alt

সাময়িকী

যেভাবে স্বপ্ন আঁকেন ভ্যানগগ

সালেহা চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১

ভ্যানগগের আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য স্টারি নাইট’

আমার একটি ভালো লাগা কাজ টেলিভিশনে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে ভালো কোন প্রোগ্রাম দেখা। পুরো ব্রন্টিদের ইতিহাস জেনেছি সেটিতে বসে, এক থোপ আলোর নিচে রাখা টেলিভিশনের রাতের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে। পা ডোবানো আলোতে। জেনেছি চার্লস ডিকেন্সের জীবন, জার্নালিজম, ভয়ানক লন্ডন বা লন্ডনের ঘিনঘিনে জীবন। সব কিছু টেলিশিনের পর্দায়। গালিভারের সঙ্গে ভ্রমণে গেছি। রবিনসন ক্রুশোর সঙ্গে এক নির্জন দ্বীপে। শুনেছি ক্যাপ্টেন করোলির ম্যান্ডোলিন এবং পালাগিয়ার প্রেম। বৃটেনের পুরো ‘বিগ রিড’ প্রোগ্রামের একুশটি বইয়ের ইতিহাস ও সারমর্ম জেনেছি একুশজন সেরা সমালোচকের কাছে। জেনেছি কোলরিজ আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের নানা সব তথ্য। ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্ত্রীর প্রেমে পড়লে কোরলিজকে বাড়িছাড়া করেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। মেরি হাচিনসনের সঙ্গে প্রেম না করে যদি ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে প্রেম করতেন কোলরিজ তাহলে ঘটনা অন্যরকম হতো। একজন তাঁর বউ আর একজন বোন। একজন বক্তা বা সমালোচক সবসময় নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেন। এরাই আমাদের চিন্তার জগতের দরজায় সজোরে কড়া নাড়তে পারেন। ভাবনায় উঁকি দেয় নতুন দিগন্ত। আর এর ফলে আমরা নতুন বই কিনি, নতুন করে ভাবি আর কিছু না হলে আলো-ছায়ায় রাতের গভীরে ঝিমাতে থাকি।

ওয়েনমেরার জানুসাক নামের একজন সমালোচক পর পর তিনরাত ভ্যানগগের জীবন নিয়ে কথা বলেছিলেন। ‘ভিনসেন্ট ফুল স্টোরি’ নামের একটি অসামান্য অনবদ্য অনুষ্ঠান আমাকে নিদ্রাহীন রেখেছে। পর পর তিন রবিবার এক ঘণ্টা করে। ভিনসেন্ট আমার আত্মার মানুষ, বেদনার মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। আমি একটি ইংরেজি কবিতায় বলেছি তোমার কষ্ট? আমি তো তা একটি সুরে বলে দিতে পারি। ‘আই নেম দ্যাট টিউন ইন ওয়ান।’ যেদিন কেট তাকে প্রত্যাখান করেছিল ভিনসেন্ট মোমের আগুনে হাত গলিয়ে ফেলে বলতে চেয়েছিল কেট তার কাছে কতটা। আর ভিনসেন্টকে উন্মাদ মনে করে কেট পালিয়ে গিয়েছিল। আমি তখন মনে মনে আর্তনাদ করে বলি কী হয়েছে কী তাতে? তোমার প্রতিভার কাছে ওইসব মেয়েরা কিছুই না পাগল শিল্পী। আমরা তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবসি। তুমি এখন আমাদের। এমনিভাবে আর একটি চরিত্র আমাকে বেদনার্ত করে সে ‘ইস্ট অফ ইডেনের’ এ্যাডাম ট্রাস্ক। তাঁর কষ্ট আমাকে আছন্ন করে। যিনি মরতে মরতে বলে যান মানুষের সম্ভাবনার কথা। ‘টিমসবেল’ বা দাউ মেয়েস্ট। তোমারও হাতে পারে। একজন গল্পের চরিত্র আর একজন মানুষ। আহা এইসব নিয়েই তো আমাদের পৃথিবী। সেখানে আছে আমার বানানো কাদাপুতুলের আর কত মানুষ। ওরা আমাকে হাসায়, কাঁদায়, আনন্দ দেয়।

‘স্টারি স্টারি নাইটের’ গানের শব্দগুলো কি মনে আছে? তুমি তোমার পাগলামি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। শান্ত মানুষ হয়ে থাকা অসহ্য হলো তোমার। তারপর? কেউ কি বুঝবে তুমি কি চেয়েছিলে ভিনসেন্ট?

পর পর তিন দিন নট নড়নচড়ন হয়ে কী দেখলাম আর কী জানলাম? জানলাম কিছু, যা জানা ছিল, কিছু অজানা। কেমন করে নয় বছরের ছবি আঁকা বদলে দিয়েছে পৃথিবীর ছরি আঁকার ইতিহাস। সাঁইত্রিশ বছরে মারা গিয়ে কী এমন ক্ষতি হয়েছে? পাগলা গারদে আটকে রেখেওবা ক্ষতি কী? এসবের মধ্যে পৃথিবীর মানুষকে যা বলবার বলেছেন। পাগলাগারদের তালা দেওয়া ঘরের জানালা দিয়ে যা দেখেছিলেন তাই তো এখন স্টারি স্টারি নাইট। যে কাকের মাঠ এসেছিল তার জীবনে সেখানেই একদিন নিজেকে গুলি করেন। কিন্তু কেন? জানুসাক ভিনসেন্টর কান কেটে একজন বারবনিতাকে উপহার দেবার বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন। আমি শুনেছি ভ্যানগগের কানে ‘টিনেটাস’ ছিল। তিনি সারাক্ষণই এটা সেটা শুনতে পেতেন। ওই রোগ মাঝে মাঝে আমাকে ধরে। জোরে গান বাজিয়ে, কান ফাটিয়ে রক্ষা করতে চাই নিজেকে। এখন অবস্থা আগের চাইতে ভালো। ভিনসেন্ট কি এই কারণে কান কেটেছিলেন? হতেও পারে। কিন্তু এই সময়ে পল গোঁগা যখন এলেন তাঁর জীবনে তিনি খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু বেশি দিন নয়। টিনেটাস নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখেছিলেন কিন্তু গোঁগার চলে যাওয়া নিয়ে নয়। তিনি মানুষের সঙ্গর জন্য পিপাসার্ত ছিলেন। ডেকেছিলেন আর এক শিল্পীকে তার সঙ্গে সময় কাটাতে। টুলোস লুর্ত্রেক আসেননি। এসেছিলেন পল গোঁগা তাহিতি যাবার আগে। কাজ শেষ করে দুই বন্ধু বারবনিতার সঙ্গে সময় কাটাতেন। সেখানে একজন ছিলেন ভ্যানগগের প্রিয়। শোনা যায় ভ্যানগগের কারণে সেই মেয়েটি আর্লসএ এসেছিলেন। আর সেই মেয়েটির প্রতি ছিল গোঁগার আকর্ষণ। একদিন ভ্যানগগের অবর্তমানে মেয়েটির সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়েছিলেন গোঁগা। তারপর সেই খবরে দুই বন্ধুতে লাগে মারামারি। প্রথমে ঝগড়া। তারপর হাতাহাতি। এই মারামারির পর গোঁগা পালালেন। আর ভিনসেন্ট কান কেটে পাঠিয়ে দিলেন তার সেই প্রিয় বারবনিতার কাছে। একা থাকা তার ভারসাম্য শেষ করেছিল। এমন হতে পারে। জানুসাক বলেছিলেন কান কাটার কারণ আর একটি। স্পেনে বুলফাইটের পর ম্যাডাডোর পরাজিত ষাঁড়ের কান কেটে সকলকে দেখান। এটাই রীতি। জানুসাক বলছেন ভিনসেন্টের এমন কোনো কারণ ছিল কিনা সঠিক বলা যাবে না তবে এটা একটা কারণ হতে পারে। তিনি বারবনিতাকে প্রশ্ন করেছিলেন আমি কি পরাজিত ষাঁড়? শারীরিক ও মানসিক কারণে ভ্যানগগ হারিয়ে ফেলেন রমণী সংসর্গের শক্তি। এবং পল গোঁগা যাকে উপভোগ করতে গেছেন সেই নারী তাঁর প্রিয়। গোঁগা উপভোগ করেছেন আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন এ তাঁর সহ্য হয়নি। তিনি পরাজিত একজন। কান কেটে সে কথা বলার চেষ্টা। এর মধ্যে কতটা সত্য তা টাইম মেশিন ছাড়া নির্ণয় কে করতে পারবে! কাজেই হাইপোথিসিস বা অনুমান। এর সঙ্গে ছিল তাঁর বংশগত পাগলামীর রোগ।

আর একটি বিষয় আমি জানুসকের কথা থেকে জানতে পারি। সেটা হলো ভ্যানগগের উপরে জাপানি আঁকিয়ের প্রভাব। ১৮৫৩ সালে জাপানের ছবি আঁকার কলাকৌশল চলে আসে ইউরোপে। ক্লড মনে, এডওয়ার্ড মনে, রিভেয়েরি, মাতিস এদের সকলের আঁকাতেই চলে আসে জাাপানের প্রভাব। এই প্রো জাপান বা পোস্ট জাপান বুঝতে আমাকে লাইব্রেরি থেকে কিছু বই এনে পড়তে হয়েছিল। যা জানলাম সেটা হলো একশো ভাগ সত্যি। কাজেই আলুখেঁকো মানুষ, খনির মানুষ বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এঁকেছিলেন জাপান প্রভাবিত ছবি। আলু খেতে খেতে আলুর মতো ভোঁতা সব মানুষ। সাদাকালো ছবিতে সিন নামের বারবনিতার যে রূপ ছিল তাকে জাপানের প্রভাবে তিনি করেন ঝলমলে। মুজমে নামের আর এক বারবনিতা হয়ে গেছে ঝলমলে নারী। জানুসাক এই রিসার্চের কারণে আর্লসএ এসেছিলেন কারণ এখানেই ছিলেন এই দুই শিল্পী ভ্যান গগ আর গোঁগা। তিনি বলেন এ যে একেবারে পচা এক শহর। তাকে অপরূপ করলেন জাপানি প্রভাবে, তুলির টানে। সেখানে মুজমকে পান নি তবে জেনেছিলেন গ্যাবি বলে আর এক বারবনিতার নাম। কান কাটার কোনো তথ্য যদিও পাননি তবে শোনা যায় সেদিন থিও চিঠি লিখেছিল ও আর জো বিয়ে করছে। এই খবর তাকে এত খুশি করে তিনি কান কেটে ফেলেন। আমি অবশ্য এই কারণ বুঝতে পারি না।

আর ভিনসেন্টের ডাক্তার গ্যাসেট ছিলেন একজন মানসিক রোগী। তাই কাকের মাঠে শরীরে গুলি করে যে গুলিটি শরীরে ছিল তা বের করেননি। বলেছিলেন এই গুলি বের করবার কোনো দরকার নেই। তাই গুলি নিয়ে তিনি বেঁচেছিলেন আরো কয়েকদিন। তারপর মারা যান। যদি গুলি বের করে তাঁকে সারিয়ে তোলা হতো তিনি কি আরো বেশিদিন বেঁচে থাকতেন এবং আমাদের দিতেন আরো নানা ছবি? নাকি আবার মারা যাবার চেষ্টা করতেন পরাজিত ষাঁড়ের বেদনায় ও হতবাঞ্ছায়? সেসব বলা কঠিন?

তাঁর ভাই থিওকে লেখা ছয়শো/সাতশো চিঠি সময়ের স্রোতে টিকে আছে। কত সব রোদভরা, আলোভরা, আবেগভরা, কালোরাত রাত ভরা নানা সব চিঠি। যে সব চিঠির কথা তিন রাত ধরে আমাদের বলেছেন জানুসাক। ভিনসেন্ট মারা যাবার ছয় মাস পরে মাথা খারাপ হয়ে যায় ভাই থিওর। তিনি মারা যান। দুই ভাইকে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়। থিওর বউ জোন দুই ভাইয়ের কবরে লাগিয়ে ছিলেন আইভি। একদিন দুই কবর থেকে দুইটি আইভি জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে। তারপর সেই জুগল আইভি বড় হতে থাকে। গভীর সবুজ পাতার আইভি আজো বলছে দুই ভাইয়ের গভীর ভালোবাসর কথা। যে সব লতাগুল্ম খুব সহজে এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট তারই একটি। থিওর ছেলে আর এক ভিনসেন্ট। তিনি বিখ্যাত করেছিলেন তার চাচাকে। জানিয়েছিলেন এই শিল্পীর প্রতিভাকে সারা বিশ্বে। ভিনসেন্ট ভিলেনিয়াম ভ্য্যানগগের তিনটি ভ কি এনে দিয়েছিল একটি ভয়াবহ মৃত্যু? কিন্তু আর একটি ভ তো সোনার পানিতে ধোওয়া। সে শব্দ ভালোবাসা। আমার তোমার আপনার সকলের হদয়ের শিশির যে ভালোবাসায়। সেই পাগল ডাক্তার গ্যসেটের পরিবার ১৯৯৯ সালে গ্যাসেটকে নিয়ে আঁকা ছবি বিক্রি করেছিলেন কয়েক মিলিয়ন ডলারে। আজ পর্যন্ত এ পৃথিবীর দ্বিতীয় মূল্যবান ছবি। প্রথম দামী ছবি পিকাসোর ‘বয় ইউথ এ পাইপ’ একশো চার মিলিযন। আঁকিয়ে পিকাসো।

ভ্যান গফ, ভ্যান গগ বা ভ্যান গো যাই তার নাম হোক না কেন, তিনি ‘স্টারি স্টারি নাইটের’ ভিনসেন্ট। তিনি সৌন্দর্য, তিনি প্রেম।

থিও খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছিলেন। ভিনসেন্টের পাশে বসে কথা বলেছিলেন। নানা সব ছেলেবেলার কথা। একসময় ক্লান্ত ভিনসেন্ট বলেছিল থিও আমি মনে হয় এখনই মারা যাব। বলতে বলতে গভীর ঘুমের মতো নিরাপদ মৃত্যু তাকে পৌঁছে দিয়েছিল স্বর্গরাজ্যে। সেখানে হয়তো থাকে সূর্যমুখীর ঝাড়।

তিনি এঁকেছিলেন প্রায় দুই হাজার একটি আর্ট ওয়ার্ক। তেলরং ছবি ৮০৬টি। এগুলো সৃষ্টি করেছিলেন শেষ দুই বছরে। ১৮৫৩ সালে জন্ম আর ১৮৯০ সালে মৃত্যু। এছাড়া ড্রইং, পেনসিল স্কেচ আরো কত কী। আঁকা শুরু করেছিলেন সাতাশ বছর বয়সে। আঁকা নিয়ে কোনো পড়াশোনা ছিল না তার। হিসেব করে বলা হয় প্রতি ছত্রিশ ঘণ্টায় একটি করে ছবি আঁকতেন তিনি।

কতগুলো প্রচলিত সত্য ভিনসেন্টের নামে বাড়িতে আরো চারজন ভিনসেন্ট ছিলেন। তিনি আঁকা শুরু করেছিলেন সাতাশ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন পল গোঁগার বন্ধু। ভিনসেন্ট বলেন গোঁগা আমাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিলেন। আর সে কল্পনার জগত ছিল মিস্ট্রি বা রহস্যময়তায় ঘেরা। তাঁর জীবন জানা যায় অসংখ্য চিঠির মাধ্যমে। থিওকে সবচাইতে বেশি। এরপর একে ওকে। থিওকে লেখা ৬০০/ ৭০০ চিঠিতে নানা সব কথা। ছবি আঁকার আগে তিনি থিওর মকো আর্ট ডিলার হতে চেয়েছিলেন। হতে চেয়েছিলেন যাজক বা পুরোহিত; না হলে স্কুলের শিক্ষক। ১৮৮৯ সালে থিওর কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি থিওকে বলেছিলেন তিনি আর্টিস্ট হতে চান। তার সবচেয়ে ব্যস্ত সময় হলো ছবি আঁকার পিরিয়ড। ডাক্তার গ্যাসেটকে এঁকেছিলেন তিনি। সে ছবি বিক্রি হয়ছিল ১৯৯০ সালে আশি মিলিয়নের বেশি ডলারে। বেঁচে থাকতে তেমন সাকসেস আসেনি তাঁর জীবনে। মুত্যুর পর থিওর ছেলে ভিনসেন্ট তাকে জগতের কাছে পরিচিত করিয়েছিল। অনেক অসুখে ভুগতেন তিনি। মানসিক হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তাকে। তিনি নিজের কান নিজে কেটেছিলেন। ১৮৯০ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন। বুকে গুলি করেছিলেন তিনি। মারা গিয়েছিলেন দুই দিন পরে।

ভিনসেন্ট ভ্যানগগ ছিলেন পোস্ট ইমপ্রেশনিজম ধারার শিল্পী। পল সেজান, গোঁগা, জর্জ সুরাত এঁরাও ছিলেন এই ধারার আর্টিস্ট। হেনরি মাতিস এঁকেছিলেন এর পরের ফবিজম ধারার ছবি।

‘স্টারি স্টারি নাইটের’ গানের শব্দগুলো কি মনে আছে? তুমি তোমার পাগলামি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। শান্ত মানুষ হয়ে থাকা অসহ্য হলো তোমার। তারপর? কেউ কি বুঝবে তুমি কি চেয়েছিলে ভিনসেন্ট? হয়তো কখনোই কেউ বুঝতে পারবে না আসলে একজন শান্ত নীরব মানুষ হয়ে থাকার সেই প্রবল চেষ্টার কথা। বুঝবে না কখনো তুমি কি চেয়েছিলে।

প্রবল সূর্যের আগুনের নিচে বসে এঁকেছিলেন অসংখ্য সূর্যমুখীর ছবি। তাঁর কাছে ছবি আঁকা ছিল প্রবল শক্তির কাজ। নরম তুলির টান নয়। কী থাকে এই ফুলে? কে জানে কে বলবে সে কথা? এঁকেছিলেন আইরিস। পাগলাগারদের জানালা দিয়ে দেখেছিলেন এইসব বেগুনী ফুল।

‘আমি স্বপ্ন দেখি ছবি আঁকার তারপর আমি আমার স্বপ্নকে আমি আঁকি।’ আমরা কি আমাদের স্বপ্নকে লিখতে পারি? তবে এই ছিল তাঁর আঁকার রহস্য তিনি স্বপ্নকে আঁকেন।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

যেভাবে স্বপ্ন আঁকেন ভ্যানগগ

সালেহা চৌধুরী

ভ্যানগগের আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য স্টারি নাইট’

বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১

আমার একটি ভালো লাগা কাজ টেলিভিশনে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে ভালো কোন প্রোগ্রাম দেখা। পুরো ব্রন্টিদের ইতিহাস জেনেছি সেটিতে বসে, এক থোপ আলোর নিচে রাখা টেলিভিশনের রাতের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে। পা ডোবানো আলোতে। জেনেছি চার্লস ডিকেন্সের জীবন, জার্নালিজম, ভয়ানক লন্ডন বা লন্ডনের ঘিনঘিনে জীবন। সব কিছু টেলিশিনের পর্দায়। গালিভারের সঙ্গে ভ্রমণে গেছি। রবিনসন ক্রুশোর সঙ্গে এক নির্জন দ্বীপে। শুনেছি ক্যাপ্টেন করোলির ম্যান্ডোলিন এবং পালাগিয়ার প্রেম। বৃটেনের পুরো ‘বিগ রিড’ প্রোগ্রামের একুশটি বইয়ের ইতিহাস ও সারমর্ম জেনেছি একুশজন সেরা সমালোচকের কাছে। জেনেছি কোলরিজ আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের নানা সব তথ্য। ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্ত্রীর প্রেমে পড়লে কোরলিজকে বাড়িছাড়া করেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। মেরি হাচিনসনের সঙ্গে প্রেম না করে যদি ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে প্রেম করতেন কোলরিজ তাহলে ঘটনা অন্যরকম হতো। একজন তাঁর বউ আর একজন বোন। একজন বক্তা বা সমালোচক সবসময় নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেন। এরাই আমাদের চিন্তার জগতের দরজায় সজোরে কড়া নাড়তে পারেন। ভাবনায় উঁকি দেয় নতুন দিগন্ত। আর এর ফলে আমরা নতুন বই কিনি, নতুন করে ভাবি আর কিছু না হলে আলো-ছায়ায় রাতের গভীরে ঝিমাতে থাকি।

ওয়েনমেরার জানুসাক নামের একজন সমালোচক পর পর তিনরাত ভ্যানগগের জীবন নিয়ে কথা বলেছিলেন। ‘ভিনসেন্ট ফুল স্টোরি’ নামের একটি অসামান্য অনবদ্য অনুষ্ঠান আমাকে নিদ্রাহীন রেখেছে। পর পর তিন রবিবার এক ঘণ্টা করে। ভিনসেন্ট আমার আত্মার মানুষ, বেদনার মানুষ, ভালোবাসার মানুষ। আমি একটি ইংরেজি কবিতায় বলেছি তোমার কষ্ট? আমি তো তা একটি সুরে বলে দিতে পারি। ‘আই নেম দ্যাট টিউন ইন ওয়ান।’ যেদিন কেট তাকে প্রত্যাখান করেছিল ভিনসেন্ট মোমের আগুনে হাত গলিয়ে ফেলে বলতে চেয়েছিল কেট তার কাছে কতটা। আর ভিনসেন্টকে উন্মাদ মনে করে কেট পালিয়ে গিয়েছিল। আমি তখন মনে মনে আর্তনাদ করে বলি কী হয়েছে কী তাতে? তোমার প্রতিভার কাছে ওইসব মেয়েরা কিছুই না পাগল শিল্পী। আমরা তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবসি। তুমি এখন আমাদের। এমনিভাবে আর একটি চরিত্র আমাকে বেদনার্ত করে সে ‘ইস্ট অফ ইডেনের’ এ্যাডাম ট্রাস্ক। তাঁর কষ্ট আমাকে আছন্ন করে। যিনি মরতে মরতে বলে যান মানুষের সম্ভাবনার কথা। ‘টিমসবেল’ বা দাউ মেয়েস্ট। তোমারও হাতে পারে। একজন গল্পের চরিত্র আর একজন মানুষ। আহা এইসব নিয়েই তো আমাদের পৃথিবী। সেখানে আছে আমার বানানো কাদাপুতুলের আর কত মানুষ। ওরা আমাকে হাসায়, কাঁদায়, আনন্দ দেয়।

‘স্টারি স্টারি নাইটের’ গানের শব্দগুলো কি মনে আছে? তুমি তোমার পাগলামি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। শান্ত মানুষ হয়ে থাকা অসহ্য হলো তোমার। তারপর? কেউ কি বুঝবে তুমি কি চেয়েছিলে ভিনসেন্ট?

পর পর তিন দিন নট নড়নচড়ন হয়ে কী দেখলাম আর কী জানলাম? জানলাম কিছু, যা জানা ছিল, কিছু অজানা। কেমন করে নয় বছরের ছবি আঁকা বদলে দিয়েছে পৃথিবীর ছরি আঁকার ইতিহাস। সাঁইত্রিশ বছরে মারা গিয়ে কী এমন ক্ষতি হয়েছে? পাগলা গারদে আটকে রেখেওবা ক্ষতি কী? এসবের মধ্যে পৃথিবীর মানুষকে যা বলবার বলেছেন। পাগলাগারদের তালা দেওয়া ঘরের জানালা দিয়ে যা দেখেছিলেন তাই তো এখন স্টারি স্টারি নাইট। যে কাকের মাঠ এসেছিল তার জীবনে সেখানেই একদিন নিজেকে গুলি করেন। কিন্তু কেন? জানুসাক ভিনসেন্টর কান কেটে একজন বারবনিতাকে উপহার দেবার বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন। আমি শুনেছি ভ্যানগগের কানে ‘টিনেটাস’ ছিল। তিনি সারাক্ষণই এটা সেটা শুনতে পেতেন। ওই রোগ মাঝে মাঝে আমাকে ধরে। জোরে গান বাজিয়ে, কান ফাটিয়ে রক্ষা করতে চাই নিজেকে। এখন অবস্থা আগের চাইতে ভালো। ভিনসেন্ট কি এই কারণে কান কেটেছিলেন? হতেও পারে। কিন্তু এই সময়ে পল গোঁগা যখন এলেন তাঁর জীবনে তিনি খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু বেশি দিন নয়। টিনেটাস নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখেছিলেন কিন্তু গোঁগার চলে যাওয়া নিয়ে নয়। তিনি মানুষের সঙ্গর জন্য পিপাসার্ত ছিলেন। ডেকেছিলেন আর এক শিল্পীকে তার সঙ্গে সময় কাটাতে। টুলোস লুর্ত্রেক আসেননি। এসেছিলেন পল গোঁগা তাহিতি যাবার আগে। কাজ শেষ করে দুই বন্ধু বারবনিতার সঙ্গে সময় কাটাতেন। সেখানে একজন ছিলেন ভ্যানগগের প্রিয়। শোনা যায় ভ্যানগগের কারণে সেই মেয়েটি আর্লসএ এসেছিলেন। আর সেই মেয়েটির প্রতি ছিল গোঁগার আকর্ষণ। একদিন ভ্যানগগের অবর্তমানে মেয়েটির সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়েছিলেন গোঁগা। তারপর সেই খবরে দুই বন্ধুতে লাগে মারামারি। প্রথমে ঝগড়া। তারপর হাতাহাতি। এই মারামারির পর গোঁগা পালালেন। আর ভিনসেন্ট কান কেটে পাঠিয়ে দিলেন তার সেই প্রিয় বারবনিতার কাছে। একা থাকা তার ভারসাম্য শেষ করেছিল। এমন হতে পারে। জানুসাক বলেছিলেন কান কাটার কারণ আর একটি। স্পেনে বুলফাইটের পর ম্যাডাডোর পরাজিত ষাঁড়ের কান কেটে সকলকে দেখান। এটাই রীতি। জানুসাক বলছেন ভিনসেন্টের এমন কোনো কারণ ছিল কিনা সঠিক বলা যাবে না তবে এটা একটা কারণ হতে পারে। তিনি বারবনিতাকে প্রশ্ন করেছিলেন আমি কি পরাজিত ষাঁড়? শারীরিক ও মানসিক কারণে ভ্যানগগ হারিয়ে ফেলেন রমণী সংসর্গের শক্তি। এবং পল গোঁগা যাকে উপভোগ করতে গেছেন সেই নারী তাঁর প্রিয়। গোঁগা উপভোগ করেছেন আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন এ তাঁর সহ্য হয়নি। তিনি পরাজিত একজন। কান কেটে সে কথা বলার চেষ্টা। এর মধ্যে কতটা সত্য তা টাইম মেশিন ছাড়া নির্ণয় কে করতে পারবে! কাজেই হাইপোথিসিস বা অনুমান। এর সঙ্গে ছিল তাঁর বংশগত পাগলামীর রোগ।

আর একটি বিষয় আমি জানুসকের কথা থেকে জানতে পারি। সেটা হলো ভ্যানগগের উপরে জাপানি আঁকিয়ের প্রভাব। ১৮৫৩ সালে জাপানের ছবি আঁকার কলাকৌশল চলে আসে ইউরোপে। ক্লড মনে, এডওয়ার্ড মনে, রিভেয়েরি, মাতিস এদের সকলের আঁকাতেই চলে আসে জাাপানের প্রভাব। এই প্রো জাপান বা পোস্ট জাপান বুঝতে আমাকে লাইব্রেরি থেকে কিছু বই এনে পড়তে হয়েছিল। যা জানলাম সেটা হলো একশো ভাগ সত্যি। কাজেই আলুখেঁকো মানুষ, খনির মানুষ বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এঁকেছিলেন জাপান প্রভাবিত ছবি। আলু খেতে খেতে আলুর মতো ভোঁতা সব মানুষ। সাদাকালো ছবিতে সিন নামের বারবনিতার যে রূপ ছিল তাকে জাপানের প্রভাবে তিনি করেন ঝলমলে। মুজমে নামের আর এক বারবনিতা হয়ে গেছে ঝলমলে নারী। জানুসাক এই রিসার্চের কারণে আর্লসএ এসেছিলেন কারণ এখানেই ছিলেন এই দুই শিল্পী ভ্যান গগ আর গোঁগা। তিনি বলেন এ যে একেবারে পচা এক শহর। তাকে অপরূপ করলেন জাপানি প্রভাবে, তুলির টানে। সেখানে মুজমকে পান নি তবে জেনেছিলেন গ্যাবি বলে আর এক বারবনিতার নাম। কান কাটার কোনো তথ্য যদিও পাননি তবে শোনা যায় সেদিন থিও চিঠি লিখেছিল ও আর জো বিয়ে করছে। এই খবর তাকে এত খুশি করে তিনি কান কেটে ফেলেন। আমি অবশ্য এই কারণ বুঝতে পারি না।

আর ভিনসেন্টের ডাক্তার গ্যাসেট ছিলেন একজন মানসিক রোগী। তাই কাকের মাঠে শরীরে গুলি করে যে গুলিটি শরীরে ছিল তা বের করেননি। বলেছিলেন এই গুলি বের করবার কোনো দরকার নেই। তাই গুলি নিয়ে তিনি বেঁচেছিলেন আরো কয়েকদিন। তারপর মারা যান। যদি গুলি বের করে তাঁকে সারিয়ে তোলা হতো তিনি কি আরো বেশিদিন বেঁচে থাকতেন এবং আমাদের দিতেন আরো নানা ছবি? নাকি আবার মারা যাবার চেষ্টা করতেন পরাজিত ষাঁড়ের বেদনায় ও হতবাঞ্ছায়? সেসব বলা কঠিন?

তাঁর ভাই থিওকে লেখা ছয়শো/সাতশো চিঠি সময়ের স্রোতে টিকে আছে। কত সব রোদভরা, আলোভরা, আবেগভরা, কালোরাত রাত ভরা নানা সব চিঠি। যে সব চিঠির কথা তিন রাত ধরে আমাদের বলেছেন জানুসাক। ভিনসেন্ট মারা যাবার ছয় মাস পরে মাথা খারাপ হয়ে যায় ভাই থিওর। তিনি মারা যান। দুই ভাইকে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়। থিওর বউ জোন দুই ভাইয়ের কবরে লাগিয়ে ছিলেন আইভি। একদিন দুই কবর থেকে দুইটি আইভি জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে। তারপর সেই জুগল আইভি বড় হতে থাকে। গভীর সবুজ পাতার আইভি আজো বলছে দুই ভাইয়ের গভীর ভালোবাসর কথা। যে সব লতাগুল্ম খুব সহজে এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট তারই একটি। থিওর ছেলে আর এক ভিনসেন্ট। তিনি বিখ্যাত করেছিলেন তার চাচাকে। জানিয়েছিলেন এই শিল্পীর প্রতিভাকে সারা বিশ্বে। ভিনসেন্ট ভিলেনিয়াম ভ্য্যানগগের তিনটি ভ কি এনে দিয়েছিল একটি ভয়াবহ মৃত্যু? কিন্তু আর একটি ভ তো সোনার পানিতে ধোওয়া। সে শব্দ ভালোবাসা। আমার তোমার আপনার সকলের হদয়ের শিশির যে ভালোবাসায়। সেই পাগল ডাক্তার গ্যসেটের পরিবার ১৯৯৯ সালে গ্যাসেটকে নিয়ে আঁকা ছবি বিক্রি করেছিলেন কয়েক মিলিয়ন ডলারে। আজ পর্যন্ত এ পৃথিবীর দ্বিতীয় মূল্যবান ছবি। প্রথম দামী ছবি পিকাসোর ‘বয় ইউথ এ পাইপ’ একশো চার মিলিযন। আঁকিয়ে পিকাসো।

ভ্যান গফ, ভ্যান গগ বা ভ্যান গো যাই তার নাম হোক না কেন, তিনি ‘স্টারি স্টারি নাইটের’ ভিনসেন্ট। তিনি সৌন্দর্য, তিনি প্রেম।

থিও খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছিলেন। ভিনসেন্টের পাশে বসে কথা বলেছিলেন। নানা সব ছেলেবেলার কথা। একসময় ক্লান্ত ভিনসেন্ট বলেছিল থিও আমি মনে হয় এখনই মারা যাব। বলতে বলতে গভীর ঘুমের মতো নিরাপদ মৃত্যু তাকে পৌঁছে দিয়েছিল স্বর্গরাজ্যে। সেখানে হয়তো থাকে সূর্যমুখীর ঝাড়।

তিনি এঁকেছিলেন প্রায় দুই হাজার একটি আর্ট ওয়ার্ক। তেলরং ছবি ৮০৬টি। এগুলো সৃষ্টি করেছিলেন শেষ দুই বছরে। ১৮৫৩ সালে জন্ম আর ১৮৯০ সালে মৃত্যু। এছাড়া ড্রইং, পেনসিল স্কেচ আরো কত কী। আঁকা শুরু করেছিলেন সাতাশ বছর বয়সে। আঁকা নিয়ে কোনো পড়াশোনা ছিল না তার। হিসেব করে বলা হয় প্রতি ছত্রিশ ঘণ্টায় একটি করে ছবি আঁকতেন তিনি।

কতগুলো প্রচলিত সত্য ভিনসেন্টের নামে বাড়িতে আরো চারজন ভিনসেন্ট ছিলেন। তিনি আঁকা শুরু করেছিলেন সাতাশ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন পল গোঁগার বন্ধু। ভিনসেন্ট বলেন গোঁগা আমাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিলেন। আর সে কল্পনার জগত ছিল মিস্ট্রি বা রহস্যময়তায় ঘেরা। তাঁর জীবন জানা যায় অসংখ্য চিঠির মাধ্যমে। থিওকে সবচাইতে বেশি। এরপর একে ওকে। থিওকে লেখা ৬০০/ ৭০০ চিঠিতে নানা সব কথা। ছবি আঁকার আগে তিনি থিওর মকো আর্ট ডিলার হতে চেয়েছিলেন। হতে চেয়েছিলেন যাজক বা পুরোহিত; না হলে স্কুলের শিক্ষক। ১৮৮৯ সালে থিওর কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি থিওকে বলেছিলেন তিনি আর্টিস্ট হতে চান। তার সবচেয়ে ব্যস্ত সময় হলো ছবি আঁকার পিরিয়ড। ডাক্তার গ্যাসেটকে এঁকেছিলেন তিনি। সে ছবি বিক্রি হয়ছিল ১৯৯০ সালে আশি মিলিয়নের বেশি ডলারে। বেঁচে থাকতে তেমন সাকসেস আসেনি তাঁর জীবনে। মুত্যুর পর থিওর ছেলে ভিনসেন্ট তাকে জগতের কাছে পরিচিত করিয়েছিল। অনেক অসুখে ভুগতেন তিনি। মানসিক হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তাকে। তিনি নিজের কান নিজে কেটেছিলেন। ১৮৯০ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন। বুকে গুলি করেছিলেন তিনি। মারা গিয়েছিলেন দুই দিন পরে।

ভিনসেন্ট ভ্যানগগ ছিলেন পোস্ট ইমপ্রেশনিজম ধারার শিল্পী। পল সেজান, গোঁগা, জর্জ সুরাত এঁরাও ছিলেন এই ধারার আর্টিস্ট। হেনরি মাতিস এঁকেছিলেন এর পরের ফবিজম ধারার ছবি।

‘স্টারি স্টারি নাইটের’ গানের শব্দগুলো কি মনে আছে? তুমি তোমার পাগলামি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। শান্ত মানুষ হয়ে থাকা অসহ্য হলো তোমার। তারপর? কেউ কি বুঝবে তুমি কি চেয়েছিলে ভিনসেন্ট? হয়তো কখনোই কেউ বুঝতে পারবে না আসলে একজন শান্ত নীরব মানুষ হয়ে থাকার সেই প্রবল চেষ্টার কথা। বুঝবে না কখনো তুমি কি চেয়েছিলে।

প্রবল সূর্যের আগুনের নিচে বসে এঁকেছিলেন অসংখ্য সূর্যমুখীর ছবি। তাঁর কাছে ছবি আঁকা ছিল প্রবল শক্তির কাজ। নরম তুলির টান নয়। কী থাকে এই ফুলে? কে জানে কে বলবে সে কথা? এঁকেছিলেন আইরিস। পাগলাগারদের জানালা দিয়ে দেখেছিলেন এইসব বেগুনী ফুল।

‘আমি স্বপ্ন দেখি ছবি আঁকার তারপর আমি আমার স্বপ্নকে আমি আঁকি।’ আমরা কি আমাদের স্বপ্নকে লিখতে পারি? তবে এই ছিল তাঁর আঁকার রহস্য তিনি স্বপ্নকে আঁকেন।

back to top