alt

সাময়িকী

প্রতীপ রূপান্তর

সুরাইয়া জাহান

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

সেবার বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে ঢাকায়। ডিসেম্বর শেষ হয়ে বছরের প্রথম দিন থেকে শৈত্য প্রবাহে কাবু সারাদেশের মানুষ। রানাকে এ বছরই সরকারি স্কুলে ভর্তি করেছে দিলরুবা। সবাই অবশ্য দিলুই ডাকে। ছোট্ট ছেলেটি বাবা মা ছাড়া অন্য কারো সাথেই মিশতে পারে না। স্কুলের প্রথম দিন তার সে কী কান্না! কোন মতেই দিলুর আঁচল ছাড়ে না। ছেলের কান্না দেখে দিলুর চোখেও অঝর ধারা নামে। সাথে দিলুর স্বামী কবির থাকাতে রক্ষে। শেষমেশ কবির একরকম জোর করেই প্রথম শ্রেণির ক্লাস টিচারের হাতে রানাকে ছেড়ে দিয়ে আসে। গেটের বাইরে এসে দেখে ফুটপাতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে দিলু। স্ত্রীকে সামলাতে তাড়াতাড়ি দিলুর পাশে বসে কবির।

‘মা ছেলে মিলে কী শুরু করলে? ছেলে কাঁদছে ক্লাসে বসে আর তুমি এখানে! দু’জনকে সামলাতে আমার অবস্থাই এবার খারাপ হয়ে যাবে...’

‘ছোট মানুষ! একা একা ভয় পায় যদি ...’ কান্নার দমকে হেঁচকি ওঠে দিলুর।

‘একা একা মানে! ক্লাসে কম করে হলেও ষাট/সত্তরটি বাচ্চা। তাছাড়া শিক্ষক আছেন।’

‘তারপরও...’ শাড়ির আঁচলে চোখ মোছে দিলু।

‘ক’দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে...’ দিলুকে আশ্বস্ত করে কবির।

সেদিন অবশ্য ক্লাসের পুরোটা সময় কেঁদেই কাটালো রানা। পরের দিনও তাই। তৃতীয় দিনেও ছেলেকে ক্লাসে পাঠিয়ে গেটের বাইরে বসে থাকে দিলু। রাস্তায় হরেক রকমের যানবাহন। টুংটাং শব্দে রিকশা চলছে। মাঝে মাঝে দু’একটা ঘোড়ার গাড়িও দেখা যায়। দিলুর মতন আরো দু’চারজন অভিভাবক বসে আছে রাস্তার ধারে। একটু দূরে ঝালমুড়ি বিক্রেতা আপন মনে তার পসরা সাজিয়ে বসেছে। সামনের বটগাছে দু’তিনটে কাক একনাগাড়ে ডেকেই চলে।

হঠাৎ স্কুলের গেটে চোখ আটকে যায় দিলুর। ধূসর বেরই হ্যাট, কালো চাদর জড়ানো ক্রাচে ভর করে একটি লোক গেট দিয়ে বেরিয়ে দিলুকে অতিক্রম করে চলে যায়। মানুষটার ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। দাড়ি গোঁফে ঢাকা মুখটা ভালো করে দেখতে পায়নি দিলু। অথচ কেমন যেন চেনা চেনা লাগে লোকটিকে। বিশেষ করে বেরই হ্যাট! আমিরুলের খুব প্রিয় ছিল। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় দিলু। একবার ভাবে তাড়াতাড়ি হেঁটে মানুষটার সামনে গিয়ে ভালো করে মুখটা দেখবে। পরক্ষণেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে আসে পা। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। কেবল দেখতে পায় ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনের জনস্রোতে মিলিয়ে যায় আগন্তুক।

বাসায় ফিরেও মনটা খচখচ করতে থাকে সারাদিন। এত পরিচিত লাগলো কেন মানুষটাকে? তবে কি মানুষটা আমিরুল ছিল? উঠে গিয়ে মানুষটার মুখটা ভালো করে না দেখায় নিজেকে বারবার ধিক্কার দেয় দিলু। বুকের ভেতর তোলপাড় করে। কোনো কাজেই মন বসে না তার। কত বছর হয়ে গেল আমিরুল নিখোঁজ! তার সহযোদ্ধারাও কোনো হদিস দিতে পারেনি। হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র কত জায়গায়ই না খোঁজ করেছে দিলুর বাবা। কেউ খবর দিতে পারেনি। কেবলমাত্র আমিরুলের বন্ধু মোতাহার বলেছিল পায়ে গুলি বিদ্ধ আহত আমিরুল ধরা পড়ে পাক বাহিনীর হাতে। তারপর আর কোনো খবর পায়নি তারা। দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ কেউ ফিরে এলো সম্পূর্ণ সুস্থ, কেউ পঙ্গু অবস্থায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে গেল- ফেরেনি আমিরুল।

এমনিতেই রাতে ঘুম হয় না দিলুর। তার মধ্যে ওই লোকটাকে দেখে ঘুম আরো উধাও হয়ে গেছে চোখ থেকে। ইদানীং চোখ লেগে এলেই একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সে। উর্দিপরা, মেশিনগান হাতে কতগুলো সৈনিক তাড়া করছে। মাঠঘাট, জলা-জঙ্গল পেরিয়ে দিলু কেবল ছুটছে আর ছুটছে। ভয়ে, আতঙ্কে ঘুমের ঘোরে গোঙাতে গোঙাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়- পাশেই ঘুমন্ত কবিরকে দেখে বুঝতে পারে ওটা স্বপ্ন ছিলো। বাকি রাতটা কিছুতেই আর ঘুম আসে না। প্রথম প্রথম ঘুম ভেঙ্গে গেলে অঝরে কাঁদতো। এখন স্বপ্নটাও কেমন মানিয়ে গেছে জীবনের সাথে। ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলে কবির জড়িয়ে ধরতো বুকের মধ্যে। মাথায় হাত বুলিয়ে পরম যতেœ ঘুম পাড়িয়ে দিত। এখন আর স্বপ্নের

ভেতর কাঁদে না দিলু। তাই কবিরেরও ঘুম ভাঙ্গে না।

দেশ স্বাধীন হয়েছে আট বছর হলো। এত বছর পরেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি দিলুর। এই ক’বছরে কত কি ঘটনাই না ঘটে গেছে। যেমন দেশটার উপর দিয়ে তেমনি দিলুর জীবনের উপর দিয়েও। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর একের পর এক ক্ষমতার পালাবদল। ক্যু আর পাল্টা ক্যু। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দ্বিধাবিভক্ত হলো দেশের মানুষ। ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসতে লাগলো একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীরা। দিলুর জীবনটাও কেটেছে নানান চড়াই উতরাইয়ের ভেতর। কোনোদিন সংসার হবে, কোলজুড়ে ফুটফুটে সন্তান আসবে, ভাবতেই পারেনি দিলু। ভাবার মতন মানসিক শক্তিও ছিলনা তার।

পিলখানা এক নম্বর গেটের পাশে দিলরুবা আর আমিরুলদের পাশাপাশি বাসা ছিল। দিলুর আব্বা তখন মিডফোর্ড হাসপাতালের হেডক্লার্ক। দিলরুবার ছোট তিনভাই। একদম ছোট ভাইটার বয়স তিন বছর। আমিরুল থাকে বড় ভাই-ভাবির সাথে। বাবা-মা বেঁচে নেই। চারুকলায় ফাইনাল বর্ষের ছাত্র। দিলু মাত্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছে। দুজনের মাঝে দারুণ সখ্য। স্বাধিকার আন্দোলনের ডামাডোল তখন দেশজুড়ে। এরই মধ্যে দুই পরিবারের সম্মতিতে দিলু আর আমিরুলের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়। আমিরুল পাশ করে বেরুলেই দু’জনের বিয়ে হবে। আর্ট কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের সাথে পুরো আন্দোলনে জড়িয়ে যায় আমিরুল। মাঝে মাঝে গোপন মিটিংয়ে দিলুকে নিয়ে যায় সাথে করে। শ্রেণি সংগ্রাম নিয়ে লম্বা বক্তৃতা শোনায় দিলুকে। মার্ক্সের থিউরি কিছুই ঢোকে না দিলুর মাথায়। যদিও দিলুর বাবা আফসার আলী সবসময় ছেলেমেয়েদের কড়া নজরদারিতে রাখেন। তারপরও ওই সময়টাই ছিল যেন মিছিল আর মিটিংয়ের।

একদিনের কথা আজীবন মনে থাকবে দিলুর। সেদিন ছিল একাত্তরের সাতই মার্চ। আমিরুল খুব উত্তেজিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে। আগেভাগেই দিলুকে বলে রেখেছে সাথে করে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে যাবে। দিলু প্রথমে রাজি হয়নি আফসার আলীর ভয়ে। কিন্তু উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় নিজেকে সামলাতে পারেনি। আমিরুলের সাথে হাজির হয় আর্ট কলেজে। সামনেই রেসকোর্স ময়দান। ছাত্র, শিক্ষক, সংস্কৃতি সংসদের কর্মীরা বিরাট মিছিল বের করে। শিক্ষকরা চারটা কুলায় স্বা-ধী-ন-তা লিখে মিছিলে অংশ নেয়। অনেকে নানান ধরনের কার্টুন আঁকে বড় বড় কাগজে। সেগুলো ছাত্রদের হাতে হাতে শোভা পায়।

চারদিকে মিছিল আর মিছিল। লাঠি, ফেস্টুন, লগি হাতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিক থেকে দলে দলে লোক আসতে থাকে। সব বয়সের, সব স্তরের নারী-পুরুষের জনসমুদ্রে পরিণত হয় রেসকোর্স ময়দান। উত্তাল সমুদ্রের ¯্রােতকেও যেন হার মানায় এই জনসমুদ্র। রেসকোর্স ময়দানের চারদিকে তখন কাঠের বেড়া ছিল। একটা বটগাছ আর জিমখানা ছিল উত্তরের কোন ঘেঁষে। মঞ্চের ধারে কাছেও যেতে পারেনি আমিরুল আর দিলু। চারদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ দেখে ভড়কে যায় দিলু। শক্ত করে আমিরুলের হাত ধরে থাকে। আমিরুল তখন উত্তেজনায় টগবগ করছে। এক হাতে দিলুকে আগলে অন্য হাতে একটা প্ল্যাকার্ড ধরে রেখেছে। একদিকে মার্চের গরম অন্যদিকে সমাবেশের গরম- সব মিলিয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার দিলুর অবস্থা। হুড়োহুড়িতে কখন যেন আমিরুলের বেরই হ্যাট মাথা থেকে উধাও। এই নিয়ে কদিন খুব মন খারাপ ছিল মানুষটার। পরে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিলু নতুন একটা হ্যাট কিনে দেয় আমিরুলকে। সেটা পেয়ে আমিরুল মহা খুশি।

বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠলেন, ভাষণ শুরু করলেন। মুহূর্তে থেমে গেল চারদিকের গুঞ্জন কোলাহল। প্রথম দিকে তিনি বর্ণনা করলেন তেইশ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তার কণ্ঠস্বর ধীর লয় থেকে উচ্চ লয়ে ওঠে। সব মানুষ আপ্লুত আর রোমাঞ্চিত হয়ে তার ভাষণ শুনছে। তিনি ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণায় সব শ্রেণি সংগ্রামের মানুষ একসূত্রে আবদ্ধ হলো। তখন আলাদা করবার উপায় ছিলো না কে মস্কো পন্থি, কে মাও সে তুং-এর ভক্ত আর কে নীরব মুসলিম লীগ। সবার সামনে একটাই গন্তব্য- স্বাধীনতা।

সমাবেশ শেষে হতে না হতেই লোকজন ঘিরে ধরে বঙ্গবন্ধুকে। কোনো রকম ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে দিলু আর আমিরুল। তারপর থেকেই প্রতিদিন যেন রূপ পাল্টাতে থাকে ঢাকা তথা দেশের পরিস্থিতি। স্বস্তি হারিয়ে যায় মানুষের মন থেকে। ঢাকার অবস্থা খারাপ দেখে আফসার আলী পুরো পরিবারকে গ্রামের বাড়ি বরিশালে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমিরুলকে ছেড়ে যাবার কষ্টে প্রথম অমত করে দিলু। কিন্তু আফসার আলীর এক কথা। দেশের পরিস্থিতি কখন কী হয়! ঢাকা-বরিশাল দোতলা লঞ্চ ছাড়ে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে। আমিরুলও আসে দিলুকে বিদায় জানাতে। লঞ্চে যেন তিল ধারনের ঠাঁই নাই। কেবিন, ডেক, সব লোকে লোকারণ্য। সবার মধ্যে অজানা আতঙ্ক আর হুড়োহুড়ি। কোনো রকমে সারেং-এর ডেকের পাশে বিছানা পেতে নেয় দিলুর পরিবার। এত লোকের মধ্যেও হকারদের ভিড়। পত্রিকাওয়ালা পত্রিকা এনে হাতে গুঁজে দেয়, ঝালমুড়িওয়ালা ছোট কৌটায় ঝালমুড়ি বানায় খচর খচর শব্দে। কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজের গন্ধে জিভে জল চলে আসে দিলুর। অন্ধ, খোঁড়া ভিখিরিরা এসে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে ভিড়ের মধ্যেও। মানুষের কোলাহল আর ধাক্কাধাক্কিতে একটুও সুস্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না আমিরুল আর দিলু। পরিবারের সবাইকে পাতা বিছানায় বসিয়ে লঞ্চের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় ওরা দু’জন। কেরানীগঞ্জের কোলঘেঁষে সূর্য ডুবে যায় আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে। সেই আভায় আরো বিষণœ লাগে দিলুকে। বারবার ওর মনে হতে থাকে জীবনে আর বোধহয় দেখা হবে না আমিরুলের সাথে। ওদিকে সুগানি ঘন ঘন ঘন্টা পিটায়। লঞ্চ ছেড়ে দেবার সংকেত। তেমন কোনো কথাই ওরা বলতে পারে না বিদায়লগ্নে। কতকটা সময় দিলু ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে থাকে আমিরুলের মুখের দিকে। ওর ডান হাতটা ধরে আমিরুল বলে ‘সাবধানে থেকো, নিজের খেয়াল রেখো। সময় করে চিঠি দিও।’ উত্তরে দিলু কেবল বলে ‘তুমিও’। ঝাপসা হয়ে আসে ওর দু’চোখ।

লঞ্চের সিঁড়ি উঠে গেছে। সদরঘাট টার্মিনাল থেকে একটু একটু করে সরে যায় লঞ্চ। সিঁড়ি না থাকায় হকাররা শেষ মুহূর্তে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে টার্মিনালে নামে। লঞ্চের পো পো ভেঁপুতে মাথা ধরে যায় দিলুর। তবুও রেলিং ধরে দাঁড়িয়েই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত আমিরুলের ধূসর রংয়ের বেরই হ্যাটটা দেখা যায়। যতদূরে সরে যায় লঞ্চ দিলুর জীবন থেকে যেন দূরে আরো দূরে চলে যায় আমিরুল।

গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে ঢাকার সাথে অনেকটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দিলুদের। একটা চিঠি পাঠালে হাতে পেতে এক সপ্তাহ থেকে দশ পনের দিনও লেগে যায়। পঁচিশে মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনী যখন পিলখানা আক্রমণ করে তখন আশেপাশের অনেক বাড়িতে ঢুকে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। সেই রাতে মারা যায় আমিরুলের বড় ভাই, ভাবি আর তাদের চার বছরের ছেলে। আমিরুল সেদিন অন্য এক বন্ধুর বাসায় বসে পোস্টার ব্যানার লিখছিলো। সেই রাতের খবর ওরই বন্ধুর কাছ থেকে পরে জেনেছে দিলু। আর ওটাই ছিলো আমিরুলের শেষ খবর। এপ্রিলের মাঝামাঝি দিলুদের গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এক ভোর রাতে রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় নদীপথে ওরা স্পিডবোটে এসে আক্রমণ করে গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর। বাড়ির পর বাড়ি আগুন ধরিয়ে ছারখার করে দেয়। গ্রামের অল্প বয়সি মেয়ে, ঘরের বউদের ধরে নিয়ে স্পিডবোটে তোলে। চারদিকে কেবল গুলি আর ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদের শব্দে দিশেহারা দিলুদের পরিবার। বাড়ি ছেড়ে তারাও অন্ধকারের ভেতর ছুটতে থাকে দিগি¦দিক। যে যেখানে পেরেছে লুকিয়ে জীবন বাঁচায়। দিলু পানিভর্তি পাট খেতে লুকিয়ে থাকে দুদিন। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাইটি মারা যায় হানাদারদের এলোপাতাড়ি গুলিতে। একদম ছোট তিন বছরের ভাইটি রাতের অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চার/পাঁচ দিন পরে বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে এক ডোবায় পাওয়া যায় ছোট্ট ভাইটির মৃতদেহ। দুদিন পরে গ্রামের লোকজন যখন পাটক্ষেত থেকে দিলুকে উদ্ধার করে ততক্ষণে উদভ্রান্ত সে। ভয়ে কুঁকড়ে থাকে ঘরের কোণে। কারো সাথেই কথা বলে না। দু’দুটো সন্তানকে একসাথে হারিয়ে শোকে দুঃখে এক সপ্তাহের মাথায় মারা যায় দিলুর মা।

নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। আমিরুলের খোঁজ নেই, মা ভাইদের হারিয়ে দিলু পাগল প্রায়। আফসার আলী দিলু আর ওর ভাইটাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। মাঝেমাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় আমিরুলকে খোঁজে দিলু। কখনো কখনো আর্ট কলেজে চলে যায় একা একা। এদিকে চাকরি রেখে মেয়ের দেখাশোনা করা কঠিন হয়ে পড়ে আফসার আলীর। বিবাহযোগ্য মেয়ে, কখন কোন বিপদ হয়! কেউ কেউ আবার দিলুকে বীরাঙ্গনা ভাবতে শুরু করে। আপনজনেরা বুদ্ধি দেয়- মেয়েকে বিয়ে দিলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ততদিনে আফসার আলী অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছেন আমিরুলের। তিনিও বিশ্বাস করেন- আমিরুল শহীদ হয়েছেন। মেয়ের এই অবস্থায় পাত্র পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। শেষমেশ বোনের ছেলে কবিরের সাথেই বিয়ে দিলেন দিলুর। একটা বেসরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে সে। কবির অবশ্য আগে থেকেই দিলুকে খুব পছন্দ করতো। তাই বিয়েতে তার অমত ছিল না। দিলুর কাছে নিজেকে স্বামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে কবিরকে।

এইসব পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে দিলুর নির্ঘুম কেটে যায় রাত।

আগের দিন ছেলের স্কুলে ওই মানুষটাকে দেখে পরের দিনও আগেভাগেই স্কুলে চলে আসে দিলু। তার মন বলছে এই স্কুলের সাথেই ওই মানুষটার কোন সম্পর্ক আছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি দিলুকে। ঠিক আগের দিনের সময়েই সেই ধূসর বেরই হ্যাট, কালো চাদর জড়িয়ে ক্রাচে ভর করে গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে আগন্তুক। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ পায় দিলু। আজ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সোজা মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। চমকে ওঠে লোকটা। থমকে যায় সামনে বাড়ানো তার ক্রাচ। ঝুঁকানো মুখটা একটু তুলে বা হাতে হ্যাটটা ঠেলে উপরে তুলে সামনে তাকায়। বিস্ময়ের ঘোরে চোখে যেন কিছুই দেখতে পায় না দিলু। একগাল দাড়ি গোঁফের ভেতর চেনা যায় মানুষটার চোখ দুটো। মায়া মাখানো চোখ দুটো এখনো আগের মতোই আছে। থরথর করে কাঁপতে থাকে দিলু। টপটপ চোখের জল পড়তে থাকে পাথুরে ফুটপাতে। হতবিহ্বল দিলুর মুখে কোনো কথাই ফোটে না। আগন্তুকের হাত থেকে ছিটকে পড়ে ক্রাচ। টাল সামলাতে না পেরে স্কুলের দেয়াল ধরে দাঁড়ায় সে।

‘আমিরুল...’ অস্ফুটে বলে দিলু।

‘দিলু তুমি...?’ ভূত দেখার মতন চমকে ওঠে আমিরুল।

নিজেকে আর সামলাতে পারে না দিলু। আঁচলে মুখ চেঁপে হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেমন নিঃস্ব আর অসহায় লাগে আমিরুলকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় দিলুর।

‘কোথায় ছিলে এতদিন? কেন নিজের খবর জানাওনি আমাদেরকে? কবে ঢাকায় এসেছো? কত জায়গায় খুঁজেছি তোমাকে?...’ একটার পর একটা প্রশ্ন করতে করতে আমিরুলের গায়ের চাদর ধরে ঝাঁকাতে থাকে দিলু। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে নিজেকে সামলাতে বেশ সময় নেয় আমিরুল। নিচে পড়ে থাকা ক্রাচটা এরই মধ্যে হাতে তুলে দেয় দিলু। ওটায় শরীরের ভর রেখে দাঁড়ায় আমিরুল।

‘অনেক কথা! একসাথে সব কী করে বলি?’ হ্যাটটা খুলে হাতে নিয়ে কান ঢেকে থাকা এলোমেলো চুলগুলোতে আঙুল বুলায় আমিরুল। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।

‘কেন এমন করলে আমার সাথে? বেঁচে থেকেও একটা খবর দাওনি...’ নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারে না দিলু।

‘এগারো নম্বর সেক্টরে কমান্ডার তাহেরের আণ্ডারে যুদ্ধে যোগদান করি। কামালপুর যুদ্ধে গুলি লাগে ডান পায়ের হাঁটুর নিচে। আহত অবস্থায় ধরা পড়ি পাক বাহিনীর হাতে। তারপর ...’ থামে আমিরুল।

‘তারপর... সব শুনতে চাই আমি।’ বলে দিলু।

‘কী হবে সেসব শুনে? আর শুনতে চেয়ো না।’

‘বলো আমি সবটা শুনতে চাই!’ মরিয়া যেন দিলু। এতোদিনের চাপাকষ্ট ওকে যেন নাছোড় করে তুলেছে।

‘দিলু ওরা অনেক অত্যাচার করেছে আমার উপর। এর চেয়ে যদি মেরে ফেলতো আমি বেঁচে যেতাম।আমাদের বাহিনীর তথ্য জানার জন্য ওরা আমাকে টয়লেটের পানি খাইয়েছে। শেষমেশ আমার গোপনাঙ্গে ইট ঝুলিয়ে দেয়...’ থেমে যায় আমিরুল। সেই দিনের যন্ত্রণার কথা মনে করে কুঁচকে ওঠে চোখ মুখ। গোপন আর্তনাদ যেন বেরিয়ে আসতে চায় বুকের গভীর থেকে। খানিক দম নিয়ে বলে’ অজ্ঞান হয়ে যাই। ক’দিন অজ্ঞান ছিলাম জানি না। মরে গেছি ভেবে ওরা নদীতে ফেলে দেয়। আর কিছু বলতে পারি না...’

হতবাক দিলু তাকিয়েই থাকে আমিরুলের মুখের দিকে। ঘোর লাগা চোখে জানতে চায়-

‘দেশে ফিরেছো কবে?’

‘একবছর আগে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় এসেছি। পরে জেনেছি- ছয় মাস শিলং-এর হাসপাতালে ছিলাম। এক সাংবাদিক দিল্লিতে নিয়ে যায়। আমি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলি। পুরনো কোনো কিছুই মনে করতে পারতাম না। সেখান থেকে এক দাতব্য সংস্থা সিঙ্গাপুর পাঠায়। ওখানে আস্তে আস্তে স্মৃতি ফিরে পাই। তোমাকে মনে পড়ে। দেশে আসতে ইচ্ছে করে।’

‘দেশে এসে কেন খোঁজ নাওনি আমার?’

হাসে আমিরুল। দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত পরাজিত এক সৈনিক যেন!

‘এই জীবনটাকে আর কারো সাথে জড়াতে চাইনি দিলু। তারপরও নিজেকে কিছুতেই মানাতে পারছিলাম না। দেশে এসেই তোমার গ্রামে যাই। তোমার এক আত্মীয়ের কাছে জেনেছি স্বামী, সন্তান নিয়ে ভালো আছো তুমি। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় এই স্কুলে আর্টের শিক্ষক হিসেবে চাকরি হলো কদিন আগে।’

‘একটিবার আমাকে দেখতে ইচ্ছে করেনি?’ ঠুকরে কেঁদে ওঠে দিলু।

যেন কিছুই শুনতে পায়নি এমনি করে ক্রাচে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় আমিরুল। ওদিকে অনেক আগেই ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। ছোট্ট রানা এসে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছে। উদভ্রান্তের মতন ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরে দিলু। পরেরদিন আবারও ছুটে যায় স্কুলে। কত কথা, কত কিছু বলার আছে মানুষটাকে। কোথায় থাকে, কে যতœ করে- কিছুই জানা হলো না। সব জানতে হবে দিলুকে।

ওই দিন সকালেই স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে চলে যায় আমিরুল। কেউ জানে না কোথায় চলে গেছে সে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

প্রতীপ রূপান্তর

সুরাইয়া জাহান

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

সেবার বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে ঢাকায়। ডিসেম্বর শেষ হয়ে বছরের প্রথম দিন থেকে শৈত্য প্রবাহে কাবু সারাদেশের মানুষ। রানাকে এ বছরই সরকারি স্কুলে ভর্তি করেছে দিলরুবা। সবাই অবশ্য দিলুই ডাকে। ছোট্ট ছেলেটি বাবা মা ছাড়া অন্য কারো সাথেই মিশতে পারে না। স্কুলের প্রথম দিন তার সে কী কান্না! কোন মতেই দিলুর আঁচল ছাড়ে না। ছেলের কান্না দেখে দিলুর চোখেও অঝর ধারা নামে। সাথে দিলুর স্বামী কবির থাকাতে রক্ষে। শেষমেশ কবির একরকম জোর করেই প্রথম শ্রেণির ক্লাস টিচারের হাতে রানাকে ছেড়ে দিয়ে আসে। গেটের বাইরে এসে দেখে ফুটপাতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে দিলু। স্ত্রীকে সামলাতে তাড়াতাড়ি দিলুর পাশে বসে কবির।

‘মা ছেলে মিলে কী শুরু করলে? ছেলে কাঁদছে ক্লাসে বসে আর তুমি এখানে! দু’জনকে সামলাতে আমার অবস্থাই এবার খারাপ হয়ে যাবে...’

‘ছোট মানুষ! একা একা ভয় পায় যদি ...’ কান্নার দমকে হেঁচকি ওঠে দিলুর।

‘একা একা মানে! ক্লাসে কম করে হলেও ষাট/সত্তরটি বাচ্চা। তাছাড়া শিক্ষক আছেন।’

‘তারপরও...’ শাড়ির আঁচলে চোখ মোছে দিলু।

‘ক’দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে...’ দিলুকে আশ্বস্ত করে কবির।

সেদিন অবশ্য ক্লাসের পুরোটা সময় কেঁদেই কাটালো রানা। পরের দিনও তাই। তৃতীয় দিনেও ছেলেকে ক্লাসে পাঠিয়ে গেটের বাইরে বসে থাকে দিলু। রাস্তায় হরেক রকমের যানবাহন। টুংটাং শব্দে রিকশা চলছে। মাঝে মাঝে দু’একটা ঘোড়ার গাড়িও দেখা যায়। দিলুর মতন আরো দু’চারজন অভিভাবক বসে আছে রাস্তার ধারে। একটু দূরে ঝালমুড়ি বিক্রেতা আপন মনে তার পসরা সাজিয়ে বসেছে। সামনের বটগাছে দু’তিনটে কাক একনাগাড়ে ডেকেই চলে।

হঠাৎ স্কুলের গেটে চোখ আটকে যায় দিলুর। ধূসর বেরই হ্যাট, কালো চাদর জড়ানো ক্রাচে ভর করে একটি লোক গেট দিয়ে বেরিয়ে দিলুকে অতিক্রম করে চলে যায়। মানুষটার ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। দাড়ি গোঁফে ঢাকা মুখটা ভালো করে দেখতে পায়নি দিলু। অথচ কেমন যেন চেনা চেনা লাগে লোকটিকে। বিশেষ করে বেরই হ্যাট! আমিরুলের খুব প্রিয় ছিল। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় দিলু। একবার ভাবে তাড়াতাড়ি হেঁটে মানুষটার সামনে গিয়ে ভালো করে মুখটা দেখবে। পরক্ষণেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে আসে পা। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। কেবল দেখতে পায় ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনের জনস্রোতে মিলিয়ে যায় আগন্তুক।

বাসায় ফিরেও মনটা খচখচ করতে থাকে সারাদিন। এত পরিচিত লাগলো কেন মানুষটাকে? তবে কি মানুষটা আমিরুল ছিল? উঠে গিয়ে মানুষটার মুখটা ভালো করে না দেখায় নিজেকে বারবার ধিক্কার দেয় দিলু। বুকের ভেতর তোলপাড় করে। কোনো কাজেই মন বসে না তার। কত বছর হয়ে গেল আমিরুল নিখোঁজ! তার সহযোদ্ধারাও কোনো হদিস দিতে পারেনি। হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র কত জায়গায়ই না খোঁজ করেছে দিলুর বাবা। কেউ খবর দিতে পারেনি। কেবলমাত্র আমিরুলের বন্ধু মোতাহার বলেছিল পায়ে গুলি বিদ্ধ আহত আমিরুল ধরা পড়ে পাক বাহিনীর হাতে। তারপর আর কোনো খবর পায়নি তারা। দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ কেউ ফিরে এলো সম্পূর্ণ সুস্থ, কেউ পঙ্গু অবস্থায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে গেল- ফেরেনি আমিরুল।

এমনিতেই রাতে ঘুম হয় না দিলুর। তার মধ্যে ওই লোকটাকে দেখে ঘুম আরো উধাও হয়ে গেছে চোখ থেকে। ইদানীং চোখ লেগে এলেই একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সে। উর্দিপরা, মেশিনগান হাতে কতগুলো সৈনিক তাড়া করছে। মাঠঘাট, জলা-জঙ্গল পেরিয়ে দিলু কেবল ছুটছে আর ছুটছে। ভয়ে, আতঙ্কে ঘুমের ঘোরে গোঙাতে গোঙাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়- পাশেই ঘুমন্ত কবিরকে দেখে বুঝতে পারে ওটা স্বপ্ন ছিলো। বাকি রাতটা কিছুতেই আর ঘুম আসে না। প্রথম প্রথম ঘুম ভেঙ্গে গেলে অঝরে কাঁদতো। এখন স্বপ্নটাও কেমন মানিয়ে গেছে জীবনের সাথে। ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলে কবির জড়িয়ে ধরতো বুকের মধ্যে। মাথায় হাত বুলিয়ে পরম যতেœ ঘুম পাড়িয়ে দিত। এখন আর স্বপ্নের

ভেতর কাঁদে না দিলু। তাই কবিরেরও ঘুম ভাঙ্গে না।

দেশ স্বাধীন হয়েছে আট বছর হলো। এত বছর পরেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি দিলুর। এই ক’বছরে কত কি ঘটনাই না ঘটে গেছে। যেমন দেশটার উপর দিয়ে তেমনি দিলুর জীবনের উপর দিয়েও। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর একের পর এক ক্ষমতার পালাবদল। ক্যু আর পাল্টা ক্যু। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দ্বিধাবিভক্ত হলো দেশের মানুষ। ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসতে লাগলো একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীরা। দিলুর জীবনটাও কেটেছে নানান চড়াই উতরাইয়ের ভেতর। কোনোদিন সংসার হবে, কোলজুড়ে ফুটফুটে সন্তান আসবে, ভাবতেই পারেনি দিলু। ভাবার মতন মানসিক শক্তিও ছিলনা তার।

পিলখানা এক নম্বর গেটের পাশে দিলরুবা আর আমিরুলদের পাশাপাশি বাসা ছিল। দিলুর আব্বা তখন মিডফোর্ড হাসপাতালের হেডক্লার্ক। দিলরুবার ছোট তিনভাই। একদম ছোট ভাইটার বয়স তিন বছর। আমিরুল থাকে বড় ভাই-ভাবির সাথে। বাবা-মা বেঁচে নেই। চারুকলায় ফাইনাল বর্ষের ছাত্র। দিলু মাত্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছে। দুজনের মাঝে দারুণ সখ্য। স্বাধিকার আন্দোলনের ডামাডোল তখন দেশজুড়ে। এরই মধ্যে দুই পরিবারের সম্মতিতে দিলু আর আমিরুলের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়। আমিরুল পাশ করে বেরুলেই দু’জনের বিয়ে হবে। আর্ট কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের সাথে পুরো আন্দোলনে জড়িয়ে যায় আমিরুল। মাঝে মাঝে গোপন মিটিংয়ে দিলুকে নিয়ে যায় সাথে করে। শ্রেণি সংগ্রাম নিয়ে লম্বা বক্তৃতা শোনায় দিলুকে। মার্ক্সের থিউরি কিছুই ঢোকে না দিলুর মাথায়। যদিও দিলুর বাবা আফসার আলী সবসময় ছেলেমেয়েদের কড়া নজরদারিতে রাখেন। তারপরও ওই সময়টাই ছিল যেন মিছিল আর মিটিংয়ের।

একদিনের কথা আজীবন মনে থাকবে দিলুর। সেদিন ছিল একাত্তরের সাতই মার্চ। আমিরুল খুব উত্তেজিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে। আগেভাগেই দিলুকে বলে রেখেছে সাথে করে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে যাবে। দিলু প্রথমে রাজি হয়নি আফসার আলীর ভয়ে। কিন্তু উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় নিজেকে সামলাতে পারেনি। আমিরুলের সাথে হাজির হয় আর্ট কলেজে। সামনেই রেসকোর্স ময়দান। ছাত্র, শিক্ষক, সংস্কৃতি সংসদের কর্মীরা বিরাট মিছিল বের করে। শিক্ষকরা চারটা কুলায় স্বা-ধী-ন-তা লিখে মিছিলে অংশ নেয়। অনেকে নানান ধরনের কার্টুন আঁকে বড় বড় কাগজে। সেগুলো ছাত্রদের হাতে হাতে শোভা পায়।

চারদিকে মিছিল আর মিছিল। লাঠি, ফেস্টুন, লগি হাতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিক থেকে দলে দলে লোক আসতে থাকে। সব বয়সের, সব স্তরের নারী-পুরুষের জনসমুদ্রে পরিণত হয় রেসকোর্স ময়দান। উত্তাল সমুদ্রের ¯্রােতকেও যেন হার মানায় এই জনসমুদ্র। রেসকোর্স ময়দানের চারদিকে তখন কাঠের বেড়া ছিল। একটা বটগাছ আর জিমখানা ছিল উত্তরের কোন ঘেঁষে। মঞ্চের ধারে কাছেও যেতে পারেনি আমিরুল আর দিলু। চারদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ দেখে ভড়কে যায় দিলু। শক্ত করে আমিরুলের হাত ধরে থাকে। আমিরুল তখন উত্তেজনায় টগবগ করছে। এক হাতে দিলুকে আগলে অন্য হাতে একটা প্ল্যাকার্ড ধরে রেখেছে। একদিকে মার্চের গরম অন্যদিকে সমাবেশের গরম- সব মিলিয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার দিলুর অবস্থা। হুড়োহুড়িতে কখন যেন আমিরুলের বেরই হ্যাট মাথা থেকে উধাও। এই নিয়ে কদিন খুব মন খারাপ ছিল মানুষটার। পরে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিলু নতুন একটা হ্যাট কিনে দেয় আমিরুলকে। সেটা পেয়ে আমিরুল মহা খুশি।

বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠলেন, ভাষণ শুরু করলেন। মুহূর্তে থেমে গেল চারদিকের গুঞ্জন কোলাহল। প্রথম দিকে তিনি বর্ণনা করলেন তেইশ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তার কণ্ঠস্বর ধীর লয় থেকে উচ্চ লয়ে ওঠে। সব মানুষ আপ্লুত আর রোমাঞ্চিত হয়ে তার ভাষণ শুনছে। তিনি ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণায় সব শ্রেণি সংগ্রামের মানুষ একসূত্রে আবদ্ধ হলো। তখন আলাদা করবার উপায় ছিলো না কে মস্কো পন্থি, কে মাও সে তুং-এর ভক্ত আর কে নীরব মুসলিম লীগ। সবার সামনে একটাই গন্তব্য- স্বাধীনতা।

সমাবেশ শেষে হতে না হতেই লোকজন ঘিরে ধরে বঙ্গবন্ধুকে। কোনো রকম ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে দিলু আর আমিরুল। তারপর থেকেই প্রতিদিন যেন রূপ পাল্টাতে থাকে ঢাকা তথা দেশের পরিস্থিতি। স্বস্তি হারিয়ে যায় মানুষের মন থেকে। ঢাকার অবস্থা খারাপ দেখে আফসার আলী পুরো পরিবারকে গ্রামের বাড়ি বরিশালে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমিরুলকে ছেড়ে যাবার কষ্টে প্রথম অমত করে দিলু। কিন্তু আফসার আলীর এক কথা। দেশের পরিস্থিতি কখন কী হয়! ঢাকা-বরিশাল দোতলা লঞ্চ ছাড়ে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে। আমিরুলও আসে দিলুকে বিদায় জানাতে। লঞ্চে যেন তিল ধারনের ঠাঁই নাই। কেবিন, ডেক, সব লোকে লোকারণ্য। সবার মধ্যে অজানা আতঙ্ক আর হুড়োহুড়ি। কোনো রকমে সারেং-এর ডেকের পাশে বিছানা পেতে নেয় দিলুর পরিবার। এত লোকের মধ্যেও হকারদের ভিড়। পত্রিকাওয়ালা পত্রিকা এনে হাতে গুঁজে দেয়, ঝালমুড়িওয়ালা ছোট কৌটায় ঝালমুড়ি বানায় খচর খচর শব্দে। কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজের গন্ধে জিভে জল চলে আসে দিলুর। অন্ধ, খোঁড়া ভিখিরিরা এসে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে ভিড়ের মধ্যেও। মানুষের কোলাহল আর ধাক্কাধাক্কিতে একটুও সুস্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না আমিরুল আর দিলু। পরিবারের সবাইকে পাতা বিছানায় বসিয়ে লঞ্চের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় ওরা দু’জন। কেরানীগঞ্জের কোলঘেঁষে সূর্য ডুবে যায় আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে। সেই আভায় আরো বিষণœ লাগে দিলুকে। বারবার ওর মনে হতে থাকে জীবনে আর বোধহয় দেখা হবে না আমিরুলের সাথে। ওদিকে সুগানি ঘন ঘন ঘন্টা পিটায়। লঞ্চ ছেড়ে দেবার সংকেত। তেমন কোনো কথাই ওরা বলতে পারে না বিদায়লগ্নে। কতকটা সময় দিলু ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে থাকে আমিরুলের মুখের দিকে। ওর ডান হাতটা ধরে আমিরুল বলে ‘সাবধানে থেকো, নিজের খেয়াল রেখো। সময় করে চিঠি দিও।’ উত্তরে দিলু কেবল বলে ‘তুমিও’। ঝাপসা হয়ে আসে ওর দু’চোখ।

লঞ্চের সিঁড়ি উঠে গেছে। সদরঘাট টার্মিনাল থেকে একটু একটু করে সরে যায় লঞ্চ। সিঁড়ি না থাকায় হকাররা শেষ মুহূর্তে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে টার্মিনালে নামে। লঞ্চের পো পো ভেঁপুতে মাথা ধরে যায় দিলুর। তবুও রেলিং ধরে দাঁড়িয়েই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত আমিরুলের ধূসর রংয়ের বেরই হ্যাটটা দেখা যায়। যতদূরে সরে যায় লঞ্চ দিলুর জীবন থেকে যেন দূরে আরো দূরে চলে যায় আমিরুল।

গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে ঢাকার সাথে অনেকটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দিলুদের। একটা চিঠি পাঠালে হাতে পেতে এক সপ্তাহ থেকে দশ পনের দিনও লেগে যায়। পঁচিশে মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনী যখন পিলখানা আক্রমণ করে তখন আশেপাশের অনেক বাড়িতে ঢুকে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। সেই রাতে মারা যায় আমিরুলের বড় ভাই, ভাবি আর তাদের চার বছরের ছেলে। আমিরুল সেদিন অন্য এক বন্ধুর বাসায় বসে পোস্টার ব্যানার লিখছিলো। সেই রাতের খবর ওরই বন্ধুর কাছ থেকে পরে জেনেছে দিলু। আর ওটাই ছিলো আমিরুলের শেষ খবর। এপ্রিলের মাঝামাঝি দিলুদের গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এক ভোর রাতে রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় নদীপথে ওরা স্পিডবোটে এসে আক্রমণ করে গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর। বাড়ির পর বাড়ি আগুন ধরিয়ে ছারখার করে দেয়। গ্রামের অল্প বয়সি মেয়ে, ঘরের বউদের ধরে নিয়ে স্পিডবোটে তোলে। চারদিকে কেবল গুলি আর ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদের শব্দে দিশেহারা দিলুদের পরিবার। বাড়ি ছেড়ে তারাও অন্ধকারের ভেতর ছুটতে থাকে দিগি¦দিক। যে যেখানে পেরেছে লুকিয়ে জীবন বাঁচায়। দিলু পানিভর্তি পাট খেতে লুকিয়ে থাকে দুদিন। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাইটি মারা যায় হানাদারদের এলোপাতাড়ি গুলিতে। একদম ছোট তিন বছরের ভাইটি রাতের অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চার/পাঁচ দিন পরে বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে এক ডোবায় পাওয়া যায় ছোট্ট ভাইটির মৃতদেহ। দুদিন পরে গ্রামের লোকজন যখন পাটক্ষেত থেকে দিলুকে উদ্ধার করে ততক্ষণে উদভ্রান্ত সে। ভয়ে কুঁকড়ে থাকে ঘরের কোণে। কারো সাথেই কথা বলে না। দু’দুটো সন্তানকে একসাথে হারিয়ে শোকে দুঃখে এক সপ্তাহের মাথায় মারা যায় দিলুর মা।

নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। আমিরুলের খোঁজ নেই, মা ভাইদের হারিয়ে দিলু পাগল প্রায়। আফসার আলী দিলু আর ওর ভাইটাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। মাঝেমাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় আমিরুলকে খোঁজে দিলু। কখনো কখনো আর্ট কলেজে চলে যায় একা একা। এদিকে চাকরি রেখে মেয়ের দেখাশোনা করা কঠিন হয়ে পড়ে আফসার আলীর। বিবাহযোগ্য মেয়ে, কখন কোন বিপদ হয়! কেউ কেউ আবার দিলুকে বীরাঙ্গনা ভাবতে শুরু করে। আপনজনেরা বুদ্ধি দেয়- মেয়েকে বিয়ে দিলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ততদিনে আফসার আলী অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছেন আমিরুলের। তিনিও বিশ্বাস করেন- আমিরুল শহীদ হয়েছেন। মেয়ের এই অবস্থায় পাত্র পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। শেষমেশ বোনের ছেলে কবিরের সাথেই বিয়ে দিলেন দিলুর। একটা বেসরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে সে। কবির অবশ্য আগে থেকেই দিলুকে খুব পছন্দ করতো। তাই বিয়েতে তার অমত ছিল না। দিলুর কাছে নিজেকে স্বামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে কবিরকে।

এইসব পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে দিলুর নির্ঘুম কেটে যায় রাত।

আগের দিন ছেলের স্কুলে ওই মানুষটাকে দেখে পরের দিনও আগেভাগেই স্কুলে চলে আসে দিলু। তার মন বলছে এই স্কুলের সাথেই ওই মানুষটার কোন সম্পর্ক আছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি দিলুকে। ঠিক আগের দিনের সময়েই সেই ধূসর বেরই হ্যাট, কালো চাদর জড়িয়ে ক্রাচে ভর করে গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে আগন্তুক। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ পায় দিলু। আজ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সোজা মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। চমকে ওঠে লোকটা। থমকে যায় সামনে বাড়ানো তার ক্রাচ। ঝুঁকানো মুখটা একটু তুলে বা হাতে হ্যাটটা ঠেলে উপরে তুলে সামনে তাকায়। বিস্ময়ের ঘোরে চোখে যেন কিছুই দেখতে পায় না দিলু। একগাল দাড়ি গোঁফের ভেতর চেনা যায় মানুষটার চোখ দুটো। মায়া মাখানো চোখ দুটো এখনো আগের মতোই আছে। থরথর করে কাঁপতে থাকে দিলু। টপটপ চোখের জল পড়তে থাকে পাথুরে ফুটপাতে। হতবিহ্বল দিলুর মুখে কোনো কথাই ফোটে না। আগন্তুকের হাত থেকে ছিটকে পড়ে ক্রাচ। টাল সামলাতে না পেরে স্কুলের দেয়াল ধরে দাঁড়ায় সে।

‘আমিরুল...’ অস্ফুটে বলে দিলু।

‘দিলু তুমি...?’ ভূত দেখার মতন চমকে ওঠে আমিরুল।

নিজেকে আর সামলাতে পারে না দিলু। আঁচলে মুখ চেঁপে হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেমন নিঃস্ব আর অসহায় লাগে আমিরুলকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় দিলুর।

‘কোথায় ছিলে এতদিন? কেন নিজের খবর জানাওনি আমাদেরকে? কবে ঢাকায় এসেছো? কত জায়গায় খুঁজেছি তোমাকে?...’ একটার পর একটা প্রশ্ন করতে করতে আমিরুলের গায়ের চাদর ধরে ঝাঁকাতে থাকে দিলু। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে নিজেকে সামলাতে বেশ সময় নেয় আমিরুল। নিচে পড়ে থাকা ক্রাচটা এরই মধ্যে হাতে তুলে দেয় দিলু। ওটায় শরীরের ভর রেখে দাঁড়ায় আমিরুল।

‘অনেক কথা! একসাথে সব কী করে বলি?’ হ্যাটটা খুলে হাতে নিয়ে কান ঢেকে থাকা এলোমেলো চুলগুলোতে আঙুল বুলায় আমিরুল। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।

‘কেন এমন করলে আমার সাথে? বেঁচে থেকেও একটা খবর দাওনি...’ নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারে না দিলু।

‘এগারো নম্বর সেক্টরে কমান্ডার তাহেরের আণ্ডারে যুদ্ধে যোগদান করি। কামালপুর যুদ্ধে গুলি লাগে ডান পায়ের হাঁটুর নিচে। আহত অবস্থায় ধরা পড়ি পাক বাহিনীর হাতে। তারপর ...’ থামে আমিরুল।

‘তারপর... সব শুনতে চাই আমি।’ বলে দিলু।

‘কী হবে সেসব শুনে? আর শুনতে চেয়ো না।’

‘বলো আমি সবটা শুনতে চাই!’ মরিয়া যেন দিলু। এতোদিনের চাপাকষ্ট ওকে যেন নাছোড় করে তুলেছে।

‘দিলু ওরা অনেক অত্যাচার করেছে আমার উপর। এর চেয়ে যদি মেরে ফেলতো আমি বেঁচে যেতাম।আমাদের বাহিনীর তথ্য জানার জন্য ওরা আমাকে টয়লেটের পানি খাইয়েছে। শেষমেশ আমার গোপনাঙ্গে ইট ঝুলিয়ে দেয়...’ থেমে যায় আমিরুল। সেই দিনের যন্ত্রণার কথা মনে করে কুঁচকে ওঠে চোখ মুখ। গোপন আর্তনাদ যেন বেরিয়ে আসতে চায় বুকের গভীর থেকে। খানিক দম নিয়ে বলে’ অজ্ঞান হয়ে যাই। ক’দিন অজ্ঞান ছিলাম জানি না। মরে গেছি ভেবে ওরা নদীতে ফেলে দেয়। আর কিছু বলতে পারি না...’

হতবাক দিলু তাকিয়েই থাকে আমিরুলের মুখের দিকে। ঘোর লাগা চোখে জানতে চায়-

‘দেশে ফিরেছো কবে?’

‘একবছর আগে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় এসেছি। পরে জেনেছি- ছয় মাস শিলং-এর হাসপাতালে ছিলাম। এক সাংবাদিক দিল্লিতে নিয়ে যায়। আমি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলি। পুরনো কোনো কিছুই মনে করতে পারতাম না। সেখান থেকে এক দাতব্য সংস্থা সিঙ্গাপুর পাঠায়। ওখানে আস্তে আস্তে স্মৃতি ফিরে পাই। তোমাকে মনে পড়ে। দেশে আসতে ইচ্ছে করে।’

‘দেশে এসে কেন খোঁজ নাওনি আমার?’

হাসে আমিরুল। দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত পরাজিত এক সৈনিক যেন!

‘এই জীবনটাকে আর কারো সাথে জড়াতে চাইনি দিলু। তারপরও নিজেকে কিছুতেই মানাতে পারছিলাম না। দেশে এসেই তোমার গ্রামে যাই। তোমার এক আত্মীয়ের কাছে জেনেছি স্বামী, সন্তান নিয়ে ভালো আছো তুমি। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় এই স্কুলে আর্টের শিক্ষক হিসেবে চাকরি হলো কদিন আগে।’

‘একটিবার আমাকে দেখতে ইচ্ছে করেনি?’ ঠুকরে কেঁদে ওঠে দিলু।

যেন কিছুই শুনতে পায়নি এমনি করে ক্রাচে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় আমিরুল। ওদিকে অনেক আগেই ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। ছোট্ট রানা এসে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছে। উদভ্রান্তের মতন ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরে দিলু। পরেরদিন আবারও ছুটে যায় স্কুলে। কত কথা, কত কিছু বলার আছে মানুষটাকে। কোথায় থাকে, কে যতœ করে- কিছুই জানা হলো না। সব জানতে হবে দিলুকে।

ওই দিন সকালেই স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে চলে যায় আমিরুল। কেউ জানে না কোথায় চলে গেছে সে।

back to top