alt

সাময়িকী

পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তি স্মরণে

‘নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি’ করোনাকালে রবীন্দ্র-অনুভব

দেবাহুতি চক্রবর্তী

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ মানেই বুঝতাম সঞ্চয়িতা কাব্যগ্রন্থ। কবিতা পড়তে যেয়ে ভাবনা হতো ‘ফাঁকি’ কবিতার নায়িকার সুস্থ হতে কেন হাওয়া বদল দরকার হলো? ঠাকুমা বোঝাতেন- যক্ষা হয়েছে, যা হলে কারো রক্ষা নেই। পুরাতন ভৃত্য- পড়তে পড়তে কতো কেঁদেছি। পুরী ভ্রমণে যেয়ে বসন্ত রোগে ধরল। তারপর- “কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত। আমি বসন্তে মরি।/বন্ধু যে-যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ।/আমি একা ঘরে, ব্যাধিখরশরে ভরিল সকল অঙ্গ।” আবার ‘অভিসার’ কবিতায় নগরের ধনী রূপবতী বাসবদত্তার পরিণতি মানতে খুব কষ্ট হতো। এমন হয় কেন? “নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ।/রোগমসী-ঢালা কালী তনু তার/লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার/ বাহিরে ফেলেছে করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।”

এই মারীগুটি মানে গুটি বসন্ত। যা এখন বিলুপ্তপ্রায়। যক্ষা এখন চিকিৎসাবিদ্যার আয়ত্তে। সবই বিজ্ঞানের কল্যাণে। অথচ একসময় এগুলো মহামারী হিসেবেই ধ্বংস করেছে কতো জনপদ। ‘বনফুল’ কাব্যগ্রন্থে কবি লেখেন,- “মানবকঙ্কাল শুয়ে ভস্মের শয্যায়/বিকট দশন মেলি মানবকপাল/ধ্বংসের স্মরণস্তূপ- ছড়াছড়ি দেখিতে ভয়াল/গভীর আঁখিকোটর আঁধারেরে দিয়েছে আবাস/ মেলিয়া দশনপাতি পৃথিবীরে করে উপহাস”। কোভিড-১৯ আজ যেন তেমন করেই পৃথিবীকে উপহাস করছে।

রবীন্দ্রনাথ এই করোনা ভাইরাসের সাথে পরিচিত নন। কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক মহামারী জনিত দুর্যোগের সাথেই তাকে বোঝাবুঝি করতে হয়েছে। যক্ষা, গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ওলাওঠা বা কলেরা, প্লেগ এসব নানা ব্যাধি মহামারী হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে ও অন্যত্র ছড়িয়েছে। মানবসমাজকে ধ্বংসের ভয়াল রূপ দেখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন তার বাংলাদেশ সবসময় রোগেশোকে জর্জর। এ নিয়ে তার অনেক লেখালেখি রয়েছে। ছিন্নপত্রের একটি পত্রাংশে দেখি, ‘এত কষ্ট এত অনারাম মানুষের কী করে সয় আমি ভেবে পাই না। প্রতি ঘরে ঘরে বাতে ধরছে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ্বর হচ্ছে, পিলেওয়ালা ছেলেগুলো অবিশ্রাম ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না- একটা একটা করে মরে যাচ্ছে। এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য কিছুতেই শোভা পায় না।” এর জের ধরেই লেখেন,- “সকল রকমের ক্ষমতার কাছেই আমরা পরাভূত হয়ে আছি। প্রকৃতি যখন উপদ্রব করে তাও সয়ে থাকি, রাজা যখন উপদ্রব করে তাও সয়ে থাকি এবং শাস্ত্র চিরকাল ধরে যে সমস্ত দুঃসহ উপদ্রব করে তার বিরুদ্ধেও কথা বলতে সাহস হয় না।” -এইসব উপদ্রব শুধু সেদিন ছিল তা নয়, মহামারী আক্রান্ত দেশে দেশে আজও আছে। আজও কথা বলতে সাহসের অভাব অনেক বেশি।

ওলাউঠা বা কলেরার জন্মভূমি ভারতীয় উপমহাদেশ। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে তা মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখায় পাই- “ভারতবর্ষ যে ওলাওঠা রোগের জন্মভূমি এ সম্বন্ধে সন্দেহ অতি অল্পই আছে- ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে এই ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে দিগি¦জয় করিতে বাহির হইয়া সিন্ধু, ইউফ্রাটিস, নীল, দানিয়ুব, ভল্গা অবশেষে আমেরিকার সেন্টলরেন্স এবং মিসিসিপি নদী পার হইয়া দেশবিদেশ উত্থিত করিয়াছিল।... ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কক সাহেব ওলাওঠাকে শরীরের উপর জীবাণুবিশেষের ক্রিয়া বলিয়া সাব্যস্ত করেন। যদিও এমত এখনো সম্পূর্ণ সর্ববাদীসম্মত হয় নাই। তথাপি অধিকাংশের এই বিশ্বাস। অনেক জীবানুবীজ বহুকাল শুষ্ক অবস্থায় থাকিয়া অনুকূল আধার পাইলে পুনরায় বাঁচিয়া ওঠে। কিন্তু কক সাহেবের ওলাওঠা জীবাণুগণকে এ পর্যন্ত বীজ সৃজন করিতে দেখা যায় নাই। এবং একবার শুষ্ক হইয়া গেলে তাহারা মরিয়া যায়। একথা যদি সত্য হয় তবে ধুলা প্রভৃতি শুষ্ক আধার

অবলম্বন করিয়া সজীব ওলাওঠা জীবাণু বায়ুযোগে চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হইতে পারে না। জলপথই তাহার প্রশস্ত পথ এবং ওলাওঠা জীবাণু জলজ। “এই পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে গ্রামবাংলার দূষিত জলাশয়গুলো নিয়ে তিনি সবাইকে সচেতন করার চেষ্টায় আজীবন সক্রিয় থাকেন। শুধু ওলাওঠা নয়, ম্যালেরিয়া নিয়েও তিনি অনেক চিন্তা রেখে যান। এক সমাবেশে বলেন, “ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথের জন্য আপন শূন্যভাণ্ডারের দিকে হতাশা দৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা।”

ম্যালেরিয়া নিবারণী বিভিন্ন সভায় তিনি মতামত দেন- “এই যে আপনারা বুঝতে পারেন, পতঙ্গে-মানুষে লড়াই। আমাদের রোগশত্রুর বাহনটি যে ক্ষেত্র অধিকার করে আছে সে অতি বিস্তীর্ণ। আমরা এতদিন বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী। তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি, কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে- যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই প্রতিকার নেই। শত্রু যত বড়োই হোক, তাকে মানব না, মশাকে রাখব না, যেমন করে পারি উচ্ছেদ করব। এ সাহস যদি হয়, তবে কেবল মশা নয়, তার চেয়ে বড়ো শত্রু নিজেদের দীনতার উপর জয়লাভ করব।” কথাগুলো আজকের ভয়াবহ অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও আমরা অনায়াসেই কণ্ঠে নিতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন। তিনি আপাদমস্তক একজন সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মনের কোনো অর্গল তিনি কোনোদিন বন্ধ রাখেননি। ইতিহাস, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, শরীরবিজ্ঞান, কৃষি, উদ্ভিদ, সমবায়- যেদিকে তাকাই সব দিকেই তাঁর আগ্রহ। রোগ-শোক-মহামারী নিয়ে তিনি ভেবেছেন। ভাবনাগুলোকে রূপ দেবার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। গভীর দেশপ্রেম নিয়ে এইসব সংকট তাঁকে যেমন ভাবিয়েছে, তেমনি সবকিছুই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও দেখেছেন। প্রকৃতির পর মানুষের অন্যায় অবিচার, নির্বিবাদে প্রকৃতি ধ্বংস করা, মারণাস্ত্রের খেলা, রাজ্য দখল, মানুষের প্রতি মানুষের সীমাহীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার তিনি কলম ধরেছেন। এই সব ব্যাধি, মহামারীর জন্ম বা বিস্তারের মাঝেও তিনি মানুষের এইসব অশুভ শক্তির পরাক্রম দেখেছেন। “দয়াহীন সভ্যতানাগিনী /তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে/গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে” বা চিতার আগুনকে দেখেছেন লুব্ধ সভ্যতার অগ্নিকণা হিসেবে। তাই তাঁর কবিতায় দেখি, “শক্তিদম্ভ স্বার্থলোভ মারীর মতন / দেখিতে দেখিতে আজি ঘিরিছে ভুবন।/ দেশ হতে দেশান্তরে স্পর্শবিষ তার / শান্তিময় পল্লী যত করে ছারখার।” এই কথাগুলো শুধু কথা নয়, তাঁর বিশ্বাস। উপেক্ষিতা পল্লী চিন্তায় দেখি- “মানুষ আপন সভ্যতাকে যখন অভ্রভেদী করে তুলতে থাকে তখন জয়ের স্পর্ধায় বস্তুর লোভে ভুলতে থাকে যে সীমার নিয়মের দ্বারা তার অভ্যুত্থান পরিমিত। প্রকৃতির নিয়ম সীমায় যে সহজ স্বাস্থ্য ও আরোগ্যতত্ত্ব আছে তাকে উপেক্ষা করেও কী করে মানুষ স্বরচিত প্রকাণ্ড জটিলতার মধ্যে কৃত্রিম প্রণালীতে জীবনযাত্রার সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে এই হয়েছে আধুনিক সভ্যতার দুরূহ সমস্যা।” ছিন্নপত্রের এক অংশে দেখি,- “মানুষের যে সভ্যতার রূপ আমাদের সামনে বর্তমান সে সভ্যতা মানুষ খাদক। তার একদল ভিক্টিম চাইই যারা তার খাদ্য, যারা তার বাহন। এই পেটুক সভ্যতায়- সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান হবে কী করে?” গভীর আর্তিতে তাই শোনা যায়, “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,/ লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর / হে নবসভ্যতা”।

ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশকে দেখেছেন। এই হতভাগ্য দেশের রোগ শোক মহামারী দুর্ভিক্ষ কথিত সভ্যতার বাহক ইংরেজ শাসনের অন্যায় আর শোষণে পরিপুষ্ট। দেশের অধিকাংশ মানুষ পক্ষান্তরে নির্জীব। এই আধমরা মানুষদের ঘা মেরে বাঁচাতে তিনি বহু চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, “দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশিত হয় তবেই দেশ প্রকাশিত। বর্তমানকালে আমাদের দেশে যদি বলা যায় যে, দেশের জন্য বক্তৃতা করো, সভা করো, তর্ক করো তবে তাহা সকলে অতি সহজেই বুঝিতে পারে। কিন্তু যদি বলা যায় যে, দেশকে জানো ও তাহার পরে স্বহস্তে যথাসাধ্য দেশের সেবা করো, তবে দেখিয়াছি, অর্থ বুঝিতে লোকের বিশেষ কষ্ট হয়।” কথাগুলো আজকের বাংলাদেশেও অনেকই সত্য। মানুষ-খাদক সভ্যতাকে রবীন্দ্রনাথ দোষী করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানকে নয়। বারবার সতর্ক করেছেন, “বিজ্ঞান মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে। সেই শক্তি যখন সমস্ত সমাজের হয়ে কাজ করবে তখনই সত্যযুগ আসবে। মানুষ বলছে, “পারলুম না”। শুষ্ক জলাশয় থেকে, নিষ্ফল ক্ষেত্র থেকে, শ্মশানভূমিতে যে চিতা নিবতে চায় না তার শিখা থেকে কান্না উঠছে। “পারলুম না, হার মেনেছি”- অথচ এ যুগের শক্তিকে যদি গ্রহণ করতে পারি, তা হলেই জিতব, তা হলেই বাঁচব।”

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানকে এড়িয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, উচিতও নয়। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই প্রাণের সাথে প্রাণের দ্বন্দ্ব লড়াই অব্যাহত আছে। কয়েক হাজার দৃশ্য-অদৃশ্য ভাইরাসের সাথে মানুষকে নিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “প্লেগ অতিথির মতো আসিল, তার পরে বছরের পর বছর যায়, আজও তাহার নররক্তপিপাসার নিবৃত্তি হইল না। যে বাঘ একবার মনুষ্য মাংসের স্বাদ পাইয়াছে সে যেমন কোনো মতে সে প্রলোভন ছাড়িতে পারে না, দুর্ভিক্ষ তেমনি করিয়া বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া আমাদের লোকালয়কে জনশূন্য করিয়া দিতেছে। ইহাকে কি আমরা দৈব দুর্ঘটনা বলিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া থাকিব। সমস্ত দেশের উপর মৃত্যুর এই যে অবিচ্ছিন্ন জালনিক্ষেপ দেখিতেছি, ইহাকে কি আমরা আকস্মিক বলিতে পারিব।

ইহা আকস্মিক নহে। ইহা বদ্ধমূল ব্যাধির আকার ধারণ করিতেছে। এমনি করিয়া বহু জাতি মারা পড়িয়াছে। আমরাও দেশব্যাপী মৃত্যুর আক্রমণ হইতে বিনা চেষ্টায় নিষ্কৃতি পাইব এমন তো কোনো কারণ দেখি না। আমরা চক্ষের সম্মুখে দেখিতেছি যে, যে-সব জাতি সুস্থ সবল তাহারাও প্রাণরক্ষার জন্য প্রতিক্ষণেই লড়াই করিতেছে। আর আমরা আমাদের জীর্ণতার উপরে মৃত্যুর পুনঃপুনঃ নখরাঘাত সত্ত্বেও বিনা প্রয়াসে বাঁচিয়া থাকিব?” বাংলাদেশসহ অনেক দেশের জন্যই আজকের পরিস্থিতিতে কথাগুলো ভাবনায় আসে। বিশেষত যেসব দেশে সরকার জনবান্ধব না হয়ে বিপরীত বিরুদ্ধ ভূমিকায় তাদের অবস্থা মনে করলেও রবীন্দ্রনাথ এই করোনাকালীন সময়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে যান। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেছেন, “ইতিমধ্যে কলিকাতায় প্লেগ দেখা দিল। ভারত গভর্নমেন্টের যেরূপ মেজাজ তাহাতে প্লেগ অপেক্ষা প্লেগ রেগুলেশন বেশি রুদ্রমূর্তি ধারণ করিয়া উঠিবে। সতর্ক থাকিলে প্লেগের হস্ত অনেকে এড়াইবে, কিন্তু রেগুলেশনের হস্তে কাহারও রক্ষা নাই। “সরকারের এই ভূমিকা তার কাছে,- ‘যমদূতের উৎপীড়নের সহিত রাজদূতের বিভীষীকার যোগ।’ তবে তার লেখাতেই পাই, “মারটাই কেবল পেয়ে বসেছি, তার থেকে শিক্ষা পাইনি। আমরাই যে আমাদের সমস্ত দুর্বলতা ও অস্বাস্থ্যের কারণগুলোকে সযতেœ সর্ব দেহে মনে পোষণ করেও বেঁচে থাকব, আমরা বিধাতাপুরুষের মতো বড়ো আদুরে ছেলে নই।” তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের স্বার্থবিরোধী শাসকের সন্ত্রাস বাইরের দিক থেকে মানুষ ভুলে যায়, কিন্তু “বহুকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেদনা অবিচার অবিশ্বাস অপমান হঠাৎ একটা তুচ্ছমাত্র বলে বিরাট আকার ধারণ করিয়া ওঠে।” কোভিড-১৯ নিয়েও কিছু কিছু দেশে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য অবশ্যই পথনির্দেশক। রাজা-প্রজা উভয়ের দায়িত্বের কথাই তিনি দেশের মানুষকে, বিশ্বের মানুষকে শোনান।

এক বছরের বেশি হয়ে গেল করোনা ভাইরাসের অদৃশ্য শক্তির সাথে মানুষ বোঝাপড়া করে চলছে। এর মাঝে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আরও কত লক্ষ লক্ষ মানুষ। ঘরবন্দি হয়ে আছে শিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সী অগণিত মানুষ। মানসিক অবসাদ, মানসিক বিপর্যয় ঘরে ঘরে। নাই বা দেখলেন রবীন্দ্রনাথ এই সময়কে। কিন্তু কোনো অদৃশ্যশক্তি বলে সমকালকে তিনি ছন্দোবদ্ধ করে গেছেন জানা নেই।

“আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে, ওগো।

দিক-দিগন্ত ঢাকি।

আজিকে আমরা কাঁদিয়া শুধাই সঘনে, ওগো,

আমরা খাঁচার পাখি।”

কবিতার শেষে এসে তিনি তাঁর সারা জীবনের বিশ্বাসকেই প্রাণ দিয়েছেন। মানুষের প্রতিকারহীন পরাভব সত্য হতে পারে না। এই দমবন্ধ করা অন্ধ বদ্ধ জীবন থেকে মানুষের মুক্তি হবেই। শক্তি, স্বাস্থ্য আর আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু নিয়ে মানুষ মুক্তির গান গাইবে। এই ভয়াতুর বেদনার, এই প্রিয়জন হারানোর নিত্য আশঙ্কার অবসান হবেই।

“নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি”

কহো আমাদের ডাকি,

মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান

আমরা খাঁচার পাখি।”

চির আশা জাগানিয়া এই রবীন্দ্রনাথ আজও তাই ভাবনায় একান্ত।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তি স্মরণে

‘নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি’ করোনাকালে রবীন্দ্র-অনুভব

দেবাহুতি চক্রবর্তী

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ মানেই বুঝতাম সঞ্চয়িতা কাব্যগ্রন্থ। কবিতা পড়তে যেয়ে ভাবনা হতো ‘ফাঁকি’ কবিতার নায়িকার সুস্থ হতে কেন হাওয়া বদল দরকার হলো? ঠাকুমা বোঝাতেন- যক্ষা হয়েছে, যা হলে কারো রক্ষা নেই। পুরাতন ভৃত্য- পড়তে পড়তে কতো কেঁদেছি। পুরী ভ্রমণে যেয়ে বসন্ত রোগে ধরল। তারপর- “কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত। আমি বসন্তে মরি।/বন্ধু যে-যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ।/আমি একা ঘরে, ব্যাধিখরশরে ভরিল সকল অঙ্গ।” আবার ‘অভিসার’ কবিতায় নগরের ধনী রূপবতী বাসবদত্তার পরিণতি মানতে খুব কষ্ট হতো। এমন হয় কেন? “নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ।/রোগমসী-ঢালা কালী তনু তার/লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার/ বাহিরে ফেলেছে করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।”

এই মারীগুটি মানে গুটি বসন্ত। যা এখন বিলুপ্তপ্রায়। যক্ষা এখন চিকিৎসাবিদ্যার আয়ত্তে। সবই বিজ্ঞানের কল্যাণে। অথচ একসময় এগুলো মহামারী হিসেবেই ধ্বংস করেছে কতো জনপদ। ‘বনফুল’ কাব্যগ্রন্থে কবি লেখেন,- “মানবকঙ্কাল শুয়ে ভস্মের শয্যায়/বিকট দশন মেলি মানবকপাল/ধ্বংসের স্মরণস্তূপ- ছড়াছড়ি দেখিতে ভয়াল/গভীর আঁখিকোটর আঁধারেরে দিয়েছে আবাস/ মেলিয়া দশনপাতি পৃথিবীরে করে উপহাস”। কোভিড-১৯ আজ যেন তেমন করেই পৃথিবীকে উপহাস করছে।

রবীন্দ্রনাথ এই করোনা ভাইরাসের সাথে পরিচিত নন। কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক মহামারী জনিত দুর্যোগের সাথেই তাকে বোঝাবুঝি করতে হয়েছে। যক্ষা, গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ওলাওঠা বা কলেরা, প্লেগ এসব নানা ব্যাধি মহামারী হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে ও অন্যত্র ছড়িয়েছে। মানবসমাজকে ধ্বংসের ভয়াল রূপ দেখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন তার বাংলাদেশ সবসময় রোগেশোকে জর্জর। এ নিয়ে তার অনেক লেখালেখি রয়েছে। ছিন্নপত্রের একটি পত্রাংশে দেখি, ‘এত কষ্ট এত অনারাম মানুষের কী করে সয় আমি ভেবে পাই না। প্রতি ঘরে ঘরে বাতে ধরছে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ্বর হচ্ছে, পিলেওয়ালা ছেলেগুলো অবিশ্রাম ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না- একটা একটা করে মরে যাচ্ছে। এত অবহেলা, অস্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য কিছুতেই শোভা পায় না।” এর জের ধরেই লেখেন,- “সকল রকমের ক্ষমতার কাছেই আমরা পরাভূত হয়ে আছি। প্রকৃতি যখন উপদ্রব করে তাও সয়ে থাকি, রাজা যখন উপদ্রব করে তাও সয়ে থাকি এবং শাস্ত্র চিরকাল ধরে যে সমস্ত দুঃসহ উপদ্রব করে তার বিরুদ্ধেও কথা বলতে সাহস হয় না।” -এইসব উপদ্রব শুধু সেদিন ছিল তা নয়, মহামারী আক্রান্ত দেশে দেশে আজও আছে। আজও কথা বলতে সাহসের অভাব অনেক বেশি।

ওলাউঠা বা কলেরার জন্মভূমি ভারতীয় উপমহাদেশ। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে তা মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখায় পাই- “ভারতবর্ষ যে ওলাওঠা রোগের জন্মভূমি এ সম্বন্ধে সন্দেহ অতি অল্পই আছে- ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে এই ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে দিগি¦জয় করিতে বাহির হইয়া সিন্ধু, ইউফ্রাটিস, নীল, দানিয়ুব, ভল্গা অবশেষে আমেরিকার সেন্টলরেন্স এবং মিসিসিপি নদী পার হইয়া দেশবিদেশ উত্থিত করিয়াছিল।... ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কক সাহেব ওলাওঠাকে শরীরের উপর জীবাণুবিশেষের ক্রিয়া বলিয়া সাব্যস্ত করেন। যদিও এমত এখনো সম্পূর্ণ সর্ববাদীসম্মত হয় নাই। তথাপি অধিকাংশের এই বিশ্বাস। অনেক জীবানুবীজ বহুকাল শুষ্ক অবস্থায় থাকিয়া অনুকূল আধার পাইলে পুনরায় বাঁচিয়া ওঠে। কিন্তু কক সাহেবের ওলাওঠা জীবাণুগণকে এ পর্যন্ত বীজ সৃজন করিতে দেখা যায় নাই। এবং একবার শুষ্ক হইয়া গেলে তাহারা মরিয়া যায়। একথা যদি সত্য হয় তবে ধুলা প্রভৃতি শুষ্ক আধার

অবলম্বন করিয়া সজীব ওলাওঠা জীবাণু বায়ুযোগে চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হইতে পারে না। জলপথই তাহার প্রশস্ত পথ এবং ওলাওঠা জীবাণু জলজ। “এই পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে গ্রামবাংলার দূষিত জলাশয়গুলো নিয়ে তিনি সবাইকে সচেতন করার চেষ্টায় আজীবন সক্রিয় থাকেন। শুধু ওলাওঠা নয়, ম্যালেরিয়া নিয়েও তিনি অনেক চিন্তা রেখে যান। এক সমাবেশে বলেন, “ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথের জন্য আপন শূন্যভাণ্ডারের দিকে হতাশা দৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা।”

ম্যালেরিয়া নিবারণী বিভিন্ন সভায় তিনি মতামত দেন- “এই যে আপনারা বুঝতে পারেন, পতঙ্গে-মানুষে লড়াই। আমাদের রোগশত্রুর বাহনটি যে ক্ষেত্র অধিকার করে আছে সে অতি বিস্তীর্ণ। আমরা এতদিন বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী। তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি, কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে- যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই প্রতিকার নেই। শত্রু যত বড়োই হোক, তাকে মানব না, মশাকে রাখব না, যেমন করে পারি উচ্ছেদ করব। এ সাহস যদি হয়, তবে কেবল মশা নয়, তার চেয়ে বড়ো শত্রু নিজেদের দীনতার উপর জয়লাভ করব।” কথাগুলো আজকের ভয়াবহ অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও আমরা অনায়াসেই কণ্ঠে নিতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন। তিনি আপাদমস্তক একজন সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মনের কোনো অর্গল তিনি কোনোদিন বন্ধ রাখেননি। ইতিহাস, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, শরীরবিজ্ঞান, কৃষি, উদ্ভিদ, সমবায়- যেদিকে তাকাই সব দিকেই তাঁর আগ্রহ। রোগ-শোক-মহামারী নিয়ে তিনি ভেবেছেন। ভাবনাগুলোকে রূপ দেবার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। গভীর দেশপ্রেম নিয়ে এইসব সংকট তাঁকে যেমন ভাবিয়েছে, তেমনি সবকিছুই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও দেখেছেন। প্রকৃতির পর মানুষের অন্যায় অবিচার, নির্বিবাদে প্রকৃতি ধ্বংস করা, মারণাস্ত্রের খেলা, রাজ্য দখল, মানুষের প্রতি মানুষের সীমাহীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার তিনি কলম ধরেছেন। এই সব ব্যাধি, মহামারীর জন্ম বা বিস্তারের মাঝেও তিনি মানুষের এইসব অশুভ শক্তির পরাক্রম দেখেছেন। “দয়াহীন সভ্যতানাগিনী /তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে/গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে” বা চিতার আগুনকে দেখেছেন লুব্ধ সভ্যতার অগ্নিকণা হিসেবে। তাই তাঁর কবিতায় দেখি, “শক্তিদম্ভ স্বার্থলোভ মারীর মতন / দেখিতে দেখিতে আজি ঘিরিছে ভুবন।/ দেশ হতে দেশান্তরে স্পর্শবিষ তার / শান্তিময় পল্লী যত করে ছারখার।” এই কথাগুলো শুধু কথা নয়, তাঁর বিশ্বাস। উপেক্ষিতা পল্লী চিন্তায় দেখি- “মানুষ আপন সভ্যতাকে যখন অভ্রভেদী করে তুলতে থাকে তখন জয়ের স্পর্ধায় বস্তুর লোভে ভুলতে থাকে যে সীমার নিয়মের দ্বারা তার অভ্যুত্থান পরিমিত। প্রকৃতির নিয়ম সীমায় যে সহজ স্বাস্থ্য ও আরোগ্যতত্ত্ব আছে তাকে উপেক্ষা করেও কী করে মানুষ স্বরচিত প্রকাণ্ড জটিলতার মধ্যে কৃত্রিম প্রণালীতে জীবনযাত্রার সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে এই হয়েছে আধুনিক সভ্যতার দুরূহ সমস্যা।” ছিন্নপত্রের এক অংশে দেখি,- “মানুষের যে সভ্যতার রূপ আমাদের সামনে বর্তমান সে সভ্যতা মানুষ খাদক। তার একদল ভিক্টিম চাইই যারা তার খাদ্য, যারা তার বাহন। এই পেটুক সভ্যতায়- সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান হবে কী করে?” গভীর আর্তিতে তাই শোনা যায়, “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,/ লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর / হে নবসভ্যতা”।

ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশকে দেখেছেন। এই হতভাগ্য দেশের রোগ শোক মহামারী দুর্ভিক্ষ কথিত সভ্যতার বাহক ইংরেজ শাসনের অন্যায় আর শোষণে পরিপুষ্ট। দেশের অধিকাংশ মানুষ পক্ষান্তরে নির্জীব। এই আধমরা মানুষদের ঘা মেরে বাঁচাতে তিনি বহু চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, “দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশিত হয় তবেই দেশ প্রকাশিত। বর্তমানকালে আমাদের দেশে যদি বলা যায় যে, দেশের জন্য বক্তৃতা করো, সভা করো, তর্ক করো তবে তাহা সকলে অতি সহজেই বুঝিতে পারে। কিন্তু যদি বলা যায় যে, দেশকে জানো ও তাহার পরে স্বহস্তে যথাসাধ্য দেশের সেবা করো, তবে দেখিয়াছি, অর্থ বুঝিতে লোকের বিশেষ কষ্ট হয়।” কথাগুলো আজকের বাংলাদেশেও অনেকই সত্য। মানুষ-খাদক সভ্যতাকে রবীন্দ্রনাথ দোষী করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানকে নয়। বারবার সতর্ক করেছেন, “বিজ্ঞান মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে। সেই শক্তি যখন সমস্ত সমাজের হয়ে কাজ করবে তখনই সত্যযুগ আসবে। মানুষ বলছে, “পারলুম না”। শুষ্ক জলাশয় থেকে, নিষ্ফল ক্ষেত্র থেকে, শ্মশানভূমিতে যে চিতা নিবতে চায় না তার শিখা থেকে কান্না উঠছে। “পারলুম না, হার মেনেছি”- অথচ এ যুগের শক্তিকে যদি গ্রহণ করতে পারি, তা হলেই জিতব, তা হলেই বাঁচব।”

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানকে এড়িয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, উচিতও নয়। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই প্রাণের সাথে প্রাণের দ্বন্দ্ব লড়াই অব্যাহত আছে। কয়েক হাজার দৃশ্য-অদৃশ্য ভাইরাসের সাথে মানুষকে নিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “প্লেগ অতিথির মতো আসিল, তার পরে বছরের পর বছর যায়, আজও তাহার নররক্তপিপাসার নিবৃত্তি হইল না। যে বাঘ একবার মনুষ্য মাংসের স্বাদ পাইয়াছে সে যেমন কোনো মতে সে প্রলোভন ছাড়িতে পারে না, দুর্ভিক্ষ তেমনি করিয়া বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া আমাদের লোকালয়কে জনশূন্য করিয়া দিতেছে। ইহাকে কি আমরা দৈব দুর্ঘটনা বলিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া থাকিব। সমস্ত দেশের উপর মৃত্যুর এই যে অবিচ্ছিন্ন জালনিক্ষেপ দেখিতেছি, ইহাকে কি আমরা আকস্মিক বলিতে পারিব।

ইহা আকস্মিক নহে। ইহা বদ্ধমূল ব্যাধির আকার ধারণ করিতেছে। এমনি করিয়া বহু জাতি মারা পড়িয়াছে। আমরাও দেশব্যাপী মৃত্যুর আক্রমণ হইতে বিনা চেষ্টায় নিষ্কৃতি পাইব এমন তো কোনো কারণ দেখি না। আমরা চক্ষের সম্মুখে দেখিতেছি যে, যে-সব জাতি সুস্থ সবল তাহারাও প্রাণরক্ষার জন্য প্রতিক্ষণেই লড়াই করিতেছে। আর আমরা আমাদের জীর্ণতার উপরে মৃত্যুর পুনঃপুনঃ নখরাঘাত সত্ত্বেও বিনা প্রয়াসে বাঁচিয়া থাকিব?” বাংলাদেশসহ অনেক দেশের জন্যই আজকের পরিস্থিতিতে কথাগুলো ভাবনায় আসে। বিশেষত যেসব দেশে সরকার জনবান্ধব না হয়ে বিপরীত বিরুদ্ধ ভূমিকায় তাদের অবস্থা মনে করলেও রবীন্দ্রনাথ এই করোনাকালীন সময়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে যান। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেছেন, “ইতিমধ্যে কলিকাতায় প্লেগ দেখা দিল। ভারত গভর্নমেন্টের যেরূপ মেজাজ তাহাতে প্লেগ অপেক্ষা প্লেগ রেগুলেশন বেশি রুদ্রমূর্তি ধারণ করিয়া উঠিবে। সতর্ক থাকিলে প্লেগের হস্ত অনেকে এড়াইবে, কিন্তু রেগুলেশনের হস্তে কাহারও রক্ষা নাই। “সরকারের এই ভূমিকা তার কাছে,- ‘যমদূতের উৎপীড়নের সহিত রাজদূতের বিভীষীকার যোগ।’ তবে তার লেখাতেই পাই, “মারটাই কেবল পেয়ে বসেছি, তার থেকে শিক্ষা পাইনি। আমরাই যে আমাদের সমস্ত দুর্বলতা ও অস্বাস্থ্যের কারণগুলোকে সযতেœ সর্ব দেহে মনে পোষণ করেও বেঁচে থাকব, আমরা বিধাতাপুরুষের মতো বড়ো আদুরে ছেলে নই।” তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের স্বার্থবিরোধী শাসকের সন্ত্রাস বাইরের দিক থেকে মানুষ ভুলে যায়, কিন্তু “বহুকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেদনা অবিচার অবিশ্বাস অপমান হঠাৎ একটা তুচ্ছমাত্র বলে বিরাট আকার ধারণ করিয়া ওঠে।” কোভিড-১৯ নিয়েও কিছু কিছু দেশে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ তাদের জন্য অবশ্যই পথনির্দেশক। রাজা-প্রজা উভয়ের দায়িত্বের কথাই তিনি দেশের মানুষকে, বিশ্বের মানুষকে শোনান।

এক বছরের বেশি হয়ে গেল করোনা ভাইরাসের অদৃশ্য শক্তির সাথে মানুষ বোঝাপড়া করে চলছে। এর মাঝে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আরও কত লক্ষ লক্ষ মানুষ। ঘরবন্দি হয়ে আছে শিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সী অগণিত মানুষ। মানসিক অবসাদ, মানসিক বিপর্যয় ঘরে ঘরে। নাই বা দেখলেন রবীন্দ্রনাথ এই সময়কে। কিন্তু কোনো অদৃশ্যশক্তি বলে সমকালকে তিনি ছন্দোবদ্ধ করে গেছেন জানা নেই।

“আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে, ওগো।

দিক-দিগন্ত ঢাকি।

আজিকে আমরা কাঁদিয়া শুধাই সঘনে, ওগো,

আমরা খাঁচার পাখি।”

কবিতার শেষে এসে তিনি তাঁর সারা জীবনের বিশ্বাসকেই প্রাণ দিয়েছেন। মানুষের প্রতিকারহীন পরাভব সত্য হতে পারে না। এই দমবন্ধ করা অন্ধ বদ্ধ জীবন থেকে মানুষের মুক্তি হবেই। শক্তি, স্বাস্থ্য আর আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু নিয়ে মানুষ মুক্তির গান গাইবে। এই ভয়াতুর বেদনার, এই প্রিয়জন হারানোর নিত্য আশঙ্কার অবসান হবেই।

“নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি”

কহো আমাদের ডাকি,

মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান

আমরা খাঁচার পাখি।”

চির আশা জাগানিয়া এই রবীন্দ্রনাথ আজও তাই ভাবনায় একান্ত।

back to top