জোবায়ের মিলন
‘দিব্যপুরুষ’ কথাসাহিত্যিক পলাশ মজুমদারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। পূর্বে তাঁর গল্প পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে বলে উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিয়েছিলাম; পাঠ করেছি প্রকাশের আগে। মনে আছে, পাণ্ডুলিপিটি পড়ার পর কয়েক দিন কিছু আর পাঠ করতে পারিনি। একটা ভাবের ঘোরে ছিলাম; প্রায় আট শ’ বছর আগের দোদুল্যমান এক সময়ের পাঠ গ্রহণ করে। অদ্ভুত কিন্তু সত্য, সত্য কিন্তু ভয়ানক- যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিবার, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, সভ্যতার বাঁক-বদল আর রক্তমরুদ্যানে অস্থিরতা- সবকিছু মিলে গা শিরশির করা কালের প্রত্যক্ষণ। কয়েকবার হোঁচট খেয়েছি- একি সত্যিই সত্য, নাকি কল্পনার পটে অঙ্কিত কোনো পটরেখা? ইতিহাস হাতড়ে যাচাই করেছি, পরখ করে দেখেছি ইতিহাস-আশ্রয়ী এ এক মিহিন কাহিনি।
বাংলা শিল্প-সাহিত্যের এক ক্রান্তিকাল উপন্যাসটির পটভূমি। এই উপন্যাসে সেই সময়কে আশ্রয় করা হয়েছে, যে সময়ে সুদীর্ঘ একটি রেখা ভেঙে পড়ছে আরেকটি নতুন রেখার উত্থানে, যে সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য রচিত হয়নি, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি শিল্প। কারণ, শিল্প-সাধনার অনুকূল পরিবেশ তখন বাংলায় ছিল না। তুর্কি আক্রমণে তটস্থ ছিলো বঙ্গ-বরেন্দ্রভূমির প্রতিটি জনপদ। হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজে জীবনধারণ হয়ে উঠেছিলো দুর্বিষহ।
লক্ষণ সেনের রাজত্বের শেষ পর্বে শাসনব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে, সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষকদের নিগ্রহ ও সামন্ত-মহাসামন্তদের অত্যাচারে অন্ত্যজ শ্রেণি আর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রাণ বিষিয়ে ওঠে, তখন তাদের জীবন আরও বিপন্ন করে তোলে তুর্কি ও সুযোগসন্ধানী এ দেশীয় সৈন্যরা। সমূহ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা মুসলমান দিব্যপুরুষদের শরণাপন্ন হয়; দীক্ষা নেয় নতুন ধর্মে। কারণ, তুর্কিরা স্বধর্মীদের ওপর নির্যাতন করে না, বরং রক্ষা করে।
উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে একেবারে প্রথম পরিচ্ছদে পুরো কাহিনির ইঙ্গিত পাঠকের চোখে ধরা পড়ে। ধর্মত্যাগের পারিবারিক টানাপোড়েন দিয়ে সাবলীল মুন্সিয়ানায় পলাশ মজুমদার শুরু করেছেন কাহিনির যাত্রা। ‘কয়েকদিন আগে যবন ধর্ম গ্রহণ করেছে হরিদাসের ছেলে নিরঞ্জন। ছেলের নতুন ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বুকটা ভারি হয়ে আছে হরিদাসের। তীব্র একটা ব্যথা অস্থির করে তুলেছে তাঁকে। এই অস্থিরতা আর অসহ্য যন্ত্রণা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে, হরিদাস তা টের পাচ্ছেন ভালোভাবে। নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টার কমতি নেই হরিদাসের। অথচ নিরঞ্জনের মা কাননবালার মানসিক অবস্থা তাঁর বিপরীত। ... হরিদাস এক কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র! এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়, তিনি জানেন না; জয়-পরাজয় তো অনেক দূরের বিষয়। এমন রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি কখনো হননি হরিদাস। তিনি কিছু ভাবতে পারছেন না আর, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে...’।
উপন্যাসটির রচনার নৈপুণ্য উজিয়ে ওঠে যখন দেখি ধর্মান্তরিত হওয়ার গল্প দিয়ে শুরু হয়ে এক প্রেম কাহিনিকে আঁকড়ে ধরে একটি মতাদর্শের প্রবেশ ও প্রভাব এবং একটি সময় পাটাতন ভেঙে নদীর বাঁকের মতো অচেনা হাত ধরে নতুন এক হাতের করমর্দন শেষে একটি উত্তাল কালকে নিখুঁত উপস্থাপন করে ফের সেই পারিবারিক বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক অগ্রসর হচ্ছেন পরিসমাপ্তির দিকে।
উপন্যাসটি এখানেই স্বতন্ত্র যে, কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বিশ্রামের বিন্দুমাত্র সুযোগ আসে না। ঘটনা, পরিপ্রেক্ষিত, অবস্থা আর চরিত্রের বিচরণ থামতে দেয় না, আলগোছে নিয়ে যায় পরের পৃষ্ঠায়। চুম্বকের মতো। যদিও ‘দিব্যপুরুষ’ পরিচ্ছন্ন উপন্যাস তবুও বার বার মনে হয়, গভীর কোনো ইতিহাসের গুহায় যেন প্রবেশ করছি, জানছি বিচিত্র গল্প, কাহিনির পর কাহিনি যা আগে জানিনি। ঔপন্যাসিক যদিও একে ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস বলেননি, কিন্তু তা বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না। সে নাই হোক, ‘দিব্যপুরুষ’ সুপাঠ্য উপন্যাস।
উপন্যাসটির শেষ পরিচ্ছদে যে বিয়োগচিত্র আঁকা হয়েছে তা’ই এই উপন্যাসটিকে অনেক অনেক দিন মননে জাগিয়ে রাখবে, এর শৈলীই একে বাঁচিয়ে রাখবে বলে আমার বিশ^াস। ‘স্ত্রীর হাত ধরে হরিদাস যবন কেন্দ্রের দিকে সোজা হেঁটে চলেন। কেন্দ্রে ঢোকার মুখেই নিরঞ্জনের দেখা পেয়ে যান তাঁরা। হরিদাস ছেলের সঙ্গে একটিও বাক্য বিনিময় করেন না; এমনকি মুখের দিকেও তাকান না। কাননবালাকে ছেলের কাছে হস্তান্তর করেন শুধু। তারপর হরিদাস নীরবে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়; কাননবালা ও নিরঞ্জনের ডাকে পেছন ফিরে একবারও তাকান না।’
এই উপন্যাসে নিরেট প্রেমগল্পের বুনন বর্ণনার মধ্য দিয়ে সেই অন্ধকার সময়ে কেন ঝরে পড়েছিল শিল্পসুষমা এবং রুদ্ধ ছিল জ্ঞানচর্চা- ইতিহাসের সরোবরে অবগাহন করে কথাশিল্পী পলাশ মজুমদার তা তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন। একই সমান্তরালে বিশাল ক্যানভাসে এঁকেছেন তৎকালীন সমাজের এক খণ্ডচিত্র।
দীর্ঘদিন পর পাঠানন্দ পাওয়া সুপাঠ্য এই উপন্যাসের জন্য নিরন্তর শুভকামনা। অগ্রসর পাঠক বইটির কথা অনেকদিন মনে রাখবে- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
দিব্যপুরুষ : পলাশ মজুমদার। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। প্রকাশক: বিদ্যাপ্রকাশ। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি-২০২১। মূল্য: ২৭০ টাকা।
জোবায়ের মিলন
বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১
‘দিব্যপুরুষ’ কথাসাহিত্যিক পলাশ মজুমদারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। পূর্বে তাঁর গল্প পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে বলে উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিয়েছিলাম; পাঠ করেছি প্রকাশের আগে। মনে আছে, পাণ্ডুলিপিটি পড়ার পর কয়েক দিন কিছু আর পাঠ করতে পারিনি। একটা ভাবের ঘোরে ছিলাম; প্রায় আট শ’ বছর আগের দোদুল্যমান এক সময়ের পাঠ গ্রহণ করে। অদ্ভুত কিন্তু সত্য, সত্য কিন্তু ভয়ানক- যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিবার, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, সভ্যতার বাঁক-বদল আর রক্তমরুদ্যানে অস্থিরতা- সবকিছু মিলে গা শিরশির করা কালের প্রত্যক্ষণ। কয়েকবার হোঁচট খেয়েছি- একি সত্যিই সত্য, নাকি কল্পনার পটে অঙ্কিত কোনো পটরেখা? ইতিহাস হাতড়ে যাচাই করেছি, পরখ করে দেখেছি ইতিহাস-আশ্রয়ী এ এক মিহিন কাহিনি।
বাংলা শিল্প-সাহিত্যের এক ক্রান্তিকাল উপন্যাসটির পটভূমি। এই উপন্যাসে সেই সময়কে আশ্রয় করা হয়েছে, যে সময়ে সুদীর্ঘ একটি রেখা ভেঙে পড়ছে আরেকটি নতুন রেখার উত্থানে, যে সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য রচিত হয়নি, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি শিল্প। কারণ, শিল্প-সাধনার অনুকূল পরিবেশ তখন বাংলায় ছিল না। তুর্কি আক্রমণে তটস্থ ছিলো বঙ্গ-বরেন্দ্রভূমির প্রতিটি জনপদ। হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজে জীবনধারণ হয়ে উঠেছিলো দুর্বিষহ।
লক্ষণ সেনের রাজত্বের শেষ পর্বে শাসনব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে, সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষকদের নিগ্রহ ও সামন্ত-মহাসামন্তদের অত্যাচারে অন্ত্যজ শ্রেণি আর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রাণ বিষিয়ে ওঠে, তখন তাদের জীবন আরও বিপন্ন করে তোলে তুর্কি ও সুযোগসন্ধানী এ দেশীয় সৈন্যরা। সমূহ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা মুসলমান দিব্যপুরুষদের শরণাপন্ন হয়; দীক্ষা নেয় নতুন ধর্মে। কারণ, তুর্কিরা স্বধর্মীদের ওপর নির্যাতন করে না, বরং রক্ষা করে।
উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে একেবারে প্রথম পরিচ্ছদে পুরো কাহিনির ইঙ্গিত পাঠকের চোখে ধরা পড়ে। ধর্মত্যাগের পারিবারিক টানাপোড়েন দিয়ে সাবলীল মুন্সিয়ানায় পলাশ মজুমদার শুরু করেছেন কাহিনির যাত্রা। ‘কয়েকদিন আগে যবন ধর্ম গ্রহণ করেছে হরিদাসের ছেলে নিরঞ্জন। ছেলের নতুন ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বুকটা ভারি হয়ে আছে হরিদাসের। তীব্র একটা ব্যথা অস্থির করে তুলেছে তাঁকে। এই অস্থিরতা আর অসহ্য যন্ত্রণা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে, হরিদাস তা টের পাচ্ছেন ভালোভাবে। নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টার কমতি নেই হরিদাসের। অথচ নিরঞ্জনের মা কাননবালার মানসিক অবস্থা তাঁর বিপরীত। ... হরিদাস এক কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র! এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়, তিনি জানেন না; জয়-পরাজয় তো অনেক দূরের বিষয়। এমন রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি কখনো হননি হরিদাস। তিনি কিছু ভাবতে পারছেন না আর, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে...’।
উপন্যাসটির রচনার নৈপুণ্য উজিয়ে ওঠে যখন দেখি ধর্মান্তরিত হওয়ার গল্প দিয়ে শুরু হয়ে এক প্রেম কাহিনিকে আঁকড়ে ধরে একটি মতাদর্শের প্রবেশ ও প্রভাব এবং একটি সময় পাটাতন ভেঙে নদীর বাঁকের মতো অচেনা হাত ধরে নতুন এক হাতের করমর্দন শেষে একটি উত্তাল কালকে নিখুঁত উপস্থাপন করে ফের সেই পারিবারিক বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক অগ্রসর হচ্ছেন পরিসমাপ্তির দিকে।
উপন্যাসটি এখানেই স্বতন্ত্র যে, কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বিশ্রামের বিন্দুমাত্র সুযোগ আসে না। ঘটনা, পরিপ্রেক্ষিত, অবস্থা আর চরিত্রের বিচরণ থামতে দেয় না, আলগোছে নিয়ে যায় পরের পৃষ্ঠায়। চুম্বকের মতো। যদিও ‘দিব্যপুরুষ’ পরিচ্ছন্ন উপন্যাস তবুও বার বার মনে হয়, গভীর কোনো ইতিহাসের গুহায় যেন প্রবেশ করছি, জানছি বিচিত্র গল্প, কাহিনির পর কাহিনি যা আগে জানিনি। ঔপন্যাসিক যদিও একে ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস বলেননি, কিন্তু তা বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না। সে নাই হোক, ‘দিব্যপুরুষ’ সুপাঠ্য উপন্যাস।
উপন্যাসটির শেষ পরিচ্ছদে যে বিয়োগচিত্র আঁকা হয়েছে তা’ই এই উপন্যাসটিকে অনেক অনেক দিন মননে জাগিয়ে রাখবে, এর শৈলীই একে বাঁচিয়ে রাখবে বলে আমার বিশ^াস। ‘স্ত্রীর হাত ধরে হরিদাস যবন কেন্দ্রের দিকে সোজা হেঁটে চলেন। কেন্দ্রে ঢোকার মুখেই নিরঞ্জনের দেখা পেয়ে যান তাঁরা। হরিদাস ছেলের সঙ্গে একটিও বাক্য বিনিময় করেন না; এমনকি মুখের দিকেও তাকান না। কাননবালাকে ছেলের কাছে হস্তান্তর করেন শুধু। তারপর হরিদাস নীরবে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়; কাননবালা ও নিরঞ্জনের ডাকে পেছন ফিরে একবারও তাকান না।’
এই উপন্যাসে নিরেট প্রেমগল্পের বুনন বর্ণনার মধ্য দিয়ে সেই অন্ধকার সময়ে কেন ঝরে পড়েছিল শিল্পসুষমা এবং রুদ্ধ ছিল জ্ঞানচর্চা- ইতিহাসের সরোবরে অবগাহন করে কথাশিল্পী পলাশ মজুমদার তা তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন। একই সমান্তরালে বিশাল ক্যানভাসে এঁকেছেন তৎকালীন সমাজের এক খণ্ডচিত্র।
দীর্ঘদিন পর পাঠানন্দ পাওয়া সুপাঠ্য এই উপন্যাসের জন্য নিরন্তর শুভকামনা। অগ্রসর পাঠক বইটির কথা অনেকদিন মনে রাখবে- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
দিব্যপুরুষ : পলাশ মজুমদার। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। প্রকাশক: বিদ্যাপ্রকাশ। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি-২০২১। মূল্য: ২৭০ টাকা।