alt

সাময়িকী

রবীন্দ্রনাথের গান

চিরনূতন চিরপুরাতন

জামিরুল শরীফ

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

আমার মন ভালো নেই,

কেন?

জানি না।

আমি একজনকে ভালোবাসি,

সে কে?

জানি না।

কেন?

কী করে বলি-

আমি কি তাকে দেখেছি?

এই যুক্তিহীন মনস্তত্ত্বের কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু এ হচ্ছে রোমান্টিক বিষাদ- যা অহেতুক, অথচ চরিত্রলক্ষণ স্পষ্ট, যার আভাস আছে, যুক্তি নেই।

আমি জানি না কি- তাহলে কি অকারণ?

মনোবিদরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন-

এইটেই রোমান্টিকতার মূলমন্ত্র।

রবীন্দ্রনাথে ‘অকারণ’ বিশেষণটি অসংখ্যবার ধ্বনিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় একেক সময় প্রায় অকারণেই।

‘কী জানি’, ‘কে জানে’, ‘না জানি’-

‘আমার মন কেমন করে-

কে জানে, কাহার তরে’

প্রভৃতি সমাবেশ তাঁর শব্দরচনার মধ্যে সবচেয়ে ক্লান্তিহীন এক ব্যাকুলতা।

‘নিশিথে কী ক’য়ে গেল মনে/ কী জানি,

কী জানি’-

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মানুষের মনের প্রতিক্রিয়ায় সত্যিই অকারণ-অহেতুক কিছু হয় বা ঘটে কি-না...

স্পষ্টত একটা প্রশ্নের মুখোমুখি রোমান্টিক কবিদের মতো সাধারণ মানুষও কি দূরপ্রেমিক?

অথবা দূরতৃষ্ণ?

কোন লক্ষ্যহীন অজানা বাসনা তাড়া করে ফেরে?

এই পর্যন্ত আমি মৌন।

কারণ সম্ভবত এই যে, এই সঙ্কীর্ণ জগত আমাদের কাছে অনন্ত ঠেকে। প্রকৃতির রূপ বদলায়, অবচেতন দূরদৃষ্টির কল্যাণে উপলব্ধিজাত অনুষঙ্গের গভীরতা আমাদের মন ভোলায়, মৌনতা চমক ভাঙে; এই যে অনুচ্চ আলাপ বাণী ভাবের অনুষঙ্গে শোনামাত্র আমাদের সবিস্ময় চমক জাগে! এবং এই জগত-প্রকৃতির দৃশ্যমান বস্তুমাত্রে যখন ভাষাই ঘটনাবহ, তখন সংবেদনশীল না হলে তা মনোযোগে আসে না।

যখন আত্মা সমস্ত জগত পরিব্যাপ্ত করে আছে-

‘ওগো সুদূর বিপুল সুদূর! তুমি যে বাজাও

ব্যাকুল বাঁশরি!

মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই, সে কথা

যে যাই পাশরি।’

তখন যে আত্মা বাস্তুবিরহিত জগত পরিব্যাপ্ত করে আছে, সেখানে নজর চলে না, শূন্য-সুদূরতার সীমায় তার দৃষ্টি প্রায় নির্নিমেষ।

রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও স্বরগুচ্ছ, ভাবব্যঞ্জনা, স্বরসংগতি, বন্দিশ, খেয়াল, কীর্তন-বাউলীয় প্রভাব, গানের আবয়বিক নির্মিতি, স্বরের কনসোনেনস-ডিসকনসোনেনস, যন্ত্রের ব্যবহার ও সুরবহন, টেম্পারামেন্ট নাড়িনক্ষত্র বিষয়ে আগ্রহী ও আলোচনা ইত্যাদি গবেষকের কাজ।

আমার নিজস্ব মত, রবীন্দ্রনাথের সুর-প্রতিভা জীবনপরিধির বৈচিত্র্য ও বোধের সীমা অতিক্রম করে চিরন্তনের অচ্ছেদ্য সূত্রে আমাদের বেঁধে ফেলেন। সে বোধের প্রধান ‘ভ্যালু’গুলো কী? প্রথমেই যেটা মনে হবে, তাহলো তিনি একজন নন-কনফার্মিস্ট, অর্থাৎ সংগীতের প্রচলিত ধারার অনুবর্তী হলেন না। তাঁর কমিটমেন্ট ‘হিউম্যানিজম’-এর কাছে। এরপর যেটা দেখতে পাই তা তাঁর সৌন্দর্য তৃষ্ণা। এই সৌন্দর্যতৃষ্ণা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কাব্যের নৈপুণ্যের মধ্যে অর্থাৎ বাণী ও সুরের যুগলবন্দী, এককথায় সংগীত ভুবনের পরিবেশের মধ্যে, অতৃপ্ত আকণ্ঠ প্রেম তৃষ্ণার মধ্যে। এমন প্রেম যা হৃদয়কে উদার করে, জীবনকে সুন্দর করে- এমনকি ক্ষুদ্রতার প্রতি বিমুখ করে মানুষকে। যেখানে প্রেম এবং ভালোবাসতে পারলে ভুবনটাই উদ্যান হয়ে যায়। সমস্ত ব্যাধি ও বার্ধক্যের, অস্বাস্থ্য ও অকল্যাণের প্রতিষেধক এমন একটা জিনিস, যেখানে মানুষে মানুষে মিলনে প্রীতি ও প্রেম সার্থকতা লাভ করে। বিরহ-বিচ্ছেদ, অতৃপ্ত-অশান্ত বিক্ষুব্ধ আত্মা এমন কিছু খুঁজে বেড়ায়, মানুষ যেখানে জীবনের সত্য

খুঁজে বেড়ায়।

কাব্যে রূপবর্ণনা সহজ ও সম্ভব, সংগীতে রূপসৃষ্টি ধ্যান তন্ময় ভাস্কর-প্রাণ বাঙ্ময় মর্মরে রচিত- “তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ ও মোর ভালোবাসার ধন।” খেয়ালের খুশিতে বা মানুষের মনের গতিবিধি ও ব্যবহার প্রকৃতির মতোই হিসেবের মধ্যে আনতে যাওয়াও বিড়ম্বনার- “আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল” কিংবা “সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারিধার। দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি, আকাশে জল ঝরে অনিবার- জগতে কেহ যেন নাহি আর” -ঠিক তখন প্রকৃতির সঙ্গে সৌহার্দ্যসূত্র মনে হয় অনন্তকালের; তার চোখে বৃষ্টি নামে এবং সে শুধু চিত্ররূপময় নয়, তার প্রাণপ্রবাহ প্রকৃতিসুন্দরে নিবিড় এবং জগতনিষ্ঠ বস্তুর ঠিকানা যায় হারিয়ে; নিরবচ্ছিন্ন জগতের ছায়াময় রাজ্যে দুটি মানব সত্তার শুদ্ধতম অস্তিত্ব বাণী ও সুরের মধ্যস্থতায় অভিনিবিষ্ট হয় বলেই সমাজ সংসারও মিছে, নিষ্ফল, অকারণ বলে মনে হয়, আর তখন - না, কবিতা নয়, গানই শ্রেষ্ঠ শিল্প। সমস্ত শিল্পের সর্বোচ্চ আসনে আছে সংগীত, তারপরে কাব্য। এই দুটোই মননব্যাপার। মানুষের মননরাজ্যে দু’য়ের একাধিপত্য প্রায় নিঃসংশয়। বহিরাগত উপদ্রব সত্ত্বেও সংগীত ও কাব্য স্বরাজ্যে-স্বয়ম্ভু। ললিতকলার ধর্মে তা অপরিবর্তনীয় কি না, এমন প্রশ্ন সত্ত্বেও বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথের গান ‘ভাস্কর্যের মতো’ অপরিবর্তনীয়। সত্তাশূন্য বস্তুরেখার ধ্যানে, সত্য ও সুন্দরের যে ভাবনার ভাস্কর্য আমরা দেখি- তা ধ্বসে পড়ে না।

১৯১৪ সালে এ এইচ ফকস স্ট্র্যাংওয়েইজ তাঁর Music of Hindustan গ্রন্থে পশ্চিমী সংগীতের প্রতিতুলনায় পূর্বি সংগীত হিসেবে তিনি রবীন্দ্রসংগীতকে মডেল হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। এমনকি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-কৃত রবীন্দ্রনাথের গানের স্টাফ নোটেশন পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন। তাহলে সম্ভাব্য একটি প্রশ্ন জোরালোভাবে জাগে, পশ্চিমী এবং ভারতীয় সংগীতের মূল প্রভেদ কী? পশ্চিমী সংগীতে কোন অনির্দিষ্ট অজৈব অর্থাৎ প্রাণিজ বা উদ্ভিদহীন কম্পোজিশনধর্মী বা অবাস্তব অবয়ব সৃষ্টির চেষ্টা অথবা ইঙ্গিত নেই। কিন্তু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত রাগরূপ ধরে চলে। সংগীত পরিবেশনকালে একটা impersonal অর্থাৎ অনির্দিষ্ট অবয়ব ইচ্ছে মতো গড়ে তোলা যায়। সেখানে গানের সুরাবয়ব জৈব বা সজীব-সম্বন্ধীয় রূপ গঠনের মতো নির্দিষ্টতা ধরা পড়ে। পড়বেই এমন নয়, সহজ মতান্তরে বলতে পারি, একটা মানসিক প্রক্রিয়ার উপলক্ষযোগে ভারতীয় বা বিশেষত রবীন্দ্র সংগীতের রূপসৃষ্টি। কোনও আত্মনিষ্ঠ বস্তুর ঠিকানা, ঋতু, প্রকৃতি ও সময়গত ভাবব্যঞ্জনা, যার সংস্পর্শে জাগে এমনই এক বিন্যাস- যা কেবল সংগীতেরই ভাষা। প্রত্যেক শব্দ এক-একটি ধ্যান, মগ্নচৈতন্য সৌন্দর্যের আনন্দরূপ- বিশেষত রবীন্দ্রনাথের গানে। সৌন্দর্যপিপাসুর কাছে বস্তু বা বিষয় গৌণ, তার ধ্যানই মুখ্য। সংগীত উপভোগে ধ্যানের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতেই হয়। পশ্চিমী সংগীতের মতো অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও বিস্তারের অবকাশ এখানে নেই।

প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি, খ্রিস্টধর্মের প্রচারকেরা ধর্মসংগীতের জন্যে উনিশ শতকে এদেশে পিয়ানোর একটা বহনযোগ্য গোছের হারমনিয়াম তৈরি করে এনেছিলেন। এদেশেই ওঁরা এটা ফেলে চলে যান। গায়ক-শিল্পীরা নিজের গানে এই যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াও কনসার্টে, তারপর জলসা-মাহফিলে আর প্রসেনিয়ম বা মঞ্চশ্রাব্য হয়ে, এই যন্ত্র এদেশে সংগীতের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠলো। পিয়ানোর মতোই সুরের স্থির পর্দার সাদা-কালো চাবির স্কেল টেম্পারমেন্ট স্বাভাবিক স্বরগত হলেও, সূক্ষ্মশ্রুতিতে সংগীতের অর্থাৎ ভারতীয় সুরের গড়ানে চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারতীয় গ্রামের কম্পন সংখ্যা ও পশ্চিমি গ্রামের কম্পন সংখ্যাও ভিন্নতর। দুটিই পরম্পরাগত দুভাবে বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষাপ্রসূত উপলব্ধির অনিবার্য তাগিদে তাঁর গানের স্বকীয় সুর শোনাতে চাইলেন জোয়ারি অর্থাৎ বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ বাণী ও সুরের আত্মীয়তা হৃদগত বা ঐকান্তিকে পৌঁছে– যে ফলকটি তানপুরা, এসরাজ, সেতার শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের তারে ধারণ করতে পারে। যদিও তাঁর অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপিভুক্ত ‘স্বরলিপি-গীতি-মালা’য় হারমনিয়াম শিক্ষার পদ্ধতি শেখালেও এ-ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট সম্মতিগত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, ‘হারমনি বা স্বরসংগতি ইয়োরোপের সংগীতের প্রধান দিক, আমাদের, অবলম্বন শাস্ত্রনির্দিষ্ট রাগরাগিণী। পশ্চিমি সংগীতে হারমনি অনেক সময় মেলডিকে ঢেকে চলে, আর, মেলডি আমাদের মূল আশ্রয়। বহুস্বরিক পশ্চিমি সংগীতে রচয়িতা স্বরগুচ্ছকে সাজাতে পারেন; আমাদের রাগরাগিনীর শ্রেণিগত স্বরগুচ্ছ এক-একটি ঋতু ও সময়গত ভাবব্যঞ্জনা নিয়ে আসে।’

আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি যে রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় সংগীতের অচলায়ন ভেঙে তিনি বিস্তর আর্ষ অর্থাৎ ব্যকরণবিরুদ্ধ স্বরচিত নিয়মে চিরসার্থক সংগীতের জন্ম দিতে পেরেছিলেন। যেখানে গুরুস্বরের মাতবরি নেই। শিল্প প্রকরণের দিক দিয়ে তাঁর গানের মর্যাদা সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যের উচ্চাসন পেয়েছে। এদিক থেকেও তিনি আজ পর্যন্ত বিশ্বের তাবৎ কবি ও সংগীতকারদেরও বহু পশ্চাতে ছেড়ে এসেছেন। এই মর্মে রবীন্দ্রনাথের উক্তি স্মরণযোগ্য, ‘আমার সমস্ত সৃষ্টির কথা মানুষ যদি একদিন ভুলেও যায়, তবু আমার গানের মৃত্যু হবে না। বাঙালিকে আমার গান গাইতেই হবে।’ একসময় গানের আবয়বিক নির্মিতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মোৎজার্ট বেঠোফেনের মতো ভেবেছিলেন। যেখানে তিনি সুরকে কথা থেকে আলাদা করে দেখেননি। তাঁর গানে কথা ও সুরের যৌগপদ্যেই ভাব আপনাকে অলৌকিক রূপে ব্যক্ত করে। এমন যৌগপদ্য মিলন ভারতীয় সংগীতে এক চমৎকার ব্যাপার বটে। তাঁর সঞ্চারিও তাই। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মুক্ত তালের গানও ছন্দোহীন নয়। সেখানে লয় পশ্চিমী সংগীতের মতো স্পষ্ট। বাঁধা গতের একঘেয়েমি ভাঙতে গান রচনার প্রথম পর্বে তিনি পশ্চিমী কাব্যগতিকে গানে আনলেন এবং শেষ পর্বে আনলেন পশ্চিমী সংগীতের গঠনকে। এ প্রসঙ্গে পরিশ্রমী সংগীত গবেষক সাধন দাশগুপ্ত তাঁর ‘সংগীত পূর্ব-পশ্চিম’ গবেষণা গ্রন্থে বলেন, ‘বহিরঙ্গে এ গান পশ্চিমী সংগীতকে মনে করালেও অন্তরে এ গান এদেশী।”

‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’-র স্বসজ্জা পিলু কানাড়া পরজে কীর্তনের ছন্দে যে-ভাবে রচিত তার তুলনা ভারতীয় সংগীতে আগে ছিল না। তাঁর গান স্থবির হয়ে পড়ে না, অপূর্ব ঐশ্বর্যে এক সচল সৃষ্টি। এইখানেই রবীন্দ্রনাথের কারিশমা, তাঁর চমৎকৃতি। বাংলার বাউল সংগীত ও কীর্তনও রাগের বন্ধন মানেনি বা কোনো একটি রাগকে সর্বস্ব মনে করেনি। ভাবসঙ্গতির ও ধ্বনিমাধুর্যের প্রাঞ্জলতা ঐতিহ্যের এই সাহস রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন। যেখানে প্রাঞ্জলতার পরিপন্থী ওস্তাদি কিংবা প্রভুত্ব চলে না। আরও একটি কথা যুক্ত করতে চাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায় পিয়ানোতে তোলা সুরে রবীন্দ্রনাথ জীবনে গান রচনা করেছেন, শেষ জীবনে করেছেন এসরাজের সহযোগে। এই পর্বে তিনি হারমনিয়াম বর্জন করেছিলেন, বিকল্পে কোনও সংগীতবাদ্য বাজিয়েছেন এমন শোনা যায়নি। তিনি স্বরলিপি লিখতে পারতেন না বলে এঁর-তাঁর সহায়তা নিতেন। কাব্যের উপমায় বাণীরূপ ও সুরভাষ্যেই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষে শ্রোতার মন কল্পনার দিকে ঝোঁকে, এবং তা এমনই এক স্বপ্নময়রাজ্য, যার সার্থকতা অর্থগত নয়, মোহজালেও ঘিরে ফেলে না, চিত্রগত পৃথিবী পর্যটনেও তার সাক্ষাৎ মেলে এবং দূর অবধি অমৃতলোকের কাছে পৌঁছে। যিনি স্বরলিপি লেখেননি, যন্ত্রে সুর তোলেননি তাঁর সংগীতরচন ক্ষমতাকে অলৌকিক ছাড়া কী বলা যায়! মায়াকাজল পরিয়ে, তর্কপ্রবৃত্তিকে ঘুম পাড়িয়ে অরূপ সন্ধানে আমাদের নিয়ে যান- যা কেবল অন্তরে অভিনিবিষ্ট। সংক্ষেপে বলতে পারি, রবীন্দ্রপ্রতিভা যেমন ভাবগ্রাহী, তেমনি পরিকল্পনার নিগূঢ় অর্থ বা মর্মসম্বন্ধীয়।

রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের গানে কাব্যের ছন্দই সংগীতের লয়। সমে ফিরে আসার বাধ্যবাধকতাও রবীন্দ্রনাথ উঠিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও বারবার বলে গেছেন তাঁর গান রাগসংগীত নয়, এর মেজাজ ও উদ্দেশ্য দুই আলাদা, এটা একটা নতুন জিনিস- তখন সে গানের সঙ্গে ওস্তাদি বাজনা বাজিয়ে রচয়িতার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় না কি? এ জিনিসটা করলে রচনায় অযথা dichotomy এসে পড়ে, যেটা গানের পক্ষে মঙ্গলকর হতে পারে না।” অর্থাৎ একটা বিপরীতমুখী প্রয়োগ-প্রশ্রয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরূপ-সম্বন্ধ নষ্ট হয়। সত্যজিতের মতের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ধ্বনিবদ্ধ শ্রুতিতে ‘তবু মনে রেখো’, ‘আমার পরাণ লয়ে’ ‘এসো এসো ফিরে এসো’ গানের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ প্রায় অশ্রুত এসরাজের সঙ্গে প্রায় খালি গলায় গেয়েছিলেন। গলায় তালবোধ লয়বোধ থাকলে তবলার চাঁটি সংযোগ অবশ্যই গানের ধ্বনিগৌরব ক্ষুণ্ণ করে- যার সমর্থনে সত্যজিৎ রায় ডাইকোটমিকে দুর্ভাগ্য বলে মনে করেন। সত্যজিৎ যেটা বলেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ যা করেছিলেন ওটা আইডিয়াল-ধারণা বা ইচ্ছা প্রসূত- যেটা বিশ্বভারতী মানেন না। ফলে কী দাঁড়ালো, কি-বোর্ড, তবলা, জোড়া তানপুরা এবং কনসার্টধর্মী মিউজিক না বাজালে রবীন্দ্রনাথের গানও sailable বা বিক্রয়যোগ্য হবে না। যুক্তি-বাজারে আইডিয়্যাল জিনিস চলে না।

তাহলে কী দাঁড়ালো –যুগধর্মের তাগিদে, যুগসিদ্ধিতে কেবল চর্চা-স্বাধিকারবোধে নিজের সীমাবদ্ধ-সুবিধায় প্রথাপ্রবণ কলটেপা পুতুলের মতো রবীন্দ্রনাথের গান আওড়াইবো? চোখ-কানের ব্যবহার আমার শিখলাম না, উপলব্ধি-অনুধ্যানে বুঝলাম না রবীন্দ্রনাথের গান কী জিনিস? দীক্ষাহীন, নৈমিত্তিক সংস্কারে যেটুকু রপ্ত- তারই অহংকারে আতিশয্যে দিন কাটবে? কেবল প্রথাগত ঐতিহ্যে মাথা নাড়া আছে, উত্তরণ নেই। মনে রাখতে হবে ঐতিহ্য আর প্রথার মধ্যে ঐক্যের চেয়ে বৈষম্যই বেশি। একজন যথার্থ শিল্পীর জীবনীশক্তির উৎস দেশ-কালাতিরিক্ত নৈর্ব্যক্তিক উপলব্ধির সংস্কারে।

কালের সঙ্গে পা মিলিয়ে, সময়ের শুচিবায়ুতে পাঁক খেয়ে খেয়ে এর গায়নপদ্ধতিও আজ কোথায় পৌঁছেছে, একট দাহময় শোচনীয়তার মধ্যে পড়েছি আমরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান যেভাবে গাইতেন, শান্তিদেব ঘোষ এবং তাঁর সমকালীন শিল্পীরা যেভাবে গাইতেন, আজ সে-ভাবে গাওয়া তো হয়ই না, তার অনুসরণও চোখে পড়ে না অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে। আত্মনিষ্ঠ শিল্পীর স্বকীয়তা মূল্য ও মর্যাদাই বা ক’জন দিতে জানেন? তাঁর গানের উপস্থাপন বর্তমান বাজার ও রুচির সঙ্গে অনেকখানি বোঝাপড়া চললেও, একথা সত্য যে, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের গান তার রসবৈচিত্র্যের স্বতন্ত্র ও সহজ প্রবৃত্তিতে সঁপে দিয়ে স্বকীয় মূল্যের যোগফলে অনেকখানি বিস্ময় লাগে। সে বিস্ময়-রবীন্দ্রনাথের গানকে ভালোবেসেই সে কণ্ঠে ধারণ করে চলেছে সবসময়ই। তবে বাংলার- বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ যদি অনতিক্রম্য হন, এই গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন, তাঁর গান কথায় সুরে এক সজীব মূর্তি এবং ললিতকলার ধর্মে তা অপরিবর্তনীয়। অপর কেউ এসে কোনো ফাঁক ভরাট করবে কিংবা এর উৎকর্ষ সাধন করবে, এমন অবকাশ তিনি রাখেননি। পশ্চিমী সংগীতের মতোই তাঁর গান বস্তুত কম্পোজিশন। গায়ক-বাদকের দক্ষতায় ও ইন্টারপ্রেটেশনের চমৎকারিত্বে যেমন একই পশ্চিমী সংগীত এক-একভাবে প্রতিভাত হয়, রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। গায়কের কাছে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন একটু ভাব, একটু দরদ, একটু রস। তাঁর গান যখন গাওয়া হবে তখন তাতে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যাবে, গায়ককেও পাওয়া যাবে।

পশ্চিমি সুরের আত্তীকরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথের আসক্তি ছিলো স্বরের কনসোনেন্সের প্রতি, পরবর্তীরা আগ্রহী ডিসকনসোনেন্সের প্রতি। তাঁদের সুরে মুভমেন্টের ঠিকানা নেই, যেমন আছে রবীন্দ্রনাথে। বাংলা গানে খুব পশ্চিমের জোড়কলম চলে রবীন্দ্রনাথকে ধরে এবং তার থেকে সরে এসেও। পশ্চি সুর¯্রষ্টারা গণিতের ছকে পাওয়া অর্থহীন কর্ডকে হারমনির পটভূমিতে সংগীত ব্যবহার করেছেন, বিশুদ্ধ অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্ম হিসেবে। পশ্চিম থেকে গ্রহণ করলেও কথার সঙ্গে সুরের মিলনের দিক থেকে, নিজের ভাবের অনুকূলে রবীন্দ্রনাথ তা গ্রহণ করলেন। তাঁর বাণী ও সুরের যুগলবন্দি পশ্চিমি গণিতের মতো নৈর্ব্যক্তিক নয়। রবীন্দ্রনাথের গান সমস্ত হিসাবনিকাশ খতিয়ানের বাইরে বিস্তীর্ণ এক দিগন্ত। সংগীতকে যাঁরা তত্ত্বের পথে পেতে চান, তাদের পক্ষে তো বটেই, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান কণ্ঠে নিয়েছেন বা ধারণ করবেন, তাদের রবীন্দ্রনাথের “সংগীতচিন্তা” এবং রবীন্দ্রসাহিত্য অবশ্যই পড়তে হবে।

সৃজনপিয়াসী মানুষ সুরকে বর্ণরূপময় করে প্রকাশ করতে চেয়েছে চিরকাল। সুর ও দূর পৃথিবীকে শিল্পী শুধু চোখের অভিজ্ঞতায় নয়, কান পেতেও শুনতে চান। শিল্পকে শেষাবধি সংগীতে উত্তীর্ণ হতে হয়- এই সত্যে যিনি যত বেশি ঘনিষ্ঠ, তিনি ততবেশি ধীমান। সুর রূপ ও বর্ণে প্রতিপন্ন করা নয় শুধু, বরং রূপের মাধুরি বা নির্যাসটুকু শব্দ কিংবা বর্ণযোজনে অধরাকে নিপুণতায় প্রকাশ করার নামই শিল্প। এই সূক্ষ্ম শিল্পকর্মটি আমাদের অদেখা মনোজগতে মূর্ত-বিস্ময়ের অভিঘাতে আলোড়িত করে। জগত কতো যে আনন্দে পূর্ণ এবং মর্তভূমির উপরে সুন্দরের অভ্যস্ত ধ্যানে অপার মহিমা বিদ্যমান এবং তার ছায়াপাতে বিস্ময়ই জাগে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মতোই মুগ্ধ হই, এবং শান্তি ও মুগ্ধতাই সংগীতের শেষ কথা।

রবীন্দ্রনাথের গানে সুর ও বাণীর জানালা খুলে গিয়ে সহস্র রশ্মি ঢুকে অন্তিম ঐক্যটাকেই উদ্ভাসিত করে তোলে, তার অসীমতাকে না মেনে উপায় থাকে না। তখন প্রকৃতি বেদনীয় কি আনন্দময় তা যেমন নিরর্থক, তেমনি জগতটা চাক্ষুষ সত্যের চেয়ে বেশি বাস্তব দেখায়। আমার কাছে এইটেই রবীন্দ্রনাথের গানের চিরকালীন লক্ষণ এবং তাঁর গান ভাষা, সুর ও ছন্দের মনষ্কতা স্বরূপে চিরন্তন অভীপ্সায় উৎসারিত চিরনূতন চিরপুরাতন। এবং যা-কিছু সনাতন তাই আধুনিক।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

রবীন্দ্রনাথের গান

চিরনূতন চিরপুরাতন

জামিরুল শরীফ

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

আমার মন ভালো নেই,

কেন?

জানি না।

আমি একজনকে ভালোবাসি,

সে কে?

জানি না।

কেন?

কী করে বলি-

আমি কি তাকে দেখেছি?

এই যুক্তিহীন মনস্তত্ত্বের কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু এ হচ্ছে রোমান্টিক বিষাদ- যা অহেতুক, অথচ চরিত্রলক্ষণ স্পষ্ট, যার আভাস আছে, যুক্তি নেই।

আমি জানি না কি- তাহলে কি অকারণ?

মনোবিদরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন-

এইটেই রোমান্টিকতার মূলমন্ত্র।

রবীন্দ্রনাথে ‘অকারণ’ বিশেষণটি অসংখ্যবার ধ্বনিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় একেক সময় প্রায় অকারণেই।

‘কী জানি’, ‘কে জানে’, ‘না জানি’-

‘আমার মন কেমন করে-

কে জানে, কাহার তরে’

প্রভৃতি সমাবেশ তাঁর শব্দরচনার মধ্যে সবচেয়ে ক্লান্তিহীন এক ব্যাকুলতা।

‘নিশিথে কী ক’য়ে গেল মনে/ কী জানি,

কী জানি’-

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মানুষের মনের প্রতিক্রিয়ায় সত্যিই অকারণ-অহেতুক কিছু হয় বা ঘটে কি-না...

স্পষ্টত একটা প্রশ্নের মুখোমুখি রোমান্টিক কবিদের মতো সাধারণ মানুষও কি দূরপ্রেমিক?

অথবা দূরতৃষ্ণ?

কোন লক্ষ্যহীন অজানা বাসনা তাড়া করে ফেরে?

এই পর্যন্ত আমি মৌন।

কারণ সম্ভবত এই যে, এই সঙ্কীর্ণ জগত আমাদের কাছে অনন্ত ঠেকে। প্রকৃতির রূপ বদলায়, অবচেতন দূরদৃষ্টির কল্যাণে উপলব্ধিজাত অনুষঙ্গের গভীরতা আমাদের মন ভোলায়, মৌনতা চমক ভাঙে; এই যে অনুচ্চ আলাপ বাণী ভাবের অনুষঙ্গে শোনামাত্র আমাদের সবিস্ময় চমক জাগে! এবং এই জগত-প্রকৃতির দৃশ্যমান বস্তুমাত্রে যখন ভাষাই ঘটনাবহ, তখন সংবেদনশীল না হলে তা মনোযোগে আসে না।

যখন আত্মা সমস্ত জগত পরিব্যাপ্ত করে আছে-

‘ওগো সুদূর বিপুল সুদূর! তুমি যে বাজাও

ব্যাকুল বাঁশরি!

মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই, সে কথা

যে যাই পাশরি।’

তখন যে আত্মা বাস্তুবিরহিত জগত পরিব্যাপ্ত করে আছে, সেখানে নজর চলে না, শূন্য-সুদূরতার সীমায় তার দৃষ্টি প্রায় নির্নিমেষ।

রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী ও স্বরগুচ্ছ, ভাবব্যঞ্জনা, স্বরসংগতি, বন্দিশ, খেয়াল, কীর্তন-বাউলীয় প্রভাব, গানের আবয়বিক নির্মিতি, স্বরের কনসোনেনস-ডিসকনসোনেনস, যন্ত্রের ব্যবহার ও সুরবহন, টেম্পারামেন্ট নাড়িনক্ষত্র বিষয়ে আগ্রহী ও আলোচনা ইত্যাদি গবেষকের কাজ।

আমার নিজস্ব মত, রবীন্দ্রনাথের সুর-প্রতিভা জীবনপরিধির বৈচিত্র্য ও বোধের সীমা অতিক্রম করে চিরন্তনের অচ্ছেদ্য সূত্রে আমাদের বেঁধে ফেলেন। সে বোধের প্রধান ‘ভ্যালু’গুলো কী? প্রথমেই যেটা মনে হবে, তাহলো তিনি একজন নন-কনফার্মিস্ট, অর্থাৎ সংগীতের প্রচলিত ধারার অনুবর্তী হলেন না। তাঁর কমিটমেন্ট ‘হিউম্যানিজম’-এর কাছে। এরপর যেটা দেখতে পাই তা তাঁর সৌন্দর্য তৃষ্ণা। এই সৌন্দর্যতৃষ্ণা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কাব্যের নৈপুণ্যের মধ্যে অর্থাৎ বাণী ও সুরের যুগলবন্দী, এককথায় সংগীত ভুবনের পরিবেশের মধ্যে, অতৃপ্ত আকণ্ঠ প্রেম তৃষ্ণার মধ্যে। এমন প্রেম যা হৃদয়কে উদার করে, জীবনকে সুন্দর করে- এমনকি ক্ষুদ্রতার প্রতি বিমুখ করে মানুষকে। যেখানে প্রেম এবং ভালোবাসতে পারলে ভুবনটাই উদ্যান হয়ে যায়। সমস্ত ব্যাধি ও বার্ধক্যের, অস্বাস্থ্য ও অকল্যাণের প্রতিষেধক এমন একটা জিনিস, যেখানে মানুষে মানুষে মিলনে প্রীতি ও প্রেম সার্থকতা লাভ করে। বিরহ-বিচ্ছেদ, অতৃপ্ত-অশান্ত বিক্ষুব্ধ আত্মা এমন কিছু খুঁজে বেড়ায়, মানুষ যেখানে জীবনের সত্য

খুঁজে বেড়ায়।

কাব্যে রূপবর্ণনা সহজ ও সম্ভব, সংগীতে রূপসৃষ্টি ধ্যান তন্ময় ভাস্কর-প্রাণ বাঙ্ময় মর্মরে রচিত- “তোমায় নতুন করে পাব ব’লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ ও মোর ভালোবাসার ধন।” খেয়ালের খুশিতে বা মানুষের মনের গতিবিধি ও ব্যবহার প্রকৃতির মতোই হিসেবের মধ্যে আনতে যাওয়াও বিড়ম্বনার- “আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল” কিংবা “সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারিধার। দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি, আকাশে জল ঝরে অনিবার- জগতে কেহ যেন নাহি আর” -ঠিক তখন প্রকৃতির সঙ্গে সৌহার্দ্যসূত্র মনে হয় অনন্তকালের; তার চোখে বৃষ্টি নামে এবং সে শুধু চিত্ররূপময় নয়, তার প্রাণপ্রবাহ প্রকৃতিসুন্দরে নিবিড় এবং জগতনিষ্ঠ বস্তুর ঠিকানা যায় হারিয়ে; নিরবচ্ছিন্ন জগতের ছায়াময় রাজ্যে দুটি মানব সত্তার শুদ্ধতম অস্তিত্ব বাণী ও সুরের মধ্যস্থতায় অভিনিবিষ্ট হয় বলেই সমাজ সংসারও মিছে, নিষ্ফল, অকারণ বলে মনে হয়, আর তখন - না, কবিতা নয়, গানই শ্রেষ্ঠ শিল্প। সমস্ত শিল্পের সর্বোচ্চ আসনে আছে সংগীত, তারপরে কাব্য। এই দুটোই মননব্যাপার। মানুষের মননরাজ্যে দু’য়ের একাধিপত্য প্রায় নিঃসংশয়। বহিরাগত উপদ্রব সত্ত্বেও সংগীত ও কাব্য স্বরাজ্যে-স্বয়ম্ভু। ললিতকলার ধর্মে তা অপরিবর্তনীয় কি না, এমন প্রশ্ন সত্ত্বেও বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথের গান ‘ভাস্কর্যের মতো’ অপরিবর্তনীয়। সত্তাশূন্য বস্তুরেখার ধ্যানে, সত্য ও সুন্দরের যে ভাবনার ভাস্কর্য আমরা দেখি- তা ধ্বসে পড়ে না।

১৯১৪ সালে এ এইচ ফকস স্ট্র্যাংওয়েইজ তাঁর Music of Hindustan গ্রন্থে পশ্চিমী সংগীতের প্রতিতুলনায় পূর্বি সংগীত হিসেবে তিনি রবীন্দ্রসংগীতকে মডেল হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। এমনকি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-কৃত রবীন্দ্রনাথের গানের স্টাফ নোটেশন পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন। তাহলে সম্ভাব্য একটি প্রশ্ন জোরালোভাবে জাগে, পশ্চিমী এবং ভারতীয় সংগীতের মূল প্রভেদ কী? পশ্চিমী সংগীতে কোন অনির্দিষ্ট অজৈব অর্থাৎ প্রাণিজ বা উদ্ভিদহীন কম্পোজিশনধর্মী বা অবাস্তব অবয়ব সৃষ্টির চেষ্টা অথবা ইঙ্গিত নেই। কিন্তু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত রাগরূপ ধরে চলে। সংগীত পরিবেশনকালে একটা impersonal অর্থাৎ অনির্দিষ্ট অবয়ব ইচ্ছে মতো গড়ে তোলা যায়। সেখানে গানের সুরাবয়ব জৈব বা সজীব-সম্বন্ধীয় রূপ গঠনের মতো নির্দিষ্টতা ধরা পড়ে। পড়বেই এমন নয়, সহজ মতান্তরে বলতে পারি, একটা মানসিক প্রক্রিয়ার উপলক্ষযোগে ভারতীয় বা বিশেষত রবীন্দ্র সংগীতের রূপসৃষ্টি। কোনও আত্মনিষ্ঠ বস্তুর ঠিকানা, ঋতু, প্রকৃতি ও সময়গত ভাবব্যঞ্জনা, যার সংস্পর্শে জাগে এমনই এক বিন্যাস- যা কেবল সংগীতেরই ভাষা। প্রত্যেক শব্দ এক-একটি ধ্যান, মগ্নচৈতন্য সৌন্দর্যের আনন্দরূপ- বিশেষত রবীন্দ্রনাথের গানে। সৌন্দর্যপিপাসুর কাছে বস্তু বা বিষয় গৌণ, তার ধ্যানই মুখ্য। সংগীত উপভোগে ধ্যানের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতেই হয়। পশ্চিমী সংগীতের মতো অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও বিস্তারের অবকাশ এখানে নেই।

প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি, খ্রিস্টধর্মের প্রচারকেরা ধর্মসংগীতের জন্যে উনিশ শতকে এদেশে পিয়ানোর একটা বহনযোগ্য গোছের হারমনিয়াম তৈরি করে এনেছিলেন। এদেশেই ওঁরা এটা ফেলে চলে যান। গায়ক-শিল্পীরা নিজের গানে এই যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াও কনসার্টে, তারপর জলসা-মাহফিলে আর প্রসেনিয়ম বা মঞ্চশ্রাব্য হয়ে, এই যন্ত্র এদেশে সংগীতের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠলো। পিয়ানোর মতোই সুরের স্থির পর্দার সাদা-কালো চাবির স্কেল টেম্পারমেন্ট স্বাভাবিক স্বরগত হলেও, সূক্ষ্মশ্রুতিতে সংগীতের অর্থাৎ ভারতীয় সুরের গড়ানে চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারতীয় গ্রামের কম্পন সংখ্যা ও পশ্চিমি গ্রামের কম্পন সংখ্যাও ভিন্নতর। দুটিই পরম্পরাগত দুভাবে বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষাপ্রসূত উপলব্ধির অনিবার্য তাগিদে তাঁর গানের স্বকীয় সুর শোনাতে চাইলেন জোয়ারি অর্থাৎ বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ বাণী ও সুরের আত্মীয়তা হৃদগত বা ঐকান্তিকে পৌঁছে– যে ফলকটি তানপুরা, এসরাজ, সেতার শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের তারে ধারণ করতে পারে। যদিও তাঁর অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপিভুক্ত ‘স্বরলিপি-গীতি-মালা’য় হারমনিয়াম শিক্ষার পদ্ধতি শেখালেও এ-ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট সম্মতিগত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, ‘হারমনি বা স্বরসংগতি ইয়োরোপের সংগীতের প্রধান দিক, আমাদের, অবলম্বন শাস্ত্রনির্দিষ্ট রাগরাগিণী। পশ্চিমি সংগীতে হারমনি অনেক সময় মেলডিকে ঢেকে চলে, আর, মেলডি আমাদের মূল আশ্রয়। বহুস্বরিক পশ্চিমি সংগীতে রচয়িতা স্বরগুচ্ছকে সাজাতে পারেন; আমাদের রাগরাগিনীর শ্রেণিগত স্বরগুচ্ছ এক-একটি ঋতু ও সময়গত ভাবব্যঞ্জনা নিয়ে আসে।’

আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি যে রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় সংগীতের অচলায়ন ভেঙে তিনি বিস্তর আর্ষ অর্থাৎ ব্যকরণবিরুদ্ধ স্বরচিত নিয়মে চিরসার্থক সংগীতের জন্ম দিতে পেরেছিলেন। যেখানে গুরুস্বরের মাতবরি নেই। শিল্প প্রকরণের দিক দিয়ে তাঁর গানের মর্যাদা সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যের উচ্চাসন পেয়েছে। এদিক থেকেও তিনি আজ পর্যন্ত বিশ্বের তাবৎ কবি ও সংগীতকারদেরও বহু পশ্চাতে ছেড়ে এসেছেন। এই মর্মে রবীন্দ্রনাথের উক্তি স্মরণযোগ্য, ‘আমার সমস্ত সৃষ্টির কথা মানুষ যদি একদিন ভুলেও যায়, তবু আমার গানের মৃত্যু হবে না। বাঙালিকে আমার গান গাইতেই হবে।’ একসময় গানের আবয়বিক নির্মিতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মোৎজার্ট বেঠোফেনের মতো ভেবেছিলেন। যেখানে তিনি সুরকে কথা থেকে আলাদা করে দেখেননি। তাঁর গানে কথা ও সুরের যৌগপদ্যেই ভাব আপনাকে অলৌকিক রূপে ব্যক্ত করে। এমন যৌগপদ্য মিলন ভারতীয় সংগীতে এক চমৎকার ব্যাপার বটে। তাঁর সঞ্চারিও তাই। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মুক্ত তালের গানও ছন্দোহীন নয়। সেখানে লয় পশ্চিমী সংগীতের মতো স্পষ্ট। বাঁধা গতের একঘেয়েমি ভাঙতে গান রচনার প্রথম পর্বে তিনি পশ্চিমী কাব্যগতিকে গানে আনলেন এবং শেষ পর্বে আনলেন পশ্চিমী সংগীতের গঠনকে। এ প্রসঙ্গে পরিশ্রমী সংগীত গবেষক সাধন দাশগুপ্ত তাঁর ‘সংগীত পূর্ব-পশ্চিম’ গবেষণা গ্রন্থে বলেন, ‘বহিরঙ্গে এ গান পশ্চিমী সংগীতকে মনে করালেও অন্তরে এ গান এদেশী।”

‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’-র স্বসজ্জা পিলু কানাড়া পরজে কীর্তনের ছন্দে যে-ভাবে রচিত তার তুলনা ভারতীয় সংগীতে আগে ছিল না। তাঁর গান স্থবির হয়ে পড়ে না, অপূর্ব ঐশ্বর্যে এক সচল সৃষ্টি। এইখানেই রবীন্দ্রনাথের কারিশমা, তাঁর চমৎকৃতি। বাংলার বাউল সংগীত ও কীর্তনও রাগের বন্ধন মানেনি বা কোনো একটি রাগকে সর্বস্ব মনে করেনি। ভাবসঙ্গতির ও ধ্বনিমাধুর্যের প্রাঞ্জলতা ঐতিহ্যের এই সাহস রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন। যেখানে প্রাঞ্জলতার পরিপন্থী ওস্তাদি কিংবা প্রভুত্ব চলে না। আরও একটি কথা যুক্ত করতে চাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায় পিয়ানোতে তোলা সুরে রবীন্দ্রনাথ জীবনে গান রচনা করেছেন, শেষ জীবনে করেছেন এসরাজের সহযোগে। এই পর্বে তিনি হারমনিয়াম বর্জন করেছিলেন, বিকল্পে কোনও সংগীতবাদ্য বাজিয়েছেন এমন শোনা যায়নি। তিনি স্বরলিপি লিখতে পারতেন না বলে এঁর-তাঁর সহায়তা নিতেন। কাব্যের উপমায় বাণীরূপ ও সুরভাষ্যেই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষে শ্রোতার মন কল্পনার দিকে ঝোঁকে, এবং তা এমনই এক স্বপ্নময়রাজ্য, যার সার্থকতা অর্থগত নয়, মোহজালেও ঘিরে ফেলে না, চিত্রগত পৃথিবী পর্যটনেও তার সাক্ষাৎ মেলে এবং দূর অবধি অমৃতলোকের কাছে পৌঁছে। যিনি স্বরলিপি লেখেননি, যন্ত্রে সুর তোলেননি তাঁর সংগীতরচন ক্ষমতাকে অলৌকিক ছাড়া কী বলা যায়! মায়াকাজল পরিয়ে, তর্কপ্রবৃত্তিকে ঘুম পাড়িয়ে অরূপ সন্ধানে আমাদের নিয়ে যান- যা কেবল অন্তরে অভিনিবিষ্ট। সংক্ষেপে বলতে পারি, রবীন্দ্রপ্রতিভা যেমন ভাবগ্রাহী, তেমনি পরিকল্পনার নিগূঢ় অর্থ বা মর্মসম্বন্ধীয়।

রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের গানে কাব্যের ছন্দই সংগীতের লয়। সমে ফিরে আসার বাধ্যবাধকতাও রবীন্দ্রনাথ উঠিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও বারবার বলে গেছেন তাঁর গান রাগসংগীত নয়, এর মেজাজ ও উদ্দেশ্য দুই আলাদা, এটা একটা নতুন জিনিস- তখন সে গানের সঙ্গে ওস্তাদি বাজনা বাজিয়ে রচয়িতার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় না কি? এ জিনিসটা করলে রচনায় অযথা dichotomy এসে পড়ে, যেটা গানের পক্ষে মঙ্গলকর হতে পারে না।” অর্থাৎ একটা বিপরীতমুখী প্রয়োগ-প্রশ্রয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরূপ-সম্বন্ধ নষ্ট হয়। সত্যজিতের মতের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ধ্বনিবদ্ধ শ্রুতিতে ‘তবু মনে রেখো’, ‘আমার পরাণ লয়ে’ ‘এসো এসো ফিরে এসো’ গানের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ প্রায় অশ্রুত এসরাজের সঙ্গে প্রায় খালি গলায় গেয়েছিলেন। গলায় তালবোধ লয়বোধ থাকলে তবলার চাঁটি সংযোগ অবশ্যই গানের ধ্বনিগৌরব ক্ষুণ্ণ করে- যার সমর্থনে সত্যজিৎ রায় ডাইকোটমিকে দুর্ভাগ্য বলে মনে করেন। সত্যজিৎ যেটা বলেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ যা করেছিলেন ওটা আইডিয়াল-ধারণা বা ইচ্ছা প্রসূত- যেটা বিশ্বভারতী মানেন না। ফলে কী দাঁড়ালো, কি-বোর্ড, তবলা, জোড়া তানপুরা এবং কনসার্টধর্মী মিউজিক না বাজালে রবীন্দ্রনাথের গানও sailable বা বিক্রয়যোগ্য হবে না। যুক্তি-বাজারে আইডিয়্যাল জিনিস চলে না।

তাহলে কী দাঁড়ালো –যুগধর্মের তাগিদে, যুগসিদ্ধিতে কেবল চর্চা-স্বাধিকারবোধে নিজের সীমাবদ্ধ-সুবিধায় প্রথাপ্রবণ কলটেপা পুতুলের মতো রবীন্দ্রনাথের গান আওড়াইবো? চোখ-কানের ব্যবহার আমার শিখলাম না, উপলব্ধি-অনুধ্যানে বুঝলাম না রবীন্দ্রনাথের গান কী জিনিস? দীক্ষাহীন, নৈমিত্তিক সংস্কারে যেটুকু রপ্ত- তারই অহংকারে আতিশয্যে দিন কাটবে? কেবল প্রথাগত ঐতিহ্যে মাথা নাড়া আছে, উত্তরণ নেই। মনে রাখতে হবে ঐতিহ্য আর প্রথার মধ্যে ঐক্যের চেয়ে বৈষম্যই বেশি। একজন যথার্থ শিল্পীর জীবনীশক্তির উৎস দেশ-কালাতিরিক্ত নৈর্ব্যক্তিক উপলব্ধির সংস্কারে।

কালের সঙ্গে পা মিলিয়ে, সময়ের শুচিবায়ুতে পাঁক খেয়ে খেয়ে এর গায়নপদ্ধতিও আজ কোথায় পৌঁছেছে, একট দাহময় শোচনীয়তার মধ্যে পড়েছি আমরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান যেভাবে গাইতেন, শান্তিদেব ঘোষ এবং তাঁর সমকালীন শিল্পীরা যেভাবে গাইতেন, আজ সে-ভাবে গাওয়া তো হয়ই না, তার অনুসরণও চোখে পড়ে না অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে। আত্মনিষ্ঠ শিল্পীর স্বকীয়তা মূল্য ও মর্যাদাই বা ক’জন দিতে জানেন? তাঁর গানের উপস্থাপন বর্তমান বাজার ও রুচির সঙ্গে অনেকখানি বোঝাপড়া চললেও, একথা সত্য যে, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের গান তার রসবৈচিত্র্যের স্বতন্ত্র ও সহজ প্রবৃত্তিতে সঁপে দিয়ে স্বকীয় মূল্যের যোগফলে অনেকখানি বিস্ময় লাগে। সে বিস্ময়-রবীন্দ্রনাথের গানকে ভালোবেসেই সে কণ্ঠে ধারণ করে চলেছে সবসময়ই। তবে বাংলার- বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ যদি অনতিক্রম্য হন, এই গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন, তাঁর গান কথায় সুরে এক সজীব মূর্তি এবং ললিতকলার ধর্মে তা অপরিবর্তনীয়। অপর কেউ এসে কোনো ফাঁক ভরাট করবে কিংবা এর উৎকর্ষ সাধন করবে, এমন অবকাশ তিনি রাখেননি। পশ্চিমী সংগীতের মতোই তাঁর গান বস্তুত কম্পোজিশন। গায়ক-বাদকের দক্ষতায় ও ইন্টারপ্রেটেশনের চমৎকারিত্বে যেমন একই পশ্চিমী সংগীত এক-একভাবে প্রতিভাত হয়, রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। গায়কের কাছে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন একটু ভাব, একটু দরদ, একটু রস। তাঁর গান যখন গাওয়া হবে তখন তাতে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যাবে, গায়ককেও পাওয়া যাবে।

পশ্চিমি সুরের আত্তীকরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথের আসক্তি ছিলো স্বরের কনসোনেন্সের প্রতি, পরবর্তীরা আগ্রহী ডিসকনসোনেন্সের প্রতি। তাঁদের সুরে মুভমেন্টের ঠিকানা নেই, যেমন আছে রবীন্দ্রনাথে। বাংলা গানে খুব পশ্চিমের জোড়কলম চলে রবীন্দ্রনাথকে ধরে এবং তার থেকে সরে এসেও। পশ্চি সুর¯্রষ্টারা গণিতের ছকে পাওয়া অর্থহীন কর্ডকে হারমনির পটভূমিতে সংগীত ব্যবহার করেছেন, বিশুদ্ধ অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্ম হিসেবে। পশ্চিম থেকে গ্রহণ করলেও কথার সঙ্গে সুরের মিলনের দিক থেকে, নিজের ভাবের অনুকূলে রবীন্দ্রনাথ তা গ্রহণ করলেন। তাঁর বাণী ও সুরের যুগলবন্দি পশ্চিমি গণিতের মতো নৈর্ব্যক্তিক নয়। রবীন্দ্রনাথের গান সমস্ত হিসাবনিকাশ খতিয়ানের বাইরে বিস্তীর্ণ এক দিগন্ত। সংগীতকে যাঁরা তত্ত্বের পথে পেতে চান, তাদের পক্ষে তো বটেই, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান কণ্ঠে নিয়েছেন বা ধারণ করবেন, তাদের রবীন্দ্রনাথের “সংগীতচিন্তা” এবং রবীন্দ্রসাহিত্য অবশ্যই পড়তে হবে।

সৃজনপিয়াসী মানুষ সুরকে বর্ণরূপময় করে প্রকাশ করতে চেয়েছে চিরকাল। সুর ও দূর পৃথিবীকে শিল্পী শুধু চোখের অভিজ্ঞতায় নয়, কান পেতেও শুনতে চান। শিল্পকে শেষাবধি সংগীতে উত্তীর্ণ হতে হয়- এই সত্যে যিনি যত বেশি ঘনিষ্ঠ, তিনি ততবেশি ধীমান। সুর রূপ ও বর্ণে প্রতিপন্ন করা নয় শুধু, বরং রূপের মাধুরি বা নির্যাসটুকু শব্দ কিংবা বর্ণযোজনে অধরাকে নিপুণতায় প্রকাশ করার নামই শিল্প। এই সূক্ষ্ম শিল্পকর্মটি আমাদের অদেখা মনোজগতে মূর্ত-বিস্ময়ের অভিঘাতে আলোড়িত করে। জগত কতো যে আনন্দে পূর্ণ এবং মর্তভূমির উপরে সুন্দরের অভ্যস্ত ধ্যানে অপার মহিমা বিদ্যমান এবং তার ছায়াপাতে বিস্ময়ই জাগে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মতোই মুগ্ধ হই, এবং শান্তি ও মুগ্ধতাই সংগীতের শেষ কথা।

রবীন্দ্রনাথের গানে সুর ও বাণীর জানালা খুলে গিয়ে সহস্র রশ্মি ঢুকে অন্তিম ঐক্যটাকেই উদ্ভাসিত করে তোলে, তার অসীমতাকে না মেনে উপায় থাকে না। তখন প্রকৃতি বেদনীয় কি আনন্দময় তা যেমন নিরর্থক, তেমনি জগতটা চাক্ষুষ সত্যের চেয়ে বেশি বাস্তব দেখায়। আমার কাছে এইটেই রবীন্দ্রনাথের গানের চিরকালীন লক্ষণ এবং তাঁর গান ভাষা, সুর ও ছন্দের মনষ্কতা স্বরূপে চিরন্তন অভীপ্সায় উৎসারিত চিরনূতন চিরপুরাতন। এবং যা-কিছু সনাতন তাই আধুনিক।

back to top