মুনীর সিরাজ
ব্যক্তিগতভাবে আমি যে ক’জন নেপালী কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদকের সাথে পরিচিত তাঁরা স্বনামখ্যাত কবি তুলসী দিবস; কবি প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক অভি সুবেদী; নেপালের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহাকবি লক্ষী প্রসাদ দেবকোটার পুত্র পদ্ম প্রসাদ দেবকোটা এবং নেপালে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী কবি ঔপন্যাসিক মণি দিক্সিত। তবে নেপালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে দু’জন কবি-সাহিত্যক সমধিক পরিচিত- তাঁরা হচ্ছেন কবি তুলসী দিবস এবং কবি অভি সুবেদী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে জড়িত থাকার কারণে বেশ কয়েকবার নেপালে যাতায়াতের কারণে নেপালি সাহিত্যচর্চার ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরে ওঠার সুযোগ হয়েছে আমার। নেপালি কবিতা ও সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু প্রবন্ধ ও অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়।
এ নিবন্ধটি বহুমাত্রিক কবি অভি সুবেদী সম্বন্ধে। তিনি পূর্ব নেপালের তেরাঙ্গুম জেলার সাবা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবি অভি সুবেদী ইংরেজি ভাষার ছাত্র এবং অধ্যাপক। তবে অভি সুবেদী দেব নাগরি ভাষায় লিখিত নেপালি বর্ণ শেখার আগে পরিচিত হয়েছিলেন বাংলা অক্ষর ও শব্দের সঙ্গে। কারণ তাঁর মা বাংলা জানতেন এবং বাংলা ভাষাতেই তিনি কাশিরাম দাসের মহাভারত পাঠ করেছিলেন। তাই বাংলায় অনূদিত কবিতা পাঠ করে অভি সুবেদী যে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম যখন তিনি তা উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করেছিলেন বলে স্বয়ং আমাকে জানিয়েছিলেন। কবি অভি সুবেদীর সাথে এই সংযোগ আনন্দদায়ক। অভি সুবেদী ‘কবিতায় বাস্তবাবাদ’ (Pragmatics of Poetry) বিষয়ে সজাগ এবং সচেতন। কীর্তিপুরে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যের রচনাশৈলী (Stylistic) এবং ভাষাতত্ত্ব (Linguistic) বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মূলত সাহিত্যের রচনাশৈলী সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ইংরেজি বিভাগে তিনি বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এবং এ বিভাগে চল্লিশ বছর অধ্যাপনা করেন।
কবি অভি সুবেদী ‘নেপালের লোককাব্য’ প্রতিষ্ঠানের (Nepali Folklore Society) সহ-সভাপতি। ‘আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট’-এর (UNESCO) তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন (২০০০-২০০৮)। তিনি ‘আন্তর্জাতিক নাটক লেখক সংগঠন’-এর (International play Wrights Forum) সদস্য ছিলেন (২০০০-২০১১)। তিনি নেপালের ‘ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক সংগঠন’-এর (Linguistic Society of Nepal) সভাপতি (১৯৯০-১৯৯২) ও মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘নেপালি সাহিত্য পরিষদ’-এর (Literary Association of Nepal) সভাপতি ছিলেন এবং ‘আন্তর্জাতিক নাটক সমালোচক সংগঠন’-এর (International Association of Theater Critics) সদস্য ছিলেন।
সাহিত্য চর্চা ও কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে নেপালের সার্বিক কাব্য-সাহিত্য চর্চার সাথে কবি অভি সুবেদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রচুর লেখায় অভ্যস্ত অভি সুবেদী কবিতা, নাটক, প্রবন্ধে স্বাধীনতা, মুক্তি, সংস্কৃতি, চিত্রশিল্প এবং সমাজ বাস্তবতার বিষয়সমূহ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। প্রগতি চেতনার ধারাবাহিকতা তার লেখার মূল উপজীব্য বিষয়। এমনই এক উচ্চারণ খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর ‘যে মানুষকে ভুলেছে সবাই’ (The Man They All Forget) কবিতায়।
রাজা এবং নেতার চলার পথের পাশে
অন্তরের দীনতায় ক্ষুদ্র ঘাসের মতো অস্তিত্ব আমার।
সময়ের বাহন নিরন্তর ছোটে সেই পথে,
শক্তিমানের স্বপ্ন-প্রসারিত পথের পাশে
আমি বাড়তে পারি না।
দেশের মুখচ্ছবিতে দেখতে পাই
রক্তরঙ ব্যারাক পাহারাদার এবং সিংহ দরবার।
রাজার প্রাসাদ আর শক্তিমানের দম্ভের কাছে একজন সাধারণ মানুষ অতি তুচ্ছ বটে। সেই অনুভূতি কবির। কিন্তু পাহারাদার দ্বারা সুরক্ষিত হলেও কবি সংঘাত এবং বিজয়ের রক্তরঙ দেখতে পান। তেমনি রাজতন্ত্র, আমলাতস্ত্র এবং সুবিধাভোগী রাজনীতিকের তথাকথিত গণতন্ত্রের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা ছিন্ন করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন কবি, রূপকের ভাষায়। মানুষের জীবনের সমস্ত স্বপ্নগুলো নিয়ে সমস্ত সুবিধাভোগীদের উৎপাটিত করে জনগণকে উজ্জ্বল মহিমায় পৌঁছে দিতে চান কবি।
তোমরা তোমাদের
কল্পনার বেদনার স্বপ্নের আকাশের
এক একেকটি ছোট টুকরো
আমার হাতে তুলে দাও, কেননা
তোমরা তোমাদের আশা ও হতাশার মাঝে
এক উজ্জ্বল রৌদ্রস্নাত সকালের স্বপ্ন দেখ।
(Street/ইতিহাসের পথে)
নেপালি ভাষায় অভি সুবেদীর কবিতা আমি পড়িনি। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদ বা সরাসরি ইংরেজিতে লেখা তাঁর কবিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রূপক, উপমা আশ্রয়ী মনে হয়। প্রচ্ছন্ন ভাষার অন্তরালে জীবনের কথা কবিতার ভাষায় বিকশিত করেন এবং সেখানে কবিতার অবয়ব গঠন, প্রকাশের উপর শ্যেন দৃষ্টি রেখেই তিনি অনবরত বলতে থাকেন জীবনের কথা, মানুষের কথা, যুদ্ধের কথা, অধিকার আদায়ের কথা, উজ্জ্বল স্বপ্নের কথা, কবিতার কথা।
সেই রাতে চাঁদের তীব্র আলোর আঘাতে
বাঁশপাতা কেঁপে উঠেছিল,
যে রাতে আমার মা
তার ওড়নার আড়ালে
আমার জন্মের গন্ধমাখা খাবার নিয়ে যাচ্ছিল
একজন মানুষের জন্য,
যাকে দীর্ঘদিন জেলে অন্তরীণ রাখবে বলে
খুঁজছিল হায়না পুলিশ
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের অপরাধে।
(Mother/মা)
বস্তুত অভি সুবেদীর কবিতা বাংলায় রূপান্তরের পর কবিতার বাধন ও মর্মার্থ অনেকটা সহজবোধ্য মনে হলেও বস্তুত তাঁর কবিতাসমূহের মর্মার্থ উদ্ধার করতে হলে, কবিতার ভিতরে প্রবেশ করতে হলে তা বার বার পাঠ করতে হয়। বার বার কবিতা পাঠে সহজাত হওয়ার পর অভি সুবেদীর কবিতার গভীরতা ও রচনাশৈলীর নান্দনিকতা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়।
কবি অভি সুবেদী যে একজন বহুমাত্রিক সাহিত্যিক তা আগেই বলেছি। তিনি প্রায় বিরতিহীনভাবে অনুবাদ করে চলেছেন নেপালী কবিতা। তিনি সর্বপ্রথম নেপালি মহাকবি, নেপালের আধুনিক কবিতা ও অনুবাদের পথ প্রদর্শক লক্ষী প্রসাদ দেবকোটার একজন পরম ভক্ত। ইংরেজিতে লেখা ‘মনু ও মদন’ মহাকাব্য রচনা থেকে শুরু করে নেপালের কবিতাকে সমকালীন পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া এবং অনুবাদ ও সরাসরি ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তরণের জন্য কঠিন অধ্যাবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন মহাকবি লক্ষী প্রসাদ দেবকোটা। ইংরেজিতে অনূদিত নেপালি কবিতা বিশ্ব মঞ্চে পৌঁছে দেয়ার নিরন্তর চেষ্টায় নিয়োজিত কবি অভি সুবেদী। ২০২০ সালে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’-এর উৎসবে কবি তুলসী দিবসের সাথে সরাসরি আলোচনায় তিনি একথাই আমাকে জানিয়েছিলেন যে, অভি সুবেদী আজকাল প্রায় অনবরতই তাঁর কবিতা অনুবাদ করছেন। কিন্তু বাংলার কবিতা বাংলাদেশের কবিতা বিশ্বমানে পৌছে দেয়ার প্রচেষ্টা কোথায়? যৎসমান্য কাজ হচ্ছে, তা কবিতার বিশ্ব মঞ্চের দরজায় কড়া নাড়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
অভি সুবেদী সমকালীন নেপালি কবিতার (১৯৯৪) আলোচনাসহ নেপালের কবিতা সম্পাদনা করেন ‘পঁচিশ বছরের নেপালি’ কবিতা নামক গ্রন্থে। কবিতা অনুবাদের কথা ইতিমধ্যে বলেছি। কবি লক্ষী প্রসাদ দেবকোটা এবং তুলসী দিবসসহ তিনি অনেক নেপালি কবির কবিতারই ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্ব কবিতার মঞ্চে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘হাইকু এবং টঙ্কা’ নামের বিশেষ ধরনের আধুনিক জাপানী কবিতা (১৯৮৭) তিনি নেপালি ভাষায় রচনা এবং অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘শতাব্দীর কবিতা’ নামক কাব্যগ্রন্থে।
কবিতা এবং কাব্য সমালোচনার পর অভি সুবেদী সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন নাটক লেখায়। নাটকের গ্রন্থ দশটিরও বেশি। এর মধ্যে ইংরেজি ভাষাতেও তিনি নাটক লিখেছেন। নেপালের উচ্চ স্তরের নাট্যকর্মীবৃন্দ মঞ্চস্থ করেছেন তাঁর বিভিন্ন নাটক। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি অনেক নাট্য-সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, তা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে।
চব্বিশটিরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা কবি অভি সুবেদী। বহুমাত্রিক অভি সুবেদী নেপালে কবিতা এবং সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমোচনীয় নাম। বিশেষ করে বিশ্ব সাহিত্যের মঞ্চে নেপালের কবিতা পরিচয় করিয়ে দেয়ার তাঁর নিরন্তর অধ্যবসায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুনীর সিরাজ
বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১
ব্যক্তিগতভাবে আমি যে ক’জন নেপালী কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদকের সাথে পরিচিত তাঁরা স্বনামখ্যাত কবি তুলসী দিবস; কবি প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক অভি সুবেদী; নেপালের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহাকবি লক্ষী প্রসাদ দেবকোটার পুত্র পদ্ম প্রসাদ দেবকোটা এবং নেপালে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী কবি ঔপন্যাসিক মণি দিক্সিত। তবে নেপালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে দু’জন কবি-সাহিত্যক সমধিক পরিচিত- তাঁরা হচ্ছেন কবি তুলসী দিবস এবং কবি অভি সুবেদী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে জড়িত থাকার কারণে বেশ কয়েকবার নেপালে যাতায়াতের কারণে নেপালি সাহিত্যচর্চার ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরে ওঠার সুযোগ হয়েছে আমার। নেপালি কবিতা ও সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু প্রবন্ধ ও অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়।
এ নিবন্ধটি বহুমাত্রিক কবি অভি সুবেদী সম্বন্ধে। তিনি পূর্ব নেপালের তেরাঙ্গুম জেলার সাবা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবি অভি সুবেদী ইংরেজি ভাষার ছাত্র এবং অধ্যাপক। তবে অভি সুবেদী দেব নাগরি ভাষায় লিখিত নেপালি বর্ণ শেখার আগে পরিচিত হয়েছিলেন বাংলা অক্ষর ও শব্দের সঙ্গে। কারণ তাঁর মা বাংলা জানতেন এবং বাংলা ভাষাতেই তিনি কাশিরাম দাসের মহাভারত পাঠ করেছিলেন। তাই বাংলায় অনূদিত কবিতা পাঠ করে অভি সুবেদী যে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম যখন তিনি তা উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করেছিলেন বলে স্বয়ং আমাকে জানিয়েছিলেন। কবি অভি সুবেদীর সাথে এই সংযোগ আনন্দদায়ক। অভি সুবেদী ‘কবিতায় বাস্তবাবাদ’ (Pragmatics of Poetry) বিষয়ে সজাগ এবং সচেতন। কীর্তিপুরে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যের রচনাশৈলী (Stylistic) এবং ভাষাতত্ত্ব (Linguistic) বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মূলত সাহিত্যের রচনাশৈলী সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ইংরেজি বিভাগে তিনি বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এবং এ বিভাগে চল্লিশ বছর অধ্যাপনা করেন।
কবি অভি সুবেদী ‘নেপালের লোককাব্য’ প্রতিষ্ঠানের (Nepali Folklore Society) সহ-সভাপতি। ‘আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট’-এর (UNESCO) তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন (২০০০-২০০৮)। তিনি ‘আন্তর্জাতিক নাটক লেখক সংগঠন’-এর (International play Wrights Forum) সদস্য ছিলেন (২০০০-২০১১)। তিনি নেপালের ‘ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক সংগঠন’-এর (Linguistic Society of Nepal) সভাপতি (১৯৯০-১৯৯২) ও মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘নেপালি সাহিত্য পরিষদ’-এর (Literary Association of Nepal) সভাপতি ছিলেন এবং ‘আন্তর্জাতিক নাটক সমালোচক সংগঠন’-এর (International Association of Theater Critics) সদস্য ছিলেন।
সাহিত্য চর্চা ও কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে নেপালের সার্বিক কাব্য-সাহিত্য চর্চার সাথে কবি অভি সুবেদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রচুর লেখায় অভ্যস্ত অভি সুবেদী কবিতা, নাটক, প্রবন্ধে স্বাধীনতা, মুক্তি, সংস্কৃতি, চিত্রশিল্প এবং সমাজ বাস্তবতার বিষয়সমূহ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। প্রগতি চেতনার ধারাবাহিকতা তার লেখার মূল উপজীব্য বিষয়। এমনই এক উচ্চারণ খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর ‘যে মানুষকে ভুলেছে সবাই’ (The Man They All Forget) কবিতায়।
রাজা এবং নেতার চলার পথের পাশে
অন্তরের দীনতায় ক্ষুদ্র ঘাসের মতো অস্তিত্ব আমার।
সময়ের বাহন নিরন্তর ছোটে সেই পথে,
শক্তিমানের স্বপ্ন-প্রসারিত পথের পাশে
আমি বাড়তে পারি না।
দেশের মুখচ্ছবিতে দেখতে পাই
রক্তরঙ ব্যারাক পাহারাদার এবং সিংহ দরবার।
রাজার প্রাসাদ আর শক্তিমানের দম্ভের কাছে একজন সাধারণ মানুষ অতি তুচ্ছ বটে। সেই অনুভূতি কবির। কিন্তু পাহারাদার দ্বারা সুরক্ষিত হলেও কবি সংঘাত এবং বিজয়ের রক্তরঙ দেখতে পান। তেমনি রাজতন্ত্র, আমলাতস্ত্র এবং সুবিধাভোগী রাজনীতিকের তথাকথিত গণতন্ত্রের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা ছিন্ন করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন কবি, রূপকের ভাষায়। মানুষের জীবনের সমস্ত স্বপ্নগুলো নিয়ে সমস্ত সুবিধাভোগীদের উৎপাটিত করে জনগণকে উজ্জ্বল মহিমায় পৌঁছে দিতে চান কবি।
তোমরা তোমাদের
কল্পনার বেদনার স্বপ্নের আকাশের
এক একেকটি ছোট টুকরো
আমার হাতে তুলে দাও, কেননা
তোমরা তোমাদের আশা ও হতাশার মাঝে
এক উজ্জ্বল রৌদ্রস্নাত সকালের স্বপ্ন দেখ।
(Street/ইতিহাসের পথে)
নেপালি ভাষায় অভি সুবেদীর কবিতা আমি পড়িনি। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদ বা সরাসরি ইংরেজিতে লেখা তাঁর কবিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রূপক, উপমা আশ্রয়ী মনে হয়। প্রচ্ছন্ন ভাষার অন্তরালে জীবনের কথা কবিতার ভাষায় বিকশিত করেন এবং সেখানে কবিতার অবয়ব গঠন, প্রকাশের উপর শ্যেন দৃষ্টি রেখেই তিনি অনবরত বলতে থাকেন জীবনের কথা, মানুষের কথা, যুদ্ধের কথা, অধিকার আদায়ের কথা, উজ্জ্বল স্বপ্নের কথা, কবিতার কথা।
সেই রাতে চাঁদের তীব্র আলোর আঘাতে
বাঁশপাতা কেঁপে উঠেছিল,
যে রাতে আমার মা
তার ওড়নার আড়ালে
আমার জন্মের গন্ধমাখা খাবার নিয়ে যাচ্ছিল
একজন মানুষের জন্য,
যাকে দীর্ঘদিন জেলে অন্তরীণ রাখবে বলে
খুঁজছিল হায়না পুলিশ
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের অপরাধে।
(Mother/মা)
বস্তুত অভি সুবেদীর কবিতা বাংলায় রূপান্তরের পর কবিতার বাধন ও মর্মার্থ অনেকটা সহজবোধ্য মনে হলেও বস্তুত তাঁর কবিতাসমূহের মর্মার্থ উদ্ধার করতে হলে, কবিতার ভিতরে প্রবেশ করতে হলে তা বার বার পাঠ করতে হয়। বার বার কবিতা পাঠে সহজাত হওয়ার পর অভি সুবেদীর কবিতার গভীরতা ও রচনাশৈলীর নান্দনিকতা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়।
কবি অভি সুবেদী যে একজন বহুমাত্রিক সাহিত্যিক তা আগেই বলেছি। তিনি প্রায় বিরতিহীনভাবে অনুবাদ করে চলেছেন নেপালী কবিতা। তিনি সর্বপ্রথম নেপালি মহাকবি, নেপালের আধুনিক কবিতা ও অনুবাদের পথ প্রদর্শক লক্ষী প্রসাদ দেবকোটার একজন পরম ভক্ত। ইংরেজিতে লেখা ‘মনু ও মদন’ মহাকাব্য রচনা থেকে শুরু করে নেপালের কবিতাকে সমকালীন পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া এবং অনুবাদ ও সরাসরি ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তরণের জন্য কঠিন অধ্যাবসায়ে নিয়োজিত ছিলেন মহাকবি লক্ষী প্রসাদ দেবকোটা। ইংরেজিতে অনূদিত নেপালি কবিতা বিশ্ব মঞ্চে পৌঁছে দেয়ার নিরন্তর চেষ্টায় নিয়োজিত কবি অভি সুবেদী। ২০২০ সালে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’-এর উৎসবে কবি তুলসী দিবসের সাথে সরাসরি আলোচনায় তিনি একথাই আমাকে জানিয়েছিলেন যে, অভি সুবেদী আজকাল প্রায় অনবরতই তাঁর কবিতা অনুবাদ করছেন। কিন্তু বাংলার কবিতা বাংলাদেশের কবিতা বিশ্বমানে পৌছে দেয়ার প্রচেষ্টা কোথায়? যৎসমান্য কাজ হচ্ছে, তা কবিতার বিশ্ব মঞ্চের দরজায় কড়া নাড়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
অভি সুবেদী সমকালীন নেপালি কবিতার (১৯৯৪) আলোচনাসহ নেপালের কবিতা সম্পাদনা করেন ‘পঁচিশ বছরের নেপালি’ কবিতা নামক গ্রন্থে। কবিতা অনুবাদের কথা ইতিমধ্যে বলেছি। কবি লক্ষী প্রসাদ দেবকোটা এবং তুলসী দিবসসহ তিনি অনেক নেপালি কবির কবিতারই ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্ব কবিতার মঞ্চে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘হাইকু এবং টঙ্কা’ নামের বিশেষ ধরনের আধুনিক জাপানী কবিতা (১৯৮৭) তিনি নেপালি ভাষায় রচনা এবং অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘শতাব্দীর কবিতা’ নামক কাব্যগ্রন্থে।
কবিতা এবং কাব্য সমালোচনার পর অভি সুবেদী সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন নাটক লেখায়। নাটকের গ্রন্থ দশটিরও বেশি। এর মধ্যে ইংরেজি ভাষাতেও তিনি নাটক লিখেছেন। নেপালের উচ্চ স্তরের নাট্যকর্মীবৃন্দ মঞ্চস্থ করেছেন তাঁর বিভিন্ন নাটক। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি অনেক নাট্য-সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, তা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে।
চব্বিশটিরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা কবি অভি সুবেদী। বহুমাত্রিক অভি সুবেদী নেপালে কবিতা এবং সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমোচনীয় নাম। বিশেষ করে বিশ্ব সাহিত্যের মঞ্চে নেপালের কবিতা পরিচয় করিয়ে দেয়ার তাঁর নিরন্তর অধ্যবসায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।