alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : দুই

শিকিবু

আবুল কাসেম

: বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

তিন.

জাপানিরা উৎসবপ্রিয় জাতি। হেইয়ান সম্রাটের দরবারে সারা বৎসরই কোনো না কোনো রাজকীয় উৎসব লেগে থাকে। উৎসবের আয়োজন, সাজসজ্জা (ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত) এবং খাবার-দাবারে একটা ঐতিহ্যিক ধারাকে অনুসরণ করা হয় এসব উৎসবে।

জিদাই মাতসুরি নামের উৎসবের আগে উৎসব বিষয়ক মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে বসেছেন। কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন মন্ত্রণালয়ের মুখ্য কর্মকর্তা (সচিব) ফুজিওয়ারা নো তামোতাকি এবং ফুজিওয়ারা নো নোবুতাকাসহ আরো কেউ কেউ। হেইয়ান জিনগু শ্রাইনের প্রধান পুরোহিত এবং অভিজাত ফুজিওয়ারা নো মিচিনাগা সম্রাটের পক্ষে উপস্থিত হয়েছেন। এ উৎসবটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন জাপানের হেইয়ান সম্রাটদের আমলের তিনটি প্রধান উৎসবের অন্যতম একটি।

উৎসবে কী কী থাকছে, তার একটা রূপরেখা পেশ করলেন ফুজিওয়ারা নো তামেতোকি। তিনি মূলত বিভাগটির প্রধান। বললেন, ঐতিহ্যবাহী এ বর্ণাঢ্য উৎসবে কিয়োটোর সকল মানুষ তো অংশ নেবেই, জাপানের অন্যান্য প্রদেশ থেকেও প্রতি বৎসরের মতো অভিজাত লোকজন এসে অংশ নেবেন। উৎসবের প্রধান আকর্ষণ বিশাল শোভাযাত্রা। সম্রাটের প্রাসাদ থেকে যাত্রা শুরু করে হেইয়ান শিনগু শ্রাইনে এসে শেষ হবে।

ফুজিওয়ারা নো মিচিনাগা বললেন, এসব আমরা জানি। উৎসবে কী কী থাকবে আমি বলে দিচ্ছি।

তার কথায় কেউ আপত্তি করলেন না। এমনকি মন্ত্রীও হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালেন। সম্রাটের প্রাসাদে তার অত্যধিক প্রভাবের কথা সবাই জানেন। প্রধান পুরোহিত জাপানের অভিজাত সমাজে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা রাখেন। তিনিও বললেন, সময় আমাদের জন্য মূল্যবান, মিচিনাগা সানই বলে দিন উৎসবে কী কী থাকবে।

মিচিনাগা বললেন, সম্রাটের প্রাসাদ উত্তমরূপে সাজাতে হবে যেন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়। বস্ত্রালংকরণে বাইরে চিত্রকররা পটচিত্র অংকন করবেন। পথযাত্রায় দৃষ্টি গোচরযোগ্য পথনক্সা অংকন করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী অভিজাত পোশাক পরিহিত অবস্থায় থাকবে নারী-পুরুষ সবাই। এবং তা উৎসবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। কপালের ভ্রুযুগল যেন পোশাকের সঙ্গে দ্বৈরথ রচনা করে। জুতার চাকচিক্য এবং নক্সা পথনক্সার সঙ্গে সামঞ্জজ্যপূর্ণ হবে। এবারে নোবুতাকা বল শোভাযাত্রায় কী কী থাকছে?

নোবুতাকা বললেন, শোভাযাত্রা এ উৎসবের প্রাণ।

মিশনাগা বললেন, এ আর নতুন কথা কী। আমি বলে দিচ্ছি টুকে রাখো। প্রথম আসছে মিকোশি (বহনযোগ্য শ্রাইন) এর কথা। প্রতিবারের মতো প্রধান পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে এটি নির্মিত হবে। অলংকরণে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে। রাজকীয় হওয়া চাই, এতে যেন কোনো কার্পণ্য না থাকে। উৎসবটি মূলত জিদাই গায়োবেতসু বা মুক্তাঙ্গন বিনোদন, যাতে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনকালের পোশাক পরিধান করে ইতিহাসের সেসব কালকে তুলে ধরা, যেসব কাল জাপানের ঐশ্বর্যকে ধারণ করে আছে। নোবুতাকা বল, এ ব্যাপারে তোমাদের পরিকল্পনা কী?

নোবুতাকা বললেন, দুই হাজার প্রশিক্ষিত অংশগ্রহণকারী বারশো বছরের নানা পোশাক, সাজসজ্জা মুখোশ প্রভৃতি পরিধান করে, সে সময়কার ঐতিহ্যবাহী শকটযান, বাড়িঘরের স্থাপত্য রেপ্লিকা, নাটক (কাবুকি, নো এবং বুনরাকু) মঞ্চায়ন দেখাতে দেখাতে শোভাযাত্রা করে আসবে। রাজকীয় যন্ত্রসঙ্গীত (প্রাচীন কালের) বাজাবে যন্ত্রীদল।

কারা বাজাবে? জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রী।

নোবুতাকা বললেন, প্রথমবারের মতো রাজকীয় সামরিক বাদক দল। আর যা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, এবারে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ থাকবে সামুরাই পোশাকে সেনাবাহিনীর। সাধারণ মানুষ তো থাকছেই। তারা তাদের মতো সাজবে।

আইনশৃঙ্খলা দেখছে কে?

উপস্থিত সেনাপ্রধানের প্রতিনিধি বললেন, আমরাই বরাবরের মতো সে দায়িত্ব পালন করব, মাননীয় মন্ত্রী।

মন্ত্রী বললেন, সেনাপ্রধান কোথায়?

তাকে মাহমান্য সম্রাট ডেকে পাঠিয়েছেন।

শোভাযাত্রায় থাকবেন।

মিচিনাগার দিকে তাকিয়ে মন্ত্রী বললেন, আচ্ছা।

মিচিনাগা বললেন, এবারে জিনগু শ্রাইনের প্রধান পুরোহিত বলুন, আপনার পরিকল্পনা কী?

মহামান্য সম্রাট শ্রাইনে আসবেন শোভাযাত্রার সঙ্গে। আমরা প্রতি বছরের মতো তা মাথায় রেখে যাবতীয় আয়োজন এবং প্রস্তুতি রাখছি। এখানে ধর্মীয় আচার শেষে সম্রাট এবং জাপানের জন্য মঙ্গল কামনা করে দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হবে। মিচিনাগা বললেন, এ বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কী বলেন মন্ত্রী সাহেব?

মন্ত্রী বলেন, না নেই। তবে একটি বিষয় বাদ পড়ে গেছে। এবারে নতুন সংযোজন রাজকীয় সামরিক যন্ত্রসঙ্গীত। তা ঠিক আছে। প্রাচীন জাপানের ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত বাদ যাবে কেন? সাধারণ মানুষের আনন্দের জন্য নানা চলমান যানে চড়ে বাদক দল এবং শিল্পীরা আগের মতোই প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান পরিবেশন করে সবাইকে আনন্দ দেবে। সবাই হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লেন।

মন্ত্রণালয়ের সচিব সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন।

মন্ত্রী বললেন, আমাদের প্রস্তুতি সভা শেষ। পুরোহিতবর্গ, মিচিনাগা সান এবং সচিব বসুন। সবাই চলে গেলে বললেন, প্রতি বছরই ঐতিহ্যের প্রশ্নে একটি বিতর্ক উপস্থিত হয়।

সবাই জানেন বিতর্কটা কী নিয়ে, তাই মন্ত্রী তা বললেন না। মিচিনাগা বললেন, তাতে মহামান্য সম্রাট এবং আমরা বিব্রত হই। যদি উৎসবটা ঐতিহ্যবাহী আনন্দ উৎসব হয়, তাতে কোনো বিভক্তি থাকা ঠিক নয়।

মন্ত্রী বললেন, হেইয়ান মানেই তো হচ্ছে শান্তি। শিন্টু ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম একই শাস্তির বাণী নিয়ে এসেছে। আমরা আনন্দিত যে, এ দুটো ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

প্রধান পুরোহিত বললেন, বৌদ্ধধর্মের দুটো ধারায় পার্থক্য সামান্যই। জাপানে তেনদাই হচ্ছে চীনা তিয়ানতাই। যার মূলে আছে পদ্মসূত্র। মহাযানের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র এটি। সাইচো ভিক্ষু তা জাপানে চালু করেছেন। তার এখন চর্চা হচ্ছে হাই এই পার্বত্য শ্রমন কমপ্লেক্সে। এক সময় সম্রাটের দরবারে তার স্থান ছিল। শিনগণও এসেছে চীনা ঝেনইয়েন মতবাদ থেকে। এর মূলে আছে তিব্বতের বজ্রযানী বৌদ্ধমতবাদ। ভিক্ষু কুকাই তা জাপানে প্রবর্তন করেন। এ শনগণের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র আছে- যাতে রয়েছে প্রতীকী সত্য, মানদালা, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান এবং মন্ত্রোচচারণ। এসবের আবেদন ব্যাপক। ভিক্ষু কুকাই কবিতা লিখতে পারতেন, চিত্র অংকন করতেন, হস্তাক্ষর ছিল লিপিকলার আদর্শ এবং সর্বোপরি ছিল তার ভাস্কর্য নির্মাণ দক্ষতা। এসব দিয়ে তিনি সম্রাট কানমুকে অভিভূত করে ফেলেন। শিনগণ সম্রাটের দরবারে উঠে আসে এবং সেই থেকে আছে। মহামান্য সম্রাট যে মতবাদ পছন্দ করেন তাকেই আমাদের অনুসরণ করতে হবে।

মিচিনাগা বললেন, তা ঠিক বলেছেন।

মন্ত্রী কোনো মন্তব্য করলেন না।

তার ভেতর ভিন্ন কিছু থাকলেও এখন তা প্রকাশিতব্য নয়।

প্রতি বৎসর উৎসবের এই দিনটিতে (২২ অক্টোবর) কিয়োটোতে বাঁধভাঙ্গা আনন্দের ঢল নামে। কিয়োটের এক লক্ষ মানুষের কেউই ঘরে থাকে না। নানা ইভেন্টে যারা অংশ নিতে পারে না, তারা দুই মাইল দীর্ঘ পথের ধারে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে।

হেইয়ান সাম্রাজ্যে সম্রাটকে সবাই শ্রদ্ধা করে। শোভাযাত্রার সামনে চলমান শ্রাইনের পেছনেই সম্রাটের বাহন। তাকে দেখে উল্লসিত জনতা শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায়। সম্রাট ইচিজো মাতা নত করে তার জবাব দেন। জনতা উল্লাসে ফেটে পড়েন।

শোভাযাত্রাটা অতিরাজকীয় হয়ে উঠেছে শামুরাই পোশাকে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে। তাদের সাজসজ্জা এবং সামুরাই তরবারির ঝলকানি মনোমুগ্ধকর। রাজকীয় সঙ্গীত ও বাজনা (ইম্পেরিয়াল মিউজিক) তার উচ্চতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

নানা শকটে সম্রাটের অমাত্যরা যাচ্ছেন। তাদের পেছনে সম্রাটের উৎসব বিভাগের লোকজন। শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন সেনাবাহিনী। তার অবশ্য দরকার ছিল না। কিয়োটোয় জাপানিরা বেশ সুশৃঙ্খল এবং আইন মান্যকারী। এরা অভিজাত শুধু পোশাক-আশাকে নয়, আচার-আচরণেও তার প্রকাশ ঘটছে।

শোভাযাত্রাটাকে এক অসাধারণ শিল্পে রূপায়িত করা হয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে দুই মাইল লম্বা এই শিল্প। নানা প্রাণীর মুখোশ পরেছেন সাধারণ নাগরিকরা। অনেকেরই যেমন কুশি সাজো অবস্থা। তবে তা একটি রীতিকে অবলম্বন করে। আর তা হচ্ছে হাজার বছরেরও বেশি সময়ে জাপানের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে। এসবের প্রকাশ ঘটেছে সাজসজ্জা এবং কাল পরস্পরা বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী চরিত্র সাজার মধ্যে, সে আমলের ভালো বাড়িঘর-প্রাসাদ প্যাগেডার রিপ্লিকার মধ্যে, নানা প্রতীক ও রূপকের মধ্যে।

নো, কাবুকি এবং বুনরাকুর চলমান পরিবেশনায়ও যেন জাপানের সাংস্কৃতিক আত্মার দৃশ্যমান প্রকাশ ঘটছে। একেবারে পেছনে লোক নৃত্যদল নানা বর্ণিল সাজে লোক নৃত্য পরিবেশন করে চলেছে লোকগানের সুরে সুরে। লোকবাদক দল প্রাণখুলে বাজিয়ে চলেছে পুরোনো এবং হাল আমলের বাদ্যযন্ত্রগুলো।

তাদের পেছনে নৃত্যপর সাধারণ নারী-পুরুষ। যারা নৃত্য করতে পারছে না, তারা নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করছে। তাদের মনে আছে এটা মুক্তাঙ্গন বিনোদন উৎসব; যার যা খুশি বিনোদন করার সুযোগ রয়েছে এখানে- অবশ্য তা জাপানি ভদ্রতা, ভব্যতা ও চিরাচরিত নিয়মকানুন মেনে।

মুরাসাকি শিকিবুরা এসেছে। তাদের বাবা উৎসব কর্মকর্তা, ফুজিওয়ারা তামেতোকি বেশ ব্যস্ত। এরা ভাইবোনেরা আনন্দ-উল্লাস করছে। বড়বোনটা নানাবাড়ি থেকে এসেছে। তাই তাদের আনন্দ আরো বেশি। ছোটভাই নোবুনোরি বেপরোয়া। ছেলেদের সঙ্গে গিয়ে নাচছে। মুরাসাকিরা আনন্দের মধ্যে উদ্বিগ্ন। এত লোকের মধ্যে যদি সে হারিয়ে যায়। তবে জাপানের শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই নিজের সুরক্ষা। তাই এরা কারো সাহায্য ছাড়াই একা একা চলতে পারে।

একটু দূরে দেখা যাচ্ছে ইঝোমি শিকিবুকে। সঙ্গে তার ঐ ছেলেটি। এরা বেপরোয়াভাবে একে অন্যের দেহ স্পর্শ করে স্পর্শ ও নৃত্যসুখ অনুভব করছে। মাঝেমধ্যে মুখ কানের কাছে নিয়ে কী সব বলছে আর হাসাহাসি করছে।

তা মুরাসাকির দৃষ্টি এড়ায় না। মাঝেমধ্যে সে দিকে তাকায়। তবে তার বড় বোনকে কিছু বুঝতে দেয় না। শোভাযাত্রা বড় ধীরে এগোছে, এরাও এগিয়ে যাচ্ছে।

এক সময় ইঝোমি ছেলেটিকে নিয়ে শোভাযাত্রা থেকে বের হয়ে যায়। মুরাসাকি কাবুকি নাটকের চলমান অভিনয় দেখছিল। একটা আকর্ষণীয় মুহূর্ত শেষ হতেই ফিরে তাকালো ইঝোমির দিকে, না, ওরা ওখানে নেই। তাহলে? সেদিনের কথা মনে হলো তার। এখন এরা আড়াল খুঁজছে?

ব্যাপারটা তা নয়। ইঝোমির বাবা গভর্নর সাহেব এসেছেন উৎসবে। ইজোমির চোখ পড়তেই, ছেলেটির জামার সামনেটা ধরে এমন টান দিল যে, ছিঁড়ে যাবার অবস্থা। এরা দু’জনও যেন গড়াতে গড়াতে পালালো সেখান থেকে।

ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ঘটনা কী?

বাবা। অনেক রাগী গভর্নর। তোমাকে চিনে ফেললে বড় সমস্যা হতো।

আমাকে বললেই আমি সরে পড়তাম।

বাহ! আমি তোমাকে ছাড়ব কেন? এই মুক্তাঙ্গন বিনোদন উৎসব তো প্রতিদিন আসে না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়।

আমরা তো এখনো অনেক ছোট। আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

রাখো তোমার ভবিষ্যৎ, মজা করা ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে চাই না।

ভালো বলেছ। ছেলেটির কথার মধ্যে হতাশা।

তা ইঝোমির দৃষ্টি এড়ালো না, বলল, খুশি হওনি মনে হয়?

সে রকম কিছু না। আমরা তো সদ্য তারুণ্যের পর পা রেখেছি যৌবন বসন্তে, তাই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারুণ্যই এখনও গর্বের। আমি তা ফেলে রাখতে চাই না, উপভোগ করতে চাই।

তোমার বাবাকে তো ভয় পাও।

আমার জন্য না, তোমার জন্য। তোমার সম্পর্কে জানতে পেরে দেখা গেল একদিন বাবা তার সামুরাই সেনাদের পাঠিয়ে তোমাকে উধাও করে দিয়েছেন। সমাজটা এখনো রক্ষণশীল সোনা। ঠিক বলেছ।

তবে তা আসলে ঠিক না, মুখোশ, ভেতরে অন্য কিছু। দেখো ওই মহিলাটির মতো, মুখে তিনি এত আস্তরণ দিয়েছেন যে, আসলটা বুঝাই যায় না। এটা প্রতারণা, আমার পছন্দ না।

তুমি এমনিতেই সুন্দর, তাই এ কথা বললে।

ধ্যাৎ, আমরা কীসব বুড়ো মানুষদের মতো কথা বলছি। এসো নিজেদের মতো কথা বলি।

উৎসব তো দেখা হচ্ছে না।

উৎসবের মধ্যেই তো আছি, দেখার আর কী আছে?

মুরাসাকিরা চলমান বাহনে বুনরাকু নাটকের অভিনয় দেখে হেসে হেসে অস্থির। বুনরাকু পুতুলের অভিনয়ভিত্তিক নাটক। বুনরাকু কথার অর্থ সাহিত্যের রস। রসসিক্ত এই নাটকে পুতুল অভিনেতা অভিনেত্রী, আবৃত্তিকে অনুসরণ করে না ভাবভঙ্গিতে অভিনয় ফুটিয়ে তুলছে। বাজছে বাদ্যযন্ত্রও। মুরাসাকির বোন বলল যে, এসব পুতুল অভিনয়ের কথা সে ওয়ে মাসাফুসার লেখায় পড়েছে। মাসাফুসা ইম্পেরিয়াল কোর্ট স্কলার।

শোভাযাত্রাটি দীর্ঘ সময় পর জিনগু শ্রাইনে এসে শেষ হলো। সম্রাট আগেই পৌঁছে গেছেন। প্রার্থনা করা হলো সম্রাট এবং জাপান সাম্রাজ্যের কল্যাণ কামনা করে।

মন্দির থেকে জন্ম নেয়া নো নাটকের মঞ্চায়ন রয়েছে উন্মুক্ত বিনোদন উৎসবের শেষ পর্যায়ে। সম্রাট ইচিজোর দুইপাশে সম্রাজ্ঞী তেইশি ও সম্রাজ্ঞী শোশি রয়েছেন। খুব সম্প্রতি শোশির সঙ্গে সম্রাটের বিয়ে হয়েছে। তার বয়স মাত্র বারো বছর। ঘটনা আছে।

বছর কয়েক আগে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে হঠাৎই সম্রাজ্ঞী তেইশি এবং তার ভ্রাতা কোরেচিকার সমর্থক প্রভাবশালী মিচিতাকা এবং মিচিকানের মৃত্যু হয়। এরা দুজন মিচিনাগার ভাই। ষড়যন্ত্রে মিচিনাগা জয়লাভ করেন এবং অপ্রতিরোধ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। সম্রাট এবং প্রাসাদে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। ঘটনার পর বালিকা মেয়ে শোশিকে সম্রাটের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ক্ষমতা আরো সুসংহত করেন। সম্রাজ্ঞী তেইশির ভ্রাতা এখন প্রাসাদের বাইরে। মন তার ভালো নেই। শোশির অবস্থা অন্যরকম। তার নাটক বুঝবার বয়স হয়নি। বালিকাদের মতো নো নাটকের পাত্রপাত্রীদের মুখোশ দেখেই তিনি আনন্দিত।

মুরাসাকি তার ভাইবোনকে নিয়ে নো নাটক দেখছে। বাবা উৎসব কর্মকর্তা বলে সামনে বসে নাটক দেখার সুযোগ হয়েছে। ইঝোমি তার ছেলে বন্ধুকে নিয়ে সকলের চোখের আড়ালে পেছনে বসাই সুবিধাজনক মনে করছে।

(ক্রমশ...)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : দুই

শিকিবু

আবুল কাসেম

বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

তিন.

জাপানিরা উৎসবপ্রিয় জাতি। হেইয়ান সম্রাটের দরবারে সারা বৎসরই কোনো না কোনো রাজকীয় উৎসব লেগে থাকে। উৎসবের আয়োজন, সাজসজ্জা (ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত) এবং খাবার-দাবারে একটা ঐতিহ্যিক ধারাকে অনুসরণ করা হয় এসব উৎসবে।

জিদাই মাতসুরি নামের উৎসবের আগে উৎসব বিষয়ক মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে বসেছেন। কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন মন্ত্রণালয়ের মুখ্য কর্মকর্তা (সচিব) ফুজিওয়ারা নো তামোতাকি এবং ফুজিওয়ারা নো নোবুতাকাসহ আরো কেউ কেউ। হেইয়ান জিনগু শ্রাইনের প্রধান পুরোহিত এবং অভিজাত ফুজিওয়ারা নো মিচিনাগা সম্রাটের পক্ষে উপস্থিত হয়েছেন। এ উৎসবটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন জাপানের হেইয়ান সম্রাটদের আমলের তিনটি প্রধান উৎসবের অন্যতম একটি।

উৎসবে কী কী থাকছে, তার একটা রূপরেখা পেশ করলেন ফুজিওয়ারা নো তামেতোকি। তিনি মূলত বিভাগটির প্রধান। বললেন, ঐতিহ্যবাহী এ বর্ণাঢ্য উৎসবে কিয়োটোর সকল মানুষ তো অংশ নেবেই, জাপানের অন্যান্য প্রদেশ থেকেও প্রতি বৎসরের মতো অভিজাত লোকজন এসে অংশ নেবেন। উৎসবের প্রধান আকর্ষণ বিশাল শোভাযাত্রা। সম্রাটের প্রাসাদ থেকে যাত্রা শুরু করে হেইয়ান শিনগু শ্রাইনে এসে শেষ হবে।

ফুজিওয়ারা নো মিচিনাগা বললেন, এসব আমরা জানি। উৎসবে কী কী থাকবে আমি বলে দিচ্ছি।

তার কথায় কেউ আপত্তি করলেন না। এমনকি মন্ত্রীও হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালেন। সম্রাটের প্রাসাদে তার অত্যধিক প্রভাবের কথা সবাই জানেন। প্রধান পুরোহিত জাপানের অভিজাত সমাজে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা রাখেন। তিনিও বললেন, সময় আমাদের জন্য মূল্যবান, মিচিনাগা সানই বলে দিন উৎসবে কী কী থাকবে।

মিচিনাগা বললেন, সম্রাটের প্রাসাদ উত্তমরূপে সাজাতে হবে যেন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়। বস্ত্রালংকরণে বাইরে চিত্রকররা পটচিত্র অংকন করবেন। পথযাত্রায় দৃষ্টি গোচরযোগ্য পথনক্সা অংকন করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী অভিজাত পোশাক পরিহিত অবস্থায় থাকবে নারী-পুরুষ সবাই। এবং তা উৎসবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। কপালের ভ্রুযুগল যেন পোশাকের সঙ্গে দ্বৈরথ রচনা করে। জুতার চাকচিক্য এবং নক্সা পথনক্সার সঙ্গে সামঞ্জজ্যপূর্ণ হবে। এবারে নোবুতাকা বল শোভাযাত্রায় কী কী থাকছে?

নোবুতাকা বললেন, শোভাযাত্রা এ উৎসবের প্রাণ।

মিশনাগা বললেন, এ আর নতুন কথা কী। আমি বলে দিচ্ছি টুকে রাখো। প্রথম আসছে মিকোশি (বহনযোগ্য শ্রাইন) এর কথা। প্রতিবারের মতো প্রধান পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে এটি নির্মিত হবে। অলংকরণে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে। রাজকীয় হওয়া চাই, এতে যেন কোনো কার্পণ্য না থাকে। উৎসবটি মূলত জিদাই গায়োবেতসু বা মুক্তাঙ্গন বিনোদন, যাতে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনকালের পোশাক পরিধান করে ইতিহাসের সেসব কালকে তুলে ধরা, যেসব কাল জাপানের ঐশ্বর্যকে ধারণ করে আছে। নোবুতাকা বল, এ ব্যাপারে তোমাদের পরিকল্পনা কী?

নোবুতাকা বললেন, দুই হাজার প্রশিক্ষিত অংশগ্রহণকারী বারশো বছরের নানা পোশাক, সাজসজ্জা মুখোশ প্রভৃতি পরিধান করে, সে সময়কার ঐতিহ্যবাহী শকটযান, বাড়িঘরের স্থাপত্য রেপ্লিকা, নাটক (কাবুকি, নো এবং বুনরাকু) মঞ্চায়ন দেখাতে দেখাতে শোভাযাত্রা করে আসবে। রাজকীয় যন্ত্রসঙ্গীত (প্রাচীন কালের) বাজাবে যন্ত্রীদল।

কারা বাজাবে? জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রী।

নোবুতাকা বললেন, প্রথমবারের মতো রাজকীয় সামরিক বাদক দল। আর যা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, এবারে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ থাকবে সামুরাই পোশাকে সেনাবাহিনীর। সাধারণ মানুষ তো থাকছেই। তারা তাদের মতো সাজবে।

আইনশৃঙ্খলা দেখছে কে?

উপস্থিত সেনাপ্রধানের প্রতিনিধি বললেন, আমরাই বরাবরের মতো সে দায়িত্ব পালন করব, মাননীয় মন্ত্রী।

মন্ত্রী বললেন, সেনাপ্রধান কোথায়?

তাকে মাহমান্য সম্রাট ডেকে পাঠিয়েছেন।

শোভাযাত্রায় থাকবেন।

মিচিনাগার দিকে তাকিয়ে মন্ত্রী বললেন, আচ্ছা।

মিচিনাগা বললেন, এবারে জিনগু শ্রাইনের প্রধান পুরোহিত বলুন, আপনার পরিকল্পনা কী?

মহামান্য সম্রাট শ্রাইনে আসবেন শোভাযাত্রার সঙ্গে। আমরা প্রতি বছরের মতো তা মাথায় রেখে যাবতীয় আয়োজন এবং প্রস্তুতি রাখছি। এখানে ধর্মীয় আচার শেষে সম্রাট এবং জাপানের জন্য মঙ্গল কামনা করে দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হবে। মিচিনাগা বললেন, এ বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কী বলেন মন্ত্রী সাহেব?

মন্ত্রী বলেন, না নেই। তবে একটি বিষয় বাদ পড়ে গেছে। এবারে নতুন সংযোজন রাজকীয় সামরিক যন্ত্রসঙ্গীত। তা ঠিক আছে। প্রাচীন জাপানের ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত বাদ যাবে কেন? সাধারণ মানুষের আনন্দের জন্য নানা চলমান যানে চড়ে বাদক দল এবং শিল্পীরা আগের মতোই প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান পরিবেশন করে সবাইকে আনন্দ দেবে। সবাই হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লেন।

মন্ত্রণালয়ের সচিব সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন।

মন্ত্রী বললেন, আমাদের প্রস্তুতি সভা শেষ। পুরোহিতবর্গ, মিচিনাগা সান এবং সচিব বসুন। সবাই চলে গেলে বললেন, প্রতি বছরই ঐতিহ্যের প্রশ্নে একটি বিতর্ক উপস্থিত হয়।

সবাই জানেন বিতর্কটা কী নিয়ে, তাই মন্ত্রী তা বললেন না। মিচিনাগা বললেন, তাতে মহামান্য সম্রাট এবং আমরা বিব্রত হই। যদি উৎসবটা ঐতিহ্যবাহী আনন্দ উৎসব হয়, তাতে কোনো বিভক্তি থাকা ঠিক নয়।

মন্ত্রী বললেন, হেইয়ান মানেই তো হচ্ছে শান্তি। শিন্টু ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম একই শাস্তির বাণী নিয়ে এসেছে। আমরা আনন্দিত যে, এ দুটো ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

প্রধান পুরোহিত বললেন, বৌদ্ধধর্মের দুটো ধারায় পার্থক্য সামান্যই। জাপানে তেনদাই হচ্ছে চীনা তিয়ানতাই। যার মূলে আছে পদ্মসূত্র। মহাযানের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র এটি। সাইচো ভিক্ষু তা জাপানে চালু করেছেন। তার এখন চর্চা হচ্ছে হাই এই পার্বত্য শ্রমন কমপ্লেক্সে। এক সময় সম্রাটের দরবারে তার স্থান ছিল। শিনগণও এসেছে চীনা ঝেনইয়েন মতবাদ থেকে। এর মূলে আছে তিব্বতের বজ্রযানী বৌদ্ধমতবাদ। ভিক্ষু কুকাই তা জাপানে প্রবর্তন করেন। এ শনগণের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র আছে- যাতে রয়েছে প্রতীকী সত্য, মানদালা, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান এবং মন্ত্রোচচারণ। এসবের আবেদন ব্যাপক। ভিক্ষু কুকাই কবিতা লিখতে পারতেন, চিত্র অংকন করতেন, হস্তাক্ষর ছিল লিপিকলার আদর্শ এবং সর্বোপরি ছিল তার ভাস্কর্য নির্মাণ দক্ষতা। এসব দিয়ে তিনি সম্রাট কানমুকে অভিভূত করে ফেলেন। শিনগণ সম্রাটের দরবারে উঠে আসে এবং সেই থেকে আছে। মহামান্য সম্রাট যে মতবাদ পছন্দ করেন তাকেই আমাদের অনুসরণ করতে হবে।

মিচিনাগা বললেন, তা ঠিক বলেছেন।

মন্ত্রী কোনো মন্তব্য করলেন না।

তার ভেতর ভিন্ন কিছু থাকলেও এখন তা প্রকাশিতব্য নয়।

প্রতি বৎসর উৎসবের এই দিনটিতে (২২ অক্টোবর) কিয়োটোতে বাঁধভাঙ্গা আনন্দের ঢল নামে। কিয়োটের এক লক্ষ মানুষের কেউই ঘরে থাকে না। নানা ইভেন্টে যারা অংশ নিতে পারে না, তারা দুই মাইল দীর্ঘ পথের ধারে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে।

হেইয়ান সাম্রাজ্যে সম্রাটকে সবাই শ্রদ্ধা করে। শোভাযাত্রার সামনে চলমান শ্রাইনের পেছনেই সম্রাটের বাহন। তাকে দেখে উল্লসিত জনতা শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায়। সম্রাট ইচিজো মাতা নত করে তার জবাব দেন। জনতা উল্লাসে ফেটে পড়েন।

শোভাযাত্রাটা অতিরাজকীয় হয়ে উঠেছে শামুরাই পোশাকে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে। তাদের সাজসজ্জা এবং সামুরাই তরবারির ঝলকানি মনোমুগ্ধকর। রাজকীয় সঙ্গীত ও বাজনা (ইম্পেরিয়াল মিউজিক) তার উচ্চতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

নানা শকটে সম্রাটের অমাত্যরা যাচ্ছেন। তাদের পেছনে সম্রাটের উৎসব বিভাগের লোকজন। শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন সেনাবাহিনী। তার অবশ্য দরকার ছিল না। কিয়োটোয় জাপানিরা বেশ সুশৃঙ্খল এবং আইন মান্যকারী। এরা অভিজাত শুধু পোশাক-আশাকে নয়, আচার-আচরণেও তার প্রকাশ ঘটছে।

শোভাযাত্রাটাকে এক অসাধারণ শিল্পে রূপায়িত করা হয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে দুই মাইল লম্বা এই শিল্প। নানা প্রাণীর মুখোশ পরেছেন সাধারণ নাগরিকরা। অনেকেরই যেমন কুশি সাজো অবস্থা। তবে তা একটি রীতিকে অবলম্বন করে। আর তা হচ্ছে হাজার বছরেরও বেশি সময়ে জাপানের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে। এসবের প্রকাশ ঘটেছে সাজসজ্জা এবং কাল পরস্পরা বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী চরিত্র সাজার মধ্যে, সে আমলের ভালো বাড়িঘর-প্রাসাদ প্যাগেডার রিপ্লিকার মধ্যে, নানা প্রতীক ও রূপকের মধ্যে।

নো, কাবুকি এবং বুনরাকুর চলমান পরিবেশনায়ও যেন জাপানের সাংস্কৃতিক আত্মার দৃশ্যমান প্রকাশ ঘটছে। একেবারে পেছনে লোক নৃত্যদল নানা বর্ণিল সাজে লোক নৃত্য পরিবেশন করে চলেছে লোকগানের সুরে সুরে। লোকবাদক দল প্রাণখুলে বাজিয়ে চলেছে পুরোনো এবং হাল আমলের বাদ্যযন্ত্রগুলো।

তাদের পেছনে নৃত্যপর সাধারণ নারী-পুরুষ। যারা নৃত্য করতে পারছে না, তারা নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করছে। তাদের মনে আছে এটা মুক্তাঙ্গন বিনোদন উৎসব; যার যা খুশি বিনোদন করার সুযোগ রয়েছে এখানে- অবশ্য তা জাপানি ভদ্রতা, ভব্যতা ও চিরাচরিত নিয়মকানুন মেনে।

মুরাসাকি শিকিবুরা এসেছে। তাদের বাবা উৎসব কর্মকর্তা, ফুজিওয়ারা তামেতোকি বেশ ব্যস্ত। এরা ভাইবোনেরা আনন্দ-উল্লাস করছে। বড়বোনটা নানাবাড়ি থেকে এসেছে। তাই তাদের আনন্দ আরো বেশি। ছোটভাই নোবুনোরি বেপরোয়া। ছেলেদের সঙ্গে গিয়ে নাচছে। মুরাসাকিরা আনন্দের মধ্যে উদ্বিগ্ন। এত লোকের মধ্যে যদি সে হারিয়ে যায়। তবে জাপানের শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই নিজের সুরক্ষা। তাই এরা কারো সাহায্য ছাড়াই একা একা চলতে পারে।

একটু দূরে দেখা যাচ্ছে ইঝোমি শিকিবুকে। সঙ্গে তার ঐ ছেলেটি। এরা বেপরোয়াভাবে একে অন্যের দেহ স্পর্শ করে স্পর্শ ও নৃত্যসুখ অনুভব করছে। মাঝেমধ্যে মুখ কানের কাছে নিয়ে কী সব বলছে আর হাসাহাসি করছে।

তা মুরাসাকির দৃষ্টি এড়ায় না। মাঝেমধ্যে সে দিকে তাকায়। তবে তার বড় বোনকে কিছু বুঝতে দেয় না। শোভাযাত্রা বড় ধীরে এগোছে, এরাও এগিয়ে যাচ্ছে।

এক সময় ইঝোমি ছেলেটিকে নিয়ে শোভাযাত্রা থেকে বের হয়ে যায়। মুরাসাকি কাবুকি নাটকের চলমান অভিনয় দেখছিল। একটা আকর্ষণীয় মুহূর্ত শেষ হতেই ফিরে তাকালো ইঝোমির দিকে, না, ওরা ওখানে নেই। তাহলে? সেদিনের কথা মনে হলো তার। এখন এরা আড়াল খুঁজছে?

ব্যাপারটা তা নয়। ইঝোমির বাবা গভর্নর সাহেব এসেছেন উৎসবে। ইজোমির চোখ পড়তেই, ছেলেটির জামার সামনেটা ধরে এমন টান দিল যে, ছিঁড়ে যাবার অবস্থা। এরা দু’জনও যেন গড়াতে গড়াতে পালালো সেখান থেকে।

ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ঘটনা কী?

বাবা। অনেক রাগী গভর্নর। তোমাকে চিনে ফেললে বড় সমস্যা হতো।

আমাকে বললেই আমি সরে পড়তাম।

বাহ! আমি তোমাকে ছাড়ব কেন? এই মুক্তাঙ্গন বিনোদন উৎসব তো প্রতিদিন আসে না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়।

আমরা তো এখনো অনেক ছোট। আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

রাখো তোমার ভবিষ্যৎ, মজা করা ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে চাই না।

ভালো বলেছ। ছেলেটির কথার মধ্যে হতাশা।

তা ইঝোমির দৃষ্টি এড়ালো না, বলল, খুশি হওনি মনে হয়?

সে রকম কিছু না। আমরা তো সদ্য তারুণ্যের পর পা রেখেছি যৌবন বসন্তে, তাই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারুণ্যই এখনও গর্বের। আমি তা ফেলে রাখতে চাই না, উপভোগ করতে চাই।

তোমার বাবাকে তো ভয় পাও।

আমার জন্য না, তোমার জন্য। তোমার সম্পর্কে জানতে পেরে দেখা গেল একদিন বাবা তার সামুরাই সেনাদের পাঠিয়ে তোমাকে উধাও করে দিয়েছেন। সমাজটা এখনো রক্ষণশীল সোনা। ঠিক বলেছ।

তবে তা আসলে ঠিক না, মুখোশ, ভেতরে অন্য কিছু। দেখো ওই মহিলাটির মতো, মুখে তিনি এত আস্তরণ দিয়েছেন যে, আসলটা বুঝাই যায় না। এটা প্রতারণা, আমার পছন্দ না।

তুমি এমনিতেই সুন্দর, তাই এ কথা বললে।

ধ্যাৎ, আমরা কীসব বুড়ো মানুষদের মতো কথা বলছি। এসো নিজেদের মতো কথা বলি।

উৎসব তো দেখা হচ্ছে না।

উৎসবের মধ্যেই তো আছি, দেখার আর কী আছে?

মুরাসাকিরা চলমান বাহনে বুনরাকু নাটকের অভিনয় দেখে হেসে হেসে অস্থির। বুনরাকু পুতুলের অভিনয়ভিত্তিক নাটক। বুনরাকু কথার অর্থ সাহিত্যের রস। রসসিক্ত এই নাটকে পুতুল অভিনেতা অভিনেত্রী, আবৃত্তিকে অনুসরণ করে না ভাবভঙ্গিতে অভিনয় ফুটিয়ে তুলছে। বাজছে বাদ্যযন্ত্রও। মুরাসাকির বোন বলল যে, এসব পুতুল অভিনয়ের কথা সে ওয়ে মাসাফুসার লেখায় পড়েছে। মাসাফুসা ইম্পেরিয়াল কোর্ট স্কলার।

শোভাযাত্রাটি দীর্ঘ সময় পর জিনগু শ্রাইনে এসে শেষ হলো। সম্রাট আগেই পৌঁছে গেছেন। প্রার্থনা করা হলো সম্রাট এবং জাপান সাম্রাজ্যের কল্যাণ কামনা করে।

মন্দির থেকে জন্ম নেয়া নো নাটকের মঞ্চায়ন রয়েছে উন্মুক্ত বিনোদন উৎসবের শেষ পর্যায়ে। সম্রাট ইচিজোর দুইপাশে সম্রাজ্ঞী তেইশি ও সম্রাজ্ঞী শোশি রয়েছেন। খুব সম্প্রতি শোশির সঙ্গে সম্রাটের বিয়ে হয়েছে। তার বয়স মাত্র বারো বছর। ঘটনা আছে।

বছর কয়েক আগে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে হঠাৎই সম্রাজ্ঞী তেইশি এবং তার ভ্রাতা কোরেচিকার সমর্থক প্রভাবশালী মিচিতাকা এবং মিচিকানের মৃত্যু হয়। এরা দুজন মিচিনাগার ভাই। ষড়যন্ত্রে মিচিনাগা জয়লাভ করেন এবং অপ্রতিরোধ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। সম্রাট এবং প্রাসাদে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। ঘটনার পর বালিকা মেয়ে শোশিকে সম্রাটের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ক্ষমতা আরো সুসংহত করেন। সম্রাজ্ঞী তেইশির ভ্রাতা এখন প্রাসাদের বাইরে। মন তার ভালো নেই। শোশির অবস্থা অন্যরকম। তার নাটক বুঝবার বয়স হয়নি। বালিকাদের মতো নো নাটকের পাত্রপাত্রীদের মুখোশ দেখেই তিনি আনন্দিত।

মুরাসাকি তার ভাইবোনকে নিয়ে নো নাটক দেখছে। বাবা উৎসব কর্মকর্তা বলে সামনে বসে নাটক দেখার সুযোগ হয়েছে। ইঝোমি তার ছেলে বন্ধুকে নিয়ে সকলের চোখের আড়ালে পেছনে বসাই সুবিধাজনক মনে করছে।

(ক্রমশ...)

back to top