alt

সাময়িকী

শঙ্খ ঘোষের কবিতাভাবনা

কুলসুম হেনা

: বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১

কবিতার গুরু শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এ সময়ের বাংলা ভাষার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী

পৃথিবীর এই অসুখের কালে ক্রমশ দীর্ঘায়িত হওয়া মৃত্যুমিছিলে আমরা প্রতিদিন কত আশ্রয়-স্তম্ভকে হারিয়ে ফেলছি। সদ্য আমাদের মহীরুহ ছায়াবৃক্ষ কবি শঙ্খ ঘোষকে হারিয়ে সারা বাংলা এখন বেদনা-বিহ্বল। তাঁর প্রতি চিরশ্রদ্ধা।

সৃজন ও মননের যুগপৎ সম্মিলনে ঋদ্ধ বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবি শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১)। গত শতকের পাঁচের দশক থেকে বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখে বর্তমান সময়ের সাথেও সমানভাবে কর্মমুখর ছিলেন তিনি। তিনি মূলত কবি। এছাড়া শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, সমালোচক ইত্যাদি পরিচয়গুলোতেও তাঁর অবদান তাৎপর্যময়। কবিতা তাঁর আত্মপ্রকাশের প্রধানতম অনুষঙ্গ। তাঁর কবিসত্তা ও কবিতার মূল্যায়ন বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে করা প্রায় অসম্ভব। তবুও কেবল কবি শঙ্খকে জানার নিমিত্তে এই প্রয়াস একটি ক্ষুদ্র অন্বেষামাত্র।

দেশ ভাগের ম্লান ক্লান্তি, রাজনীতি ও অর্থনীতির অস্থির অনিশ্চয়তায় পূর্ণ কলকাতার নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ‘নিভন্ত চুল্লীতে’ আগুন দিতে ও আরেকটু কাল বাঁচার আনন্দ দিতে এবং নিতে শঙ্খ ঘোষ বাংলা কবিতার জগতে আসেন। তাঁর কবিসত্তা নির্জন ও ঐতিহ্যানুসারী। তথাকথিত জাঁকজমকপূর্ণতায় আস্থা না রেখে তিনি থাকেন ‘আপাত সারল্যের আড়ালে’। ক্রমাগত ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের মানুষকে তাদের সঙ্কটের দর্পণে হাজির করেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় : ‘ধ্বংস করে দাও/ আমাকে যদি চাও/ আমার সন্ততি থাকে থাক’।

তিনি যে কাব্যযাত্রার আরম্ভ করেন সেই ভ্রমণ তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত ছিল গতিময়। শঙ্খ ঘোষের অনুকরণযোগ্য যাপিত জীবন থেকে কবিসত্তার প্রাজ্ঞতার আভাস মেলে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা- উচ্চারণ ও মাধুর্যে সমানভাবে সমুজ্জ্বল। তাঁকে জানার প্রয়াসে অবলম্বন হয়েছে তাঁরই রচিত প্রবন্ধ সব। এসব প্রবন্ধে তিনি তাঁর কবিতার অভিপ্রায়, দায় সম্পর্কে জানিয়ে গিয়েছেন। কবিতার রূপ কেমন হওয়া উচিৎ তা তিনি সেসব লেখায় ব্যাখ্যা করেন। শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকাংশে তিনি বললেন :

“সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার। কিন্তু জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে আছি দিনরাত যে একটি কবিতার জন্যেও কখনো-কখনো অনেকদিন থেমে থাকতে হয়। উপরন্তু আমি যে আধুনিকতার কথা ভাবি সেখানে মন্থর পুনরাবৃত্তির কোনো মানে নেই, অবাধ প্রগলভতার কোনো প্রশ্রয় নেই। তাই কম লিখি বলে আমার ভয় হয় না।” (শঙ্খ ১৯৭০ : ৫)

বারংবার একই ধরনের লেখার পুনরাবৃত্তি করে কবিতার সংখ্যাগত পরিমাণকে বৃদ্ধি করায় অভ্যস্ত নন শঙ্খ ঘোষ। ‘সত্য’ শব্দটি আপেক্ষিক কিন্তু কবিতায় কবি শঙ্খ যে সত্যকে প্রকাশ করার কথা বলেন তা বোঝার জন্য তাঁর শব্দ ও সত্য গ্রন্থের আশ্রয় নিতে হয়। কবিতার মুহূর্তগুলি কেমন হওয়া উচিৎ সেটিও তিনি সেখানে বিশ্লেষণ করে দেখান। তাঁর কবিতার পরিমিতিবোধ ও প্রজ্ঞা প্রশস্তি দেয় পাঠককে। শুভ্রতার অনুভব দিতে পারে তাঁর কবিতা। গভীর জীবনবোধের প্রজ্ঞা ও দার্শনিকতায় ঋদ্ধ তাঁর কাব্যচর্চা। তাঁর কবিতার প্রকরণ যেনো হয়ে ওঠে ছন্দের তরঙ্গায়িত খেলা। রবীন্দ্রনাথ যেমন মনে করতেন আধুনিকতা সময়ের চেয়ে মর্জির সাথে বেশি সম্পর্কিত তেমনটির সাপেক্ষে শঙ্খ ঘোষের সত্তাকে বলা যেতে পারে আধুনিক মর্জির। তিনি আধুনিকতাকে কখনো স্বেচ্ছাচার মনে করেননি বা ‘হাংরি’র দৃষ্টিতে আধুনিকতার বিচার করেননি। তাঁর আধুনিকতা বলে : ‘শব্দ কোরো না/ হেসো না বাচ্চা/ চুপ, হাত পা ছুঁড়ো না’। তিনি আরো জানান যে লিখতে হবে নিঃশব্দে কবিতা এবং নিঃশব্দ কবিতা।

সমালোচকদের বেঁধে দেওয়া বিচারদণ্ডে কবিকে সীমায়িত করা অনুচিত; তবুও সর্বোত্তম শব্দ নির্বাচন, মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতাকে কবিতার মানদণ্ড হিসেবে আস্থা করলে শঙ্খ ঘোষের কবিতা এই তিনটি পরীক্ষাতেই অনায়াস উত্তীর্ণ হয়। শব্দের তো একক, সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকে না, তবে শব্দই তার পরবর্তী শব্দের চারিত্র্য নির্মাণ করে দেয়। রবার্ট পেন্ ওয়ারেন (১৯০৫-১৯৮৯) তাঁর অ্যান অ্যাপ্রোচ টু লিটারেচার এ্যান্ড আর্ন্ডাসটান্ডিং পোয়েট্ররি (১৯৩৪) গ্রন্থে ব্যাখ্যাসহ বলেন শব্দের চারিত্র্য ঠিক না হলে কবিতার ‘টোন’ নষ্ট হয়। শঙ্খ ঘোষও মনে করতেন কবিতার আক্ষরিক অর্থ নেই; তবে কবিতা যে কোনো সময় আগুন বা বৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে। পেন্ ওয়ারেনের ক্রনলজিকাল টাইম এ্যান্ড হিসটোরির যোগ থাকতে হয় কবিতায়।

পশ্চিমাবিশে^র গুরুত্বপূর্ণ কবি ডেরেক ওয়ালকট (১৯৩০-২০১৭) মনে করতেন- তৃতীয় বিশে^র কেন্দ্রে কবিরা বাস করেন আর প্রথম বিশে^ কবিদের বাস পরিধিতে এবং প্রথম বিশে^ কবিরা ততটা আদৃত বা মূল্যায়িত হন না। অর্থাৎ মুক্ত অর্থনীতির পুঁজিবাদী বিকাশের সাথে শিল্পের সম্পর্ক সমানুপাতিক নয়। উন্নত বিশে^র মানুষেরা সম্পর্কের মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়। নৈতিকতা, ভালোবাসা, বিশ্বাসকে অবলম্বন করে থাকা মানুষ যতটা সংবেদনশীল তার প্রকাশ ঘটে সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে। শঙ্খ ঘোষ সেই সংবেদনকে কবিতায় প্রকাশের গুরুভার হাতে নেন। শঙ্খ ঘোষ সময়ের সাথে আচ্ছন্ন নন, তাই তাঁর কবিতার পর্ব বিভাগ অর্থহীন। তাঁর প্রথম কবিতা থেকে শেষতম লেখা কবিতাটি পর্যন্ত একটি পূর্ণ কবিতা সৃষ্টির অভিযাত্রা। তাঁর কবিতার নন্দন কবিতাকে প্রসারিত হবার স্বাধীনতা দেয়। এক্ষেত্রে থিয়োডর অ্যাডোরনো বলেন : Art is social, not merely by virtue of its process of production... it becomes social by virtue of oppositional position to society itself, a position can occupy only by defending itself it’s autonomous.শঙ্খ ঘোষের কবিতার সেই অটোনোমাস শক্তি হলো তাঁর কবিতার জনমুখী নান্দনিকতা। শব্দের পরিমিতিবোধ ও অনুকরণযোগ্য শৈলী তাঁর কবিতাকে করে তোলে অপ্রতিম। আধুনিক জীবন ও জগতের বাস্তবতা যুগপৎভাবে তাঁর কবিতার পথ নির্মাণ করে। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বচলাচলের সত্যকে আবিষ্কার করে নেওয়াকেই কবির দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি।

কবির সত্তা নির্মিত হয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ তাঁর কবিসত্তাকে ধারণ করে। শব্দের চারিত্র্য ও তার বহুমাত্রিক ব্যবহারকে নিজস্ব রুচি ও পাণ্ডিত্য দ্বারা শঙ্খ ঘোষ আয়ত্ব করেন। তিনি মনে করেন নতুন শব্দ সৃষ্টি নয় বরং শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টি করাই কবির অভিপ্রায়। তাঁর কবিতা নির্মেদ এবং আভরণহীন অনাড়ম্বরতায় স্নিগ্ধ। তাঁর কবিতার দ্যুতি অবলোকন করা যায়।

দিনগুলি রাতগুলি (১৯৫৬) তাঁর প্রথম কাব্য। এর মাধ্যমেই তাঁর কবিজীবনের অভিযাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘজীবনের প্রতিটি সময়ে সমাজ, রাজনীতির অস্থিরতার অষন্তোষ প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে তাঁর কবিতা। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে কাব্যে তিনি লেখেন : ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্য গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’ কবি এখানে সময়ের বহমানতায় মুখ ও মুখোশের দিকে ইঙ্গিত করেন, কসমেটিক চেহারার দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। তিনি কেবল বিবর্তিত মনুষ্যত্বের সঙ্কটের দিকে আলো ফেলেন না। তিনি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। নৈতিকতার ও ক্ষমতার সহাবস্থান যে অসম্ভব তা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে নীতি রক্ষার ধারক হওয়া চলে না। এক ধরনের বাণীধর্মী ইঙ্গিতময়তা রয়েছে তাঁর কবিতায়। কবিতার সমাপনকে তিনি যুদ্ধের মতো করে দেখেন। তাঁর কবিতার প্রতিবাদ সার্বজনীনতায় রূপ ধারণ করে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। কবি শঙ্খ ঘোষের রাজনৈতিক প্রতীতি শেষজীবন পর্যন্ত কতটা স্বক্রিয় ছিল তা বুঝতে ২০১৮ সালে কবির লেখা একটি কবিতা স্মরণ করা জরুরি। তিনি লেখেন ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ নামে একটি কবিতা, যেখানে তিনি বলেন :

দেখ খুলে তোর তিন নয়ন

রাস্তা জুড়ে খড়গ হাতে

দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন

সবাই আমায় র্ক তোয়াজ

ছড়িয়ে যাবে দিগ্বিদিকে

মুক্ত গণতন্ত্র আজ।

বীরভূমের একজন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতার হীন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই কবিতা লেখেন। এই কবিতার জন্য সেই রাজনৈতিক নেতা যেভাবে তাঁকে অসম্মান করার চেষ্টা করেন সেটি তাঁর কবিতাকে আরো যথার্থ করে তোলে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীদের মুখে যে উন্নয়ন শব্দটি বারবার উচ্চারিত হয় আসলে সেই উচ্চারণের তলায় নিষ্পেষিত হয় মানুষ। ‘মুক্ত গণতন্ত্রে’ মানুষের যথেচ্ছ আয়ের স্বাধীনতায় কারা উন্নয়নের সুবিধা পায়, আর কারা পীড়িত হয় সে খবর কবির জানা। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চালিয়ে যাওয়া এই ক্ষমতাচর্চার বিদ্রুপ রচিত হয় এই কবিতায়। তিনি মনে করতেন ‘চিত্রগুপ্ত’র মতো করে রাজার হিসেব লিখে যাবেন তাঁর খাতায়। তাই তিনি এই সময়ের হিসেব-নিকেশ প্রকাশ করে যান তাঁর কবিতায়।

লাইনেই ছিলাম বাবা (১৯৯৩) কাব্যের ‘তুমি কোন দলে’ কবিতাটির পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থানগত সঙ্কট তাঁকে কতখানি নাড়া দেয়। তিনি লেখেন : ‘কী কাজ কী কথা সেটা তত বড়ো কথা নয় আগে বলো তুমি কোন্ দল/[...] বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল / আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল/ রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন্ দল তুমি কোন্ দল।’

কবির রাজনৈতিক প্রতীতি এক নির্মল নির্বেদ তুলনারহিত হয় যখন তিনি লেখেন : ‘ক্ষমতার উৎস থেকে ক্ষমতার মোহনা- যা বলো-/ সে কেবল ক্ষমতাকে দাপিয়ে বেড়ানো ক্ষমতায়।’ (চরিত্র)। কবির এই চেতনা দেশ-কাল পাত্রের সীমানা পেরিয়ে সত্যবচন হয়ে ওঠে। তাঁর কাব্যভাবনার চেয়ে অনুভবের সান্দ্রতা বেশি আবেগপূর্ণ। প্রকাশভঙ্গির পেলব, সৌকর্যের পাশাপাশি স্তিতধী বুদ্ধিজীবীর স্বচ্ছ চেতনা প্রাসঙ্গিকভাবে অবস্থান করে তাঁর ভেতর। তিনি এ বিষয়ে মনে করেন প্রাসঙ্গিক বলতে বোঝায় যে, সেটা অনুধাবনযোগ্য কিন্তু অনুকরণযোগ্য নাও হতে পারে। তিনি তাঁর সীমারেখা জানেন এবং নিঃশব্দ দ্বারা প্রকাশ করেন- যা বেশি করে বলতে চান। বিনির্মাণ নয় বরং নতুন সৃষ্টি তাঁর কাব্যসত্তাকে অভিনব করে তোলে। জীবনের শুরু থেকে একটি কথা বলে যান তিনি : ‘সুন্দর কথা কে আর শোনে/ দু-চারটি সত্য কথা বলো।’

শঙ্খ ঘোষের কবিতাচিন্তার স্বরূপ সন্ধানে গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছকে (১৯৯৪) অবলম্বন করতে চাই। ‘গান্ধর্ব’ শব্দের বেশ কয়েকটি অর্থ পৌরাণিক অভিধানে পাওয়া যায়। শঙ্খ ঘোষ এই কাব্যে স্বর্গের গায়ক যে গান্ধর্ব, তাদের কথা নির্দেশ করেন। বাংলা প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে স্বর্গের দেবতাদের স্তুতি করা হয়েছে- যার ধারা নমুনা এখনো কিছু সাহিত্যে রয়েছে। কেবল স্বর্গের নয়, মর্ত্যরে এমনকি পাতাল কন্যা অন্ত্যজ শ্রেণির মনসাকেও তুষ্টি করতে সাহিত্য রচিত হয়েছে। কারণ তিনি দেবী। স্বর্গে এই দেব-দেবীদের একধাপ নিচে বাস করেন গায়ক-বাদক দল অর্থাৎ গান্ধর্বরা। আর তারও একধাপ নিচে বাস অপ্সরাদের অর্থাৎ গান্ধর্ব সঙ্গিনীদের। মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দিরের প্যানেলেও সেই মতো বিন্যাসে থাকে উপরে দেবতা, মাঝের সারিতে গান্ধর্বরা এবং নিচের সারিতে নর্তকী প্রমোদিনীগণ। শিল্পের মাধ্যমে যৌনতার কলা প্রকাশের নিদর্শন হিসেবে শিল্পপিয়াসী মুসাফির সেইসব রমণীদের নিখুঁত স্তনের, নিতম্বের, কটিদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করেন, বিচার করেন শিল্পীর সৃষ্টিশীলতার মাত্রা। সেই শিল্পপর্যবেক্ষণের মুহূর্তে কেউ কি ভাবতে পারেন কেন এই সুন্দরীদের স্থান এত নি¤œগামী? শঙ্খ ঘোষ ভেবেছেন সেই কথা। সেই ভাবনার জ¦ালা তিনি মরমে গেঁথেছেন আর লিখেছেন গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ। তিনি দেবতাদের একধাপ নিচের অবস্থানে থাকা গন্ধর্বদের নিয়ে কবিতা কেনো লেখেন এবং তাদেরকে তিনি কী বলতে চান বা তাদের নিকট থেকে কবি কী শিখতে চান তা জানার প্রয়াস করা যায় এই কাব্যের মাধ্যমে। মহাদেব শিবের বড় ভক্ত এবং বিশ্বস্ত হলো এই গন্ধর্বরা। গান্ধর্বদের স্ত্রীদের মধ্যে রয়েছে উর্বশী, রম্ভা, মেনকারা। সমুদ্র মন্থন করে শিব যে অমৃত আহরণ করেন, সগর্বে সেই অমৃতের রক্ষক গন্ধর্বরা। তারা ভক্ষক নয় তাই কখনো এই অমৃত তারা পান করে না। চাইলেই পান করা যায় তবুও তা না করার যে সংযম সেই ত্যাগের ও আনন্দের উৎস শঙ্খ ঘোষ গান্ধর্বদের কাছ থেকে শিখে নিতে চান। স্বর্গের দেবতারা যখন সুরাসক্ত হয়ে পড়ে অপ্সরা অর্থাৎ গান্ধর্বের প্রিয়াদের প্রতি কামলিপ্সায় আক্রান্ত হয় তখনও গন্ধর্বরা সেতার বাজিয়ে যায়। সুরের সাধনায় মগ্ন থেকে ব্যক্তিগত দুঃখবোধকে জয় করে নেয় তারা। প্রত্যেক শিল্পী যেমন তার প্রতিবাদ রচনা করেন নিজের স্তম্ভে দাঁড়িয়ে এবং সেটা কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রতিবাদের মতো করে নয়। কবি শঙ্খ ঘোষ গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে গন্ধর্বদের নিকট থেকে কবির ধ্যান বা তপস্যার শিক্ষা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন। তিনি বলেন নিঃশব্দে কাজ করে যাবার কথা। শব্দের চেয়ে নৈঃশব্দ্যের কার্যক্ষমতা বেশি। শব্দে যা প্রকাশ হয় না, নিঃশব্দ সেই অপ্রকাশকে প্রকাশ করে দিতে পারে। গন্ধর্বরা উন্মাদ তাই তারা এই সাধনা চালিয়ে যেতে পারে। কবি বলেন : ‘গন্ধর্ব, উন্মাদ, তুমি অর্থহীন হাতে উঠে এসে/ জলমণ্ডলের ছায়া মাখিয়ে গিয়েছ এই মুখে/ তবু আজও বৃষ্টিহারা হয়ে আছে সমস্ত প্রবেশ/ আমারও পায়ের কাছে চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে।’ গন্ধর্বদের কাছে লজ্জাবনত কবি। এই কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় দেশভাগের নির্মমতার কথা। এক স্বার্থকে বাঁচাতে গিয়ে অন্যের সর্বনাশ করার মধ্য দিয়েই দেশভাগের দাঙ্গা তৈরি হয়। তাই কবি আর্তনাদ করে বলেন : ‘আমি সর্বনাশ দিয়ে সর্বনাশ বাঁচাতে গিয়েছি/ হাত ছুঁতে গিয়ে শুধু আগুন ছুঁয়েছি, আর তুমি/ শূন্যের ভিতরে ওই বিষণœ প্রতিভাকণা নিয়ে/ আমার মুখের দিকে চেয়ে আছো বিষম পাহাড়ে।’

অর্থাৎ দেশভাগের অন্যায়ের দাগ সবার হাতে লেগে রয়েছে। সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে প্রত্যেক বেঁচে যাওয়া মানুষটি তখন কোনো না কোনোভাবে অন্য কারোর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। এত গভীরে গিয়ে ভাবতে পারেন তিনি। এই কাব্য যখন লেখা হয় তখন কবি ছিলেন সিমলাতে। একা একটি বাংলো বাড়িতে পাহাড় আর নৈঃশব্দ্যের গান শুনতেন আর কবিতা লিখতেন। নির্জনতার মধ্য থেকেই কোলাহলের সবটুকুকে স্পর্শ করা যায়। কবি ব্যক্তিগত ব্যথা-বেদনাকে অতিক্রম করে সর্বজনীন, চিরন্তন ভাব ধারণ করতে পারেন তাঁর কবিতায়। শিল্পের কাজ সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ লেখেন এই কাব্যে। শব্দের অবাঙ বা নৈঃশব্দ্যের চর্চা করেন তিনি। নিঃসীম বেদনা এবং অপরের অসুখের সুখকে ধারণ করে গান্ধর্বরা। তাই কবি গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছের মাধ্যমে বলেন আত্মবিলাস নয় আত্মসন্ধান ও আত্মপোলব্ধির কাজ করতে হবে কবিকে। তিনি মনে করতেন মানুষের আভ্যন্তরিক ও বহিসত্তার পার্থক্য বুঝতে হবে। এর জন্য কবির গভীর মগ্নতা ও মনোলব্ধ অভিজ্ঞতা কবিতায় উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। মগ্নতা কবির দর্শনকে সামনে নিয়ে আসে। ‘স্মৃতিলোক’, ‘আত্মলোক’, ‘পৃথিবী’ এই তিনের সমন্বয়ে কবির মগ্নতা তৈরি হয়। কারণ এই তিনটিই জন্মভূমি থাকে সকলের।

বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ বিষয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ সন্দিহান ছিলেন কেননা বাংলা কবিতা বড় বাড়াবাড়ি রকমের পুরুষ উচ্চারণে পূর্ণ এবং কলরোলময় মিথ্যের আতিশয্যে ভরা। কবিতায় কবির ব্যক্তিগত চর্চা থাকা উচিৎ নয়। কবি যদি এই চর্চা করেন তাহলে মানুষের কাছে, প্রবৃত্তির কাছে হেরে যান কবি। পৃথিবীতে অমৃত-গরল যেমন আপেক্ষিক বিষয় তেমনি ব্যক্তিভেদে এর অনুভবও আলাদা হয়। তাই ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের গাঁথা রচনা না করে কবিতায় অপরের দুঃখকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে মানবাত্মার মঙ্গলের কাজ করাই কবিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হিসেবে মনে করেছেন শঙ্খ ঘোষ।

সাহিত্যের আঙ্গিক আধুনিক হওয়ায় কবিতার আঙ্গিকও পরিবর্তনশীল। আঙ্গিক শ্রুতিফল হওয়ার চেয়ে আঙ্গিক বাচনিক হওয়া এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ের কবিতা ব্যক্তিভেদে আলাদা স্বাদ দেয়। কবিতায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বহুল চর্চা করা হয় এখন। কবিতা হলো মানুষের ব্যর্থতাজাত নৈঃশব্দ্য। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন কবির কাজ হলো জীবনের সমার্থক সত্যকে প্রকাশ করা। অর্থাৎ কবিতার ভেতর নৈর্ব্যক্তিকতার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চেতনার প্রচার থেকে বিমুখ হওয়া প্রয়োজন। কবির কাজ কবিতার মাধ্যমে সামষ্টিক চেতনা তৈরির কাজ করে জাতীয় বিপ্লব গঠনে ভূমিকা রাখা। শঙ্খ ঘোষ আশা করেন কবিতা মানুষের ব্যর্থতাজাত হতাশার দলিল হয়ে উঠুক। অপ্রকাশের মধ্য দিয়ে, বক্তব্যহীনতার মধ্য দিয়ে একটা ভাব তুলে ধরতে চান কবি। ‘আমার কবিতা’ নামের প্রবন্ধটিতে কবি তাঁর কবিতার উদ্দেশ্য বিষয়ে বর্ণনা করেন। কবির উদ্দেশ্য সামষ্টিক অর্থে মর্মবেদনা উস্কে দেওয়া।

শরীর চৈতন্য, সামাজিক স্বপ্ন, বিচ্ছিন্নতাকে মহাকাব্যিক আকারে ধারণ করার নন্দনই শঙ্খ ঘোষের কবিতার, কবিসত্তার লক্ষ্য ও লড়াই। তিনি নিজেই নিজের প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠেননি কখনো। নিজেকেই বারবার অতিক্রম করে যান এবং সমাজবিন্দুতে অলঙ্ঘ্য নিয়মে ফেরেন এবং প্রতিবার পূর্ণাবয়ব পরিশোধিত কবিসত্তা নিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। দুটি আপাতবিরোধী অন্বেষায় কবি নিজেকে আলাদা করেন, স্বকীয় পরিভাষায় বৃত্ত হন এবং এর পাশাপাশি নিজেকে মিলিয়ে দেন সমাজ বা বিশেষ ভাবনা-অনুভাবনার সঙ্গে। শরবিদ্ধ শঙ্খ ঘোষ প্রতিনিয়ত সমবেত মানুষের হৃদয়ের বেদনাকে কবিতায় প্রকাশের চেষ্টা করেন।

স্বকালের এবং সমকালের কবিতাকে সাধারণত গুরুত্ব দেওয়া হয় না কিন্তু সেই গুরুত্ব শঙ্খ ঘোষ অর্জন করে নিয়েছিলেন। কারণ, প্রজ্ঞাশাসিত মনন ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে মানুষের চিরন্তনতা উপস্থাপনের প্রয়াসই ছিল তাঁর আমৃত্যু সক্রিয় কবিতাভাবনা।

তথ্য সহায়িকা :

শঙ্খ ঘোষ। কবিতার মুহূর্ত। কলকাতা : অনুষ্টুপ, ১৯৮৭

শঙ্খ ঘোষ। কবির অভিপ্রায়। কলকাতা : তালপাতা, ১৯৯৩

শঙ্খ ঘোষ। দেখার দৃষ্টি। ঢাকা : কথাপ্রকাশ, ২০০৬

শঙ্খ ঘোষ। শব্দ ও সত্য। কলকাতা : তালপাতা, ১৯৯৪

শঙ্খ ঘোষ। শেষ্ঠ কবিতা। কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৭০

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

শঙ্খ ঘোষের কবিতাভাবনা

কুলসুম হেনা

কবিতার গুরু শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এ সময়ের বাংলা ভাষার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী

বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১

পৃথিবীর এই অসুখের কালে ক্রমশ দীর্ঘায়িত হওয়া মৃত্যুমিছিলে আমরা প্রতিদিন কত আশ্রয়-স্তম্ভকে হারিয়ে ফেলছি। সদ্য আমাদের মহীরুহ ছায়াবৃক্ষ কবি শঙ্খ ঘোষকে হারিয়ে সারা বাংলা এখন বেদনা-বিহ্বল। তাঁর প্রতি চিরশ্রদ্ধা।

সৃজন ও মননের যুগপৎ সম্মিলনে ঋদ্ধ বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবি শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১)। গত শতকের পাঁচের দশক থেকে বাংলা সাহিত্যের নানা শাখায় সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখে বর্তমান সময়ের সাথেও সমানভাবে কর্মমুখর ছিলেন তিনি। তিনি মূলত কবি। এছাড়া শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, সমালোচক ইত্যাদি পরিচয়গুলোতেও তাঁর অবদান তাৎপর্যময়। কবিতা তাঁর আত্মপ্রকাশের প্রধানতম অনুষঙ্গ। তাঁর কবিসত্তা ও কবিতার মূল্যায়ন বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে করা প্রায় অসম্ভব। তবুও কেবল কবি শঙ্খকে জানার নিমিত্তে এই প্রয়াস একটি ক্ষুদ্র অন্বেষামাত্র।

দেশ ভাগের ম্লান ক্লান্তি, রাজনীতি ও অর্থনীতির অস্থির অনিশ্চয়তায় পূর্ণ কলকাতার নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ‘নিভন্ত চুল্লীতে’ আগুন দিতে ও আরেকটু কাল বাঁচার আনন্দ দিতে এবং নিতে শঙ্খ ঘোষ বাংলা কবিতার জগতে আসেন। তাঁর কবিসত্তা নির্জন ও ঐতিহ্যানুসারী। তথাকথিত জাঁকজমকপূর্ণতায় আস্থা না রেখে তিনি থাকেন ‘আপাত সারল্যের আড়ালে’। ক্রমাগত ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের মানুষকে তাদের সঙ্কটের দর্পণে হাজির করেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় : ‘ধ্বংস করে দাও/ আমাকে যদি চাও/ আমার সন্ততি থাকে থাক’।

তিনি যে কাব্যযাত্রার আরম্ভ করেন সেই ভ্রমণ তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত ছিল গতিময়। শঙ্খ ঘোষের অনুকরণযোগ্য যাপিত জীবন থেকে কবিসত্তার প্রাজ্ঞতার আভাস মেলে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা- উচ্চারণ ও মাধুর্যে সমানভাবে সমুজ্জ্বল। তাঁকে জানার প্রয়াসে অবলম্বন হয়েছে তাঁরই রচিত প্রবন্ধ সব। এসব প্রবন্ধে তিনি তাঁর কবিতার অভিপ্রায়, দায় সম্পর্কে জানিয়ে গিয়েছেন। কবিতার রূপ কেমন হওয়া উচিৎ তা তিনি সেসব লেখায় ব্যাখ্যা করেন। শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকাংশে তিনি বললেন :

“সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার। কিন্তু জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে আছি দিনরাত যে একটি কবিতার জন্যেও কখনো-কখনো অনেকদিন থেমে থাকতে হয়। উপরন্তু আমি যে আধুনিকতার কথা ভাবি সেখানে মন্থর পুনরাবৃত্তির কোনো মানে নেই, অবাধ প্রগলভতার কোনো প্রশ্রয় নেই। তাই কম লিখি বলে আমার ভয় হয় না।” (শঙ্খ ১৯৭০ : ৫)

বারংবার একই ধরনের লেখার পুনরাবৃত্তি করে কবিতার সংখ্যাগত পরিমাণকে বৃদ্ধি করায় অভ্যস্ত নন শঙ্খ ঘোষ। ‘সত্য’ শব্দটি আপেক্ষিক কিন্তু কবিতায় কবি শঙ্খ যে সত্যকে প্রকাশ করার কথা বলেন তা বোঝার জন্য তাঁর শব্দ ও সত্য গ্রন্থের আশ্রয় নিতে হয়। কবিতার মুহূর্তগুলি কেমন হওয়া উচিৎ সেটিও তিনি সেখানে বিশ্লেষণ করে দেখান। তাঁর কবিতার পরিমিতিবোধ ও প্রজ্ঞা প্রশস্তি দেয় পাঠককে। শুভ্রতার অনুভব দিতে পারে তাঁর কবিতা। গভীর জীবনবোধের প্রজ্ঞা ও দার্শনিকতায় ঋদ্ধ তাঁর কাব্যচর্চা। তাঁর কবিতার প্রকরণ যেনো হয়ে ওঠে ছন্দের তরঙ্গায়িত খেলা। রবীন্দ্রনাথ যেমন মনে করতেন আধুনিকতা সময়ের চেয়ে মর্জির সাথে বেশি সম্পর্কিত তেমনটির সাপেক্ষে শঙ্খ ঘোষের সত্তাকে বলা যেতে পারে আধুনিক মর্জির। তিনি আধুনিকতাকে কখনো স্বেচ্ছাচার মনে করেননি বা ‘হাংরি’র দৃষ্টিতে আধুনিকতার বিচার করেননি। তাঁর আধুনিকতা বলে : ‘শব্দ কোরো না/ হেসো না বাচ্চা/ চুপ, হাত পা ছুঁড়ো না’। তিনি আরো জানান যে লিখতে হবে নিঃশব্দে কবিতা এবং নিঃশব্দ কবিতা।

সমালোচকদের বেঁধে দেওয়া বিচারদণ্ডে কবিকে সীমায়িত করা অনুচিত; তবুও সর্বোত্তম শব্দ নির্বাচন, মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতাকে কবিতার মানদণ্ড হিসেবে আস্থা করলে শঙ্খ ঘোষের কবিতা এই তিনটি পরীক্ষাতেই অনায়াস উত্তীর্ণ হয়। শব্দের তো একক, সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকে না, তবে শব্দই তার পরবর্তী শব্দের চারিত্র্য নির্মাণ করে দেয়। রবার্ট পেন্ ওয়ারেন (১৯০৫-১৯৮৯) তাঁর অ্যান অ্যাপ্রোচ টু লিটারেচার এ্যান্ড আর্ন্ডাসটান্ডিং পোয়েট্ররি (১৯৩৪) গ্রন্থে ব্যাখ্যাসহ বলেন শব্দের চারিত্র্য ঠিক না হলে কবিতার ‘টোন’ নষ্ট হয়। শঙ্খ ঘোষও মনে করতেন কবিতার আক্ষরিক অর্থ নেই; তবে কবিতা যে কোনো সময় আগুন বা বৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে। পেন্ ওয়ারেনের ক্রনলজিকাল টাইম এ্যান্ড হিসটোরির যোগ থাকতে হয় কবিতায়।

পশ্চিমাবিশে^র গুরুত্বপূর্ণ কবি ডেরেক ওয়ালকট (১৯৩০-২০১৭) মনে করতেন- তৃতীয় বিশে^র কেন্দ্রে কবিরা বাস করেন আর প্রথম বিশে^ কবিদের বাস পরিধিতে এবং প্রথম বিশে^ কবিরা ততটা আদৃত বা মূল্যায়িত হন না। অর্থাৎ মুক্ত অর্থনীতির পুঁজিবাদী বিকাশের সাথে শিল্পের সম্পর্ক সমানুপাতিক নয়। উন্নত বিশে^র মানুষেরা সম্পর্কের মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়। নৈতিকতা, ভালোবাসা, বিশ্বাসকে অবলম্বন করে থাকা মানুষ যতটা সংবেদনশীল তার প্রকাশ ঘটে সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে। শঙ্খ ঘোষ সেই সংবেদনকে কবিতায় প্রকাশের গুরুভার হাতে নেন। শঙ্খ ঘোষ সময়ের সাথে আচ্ছন্ন নন, তাই তাঁর কবিতার পর্ব বিভাগ অর্থহীন। তাঁর প্রথম কবিতা থেকে শেষতম লেখা কবিতাটি পর্যন্ত একটি পূর্ণ কবিতা সৃষ্টির অভিযাত্রা। তাঁর কবিতার নন্দন কবিতাকে প্রসারিত হবার স্বাধীনতা দেয়। এক্ষেত্রে থিয়োডর অ্যাডোরনো বলেন : Art is social, not merely by virtue of its process of production... it becomes social by virtue of oppositional position to society itself, a position can occupy only by defending itself it’s autonomous.শঙ্খ ঘোষের কবিতার সেই অটোনোমাস শক্তি হলো তাঁর কবিতার জনমুখী নান্দনিকতা। শব্দের পরিমিতিবোধ ও অনুকরণযোগ্য শৈলী তাঁর কবিতাকে করে তোলে অপ্রতিম। আধুনিক জীবন ও জগতের বাস্তবতা যুগপৎভাবে তাঁর কবিতার পথ নির্মাণ করে। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বচলাচলের সত্যকে আবিষ্কার করে নেওয়াকেই কবির দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি।

কবির সত্তা নির্মিত হয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ তাঁর কবিসত্তাকে ধারণ করে। শব্দের চারিত্র্য ও তার বহুমাত্রিক ব্যবহারকে নিজস্ব রুচি ও পাণ্ডিত্য দ্বারা শঙ্খ ঘোষ আয়ত্ব করেন। তিনি মনে করেন নতুন শব্দ সৃষ্টি নয় বরং শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টি করাই কবির অভিপ্রায়। তাঁর কবিতা নির্মেদ এবং আভরণহীন অনাড়ম্বরতায় স্নিগ্ধ। তাঁর কবিতার দ্যুতি অবলোকন করা যায়।

দিনগুলি রাতগুলি (১৯৫৬) তাঁর প্রথম কাব্য। এর মাধ্যমেই তাঁর কবিজীবনের অভিযাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘজীবনের প্রতিটি সময়ে সমাজ, রাজনীতির অস্থিরতার অষন্তোষ প্রকাশের মাধ্যম হয়েছে তাঁর কবিতা। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে কাব্যে তিনি লেখেন : ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্য গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’ কবি এখানে সময়ের বহমানতায় মুখ ও মুখোশের দিকে ইঙ্গিত করেন, কসমেটিক চেহারার দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। তিনি কেবল বিবর্তিত মনুষ্যত্বের সঙ্কটের দিকে আলো ফেলেন না। তিনি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। নৈতিকতার ও ক্ষমতার সহাবস্থান যে অসম্ভব তা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে নীতি রক্ষার ধারক হওয়া চলে না। এক ধরনের বাণীধর্মী ইঙ্গিতময়তা রয়েছে তাঁর কবিতায়। কবিতার সমাপনকে তিনি যুদ্ধের মতো করে দেখেন। তাঁর কবিতার প্রতিবাদ সার্বজনীনতায় রূপ ধারণ করে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। কবি শঙ্খ ঘোষের রাজনৈতিক প্রতীতি শেষজীবন পর্যন্ত কতটা স্বক্রিয় ছিল তা বুঝতে ২০১৮ সালে কবির লেখা একটি কবিতা স্মরণ করা জরুরি। তিনি লেখেন ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ নামে একটি কবিতা, যেখানে তিনি বলেন :

দেখ খুলে তোর তিন নয়ন

রাস্তা জুড়ে খড়গ হাতে

দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন

সবাই আমায় র্ক তোয়াজ

ছড়িয়ে যাবে দিগ্বিদিকে

মুক্ত গণতন্ত্র আজ।

বীরভূমের একজন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতার হীন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই কবিতা লেখেন। এই কবিতার জন্য সেই রাজনৈতিক নেতা যেভাবে তাঁকে অসম্মান করার চেষ্টা করেন সেটি তাঁর কবিতাকে আরো যথার্থ করে তোলে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীদের মুখে যে উন্নয়ন শব্দটি বারবার উচ্চারিত হয় আসলে সেই উচ্চারণের তলায় নিষ্পেষিত হয় মানুষ। ‘মুক্ত গণতন্ত্রে’ মানুষের যথেচ্ছ আয়ের স্বাধীনতায় কারা উন্নয়নের সুবিধা পায়, আর কারা পীড়িত হয় সে খবর কবির জানা। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চালিয়ে যাওয়া এই ক্ষমতাচর্চার বিদ্রুপ রচিত হয় এই কবিতায়। তিনি মনে করতেন ‘চিত্রগুপ্ত’র মতো করে রাজার হিসেব লিখে যাবেন তাঁর খাতায়। তাই তিনি এই সময়ের হিসেব-নিকেশ প্রকাশ করে যান তাঁর কবিতায়।

লাইনেই ছিলাম বাবা (১৯৯৩) কাব্যের ‘তুমি কোন দলে’ কবিতাটির পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থানগত সঙ্কট তাঁকে কতখানি নাড়া দেয়। তিনি লেখেন : ‘কী কাজ কী কথা সেটা তত বড়ো কথা নয় আগে বলো তুমি কোন্ দল/[...] বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল / আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল/ রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন্ দল তুমি কোন্ দল।’

কবির রাজনৈতিক প্রতীতি এক নির্মল নির্বেদ তুলনারহিত হয় যখন তিনি লেখেন : ‘ক্ষমতার উৎস থেকে ক্ষমতার মোহনা- যা বলো-/ সে কেবল ক্ষমতাকে দাপিয়ে বেড়ানো ক্ষমতায়।’ (চরিত্র)। কবির এই চেতনা দেশ-কাল পাত্রের সীমানা পেরিয়ে সত্যবচন হয়ে ওঠে। তাঁর কাব্যভাবনার চেয়ে অনুভবের সান্দ্রতা বেশি আবেগপূর্ণ। প্রকাশভঙ্গির পেলব, সৌকর্যের পাশাপাশি স্তিতধী বুদ্ধিজীবীর স্বচ্ছ চেতনা প্রাসঙ্গিকভাবে অবস্থান করে তাঁর ভেতর। তিনি এ বিষয়ে মনে করেন প্রাসঙ্গিক বলতে বোঝায় যে, সেটা অনুধাবনযোগ্য কিন্তু অনুকরণযোগ্য নাও হতে পারে। তিনি তাঁর সীমারেখা জানেন এবং নিঃশব্দ দ্বারা প্রকাশ করেন- যা বেশি করে বলতে চান। বিনির্মাণ নয় বরং নতুন সৃষ্টি তাঁর কাব্যসত্তাকে অভিনব করে তোলে। জীবনের শুরু থেকে একটি কথা বলে যান তিনি : ‘সুন্দর কথা কে আর শোনে/ দু-চারটি সত্য কথা বলো।’

শঙ্খ ঘোষের কবিতাচিন্তার স্বরূপ সন্ধানে গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছকে (১৯৯৪) অবলম্বন করতে চাই। ‘গান্ধর্ব’ শব্দের বেশ কয়েকটি অর্থ পৌরাণিক অভিধানে পাওয়া যায়। শঙ্খ ঘোষ এই কাব্যে স্বর্গের গায়ক যে গান্ধর্ব, তাদের কথা নির্দেশ করেন। বাংলা প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে স্বর্গের দেবতাদের স্তুতি করা হয়েছে- যার ধারা নমুনা এখনো কিছু সাহিত্যে রয়েছে। কেবল স্বর্গের নয়, মর্ত্যরে এমনকি পাতাল কন্যা অন্ত্যজ শ্রেণির মনসাকেও তুষ্টি করতে সাহিত্য রচিত হয়েছে। কারণ তিনি দেবী। স্বর্গে এই দেব-দেবীদের একধাপ নিচে বাস করেন গায়ক-বাদক দল অর্থাৎ গান্ধর্বরা। আর তারও একধাপ নিচে বাস অপ্সরাদের অর্থাৎ গান্ধর্ব সঙ্গিনীদের। মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দিরের প্যানেলেও সেই মতো বিন্যাসে থাকে উপরে দেবতা, মাঝের সারিতে গান্ধর্বরা এবং নিচের সারিতে নর্তকী প্রমোদিনীগণ। শিল্পের মাধ্যমে যৌনতার কলা প্রকাশের নিদর্শন হিসেবে শিল্পপিয়াসী মুসাফির সেইসব রমণীদের নিখুঁত স্তনের, নিতম্বের, কটিদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করেন, বিচার করেন শিল্পীর সৃষ্টিশীলতার মাত্রা। সেই শিল্পপর্যবেক্ষণের মুহূর্তে কেউ কি ভাবতে পারেন কেন এই সুন্দরীদের স্থান এত নি¤œগামী? শঙ্খ ঘোষ ভেবেছেন সেই কথা। সেই ভাবনার জ¦ালা তিনি মরমে গেঁথেছেন আর লিখেছেন গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ। তিনি দেবতাদের একধাপ নিচের অবস্থানে থাকা গন্ধর্বদের নিয়ে কবিতা কেনো লেখেন এবং তাদেরকে তিনি কী বলতে চান বা তাদের নিকট থেকে কবি কী শিখতে চান তা জানার প্রয়াস করা যায় এই কাব্যের মাধ্যমে। মহাদেব শিবের বড় ভক্ত এবং বিশ্বস্ত হলো এই গন্ধর্বরা। গান্ধর্বদের স্ত্রীদের মধ্যে রয়েছে উর্বশী, রম্ভা, মেনকারা। সমুদ্র মন্থন করে শিব যে অমৃত আহরণ করেন, সগর্বে সেই অমৃতের রক্ষক গন্ধর্বরা। তারা ভক্ষক নয় তাই কখনো এই অমৃত তারা পান করে না। চাইলেই পান করা যায় তবুও তা না করার যে সংযম সেই ত্যাগের ও আনন্দের উৎস শঙ্খ ঘোষ গান্ধর্বদের কাছ থেকে শিখে নিতে চান। স্বর্গের দেবতারা যখন সুরাসক্ত হয়ে পড়ে অপ্সরা অর্থাৎ গান্ধর্বের প্রিয়াদের প্রতি কামলিপ্সায় আক্রান্ত হয় তখনও গন্ধর্বরা সেতার বাজিয়ে যায়। সুরের সাধনায় মগ্ন থেকে ব্যক্তিগত দুঃখবোধকে জয় করে নেয় তারা। প্রত্যেক শিল্পী যেমন তার প্রতিবাদ রচনা করেন নিজের স্তম্ভে দাঁড়িয়ে এবং সেটা কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রতিবাদের মতো করে নয়। কবি শঙ্খ ঘোষ গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে গন্ধর্বদের নিকট থেকে কবির ধ্যান বা তপস্যার শিক্ষা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন। তিনি বলেন নিঃশব্দে কাজ করে যাবার কথা। শব্দের চেয়ে নৈঃশব্দ্যের কার্যক্ষমতা বেশি। শব্দে যা প্রকাশ হয় না, নিঃশব্দ সেই অপ্রকাশকে প্রকাশ করে দিতে পারে। গন্ধর্বরা উন্মাদ তাই তারা এই সাধনা চালিয়ে যেতে পারে। কবি বলেন : ‘গন্ধর্ব, উন্মাদ, তুমি অর্থহীন হাতে উঠে এসে/ জলমণ্ডলের ছায়া মাখিয়ে গিয়েছ এই মুখে/ তবু আজও বৃষ্টিহারা হয়ে আছে সমস্ত প্রবেশ/ আমারও পায়ের কাছে চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে।’ গন্ধর্বদের কাছে লজ্জাবনত কবি। এই কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় দেশভাগের নির্মমতার কথা। এক স্বার্থকে বাঁচাতে গিয়ে অন্যের সর্বনাশ করার মধ্য দিয়েই দেশভাগের দাঙ্গা তৈরি হয়। তাই কবি আর্তনাদ করে বলেন : ‘আমি সর্বনাশ দিয়ে সর্বনাশ বাঁচাতে গিয়েছি/ হাত ছুঁতে গিয়ে শুধু আগুন ছুঁয়েছি, আর তুমি/ শূন্যের ভিতরে ওই বিষণœ প্রতিভাকণা নিয়ে/ আমার মুখের দিকে চেয়ে আছো বিষম পাহাড়ে।’

অর্থাৎ দেশভাগের অন্যায়ের দাগ সবার হাতে লেগে রয়েছে। সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে প্রত্যেক বেঁচে যাওয়া মানুষটি তখন কোনো না কোনোভাবে অন্য কারোর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। এত গভীরে গিয়ে ভাবতে পারেন তিনি। এই কাব্য যখন লেখা হয় তখন কবি ছিলেন সিমলাতে। একা একটি বাংলো বাড়িতে পাহাড় আর নৈঃশব্দ্যের গান শুনতেন আর কবিতা লিখতেন। নির্জনতার মধ্য থেকেই কোলাহলের সবটুকুকে স্পর্শ করা যায়। কবি ব্যক্তিগত ব্যথা-বেদনাকে অতিক্রম করে সর্বজনীন, চিরন্তন ভাব ধারণ করতে পারেন তাঁর কবিতায়। শিল্পের কাজ সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ লেখেন এই কাব্যে। শব্দের অবাঙ বা নৈঃশব্দ্যের চর্চা করেন তিনি। নিঃসীম বেদনা এবং অপরের অসুখের সুখকে ধারণ করে গান্ধর্বরা। তাই কবি গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছের মাধ্যমে বলেন আত্মবিলাস নয় আত্মসন্ধান ও আত্মপোলব্ধির কাজ করতে হবে কবিকে। তিনি মনে করতেন মানুষের আভ্যন্তরিক ও বহিসত্তার পার্থক্য বুঝতে হবে। এর জন্য কবির গভীর মগ্নতা ও মনোলব্ধ অভিজ্ঞতা কবিতায় উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। মগ্নতা কবির দর্শনকে সামনে নিয়ে আসে। ‘স্মৃতিলোক’, ‘আত্মলোক’, ‘পৃথিবী’ এই তিনের সমন্বয়ে কবির মগ্নতা তৈরি হয়। কারণ এই তিনটিই জন্মভূমি থাকে সকলের।

বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ বিষয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ সন্দিহান ছিলেন কেননা বাংলা কবিতা বড় বাড়াবাড়ি রকমের পুরুষ উচ্চারণে পূর্ণ এবং কলরোলময় মিথ্যের আতিশয্যে ভরা। কবিতায় কবির ব্যক্তিগত চর্চা থাকা উচিৎ নয়। কবি যদি এই চর্চা করেন তাহলে মানুষের কাছে, প্রবৃত্তির কাছে হেরে যান কবি। পৃথিবীতে অমৃত-গরল যেমন আপেক্ষিক বিষয় তেমনি ব্যক্তিভেদে এর অনুভবও আলাদা হয়। তাই ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের গাঁথা রচনা না করে কবিতায় অপরের দুঃখকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে মানবাত্মার মঙ্গলের কাজ করাই কবিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হিসেবে মনে করেছেন শঙ্খ ঘোষ।

সাহিত্যের আঙ্গিক আধুনিক হওয়ায় কবিতার আঙ্গিকও পরিবর্তনশীল। আঙ্গিক শ্রুতিফল হওয়ার চেয়ে আঙ্গিক বাচনিক হওয়া এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ের কবিতা ব্যক্তিভেদে আলাদা স্বাদ দেয়। কবিতায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বহুল চর্চা করা হয় এখন। কবিতা হলো মানুষের ব্যর্থতাজাত নৈঃশব্দ্য। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন কবির কাজ হলো জীবনের সমার্থক সত্যকে প্রকাশ করা। অর্থাৎ কবিতার ভেতর নৈর্ব্যক্তিকতার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চেতনার প্রচার থেকে বিমুখ হওয়া প্রয়োজন। কবির কাজ কবিতার মাধ্যমে সামষ্টিক চেতনা তৈরির কাজ করে জাতীয় বিপ্লব গঠনে ভূমিকা রাখা। শঙ্খ ঘোষ আশা করেন কবিতা মানুষের ব্যর্থতাজাত হতাশার দলিল হয়ে উঠুক। অপ্রকাশের মধ্য দিয়ে, বক্তব্যহীনতার মধ্য দিয়ে একটা ভাব তুলে ধরতে চান কবি। ‘আমার কবিতা’ নামের প্রবন্ধটিতে কবি তাঁর কবিতার উদ্দেশ্য বিষয়ে বর্ণনা করেন। কবির উদ্দেশ্য সামষ্টিক অর্থে মর্মবেদনা উস্কে দেওয়া।

শরীর চৈতন্য, সামাজিক স্বপ্ন, বিচ্ছিন্নতাকে মহাকাব্যিক আকারে ধারণ করার নন্দনই শঙ্খ ঘোষের কবিতার, কবিসত্তার লক্ষ্য ও লড়াই। তিনি নিজেই নিজের প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠেননি কখনো। নিজেকেই বারবার অতিক্রম করে যান এবং সমাজবিন্দুতে অলঙ্ঘ্য নিয়মে ফেরেন এবং প্রতিবার পূর্ণাবয়ব পরিশোধিত কবিসত্তা নিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। দুটি আপাতবিরোধী অন্বেষায় কবি নিজেকে আলাদা করেন, স্বকীয় পরিভাষায় বৃত্ত হন এবং এর পাশাপাশি নিজেকে মিলিয়ে দেন সমাজ বা বিশেষ ভাবনা-অনুভাবনার সঙ্গে। শরবিদ্ধ শঙ্খ ঘোষ প্রতিনিয়ত সমবেত মানুষের হৃদয়ের বেদনাকে কবিতায় প্রকাশের চেষ্টা করেন।

স্বকালের এবং সমকালের কবিতাকে সাধারণত গুরুত্ব দেওয়া হয় না কিন্তু সেই গুরুত্ব শঙ্খ ঘোষ অর্জন করে নিয়েছিলেন। কারণ, প্রজ্ঞাশাসিত মনন ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে মানুষের চিরন্তনতা উপস্থাপনের প্রয়াসই ছিল তাঁর আমৃত্যু সক্রিয় কবিতাভাবনা।

তথ্য সহায়িকা :

শঙ্খ ঘোষ। কবিতার মুহূর্ত। কলকাতা : অনুষ্টুপ, ১৯৮৭

শঙ্খ ঘোষ। কবির অভিপ্রায়। কলকাতা : তালপাতা, ১৯৯৩

শঙ্খ ঘোষ। দেখার দৃষ্টি। ঢাকা : কথাপ্রকাশ, ২০০৬

শঙ্খ ঘোষ। শব্দ ও সত্য। কলকাতা : তালপাতা, ১৯৯৪

শঙ্খ ঘোষ। শেষ্ঠ কবিতা। কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৭০

back to top