alt

সাময়িকী

প্রণম্য শব্দভাস্কর নিভৃত পাঠের কবি

ওবায়েদ আকাশ

: বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/10Jun21/news/shikdar-aminul-haque-1.jpg

সিকদার আমিনুল হক / ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২-১৭ মে ২০০৩

তুলে রাখা নেবুফুল বাসি হয়ে এলো; কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে দিনমান, সন্ধ্যায় ফুরিয়ে গেল লাল গোলাপের ঘ্রাণ- তবু সে এলো না। অগত্যা, বিক্ষত পাহাড় ডিঙিয়ে, রাতের নক্ষত্র হয়ে তাকে উড়ে যেতে হলো আকাশের উড়ন্ত ডালায়।... সিকদার আমিনুল হক আমাদের ছকবাঁধা বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সরল জাগতিক বিবেচনাবোধের গভীর নিরিখ ছিঁড়ে যখন ২০০৩ সালের ১৭ মে হঠাৎ চিরশান্ত হয়ে আমাদের অবাক করলেন, তখন ঠিক এভাবে ভেবেছি তাঁকে, হয়তো অনেকে ভেবেছে আরো নিবিড়তায়।

আমাদের একাডেমিশিয়ান কতিপয় সমালোচক-বুদ্ধিজীবী এবং কিছু প্রথাবিমুগ্ধ কবি-লেখকের অসার রচনার বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল প্রচারের পাতাগুলো তাঁর গুরুত্বকে প্রায় ধারণ করতে পারেনি জীবিতাবস্থায়; এবং এখনও যে খুব পারছে, সে-কথা অকপট বলতে পারেন না কেউ। তাই তিনি দূরের নক্ষত্র হয়ে, তা সে যত দূরেরই হোক, যে আলো থেকে বঞ্চিত নয় কেউ; তিনি আলোকিত করেন তরুণ কবির কবিতার খাতা, পড়ার টেবিল থেকে সময়কে বুঝে নেবার উজ্জ্বল মেধাবী পাঠককে।

যদিও তা সর্বপ্লাবী ছিল না, তবু মধ্য উনিশ শতকে যে রোমান্টিকতার রিনরিনে ধ্বনি সারা পৃথিবীর কাব্যব্যঞ্জনায় অনুরণিত হলো, সেখান থেকে আজকের একুশ শতকের বাংলা কবিতায় নানা ভাংচুর দিকবদল-প্রতিবদলের স্বযাত্রায় কখনো তা সুররিয়ালিস্ট আবার কখনো ভুরভুরে রোমান্টিকতার গন্ধে গন্ধময় থেকেছে। সিকদার আমিনুল হক যখন বয়সে তরুণ, সদ্য কবিতাকর্মী, তখন সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়তায় কবিতা ছিনিয়ে নিয়েছিল সর্বোচ্চ আসন। তখনকার ইংল্যান্ডে কবিতা এবং কবিতাকে সঙ্গীতাকারে তুলে ধরার ভেতর দিয়ে হাজার হাজার পাঠক-স্রোতা-কবিতে যে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, তা পৃথিবীর অন্যান্য ভূখ-ের মতো তখনকার বাংলাদেশের কবিদের কাছেও হয়ে ওঠে ব্যাপক আগ্রহের বিষয়। একটি মাতাল সময় যাপন এবং গ্রহণের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা আন্দোলন। সিকদার আমিনুল হক সেই সময়ের কবিদের এক স্বতন্ত্র প্রতিনিধি হয়ে লিখেছেন দুহাত উজার করে। তিনি লিখেছেন তাঁর দুহাত প্রসারিত করে যতটুকু ধরা যায় ততটুকু এবং যেটুকু ছোঁয়া যায় না, তারও ওপারের কথা; লিখেছেন তার সময়, ঐহিত্য, ইতিহাস, প্রকৃতি; লিখেছেন ব্যক্তি এবং বিশ্বকে; লিখেছেন বাস্তবতাকে ডিঙিয়ে কল্পনার স্বপ্নশুভ্র অনাগত সব দিনলিপি।

সিকদার আমিনুল হক এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, পাঠকমাত্র তাঁর কবিতা পড়ে বুঝে-না-বুঝে ভাবতে বাধ্য হবেন যে, তিনি কবিতা কিংবা এমন কিছু পাঠ করছেন- যা তাকে সম্মোহিত করে

বিশ শতকের সূচনাপর্বে সারা ইউরোপ তথা বাংলা কবিতায়ও যে বোদলেয়ারীয় উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, তার প্রবহমানতা সহজে মিলিয়ে যায়নি। বিশেষ করে রবীন্দ্রোত্তর তিরিশের বাংলা কবিতা এবং বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের পূর্ববর্তী ষাটের দশকের কবিদের ভেতর সে উন্মাদনা ব্যাপকই প্রভাব বিস্তার করে। বলা যায় আমাদের ষাটের কবিরা সঙ্গত কারণে অনেকেই তিরিশীয় কাব্য ধারাকে মহার্ঘ মনে করে পথ হেঁটেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক উন্মাদনা ও বিশ্বব্যাপী কবিতা-কেন্দ্রিক নানামুখী মুভমেন্টের ঝড়ো হাওয়ায় বাংলাদেশের ষাটের কবিতা উচ্চৈঃস্বর-স্লোগান মুখিনতা থেকে গভীরতর উচ্ছলতায় সর্বত্র চষে বেরিয়েছে।

সিকদার আমিনুল হকের গুরুত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি সেই সমসাময়িক হয়েও সেই উন্মাদনার ভিড়ে গা এলিয়ে দেননি। তিনি যে কাব্যিক প্রমত্ততায় নিজেকে নিঃশব্দ পেঁচার মতো আড়াল করে কবিতা লিখেছেন, সে ধারা তার একান্ত নিজের, নির্জন

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/10Jun21/news/shikdar-aminul-haque-2.jpg

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (ডান দিক থেকে তৃতীয়), স্ত্রী মাসুদা আমিন জলি (সর্ব বাঁয়ে) ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সিকদার আমিনুল হক

এবং মানবিক অস্তিত্বের গভীরতর শেকড় পর্যন্ত তার যাত্রা। তাঁর সেই স্বনির্মিত কাব্যভাষা তাঁর সহজাত কবিপ্রতিভার ঠাস বুননে নিবিড়ে বসে নির্মাণ করেছেন। প্রবল সতর্কতা, সচেতনতাকে ধীরে ধীরে মুঠোবন্দি করে আমাদের বাংলা কবিতাকে যে নতুন ধারার গতিময়তা এনে দিয়েছেন, তা আমাদের সমসাময়িক কবিদের ভেতর বিরল অবশ্যই। সিকদার আমিনুল হক এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, পাঠকমাত্র তাঁর কবিতা পড়ে বুঝে-না-বুঝে ভাবতে বাধ্য হবেন যে, তিনি কবিতা কিংবা এমন কিছু পাঠ করছেন- যা তাকে সম্মোহিত করে। সিকদারের এই সম্মোহন-প্রতিভা হঠাৎ করে বা একদিনে তৈরি হয়নি, তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, তার যাপিত অভিজ্ঞতা, তার নিরালস্য ভ্রমণ পিপাসা তাকে এ ক্ষমতায় স্থিত করেছে। কারণ সিকদার আমিনুল হক সেই ক্ষমতাধর কবি যিনি কবিতার সব শর্ত পূরণ করে চারপাশের যা-কিছু দৃশ্যময়তাকে কবিতা করে তুলতে পারেন। যা কেবল কোনো মহৎ কবিই আয়ত্ত করতে পারেন। সিকদার আমিনুল হকের গুরুত্ব এখানে যে, তিনি দেখার ভেতর দিয়ে সমস্ত বর্ণ বা আশরাফ আতরাফের ভেদাভেদকে একাকার করে সমান্তরাল করে দেখে অভ্যস্ত; তাই তিনি ব্যাপক বিত্তবৈভবের মধ্যে বসেও এই পৃথিবীর সমগ্র মানব সমাজকে ভেবেছেন একই পরিবারভুক্ত। শুধু তাঁর কবিতার ক্ষেত্রেই নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আপন ভুবনেও সিকদার আমিনুল হক ছিলেন একজন সত্যিকারের আধুনিক মানুষ। তাঁর সচ্ছল-স্বছন্দ জীবন আর সংস্কারমুক্ত উঁচু মানসিকতার কারণে তাঁকে অহঙ্কারী, গরুগম্ভীর চরিত্রের কেউ কেউ ভেবেছেন হয়তো, কিন্তু তাঁর একান্ত সান্নিধ্য পাবার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে, কেবল তারাই বলতে পারবেন তিনি কতটা তার উল্টো স্বভাবের মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত মোলায়েম আর মৃদুভাষী এই শব্দশিল্পীর মানুষকে কাছে পাবার আকাক্সক্ষা ছিল দুর্বার। নিতান্ত লাজুক স্বভাবের কারণে তাঁর বন্ধুভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল না, কিন্তু নিজেকে কখনো তিনি বন্ধুশূন্য ভাবেননি, কারণ শব্দ আর সাদাপাতাই ছিল নির্লোভ এই কবির সারাক্ষণের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ সত্যতা প্রমাণে তাঁর একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তির উল্লেখ প্রাসঙ্গিক:

রিভুর ধারণা আমি খুব অহঙ্কারী

খানিকটা সত্য এর, কানিকটা নয়;

ওই-ই কথা বললো না, হাসলো শুধুই

বললে আমিও বলতাম নিশ্চয়।

আধুনিক মানবমনের ক্রমবর্ধমান জটিলতা, অস্তিত্ব সংকট, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বিলাসিতা, শৌখিনতা, নস্টালজিয়া, কাতরতা- সবকিছুই খামচে খামচে গেছে তাঁর কবিতাকে।

ব্যাপক প্রভাবশালী তিরিশের দশকেই বাংলা কবিতা রোমান্টিকতামুক্ত হয়ে বাস্তবতাকে অতিক্রম করে অতিবাস্তব চরিত্র ধারণ করে গতিময় হয়ে ওঠে। আগেই বলেছি, সিকদার সে গড্ডলে গা এলাননি। তিনিও বাস্তবতাবিরোধী একটি ধারার অনুসারী ছিলেন বটে, তবে তা তার নিজের মতো করে খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশ শতকের সূচনালগ্নের কয়েকজন ফরাসি সিম্বলিস্ট বা প্রতীকবাদী কবিদের দ্বারা তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এবং আমাদের বাংলা কবিতায় তিনি সে ধারারই একজন উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তিনি প্রভাবিত হন সমসাময়িক জার্মান সাহিত্য এবং স্প্যানিশ কবিদের দ্বারা। বিশেষ করে ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতায় তাঁর মগ্নতা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সে-সময়ের কয়েকজন প্রতিনিধিত্বশীল ফরাসি কবির কবিতার মতো সিকদারের কবিতা একইসঙ্গে রোমান্টিক, অতিবাস্তব এবং প্রতীকবাদী চরিত্র ধারণ করে। ফরাসি কবি পল এল্যুয়ার, আঁরি মিশো, জাক প্রেভের, রনে শার, ফ্রাঁসিস পঁজ-এর কবিতার স্যুররিয়ালিটি এবং রোমান্টিকতা সিকদার আমিনুল হককে ভূতে পাওয়ার মতোই পেয়ে বসে। বিশেষ করে জাক প্রেভের যে তাঁকে কীভাবে আলোড়িত করেছিল প্রেভেরকে নিয়ে লেখা ‘প্রেভের তোমাকে বলি’ কবিতায় তার কিছুটা আভাস লক্ষণীয়:

প্রেভের আমিও বসি রেস্তোরাঁয়। সন্ধ্যা ঘন হয়।

টেবিলে টেবিলে আসে মানুষের ঝাঁক। কাপ-ডিশ,

চামিচের আড়ালে গল্পের চারাগাছ।...

এখন সিকদারকে যারা ফরাসি কবিতার প্রভাবদুষ্টতায় অভিযুক্ত করতে ছাড়েন না, তারা একথা কি কখনো আমলে আনেন যে, মহত্তম কবি জীবনানন্দ দাশ ইউরোপীয় ছাচে বাংলার নদী মাঠ নিসর্গ বসিয়ে আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বিই থেকে গেলেন? আর একই কায়দায় সিকদার আমিনুল হকও যে মদের গ্লাসে রঙিন তরলের পাশাপাশি বাংলার আকাশছেঁড়া বৃষ্টির জলও ধারণ করেছেন, বিরান মাঠ জুড়ে নগরের পাশাপাশি বুনো লতা, শালবনের বেড়ে ওঠা দেখেছেন; এ-জন্য তাঁর কবিতার বাইরে বেরিয়ে আমাদের প্রমাণ খুঁজতে হয় না:

আমি বাংলার সদর্পিত ঘোষণার ধানখেত, মাছরাঙা ও কাদাখোঁচা, বাঁশঝাড় দেখার ফাঁকে ফাঁকে জলটলটলে সাতাশটা পুকুর দেখার প্রাণান্ত চেষ্টার পর গণনাই ছেড়ে দিলাম।...

[পুকুরে জল নাই / আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি]

এরপরও সিকদার আমিনুল হক ষাটের একজন অন্যতম রোমান্টিক কবি বলেই বিবেচিত হবেন বলে বিশ্বাস। একথা বললে বেশি বলা হবে না যে, তিরিশ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় সিকদারের মতো এতোটা বিশুদ্ধ রোমান্টিক কবি আর সচরাচর দেখা যায় না। সে-অর্থেও সিকদার আমিনুল হক সমকালীন বাংলা কবিতায় এককভাবে স্বতন্ত্র বলতে হবে।

চোখে দেখার কিংবা ব্যক্তিগত অনুভূতির শুভ্রতা তা যত গোপনই হোক, নিরন্তর কাত হয়ে টেবিলে পড়ে থাকা কবির কাছে তা আর লুপ্ত কোনো ব্যাপার হয়ে থাকে না। পাঠকের মুখোমুখি হবার যে ব্যগ্রতা তা কলমের নিবে বসে উদগ্র হয়ে ওঠেই। আর এই একান্ত ব্যক্তিগত চোখ দিয়ে যিনি বিশ্বকে পরিমাপ করে নেন, তিনি ভাবেন এই ব্যক্তির মধ্যেই বসবাস সমগ্র ভূগোল। সিকদার আমিনুল হক সেই অনুভূতিদগ্ধ কবি; যিনি অনুভব করেন ব্যক্তির মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই পৃথিবী অসাড়-নিরর্থ হয়ে পড়ে। তিনি মনে করেন ভিড়ের মধ্যে যে জীবন, ব্যক্তির সূক্ষ্মতর অনুভূতি সেখানে অচল। বরং নির্জনতার নিঃশব্দ ভুবনে যিনি যুগযন্ত্রণা-জীবযন্ত্রণাকে সেলাই করতে জানেন, তিনি প্রকৃত কবি। আর এই মানচিত্রের সূক্ষ্মদর্শী পরিব্রাজক সিকদার আমিনুল হক তাঁর নির্জন ভুবনে বসে ঘোষণা করেন : ‘মৃত্যু বাঁধা রাজপথে আমার কবিতা অচঞ্চল/শহুরে গ্রামীণ নয়, অন্ধকারে শুধু অগ্রদূত।’ কোথা থেকে আসে সিকদার আমিনুল হকের কবিতা? তাঁর কবিতা ও কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাঁর জবানীতেই শোনা যাক মাত্র কয়েক পঙক্তি:

বিষয়বস্তুর জন্যে আমার কবিতা অস্তিত্বের

শঙ্কা নিয়ে নৈশ জাগে। ম্রিয়মাণ আমি ও কবিতা

দীঘিতে সাঁতার কাটি বাঁচার ইচ্ছায়;

যাই পর্বতের শীর্ষে, লোকে বলে দুর্ধর্ষ ট্রেকার

অথবা মরুতে জেদী যাযাবর, ছুটি তেপান্তরে;

রাখালের সঙ্গে ঘুরি ক্লান্ত মেষ পালকের বেশে।

সরাইখানায় গিয়ে পান করি আমি ও কবিতা

গাঢ় দ্রাক্ষারস, জুয়ো খেলি সারারাত্রিভর।...

বিষয়বস্তুর জন্যে আমার কবিতা আর আমি

গেছি নষ্ট মহিলার দুয়ারে।...

বিষয়বস্তুর জন্যে খুঁজে আনে শাগালের ছবি

আমার কবিতা। কিংবা গান্ধারের বিপুল ঐশ্বর্য,

মননের চিত্র, গীতি, মরমীর অচিন পাখিকে-

[আমি ও আমার কবিতা/আমি সেই ইলেক্ট্রা]

অস্তিত্বের আশঙ্কায় শঙ্কিত কবি সারারাত জেগে জেগে কবিতা খোঁজেন। তার জানালায় মৃত্যু, করিডোরে মৃত্যু, ড্রইং রুমে বসে কফি কিংবা আকণ্ঠ রঙিন মদে উন্মাতাল হয়ে তাঁকে পাহারা দেয় মৃত্যু। চিরস্থায়ী রুগ্ণতা আর মৃত্যুর ভয় এই রোদ-জোছনভরা পৃথিবী থেকে তাঁকে তুলে নিতে চায়। তিনি বন্ধুদের সাক্ষী রেখে বলেন, ‘বন্ধুরা হয়তো জানো, শরীরের কেন এত মুগ্ধ মৃত্যুভয়।’ আর এই অনিবার্য মৃত্যুর কথা ভেবেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। নিয়তিকে প্রভু ভেবে মগ্ন থাকেন না প্রার্থনায়। বরং সভ্যতার আড়ালিপনাকে উপহাস করে তিনি শুচিশুভ্র মুখোশের গভীর থেকে তুলে আনেন জীবনকে যথেচ্ছ উপভোগের সত্য। তিনি মনে করেন, আমাদের সভ্যতার ভাড়ামোর আড়াল থেকে মানুষের স্বাস্থ্যকর জৈবিক জীবনকে কখনো কুয়াশা মুছে দেখা হয় না ঝকঝকে স্বচ্ছ আয়নায়। যা কিছু অসামাজিক, অনৈতিক তার গভীরেই যে নিদ্রামগ্ন নান্দনিক শৌখিনতা, আসক্ত সুন্দর- তা সিকদার আমিনুল হকের কবিতার ভ্রমণের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাই তাঁর কবিতায় বারবার ঘুরেফিরে আসে শাওয়ারের শব্দ, শেমিজের ঘ্রাণ, ব্রা, অন্তর্বাস, মধ্যরাতের পানশালার টুংটাং শব্দ, সাদাত্বক, নারীর স্তন, প্রেমিকার গাল, বালিকার নগ্ন স্নান, চুম্বন, ওষ্ঠ ইত্যাদি শব্দসখ্যের তীব্রতা।

প্রচলিত ছন্দকে সিকদার আমিনুল হক যথেচ্ছ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন তাঁর ছন্দকৌশলের যাদুকরী ক্ষমতা। বিশেষ করে তিনি তাঁর কবিতার দীর্ঘকালের অদ্বিতীয় সঙ্গী করে নিয়েছিলেন অক্ষরবৃত্তকে। আধুনিক মানবমনের নিরাভরণ-নান্দনিক উপস্থাপনাকে অক্ষরবৃত্তেই তিনি শ্রেষ্ঠ আশ্রয় খুঁজে দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে সমসাময়িক অনেক মহৎ কবির সমগোত্রীয় তিনি। এর বাইরে তিনি ফ্রি ভার্স বা মুক্ত টানাগদ্যে কবিতা লেখার বিপজ্জনক পথে হেঁটেও সফল হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠই যথেষ্ট মনে করি। প্রচলিত ছন্দকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার ঔদ্ধত্য খুব কম কবিই দেখাতে পারেন। এ বিষয়ে সিকদারের ক্ষমতাকে পরখ করতে তাঁর অক্ষরবৃত্তের চালকে স্মরণ করা যেতে পারে। এ চালে তিনি সাবলীলভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন মুক্তক বা টানা গদ্যের আবেশ। বলতে পারেন যা খুশি তাই; যেমন খুশি তেমন করে। আর এমন ক্ষমতাধর কবিই যে পারেন তার চারপাশ, সময়, দৃশ্য-অদৃশ্যময়তাকে মুহূর্তে কবিতা করে তুলতে- এ সত্য লুকিয়ে থাকে কবির পঙ্ক্তিঘোরের অপার রহস্যে। সহজ সাবলীল অথচ কবিতার সব শর্তকে পূরণ করে সিকদার আমিনুল হক তাঁর শেষ বইতে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর ষাটের দশকের একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন এভাবে টানা গদ্যে :

নিশাত সাদানী ছিল উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার গ্রীবা গলদা চিংড়ির মতো; কটি বাচ্চা ঘোটকীর মতো সরু আর নিতম্বকে মনে হ’তো জলোচ্ছ্বাস কিংবা জোয়ারের মতো।

আমাদের ষাট দশকের তরুণদের ইচ্ছা আর স্বপ্ন এই ভাবে, তার রূপকে অসম্ভব থেকে সম্ভব করেছিলো। আমরা তার চলে যাওয়ার অন্ধকারে রাত্রি আর ঝাউয়ের গন্ধ পেতাম।

তার বাবা জানতেন দুর্দান্ত ফার্সি। তার রক্ত লাল নয়। আমাদের মন বলতো, এই রক্ত সাদা আর তাবরিজের শীতের বরফের মতো ঠা-া।... গ্রীষ্ম তার সহ্য হ’তো না; লম্বা কুর্তা আর সালোয়ার খুলে সে হাফ প্যান্ট পরে অনাবিল স্বস্তিতে ঘুরে বেড়াতো বাগানে কিংবা বারান্দায়। তার উন্মুক্ত নিম্ন শরীরের চর্বি ছিল নীল। শিরার শাখা-প্রশাখা ঘন সবুজ।

ষাট দশকের বাস্তবতা। ঢাকার আকাশে তখন অনেক নক্ষত্র ছিলো। নীরবতা ছিলো। নিশাত সাদানীর মতো রূপসীরা ছিলো। তখন বাজারে আপেলের পাশে ছিলো আঙুরের ঝুড়ি। লোভ ছিল, কিন্তু আমাদের হাতে পয়সা ছিলো না।

[নিশাত সাদানী/আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি]

এভাবে না বাস্তব না সত্যকে আলো আঁধারির মাধ্যমে তুলে ধরে সম্মোহিত করার ক্ষমতা ষাটের কেবল সিকদারেরই ছিল বটে। তিনি আমাদের স্বপ্নের মতো টেনে নিয়ে যান আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের যেন অবিকল বাস্তবতায়।

সিকদার আমিনুল হককে যে সকল ফরাসি কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কথা বলা হয় তাদের অন্যতম, ফরাসি স্যুররিয়ালিস্টদের ভাষায়, মধ্য বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি পিয়ের র‌্যভেরদি মনে করতেন, “সত্যিকারের কবিতা ডানায় ভর দিয়ে উড়ে আসে। তাকে বানানো যায় না।” সিকদার এ কথা মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করতেন। এ কথাকে অকাতরে স্বীকার করে তিনি বলেছেন- “আমার কাজ কবিতা লেখা, শুধুই কবিতা লেখা। সৌভাগ্য একটাই, আমার কলম এখনো থামেনি। লেখাকে দৈব ব্যাপার ব’লেই ছেড়ে দিয়েছি; ভালো লেখার চেষ্টা থাকতে পারে- কিন্তু সফলতা-অসফলতার হাতে কবিকে শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এটা একান্তই আমার অভিজ্ঞতা; অন্যদের ভিন্ন ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেও আমি মূল্য দেই।” কিংবা সিকদার আমিনুল হক মূল্য দিয়েছিলেন পল ভালেরির নিভৃত দিনপঞ্জিতে উচ্চারিত সেই অমোঘ সত্য : “স্নায়ুই হলো সবচেয়ে বড়ো কবি।”

যে কবিতা বানানো যায় না, অথচ কবিই তা রচনা করেন, যে কবিতার জন্য কবিকে অপেক্ষা করতে হয় প্রহরের পর প্রহর, অথচ তা শেষ পর্যন্ত কবির হাতেই শৃঙ্খলিত হয়; যে কবিতা কোনো মহাবিদ্যালয়ের গবেষণাগার কিংবা নির্মাণশালায় নির্মিত হয় না, তাকে দৈব বলেই ছেড়ে দিয়েছেন যে কবি, সেই সিকদার আমিনুল হকের কবিতার স্বাতন্ত্র্য কিংবা গুরুত্বকে অনুধাবনের মতো প্রকৃত সমালোচকের অভাব হয়তো আরও দীর্ঘদিনই থেকে যাবে; কিন্তু ঈর্ষাকাতর বন্ধুদের মরচেধরা লোহার দরজা ভেঙে যে যুগে যুগেই বেরিয়ে আসবেন একজন বুদ্ধদেব বসু কিংবা মোহিতলাল মজুমদার- এ সত্য নির্মমতর। সমসাময়িক কবিবন্ধুদের উত্তর-উত্তর খ্যাতির করাতে একটুও আহত হননি যে কবি, কিংবা নিজেই সূক্ষ্মতর বালুকণা হয়ে ঝিনুকের আড়ালে শুয়ে কেবলই অতলের দিকে যাত্রা করেছিলেন যিনি মুক্তো ফলাতে; আপাত অন্ধকার তাকে মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো সাময়িক গ্রাস করলেও সেই অনর্থ মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে তিনি ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে বেরিয়ে আসছেন তাঁর মৃত্যুর এত বছরের পরেও। যখন কবিদের মার্কেটখ্যাত আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো থেকে কেবলই শেষ হয়ে যায় সিকদার আমিনুল হকের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই; কিংবা ‘দূরের কার্নিশ’ কিংবা ‘পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’ কিংবা ‘তিন পাপড়ির ফুল’-এর মতো দু®প্রাপ্য বইগুলোর জন্য আজকের একজন তরুণ কবিতাকর্মী হন্তদন্ত হয়ে খুঁড়ে বেড়ান নীলক্ষেত কিংবা পল্টনের বইয়ের দোকানগুলো- তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন কবি সিকদার আমিনুল হক।

তাঁর আরও পরিণত কাব্যগ্রন্থ সতত ডানার মানুষ, কাফকার জামা, রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা, বাতাসের সঙ্গে আলাপ, লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেল এবং আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি। সিকদার আমিনুল হকের কবিতা যেন আরো বেশি সমৃদ্ধ ও বিস্ময়সৌন্দর্য ধারণ করে প্রকাশ পাচ্ছিল তাঁর শেষ বছরগুলোতে। এমনকি তাঁর শেষ লেখা কবিতাটিতে পর্যন্ত তাঁর সাবলীলতা, স্বাতন্ত্র্য, চিত্রকল্প নির্মাণের অভিনবত্ব সমকালীন বাংলা কবিতায় কেবল বিরলই নয়, দু®প্রাপ্যও যে বটে। কবি সিকদার আমিনুল হক আমার দেখা অনন্য আর নিপুণ এক শব্দভাস্কর। তাঁর কবিতার পাঠক হিসেবে আমার অহঙ্কার আছে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

প্রণম্য শব্দভাস্কর নিভৃত পাঠের কবি

ওবায়েদ আকাশ

বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/10Jun21/news/shikdar-aminul-haque-1.jpg

সিকদার আমিনুল হক / ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২-১৭ মে ২০০৩

তুলে রাখা নেবুফুল বাসি হয়ে এলো; কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে দিনমান, সন্ধ্যায় ফুরিয়ে গেল লাল গোলাপের ঘ্রাণ- তবু সে এলো না। অগত্যা, বিক্ষত পাহাড় ডিঙিয়ে, রাতের নক্ষত্র হয়ে তাকে উড়ে যেতে হলো আকাশের উড়ন্ত ডালায়।... সিকদার আমিনুল হক আমাদের ছকবাঁধা বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সরল জাগতিক বিবেচনাবোধের গভীর নিরিখ ছিঁড়ে যখন ২০০৩ সালের ১৭ মে হঠাৎ চিরশান্ত হয়ে আমাদের অবাক করলেন, তখন ঠিক এভাবে ভেবেছি তাঁকে, হয়তো অনেকে ভেবেছে আরো নিবিড়তায়।

আমাদের একাডেমিশিয়ান কতিপয় সমালোচক-বুদ্ধিজীবী এবং কিছু প্রথাবিমুগ্ধ কবি-লেখকের অসার রচনার বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল প্রচারের পাতাগুলো তাঁর গুরুত্বকে প্রায় ধারণ করতে পারেনি জীবিতাবস্থায়; এবং এখনও যে খুব পারছে, সে-কথা অকপট বলতে পারেন না কেউ। তাই তিনি দূরের নক্ষত্র হয়ে, তা সে যত দূরেরই হোক, যে আলো থেকে বঞ্চিত নয় কেউ; তিনি আলোকিত করেন তরুণ কবির কবিতার খাতা, পড়ার টেবিল থেকে সময়কে বুঝে নেবার উজ্জ্বল মেধাবী পাঠককে।

যদিও তা সর্বপ্লাবী ছিল না, তবু মধ্য উনিশ শতকে যে রোমান্টিকতার রিনরিনে ধ্বনি সারা পৃথিবীর কাব্যব্যঞ্জনায় অনুরণিত হলো, সেখান থেকে আজকের একুশ শতকের বাংলা কবিতায় নানা ভাংচুর দিকবদল-প্রতিবদলের স্বযাত্রায় কখনো তা সুররিয়ালিস্ট আবার কখনো ভুরভুরে রোমান্টিকতার গন্ধে গন্ধময় থেকেছে। সিকদার আমিনুল হক যখন বয়সে তরুণ, সদ্য কবিতাকর্মী, তখন সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়তায় কবিতা ছিনিয়ে নিয়েছিল সর্বোচ্চ আসন। তখনকার ইংল্যান্ডে কবিতা এবং কবিতাকে সঙ্গীতাকারে তুলে ধরার ভেতর দিয়ে হাজার হাজার পাঠক-স্রোতা-কবিতে যে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, তা পৃথিবীর অন্যান্য ভূখ-ের মতো তখনকার বাংলাদেশের কবিদের কাছেও হয়ে ওঠে ব্যাপক আগ্রহের বিষয়। একটি মাতাল সময় যাপন এবং গ্রহণের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা আন্দোলন। সিকদার আমিনুল হক সেই সময়ের কবিদের এক স্বতন্ত্র প্রতিনিধি হয়ে লিখেছেন দুহাত উজার করে। তিনি লিখেছেন তাঁর দুহাত প্রসারিত করে যতটুকু ধরা যায় ততটুকু এবং যেটুকু ছোঁয়া যায় না, তারও ওপারের কথা; লিখেছেন তার সময়, ঐহিত্য, ইতিহাস, প্রকৃতি; লিখেছেন ব্যক্তি এবং বিশ্বকে; লিখেছেন বাস্তবতাকে ডিঙিয়ে কল্পনার স্বপ্নশুভ্র অনাগত সব দিনলিপি।

সিকদার আমিনুল হক এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, পাঠকমাত্র তাঁর কবিতা পড়ে বুঝে-না-বুঝে ভাবতে বাধ্য হবেন যে, তিনি কবিতা কিংবা এমন কিছু পাঠ করছেন- যা তাকে সম্মোহিত করে

বিশ শতকের সূচনাপর্বে সারা ইউরোপ তথা বাংলা কবিতায়ও যে বোদলেয়ারীয় উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, তার প্রবহমানতা সহজে মিলিয়ে যায়নি। বিশেষ করে রবীন্দ্রোত্তর তিরিশের বাংলা কবিতা এবং বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের পূর্ববর্তী ষাটের দশকের কবিদের ভেতর সে উন্মাদনা ব্যাপকই প্রভাব বিস্তার করে। বলা যায় আমাদের ষাটের কবিরা সঙ্গত কারণে অনেকেই তিরিশীয় কাব্য ধারাকে মহার্ঘ মনে করে পথ হেঁটেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক উন্মাদনা ও বিশ্বব্যাপী কবিতা-কেন্দ্রিক নানামুখী মুভমেন্টের ঝড়ো হাওয়ায় বাংলাদেশের ষাটের কবিতা উচ্চৈঃস্বর-স্লোগান মুখিনতা থেকে গভীরতর উচ্ছলতায় সর্বত্র চষে বেরিয়েছে।

সিকদার আমিনুল হকের গুরুত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি সেই সমসাময়িক হয়েও সেই উন্মাদনার ভিড়ে গা এলিয়ে দেননি। তিনি যে কাব্যিক প্রমত্ততায় নিজেকে নিঃশব্দ পেঁচার মতো আড়াল করে কবিতা লিখেছেন, সে ধারা তার একান্ত নিজের, নির্জন

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/10Jun21/news/shikdar-aminul-haque-2.jpg

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (ডান দিক থেকে তৃতীয়), স্ত্রী মাসুদা আমিন জলি (সর্ব বাঁয়ে) ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সিকদার আমিনুল হক

এবং মানবিক অস্তিত্বের গভীরতর শেকড় পর্যন্ত তার যাত্রা। তাঁর সেই স্বনির্মিত কাব্যভাষা তাঁর সহজাত কবিপ্রতিভার ঠাস বুননে নিবিড়ে বসে নির্মাণ করেছেন। প্রবল সতর্কতা, সচেতনতাকে ধীরে ধীরে মুঠোবন্দি করে আমাদের বাংলা কবিতাকে যে নতুন ধারার গতিময়তা এনে দিয়েছেন, তা আমাদের সমসাময়িক কবিদের ভেতর বিরল অবশ্যই। সিকদার আমিনুল হক এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, পাঠকমাত্র তাঁর কবিতা পড়ে বুঝে-না-বুঝে ভাবতে বাধ্য হবেন যে, তিনি কবিতা কিংবা এমন কিছু পাঠ করছেন- যা তাকে সম্মোহিত করে। সিকদারের এই সম্মোহন-প্রতিভা হঠাৎ করে বা একদিনে তৈরি হয়নি, তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, তার যাপিত অভিজ্ঞতা, তার নিরালস্য ভ্রমণ পিপাসা তাকে এ ক্ষমতায় স্থিত করেছে। কারণ সিকদার আমিনুল হক সেই ক্ষমতাধর কবি যিনি কবিতার সব শর্ত পূরণ করে চারপাশের যা-কিছু দৃশ্যময়তাকে কবিতা করে তুলতে পারেন। যা কেবল কোনো মহৎ কবিই আয়ত্ত করতে পারেন। সিকদার আমিনুল হকের গুরুত্ব এখানে যে, তিনি দেখার ভেতর দিয়ে সমস্ত বর্ণ বা আশরাফ আতরাফের ভেদাভেদকে একাকার করে সমান্তরাল করে দেখে অভ্যস্ত; তাই তিনি ব্যাপক বিত্তবৈভবের মধ্যে বসেও এই পৃথিবীর সমগ্র মানব সমাজকে ভেবেছেন একই পরিবারভুক্ত। শুধু তাঁর কবিতার ক্ষেত্রেই নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আপন ভুবনেও সিকদার আমিনুল হক ছিলেন একজন সত্যিকারের আধুনিক মানুষ। তাঁর সচ্ছল-স্বছন্দ জীবন আর সংস্কারমুক্ত উঁচু মানসিকতার কারণে তাঁকে অহঙ্কারী, গরুগম্ভীর চরিত্রের কেউ কেউ ভেবেছেন হয়তো, কিন্তু তাঁর একান্ত সান্নিধ্য পাবার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে, কেবল তারাই বলতে পারবেন তিনি কতটা তার উল্টো স্বভাবের মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত মোলায়েম আর মৃদুভাষী এই শব্দশিল্পীর মানুষকে কাছে পাবার আকাক্সক্ষা ছিল দুর্বার। নিতান্ত লাজুক স্বভাবের কারণে তাঁর বন্ধুভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল না, কিন্তু নিজেকে কখনো তিনি বন্ধুশূন্য ভাবেননি, কারণ শব্দ আর সাদাপাতাই ছিল নির্লোভ এই কবির সারাক্ষণের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ সত্যতা প্রমাণে তাঁর একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তির উল্লেখ প্রাসঙ্গিক:

রিভুর ধারণা আমি খুব অহঙ্কারী

খানিকটা সত্য এর, কানিকটা নয়;

ওই-ই কথা বললো না, হাসলো শুধুই

বললে আমিও বলতাম নিশ্চয়।

আধুনিক মানবমনের ক্রমবর্ধমান জটিলতা, অস্তিত্ব সংকট, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বিলাসিতা, শৌখিনতা, নস্টালজিয়া, কাতরতা- সবকিছুই খামচে খামচে গেছে তাঁর কবিতাকে।

ব্যাপক প্রভাবশালী তিরিশের দশকেই বাংলা কবিতা রোমান্টিকতামুক্ত হয়ে বাস্তবতাকে অতিক্রম করে অতিবাস্তব চরিত্র ধারণ করে গতিময় হয়ে ওঠে। আগেই বলেছি, সিকদার সে গড্ডলে গা এলাননি। তিনিও বাস্তবতাবিরোধী একটি ধারার অনুসারী ছিলেন বটে, তবে তা তার নিজের মতো করে খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশ শতকের সূচনালগ্নের কয়েকজন ফরাসি সিম্বলিস্ট বা প্রতীকবাদী কবিদের দ্বারা তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এবং আমাদের বাংলা কবিতায় তিনি সে ধারারই একজন উজ্জ্বল প্রতিনিধি। তিনি প্রভাবিত হন সমসাময়িক জার্মান সাহিত্য এবং স্প্যানিশ কবিদের দ্বারা। বিশেষ করে ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতায় তাঁর মগ্নতা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সে-সময়ের কয়েকজন প্রতিনিধিত্বশীল ফরাসি কবির কবিতার মতো সিকদারের কবিতা একইসঙ্গে রোমান্টিক, অতিবাস্তব এবং প্রতীকবাদী চরিত্র ধারণ করে। ফরাসি কবি পল এল্যুয়ার, আঁরি মিশো, জাক প্রেভের, রনে শার, ফ্রাঁসিস পঁজ-এর কবিতার স্যুররিয়ালিটি এবং রোমান্টিকতা সিকদার আমিনুল হককে ভূতে পাওয়ার মতোই পেয়ে বসে। বিশেষ করে জাক প্রেভের যে তাঁকে কীভাবে আলোড়িত করেছিল প্রেভেরকে নিয়ে লেখা ‘প্রেভের তোমাকে বলি’ কবিতায় তার কিছুটা আভাস লক্ষণীয়:

প্রেভের আমিও বসি রেস্তোরাঁয়। সন্ধ্যা ঘন হয়।

টেবিলে টেবিলে আসে মানুষের ঝাঁক। কাপ-ডিশ,

চামিচের আড়ালে গল্পের চারাগাছ।...

এখন সিকদারকে যারা ফরাসি কবিতার প্রভাবদুষ্টতায় অভিযুক্ত করতে ছাড়েন না, তারা একথা কি কখনো আমলে আনেন যে, মহত্তম কবি জীবনানন্দ দাশ ইউরোপীয় ছাচে বাংলার নদী মাঠ নিসর্গ বসিয়ে আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বিই থেকে গেলেন? আর একই কায়দায় সিকদার আমিনুল হকও যে মদের গ্লাসে রঙিন তরলের পাশাপাশি বাংলার আকাশছেঁড়া বৃষ্টির জলও ধারণ করেছেন, বিরান মাঠ জুড়ে নগরের পাশাপাশি বুনো লতা, শালবনের বেড়ে ওঠা দেখেছেন; এ-জন্য তাঁর কবিতার বাইরে বেরিয়ে আমাদের প্রমাণ খুঁজতে হয় না:

আমি বাংলার সদর্পিত ঘোষণার ধানখেত, মাছরাঙা ও কাদাখোঁচা, বাঁশঝাড় দেখার ফাঁকে ফাঁকে জলটলটলে সাতাশটা পুকুর দেখার প্রাণান্ত চেষ্টার পর গণনাই ছেড়ে দিলাম।...

[পুকুরে জল নাই / আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি]

এরপরও সিকদার আমিনুল হক ষাটের একজন অন্যতম রোমান্টিক কবি বলেই বিবেচিত হবেন বলে বিশ্বাস। একথা বললে বেশি বলা হবে না যে, তিরিশ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় সিকদারের মতো এতোটা বিশুদ্ধ রোমান্টিক কবি আর সচরাচর দেখা যায় না। সে-অর্থেও সিকদার আমিনুল হক সমকালীন বাংলা কবিতায় এককভাবে স্বতন্ত্র বলতে হবে।

চোখে দেখার কিংবা ব্যক্তিগত অনুভূতির শুভ্রতা তা যত গোপনই হোক, নিরন্তর কাত হয়ে টেবিলে পড়ে থাকা কবির কাছে তা আর লুপ্ত কোনো ব্যাপার হয়ে থাকে না। পাঠকের মুখোমুখি হবার যে ব্যগ্রতা তা কলমের নিবে বসে উদগ্র হয়ে ওঠেই। আর এই একান্ত ব্যক্তিগত চোখ দিয়ে যিনি বিশ্বকে পরিমাপ করে নেন, তিনি ভাবেন এই ব্যক্তির মধ্যেই বসবাস সমগ্র ভূগোল। সিকদার আমিনুল হক সেই অনুভূতিদগ্ধ কবি; যিনি অনুভব করেন ব্যক্তির মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই পৃথিবী অসাড়-নিরর্থ হয়ে পড়ে। তিনি মনে করেন ভিড়ের মধ্যে যে জীবন, ব্যক্তির সূক্ষ্মতর অনুভূতি সেখানে অচল। বরং নির্জনতার নিঃশব্দ ভুবনে যিনি যুগযন্ত্রণা-জীবযন্ত্রণাকে সেলাই করতে জানেন, তিনি প্রকৃত কবি। আর এই মানচিত্রের সূক্ষ্মদর্শী পরিব্রাজক সিকদার আমিনুল হক তাঁর নির্জন ভুবনে বসে ঘোষণা করেন : ‘মৃত্যু বাঁধা রাজপথে আমার কবিতা অচঞ্চল/শহুরে গ্রামীণ নয়, অন্ধকারে শুধু অগ্রদূত।’ কোথা থেকে আসে সিকদার আমিনুল হকের কবিতা? তাঁর কবিতা ও কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাঁর জবানীতেই শোনা যাক মাত্র কয়েক পঙক্তি:

বিষয়বস্তুর জন্যে আমার কবিতা অস্তিত্বের

শঙ্কা নিয়ে নৈশ জাগে। ম্রিয়মাণ আমি ও কবিতা

দীঘিতে সাঁতার কাটি বাঁচার ইচ্ছায়;

যাই পর্বতের শীর্ষে, লোকে বলে দুর্ধর্ষ ট্রেকার

অথবা মরুতে জেদী যাযাবর, ছুটি তেপান্তরে;

রাখালের সঙ্গে ঘুরি ক্লান্ত মেষ পালকের বেশে।

সরাইখানায় গিয়ে পান করি আমি ও কবিতা

গাঢ় দ্রাক্ষারস, জুয়ো খেলি সারারাত্রিভর।...

বিষয়বস্তুর জন্যে আমার কবিতা আর আমি

গেছি নষ্ট মহিলার দুয়ারে।...

বিষয়বস্তুর জন্যে খুঁজে আনে শাগালের ছবি

আমার কবিতা। কিংবা গান্ধারের বিপুল ঐশ্বর্য,

মননের চিত্র, গীতি, মরমীর অচিন পাখিকে-

[আমি ও আমার কবিতা/আমি সেই ইলেক্ট্রা]

অস্তিত্বের আশঙ্কায় শঙ্কিত কবি সারারাত জেগে জেগে কবিতা খোঁজেন। তার জানালায় মৃত্যু, করিডোরে মৃত্যু, ড্রইং রুমে বসে কফি কিংবা আকণ্ঠ রঙিন মদে উন্মাতাল হয়ে তাঁকে পাহারা দেয় মৃত্যু। চিরস্থায়ী রুগ্ণতা আর মৃত্যুর ভয় এই রোদ-জোছনভরা পৃথিবী থেকে তাঁকে তুলে নিতে চায়। তিনি বন্ধুদের সাক্ষী রেখে বলেন, ‘বন্ধুরা হয়তো জানো, শরীরের কেন এত মুগ্ধ মৃত্যুভয়।’ আর এই অনিবার্য মৃত্যুর কথা ভেবেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। নিয়তিকে প্রভু ভেবে মগ্ন থাকেন না প্রার্থনায়। বরং সভ্যতার আড়ালিপনাকে উপহাস করে তিনি শুচিশুভ্র মুখোশের গভীর থেকে তুলে আনেন জীবনকে যথেচ্ছ উপভোগের সত্য। তিনি মনে করেন, আমাদের সভ্যতার ভাড়ামোর আড়াল থেকে মানুষের স্বাস্থ্যকর জৈবিক জীবনকে কখনো কুয়াশা মুছে দেখা হয় না ঝকঝকে স্বচ্ছ আয়নায়। যা কিছু অসামাজিক, অনৈতিক তার গভীরেই যে নিদ্রামগ্ন নান্দনিক শৌখিনতা, আসক্ত সুন্দর- তা সিকদার আমিনুল হকের কবিতার ভ্রমণের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাই তাঁর কবিতায় বারবার ঘুরেফিরে আসে শাওয়ারের শব্দ, শেমিজের ঘ্রাণ, ব্রা, অন্তর্বাস, মধ্যরাতের পানশালার টুংটাং শব্দ, সাদাত্বক, নারীর স্তন, প্রেমিকার গাল, বালিকার নগ্ন স্নান, চুম্বন, ওষ্ঠ ইত্যাদি শব্দসখ্যের তীব্রতা।

প্রচলিত ছন্দকে সিকদার আমিনুল হক যথেচ্ছ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন তাঁর ছন্দকৌশলের যাদুকরী ক্ষমতা। বিশেষ করে তিনি তাঁর কবিতার দীর্ঘকালের অদ্বিতীয় সঙ্গী করে নিয়েছিলেন অক্ষরবৃত্তকে। আধুনিক মানবমনের নিরাভরণ-নান্দনিক উপস্থাপনাকে অক্ষরবৃত্তেই তিনি শ্রেষ্ঠ আশ্রয় খুঁজে দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে সমসাময়িক অনেক মহৎ কবির সমগোত্রীয় তিনি। এর বাইরে তিনি ফ্রি ভার্স বা মুক্ত টানাগদ্যে কবিতা লেখার বিপজ্জনক পথে হেঁটেও সফল হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘সতত ডানার মানুষ’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠই যথেষ্ট মনে করি। প্রচলিত ছন্দকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার ঔদ্ধত্য খুব কম কবিই দেখাতে পারেন। এ বিষয়ে সিকদারের ক্ষমতাকে পরখ করতে তাঁর অক্ষরবৃত্তের চালকে স্মরণ করা যেতে পারে। এ চালে তিনি সাবলীলভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন মুক্তক বা টানা গদ্যের আবেশ। বলতে পারেন যা খুশি তাই; যেমন খুশি তেমন করে। আর এমন ক্ষমতাধর কবিই যে পারেন তার চারপাশ, সময়, দৃশ্য-অদৃশ্যময়তাকে মুহূর্তে কবিতা করে তুলতে- এ সত্য লুকিয়ে থাকে কবির পঙ্ক্তিঘোরের অপার রহস্যে। সহজ সাবলীল অথচ কবিতার সব শর্তকে পূরণ করে সিকদার আমিনুল হক তাঁর শেষ বইতে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর ষাটের দশকের একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন এভাবে টানা গদ্যে :

নিশাত সাদানী ছিল উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার গ্রীবা গলদা চিংড়ির মতো; কটি বাচ্চা ঘোটকীর মতো সরু আর নিতম্বকে মনে হ’তো জলোচ্ছ্বাস কিংবা জোয়ারের মতো।

আমাদের ষাট দশকের তরুণদের ইচ্ছা আর স্বপ্ন এই ভাবে, তার রূপকে অসম্ভব থেকে সম্ভব করেছিলো। আমরা তার চলে যাওয়ার অন্ধকারে রাত্রি আর ঝাউয়ের গন্ধ পেতাম।

তার বাবা জানতেন দুর্দান্ত ফার্সি। তার রক্ত লাল নয়। আমাদের মন বলতো, এই রক্ত সাদা আর তাবরিজের শীতের বরফের মতো ঠা-া।... গ্রীষ্ম তার সহ্য হ’তো না; লম্বা কুর্তা আর সালোয়ার খুলে সে হাফ প্যান্ট পরে অনাবিল স্বস্তিতে ঘুরে বেড়াতো বাগানে কিংবা বারান্দায়। তার উন্মুক্ত নিম্ন শরীরের চর্বি ছিল নীল। শিরার শাখা-প্রশাখা ঘন সবুজ।

ষাট দশকের বাস্তবতা। ঢাকার আকাশে তখন অনেক নক্ষত্র ছিলো। নীরবতা ছিলো। নিশাত সাদানীর মতো রূপসীরা ছিলো। তখন বাজারে আপেলের পাশে ছিলো আঙুরের ঝুড়ি। লোভ ছিল, কিন্তু আমাদের হাতে পয়সা ছিলো না।

[নিশাত সাদানী/আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি]

এভাবে না বাস্তব না সত্যকে আলো আঁধারির মাধ্যমে তুলে ধরে সম্মোহিত করার ক্ষমতা ষাটের কেবল সিকদারেরই ছিল বটে। তিনি আমাদের স্বপ্নের মতো টেনে নিয়ে যান আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের যেন অবিকল বাস্তবতায়।

সিকদার আমিনুল হককে যে সকল ফরাসি কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কথা বলা হয় তাদের অন্যতম, ফরাসি স্যুররিয়ালিস্টদের ভাষায়, মধ্য বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি পিয়ের র‌্যভেরদি মনে করতেন, “সত্যিকারের কবিতা ডানায় ভর দিয়ে উড়ে আসে। তাকে বানানো যায় না।” সিকদার এ কথা মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করতেন। এ কথাকে অকাতরে স্বীকার করে তিনি বলেছেন- “আমার কাজ কবিতা লেখা, শুধুই কবিতা লেখা। সৌভাগ্য একটাই, আমার কলম এখনো থামেনি। লেখাকে দৈব ব্যাপার ব’লেই ছেড়ে দিয়েছি; ভালো লেখার চেষ্টা থাকতে পারে- কিন্তু সফলতা-অসফলতার হাতে কবিকে শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এটা একান্তই আমার অভিজ্ঞতা; অন্যদের ভিন্ন ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেও আমি মূল্য দেই।” কিংবা সিকদার আমিনুল হক মূল্য দিয়েছিলেন পল ভালেরির নিভৃত দিনপঞ্জিতে উচ্চারিত সেই অমোঘ সত্য : “স্নায়ুই হলো সবচেয়ে বড়ো কবি।”

যে কবিতা বানানো যায় না, অথচ কবিই তা রচনা করেন, যে কবিতার জন্য কবিকে অপেক্ষা করতে হয় প্রহরের পর প্রহর, অথচ তা শেষ পর্যন্ত কবির হাতেই শৃঙ্খলিত হয়; যে কবিতা কোনো মহাবিদ্যালয়ের গবেষণাগার কিংবা নির্মাণশালায় নির্মিত হয় না, তাকে দৈব বলেই ছেড়ে দিয়েছেন যে কবি, সেই সিকদার আমিনুল হকের কবিতার স্বাতন্ত্র্য কিংবা গুরুত্বকে অনুধাবনের মতো প্রকৃত সমালোচকের অভাব হয়তো আরও দীর্ঘদিনই থেকে যাবে; কিন্তু ঈর্ষাকাতর বন্ধুদের মরচেধরা লোহার দরজা ভেঙে যে যুগে যুগেই বেরিয়ে আসবেন একজন বুদ্ধদেব বসু কিংবা মোহিতলাল মজুমদার- এ সত্য নির্মমতর। সমসাময়িক কবিবন্ধুদের উত্তর-উত্তর খ্যাতির করাতে একটুও আহত হননি যে কবি, কিংবা নিজেই সূক্ষ্মতর বালুকণা হয়ে ঝিনুকের আড়ালে শুয়ে কেবলই অতলের দিকে যাত্রা করেছিলেন যিনি মুক্তো ফলাতে; আপাত অন্ধকার তাকে মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো সাময়িক গ্রাস করলেও সেই অনর্থ মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে তিনি ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে বেরিয়ে আসছেন তাঁর মৃত্যুর এত বছরের পরেও। যখন কবিদের মার্কেটখ্যাত আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো থেকে কেবলই শেষ হয়ে যায় সিকদার আমিনুল হকের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই; কিংবা ‘দূরের কার্নিশ’ কিংবা ‘পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা’ কিংবা ‘তিন পাপড়ির ফুল’-এর মতো দু®প্রাপ্য বইগুলোর জন্য আজকের একজন তরুণ কবিতাকর্মী হন্তদন্ত হয়ে খুঁড়ে বেড়ান নীলক্ষেত কিংবা পল্টনের বইয়ের দোকানগুলো- তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন কবি সিকদার আমিনুল হক।

তাঁর আরও পরিণত কাব্যগ্রন্থ সতত ডানার মানুষ, কাফকার জামা, রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা, বাতাসের সঙ্গে আলাপ, লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেল এবং আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি। সিকদার আমিনুল হকের কবিতা যেন আরো বেশি সমৃদ্ধ ও বিস্ময়সৌন্দর্য ধারণ করে প্রকাশ পাচ্ছিল তাঁর শেষ বছরগুলোতে। এমনকি তাঁর শেষ লেখা কবিতাটিতে পর্যন্ত তাঁর সাবলীলতা, স্বাতন্ত্র্য, চিত্রকল্প নির্মাণের অভিনবত্ব সমকালীন বাংলা কবিতায় কেবল বিরলই নয়, দু®প্রাপ্যও যে বটে। কবি সিকদার আমিনুল হক আমার দেখা অনন্য আর নিপুণ এক শব্দভাস্কর। তাঁর কবিতার পাঠক হিসেবে আমার অহঙ্কার আছে।

back to top