alt

সাময়িকী

সিকদার আমিনুল হক স্বতন্ত্র ও নিমগ্ন কাব্যসাধক

জয়নাল আবেদীন শিবু

: বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

স্ত্রী মাসুদা আমিন জলি, দুই পুত্র মিশা ও বান্টির সঙ্গে কবি সিকদার আমিনুল হক

সিকদার আমিনুল হক ষাটের দশকের অন্যতম কবি। ষাটের দশক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় জাগরণের গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। শিল্প-সাহিত্যে এর প্রভাব উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠেছে। এ সময় বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীগণ সংক্ষুব্ধ লেখনি ও শিল্পকর্ম দিয়ে ক্ষোভে বিক্ষোভে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেদের শামিল করে নিয়েছেন। এই স্লোগানমুখর সময়ে বাংলা কবিতায় সিকদার আমিনুল হকের আগমন হলেও স্লোগানধর্মিতা তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিবড়িতার মধ্য দিয়ে, নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কাব্যভাষার একটি পথ বেছে নিলেন। পরাবাস্তবের, বিমূর্ততার সে পথ সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় শাখা মেলতে থাকে শুরু থেকেই। অনন্য এক কবিভাষা লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায়। ষাটের অন্য কবিদের মতো সিকদার আমিনুল হকও স্বতন্ত্র পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। ‘ষাট দশকের কবিতায় প্রায় সকলেই প্রথম থেকে স্বতন্ত্র হয়েছিলেন। সিকদার আমিনুল হকও প্রথম থেকেই স্বতন্ত্র। ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে তিনি লিরিক কবিতা এবং গদ্য কবিতায় বিশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন।’ মাসুদুল হকের এ কাব্যবিচার যথার্থই। সিকদার আমিনুল হকের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইদানীং আমার পড়া হলো। পাঠক হিসেবে স্পর্শ করেছে তাঁর কবিতাগুলো। একসাথে অনেক কবিতা পড়ায় কবি-সত্তাকে বুঝে নিতেও সহায়তা হয়। তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে বিমূর্ত ভাবনার বুনন, খুব গভীরে জীবন জাগ্রত। মগ্নতার, ভাবালুতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যায় তাঁর কবিতার ক্যারেকটার। কবিতায় নিবিড় এক কবির নাম সিকদার আমিনুল হক। কবিতার প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা তাঁকে ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে গেছে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর চেতনালোকে হৃদ্ধ হয়ে উঠেছে কবিতাগুলো। সচেতন শিল্পসত্তার অধিকারি আত্মবিশ^াসি কবি আমিনুল হক। হৃদয়ে ধারণ করেছেন বিশাল এক সমুদ্র, যার জলরাশি কাব্যতৃষ্ণায় উন্মুখ। কবির কাব্যতৃষ্ণা আরো প্রবল হয়ে উঠেছে বাস্তব জীবনের নানা অভিঘাতে। প্রেম, হতাশা, বিতৃষ্ণা, জীবনের দুঃখ-দুর্দশা, বঞ্চনা, রাষ্ট্রশক্তির সীমাহীন শোষণ, আগ্রাসন কবির অনুভূতিতে ব্যাপক স্পন্দন তোলে। এগুলোই তাঁর কবিতায় রূপায়িত হয়ে ওঠে বিমূর্ত ব্যঞ্জনায়। কবির মনন বিশে^র ব্যাপক ক্যানভাসে স্থান পেয়েছে বস্তুবিশে^র বহু বিষয়। জীবনের ছোটোখাটো বিষয়ও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে নতুন কাব্য সৌন্দর্যে। একটি সাধারণ বিষয়কেও কবিতায় উপজীব্য করে তোলেন সুন্দর অবয়বে। আমিনুল হকের কবিতায় ভাব এবং ভাষা সান্ধ্যভাষার মতো আলো আঁধারি থাকলেও বোদ্ধা পাঠকের কাছে তা অস্পষ্ট হবে না। প্রাত্যহিক ব্যবহারি চেনাজানা শব্দের বুননে তাঁর কবিতা ধারণ করে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। কিছুটা ধরা কিছুটা অধরার ভেতর দিয়ে পাঠককে টেনে নেবে এক ভালোলাগার মোহনায়। পঞ্চাশ-ষাটের কবিতায় অহেতুক অস্পষ্টতা খুব বেশি নেই। বাংলা কবিতায় এই স্পষ্টবাদিতা ত্রিশের পর থেকে লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে কাব্যের বিশেষত্বটাও লক্ষ্যণীয়। অগ্রজ প্রথাবিরোধিতা ভেঙ্গে পরিচিত শব্দ প্রয়োগে নৈঃশব্দ্যের, নন্দনের চাষবাসে আধুনিক কবিতা আরো রূপময়ী, মমতাময়ী হয়ে উঠেছে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিদের হাতে। এসময়ের কবিতায় তাই অধিকতর মানবিক, সামাজিক এবং শৈল্পিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। পুরাতন পথ বেয়েই সব সময় নতুন নতুন পথের সৃষ্টি। কবিতায়ও তেমনি। পুরাতন নিয়ে দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে না কবিতা; নতুনত্বই তার প্রাণ। আর সেই প্রাণ সঞ্চারে প্রাগ্রসর ¯্রষ্টা ও দ্রষ্টাদের শিল্পদৃষ্টিই সমকালে নতুন শিল্পভাবনা হিসেবে সংস্থিত হয়ে ওঠে। ষাটের কবিতায় তেমনি সিকদার আমিনুল হকের মৌলিকত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনের সমূহ সংযোগ রয়েছে তাঁর কবিতায়। একের ভেতর অনেকের উপস্থিতি নিয়েই তাঁর কবিতা। একটা কবিতাংশ পড়ে নেয়া যেতে পারে-

তোমাকে আমার চাই, এই কথা ভুলি না কখনো!

আফিসের দায় সেরে যখন রিকশায় বাড়ি ফিরি,

লাঞ্চে রেস্তোরাঁয় গিয়ে এই মন্ত্র জপি মনে মনে

তোমাকে আমার চাই। যে স্লোগান বেতন বাড়াতে

সচিবালয়ের গেটে আসে, তার সাথে ভিড়ে গিয়ে বলি

তোমাকে আমার চাই। সকালে গলির মোড়ে গিয়ে

সেলুনের শাদা ফেনা গালের কৌতুকে বসে গেলে

কবিতার বিষয়বস্তুকে আমিনুল হক মুক্তি দিয়েছেন। প্রাত্যহিক জীবন যাপনের প্রতিফলনই তাঁর কবিতা। প্রতিদিনের দুঃখ-কষ্ট, কামনা-বাসনা, ব্যর্থতা কবির জীবন যাপনে নানাভাবে নাড়া দেয়, চেতনাভূমে জমা হতে থাকে। কবিতায় অনায়াসে রোপিত হয়ে ওঠে এগুলো। কবিতা তো জীবনের টুকরোটুকরো রোদ্দুর, ছিটেফোঁটা বৃষ্টির কোলাহল, খসে পড়া পাতা। শাস্ত্রজ্ঞান দিয়ে সবসময় কবিতা বিচার হয় না। পার্থিব শৃঙ্খলা আর জীবনলীলার বাহিরেও কখনো কখনো কবির বীক্ষায় কাজ করে পরাবাস্তববাদের চলিষ্ণু চেতনা। যুক্তি ও জীবনকৃত্য তখন গৌণ হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্ন এলোমেলো স্বপ্নও চৈতন্যে বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে কবির মনোলোকে। অবচেতনেও তখন সুন্দর অবয়বে প্রতীকায়িত হয়ে ওঠে মন-মস্তিষ্ক-প্রসূত বোধ-ভাবনার বিস্তার। এই অনস্তিত্বের মাঝেও কবি খুঁজে চলেন স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব। শিল্পে এটি পরাবাস্তববাদী চেতনা। আধুনিক শিল্প সাহিত্যে এর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। পরাবাস্তববাদে যুক্তির চেয়ে অবচেতনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশেরই প্রাধান্য বেশি। সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় পরাবাস্তববাদী চেতনা লক্ষ্য করা যায়। পরাবাস্তববাদীদের মতে, ‘যুক্তির জাল জীবনের ও মানুষের নিহিত শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যুক্তি-বুদ্ধি-চেতনা এসব হচ্ছে ভাবনার প্রথাগত পদ্ধতি। এগুলো মানুষের কল্পনা ব্যাহত করে। যুক্তির প্রভাবে সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়।’ যুক্তিমুক্ত মনের কল্পনাই চৈতন্যের স্বাধীনতা, পরাবাস্তববাদিতা। আর এ চেতনায় সুন্দরের শৃঙ্খলা নিহিত। এ বিষয়ে কবি ওবায়েদ আকাশের মতামত- “ননপ্রফেশনালিজম আরো বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ। আর একটু ভেবে বললে বলা যায়, ননপ্রফেশনালিজমের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে, প্রফেশনালিজমের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যে অন্য আরেক রকম উচ্ছৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে যাত্রা- সেটাই হচ্ছে শিল্পের সত্যিকারের স্মার্টনেস।” এই স্মার্টনেসের প্রকাশ ঘটেছে সিকদার আমিনুল হকের কবিতায়-

অন্যসব আলো অন্ধকার এখানে ফুরালো

লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো

এখানে; এই খানে মৃণালিনী ঘোষালের শব

ভাসিতেছে চিরদিন: নীল লাল, রুপালী নীরব।

কিংবা,

রাত্রি মানে বিড়ালের মতো চাঁদ; অতিশয় শাদা

জ্যোৎ¯œা নিশ্চয় চায় একপাশে কোলস্টোরেল ছাড়া

স্যালাদের নির্জনতা।

এই যে লাল নীল মাছ মেঘ-ম্লান নীল জোছনার আলো, মৃণালিনী ঘোষালের শব চিরদিন ভাসছে রুপালী নীরব। কথাগুলো আপাত বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে। এই যে রাত্রি মানে বিড়ালের মতো চাঁদ- কবির এ দেখাও সঠিক। বিমূর্ততার বুননে ‘বেড়ালের মতো চাঁদ’ মূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের সামনে। কবির অবচেতনে, মর্মচক্ষে রাত্রিকে বেড়ালের মতো দেখার মাধ্যমে নান্দনিকতার বহির্প্রকাশ ঘটে কবিতায়। আমিনুল হকের অনেক কবিতাই এরকম লাবণ্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

সময়ের অভিঘাত, ক্লেদাক্ততা যাপিত জীবনের নানা টানাপোড়েন আমিনুল হকের কবিতার পরতে পরতে প্রোথিত রয়েছে। সামাজিক জীব হিসেবে আমরা কেউই বৃত্তাবদ্ধ জীবনের বাইরে নই, আমাদের চলমান জীবনে ঘুরেফিরে সুখ-দুখ, বেদনা, বিরক্তি, হতাশার কালোছায়া ফেলে যায় ভেসে চলা বাতাসের নাও। এই ক্লেদাক্ততা সব সময় শিল্পের সংকট তৈরি করে করে না; ধ্যানীদের কর্মে আরো একাগ্রতা, নিবিষ্টতাও বাড়িয়ে দেয়। বিষণœ সন্ধ্যাও কবির দগ্ধবুকে সৃজনস্পৃহা বাড়িয়ে তোলে। ‘আছি বিকল্প সুখে’ কবিতায় বাহ্যিক দৃষ্টিতে কবির বেদনা-বিধূরতা ফুটে উঠলেও এর অর্ন্তনিহিত তাৎপর্যে দেখা যায় কবিমনের বিপ্রতীপ ভাবনা সৌন্দর্যে ভরে ওঠে- জীবনঘনিষ্ঠতায়।

এখানে নামছে সন্ধ্যা বিশ^হীন বিষণ্ন বাড়িতে;

রোজ নামে এই ভাবে, চোখে দেখি নিকম্প স্তব্ধতা

আর জুজু বুড়ি হরেক রকম! অবশ্য সন্ধ্যাই

নয়, সারাদিন যত খুঁটিনাটি সস্ত্রস্ত সঞ্চয়

জমেছে আঁধার ঘরে, হৃদয়ের আনাচে-কানাচে

রক্তহীন অন্তস্থলে সব যেন দীর্ঘ বর্শা হাতে-

ছুটে আসে প্রান্তরের দস্যুদল। আমি যে বন্দিনী

সম্ভ্রান্ত সুঠাণ্ডা ঘরে অলৌকিক সম্পদের ভারে

এ কথা দস্যু জানে। -আলোকের নিচে

ধর্ষণের আশঙ্কায় এঁটে দিই স্বেচ্ছায় দরজা।

সিকদার আমিনুল হকের প্রেমের কবিতা নান্দনিকতায় ঋদ্ধ। তাঁর প্রেম চেতনা কেবল আবেগময় উচ্ছ্বাস নয়, সুনীতি ও সৌন্দর্যের প্রতি একনিষ্ট। কবির প্রেমের কবিতায় দেখা যায় ব্যক্তিক কামনা-বাসনার চেয়ে প্রেমার্ত হৃদয়ের শাশ্বত আর্তি নৈর্ব্যক্তিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাঁর প্রেমের কবিতায়, কথায় প্রতীকের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় মানব মনের নানা আকাক্সক্ষা। নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে কবির প্রেম-চেতনা। বাড়িয়ে তোলে কবিতার বাহ্যিক সৌন্দর্য।

সিকদার আমিনুল হক নিবীড়তার কবি, নিমগ্নতার কবি। মাঝে মাঝে নিশুতি রাতের নীরবতাও খুব উপভোগ করেন। যন্ত্র দুনিয়ার জঞ্জাল থেকে একটু আড়ালে, একান্তে নিসঙ্গতাও যে যাপনের একটা বিষয় হতে পারে, সিকদার আমিনুল হকের কবিতা তা শিখিয়ে দেয়। নিসঙ্গতাকে স্বাচ্ছন্দ্যে যাপনের জন্য তেমন মন চাই। নিসঙ্গতাও কখনো কখনো নতুন উদ্যমে, উৎসাহে কর্মচাঞ্চল্য নিয়ে আসে। আবার সবকিছু ছেড়েছুড়ে একেবারে আয়েশে সাদা বিছানায় দেহ এলিয়ে দেয়ার মাঝেও আছে পরম আরামবোধ। কবির এ অন্তর্মুখিতা লক্ষ্য করি-

এখন বরঞ্চ ভালো লাগে কাক, মূঢ় একাকিত্ব

দুপুরের রোদ ভাঙ্গি, ভালো লাগে নর্দমার ধ্যান-

গলির উড়ন্ত বৃষ্টি, চাপকলে ভিখিরির তৃষ্ণা,

অন্ধকার গাছপালা, পরিচ্ছন্ন ডবল ডেকার।

আকণ্ঠ ডুবিয়ে দেহ ভালো লাগে শাদা বিছানাকে;

রাজনীতির উত্তাল সময়ের কবি আমিনুল হকের কবিতায় রাজনৈতিক চেতনাও উল্লেখযোগ্য, তবে তা স্লোগানধর্মী নয়। সমকালীন রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতরেই একজন কবির বসবাস বলে কবিতায় এই অনুষঙ্গ স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে। শধু কবিতায় কেন, সকল শিল্প মাধ্যমেই সমকালের চেহারা সবচেয়ে বেশি ফোকাস করে ওঠে। সিকদার আমিনুল হকের অনেক কবিতায়ই প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে বা প্রতীকের মাধ্যমে রাজনীতি চেতনা উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কবির আত্মজ মিশা যখন রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে, দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে এক সময় দেশ মাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুতি নেয়। আত্মজের ইতিবাচক আচরণে পিতা গর্বিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু আশঙ্কাও কাজ করে ভেতরে ভেতরে। আত্মজ যে বখাটে হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা নয়। আশঙ্কা করেন- দেশের প্রতি আত্মজের প্রেম কতটা প্রগাঢ় হবে। কেননা প্রকৃত দেশপ্রেমিককে বৈষয়িক মোহ মায়া ত্যাগ করে নিজেকে দেশের কাজেই ব্যয় করতে হয়। খাটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে কবি আত্মজের মনোবল বাড়িয়ে দিতে চান। স্বদেশপ্রেম যাদের সত্তায় ধারণ করেন- এই ঘাতকের দেশে তারাই আগে ফুরিয়ে যায়, ঘুমের দেশে চলে যায়। কবিতায় ‘এই ঘাতকের দেশে’ ‘দুঃস্বপ্নের দেশে’ উচ্চারণের মাধ্যমে কবি স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের স্বৈরাচারি শাসন, শোষণের বিরুদ্ধে স্পর্ধিত ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রের অন্যায়কে অন্তর থেকে ঘৃণা করেন বলেই ফলাও করে তুলে ধরেন এমন অসংগতি। ‘আত্মজের প্রতি’ কবিতাটি উপস্থিত করলেই আমিনুল হকের কবি-মানস সহজেই আমাদের সামনে চলে আসবে।

মিশা, তোকে নিয়ে তোর মা আর আমি ইদানীং খুব

ভয়ে ভয়ে থাকি।

না, বখাটে হসনি তুই, কেউ বলবে না তোকে রখে-বসা

পাড়ার মাস্তান;

কিংবা গিলিসনি বড়ি লুকিয়ে, খাসনে ছাইপাঁশ-

আমরা ভীত বড়ো ভীত তোর অন্য রকম হাবভাব দেখে।

আমরা ভীত অত্যন্ত ভীত, কেননা এই ভালোবাসা বড়ো

সর্বনাশা ভালোবাসা।

তোর অস্তিত্ব জুড়ে যাঁর নাম, যাঁর স্বপ্ন, যে দীর্ঘদেহী

করে ঘোরাফেরা

সকাল-সন্ধ্যা-রাত্রি বস্তুত বারো মাস;

জানিস নি সেই প্রণয়ের মূল্য? তুই কি শুনিস নি

জামিলের নাম? মনসুর, নজরুল, তাজউদ্দীন? জানিস কি

এই স্বপ্ন, এই ভালবাসা চায় বলিদান।

দেখতে কি পাস না তুই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা রোরুদ্যমান দুইটি মেয়ের

প্রতিদান- বিপর্যস্ত ভালবাসা। যারাই বেসেছে ভালো

বঙ্গবন্ধুকে, তারাই ফুরিয়ে যায়, তাদেরই ঘুম আসে

এই বিশাল ঘাতকের দেশে সকলের আগে।

তোকে নিয়ে তোর মা আর আমি পিতা সর্বদা শঙ্কিত থাকি।

যে বয়সে দেয়ালে থাকে জ্যাকসন আর শ্রীদেবীর

নয়ন ভোলানো ছবি

সে বয়সে তোর ঘরে সারা দেয়াল জুড়ে দেখি সাতই মার্চের জনসভা

আর বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত তর্জনী ওঠানো হাত, দেখি

নীলিমায় পায়রা ওড়ানো স্বপ্নদূত বঙ্গবন্ধুর

আরেকটি ছবি। এবং সেই যে দেবদূত ফিরলেন বন্দিদশা থেকে

মুক্ত বাংলায়, ঢাকার রাস্তার সেই জনস্রোতে...

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে প্রতি পরম শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন কবি। বঙ্গবন্ধু কেবল একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি দেশের ইতিহাস। এদেশের মুক্তিসংগ্রামের দিশারি বঙ্গবন্ধু নির্বিবাদে আমাদের শ্রদ্ধাজন; এতে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। ‘আত্মজের প্রতি’ কবিতায় ইতিহাসের প্রতিও কবির শ্রদ্ধাশীলতা প্রকাশ পায়। এভাবে ‘প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা’, ‘মৃতের বাড়িতে’, ‘আর্ত সময়ের কথা’ কবিতায় কবির সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার উপজীব্য হয়ে উঠেছে নিজস্ব বিশিষ্টতায়। ‘প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা’ কবিতায় স্বাধীনতা-উত্তর আশির দশকের স্বৈরাচারী শাসন-নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় কপটতা, প্রতারণা সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষভাবে অন্ধকারের গহ্বরে ঠেলে দিয়েছিলো। জলপাই রঙের উর্দির নিচে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে উঠেছিলো স্বাধীনতা। এ দুর্বিষহ দলন কবিকে আহত করে। এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ করেন-

কিন্তু কিছুই যেনো নেই। কান্না ছাড়া আর বিলাপ ছাড়া।

বাগাড়ম্বর আর উঁচু আদর্শের কথা ছাড়া। দলত্যাগ

আর বোকা বানানো ছাড়া। টেলিভিশনের ধাপ্পাবাজি

আর সভা-সমিতির ভাঁড়ামি ছাড়া। নতুন নতুন অর্ডিন্যান্স

আর দুর্নীতির ছাড়পত্র ছাড়া। দুর্বিষহ দলন আর

দুর্ভাগ্যের রজনী ছাড়া। ক্লেদ আর লোক দেখানো

ধার্মিকতা ছাড়া

না। আমি তোমাকে নিয়ে কোনো আশার কথা বলবো না স্বাধীনতা

আমার দেশে কিংবা পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই

তোমাকে জলপাই রঙের উর্দি থেকে বাঁচাতে হবে।

প্রত্যেক মানুষের চৈতন্যেই নস্টালজিয়া থাকে। ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর কবিদের মানসপটে আরো বেশি উজ্জ্বল রেখাপাত করে। সিকদার আমিনুল হকও এর ব্যতিক্রম নন। অতীত বিধুরতা তাঁর মনেও নাড়া দিয়ে ওঠে- ‘সমুদ্রের তীরে বসে দেখতাম নারিকেল বীথি-/ সোনালী কাঁকড়া আর গাঙচিল’। এতে সহজেই কবির অতীত বর্তমানে এসে উপস্থিত হয়ে ওঠে। ‘দিনগত পাপক্ষয়’ কবিতায় সামাজিক, মানবিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। মানবিক সংকট, সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সময়ে বিভিন্নভাবে মানুষ তাঁর মানবিক মূল্যবোধ হারাতে বসেছে। মূল্যবোধের এই ক্ষয়ই অবক্ষয়। সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় এই অবক্ষয়ের চিত্র উঠে আসে- ‘আর আজ সভ্যতার মঞ্চে বিশ্রী পাহারা বসিয়ে/ ট্রাউজার পরে ঘোরে চৌরাস্তার টেরিকাটা মাথা/ ক্লাব-প্রাণ অশ্লীল মাস্তান।’ কিংবা- ‘বাড়ছে কেবলি দেখি, রুক্ষ ফ্যাট, নর্দমার ক্বাথ/ ঘেয়ো দোকানের ভিড়, উটকো বস্তি, ট্র্যাফিকের জ্যাম/ ভিখিরির ঐক্যতান, সুন্দরীর সম্পদ হারানো হাঁসফাঁস স্থূল দেহ। কবি মনে করেন- ‘ব্যর্থতার বিনষ্ট শহরে আজ ক্ষুধার্তের আর্ত হাহাকার।’ তাঁর কাছে ‘অর্থহীন এই মাছ আজ যেনো নগরীর ভিড়’।

ষাটের দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হওয়া সত্ত্বেও সিকদার আমিনুল হকের কাজগুলো নিয়ে সেভাবে আলোচনা বা মূল্যায়ন হচ্ছে না। জীবনে যেভাবে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিলেন, মৃত্যুর পরও অনেকটা সেভাবেই আছেন। ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’ শিরোনামে সিকদার আমিনুল হকের একটি কবিতার বই রয়েছে। এই নামকরণটিই আমাদেরকে সহজে বুঝিয়ে দেয় কবির জীবনযন্ত্রণার কথা। ক্ষোভের কথা। কবির জীবনে এই উপেক্ষাই তাঁকে আরো ইস্পাত কঠিন সংকল্পে আকাশস্পর্শী করে তোলে। তিনি তাঁর অমিত প্রতিভাবলে সকল উপেক্ষা অতিক্রম করেছেন একান্ত একাগ্রতায়, নিষ্ঠায়। কবির দহন দাহ্য হয়ে উঠেছে কিংবা শীতলতা পেয়েছে রূপকে, প্রতীকে কবিতার শরীরে। কবিতাকেই খুঁজে নিয়েছেন পরম আদরে প্রণয়িনী প্রেমিকার মতোন। তার রূপ-রসে সিক্ত হয়েছেন আপদমস্তক। তিনি ভিড়ের মাঝে ভিড়তে যাননি, একাকিত্বের মাঝে অনন্য মগ্নতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। কবির এমন মগ্ন চৈতন্যে মুখরিত হয়ে ওঠে কবিতা, যে কবিতা কবির মতোই একা, আলাদা। রূপকে, প্রতীকে ভরপুর। কবির মতে ‘কবিতা পরস্ত্রীর মতো পবিত্র’। যার দেহ ভোগের অধিকার রয়েছে কেবল স্বীকৃতের (বোদ্ধার, সমঝদারের); সকলে এর শরীর ছুঁতে পারে না। কবিতা থাকে কামনাদাত্রীর ওষ্ঠে। প্রণয়িনী বা কামনাদাত্রীর কোমল ঠোঁটের উষ্ণতায় যে কাতর হতে পারে, কেবল সে-ই হৃদয়ঙ্গম করতে পারে কবিতা। কবিতা সম্পর্কে কবির জবানবন্দি-

কবিতাকে থাকতে দাও একা, অস্পষ্ট আর পরস্ত্রীর মতো পবিত্র।

মানুষের হাত, সে স্বাচ্ছন্দ্যে নামুক পাতালের নিচে, অন্ধকারে।

পাল তোলার জন্য কবজির জোর এবং পাহাড়ে

ওঠার জন্য শক্ত গোড়ালী এখনো দরকার।

কবিতা সে থাকুক কামনাদাত্রীর ওষ্ঠে, বগলের নিচের ছোট

অন্ধকারে, এবং যার প্রণয়িনী নেই, পানশালায় তার শেষ পাত্রে।

কবিতা উজ্জ্বল হও। তুমি বাঁচো। এবং সুবিশাল নারীর নিতম্বের মতো

দায়িত্ববোধে আবৃত হও!

যারা তোমাকে দেখে না। তুমি সেই কিশোরীর অন্তর্বাস, বৃদ্ধেরা যার রঙ পর্যন্ত

আঁচ করতে পারে না।

সিকদার আমিনুল হকের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য নারী চেতনা। নারী প্রেমিকা, প্রণয়িনী। নারীর ঠোঁটে যেমন প্রেম থাকে, তেমনি কামেরও জন্ম দেয়। নারী বিষয়ক কবিতা পশ্চিমা মিথ, উপমায় সৌন্দর্য বর্ধন এবং সমৃদ্ধ করেছে। ফরাসি কবি র‌্যাবোর মতো সিকদার আমিনুল হক নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় নানা রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। নারীকে বিভিন্নভাবে তাঁর কবিতায় উপস্থিত করেছেন। নারী তাঁর কাছে কখনো শ্রদ্ধার পাত্র, কখনো হয়ে ওঠেন কামনার আধার। এই নারী কখনো ভেনিসের সুনসান ফকফকা রাত্রিতে পার্কে ঘুরে, কখনো ঝাউপাতা খেয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে সমুদ্রের বালুঘরে। এই নারী কখনো উঁচু-নিচু মাংসের স্তূপ, কখনো পুরুষের চোখে এরা টকটকে টমেটোর লাল। নারী কখনো সৌন্দর্যের ঝর্ণাধারা। তাঁর নারী ভাবনা হলো- “সব নারী আমাদের ভাবনায় ফেলে না, কেউ কেউ ফেলে। আর যারা অপেক্ষা করে, তারা শীতের সবুজ পতঙ্গের মতো। -অনেকে চাঁদ আর ঝুলবারান্দার নিচে পরাধীন! অনিশ্চিত তাদের টলমলে সুঠাম পা; বালিকা-বয়স থেকেই নিদ্রিত স্তন হয়ে ওঠে ওদের নৈরাশ্য এবং সম্পদের ভার! তারা বাঁচে বসন্ত আর প্রেমের কয়েকটা দিন...।” কবির কাক্সিক্ষত নারী ‘সুলতা’। জীবনান্দের ‘সুরঞ্জনার’ মতো সিকদারের বিভিন্ন কবিতায় ‘সুলতা’ সুন্দরের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। কবি কখনো ‘সুলতাকে’ সুন্দরী এলসার সাথে মিলিয়ে ফেলেন।

সিকদার আমিনুল হক, আত্মদহনপীড়িত রূপকল্পের এ কবির কবিতা মূল্যায়ন হোক, মূর্তমান হয়ে উঠুক এ সময়ের তরুণদের কাছে। আমাদের মাঝে সমাসীন থাকুন আমাদের অগ্রজ।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

সিকদার আমিনুল হক স্বতন্ত্র ও নিমগ্ন কাব্যসাধক

জয়নাল আবেদীন শিবু

স্ত্রী মাসুদা আমিন জলি, দুই পুত্র মিশা ও বান্টির সঙ্গে কবি সিকদার আমিনুল হক

বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

সিকদার আমিনুল হক ষাটের দশকের অন্যতম কবি। ষাটের দশক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় জাগরণের গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। শিল্প-সাহিত্যে এর প্রভাব উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠেছে। এ সময় বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীগণ সংক্ষুব্ধ লেখনি ও শিল্পকর্ম দিয়ে ক্ষোভে বিক্ষোভে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেদের শামিল করে নিয়েছেন। এই স্লোগানমুখর সময়ে বাংলা কবিতায় সিকদার আমিনুল হকের আগমন হলেও স্লোগানধর্মিতা তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিবড়িতার মধ্য দিয়ে, নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কাব্যভাষার একটি পথ বেছে নিলেন। পরাবাস্তবের, বিমূর্ততার সে পথ সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় শাখা মেলতে থাকে শুরু থেকেই। অনন্য এক কবিভাষা লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায়। ষাটের অন্য কবিদের মতো সিকদার আমিনুল হকও স্বতন্ত্র পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। ‘ষাট দশকের কবিতায় প্রায় সকলেই প্রথম থেকে স্বতন্ত্র হয়েছিলেন। সিকদার আমিনুল হকও প্রথম থেকেই স্বতন্ত্র। ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে তিনি লিরিক কবিতা এবং গদ্য কবিতায় বিশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন।’ মাসুদুল হকের এ কাব্যবিচার যথার্থই। সিকদার আমিনুল হকের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইদানীং আমার পড়া হলো। পাঠক হিসেবে স্পর্শ করেছে তাঁর কবিতাগুলো। একসাথে অনেক কবিতা পড়ায় কবি-সত্তাকে বুঝে নিতেও সহায়তা হয়। তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে বিমূর্ত ভাবনার বুনন, খুব গভীরে জীবন জাগ্রত। মগ্নতার, ভাবালুতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যায় তাঁর কবিতার ক্যারেকটার। কবিতায় নিবিড় এক কবির নাম সিকদার আমিনুল হক। কবিতার প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা তাঁকে ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে গেছে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর চেতনালোকে হৃদ্ধ হয়ে উঠেছে কবিতাগুলো। সচেতন শিল্পসত্তার অধিকারি আত্মবিশ^াসি কবি আমিনুল হক। হৃদয়ে ধারণ করেছেন বিশাল এক সমুদ্র, যার জলরাশি কাব্যতৃষ্ণায় উন্মুখ। কবির কাব্যতৃষ্ণা আরো প্রবল হয়ে উঠেছে বাস্তব জীবনের নানা অভিঘাতে। প্রেম, হতাশা, বিতৃষ্ণা, জীবনের দুঃখ-দুর্দশা, বঞ্চনা, রাষ্ট্রশক্তির সীমাহীন শোষণ, আগ্রাসন কবির অনুভূতিতে ব্যাপক স্পন্দন তোলে। এগুলোই তাঁর কবিতায় রূপায়িত হয়ে ওঠে বিমূর্ত ব্যঞ্জনায়। কবির মনন বিশে^র ব্যাপক ক্যানভাসে স্থান পেয়েছে বস্তুবিশে^র বহু বিষয়। জীবনের ছোটোখাটো বিষয়ও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে নতুন কাব্য সৌন্দর্যে। একটি সাধারণ বিষয়কেও কবিতায় উপজীব্য করে তোলেন সুন্দর অবয়বে। আমিনুল হকের কবিতায় ভাব এবং ভাষা সান্ধ্যভাষার মতো আলো আঁধারি থাকলেও বোদ্ধা পাঠকের কাছে তা অস্পষ্ট হবে না। প্রাত্যহিক ব্যবহারি চেনাজানা শব্দের বুননে তাঁর কবিতা ধারণ করে অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। কিছুটা ধরা কিছুটা অধরার ভেতর দিয়ে পাঠককে টেনে নেবে এক ভালোলাগার মোহনায়। পঞ্চাশ-ষাটের কবিতায় অহেতুক অস্পষ্টতা খুব বেশি নেই। বাংলা কবিতায় এই স্পষ্টবাদিতা ত্রিশের পর থেকে লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে কাব্যের বিশেষত্বটাও লক্ষ্যণীয়। অগ্রজ প্রথাবিরোধিতা ভেঙ্গে পরিচিত শব্দ প্রয়োগে নৈঃশব্দ্যের, নন্দনের চাষবাসে আধুনিক কবিতা আরো রূপময়ী, মমতাময়ী হয়ে উঠেছে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিদের হাতে। এসময়ের কবিতায় তাই অধিকতর মানবিক, সামাজিক এবং শৈল্পিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। পুরাতন পথ বেয়েই সব সময় নতুন নতুন পথের সৃষ্টি। কবিতায়ও তেমনি। পুরাতন নিয়ে দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে না কবিতা; নতুনত্বই তার প্রাণ। আর সেই প্রাণ সঞ্চারে প্রাগ্রসর ¯্রষ্টা ও দ্রষ্টাদের শিল্পদৃষ্টিই সমকালে নতুন শিল্পভাবনা হিসেবে সংস্থিত হয়ে ওঠে। ষাটের কবিতায় তেমনি সিকদার আমিনুল হকের মৌলিকত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনের সমূহ সংযোগ রয়েছে তাঁর কবিতায়। একের ভেতর অনেকের উপস্থিতি নিয়েই তাঁর কবিতা। একটা কবিতাংশ পড়ে নেয়া যেতে পারে-

তোমাকে আমার চাই, এই কথা ভুলি না কখনো!

আফিসের দায় সেরে যখন রিকশায় বাড়ি ফিরি,

লাঞ্চে রেস্তোরাঁয় গিয়ে এই মন্ত্র জপি মনে মনে

তোমাকে আমার চাই। যে স্লোগান বেতন বাড়াতে

সচিবালয়ের গেটে আসে, তার সাথে ভিড়ে গিয়ে বলি

তোমাকে আমার চাই। সকালে গলির মোড়ে গিয়ে

সেলুনের শাদা ফেনা গালের কৌতুকে বসে গেলে

কবিতার বিষয়বস্তুকে আমিনুল হক মুক্তি দিয়েছেন। প্রাত্যহিক জীবন যাপনের প্রতিফলনই তাঁর কবিতা। প্রতিদিনের দুঃখ-কষ্ট, কামনা-বাসনা, ব্যর্থতা কবির জীবন যাপনে নানাভাবে নাড়া দেয়, চেতনাভূমে জমা হতে থাকে। কবিতায় অনায়াসে রোপিত হয়ে ওঠে এগুলো। কবিতা তো জীবনের টুকরোটুকরো রোদ্দুর, ছিটেফোঁটা বৃষ্টির কোলাহল, খসে পড়া পাতা। শাস্ত্রজ্ঞান দিয়ে সবসময় কবিতা বিচার হয় না। পার্থিব শৃঙ্খলা আর জীবনলীলার বাহিরেও কখনো কখনো কবির বীক্ষায় কাজ করে পরাবাস্তববাদের চলিষ্ণু চেতনা। যুক্তি ও জীবনকৃত্য তখন গৌণ হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্ন এলোমেলো স্বপ্নও চৈতন্যে বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে কবির মনোলোকে। অবচেতনেও তখন সুন্দর অবয়বে প্রতীকায়িত হয়ে ওঠে মন-মস্তিষ্ক-প্রসূত বোধ-ভাবনার বিস্তার। এই অনস্তিত্বের মাঝেও কবি খুঁজে চলেন স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব। শিল্পে এটি পরাবাস্তববাদী চেতনা। আধুনিক শিল্প সাহিত্যে এর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। পরাবাস্তববাদে যুক্তির চেয়ে অবচেতনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশেরই প্রাধান্য বেশি। সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় পরাবাস্তববাদী চেতনা লক্ষ্য করা যায়। পরাবাস্তববাদীদের মতে, ‘যুক্তির জাল জীবনের ও মানুষের নিহিত শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যুক্তি-বুদ্ধি-চেতনা এসব হচ্ছে ভাবনার প্রথাগত পদ্ধতি। এগুলো মানুষের কল্পনা ব্যাহত করে। যুক্তির প্রভাবে সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়।’ যুক্তিমুক্ত মনের কল্পনাই চৈতন্যের স্বাধীনতা, পরাবাস্তববাদিতা। আর এ চেতনায় সুন্দরের শৃঙ্খলা নিহিত। এ বিষয়ে কবি ওবায়েদ আকাশের মতামত- “ননপ্রফেশনালিজম আরো বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ। আর একটু ভেবে বললে বলা যায়, ননপ্রফেশনালিজমের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে, প্রফেশনালিজমের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যে অন্য আরেক রকম উচ্ছৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে যাত্রা- সেটাই হচ্ছে শিল্পের সত্যিকারের স্মার্টনেস।” এই স্মার্টনেসের প্রকাশ ঘটেছে সিকদার আমিনুল হকের কবিতায়-

অন্যসব আলো অন্ধকার এখানে ফুরালো

লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো

এখানে; এই খানে মৃণালিনী ঘোষালের শব

ভাসিতেছে চিরদিন: নীল লাল, রুপালী নীরব।

কিংবা,

রাত্রি মানে বিড়ালের মতো চাঁদ; অতিশয় শাদা

জ্যোৎ¯œা নিশ্চয় চায় একপাশে কোলস্টোরেল ছাড়া

স্যালাদের নির্জনতা।

এই যে লাল নীল মাছ মেঘ-ম্লান নীল জোছনার আলো, মৃণালিনী ঘোষালের শব চিরদিন ভাসছে রুপালী নীরব। কথাগুলো আপাত বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে। এই যে রাত্রি মানে বিড়ালের মতো চাঁদ- কবির এ দেখাও সঠিক। বিমূর্ততার বুননে ‘বেড়ালের মতো চাঁদ’ মূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের সামনে। কবির অবচেতনে, মর্মচক্ষে রাত্রিকে বেড়ালের মতো দেখার মাধ্যমে নান্দনিকতার বহির্প্রকাশ ঘটে কবিতায়। আমিনুল হকের অনেক কবিতাই এরকম লাবণ্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

সময়ের অভিঘাত, ক্লেদাক্ততা যাপিত জীবনের নানা টানাপোড়েন আমিনুল হকের কবিতার পরতে পরতে প্রোথিত রয়েছে। সামাজিক জীব হিসেবে আমরা কেউই বৃত্তাবদ্ধ জীবনের বাইরে নই, আমাদের চলমান জীবনে ঘুরেফিরে সুখ-দুখ, বেদনা, বিরক্তি, হতাশার কালোছায়া ফেলে যায় ভেসে চলা বাতাসের নাও। এই ক্লেদাক্ততা সব সময় শিল্পের সংকট তৈরি করে করে না; ধ্যানীদের কর্মে আরো একাগ্রতা, নিবিষ্টতাও বাড়িয়ে দেয়। বিষণœ সন্ধ্যাও কবির দগ্ধবুকে সৃজনস্পৃহা বাড়িয়ে তোলে। ‘আছি বিকল্প সুখে’ কবিতায় বাহ্যিক দৃষ্টিতে কবির বেদনা-বিধূরতা ফুটে উঠলেও এর অর্ন্তনিহিত তাৎপর্যে দেখা যায় কবিমনের বিপ্রতীপ ভাবনা সৌন্দর্যে ভরে ওঠে- জীবনঘনিষ্ঠতায়।

এখানে নামছে সন্ধ্যা বিশ^হীন বিষণ্ন বাড়িতে;

রোজ নামে এই ভাবে, চোখে দেখি নিকম্প স্তব্ধতা

আর জুজু বুড়ি হরেক রকম! অবশ্য সন্ধ্যাই

নয়, সারাদিন যত খুঁটিনাটি সস্ত্রস্ত সঞ্চয়

জমেছে আঁধার ঘরে, হৃদয়ের আনাচে-কানাচে

রক্তহীন অন্তস্থলে সব যেন দীর্ঘ বর্শা হাতে-

ছুটে আসে প্রান্তরের দস্যুদল। আমি যে বন্দিনী

সম্ভ্রান্ত সুঠাণ্ডা ঘরে অলৌকিক সম্পদের ভারে

এ কথা দস্যু জানে। -আলোকের নিচে

ধর্ষণের আশঙ্কায় এঁটে দিই স্বেচ্ছায় দরজা।

সিকদার আমিনুল হকের প্রেমের কবিতা নান্দনিকতায় ঋদ্ধ। তাঁর প্রেম চেতনা কেবল আবেগময় উচ্ছ্বাস নয়, সুনীতি ও সৌন্দর্যের প্রতি একনিষ্ট। কবির প্রেমের কবিতায় দেখা যায় ব্যক্তিক কামনা-বাসনার চেয়ে প্রেমার্ত হৃদয়ের শাশ্বত আর্তি নৈর্ব্যক্তিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাঁর প্রেমের কবিতায়, কথায় প্রতীকের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় মানব মনের নানা আকাক্সক্ষা। নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে কবির প্রেম-চেতনা। বাড়িয়ে তোলে কবিতার বাহ্যিক সৌন্দর্য।

সিকদার আমিনুল হক নিবীড়তার কবি, নিমগ্নতার কবি। মাঝে মাঝে নিশুতি রাতের নীরবতাও খুব উপভোগ করেন। যন্ত্র দুনিয়ার জঞ্জাল থেকে একটু আড়ালে, একান্তে নিসঙ্গতাও যে যাপনের একটা বিষয় হতে পারে, সিকদার আমিনুল হকের কবিতা তা শিখিয়ে দেয়। নিসঙ্গতাকে স্বাচ্ছন্দ্যে যাপনের জন্য তেমন মন চাই। নিসঙ্গতাও কখনো কখনো নতুন উদ্যমে, উৎসাহে কর্মচাঞ্চল্য নিয়ে আসে। আবার সবকিছু ছেড়েছুড়ে একেবারে আয়েশে সাদা বিছানায় দেহ এলিয়ে দেয়ার মাঝেও আছে পরম আরামবোধ। কবির এ অন্তর্মুখিতা লক্ষ্য করি-

এখন বরঞ্চ ভালো লাগে কাক, মূঢ় একাকিত্ব

দুপুরের রোদ ভাঙ্গি, ভালো লাগে নর্দমার ধ্যান-

গলির উড়ন্ত বৃষ্টি, চাপকলে ভিখিরির তৃষ্ণা,

অন্ধকার গাছপালা, পরিচ্ছন্ন ডবল ডেকার।

আকণ্ঠ ডুবিয়ে দেহ ভালো লাগে শাদা বিছানাকে;

রাজনীতির উত্তাল সময়ের কবি আমিনুল হকের কবিতায় রাজনৈতিক চেতনাও উল্লেখযোগ্য, তবে তা স্লোগানধর্মী নয়। সমকালীন রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতরেই একজন কবির বসবাস বলে কবিতায় এই অনুষঙ্গ স্বাভাবিকভাবে চলে আসবে। শধু কবিতায় কেন, সকল শিল্প মাধ্যমেই সমকালের চেহারা সবচেয়ে বেশি ফোকাস করে ওঠে। সিকদার আমিনুল হকের অনেক কবিতায়ই প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে বা প্রতীকের মাধ্যমে রাজনীতি চেতনা উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কবির আত্মজ মিশা যখন রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে, দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে এক সময় দেশ মাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুতি নেয়। আত্মজের ইতিবাচক আচরণে পিতা গর্বিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু আশঙ্কাও কাজ করে ভেতরে ভেতরে। আত্মজ যে বখাটে হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা নয়। আশঙ্কা করেন- দেশের প্রতি আত্মজের প্রেম কতটা প্রগাঢ় হবে। কেননা প্রকৃত দেশপ্রেমিককে বৈষয়িক মোহ মায়া ত্যাগ করে নিজেকে দেশের কাজেই ব্যয় করতে হয়। খাটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে কবি আত্মজের মনোবল বাড়িয়ে দিতে চান। স্বদেশপ্রেম যাদের সত্তায় ধারণ করেন- এই ঘাতকের দেশে তারাই আগে ফুরিয়ে যায়, ঘুমের দেশে চলে যায়। কবিতায় ‘এই ঘাতকের দেশে’ ‘দুঃস্বপ্নের দেশে’ উচ্চারণের মাধ্যমে কবি স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের স্বৈরাচারি শাসন, শোষণের বিরুদ্ধে স্পর্ধিত ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রের অন্যায়কে অন্তর থেকে ঘৃণা করেন বলেই ফলাও করে তুলে ধরেন এমন অসংগতি। ‘আত্মজের প্রতি’ কবিতাটি উপস্থিত করলেই আমিনুল হকের কবি-মানস সহজেই আমাদের সামনে চলে আসবে।

মিশা, তোকে নিয়ে তোর মা আর আমি ইদানীং খুব

ভয়ে ভয়ে থাকি।

না, বখাটে হসনি তুই, কেউ বলবে না তোকে রখে-বসা

পাড়ার মাস্তান;

কিংবা গিলিসনি বড়ি লুকিয়ে, খাসনে ছাইপাঁশ-

আমরা ভীত বড়ো ভীত তোর অন্য রকম হাবভাব দেখে।

আমরা ভীত অত্যন্ত ভীত, কেননা এই ভালোবাসা বড়ো

সর্বনাশা ভালোবাসা।

তোর অস্তিত্ব জুড়ে যাঁর নাম, যাঁর স্বপ্ন, যে দীর্ঘদেহী

করে ঘোরাফেরা

সকাল-সন্ধ্যা-রাত্রি বস্তুত বারো মাস;

জানিস নি সেই প্রণয়ের মূল্য? তুই কি শুনিস নি

জামিলের নাম? মনসুর, নজরুল, তাজউদ্দীন? জানিস কি

এই স্বপ্ন, এই ভালবাসা চায় বলিদান।

দেখতে কি পাস না তুই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা রোরুদ্যমান দুইটি মেয়ের

প্রতিদান- বিপর্যস্ত ভালবাসা। যারাই বেসেছে ভালো

বঙ্গবন্ধুকে, তারাই ফুরিয়ে যায়, তাদেরই ঘুম আসে

এই বিশাল ঘাতকের দেশে সকলের আগে।

তোকে নিয়ে তোর মা আর আমি পিতা সর্বদা শঙ্কিত থাকি।

যে বয়সে দেয়ালে থাকে জ্যাকসন আর শ্রীদেবীর

নয়ন ভোলানো ছবি

সে বয়সে তোর ঘরে সারা দেয়াল জুড়ে দেখি সাতই মার্চের জনসভা

আর বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত তর্জনী ওঠানো হাত, দেখি

নীলিমায় পায়রা ওড়ানো স্বপ্নদূত বঙ্গবন্ধুর

আরেকটি ছবি। এবং সেই যে দেবদূত ফিরলেন বন্দিদশা থেকে

মুক্ত বাংলায়, ঢাকার রাস্তার সেই জনস্রোতে...

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে প্রতি পরম শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন কবি। বঙ্গবন্ধু কেবল একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি দেশের ইতিহাস। এদেশের মুক্তিসংগ্রামের দিশারি বঙ্গবন্ধু নির্বিবাদে আমাদের শ্রদ্ধাজন; এতে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। ‘আত্মজের প্রতি’ কবিতায় ইতিহাসের প্রতিও কবির শ্রদ্ধাশীলতা প্রকাশ পায়। এভাবে ‘প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা’, ‘মৃতের বাড়িতে’, ‘আর্ত সময়ের কথা’ কবিতায় কবির সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার উপজীব্য হয়ে উঠেছে নিজস্ব বিশিষ্টতায়। ‘প্রতিটি সকালের স্বাধীনতা’ কবিতায় স্বাধীনতা-উত্তর আশির দশকের স্বৈরাচারী শাসন-নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় কপটতা, প্রতারণা সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষভাবে অন্ধকারের গহ্বরে ঠেলে দিয়েছিলো। জলপাই রঙের উর্দির নিচে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে উঠেছিলো স্বাধীনতা। এ দুর্বিষহ দলন কবিকে আহত করে। এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ করেন-

কিন্তু কিছুই যেনো নেই। কান্না ছাড়া আর বিলাপ ছাড়া।

বাগাড়ম্বর আর উঁচু আদর্শের কথা ছাড়া। দলত্যাগ

আর বোকা বানানো ছাড়া। টেলিভিশনের ধাপ্পাবাজি

আর সভা-সমিতির ভাঁড়ামি ছাড়া। নতুন নতুন অর্ডিন্যান্স

আর দুর্নীতির ছাড়পত্র ছাড়া। দুর্বিষহ দলন আর

দুর্ভাগ্যের রজনী ছাড়া। ক্লেদ আর লোক দেখানো

ধার্মিকতা ছাড়া

না। আমি তোমাকে নিয়ে কোনো আশার কথা বলবো না স্বাধীনতা

আমার দেশে কিংবা পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই

তোমাকে জলপাই রঙের উর্দি থেকে বাঁচাতে হবে।

প্রত্যেক মানুষের চৈতন্যেই নস্টালজিয়া থাকে। ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর কবিদের মানসপটে আরো বেশি উজ্জ্বল রেখাপাত করে। সিকদার আমিনুল হকও এর ব্যতিক্রম নন। অতীত বিধুরতা তাঁর মনেও নাড়া দিয়ে ওঠে- ‘সমুদ্রের তীরে বসে দেখতাম নারিকেল বীথি-/ সোনালী কাঁকড়া আর গাঙচিল’। এতে সহজেই কবির অতীত বর্তমানে এসে উপস্থিত হয়ে ওঠে। ‘দিনগত পাপক্ষয়’ কবিতায় সামাজিক, মানবিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। মানবিক সংকট, সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সময়ে বিভিন্নভাবে মানুষ তাঁর মানবিক মূল্যবোধ হারাতে বসেছে। মূল্যবোধের এই ক্ষয়ই অবক্ষয়। সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় এই অবক্ষয়ের চিত্র উঠে আসে- ‘আর আজ সভ্যতার মঞ্চে বিশ্রী পাহারা বসিয়ে/ ট্রাউজার পরে ঘোরে চৌরাস্তার টেরিকাটা মাথা/ ক্লাব-প্রাণ অশ্লীল মাস্তান।’ কিংবা- ‘বাড়ছে কেবলি দেখি, রুক্ষ ফ্যাট, নর্দমার ক্বাথ/ ঘেয়ো দোকানের ভিড়, উটকো বস্তি, ট্র্যাফিকের জ্যাম/ ভিখিরির ঐক্যতান, সুন্দরীর সম্পদ হারানো হাঁসফাঁস স্থূল দেহ। কবি মনে করেন- ‘ব্যর্থতার বিনষ্ট শহরে আজ ক্ষুধার্তের আর্ত হাহাকার।’ তাঁর কাছে ‘অর্থহীন এই মাছ আজ যেনো নগরীর ভিড়’।

ষাটের দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হওয়া সত্ত্বেও সিকদার আমিনুল হকের কাজগুলো নিয়ে সেভাবে আলোচনা বা মূল্যায়ন হচ্ছে না। জীবনে যেভাবে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিলেন, মৃত্যুর পরও অনেকটা সেভাবেই আছেন। ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’ শিরোনামে সিকদার আমিনুল হকের একটি কবিতার বই রয়েছে। এই নামকরণটিই আমাদেরকে সহজে বুঝিয়ে দেয় কবির জীবনযন্ত্রণার কথা। ক্ষোভের কথা। কবির জীবনে এই উপেক্ষাই তাঁকে আরো ইস্পাত কঠিন সংকল্পে আকাশস্পর্শী করে তোলে। তিনি তাঁর অমিত প্রতিভাবলে সকল উপেক্ষা অতিক্রম করেছেন একান্ত একাগ্রতায়, নিষ্ঠায়। কবির দহন দাহ্য হয়ে উঠেছে কিংবা শীতলতা পেয়েছে রূপকে, প্রতীকে কবিতার শরীরে। কবিতাকেই খুঁজে নিয়েছেন পরম আদরে প্রণয়িনী প্রেমিকার মতোন। তার রূপ-রসে সিক্ত হয়েছেন আপদমস্তক। তিনি ভিড়ের মাঝে ভিড়তে যাননি, একাকিত্বের মাঝে অনন্য মগ্নতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। কবির এমন মগ্ন চৈতন্যে মুখরিত হয়ে ওঠে কবিতা, যে কবিতা কবির মতোই একা, আলাদা। রূপকে, প্রতীকে ভরপুর। কবির মতে ‘কবিতা পরস্ত্রীর মতো পবিত্র’। যার দেহ ভোগের অধিকার রয়েছে কেবল স্বীকৃতের (বোদ্ধার, সমঝদারের); সকলে এর শরীর ছুঁতে পারে না। কবিতা থাকে কামনাদাত্রীর ওষ্ঠে। প্রণয়িনী বা কামনাদাত্রীর কোমল ঠোঁটের উষ্ণতায় যে কাতর হতে পারে, কেবল সে-ই হৃদয়ঙ্গম করতে পারে কবিতা। কবিতা সম্পর্কে কবির জবানবন্দি-

কবিতাকে থাকতে দাও একা, অস্পষ্ট আর পরস্ত্রীর মতো পবিত্র।

মানুষের হাত, সে স্বাচ্ছন্দ্যে নামুক পাতালের নিচে, অন্ধকারে।

পাল তোলার জন্য কবজির জোর এবং পাহাড়ে

ওঠার জন্য শক্ত গোড়ালী এখনো দরকার।

কবিতা সে থাকুক কামনাদাত্রীর ওষ্ঠে, বগলের নিচের ছোট

অন্ধকারে, এবং যার প্রণয়িনী নেই, পানশালায় তার শেষ পাত্রে।

কবিতা উজ্জ্বল হও। তুমি বাঁচো। এবং সুবিশাল নারীর নিতম্বের মতো

দায়িত্ববোধে আবৃত হও!

যারা তোমাকে দেখে না। তুমি সেই কিশোরীর অন্তর্বাস, বৃদ্ধেরা যার রঙ পর্যন্ত

আঁচ করতে পারে না।

সিকদার আমিনুল হকের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য নারী চেতনা। নারী প্রেমিকা, প্রণয়িনী। নারীর ঠোঁটে যেমন প্রেম থাকে, তেমনি কামেরও জন্ম দেয়। নারী বিষয়ক কবিতা পশ্চিমা মিথ, উপমায় সৌন্দর্য বর্ধন এবং সমৃদ্ধ করেছে। ফরাসি কবি র‌্যাবোর মতো সিকদার আমিনুল হক নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় নানা রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। নারীকে বিভিন্নভাবে তাঁর কবিতায় উপস্থিত করেছেন। নারী তাঁর কাছে কখনো শ্রদ্ধার পাত্র, কখনো হয়ে ওঠেন কামনার আধার। এই নারী কখনো ভেনিসের সুনসান ফকফকা রাত্রিতে পার্কে ঘুরে, কখনো ঝাউপাতা খেয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে সমুদ্রের বালুঘরে। এই নারী কখনো উঁচু-নিচু মাংসের স্তূপ, কখনো পুরুষের চোখে এরা টকটকে টমেটোর লাল। নারী কখনো সৌন্দর্যের ঝর্ণাধারা। তাঁর নারী ভাবনা হলো- “সব নারী আমাদের ভাবনায় ফেলে না, কেউ কেউ ফেলে। আর যারা অপেক্ষা করে, তারা শীতের সবুজ পতঙ্গের মতো। -অনেকে চাঁদ আর ঝুলবারান্দার নিচে পরাধীন! অনিশ্চিত তাদের টলমলে সুঠাম পা; বালিকা-বয়স থেকেই নিদ্রিত স্তন হয়ে ওঠে ওদের নৈরাশ্য এবং সম্পদের ভার! তারা বাঁচে বসন্ত আর প্রেমের কয়েকটা দিন...।” কবির কাক্সিক্ষত নারী ‘সুলতা’। জীবনান্দের ‘সুরঞ্জনার’ মতো সিকদারের বিভিন্ন কবিতায় ‘সুলতা’ সুন্দরের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। কবি কখনো ‘সুলতাকে’ সুন্দরী এলসার সাথে মিলিয়ে ফেলেন।

সিকদার আমিনুল হক, আত্মদহনপীড়িত রূপকল্পের এ কবির কবিতা মূল্যায়ন হোক, মূর্তমান হয়ে উঠুক এ সময়ের তরুণদের কাছে। আমাদের মাঝে সমাসীন থাকুন আমাদের অগ্রজ।

back to top