alt

সাময়িকী

অরণ্যের স্বপ্ন

আবদুল লতিফ

: বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১

সুন্দরবনের জলাশয় থেকে উঠে আসছে কুমির

আবার সুন্দরবন? মৃদু আপত্তি কারো কারো কণ্ঠে। বিশেষত শিরিনের কণ্ঠে জোরালো আপত্তি। শিরিন আমার অত্যন্ত স্নেভাজন, যে যাই বলুক না কেন ওর মতামতের মূল্য দিতেই হয়। বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করানো গেল। আমাদের ছোট দেশে উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ এলাকা কম। তাছাড়া আমাদের অফিসের বিরাট দল নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া চলে না। দেখতে হবে যেখানে যাবো সেখানে সবাইকে একসাথে থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। তবে এটাও ঠিক যে প্রতি বছর যদি নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া যায় তবে তার আনন্দ অন্যরকম। যাহোক, শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ওপর ভিত্তি করে এবছর সুন্দরবন বাৎসরিক বিনোদনের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হলো।

আমি নিজে এর আগে আরো দুবার ঘুরে এসেছি। তবু আরো একবার যেতে আপত্তি নেই। সুন্দর যে কোনো কিছু চিরদিনের জন্য আনন্দের খোরাক জুগিয়ে চলে, তাই তারা কখনো পুরোনো হয় না। যে সূর্য চন্দ্র তারকারাজিকে দেখে আমাদের জীবনের শুরু তারা কি কখনো দিনের সাথে সাথে পুরোনো হয়ে যায়? আর সুন্দরবন তো চিরদিনই সৌন্দর্যের আধার। ওখানকার সবুজ বিচিত্র বনানীর হাতছানি, ¯্রােতস্বিনীর মৃদুমন্দ গতি, উদার আকাশটাকে হাত বাড়িয়ে পাওয়া, জীববৈচিত্র্য সব মিলিয়ে সুন্দরবন এক আশ্চর্য সৌন্দর্যের রানী, বাংলাদেশের গর্ব।

ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে অফিসের কাজকর্ম একটু গুছিয়ে নিয়ে সবাইকে একসাথে জড়ো করে যখন যাত্রা শুরু হলো তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর তিনটে পেরিয়ে গেছে। বিলাসবহুল চারটা বাসে অফিসের প্রায় প্রত্যেক সদস্য তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। সংখ্যায় আমরা ১১৫ জন। দেরি করে বেরোনোর খেসারত দিতে হলো। আমরা যখন খুলনার লঞ্চঘাটে গিয়ে পৌঁছেছি তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়ে সবাই খুব ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। আমাদের সাথে অনেক শিশুও আছে। একসাথে সবাইকে এক লঞ্চে জায়গা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না ফলে আমাদের সবাইকে দুটো পৃথক লঞ্চে স্থান করে নিতে হচ্ছে। শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ছোট নৌকায় করে আমরা যে যার লঞ্চে উঠে গেলাম। যে লঞ্চটায় আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল তার নাম ‘বনসাথী’। এখানেই আমাদের তিন রাত্রিযাপন করতে হবে। প্রথমেই ডেকের ওপর টেবিলে রাতের আহার সারা হলো। এখন ক্লান্ত দেহটাকে বিশ্রাম দিতে হবে।

মাত্র একদিন আগে পূর্ণিমা ছিল। আজকেও সেই চাঁদের ভরা যৌবন, মেঘের মাঝে লুকোচুরি খেলছে, আর নদীর ওপর থেকে আসা হিমেল বাতাস পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে দেহে মনে। এমন পরিবেশে নিজের মনটাকে বশে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ডেকের আলো আঁধারির এক কোণে লায়লার কাঁধে হাত রেখে একটা হিন্দি গানের কলি বলতে চেষ্টা করলাম, ‘তুঝে ম্যাঁয় চাঁদ কাহতা থা মগর উসমে ভি দাগ হ্যায়’। লায়লা ক্ষেপে উঠলো রাত দুপুরে বখাটে ছোকরাদের মতো হিন্দি গান নিয়ে ইয়ার্কি? রবিঠাকুরের দেশে বাংলার কি এতই আকাল পড়েছে? আরও কিছু বলতে পারতাম কিন্তু তার আগেই ও বললো আমি কেবিনে চললাম, কাল সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে তো, নাকি ডেকে বসে চাঁদের প্রেমে পড়ে থাকলেই চলবে। সত্যিই তো ফেমাস টুরের লিডার রুবেল আমাকে বলে রেখেছে, যদি পারেন কাল ভোরে ডেকে চলে আসবেন, আপনার ভালো লাগবে।

যদিও অনেক রাতে শয্যাগ্রহণ করেছি তবু ঠিক ভোরে ঘুম ভাঙলো। লায়লার সাথে ডেকে এসে রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে যে সূর্যটাকে দেখতে পেলাম তার রক্তিম আভা খণ্ড খণ্ড মেঘের মাঝখানে পড়ে বেশ ম্রিয়মাণ। সে আলোয় স্নিগ্ধতা আছে, কিন্তু অতিভাস্বর হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারছে না। মেঘ আকাশ নদী মিলিয়ে সেও এক অপূর্ব শোভা।

আমাদের নৌযান এগিয়ে চলেছে নদীর ওপর দিয়ে। ভেসে চলেছি, আর আকাশ এবং দুই পাড়ের অরণ্যের ছবি এঁকে নিচ্ছি মনের ক্যামেরায়। মনে পড়লো রবি ঠাকুরের একটা কথা। “ভেসে চলার মধ্যে দু’ধরনের বিরোধের সামঞ্জস্য হয়, বসেও আছি, চলছিও। সেই জন্যে চলার কাজ হচ্ছে, অথচ চলার কাজে মনকে লাগাতে হচ্ছে না। তাই মন সামনে যা দেখছে তাকে পূর্ণ করে দেখছে। জল স্থল আকাশের সবকিছু মিলিয়ে দেখতে পাচ্ছে।”

নদীপাড়ের সবুজ বনানী নৌযানের গতির সাথে সাথে এগিয়ে চলেছে। নদীর তরঙ্গ, ওপারে সবুজ শ্যামল ধরা আর মাথার ওপর নীল আকাশ, অপূর্ব সমন্বয়। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলের এই প্রশস্ত বনভূমি সারা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। গঙ্গা, মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১৯৯৭ সনের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেছে।

এরই মধ্যে প্রাতঃরাশ সারা হয়ে গিয়েছিলো এখন মধ্যাহ্নভোজ। ডেকের ওপর সারি সারি টেবিলের ওপর তৃপ্তিসহকারে ভূরিভোজ সাঙ্গ হলো। একটু পরে আমরা ‘বনসাথী’ থেকে নেমে কটকা বীচের উদ্দেশ্যে যাবো। মাঝনদীতে লঞ্চ নোঙর করে থাকে, সেখান থেকে একটা ছোট ট্রলারে গাদাগাদি করে বসে কিছুদূরে অবস্থিত একটা ছোট কাঠের জেটিতে নামতে হয়। তারপর পায়ে হেঁটে প্রায় তিন কিলোমিটার কটকা অভয়ারণ্যের ঘন সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়ার বন পেরিয়ে জামতলা সমুদ্র সৈকত। এই পথটা অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরীর সাথে সারিবদ্ধভাবে যেতে হয়। এই অঞ্চলে মাঝে মাঝে সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মেলে। যদিও আমরা কখনও তার দেখা পাইনি আর সম্ভবত সে অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হবে না তাই পায়ে হাঁটার পথটুকু আমরা পথের ধারের ঘন অরণ্যের শোভা দেখেই তৃপ্ত থাকি। কত রকমের গাছপালা নাম না জানা ফুলফলে ভর্তি জঙ্গল। মাঝে মাঝে গভীর অরণ্যের ভেতর থেকে চিত্রা হরিণের উঁকি মারা এবং চকিতে মিলিয়ে যাওয়া। দু’একটা পাখির ডাকও কানে আসছে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় জঙ্গল পার হয়ে এসে পড়েছি একটা ফাঁকা জায়গায় সমুদ্রতীরে। এটাই কটকা সমুদ্র সৈকত, যদিও এই বিশেষ এলাকাটা জামতলা সমুদ্রসৈকত নামে খ্যাত। সমুদ্র দেখলেই আমাদের মন ছুটে চলে ঢেউয়ের ওপর দিয়ে হাঁটতে, লুটোপুটি খেয়ে স্নান করতে কিন্তু জামতলা বা কটকা সমুদ্রসৈকত হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্র সৈকত। এই সৈকতে ঢেউয়ের আকার অত্যন্ত পরিবর্তনশীল এবং অজ্ঞাত চোরাবালিতে পরিপূর্ণ। এর আগের বার যখন এসেছি তখন তীরে একটা বোর্ডে বেশ কয়েকজনের সলিলসমাধির কথা উল্লেখ করে সতর্কতাবাণী টাঙানো ছিল। এখানে তাই নামা বা স্নান করার প্রশ্নই ওঠে না।

এখন ভাটার সময়, সমুদ্রের জল সরে গেছে দূরে। বেলাভূমি জুড়ে পলিমাটির স্তূপ, কিছু ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড় জেগে আছে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়তে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম।

বনসাথীতে রাত্রি নামলো। ডেকের ওপর সারি সারি টেবিল চেয়ারে রাত্রিকালীন আহার। চমৎকার ব্যবস্থা। পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে সংকেত পেলাম। তবু মাঝরাতের আকাশটাকে আর একবার ভালো করে দেখবার জন্যে ¯িœগ্ধশীতল বাতাস গায়ে মেখে বেশ কিছুক্ষণ ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। আকাশে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, অঝর ধারায় জ্যোৎ¯œার আলো ঝরে পড়ছে।

সকাল হতে না হতেই উঠে পড়েছি ট্রলার নৌকায়, এবার গন্তব্যস্থল শরনখোলা রেঞ্জ। এর আগেরবার যখন এখানে এসেছিলাম তখন এলাকাটাকে দেখেছি গাছপালায় ভরা কিন্তু এবার এর চেহারা দেখলাম একেবারে অন্যরকম। ট্রলার থেকে নেমে ডাঙায় উঠতেই দেখা হলো মারমুখী একদল হনুমানের সঙ্গে। আমরা দলবদ্ধ থাকায় তারা আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছিল না তবু তাদের লম্ফঝম্প দেখে আমরা সতর্ক থাকার চেষ্টা করলাম। এই এলাকার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। আম্ফান ঝড়ের আঘাতে গাছপালা ভেঙে পড়ে আছে চতুর্দিকে। সম্ভবত খাদ্যসঙ্কটের কারণে এখানকার শাখামৃগদের এই অবস্থা।

এরপর হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র। ট্রলার থেকে নামতেই সামনে নামফলক আর তার পাশেই দৃষ্টিনন্দন এক বিরাট পুকুর। থরে থরে শাপলা ফুটে আছে। পুকুরের মাঝখানে একটা ছাউনি দেওয়া বিশ্রামাগার, ডাঙার সাথে ঝুলন্ত কাঠের সেতু দিয়ে বিশ্রামাগারের সংযোগস্থল। অরণ্যের মাঝখান দিয়ে পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখার জন্য আছে এক কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যরে কাঠের ফুট ট্রেইল। সাবধানে দলবেঁধে হেঁটে পুরো অরণ্য এলাকাটাকে পর্যবেক্ষণ করা হলো। এখানকার প্রবেশপথে যে শাখামৃগদের দেখা পেয়েছিলাম তারা একান্তই নিরীহ। আমাদের দলের লোকজন তাদের দিকে দু’একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছুঁড়ে দিতেই তারা সেগুলো নিয়ে প্যাকেট খুলে তার সদ্বব্যবহার করলো। আবার ওদিকে কাদার ওপর পড়ে যাওয়া বিস্কুটগুলোকে মাটির ওপর জমে থাকা জলে ধুয়ে নিয়ে কুটকুট করে খেতে থাকলো। ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে লায়লা ভারি উৎফুল্ল। আসলে লায়লার স্বভাবটাই ওইরকম। ওর ছেলেমানুষী দেখলে আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে সে প্রৌঢ়ত্বের দুয়ারে ঘা দিয়েছে। ‘আহা রে আগে জানলে ওদের জন্যে কিছু খাবার নিয়ে আসতাম’ ওর আক্ষেপ।

তারপর আমার হাত ধরে আবেগমাখা কণ্ঠে বললো, ‘জানো, ওদের বুদ্ধিমত্তা দেখলে মাঝে মাঝে ডারউইন সাহেবকে মনে পড়ে’।

বললাম, ‘ডারউইন সাহেবকে তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একসময় বহু দ্বিপদী প্রাণির পদচারণায় মুখর ছিল আমাদের এই পৃথিবী। তারপর লুসির কথা মনে করো।’

‘লুসি!’ ওর কণ্ঠে বিস্ময়।

‘লুসি নামটা শুনে অত আহ্লাদিত হোয়ো না। সে তোমার মতো কোনো সুন্দরী মহিলা না। বিজ্ঞানীরা ৩২ লক্ষ বছরের পুরোনো ফসিল ঘেঁটে তাকে আবিষ্কার করেন। লুসির মধ্যে মানুষ এবং বনমানুষ উভয়ের বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল।’

‘থাক এমন চমৎকার পরিবেশে ডারউইনের জটিল তত্ত্ব টেনে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।’

‘প্রসঙ্গটা কিন্তু তুমিই শুরু করেছিলে।’

দাম্পত্য তর্কাতর্কি শেষ করে আমরা ট্রলারে গিয়ে উঠি।

দুপুরে মধ্যাহ্নভোজন শেষ হতে না হতেই বনসাথী যাত্রা শুরু করেছে। এবার নদী ছেড়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে দিয়ে। তাকিয়ে আছি অসীম সাগরের দিকে। কূলকিনারা কিছু নেই শুধু তরঙ্গরাশি, ‘হেরো সাগর ওঠে তরঙ্গিয়া’। সাগরের অনেক রূপ। কখনো শান্ত ¯িœগ্ধরূপে আবার কখনো অশান্ত ভয়ঙ্কররূপে তাকে দেখা যায়। আজ সাগরের বড় ¯িœগ্ধরূপ, ছোট ছোট ঢেউ ঝিকমিক করে উঠছে সূর্যের আলোয়। ডেকের ওপর পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে প্রশান্ত বাতাস, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, মলয়জশীতলাং, মাতরম।

আমাদের গন্তব্য প্রকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোমুগ্ধকর এক স্থান, ‘হিরণ পয়েন্ট’। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হিরণ পয়েন্ট সুন্দরবনের দক্ষিণের একটি অভয়ারণ্য। হিরণপয়েন্টের আর এক নাম নীলকমল। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি অভয়ারণ্য। কাছে পৌঁছবার সময় দেখলাম নদীর ওপর নৌবাহিনীর কিছু যুদ্ধজাহাজ। এই এলাকাটি নৌবাহিনীর অধীনে। অরণ্য এলাকায় পৌঁছতেই কাঠের একটি গেট আমাদের স্বাগত জানালো। কাঠের ট্রেইল ধরে অরণ্য পরিক্রমা শুরু হলো। সবুজ বনানীর ভেতর দিয়ে হাঁটছি, মাঝে মাঝে নাম না জানা পাখির ডাক, পাতার আড়ালে চিত্রা হরিণের চকিৎ পদচারণা। এরই মধ্যে দেখলাম এক প্রৌঢ় ভ্রমনকারী টেলিস্কোপ লেন্স ক্যামেরা চোখে দিয়ে গভীর অরণ্যের দিকে, বড় বড় সুন্দরী গাছের মাঝখানে কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। একটু আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছিলো কিন্তু তার ধ্যানগম্ভীর মূর্তি দেখে কথা বলার সাহস হলো না। ট্রেইল ধরে হেঁটে চলেছি মাঝে মাঝে কিছু খোলামেলা জায়গা, উপরের দিকে চোখা হয়ে জেগে আছে অজস্র শ্বাসমূল। দৌড়ে বেড়াচ্ছে শাখামৃগের দল। পথে একটা ছাউনির মধ্যে বসার জায়গা। সবকিছু পার হয়ে একটি সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। সিঁড়ি বেয়ে ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে উঠে নয়ন সার্থক হয়ে গেল চারিদিকের অপরূপ সবুজ অরণ্যের রূপরাশি দেখে। ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় রসিক মধুকরের রসের ভাণ্ডার। ওরা এখানে একটি মৌচাক তৈরি করেছে। বেশ কিছুক্ষণ এই টাওয়ার থেকে অরণ্য পর্যবেক্ষণ করে নেমে আসলাম। নিচে একটু দূরে একটি জলাশয়। এই জলাশয় এখান থেকে বনের ভেতরের দিকে চলে গিয়েছে। জলাশয়ের ভেতর তাকিয়ে দেখি একটু দূরে ভেসে আছে একসাথে চারটি কুমির। রেলিংয়ের নিচে ভিজে মাটিতে ছোটাছুটি করছে অজ¯্র লাল কাঁকড়ার দল।

হিরণ পয়েন্ট ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এসেছি নৌযানে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পশুর নদীতীরে অবস্থিত করমজল পর্যটন কেন্দ্র। এখানে আছে হরিণ, কুমির আর রেসাস বানরসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। করমজল বাংলাদেশের একমাত্র প্রকৃতিক কুমির প্রজনন কেন্দ্র। বোট থেকে নামতেই সামনে চোখে পড়লো বৃহৎ আকারের একটি ম্যাপ, সমগ্র সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলকে এখানে চিহ্নিত করা হয়েছে। চোখে পড়লো খোলা জায়গায় বানরের বাড়াবাড়ি অর্থৎি বাঁদরামো। বড় একটা এলাকাজুড়ে আছে হরিণের আবাসস্থল। ওদের কাছে খাবার ধরলে ওরা হাত থেকে খাবার নিয়ে চর্বিতচর্বণ করে। বন্ধুসুলভ কৃতজ্ঞতা ওদের মায়াবী হরিণচোখে।

দেখা হলো প্রেমিকযুগল রোমিও জুলিয়েটের সাথে। করমজলে ওরা কুমির আর স্ত্রী-কুমিরের রূপে অবতীর্ণ হয়েছে। রোমিও বিরাট বড় এক হাঁ করে নট নড়নচড়ন হয়ে রোদ পোহাচ্ছে আর প্রেমিকা জুলিয়েটও অনতিদূরে অপেক্ষা করে আছে দ্বৈত মিলনের আশায়। বড় মধুর এক দৃশ্য।

রোমিও জুলিয়েট করমজলের আতিথ্য গ্রহণ করে ২০০২ সালে। ২০০৫ সালে প্রজননক্ষম হওয়ার পর আজ পর্যন্ত জুলিয়েট তার ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে তার সাথীকে উপহার দিয়েছে প্রায় পাঁচশ’র কাছাকাছি ডিম। তা থেকে বনবিভাগের কর্মীরা তাদের প্রজননেেকন্দ্রে ফুটিয়েছেন প্রায় তিনশ’ শিশুকুমির।

সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে আসছে। এখানকার নদীর ডলফিনেরাও হুমকির মুখোমুখি। করমজলের একটি সাজানো কক্ষে এই সতর্কবাণীটি চোখে পড়লো-

“মিষ্টি পানির ডলফিনকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা ভীষণ প্রয়োজন। সম্প্রতি চীনের ইয়াংজি নদীর ডলফিন বাইজির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটি দুঃখজনক ঘটনা। মানব ইতিহাসে বাইজি প্রথম জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের মিষ্টি পানির ডলফিনরা বাইজির মতো একই রকম বিপদের সম্মুখীন এবং এদেরকে ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের সাহায্য করা প্রয়োজন।”

বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা সফল হোক।

এই পর্যায়ে আমাদের শেষ ভ্রমণস্থল দুবলার চর। এই চর অঞ্চলটি একটি দ্বীপ। অঞ্চলটি বিশুদ্ধ শুটকি মাছের রাজ্য বলে খ্যাত। স্থানটি হিন্দু ধর্মের পবিত্র পুণ্য¯œান, রাসমেলার জন্যও বিখ্যাত। দুবলার চরে পড়ন্ত বেলায় গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে অনুষ্ঠিত হলো যাত্রীদের সকলের অংশগ্রহণে এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।

রাতে লঞ্চে ফিরে এল সবাই। যাত্রাশেষে এবার আমাদের ফিরে যাওয়ার পালা। পরদিন দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের পর শুরু হলো র‌্যাফেল ড্র। ভাগ্যবানেরা জিতে নিল নানা রকম পুরস্কার। রাতের বেলা লঞ্চ ভিড়লো খুলনার ঘাটে। সেখান থেকে রেল স্টেশন। ট্রেনের কামরায় আসন গ্রহণ পর যাত্রা শুরু হলো রাজধানীর উদ্দেশ্যে।

রাতের আঁধার ভেঙে ট্রেন ছুটে চলেছে রাজধানীর দিকে, সেই কর্মস্থলে। ট্রেনের দোলায় দুলতে দুলতে ঘুম ঘুম চোখে ভেসে উঠছে সবুজ শ্যামলে ঘেরা এক অপরূপ অরণ্যের স্বপ্ন।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

অরণ্যের স্বপ্ন

আবদুল লতিফ

সুন্দরবনের জলাশয় থেকে উঠে আসছে কুমির

বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১

আবার সুন্দরবন? মৃদু আপত্তি কারো কারো কণ্ঠে। বিশেষত শিরিনের কণ্ঠে জোরালো আপত্তি। শিরিন আমার অত্যন্ত স্নেভাজন, যে যাই বলুক না কেন ওর মতামতের মূল্য দিতেই হয়। বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করানো গেল। আমাদের ছোট দেশে উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ এলাকা কম। তাছাড়া আমাদের অফিসের বিরাট দল নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া চলে না। দেখতে হবে যেখানে যাবো সেখানে সবাইকে একসাথে থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। তবে এটাও ঠিক যে প্রতি বছর যদি নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া যায় তবে তার আনন্দ অন্যরকম। যাহোক, শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ওপর ভিত্তি করে এবছর সুন্দরবন বাৎসরিক বিনোদনের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হলো।

আমি নিজে এর আগে আরো দুবার ঘুরে এসেছি। তবু আরো একবার যেতে আপত্তি নেই। সুন্দর যে কোনো কিছু চিরদিনের জন্য আনন্দের খোরাক জুগিয়ে চলে, তাই তারা কখনো পুরোনো হয় না। যে সূর্য চন্দ্র তারকারাজিকে দেখে আমাদের জীবনের শুরু তারা কি কখনো দিনের সাথে সাথে পুরোনো হয়ে যায়? আর সুন্দরবন তো চিরদিনই সৌন্দর্যের আধার। ওখানকার সবুজ বিচিত্র বনানীর হাতছানি, ¯্রােতস্বিনীর মৃদুমন্দ গতি, উদার আকাশটাকে হাত বাড়িয়ে পাওয়া, জীববৈচিত্র্য সব মিলিয়ে সুন্দরবন এক আশ্চর্য সৌন্দর্যের রানী, বাংলাদেশের গর্ব।

ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে অফিসের কাজকর্ম একটু গুছিয়ে নিয়ে সবাইকে একসাথে জড়ো করে যখন যাত্রা শুরু হলো তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর তিনটে পেরিয়ে গেছে। বিলাসবহুল চারটা বাসে অফিসের প্রায় প্রত্যেক সদস্য তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। সংখ্যায় আমরা ১১৫ জন। দেরি করে বেরোনোর খেসারত দিতে হলো। আমরা যখন খুলনার লঞ্চঘাটে গিয়ে পৌঁছেছি তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়ে সবাই খুব ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। আমাদের সাথে অনেক শিশুও আছে। একসাথে সবাইকে এক লঞ্চে জায়গা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না ফলে আমাদের সবাইকে দুটো পৃথক লঞ্চে স্থান করে নিতে হচ্ছে। শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ছোট নৌকায় করে আমরা যে যার লঞ্চে উঠে গেলাম। যে লঞ্চটায় আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল তার নাম ‘বনসাথী’। এখানেই আমাদের তিন রাত্রিযাপন করতে হবে। প্রথমেই ডেকের ওপর টেবিলে রাতের আহার সারা হলো। এখন ক্লান্ত দেহটাকে বিশ্রাম দিতে হবে।

মাত্র একদিন আগে পূর্ণিমা ছিল। আজকেও সেই চাঁদের ভরা যৌবন, মেঘের মাঝে লুকোচুরি খেলছে, আর নদীর ওপর থেকে আসা হিমেল বাতাস পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে দেহে মনে। এমন পরিবেশে নিজের মনটাকে বশে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ডেকের আলো আঁধারির এক কোণে লায়লার কাঁধে হাত রেখে একটা হিন্দি গানের কলি বলতে চেষ্টা করলাম, ‘তুঝে ম্যাঁয় চাঁদ কাহতা থা মগর উসমে ভি দাগ হ্যায়’। লায়লা ক্ষেপে উঠলো রাত দুপুরে বখাটে ছোকরাদের মতো হিন্দি গান নিয়ে ইয়ার্কি? রবিঠাকুরের দেশে বাংলার কি এতই আকাল পড়েছে? আরও কিছু বলতে পারতাম কিন্তু তার আগেই ও বললো আমি কেবিনে চললাম, কাল সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে তো, নাকি ডেকে বসে চাঁদের প্রেমে পড়ে থাকলেই চলবে। সত্যিই তো ফেমাস টুরের লিডার রুবেল আমাকে বলে রেখেছে, যদি পারেন কাল ভোরে ডেকে চলে আসবেন, আপনার ভালো লাগবে।

যদিও অনেক রাতে শয্যাগ্রহণ করেছি তবু ঠিক ভোরে ঘুম ভাঙলো। লায়লার সাথে ডেকে এসে রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে যে সূর্যটাকে দেখতে পেলাম তার রক্তিম আভা খণ্ড খণ্ড মেঘের মাঝখানে পড়ে বেশ ম্রিয়মাণ। সে আলোয় স্নিগ্ধতা আছে, কিন্তু অতিভাস্বর হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারছে না। মেঘ আকাশ নদী মিলিয়ে সেও এক অপূর্ব শোভা।

আমাদের নৌযান এগিয়ে চলেছে নদীর ওপর দিয়ে। ভেসে চলেছি, আর আকাশ এবং দুই পাড়ের অরণ্যের ছবি এঁকে নিচ্ছি মনের ক্যামেরায়। মনে পড়লো রবি ঠাকুরের একটা কথা। “ভেসে চলার মধ্যে দু’ধরনের বিরোধের সামঞ্জস্য হয়, বসেও আছি, চলছিও। সেই জন্যে চলার কাজ হচ্ছে, অথচ চলার কাজে মনকে লাগাতে হচ্ছে না। তাই মন সামনে যা দেখছে তাকে পূর্ণ করে দেখছে। জল স্থল আকাশের সবকিছু মিলিয়ে দেখতে পাচ্ছে।”

নদীপাড়ের সবুজ বনানী নৌযানের গতির সাথে সাথে এগিয়ে চলেছে। নদীর তরঙ্গ, ওপারে সবুজ শ্যামল ধরা আর মাথার ওপর নীল আকাশ, অপূর্ব সমন্বয়। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলের এই প্রশস্ত বনভূমি সারা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। গঙ্গা, মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১৯৯৭ সনের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে সুন্দরবন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেছে।

এরই মধ্যে প্রাতঃরাশ সারা হয়ে গিয়েছিলো এখন মধ্যাহ্নভোজ। ডেকের ওপর সারি সারি টেবিলের ওপর তৃপ্তিসহকারে ভূরিভোজ সাঙ্গ হলো। একটু পরে আমরা ‘বনসাথী’ থেকে নেমে কটকা বীচের উদ্দেশ্যে যাবো। মাঝনদীতে লঞ্চ নোঙর করে থাকে, সেখান থেকে একটা ছোট ট্রলারে গাদাগাদি করে বসে কিছুদূরে অবস্থিত একটা ছোট কাঠের জেটিতে নামতে হয়। তারপর পায়ে হেঁটে প্রায় তিন কিলোমিটার কটকা অভয়ারণ্যের ঘন সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়ার বন পেরিয়ে জামতলা সমুদ্র সৈকত। এই পথটা অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরীর সাথে সারিবদ্ধভাবে যেতে হয়। এই অঞ্চলে মাঝে মাঝে সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মেলে। যদিও আমরা কখনও তার দেখা পাইনি আর সম্ভবত সে অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হবে না তাই পায়ে হাঁটার পথটুকু আমরা পথের ধারের ঘন অরণ্যের শোভা দেখেই তৃপ্ত থাকি। কত রকমের গাছপালা নাম না জানা ফুলফলে ভর্তি জঙ্গল। মাঝে মাঝে গভীর অরণ্যের ভেতর থেকে চিত্রা হরিণের উঁকি মারা এবং চকিতে মিলিয়ে যাওয়া। দু’একটা পাখির ডাকও কানে আসছে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় জঙ্গল পার হয়ে এসে পড়েছি একটা ফাঁকা জায়গায় সমুদ্রতীরে। এটাই কটকা সমুদ্র সৈকত, যদিও এই বিশেষ এলাকাটা জামতলা সমুদ্রসৈকত নামে খ্যাত। সমুদ্র দেখলেই আমাদের মন ছুটে চলে ঢেউয়ের ওপর দিয়ে হাঁটতে, লুটোপুটি খেয়ে স্নান করতে কিন্তু জামতলা বা কটকা সমুদ্রসৈকত হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্র সৈকত। এই সৈকতে ঢেউয়ের আকার অত্যন্ত পরিবর্তনশীল এবং অজ্ঞাত চোরাবালিতে পরিপূর্ণ। এর আগের বার যখন এসেছি তখন তীরে একটা বোর্ডে বেশ কয়েকজনের সলিলসমাধির কথা উল্লেখ করে সতর্কতাবাণী টাঙানো ছিল। এখানে তাই নামা বা স্নান করার প্রশ্নই ওঠে না।

এখন ভাটার সময়, সমুদ্রের জল সরে গেছে দূরে। বেলাভূমি জুড়ে পলিমাটির স্তূপ, কিছু ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড় জেগে আছে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়তে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম।

বনসাথীতে রাত্রি নামলো। ডেকের ওপর সারি সারি টেবিল চেয়ারে রাত্রিকালীন আহার। চমৎকার ব্যবস্থা। পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে সংকেত পেলাম। তবু মাঝরাতের আকাশটাকে আর একবার ভালো করে দেখবার জন্যে ¯িœগ্ধশীতল বাতাস গায়ে মেখে বেশ কিছুক্ষণ ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। আকাশে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, অঝর ধারায় জ্যোৎ¯œার আলো ঝরে পড়ছে।

সকাল হতে না হতেই উঠে পড়েছি ট্রলার নৌকায়, এবার গন্তব্যস্থল শরনখোলা রেঞ্জ। এর আগেরবার যখন এখানে এসেছিলাম তখন এলাকাটাকে দেখেছি গাছপালায় ভরা কিন্তু এবার এর চেহারা দেখলাম একেবারে অন্যরকম। ট্রলার থেকে নেমে ডাঙায় উঠতেই দেখা হলো মারমুখী একদল হনুমানের সঙ্গে। আমরা দলবদ্ধ থাকায় তারা আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছিল না তবু তাদের লম্ফঝম্প দেখে আমরা সতর্ক থাকার চেষ্টা করলাম। এই এলাকার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। আম্ফান ঝড়ের আঘাতে গাছপালা ভেঙে পড়ে আছে চতুর্দিকে। সম্ভবত খাদ্যসঙ্কটের কারণে এখানকার শাখামৃগদের এই অবস্থা।

এরপর হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র। ট্রলার থেকে নামতেই সামনে নামফলক আর তার পাশেই দৃষ্টিনন্দন এক বিরাট পুকুর। থরে থরে শাপলা ফুটে আছে। পুকুরের মাঝখানে একটা ছাউনি দেওয়া বিশ্রামাগার, ডাঙার সাথে ঝুলন্ত কাঠের সেতু দিয়ে বিশ্রামাগারের সংযোগস্থল। অরণ্যের মাঝখান দিয়ে পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখার জন্য আছে এক কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যরে কাঠের ফুট ট্রেইল। সাবধানে দলবেঁধে হেঁটে পুরো অরণ্য এলাকাটাকে পর্যবেক্ষণ করা হলো। এখানকার প্রবেশপথে যে শাখামৃগদের দেখা পেয়েছিলাম তারা একান্তই নিরীহ। আমাদের দলের লোকজন তাদের দিকে দু’একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছুঁড়ে দিতেই তারা সেগুলো নিয়ে প্যাকেট খুলে তার সদ্বব্যবহার করলো। আবার ওদিকে কাদার ওপর পড়ে যাওয়া বিস্কুটগুলোকে মাটির ওপর জমে থাকা জলে ধুয়ে নিয়ে কুটকুট করে খেতে থাকলো। ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে লায়লা ভারি উৎফুল্ল। আসলে লায়লার স্বভাবটাই ওইরকম। ওর ছেলেমানুষী দেখলে আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে সে প্রৌঢ়ত্বের দুয়ারে ঘা দিয়েছে। ‘আহা রে আগে জানলে ওদের জন্যে কিছু খাবার নিয়ে আসতাম’ ওর আক্ষেপ।

তারপর আমার হাত ধরে আবেগমাখা কণ্ঠে বললো, ‘জানো, ওদের বুদ্ধিমত্তা দেখলে মাঝে মাঝে ডারউইন সাহেবকে মনে পড়ে’।

বললাম, ‘ডারউইন সাহেবকে তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একসময় বহু দ্বিপদী প্রাণির পদচারণায় মুখর ছিল আমাদের এই পৃথিবী। তারপর লুসির কথা মনে করো।’

‘লুসি!’ ওর কণ্ঠে বিস্ময়।

‘লুসি নামটা শুনে অত আহ্লাদিত হোয়ো না। সে তোমার মতো কোনো সুন্দরী মহিলা না। বিজ্ঞানীরা ৩২ লক্ষ বছরের পুরোনো ফসিল ঘেঁটে তাকে আবিষ্কার করেন। লুসির মধ্যে মানুষ এবং বনমানুষ উভয়ের বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল।’

‘থাক এমন চমৎকার পরিবেশে ডারউইনের জটিল তত্ত্ব টেনে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।’

‘প্রসঙ্গটা কিন্তু তুমিই শুরু করেছিলে।’

দাম্পত্য তর্কাতর্কি শেষ করে আমরা ট্রলারে গিয়ে উঠি।

দুপুরে মধ্যাহ্নভোজন শেষ হতে না হতেই বনসাথী যাত্রা শুরু করেছে। এবার নদী ছেড়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে দিয়ে। তাকিয়ে আছি অসীম সাগরের দিকে। কূলকিনারা কিছু নেই শুধু তরঙ্গরাশি, ‘হেরো সাগর ওঠে তরঙ্গিয়া’। সাগরের অনেক রূপ। কখনো শান্ত ¯িœগ্ধরূপে আবার কখনো অশান্ত ভয়ঙ্কররূপে তাকে দেখা যায়। আজ সাগরের বড় ¯িœগ্ধরূপ, ছোট ছোট ঢেউ ঝিকমিক করে উঠছে সূর্যের আলোয়। ডেকের ওপর পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে প্রশান্ত বাতাস, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, মলয়জশীতলাং, মাতরম।

আমাদের গন্তব্য প্রকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোমুগ্ধকর এক স্থান, ‘হিরণ পয়েন্ট’। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হিরণ পয়েন্ট সুন্দরবনের দক্ষিণের একটি অভয়ারণ্য। হিরণপয়েন্টের আর এক নাম নীলকমল। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি অভয়ারণ্য। কাছে পৌঁছবার সময় দেখলাম নদীর ওপর নৌবাহিনীর কিছু যুদ্ধজাহাজ। এই এলাকাটি নৌবাহিনীর অধীনে। অরণ্য এলাকায় পৌঁছতেই কাঠের একটি গেট আমাদের স্বাগত জানালো। কাঠের ট্রেইল ধরে অরণ্য পরিক্রমা শুরু হলো। সবুজ বনানীর ভেতর দিয়ে হাঁটছি, মাঝে মাঝে নাম না জানা পাখির ডাক, পাতার আড়ালে চিত্রা হরিণের চকিৎ পদচারণা। এরই মধ্যে দেখলাম এক প্রৌঢ় ভ্রমনকারী টেলিস্কোপ লেন্স ক্যামেরা চোখে দিয়ে গভীর অরণ্যের দিকে, বড় বড় সুন্দরী গাছের মাঝখানে কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। একটু আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছিলো কিন্তু তার ধ্যানগম্ভীর মূর্তি দেখে কথা বলার সাহস হলো না। ট্রেইল ধরে হেঁটে চলেছি মাঝে মাঝে কিছু খোলামেলা জায়গা, উপরের দিকে চোখা হয়ে জেগে আছে অজস্র শ্বাসমূল। দৌড়ে বেড়াচ্ছে শাখামৃগের দল। পথে একটা ছাউনির মধ্যে বসার জায়গা। সবকিছু পার হয়ে একটি সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। সিঁড়ি বেয়ে ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে উঠে নয়ন সার্থক হয়ে গেল চারিদিকের অপরূপ সবুজ অরণ্যের রূপরাশি দেখে। ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় রসিক মধুকরের রসের ভাণ্ডার। ওরা এখানে একটি মৌচাক তৈরি করেছে। বেশ কিছুক্ষণ এই টাওয়ার থেকে অরণ্য পর্যবেক্ষণ করে নেমে আসলাম। নিচে একটু দূরে একটি জলাশয়। এই জলাশয় এখান থেকে বনের ভেতরের দিকে চলে গিয়েছে। জলাশয়ের ভেতর তাকিয়ে দেখি একটু দূরে ভেসে আছে একসাথে চারটি কুমির। রেলিংয়ের নিচে ভিজে মাটিতে ছোটাছুটি করছে অজ¯্র লাল কাঁকড়ার দল।

হিরণ পয়েন্ট ভ্রমণ শেষ করে ফিরে এসেছি নৌযানে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পশুর নদীতীরে অবস্থিত করমজল পর্যটন কেন্দ্র। এখানে আছে হরিণ, কুমির আর রেসাস বানরসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। করমজল বাংলাদেশের একমাত্র প্রকৃতিক কুমির প্রজনন কেন্দ্র। বোট থেকে নামতেই সামনে চোখে পড়লো বৃহৎ আকারের একটি ম্যাপ, সমগ্র সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলকে এখানে চিহ্নিত করা হয়েছে। চোখে পড়লো খোলা জায়গায় বানরের বাড়াবাড়ি অর্থৎি বাঁদরামো। বড় একটা এলাকাজুড়ে আছে হরিণের আবাসস্থল। ওদের কাছে খাবার ধরলে ওরা হাত থেকে খাবার নিয়ে চর্বিতচর্বণ করে। বন্ধুসুলভ কৃতজ্ঞতা ওদের মায়াবী হরিণচোখে।

দেখা হলো প্রেমিকযুগল রোমিও জুলিয়েটের সাথে। করমজলে ওরা কুমির আর স্ত্রী-কুমিরের রূপে অবতীর্ণ হয়েছে। রোমিও বিরাট বড় এক হাঁ করে নট নড়নচড়ন হয়ে রোদ পোহাচ্ছে আর প্রেমিকা জুলিয়েটও অনতিদূরে অপেক্ষা করে আছে দ্বৈত মিলনের আশায়। বড় মধুর এক দৃশ্য।

রোমিও জুলিয়েট করমজলের আতিথ্য গ্রহণ করে ২০০২ সালে। ২০০৫ সালে প্রজননক্ষম হওয়ার পর আজ পর্যন্ত জুলিয়েট তার ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে তার সাথীকে উপহার দিয়েছে প্রায় পাঁচশ’র কাছাকাছি ডিম। তা থেকে বনবিভাগের কর্মীরা তাদের প্রজননেেকন্দ্রে ফুটিয়েছেন প্রায় তিনশ’ শিশুকুমির।

সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে আসছে। এখানকার নদীর ডলফিনেরাও হুমকির মুখোমুখি। করমজলের একটি সাজানো কক্ষে এই সতর্কবাণীটি চোখে পড়লো-

“মিষ্টি পানির ডলফিনকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা ভীষণ প্রয়োজন। সম্প্রতি চীনের ইয়াংজি নদীর ডলফিন বাইজির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটি দুঃখজনক ঘটনা। মানব ইতিহাসে বাইজি প্রথম জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের মিষ্টি পানির ডলফিনরা বাইজির মতো একই রকম বিপদের সম্মুখীন এবং এদেরকে ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের সাহায্য করা প্রয়োজন।”

বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা সফল হোক।

এই পর্যায়ে আমাদের শেষ ভ্রমণস্থল দুবলার চর। এই চর অঞ্চলটি একটি দ্বীপ। অঞ্চলটি বিশুদ্ধ শুটকি মাছের রাজ্য বলে খ্যাত। স্থানটি হিন্দু ধর্মের পবিত্র পুণ্য¯œান, রাসমেলার জন্যও বিখ্যাত। দুবলার চরে পড়ন্ত বেলায় গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে অনুষ্ঠিত হলো যাত্রীদের সকলের অংশগ্রহণে এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।

রাতে লঞ্চে ফিরে এল সবাই। যাত্রাশেষে এবার আমাদের ফিরে যাওয়ার পালা। পরদিন দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের পর শুরু হলো র‌্যাফেল ড্র। ভাগ্যবানেরা জিতে নিল নানা রকম পুরস্কার। রাতের বেলা লঞ্চ ভিড়লো খুলনার ঘাটে। সেখান থেকে রেল স্টেশন। ট্রেনের কামরায় আসন গ্রহণ পর যাত্রা শুরু হলো রাজধানীর উদ্দেশ্যে।

রাতের আঁধার ভেঙে ট্রেন ছুটে চলেছে রাজধানীর দিকে, সেই কর্মস্থলে। ট্রেনের দোলায় দুলতে দুলতে ঘুম ঘুম চোখে ভেসে উঠছে সবুজ শ্যামলে ঘেরা এক অপরূপ অরণ্যের স্বপ্ন।

back to top