alt

সাময়িকী

মেরুদণ্ড সোজা রাখার আর এক নাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

গৌতম রায়

: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/17Jun21/news/buddhodev.jpg

যে সৃষ্টিই রসোত্তীর্ণ হয় স্রষ্টার সোজা মেরুদণ্ডের গুণে- এটা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন সদ্য প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। লেখার দুনিয়াতেই হোক, কিংবা গান, ছবি আঁকা বা খেলাধুলা- যে কোনো সৃষ্টিশীলতাতেই স্রষ্টার উঁচু মাথাটা উঁচু করে আকাশের দিকে মেলে রাখাটা যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে, তখন আজীবন মাথা উঁচু করে রাখা মানুষটা ঘুমের অচেতনতার ভিতরে মৃত্যুর গহীন স্রারাজ্যে প্রবেশ করেও দেখিয়ে দিলেন, মৃত্যু নামক শূন্যতার কাছে ও শান্ত-ঋজু-দৃঢ় মেরুদণ্ডের স্পর্শন কীভাবে পূর্ণতা নির্মাণের দিকপ্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে। মৃত্যুসাগর সরিয়ে কীভাবে শূন্যে বেঁচে থাকা যায়- জীবনানন্দের কবিতাকে যেন নিজের জীবন আর সৃষ্টির দোলাচালে আগামী প্রজন্মকে ভাবার ভাবনা দিয়েই জীবননাট্য থেকে অন্তর্হিত হলেন বুদ্ধদেব।

প্রোপাগান্ডিস্ট না হলে কোনো পন্থাই কোনো মানুষকে ঠিক আপনার জন বলে ভেবে নিতে পারে না। তাই কোনো দলের কাছে টিকি না বাঁধা বুদ্ধদেব নাকি প্রথম জীবনে মারাত্মক বামপন্থা বিরোধী ছিলেন- সেই তৈলাধার পাত্রের বাখোয়াজি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ, তাঁর সৃষ্টিতে শ্রেণির কথা বলেছেন। হয়তো সেই শ্রেণিদর্শনের পৌনঃপৌনিকতা কখনো কখনো আর্টের ক্যানভাসে কারো কারো কাছে রিপিটেশন বলে ঠাওর হয়েছে। তবু যেহেতু প্রয়োজনে কিংবা বিনা কারণে চরিত্রের মুখে তিনি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলান নি, তাই হয়তো বুদ্ধদেবের পৈতে বা ফেজ টুপি কিংবা নূর দাঁড়ি খুঁজবার মানুষের এখন অভাব খুব একটা হবে না।

মেরুদণ্ডের ঋজুতা, দৃঢ়তা তৈরিতে দরকার পড়ে পরিবেশ অনুকূলতা। একটা স্বচ্ছ, যুক্তিপূর্ণ অথচ সংবেদনশীল পরিবেশ না পেলে মেরুদণ্ডের সম্যক বিকাশ ঘটানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য বিষয়। আর সেই রেশমী কিন্তু ইস্পাতকঠিন পরিবেশ গড়তে দরকার হয় পারিপার্শ্বিকতার। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোরের সামাজিক যন্ত্রণা- দেশভাগ এবং তার পরবর্তী আবর্তন একটা সংবেদনশীল মেরুদণ্ডের প্রতিটি তন্তুকে গড়েছিল পরম যত্নে। তাই সমকালীনতার প্রেক্ষিত যেমন কবিতায়, তেমনই ফিল্মে যেন একটা অবচেতন প্রলেপ দিয়ে গিয়েছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে।

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/17Jun21/news/buddhodev-2.jpg

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নির্মিত টোপ ছবিতে অভিনয় করেছেন পাওলি দাম

কবিতার একটা বাস্তব পরাবাস্তবের দোলাচালে চিন্তার প্রক্ষেপণ ঘটেছিল বুদ্ধদেবের। সেই দিক থেকে যদি বিচার করতে হয়, তাহলে বলতে হবে, ফিল্ম নয়, কবিতাই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। তিনি যখন প্রথম কবিতা লেখেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র চৌদ্দ। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা যখন প্রথম ছাপা হয়েছিল তখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বয়স মাত্র ষোল। কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিম-লে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব। খালাসিটোলার পানাসক্তি একদিকে এঁদের জীবনকে একটু অন্যরকমভাবে দেখতে শিখিয়েছিল। আবার অপরদিকে সেই অন্যরকমভাবে দেখা-চেনা-শোনা-জানার পরিম-ল তাঁদের প্রত্যেকের সৃষ্টিকেই একটা ভিন্ন খাতে বইয়ে দিয়েছিল। সৃষ্টির উনর ফেলেছিল একটা সময়ের প্রলম্বিত প্রতিবিম্ব।

কোনো জোড়াতালি দিয়ে সৃষ্টিকে তুলে ধরবার প্রশ্নে তিনি কখনোই নিজের সঙ্গে নিজে আপোস করেন নি। এই চূড়ান্ত পারফেকশনিজম সত্যজিৎকে যেমন সৃষ্টিজনিত সাফল্য দিয়েছিল, তেমনটাই প্রাপ্তি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তেরও ঘটেছিল।

সমরেশ বসু যেমন প্রথাবদ্ধ বাউন্ডুলেপনার ধারাপাতের আবদ্ধ এক্কাদোক্কাতে কখনোই নিজেকে মেলে ধরেন নি, নিজের সৃষ্টিকে সেই একের ভিতর অনেক ছন্দে বিকশিত করেন নি, তেমনটা কখনো এই খালাসিটোলার উন্মত্ত যৌবনের ফেনিল আস্তরণে বিকাশমান সৃষ্টিশীলতার পর্দাগুলো দোলা খায় নি। একটা আবর্তে সেই সময়ের কাঠিন্যকে এঁরা ভেঙেছেন। সমরেশ যখন তৈরি করেছেন একের পর এক সময়ের দলিল সময়েরই কষ্টিপাথরে, তখন সুনীল, শক্তিরা সেই সময়ের উত্তালকাহিনির কাঠখোদাই করা চিত্রকে উৎকীর্ণ করেছেন মোটের উপর নাগরিক পরিবৃত্তে। সেই পরিবৃত্তের ব্যাপ্তিকেই এক অসামান্য মাত্রাবৃত্তের ছান্দসিক মেরুকরণে স্পন্দিত করেছিলেন কমলকুমার। সুহাসিনীর পমেটম যখন মধ্যবিত্তের চেনা দুনিয়াকে উল্টেপাল্টে দিয়েছে। আবার ‘নিম অন্নপূর্ণা’ই নিম্নবিত্তের মূল্যবোধকে একটা কালের কষ্টি পাথরে গেঁথেছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত হয়তো মধ্যবিত্তের এই সঙ্কট আর নিম্নবিত্তের সঙ্কটের থেকে বের হয়ে আসার একটা মনস্বাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, এই চাপান উতোরটাকে তাঁর যৌবনকালের অন্যতম বড়ো সামাজিক ঘূর্ণন বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। সেই কারণেই হয়তো কমলকুমার কাহিনীকে সেলুলয়ডে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সময়ের টিকছাপকে একটা আগামীর প্রক্ষিপ্ত উল্লঙ্ঘন হিশেবেই মেলে ধরতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। সঙ্কটের আবর্তে নিজে সাঁতার না কাটলে সঙ্কটের চরিত্র বোঝা কঠিন হয়। আর সেই না বুঝে আবর্ত নির্মাণের চেষ্টা করলেই- সেই সৃষ্টি হয়ে পড়ে জোলো, মেকি- এই প্রত্যয় কিন্তু মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখার সময় থেকেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ভিতরে ছিল। সময়ের দাবিতে সেই প্রত্যয় অনেক শাসে, জলে পুরুষ্টু হয়েছে। কিন্তু কখনোই কি কলমে, কি সেলুলয়েডে প্রত্যয়হীন একটা মেকি চিত্রকল্পের ফাজলামো নির্মাণের কথা কোনো অবস্থাতেই তিনি ভাবতে পারেন নি। এই প্রত্যয়ের স্থিততাই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতাকে করে তুলেছে ফিল্ম। আবার বলা যেতে পারে ফিল্মকে করে তুলেছে কবিতা। আবার কখনো কখনো সেই কবিতা হয়ে উঠেছে একটা ক্যানভাস জোড়া ছবি কিংবা সিনেমা হয়ে উঠেছেন সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠের রবীন্দ্রমন্ত্র।

কবিতার বুদ্ধদেব যখন দাঁড়াতেন ক্যামেরার পিছনে তখন সেলুলয়েডে লেখা হতো ছন্দ আর ছন্দভাঙার এক আক্ষরিক যুদ্ধের দামামার ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ছন্দোবদ্ধ শব্দাবলী। কবিতার ধারাতে বুদ্ধদেবকে সুনীল, শক্তি, তারাপদ রায়দের ঘরাণার শিল্পী বলে অভিহিত করা যায়। কমলকুমার আসেন বুদ্ধদেবের ফিল্মি ভাষার কবিতার ছান্দসিক যাপনচিত্রের বিনিসুতুর টানাপোড়েনে। সেই সুতোর কাছে ওঠে হাজারো বাহারি নক্সা। কবিতার কাগজ, কলম, পেন্সিল, ছাপাখানা, প্রুফ, বই, মলাট- কখন যে হয়ে অ্যাকশন-রোলিং-কাটের ছন্দোময় জীবন তা বুদ্ধদেব ও হয়তো মালুম করতে পারতেন না, পারেন না দর্শক কিংবা শ্রোতা বা পাঠক।

এই যে কবিতা কখনো খালিসিটোলার হইচই, আগাড়ম্বর আবার কখনো পুরুলিয়ার শুষ্ক মাটি কিংবা শিমুলে আগুন ধরানো আকাশ হয়ে ওঠে। সেই আকাশের একমুঠো রঙই হয়তো ছড়িয়ে যায় স্কটিশ চার্চের মেধাবী আমেজে। সেই আমেজে বুদ্ধদেব কে কখন যে ঋদ্ধ করে চলে যান কেয়া চক্রবর্তী, পাঠক-শ্রোতা-দর্শক তো কোন ছাড়! বুদ্ধদেব নিজেও হয়তো সব সময়ে ঠিক সময় মতো তা বুঝে উঠতে পারেন না। তবুও জেগে থাকে মায়া। যেন কোন অনাগত অতীত থেকে ভেসে ভেসে আসে পেঁজা তুলোর মতো কেয়া চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বর। কেয়ার অভিনয়ের দীপ্ত ভঙ্গিমা। সর্বোপরি শিল্পী হিশেবে কেয়ার উন্নত মেরুদ-টি।

জীবনানন্দীয় ধারার গভীর থেকে গভীরতম অনুরাগী হয়েও খালাসিটোলার সেইসব বাউুলেদের ভিতরে যেমন একটা ছক ভাঙার অন্তহীন জাগর সব সময়েই তীব্রভাবে শক্তিশালী ছিল, তেমনিই সমসাময়িক বাংলা ফিল্মে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-জহির রায়হান-মৃণালের সময়ের সঙ্গে বা একটু পরের স্রষ্টা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নিজেকে কখনো চেনা ছন্দে, কখনো অচেনা আনন্দে ঋত্বিকের যন্ত্রণাক্ষিপ্ত হৃদয়ের অনুরাগী হিশেবেই যেন নিজেকে অনেকটা মেলে দেন। অথচ সেই অনুরাগে ঋত্বিকের আনমেথোডিকাল সেন্সগুলি একেবারেই বিদ্যমান থাকে না। এই মেথডিকাল, অর্থাৎ নিয়মানুবর্তিতার দিকে বুদ্ধদেবকে যেন মনে হয় অনেকটাই সত্যজিৎ রায়ের ঘরের মানুষ। আবার সেই মানুষটিকেই যেন কোনো সঙ্গতিপূর্ণ মনে হয় মৃণাল সেনের সঙ্গে ফিল্ম নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্তহীন রাজানুগ্রহের ধারাপ্রবাহ দেখে। ঋত্বিকের যে ক্ষুব্ধ স্বদেশের অন্ধিসন্ধিগুলো ঘিরে যন্ত্রণা ছিল, সেই যন্ত্রণার প্রকাশ ছিল, তেমন যন্ত্রণাবিদ্ধ বনপোড়া হরিণীর আর্তনাদ বুদ্ধদেবের সৃষ্টিতে অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেই আর্তনাদের উচ্চারণে বুদ্ধদেব ছিলেন সত্যজিতের মতোই আর্ট বিষয়ক খুঁতখুঁতে একজন মানুষ। সত্যজিতের মতোই অত্যন্ত বেশি রকমের পারফেকশনিস্ট। কোনো জোড়াতালি দিয়ে সৃষ্টিকে তুলে ধরবার প্রশ্নে তিনি কখনোই নিজের সঙ্গে নিজে আপোস করেন নি। এই চূড়ান্ত পারফেকশনিজম সত্যজিৎকে যেমন সৃষ্টিজনিত সাফল্য দিয়েছিল, তেমনটাই প্রাপ্তি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তেরও ঘটেছিল।

ছয়ের দশকের রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গ বুদ্ধদেবের মননলোকে সাড়া ফেলেছিল। সাতের দশকের মাদকতা কখনো কখনো তাঁকে শঙ্খ ঘোষের ‘কবিই শুধু নিজের জোরে মাতালে’র আঙ্গিকে মাতাল করেছিল। আবার সাতের দশকের শেষদিকের রাজনৈতিক স্থিতি তাঁকে একটি স্থিরবিন্দুতে স্থিত হতে অনেকখানিই সাহায্য করেছিল। সাতের দশকের সঙ্কীর্ণতাবাদী রাজনীতির আবেগ যে সমসাময়িক বাংলার অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের মতোই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকেও খানিকটা মজিয়ে দেয় নি- এমনটা মনে করবার কিন্তু আদৌ এতোটুকু কারণ নেই। কিন্তু সেই মজে যাওয়াটা পরবর্তীকালের স্থিতধী প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রেও বুদ্ধদেবের জীবনে খুবই ইতিবাচক একটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি তৈরির একটা বড় সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটে ছিল বামফ্রন্ট সরকার। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের দায়িত্ব ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে। অনেকেই মনে করেন, ছাত্র জীবনে বামপন্থার সঙ্গে প্রায় সম্পর্কবিহীন, এমনকি বামপন্থাবিরোধী বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ভিতরে বামপন্থা এবং বামপন্থীদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক মানসিকতার সৃষ্টিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বড়ো রকমের প্রভাব বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের উপর পড়েছিল। রাজনীতিক বুদ্ধদেবের বৌদ্ধিক চেতনা, কবি বুদ্ধদেব- ফিল্মমেকার বুদ্ধদেবকে নিজের সৃষ্টির অভিমুখকে শ্রেণি সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দুতে ফোকাস করতে অনেকখানিই সাহায্য করেছিল। আর এই সময়কালের সব থেকে বড়ো যে বৈশিষ্ট্যটা আমরা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে দেখেছিলাম, সেটি হলো; সরকারি অনুগ্রহ নিজের শিল্পকলার বিকাশে একজন শিল্পী অর্জন করলেও তাঁকে কখনোই বাধ্য করা হতো না, সরকার বা শাসকদলের হয়ে শীবাকীর্তন গাইতে বাধ্য করা। বর্তমান নিবন্ধকার সাক্ষী আছেন যে, দিব্যেন্দু পালিতের মতো সাহিত্যিক, যিনি কলকাতার ভিতরে বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে সি পি আই (এম) বিধায়ক শচীন সেনের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে খবরের কাগজের পাতায় সলব হয়েও পরবর্তীতে সাধারণ ভোটের কালে বামফ্রন্টকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো বিবৃতিতে সই করতে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সরকারী সাহায্য অনেক পেয়েছিলেন বামফ্রন্টের কালে। কিন্তু তার বিনিময়ে বামফ্রন্ট আমলে তাঁকে কখনো সরকার বা সরকারী দলের হয়ে শীবাকীর্তন গাইতে বাধ্য করা হয়েছে- এমনটা কখনো দেখা যায় নি। কি ভারত, কি বাংলাদেশ সর্বত্রই শাসকের এই ধরনের বিষয়ে এটাই প্রধান প্রবণতা দেখা যায় যে, শাসকের গুণকীর্তনে সম্মতি না জানালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হয়ে ওঠেন শাসক দলের টার্গেট। ছলে বলে কৌশলে তাঁকে হেনস্থা করতে ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে বসে থাকা কুশিলবেরা অত্যন্ত যতœবান হয়ে পড়েন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত আর্থ-ক্ষমতার মদদ না পেলেই একদা রাজানুগ্রহ পাওয়া স্রষ্টা হয়ে ওঠেন সব থেকে কঠিন রাজ সমালোচক।

এই বিষয়াবলীর একটিও আমরা ঘটতে দেখি না বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে ঘিরে। একটা সময়ে যে বামপন্থার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল, শ্রেণি সচেতনতার স্ফুরণ প্রায় ছিল নাই বলা যেতে পারে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাহচর্য সেই বদলটা ঘটিয়ে দিল পুরোপুরিভাবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ভিতরে। কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কাছে টিকি না বেঁধেও নিজেকে একজন সফলভাবে বামপন্থী চিন্তক হিশেবে মেলে ধরতে সক্ষম হলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কখনো বাধ্য করলেন না বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে ব্রিগেডে বামফ্রন্টের সমাবেশে হাজিরা দিতে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের অনুপ্রেরণার শীবারবে মত্ত হয়ে উঠতেও হলো না ফিল্মমেকার বুদ্ধদেবকে।

শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে শিল্পীর এই পরিম-লেই শিরদাঁড়া সোজা রাখবার প্রশ্নটা অনেকবেশি জরুরি হয়ে ওঠে। রাজার প্রসাদ পেতে ঢপের দলের শখের কীর্তনিয়া হওয়ার সুপ্ত বাসনা অনেকেরই থাকে। কিন্তু মন্দ মেয়ের উপাখ্যান রচনা করে প্রগতিশীল বলে দাবি করা শাসকের গৌরবের দিনগুলিতেও কয়লায় কালো সত্যকে তুলে ধরতে হাত কাঁপে নি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের। কারণ, তিনি জানতেন; সেই সময়ের সরকার কখনোই, ‘সব করে দিয়েছি’ এই মানসিকতাকে সমাজের বুকে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করে নি।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

মেরুদণ্ড সোজা রাখার আর এক নাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

গৌতম রায়

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/17Jun21/news/buddhodev.jpg

যে সৃষ্টিই রসোত্তীর্ণ হয় স্রষ্টার সোজা মেরুদণ্ডের গুণে- এটা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন সদ্য প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। লেখার দুনিয়াতেই হোক, কিংবা গান, ছবি আঁকা বা খেলাধুলা- যে কোনো সৃষ্টিশীলতাতেই স্রষ্টার উঁচু মাথাটা উঁচু করে আকাশের দিকে মেলে রাখাটা যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে, তখন আজীবন মাথা উঁচু করে রাখা মানুষটা ঘুমের অচেতনতার ভিতরে মৃত্যুর গহীন স্রারাজ্যে প্রবেশ করেও দেখিয়ে দিলেন, মৃত্যু নামক শূন্যতার কাছে ও শান্ত-ঋজু-দৃঢ় মেরুদণ্ডের স্পর্শন কীভাবে পূর্ণতা নির্মাণের দিকপ্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে। মৃত্যুসাগর সরিয়ে কীভাবে শূন্যে বেঁচে থাকা যায়- জীবনানন্দের কবিতাকে যেন নিজের জীবন আর সৃষ্টির দোলাচালে আগামী প্রজন্মকে ভাবার ভাবনা দিয়েই জীবননাট্য থেকে অন্তর্হিত হলেন বুদ্ধদেব।

প্রোপাগান্ডিস্ট না হলে কোনো পন্থাই কোনো মানুষকে ঠিক আপনার জন বলে ভেবে নিতে পারে না। তাই কোনো দলের কাছে টিকি না বাঁধা বুদ্ধদেব নাকি প্রথম জীবনে মারাত্মক বামপন্থা বিরোধী ছিলেন- সেই তৈলাধার পাত্রের বাখোয়াজি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ, তাঁর সৃষ্টিতে শ্রেণির কথা বলেছেন। হয়তো সেই শ্রেণিদর্শনের পৌনঃপৌনিকতা কখনো কখনো আর্টের ক্যানভাসে কারো কারো কাছে রিপিটেশন বলে ঠাওর হয়েছে। তবু যেহেতু প্রয়োজনে কিংবা বিনা কারণে চরিত্রের মুখে তিনি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলান নি, তাই হয়তো বুদ্ধদেবের পৈতে বা ফেজ টুপি কিংবা নূর দাঁড়ি খুঁজবার মানুষের এখন অভাব খুব একটা হবে না।

মেরুদণ্ডের ঋজুতা, দৃঢ়তা তৈরিতে দরকার পড়ে পরিবেশ অনুকূলতা। একটা স্বচ্ছ, যুক্তিপূর্ণ অথচ সংবেদনশীল পরিবেশ না পেলে মেরুদণ্ডের সম্যক বিকাশ ঘটানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য বিষয়। আর সেই রেশমী কিন্তু ইস্পাতকঠিন পরিবেশ গড়তে দরকার হয় পারিপার্শ্বিকতার। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোরের সামাজিক যন্ত্রণা- দেশভাগ এবং তার পরবর্তী আবর্তন একটা সংবেদনশীল মেরুদণ্ডের প্রতিটি তন্তুকে গড়েছিল পরম যত্নে। তাই সমকালীনতার প্রেক্ষিত যেমন কবিতায়, তেমনই ফিল্মে যেন একটা অবচেতন প্রলেপ দিয়ে গিয়েছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে।

http://sangbad.net.bd/images/2021/June/17Jun21/news/buddhodev-2.jpg

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নির্মিত টোপ ছবিতে অভিনয় করেছেন পাওলি দাম

কবিতার একটা বাস্তব পরাবাস্তবের দোলাচালে চিন্তার প্রক্ষেপণ ঘটেছিল বুদ্ধদেবের। সেই দিক থেকে যদি বিচার করতে হয়, তাহলে বলতে হবে, ফিল্ম নয়, কবিতাই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। তিনি যখন প্রথম কবিতা লেখেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র চৌদ্দ। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা যখন প্রথম ছাপা হয়েছিল তখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বয়স মাত্র ষোল। কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিম-লে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব। খালাসিটোলার পানাসক্তি একদিকে এঁদের জীবনকে একটু অন্যরকমভাবে দেখতে শিখিয়েছিল। আবার অপরদিকে সেই অন্যরকমভাবে দেখা-চেনা-শোনা-জানার পরিম-ল তাঁদের প্রত্যেকের সৃষ্টিকেই একটা ভিন্ন খাতে বইয়ে দিয়েছিল। সৃষ্টির উনর ফেলেছিল একটা সময়ের প্রলম্বিত প্রতিবিম্ব।

কোনো জোড়াতালি দিয়ে সৃষ্টিকে তুলে ধরবার প্রশ্নে তিনি কখনোই নিজের সঙ্গে নিজে আপোস করেন নি। এই চূড়ান্ত পারফেকশনিজম সত্যজিৎকে যেমন সৃষ্টিজনিত সাফল্য দিয়েছিল, তেমনটাই প্রাপ্তি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তেরও ঘটেছিল।

সমরেশ বসু যেমন প্রথাবদ্ধ বাউন্ডুলেপনার ধারাপাতের আবদ্ধ এক্কাদোক্কাতে কখনোই নিজেকে মেলে ধরেন নি, নিজের সৃষ্টিকে সেই একের ভিতর অনেক ছন্দে বিকশিত করেন নি, তেমনটা কখনো এই খালাসিটোলার উন্মত্ত যৌবনের ফেনিল আস্তরণে বিকাশমান সৃষ্টিশীলতার পর্দাগুলো দোলা খায় নি। একটা আবর্তে সেই সময়ের কাঠিন্যকে এঁরা ভেঙেছেন। সমরেশ যখন তৈরি করেছেন একের পর এক সময়ের দলিল সময়েরই কষ্টিপাথরে, তখন সুনীল, শক্তিরা সেই সময়ের উত্তালকাহিনির কাঠখোদাই করা চিত্রকে উৎকীর্ণ করেছেন মোটের উপর নাগরিক পরিবৃত্তে। সেই পরিবৃত্তের ব্যাপ্তিকেই এক অসামান্য মাত্রাবৃত্তের ছান্দসিক মেরুকরণে স্পন্দিত করেছিলেন কমলকুমার। সুহাসিনীর পমেটম যখন মধ্যবিত্তের চেনা দুনিয়াকে উল্টেপাল্টে দিয়েছে। আবার ‘নিম অন্নপূর্ণা’ই নিম্নবিত্তের মূল্যবোধকে একটা কালের কষ্টি পাথরে গেঁথেছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত হয়তো মধ্যবিত্তের এই সঙ্কট আর নিম্নবিত্তের সঙ্কটের থেকে বের হয়ে আসার একটা মনস্বাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, এই চাপান উতোরটাকে তাঁর যৌবনকালের অন্যতম বড়ো সামাজিক ঘূর্ণন বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। সেই কারণেই হয়তো কমলকুমার কাহিনীকে সেলুলয়ডে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সময়ের টিকছাপকে একটা আগামীর প্রক্ষিপ্ত উল্লঙ্ঘন হিশেবেই মেলে ধরতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। সঙ্কটের আবর্তে নিজে সাঁতার না কাটলে সঙ্কটের চরিত্র বোঝা কঠিন হয়। আর সেই না বুঝে আবর্ত নির্মাণের চেষ্টা করলেই- সেই সৃষ্টি হয়ে পড়ে জোলো, মেকি- এই প্রত্যয় কিন্তু মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখার সময় থেকেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ভিতরে ছিল। সময়ের দাবিতে সেই প্রত্যয় অনেক শাসে, জলে পুরুষ্টু হয়েছে। কিন্তু কখনোই কি কলমে, কি সেলুলয়েডে প্রত্যয়হীন একটা মেকি চিত্রকল্পের ফাজলামো নির্মাণের কথা কোনো অবস্থাতেই তিনি ভাবতে পারেন নি। এই প্রত্যয়ের স্থিততাই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতাকে করে তুলেছে ফিল্ম। আবার বলা যেতে পারে ফিল্মকে করে তুলেছে কবিতা। আবার কখনো কখনো সেই কবিতা হয়ে উঠেছে একটা ক্যানভাস জোড়া ছবি কিংবা সিনেমা হয়ে উঠেছেন সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠের রবীন্দ্রমন্ত্র।

কবিতার বুদ্ধদেব যখন দাঁড়াতেন ক্যামেরার পিছনে তখন সেলুলয়েডে লেখা হতো ছন্দ আর ছন্দভাঙার এক আক্ষরিক যুদ্ধের দামামার ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ছন্দোবদ্ধ শব্দাবলী। কবিতার ধারাতে বুদ্ধদেবকে সুনীল, শক্তি, তারাপদ রায়দের ঘরাণার শিল্পী বলে অভিহিত করা যায়। কমলকুমার আসেন বুদ্ধদেবের ফিল্মি ভাষার কবিতার ছান্দসিক যাপনচিত্রের বিনিসুতুর টানাপোড়েনে। সেই সুতোর কাছে ওঠে হাজারো বাহারি নক্সা। কবিতার কাগজ, কলম, পেন্সিল, ছাপাখানা, প্রুফ, বই, মলাট- কখন যে হয়ে অ্যাকশন-রোলিং-কাটের ছন্দোময় জীবন তা বুদ্ধদেব ও হয়তো মালুম করতে পারতেন না, পারেন না দর্শক কিংবা শ্রোতা বা পাঠক।

এই যে কবিতা কখনো খালিসিটোলার হইচই, আগাড়ম্বর আবার কখনো পুরুলিয়ার শুষ্ক মাটি কিংবা শিমুলে আগুন ধরানো আকাশ হয়ে ওঠে। সেই আকাশের একমুঠো রঙই হয়তো ছড়িয়ে যায় স্কটিশ চার্চের মেধাবী আমেজে। সেই আমেজে বুদ্ধদেব কে কখন যে ঋদ্ধ করে চলে যান কেয়া চক্রবর্তী, পাঠক-শ্রোতা-দর্শক তো কোন ছাড়! বুদ্ধদেব নিজেও হয়তো সব সময়ে ঠিক সময় মতো তা বুঝে উঠতে পারেন না। তবুও জেগে থাকে মায়া। যেন কোন অনাগত অতীত থেকে ভেসে ভেসে আসে পেঁজা তুলোর মতো কেয়া চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বর। কেয়ার অভিনয়ের দীপ্ত ভঙ্গিমা। সর্বোপরি শিল্পী হিশেবে কেয়ার উন্নত মেরুদ-টি।

জীবনানন্দীয় ধারার গভীর থেকে গভীরতম অনুরাগী হয়েও খালাসিটোলার সেইসব বাউুলেদের ভিতরে যেমন একটা ছক ভাঙার অন্তহীন জাগর সব সময়েই তীব্রভাবে শক্তিশালী ছিল, তেমনিই সমসাময়িক বাংলা ফিল্মে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-জহির রায়হান-মৃণালের সময়ের সঙ্গে বা একটু পরের স্রষ্টা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নিজেকে কখনো চেনা ছন্দে, কখনো অচেনা আনন্দে ঋত্বিকের যন্ত্রণাক্ষিপ্ত হৃদয়ের অনুরাগী হিশেবেই যেন নিজেকে অনেকটা মেলে দেন। অথচ সেই অনুরাগে ঋত্বিকের আনমেথোডিকাল সেন্সগুলি একেবারেই বিদ্যমান থাকে না। এই মেথডিকাল, অর্থাৎ নিয়মানুবর্তিতার দিকে বুদ্ধদেবকে যেন মনে হয় অনেকটাই সত্যজিৎ রায়ের ঘরের মানুষ। আবার সেই মানুষটিকেই যেন কোনো সঙ্গতিপূর্ণ মনে হয় মৃণাল সেনের সঙ্গে ফিল্ম নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্তহীন রাজানুগ্রহের ধারাপ্রবাহ দেখে। ঋত্বিকের যে ক্ষুব্ধ স্বদেশের অন্ধিসন্ধিগুলো ঘিরে যন্ত্রণা ছিল, সেই যন্ত্রণার প্রকাশ ছিল, তেমন যন্ত্রণাবিদ্ধ বনপোড়া হরিণীর আর্তনাদ বুদ্ধদেবের সৃষ্টিতে অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেই আর্তনাদের উচ্চারণে বুদ্ধদেব ছিলেন সত্যজিতের মতোই আর্ট বিষয়ক খুঁতখুঁতে একজন মানুষ। সত্যজিতের মতোই অত্যন্ত বেশি রকমের পারফেকশনিস্ট। কোনো জোড়াতালি দিয়ে সৃষ্টিকে তুলে ধরবার প্রশ্নে তিনি কখনোই নিজের সঙ্গে নিজে আপোস করেন নি। এই চূড়ান্ত পারফেকশনিজম সত্যজিৎকে যেমন সৃষ্টিজনিত সাফল্য দিয়েছিল, তেমনটাই প্রাপ্তি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তেরও ঘটেছিল।

ছয়ের দশকের রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গ বুদ্ধদেবের মননলোকে সাড়া ফেলেছিল। সাতের দশকের মাদকতা কখনো কখনো তাঁকে শঙ্খ ঘোষের ‘কবিই শুধু নিজের জোরে মাতালে’র আঙ্গিকে মাতাল করেছিল। আবার সাতের দশকের শেষদিকের রাজনৈতিক স্থিতি তাঁকে একটি স্থিরবিন্দুতে স্থিত হতে অনেকখানিই সাহায্য করেছিল। সাতের দশকের সঙ্কীর্ণতাবাদী রাজনীতির আবেগ যে সমসাময়িক বাংলার অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের মতোই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকেও খানিকটা মজিয়ে দেয় নি- এমনটা মনে করবার কিন্তু আদৌ এতোটুকু কারণ নেই। কিন্তু সেই মজে যাওয়াটা পরবর্তীকালের স্থিতধী প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রেও বুদ্ধদেবের জীবনে খুবই ইতিবাচক একটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি তৈরির একটা বড় সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটে ছিল বামফ্রন্ট সরকার। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের দায়িত্ব ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে। অনেকেই মনে করেন, ছাত্র জীবনে বামপন্থার সঙ্গে প্রায় সম্পর্কবিহীন, এমনকি বামপন্থাবিরোধী বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ভিতরে বামপন্থা এবং বামপন্থীদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক মানসিকতার সৃষ্টিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বড়ো রকমের প্রভাব বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের উপর পড়েছিল। রাজনীতিক বুদ্ধদেবের বৌদ্ধিক চেতনা, কবি বুদ্ধদেব- ফিল্মমেকার বুদ্ধদেবকে নিজের সৃষ্টির অভিমুখকে শ্রেণি সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দুতে ফোকাস করতে অনেকখানিই সাহায্য করেছিল। আর এই সময়কালের সব থেকে বড়ো যে বৈশিষ্ট্যটা আমরা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে দেখেছিলাম, সেটি হলো; সরকারি অনুগ্রহ নিজের শিল্পকলার বিকাশে একজন শিল্পী অর্জন করলেও তাঁকে কখনোই বাধ্য করা হতো না, সরকার বা শাসকদলের হয়ে শীবাকীর্তন গাইতে বাধ্য করা। বর্তমান নিবন্ধকার সাক্ষী আছেন যে, দিব্যেন্দু পালিতের মতো সাহিত্যিক, যিনি কলকাতার ভিতরে বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে সি পি আই (এম) বিধায়ক শচীন সেনের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে খবরের কাগজের পাতায় সলব হয়েও পরবর্তীতে সাধারণ ভোটের কালে বামফ্রন্টকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো বিবৃতিতে সই করতে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সরকারী সাহায্য অনেক পেয়েছিলেন বামফ্রন্টের কালে। কিন্তু তার বিনিময়ে বামফ্রন্ট আমলে তাঁকে কখনো সরকার বা সরকারী দলের হয়ে শীবাকীর্তন গাইতে বাধ্য করা হয়েছে- এমনটা কখনো দেখা যায় নি। কি ভারত, কি বাংলাদেশ সর্বত্রই শাসকের এই ধরনের বিষয়ে এটাই প্রধান প্রবণতা দেখা যায় যে, শাসকের গুণকীর্তনে সম্মতি না জানালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হয়ে ওঠেন শাসক দলের টার্গেট। ছলে বলে কৌশলে তাঁকে হেনস্থা করতে ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে বসে থাকা কুশিলবেরা অত্যন্ত যতœবান হয়ে পড়েন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত আর্থ-ক্ষমতার মদদ না পেলেই একদা রাজানুগ্রহ পাওয়া স্রষ্টা হয়ে ওঠেন সব থেকে কঠিন রাজ সমালোচক।

এই বিষয়াবলীর একটিও আমরা ঘটতে দেখি না বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে ঘিরে। একটা সময়ে যে বামপন্থার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল, শ্রেণি সচেতনতার স্ফুরণ প্রায় ছিল নাই বলা যেতে পারে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাহচর্য সেই বদলটা ঘটিয়ে দিল পুরোপুরিভাবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ভিতরে। কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কাছে টিকি না বেঁধেও নিজেকে একজন সফলভাবে বামপন্থী চিন্তক হিশেবে মেলে ধরতে সক্ষম হলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কখনো বাধ্য করলেন না বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে ব্রিগেডে বামফ্রন্টের সমাবেশে হাজিরা দিতে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের অনুপ্রেরণার শীবারবে মত্ত হয়ে উঠতেও হলো না ফিল্মমেকার বুদ্ধদেবকে।

শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে শিল্পীর এই পরিম-লেই শিরদাঁড়া সোজা রাখবার প্রশ্নটা অনেকবেশি জরুরি হয়ে ওঠে। রাজার প্রসাদ পেতে ঢপের দলের শখের কীর্তনিয়া হওয়ার সুপ্ত বাসনা অনেকেরই থাকে। কিন্তু মন্দ মেয়ের উপাখ্যান রচনা করে প্রগতিশীল বলে দাবি করা শাসকের গৌরবের দিনগুলিতেও কয়লায় কালো সত্যকে তুলে ধরতে হাত কাঁপে নি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের। কারণ, তিনি জানতেন; সেই সময়ের সরকার কখনোই, ‘সব করে দিয়েছি’ এই মানসিকতাকে সমাজের বুকে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করে নি।

back to top