষয়েও হারুকি মুরাকামি অত্যন্ত সতর্ক। বলেন, তিনি যখন পনের বছর বয়সী কোন তরুণ চরিত্র নির্মাণ করেন, তখন তিনি নিজের পনের বছর বয়সে ফেরত যান। অনেকটা টাইম মেশিনের মতো। ২০০৫ সালে সানডে ক্যারালন্ডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি সব কিছুই মনে করতে পারি। আমার সেই বয়সের সব হাওয়া বাতাস ও তার গন্ধ পাই, অত্যন্ত সতর্ক এবং স্পষ্টভাবে।’ ফেলে আসা অতীতে তিনি এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টি বিস্তার করে এসেছেন যে তিনি ঘাড় ঘুরালেই দেখতে পান শৈশব। সে সময়ের খেলার মাঠ, পাঠশালা, বন্ধুর মুখ কোন কিছুই তার কাছে থেকে দূরে যেতে পারে না। যা বিশেষ করে একজন লেখকের জন্য স্মৃতি আর্কাইভ হয়ে থাকে। হারুকি মুরাকামির সেটি আছে।

একটি উপন্যাস লেখার জন্য লেখককে প্রথমেই চিন্তা করতে হয় ‘প্লট’। অসংখ্য উপন্যাস রচিত হয়েছে নানান ভাষায়। প্রতিটি উপন্যাস গল্প বা অখ্যান নির্ভর। আজকে যে লেখক উপন্যাস লিখতে চান তার পক্ষে বিষয় নির্বাচন করার সত্যি একটি দুরূহ কাজ। বিষয় খুঁজতেও লেখককে এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়। ফলে অনেক উপন্যাসই তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না বিষয় বৈচিত্র্যে স্বতন্ত্র না হওয়ার কারণে। এ বিষয়টিকেও সহজ করে দিয়েছেন মুরাকামি। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি বহু বছর আগে দেখা স্টীভেন স্পিলবার্গের সাইন্স ফিকশন ধর্মী চলচ্চিত্র, ‘ই. টি দি এক্সট্রা টেরিসটরিয়াল’-এর কাহিনীর অবতারণা করেন। বলেন, ‘সেই চলচ্চিত্রে ই.টি তার গাড়ির গ্যারেজে ফেলে রাখা আবর্জনা দিয়ে একটি সম্প্রচার যন্ত্র আবিষ্কার করে! সেই ছবিটি আমি একটি থিয়েটারে দেখেছিলাম। দেখার পর একটি বড় ধরনের ধাক্কা অনুভব করি। বুঝলাম একটি উপন্যাসের প্লট বা উপন্যাস রচনা করাটাও ঠিক একই রকম। মূল কথা হচ্ছে তুমি কোথা থেকে বিষয় তুলে আনছো তা কতটুকু গুনসম্পন্ন সেটি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়-সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘ম্যাজিক’। তোমার মধ্যে তা থেকে থাকলে নিজের ভাষায় অত্যন্ত অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নেচে উঠবে শব্দ ও সুরের গমকে।’ মোরাকামির এ কথাটি প্রতিটি ঔপন্যাসিকের জন্য অত্যন্ত ইঙ্গিতবহ ও গুরুত্বপূর্ণ। লেখক তো সময়কেই কাটাছেঁড়া করতে করতে এগিয়ে যায়। সেখানে বহুবিধ বিষয় ছড়ানো ছিটানো থাকে। শৌখিন কোন জীবনের চেয়ে ভেঙে পড়া কুটিরের একজন সুবিধাবঞ্চিত মানুষই একজন ঔপন্যাসিক বা গল্পকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

মোরাকামি নানানভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন একজন ঔপন্যাসিক হিশেবে। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি নিজেকে একজন ভিডিও গেম নির্মাতা হিশেবেও ভেবেছেন- ‘যখন লিখি কখনো কখনো নিজেকে আমার ভিডিও গেম নির্মাতা মনে হয় এবং একই সাথে খেলোয়াড়ও। ধরো আমি একটি ভিডিও গেম তৈরী করছি এবং এর মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি। বাম হাত জানে না ডান হাত কি করছে। এটা এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। এক ধরনের বিভক্তির অনুভূতি।’ মুরাকামি একজন ঔপন্যাসিকের মানসিক প্রস্তুতির যে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে তা বর্ণনা করতে গিয়ে নানান প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। যার সবই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। তিনি সম্ভবত ঝিনুক রান্না এবং খেতে পছন্দ করেন। এর সাথেও তিনি উপন্যাস রচনার যোগ খুঁজে পেয়েছেন। বলছেন, ‘ঝিনুক রান্না করা এক ধরনের আনন্দ, কিন্তু তা একেবারে নিজস্ব অভিজ্ঞতা। যা অনেকটাই একাকিত্ব এবং স্বাধীনতার মধ্যকার সম্পর্কের মতো। তুমি খুঁজছো অভ্যন্তরে কী রয়েছে। তুমি তার প্রতিটি শব্দ অবিষ্কার করার চেষ্টা করছো। এটা অনেকটা নিজের ভেতরে নিজের সেঁধিয়ে যাওয়ার মতো কাজ। উপন্যাস লেখাও ঠিক ঝিনুক রান্নার মতো একটি ব্যপার। তুমি এ কাজটি করছো, কারণ তুমি এটি করতে পছন্দ করো। যখন আমার মানসিক চাপ বাড়ে, যখন ভাবি আমি উপন্যাস লিখছি, তখন ভাবি আমিতো ঝিনুক রান্না করছি। তাতে আমি ফুরফুরে হয়ে উঠি, কোন চাপ অনুভব করি না।’

আবার লেখালেখি অন্যকে আকর্ষণ প্রচেষ্টার মতোই একটি একনিষ্ঠ কাজ বলে মনে করেন হরুকি মুরাকামি। এক্ষেত্রে লেখালেখি মানে কোন একজন রমণীর দৃষ্টি আকর্ষণ চেষ্টা হিশেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এটি নিরন্ত চর্চার বিষয়, কিন্তু এ চেষ্টা অনেকটাই সহজাত।’

হারুকি মুরাকামির লেখার যে কল্পধাম তাতে ঠাসা কল্পনা। কল্পনারও যে বিভিন্ন স্তর আছে তাও পাওয়া গেলো সেখানে। আবার কেবল কল্পনা থাকলেইযে উপন্যাস হয়ে যাবে তাও কিন্তু নয়। তাকে পাঠকের জন্য বিলিয়ে দেয়ার যে প্রস্তুতি বা প্রক্রিয়া তাও একজন লেখককে নির্মাণ করতে হবে। বলার ভঙিতে হৃদম, সুর এবং যাদুর ব্যঞ্জনা একাকার হলে তবেই একজন পাঠক একজন ঔপন্যানিকের নতুন গ্রন্থের জন্য চণ্ডীদাসের মতো অপেক্ষা করবে!

তথ্যসূত্র:

জাজ মেসেঞ্জার-হারুকি মুরাকামি

দি নিউ ইয়র্কার ইন্টারভিউ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

হারুকি মুরাকামি, দি আর্ট অব ফিকশন, প্যারিস রিভিউ-২০০৪

দি আর্ট ডেস্ক, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

back to top