alt

সাময়িকী

তৈমুর শেখের জানাজা

শেলী সেনগুপ্তা

: বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

সবুজ গ্রামটা দেখতে দেখতে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা একটা ছোট্ট নালাতে পরিণত হয়েছে। পুকুরগুলো মজে গেছে। আগে যারা জমির মালিক ছিলো এখন তারা দিনমুজুর। অন্যের জমিতে কাজ করেও দুবেলা খাবার জোগার করতে পারে না। গ্রামজুড়ে হাহাকার। আগে এ গ্রামে রাতেরবেলা কবিগানের আসর বসতো। সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে কেচ্ছার আসর বসতো। হাতে হাতে হুকো ঘুরে বেড়াতো। মানুষগুলো খুব সুখি ছিলো।

গ্রামে এখন সবসময় ঝগড়াবিবাদ চলছে। গ্রামের এই অবস্থার জন্য একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছে। অথচ কেউই নিজের দোষ মেনে নিচ্ছে না।

মরিয়মপুর গ্রামের করিম শেখের ছেলে তৈমুর শেখ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে এলো। গলায় মোটা সোনার চেন, হাতে বড় ঘড়ি, আর চোখে সানগ্লাস দিয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়াতো। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, টুংটাং শব্দ করা লাইটার দেখে পাড়ার ছেলেদের চোখ ছানাবড়া হতো। কিছুক্ষণ পর পর হাতের লাল ফোনটা বেজে ওঠে আর আরবি ভাষায় কী যেন সব বলে। আশপাশের লোকজন হা করে শোনে আর অবাক হয়। এসব দেখে দেখে গ্রামের ছেলেদের রাতের ঘুম নষ্ট হতো। ওরাও এক এক জন তৈমুর শেখ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।

একসময় গ্রামে রটে গেলো, তৈমুর শেখ চাইলেই গ্রামের ছেলেদের মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি দিতে পারে। ওর কাছে বিদেশে চাকরি দেয়ার পারমিট আছে। প্রথমেই তাঁতি পাড়ার বংকু আসলো টাকা নিয়ে,

- তৈমুর বাই, আমি বিদেশ যামু, ট্যাহা লইয়া আইছি। পাডানের ব্যবস্থা করেন।

টাকাগুলো গুণে নিয়ে বললো,

- দূর পাগলা, এতো কম ট্যাহা দিয়ে বিদেশ যাবি কেমনে রে? আরো ট্যাহা লাগবো।

- বাইত তো আর ট্যাহা নাই রে বাই, কি করুম?

- ট্যাহা নাই তো কি অইছে, জমি আছে না? হেইডা বন্দক দিয়া যা, কামাই কইরা ছাড়াইয়া লইবি।

- আইচ্ছা, বাবারে কইয়া দেহি।

- দেহিস, যাইবার চাইলে কইস, তুই না গেলে আরো বহুত মানুষ আছে, তরে আপন ভাবি, তর লাইগা কিছু কম কইরা দিমু।

- আইচ্ছা।

পরদিনই বংকুর বাবার জমির কাগজ চলে এলো তৈমুর শেখের সিন্দুকে। আর বংকু দিন গুনছে বিদেশ যাবার। মনটা উড়ছে ফরফর করে। বংকুর বাবা প্রতিদিন বেশি বেশি বাজার করে। চোখের জল মুছে বংকুর মা ছেলের পছন্দের রান্না করে। পাশে বসিয়ে খাওয়ায়। বিদেশ গেলে কে খাওয়াবে এতো যত্ন করে?

বঙ্কুর মতো অনেকেই বিদেশ যেতে চায়। গলায় মোটা সোনার চেন আর হাতে হাতে মোবাইল নিয়ে হাটের মধ্যখানে বসে গল্প করার স্বপ্ন সবাই দেখতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে গ্রামের অনেকেই বিদেশে যাবার জন্য পৈতৃক ভিটামাটি বিক্রি করে দিলো।

দেখতে দেখতে মরিয়মপুরের সব জমি ধীরে ধীরে তৈমুর শেখের কাছে চলে আসছে।

সবাই দেখলো মরিয়মপুরে অনেক লোকজনের আনাগোনা। ঢাকার লোকজন এসে জমির মাপঝোঁক করছে। আরো কিছুদিন পর বিশাল বিশাল স্থাপনা হচ্ছে। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব আযানের পর বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে এক লোককে জিজ্ঞেস করলো,

- এইহানে কি অয়তাছে?

- ক্যান হুজুর আপনে জানেন না, এই হানে সার কারখানা অইবো।

- কি কও? কার জমিত অইবো? কেডা বানাইতাছে?

- ঢাহার ব্যবসায়ী বানাইতাছে? জমিতো হ্যারা কিন্যা লইছে।

লোকটা নিজের কাজে চলে গেলো।

পরদিন জমির আলীর ধানক্ষেত, শাকিলের বাবার ভিটা আর রথিন সোনারুর দোকান ভেঙ্গে দেয়া হলো। সেখানে নাকি কারখানা হবে। প্রতিবাদ করতে গেলে দেখা গেলো কবেই সে জমি বিক্রি হয়ে গেছে।

শুকুর আলী কেঁদে কেটে বলে,

- আমি তো গোপাট বেচছি, আমার ভিডা গ্যালো ক্যান?

এর কোন জবাব নেই কারো কাছে। কারখানা মালিকের লোকজন এসে শুকুর আলীকে সরিয়ে দিলো। গ্রামে আর মাঠ থাকলো না, ধানী জমি আর গ্রামের কোল থেকে নেমে আসা ছোট ছোট পায়ে চলা পথগুলোও একাকার হয়ে কারখানার পেটের ভেতর জায়গা করে নিলো। কেন হলো, কীভাবে হলো, জবাব দেবার কেউ নেই।

তৈমুর শেখ এখন ঢাকায় থাকে। বড় একটা গাড়ি করে মাঝে মাঝে গ্রামে আসে, সাথে একজন বডিগার্ড থাকে। কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যায়। দেখতে দেখতে ওদের একতলা বাড়ি তিনতলা হয়ে গেলো। গ্রামের লোকজন এখন তৈমুর শেখের আশাপাশে যেতে পারে না, দু’একবার যারা চেষ্টা করেছে তারা বডিগার্ডের হাতে রাম থাপ্পড় খেয়ে সরে এসেছে।

মরিয়মপুর গ্রাম থেকে হাসি হারিয়ে গেছে। লোকগুলো রোবোটের মতো দু’বেলা খাবার জোগার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাদের তখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে তাদের কেউ কেউ সার কারখানায় কাজ নিলো। যাদের ভিটামাটি কিছুই নেই তারা ঢাকায় চলে গেলো। ক্ষুধার্ত অজগর সাপের মতো কালো ধোঁয়া প্রতিদিন গ্রামটাকে গিলে খেতে আসে।

মাঠে ঘাস নেই, গাভীগুলো খেতে না পেয়ে দিন দিন কৃশ হয়ে যাচ্ছে, গাভী এবং মা, কারো স্তনে নেই দুধের নহর।

মরিয়মপুর গ্রামের মানুষগুলো এ জীবনে মানিয়ে নিয়েছে। শতছিন্ন গ্রামটা বিশাল সার কারখানার আড়ালে চলে গেলো।

কারখানার ভেঁপু বাজে, আর গ্রামের লোকেরা পিঁপড়ের সারির মতো ঢিমেতালে কারখানার ভেতরে ঢুকে যায়। আজও তাই গেলো, সাথে ছোট্ট পুঁটলিতে খাবার। কাজ করে ক্লান্ত হয়ে দুপুরে সবাই খাবার খেতে বসেছে। এমন সময় ফোরম্যান এসে বললো,

- হুনছিস তোরা, ই গেরামের তৈমুর শেখ সাব মইরা গ্যাছে।

নির্বিকারে শুনলো সবাই। কেউ খাওয়া থামালো না। একজন তৈমুর শেখের মৃত্যুতে যেন ওদের কিছু আসে যায় না। এই মুহূর্তে খাবার শেষ করে আবার কাজ শুরু করাই মূল উদ্দেশ্য। কাজে যেতে দেরি হলে একবেলার বেতন কাটা যাবে। এটা কেউ চায় না।

ওদের মধ্যে কোন উৎসাহ না দেখে ফোরম্যান তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে কাজে যাবার তাড়া দিয়ে চলে গেলো।

বিকেলে কারখানা ছুটি হলে ক্লান্ত শ্রমিকরা বের হয়ে এলো। এখন সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। এমন সময় ঢাকা থেকে সারি সারি গাড়ি এসে দাঁড়ালো গ্রামের রাস্তায়। সামনে একটা হিমায়িত লাশের গাড়ি। গাড়িগুলো থেকে একে একে সবাই নেমে এলো। বেশ ভাবগম্ভীর পরিবেশ। হিম গাড়ির দরজা খুলে গেলো। চারজন লোক লাশের খাটিয়া নিয়ে নামলো। খাটিয়াটা রাখতে গেলে সিকিউরিটির লোকজন হা হা করে ছুটে এলো। এটা কারখানার জায়গা, এখানে লাশের খাটিয়া রাখা যাবে না। রীতিমতো হৈহুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো। সাথে আসা লোকজন অনেক অনুরোধ করে খাটিয়া রাখলো। জানাজার আয়োজন করার জন্য লোক ডাকাডাকি শুরু করতেই, সিকিউরিটি থেকে জানিয়ে দিলো এখানে জানাজা করা যাবে না, এটা কারখানার জায়গা।

ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোথাও জানাজার ব্যবস্থা করতে চাইলেও অনুমতি পাওয়া গেলো না। মরিয়মপুর গ্রামের গ্রায় সব জমিই কারখানার মালিকানাধীন। জানাজা পড়তে হলে হেড অফিস থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে আসতে হবে।

সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, পশ্চিম আকাশ যেন লজ্জায় লাল হয়ে আছে। এখনো জানাজা হয় নি, হবার কোনো ব্যবস্থাও নেই। ঢাকা থেকে আসা লোকজন বারবার ঘড়ি দেখছে। কম বয়সীরা আড়ালে আবডালে সিগারেট জ্বালাচ্ছে। কেউ কেউ এক পা এক পা করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

গ্রামের লোকজন দূর দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ কেউ গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বিড়ি ফুঁকছে। বিড়ির শেষ অংশটা থেকে জোরে ধোঁয়া টেনে নিয়ে ছেড়ে দেয়ার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত জোরে ছাড়ছে। তারপর থুথু ছিটিয়ে উঠে চলে গেলো। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে দেখতে দেখতে আবারও থুথু ছিটালো।

মরিয়মপুর গ্রাম ধীরে ধীরে বাদামী চাদরে শরীর মুড়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর একটা করে গাড়ি বের হয়ে যাচ্ছে। শেষ গাড়িটাও একটু ইতস্তত করে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে হিম গাড়িটাও চলে গেলো। কারখানার জমিতে রয়ে গেছে তৈমুর শেখের খাটিয়া। সিকিউরিটির লোকজন তখনও পাহারা দিচ্ছে যেন এখানে জানাজা না হয়।

প্রতিদিনের মতো রাত হলো। মরিয়মপুর গ্রাম ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলো। আজকাল এ গ্রামে শেয়াল ডাকে না, এক ঘণ্টা পর পর কারখানার ঘড়ি থেকে সময় জানিয়ে দিচ্ছে। ঢাকাগামী রাস্তার ছিটেফোঁটা আলোতে গ্রামটা রহস্যময় আলোতে আলোকিত। কারখানার বাইরের আলোর চারপাশে পোকারা নাচানাচি করছে। কোন কোন পোকা ডানা পুড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, আবার নতুম এক দল ছুটে আসছে।

দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামেও ভোর আসে। নামাজ শেষ করে মুসুল্লীরা জড়ো হয়েছে কবরস্থানে। কারখানার সামনে থেকে কবরস্থান পর্যন্ত ছ্যাঁচড়ে আসার দাগ।

সবাই অবাক হয়ে দেখলো, তৈমুর শেখের জানাজাবিহীন কাফন মোড়ানো লাশটা কবরস্থানের মাঝখানে পড়ে আছে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

তৈমুর শেখের জানাজা

শেলী সেনগুপ্তা

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১

সবুজ গ্রামটা দেখতে দেখতে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা একটা ছোট্ট নালাতে পরিণত হয়েছে। পুকুরগুলো মজে গেছে। আগে যারা জমির মালিক ছিলো এখন তারা দিনমুজুর। অন্যের জমিতে কাজ করেও দুবেলা খাবার জোগার করতে পারে না। গ্রামজুড়ে হাহাকার। আগে এ গ্রামে রাতেরবেলা কবিগানের আসর বসতো। সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে কেচ্ছার আসর বসতো। হাতে হাতে হুকো ঘুরে বেড়াতো। মানুষগুলো খুব সুখি ছিলো।

গ্রামে এখন সবসময় ঝগড়াবিবাদ চলছে। গ্রামের এই অবস্থার জন্য একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছে। অথচ কেউই নিজের দোষ মেনে নিচ্ছে না।

মরিয়মপুর গ্রামের করিম শেখের ছেলে তৈমুর শেখ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে এলো। গলায় মোটা সোনার চেন, হাতে বড় ঘড়ি, আর চোখে সানগ্লাস দিয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়াতো। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, টুংটাং শব্দ করা লাইটার দেখে পাড়ার ছেলেদের চোখ ছানাবড়া হতো। কিছুক্ষণ পর পর হাতের লাল ফোনটা বেজে ওঠে আর আরবি ভাষায় কী যেন সব বলে। আশপাশের লোকজন হা করে শোনে আর অবাক হয়। এসব দেখে দেখে গ্রামের ছেলেদের রাতের ঘুম নষ্ট হতো। ওরাও এক এক জন তৈমুর শেখ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।

একসময় গ্রামে রটে গেলো, তৈমুর শেখ চাইলেই গ্রামের ছেলেদের মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি দিতে পারে। ওর কাছে বিদেশে চাকরি দেয়ার পারমিট আছে। প্রথমেই তাঁতি পাড়ার বংকু আসলো টাকা নিয়ে,

- তৈমুর বাই, আমি বিদেশ যামু, ট্যাহা লইয়া আইছি। পাডানের ব্যবস্থা করেন।

টাকাগুলো গুণে নিয়ে বললো,

- দূর পাগলা, এতো কম ট্যাহা দিয়ে বিদেশ যাবি কেমনে রে? আরো ট্যাহা লাগবো।

- বাইত তো আর ট্যাহা নাই রে বাই, কি করুম?

- ট্যাহা নাই তো কি অইছে, জমি আছে না? হেইডা বন্দক দিয়া যা, কামাই কইরা ছাড়াইয়া লইবি।

- আইচ্ছা, বাবারে কইয়া দেহি।

- দেহিস, যাইবার চাইলে কইস, তুই না গেলে আরো বহুত মানুষ আছে, তরে আপন ভাবি, তর লাইগা কিছু কম কইরা দিমু।

- আইচ্ছা।

পরদিনই বংকুর বাবার জমির কাগজ চলে এলো তৈমুর শেখের সিন্দুকে। আর বংকু দিন গুনছে বিদেশ যাবার। মনটা উড়ছে ফরফর করে। বংকুর বাবা প্রতিদিন বেশি বেশি বাজার করে। চোখের জল মুছে বংকুর মা ছেলের পছন্দের রান্না করে। পাশে বসিয়ে খাওয়ায়। বিদেশ গেলে কে খাওয়াবে এতো যত্ন করে?

বঙ্কুর মতো অনেকেই বিদেশ যেতে চায়। গলায় মোটা সোনার চেন আর হাতে হাতে মোবাইল নিয়ে হাটের মধ্যখানে বসে গল্প করার স্বপ্ন সবাই দেখতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে গ্রামের অনেকেই বিদেশে যাবার জন্য পৈতৃক ভিটামাটি বিক্রি করে দিলো।

দেখতে দেখতে মরিয়মপুরের সব জমি ধীরে ধীরে তৈমুর শেখের কাছে চলে আসছে।

সবাই দেখলো মরিয়মপুরে অনেক লোকজনের আনাগোনা। ঢাকার লোকজন এসে জমির মাপঝোঁক করছে। আরো কিছুদিন পর বিশাল বিশাল স্থাপনা হচ্ছে। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব আযানের পর বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে এক লোককে জিজ্ঞেস করলো,

- এইহানে কি অয়তাছে?

- ক্যান হুজুর আপনে জানেন না, এই হানে সার কারখানা অইবো।

- কি কও? কার জমিত অইবো? কেডা বানাইতাছে?

- ঢাহার ব্যবসায়ী বানাইতাছে? জমিতো হ্যারা কিন্যা লইছে।

লোকটা নিজের কাজে চলে গেলো।

পরদিন জমির আলীর ধানক্ষেত, শাকিলের বাবার ভিটা আর রথিন সোনারুর দোকান ভেঙ্গে দেয়া হলো। সেখানে নাকি কারখানা হবে। প্রতিবাদ করতে গেলে দেখা গেলো কবেই সে জমি বিক্রি হয়ে গেছে।

শুকুর আলী কেঁদে কেটে বলে,

- আমি তো গোপাট বেচছি, আমার ভিডা গ্যালো ক্যান?

এর কোন জবাব নেই কারো কাছে। কারখানা মালিকের লোকজন এসে শুকুর আলীকে সরিয়ে দিলো। গ্রামে আর মাঠ থাকলো না, ধানী জমি আর গ্রামের কোল থেকে নেমে আসা ছোট ছোট পায়ে চলা পথগুলোও একাকার হয়ে কারখানার পেটের ভেতর জায়গা করে নিলো। কেন হলো, কীভাবে হলো, জবাব দেবার কেউ নেই।

তৈমুর শেখ এখন ঢাকায় থাকে। বড় একটা গাড়ি করে মাঝে মাঝে গ্রামে আসে, সাথে একজন বডিগার্ড থাকে। কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যায়। দেখতে দেখতে ওদের একতলা বাড়ি তিনতলা হয়ে গেলো। গ্রামের লোকজন এখন তৈমুর শেখের আশাপাশে যেতে পারে না, দু’একবার যারা চেষ্টা করেছে তারা বডিগার্ডের হাতে রাম থাপ্পড় খেয়ে সরে এসেছে।

মরিয়মপুর গ্রাম থেকে হাসি হারিয়ে গেছে। লোকগুলো রোবোটের মতো দু’বেলা খাবার জোগার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাদের তখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে তাদের কেউ কেউ সার কারখানায় কাজ নিলো। যাদের ভিটামাটি কিছুই নেই তারা ঢাকায় চলে গেলো। ক্ষুধার্ত অজগর সাপের মতো কালো ধোঁয়া প্রতিদিন গ্রামটাকে গিলে খেতে আসে।

মাঠে ঘাস নেই, গাভীগুলো খেতে না পেয়ে দিন দিন কৃশ হয়ে যাচ্ছে, গাভী এবং মা, কারো স্তনে নেই দুধের নহর।

মরিয়মপুর গ্রামের মানুষগুলো এ জীবনে মানিয়ে নিয়েছে। শতছিন্ন গ্রামটা বিশাল সার কারখানার আড়ালে চলে গেলো।

কারখানার ভেঁপু বাজে, আর গ্রামের লোকেরা পিঁপড়ের সারির মতো ঢিমেতালে কারখানার ভেতরে ঢুকে যায়। আজও তাই গেলো, সাথে ছোট্ট পুঁটলিতে খাবার। কাজ করে ক্লান্ত হয়ে দুপুরে সবাই খাবার খেতে বসেছে। এমন সময় ফোরম্যান এসে বললো,

- হুনছিস তোরা, ই গেরামের তৈমুর শেখ সাব মইরা গ্যাছে।

নির্বিকারে শুনলো সবাই। কেউ খাওয়া থামালো না। একজন তৈমুর শেখের মৃত্যুতে যেন ওদের কিছু আসে যায় না। এই মুহূর্তে খাবার শেষ করে আবার কাজ শুরু করাই মূল উদ্দেশ্য। কাজে যেতে দেরি হলে একবেলার বেতন কাটা যাবে। এটা কেউ চায় না।

ওদের মধ্যে কোন উৎসাহ না দেখে ফোরম্যান তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে কাজে যাবার তাড়া দিয়ে চলে গেলো।

বিকেলে কারখানা ছুটি হলে ক্লান্ত শ্রমিকরা বের হয়ে এলো। এখন সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। এমন সময় ঢাকা থেকে সারি সারি গাড়ি এসে দাঁড়ালো গ্রামের রাস্তায়। সামনে একটা হিমায়িত লাশের গাড়ি। গাড়িগুলো থেকে একে একে সবাই নেমে এলো। বেশ ভাবগম্ভীর পরিবেশ। হিম গাড়ির দরজা খুলে গেলো। চারজন লোক লাশের খাটিয়া নিয়ে নামলো। খাটিয়াটা রাখতে গেলে সিকিউরিটির লোকজন হা হা করে ছুটে এলো। এটা কারখানার জায়গা, এখানে লাশের খাটিয়া রাখা যাবে না। রীতিমতো হৈহুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো। সাথে আসা লোকজন অনেক অনুরোধ করে খাটিয়া রাখলো। জানাজার আয়োজন করার জন্য লোক ডাকাডাকি শুরু করতেই, সিকিউরিটি থেকে জানিয়ে দিলো এখানে জানাজা করা যাবে না, এটা কারখানার জায়গা।

ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোথাও জানাজার ব্যবস্থা করতে চাইলেও অনুমতি পাওয়া গেলো না। মরিয়মপুর গ্রামের গ্রায় সব জমিই কারখানার মালিকানাধীন। জানাজা পড়তে হলে হেড অফিস থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে আসতে হবে।

সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, পশ্চিম আকাশ যেন লজ্জায় লাল হয়ে আছে। এখনো জানাজা হয় নি, হবার কোনো ব্যবস্থাও নেই। ঢাকা থেকে আসা লোকজন বারবার ঘড়ি দেখছে। কম বয়সীরা আড়ালে আবডালে সিগারেট জ্বালাচ্ছে। কেউ কেউ এক পা এক পা করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

গ্রামের লোকজন দূর দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ কেউ গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বিড়ি ফুঁকছে। বিড়ির শেষ অংশটা থেকে জোরে ধোঁয়া টেনে নিয়ে ছেড়ে দেয়ার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত জোরে ছাড়ছে। তারপর থুথু ছিটিয়ে উঠে চলে গেলো। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে দেখতে দেখতে আবারও থুথু ছিটালো।

মরিয়মপুর গ্রাম ধীরে ধীরে বাদামী চাদরে শরীর মুড়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর একটা করে গাড়ি বের হয়ে যাচ্ছে। শেষ গাড়িটাও একটু ইতস্তত করে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে হিম গাড়িটাও চলে গেলো। কারখানার জমিতে রয়ে গেছে তৈমুর শেখের খাটিয়া। সিকিউরিটির লোকজন তখনও পাহারা দিচ্ছে যেন এখানে জানাজা না হয়।

প্রতিদিনের মতো রাত হলো। মরিয়মপুর গ্রাম ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলো। আজকাল এ গ্রামে শেয়াল ডাকে না, এক ঘণ্টা পর পর কারখানার ঘড়ি থেকে সময় জানিয়ে দিচ্ছে। ঢাকাগামী রাস্তার ছিটেফোঁটা আলোতে গ্রামটা রহস্যময় আলোতে আলোকিত। কারখানার বাইরের আলোর চারপাশে পোকারা নাচানাচি করছে। কোন কোন পোকা ডানা পুড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, আবার নতুম এক দল ছুটে আসছে।

দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামেও ভোর আসে। নামাজ শেষ করে মুসুল্লীরা জড়ো হয়েছে কবরস্থানে। কারখানার সামনে থেকে কবরস্থান পর্যন্ত ছ্যাঁচড়ে আসার দাগ।

সবাই অবাক হয়ে দেখলো, তৈমুর শেখের জানাজাবিহীন কাফন মোড়ানো লাশটা কবরস্থানের মাঝখানে পড়ে আছে।

back to top