alt

সাময়িকী

বহু বিচিত্র সেলিনা হোসেন

রাহাত রাব্বানী

: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

সেলিনা হোসেন / জন্ম : ১৪ জুন ১৯৪৭

সেলিনা হোসেন বাংলা কথাসাহিত্যে এক অপরিহার্য নাম। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে রচনা করেছেন কালোত্তীর্ণ নানান লেখা। হয়েছেন বিভিন্ন ভাষার পাঠকের কাছেও অতি প্রিয়।

সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসে আধুনিকতার ছাপ প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে। আধুনিকতার এই হাতেখড়িও শুরু হয় পরিবার থেকেই। আকিকা করা ‘খায়রুন্নেসা’ নাম বদলিয়ে তার বড় বোন পরীক্ষায় খাতায় নাম রাখেন ‘সেলিনা হোসেন’। সময়ের তুলনায় যা নিঃসন্দেহে প্রবল সাহসিকতা, একই সাথে, আধুনিকতা। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। রাকসু এবং ছাত্রী হলে নির্বাচনও করেন আধুনিক এই কথাকার। তাঁর মা ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন- যা তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে ধরা পড়ে।

১৯৪৭ সালে রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষার প্রভাবসঞ্চারী লেখক সেলিনা হোসেন। ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই প্রকাশ পায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্প চর্চা শুরু করেন সেলিনা হোসেন। তিনি মনে করেন, “লেখক তার সাহিত্যে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন, সে শেকড় যায় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় শেকড় প্রোথিত করা সহজ। ছড়ানো ছিটানো বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র মিলে এই ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনেক বড়। যা কবিতায় সহজ নয়।”

লেখালেখিই তাঁর একমাত্র আরাধ্য। লেখালেখি তাকে দিয়েছেও প্রচুর। ইংরেজি, রুশ, কানাডি, মেলেসহ নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার গল্প-উপন্যাস। দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রচনা পাঠ্য। শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত। সেলিনা হোসেনের সাহিত্য কর্মের ওপর হয়েছে ১১ টি পিএইচডি।

বাবার চাকুরির কল্যাণে তিনি দেখেছেন বাংলার প্রকৃতি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের জীবন। যা তার সাহিত্যে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। তিনি অতীতকে দেখেন বর্তমানের দৃষ্টিতে। খুঁজে নেন শিল্পিত উপাদান- যা তার ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে উপস্থিতি। লোভ, অধঃপতন ও প্রতিরোধের এই গল্পে টের পাওয়া যায় স্বৈরশাসনের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সেলিনা হোসেনের লেখার মৌল উপাদান। তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সালের ধারা বর্ণনা পাই সহজেই।

সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ গোছানো শুরু হতেই আবার বাংলার ভাগ্যাকাশে নামে কালো মেঘের ঘনঘটা। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ রাতে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে সেলিনা হোসেন রচনা করেন ‘আগস্টের একরাত’। মুজিব হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ এখানে লেখক না দেখিয়ে পাঠককে করেছেন অনুসন্ধানী। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তিনি। কবি শহীদ কাদরীর কণ্ঠে সেলিনা হোসেন উপস্থাপন করেছেন সেই সতর্কবার্তা: “প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশক্রমে মি. কাও চুয়াত্তরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। আপনার জীবন সংশয় বিষয়ে তিনি জানালে, আপনি বলেছিলেন, ওরা আমার সন্তান। ওরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না।”

সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের মূল প্রবণতা সময়কে নিজস্ব ঘরানায় চিহ্নিত করা। যার কারণে ঘুরেফিরে রাজনীতি নানানভাবে তাঁর লেখায় ধরা দেয়। একসময়ের তুমুল আলোচিত ছিটমহল নিয়ে লিখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাস। সম্ভবত বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম এই বিষয়ে উপন্যাস লিখেন। সেইসময়, অধ্যাপক ইউলিয়াম ভ্যান সেন্ডেল (নেদারল্যান্ড)-এর একটি গবেষণা পড়ে আন্দোলিত হন সেলিনা হোসেন। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পটভূমি লেখা ‘ভূমি ও কুসুম’-এ মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ।

নানান বিষয়ে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসেন সেলিনা হোসেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে উক্ত উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ। কাল্পনিক এক কাহিনির শেষে এসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কঠিন বাস্তবতা তুলে আনেন উপন্যাসের শেষ অংশে। বুড়ি তার ছেলেকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়ার এই ঘটনা লেখক জানেন তার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজের কাছ থেকে। যশোরের কালীগঞ্জের এই ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে প্রথমে অনুরোধ তিনিই করেন। “তুই মরে গেলি। আমি রইলাম তোর শোক বহন করার জন্য।” -মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা সন্তানের জন্য সকল মায়ের করুণ হাহাকার বুড়ির মাধ্যমেই ধরা দিয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দ. এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে উপন্যাসটি পাঠ্য।

সেলিনা হোসেন মানুষকে দেখেছেন নানানভাবে। নাগরিক মধ্যবিত্তের আত্ম-সংকট, ধর্মান্ধতা বিষয়কে নিয়ে রচিত হয়েছে তার নগরজীবন কেন্দ্রিক উপন্যাস ‘মগ্ন চৈতন্যে শিষ’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’ প্রকাশ পায়। নদী তীরবর্তী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের সংগ্রামী জীবনধারাকে চিত্রিত করেছেন এখানে। একইভাবে নাফ নদীর তীরবর্তী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চিহ্নিত হয়েছে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’তে। এশিয়া ও আফ্রিকা এই দুই মহাদেশের মানুষের গল্প নিয়ে রচনা করেন ‘গাছটির ছায়া নেই’। ২০১২ সালে এইচআইভি ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে।

সেলিনা হোসেনের অনুপ্রেরণার এক বড় অংশজুড়ে বিচরণ করছে কবিগুরুর জীবন ও সাহিত্য সৃষ্টি। বিশ্বকবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও রয়েছে সেলিনা হোসেনের সরব উপস্থিতি। শিলাইদহ, পতিসর, শাহবাজপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানের পটভূমি নিয়ে চিত্রিত হয়েছে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’। রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের চরিত্রগুলোকে ভেঙে নতুন করে, ‘ছিন্নপত্র’ ও নাটক ব্যবহার করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে।

উপমহাদেশের শক্তিশালী কবি মির্জা গালিকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানান ধরনের বই। দেশ বিদেশের অসংখ্য গবেষকদের বিষয় হয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন নানাবৈচিত্র্যে ভরপুর। ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এই মানুষকে নিয়ে সেলিনা হোসেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’র তুলে এনেছেন শিল্পের সাথে ইতিহাসের যোগ।

সেলিনা হোসেনের লেখার বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, উঠে এসেছে মানবিকতা। মা-মেয়ের গভীর সম্পর্কের সফল উদাহরণ তার ‘লারা’ উপন্যাস। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে পোস্তাগোলায় এরার পারাবতের সেসাস-১৫০ প্রকৃতির বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন লেখকের প্রিয় কন্যা, দেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে লারা লিখেন, ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমরা হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ ফারিয়া লারার দৈহিক প্রস্থান হলেও তার স্বপ্ন এখনো জাগিয়ে রেখেছে মা সেলিনা হোসেন এবং বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান। লারা গণমানুষের কথা ভাবতো। তার ভাবনা আর স্মৃতি আঁকড়ে অই একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয়

‘লারা ফাউন্ডেশন।’ “দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঞ্চনা ও আবহেলার শিকার প্রান্তিক নারী-মেয়ে-শিশু ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক সহায়তা দান” - এই লক্ষ্যে দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি।

ফারিয়া লারার এই মৃত্যুতে প্রচণ্ড ভেঙেও পড়েছিলেন সেলিনা হোসেন। স্তব্ধ হয়ে যায় তার কলম। দেহ-মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অস্থিরাবস্থায়ও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে ফিরে আসেন আবার। লিখেন নিয়মিত। শুধু উপন্যাস নয় গল্প, শিশুসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর সরব উপস্থিতি। মননশীল প্রবন্ধেও জয় করেছেন পাঠকহৃদয়। তাঁর সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে দেশ, সমাজ আর মানুষের কথা। যেখানে খুব সহজেই ধরা পড়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজের আলো কিংবা অন্ধকার।

জীবনের চুয়াত্তর বছর ফেলে আসা প্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কলম থেকে আরও অনেক ‘মগ্ন চৈতন্যের শিস’ বেরিয়ে আসুক। পঁচাত্তরে এই শুভ প্রত্যাশা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

বহু বিচিত্র সেলিনা হোসেন

রাহাত রাব্বানী

সেলিনা হোসেন / জন্ম : ১৪ জুন ১৯৪৭

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

সেলিনা হোসেন বাংলা কথাসাহিত্যে এক অপরিহার্য নাম। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে রচনা করেছেন কালোত্তীর্ণ নানান লেখা। হয়েছেন বিভিন্ন ভাষার পাঠকের কাছেও অতি প্রিয়।

সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসে আধুনিকতার ছাপ প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে। আধুনিকতার এই হাতেখড়িও শুরু হয় পরিবার থেকেই। আকিকা করা ‘খায়রুন্নেসা’ নাম বদলিয়ে তার বড় বোন পরীক্ষায় খাতায় নাম রাখেন ‘সেলিনা হোসেন’। সময়ের তুলনায় যা নিঃসন্দেহে প্রবল সাহসিকতা, একই সাথে, আধুনিকতা। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। রাকসু এবং ছাত্রী হলে নির্বাচনও করেন আধুনিক এই কথাকার। তাঁর মা ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন- যা তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে ধরা পড়ে।

১৯৪৭ সালে রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষার প্রভাবসঞ্চারী লেখক সেলিনা হোসেন। ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই প্রকাশ পায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্প চর্চা শুরু করেন সেলিনা হোসেন। তিনি মনে করেন, “লেখক তার সাহিত্যে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন, সে শেকড় যায় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় শেকড় প্রোথিত করা সহজ। ছড়ানো ছিটানো বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র মিলে এই ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনেক বড়। যা কবিতায় সহজ নয়।”

লেখালেখিই তাঁর একমাত্র আরাধ্য। লেখালেখি তাকে দিয়েছেও প্রচুর। ইংরেজি, রুশ, কানাডি, মেলেসহ নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার গল্প-উপন্যাস। দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রচনা পাঠ্য। শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত। সেলিনা হোসেনের সাহিত্য কর্মের ওপর হয়েছে ১১ টি পিএইচডি।

বাবার চাকুরির কল্যাণে তিনি দেখেছেন বাংলার প্রকৃতি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের জীবন। যা তার সাহিত্যে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। তিনি অতীতকে দেখেন বর্তমানের দৃষ্টিতে। খুঁজে নেন শিল্পিত উপাদান- যা তার ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে উপস্থিতি। লোভ, অধঃপতন ও প্রতিরোধের এই গল্পে টের পাওয়া যায় স্বৈরশাসনের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সেলিনা হোসেনের লেখার মৌল উপাদান। তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সালের ধারা বর্ণনা পাই সহজেই।

সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ গোছানো শুরু হতেই আবার বাংলার ভাগ্যাকাশে নামে কালো মেঘের ঘনঘটা। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ রাতে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে সেলিনা হোসেন রচনা করেন ‘আগস্টের একরাত’। মুজিব হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ এখানে লেখক না দেখিয়ে পাঠককে করেছেন অনুসন্ধানী। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তিনি। কবি শহীদ কাদরীর কণ্ঠে সেলিনা হোসেন উপস্থাপন করেছেন সেই সতর্কবার্তা: “প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশক্রমে মি. কাও চুয়াত্তরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। আপনার জীবন সংশয় বিষয়ে তিনি জানালে, আপনি বলেছিলেন, ওরা আমার সন্তান। ওরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না।”

সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের মূল প্রবণতা সময়কে নিজস্ব ঘরানায় চিহ্নিত করা। যার কারণে ঘুরেফিরে রাজনীতি নানানভাবে তাঁর লেখায় ধরা দেয়। একসময়ের তুমুল আলোচিত ছিটমহল নিয়ে লিখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাস। সম্ভবত বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম এই বিষয়ে উপন্যাস লিখেন। সেইসময়, অধ্যাপক ইউলিয়াম ভ্যান সেন্ডেল (নেদারল্যান্ড)-এর একটি গবেষণা পড়ে আন্দোলিত হন সেলিনা হোসেন। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পটভূমি লেখা ‘ভূমি ও কুসুম’-এ মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ।

নানান বিষয়ে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসেন সেলিনা হোসেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে উক্ত উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ। কাল্পনিক এক কাহিনির শেষে এসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কঠিন বাস্তবতা তুলে আনেন উপন্যাসের শেষ অংশে। বুড়ি তার ছেলেকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়ার এই ঘটনা লেখক জানেন তার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজের কাছ থেকে। যশোরের কালীগঞ্জের এই ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে প্রথমে অনুরোধ তিনিই করেন। “তুই মরে গেলি। আমি রইলাম তোর শোক বহন করার জন্য।” -মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা সন্তানের জন্য সকল মায়ের করুণ হাহাকার বুড়ির মাধ্যমেই ধরা দিয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দ. এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে উপন্যাসটি পাঠ্য।

সেলিনা হোসেন মানুষকে দেখেছেন নানানভাবে। নাগরিক মধ্যবিত্তের আত্ম-সংকট, ধর্মান্ধতা বিষয়কে নিয়ে রচিত হয়েছে তার নগরজীবন কেন্দ্রিক উপন্যাস ‘মগ্ন চৈতন্যে শিষ’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’ প্রকাশ পায়। নদী তীরবর্তী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের সংগ্রামী জীবনধারাকে চিত্রিত করেছেন এখানে। একইভাবে নাফ নদীর তীরবর্তী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চিহ্নিত হয়েছে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’তে। এশিয়া ও আফ্রিকা এই দুই মহাদেশের মানুষের গল্প নিয়ে রচনা করেন ‘গাছটির ছায়া নেই’। ২০১২ সালে এইচআইভি ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে।

সেলিনা হোসেনের অনুপ্রেরণার এক বড় অংশজুড়ে বিচরণ করছে কবিগুরুর জীবন ও সাহিত্য সৃষ্টি। বিশ্বকবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও রয়েছে সেলিনা হোসেনের সরব উপস্থিতি। শিলাইদহ, পতিসর, শাহবাজপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানের পটভূমি নিয়ে চিত্রিত হয়েছে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’। রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের চরিত্রগুলোকে ভেঙে নতুন করে, ‘ছিন্নপত্র’ ও নাটক ব্যবহার করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে।

উপমহাদেশের শক্তিশালী কবি মির্জা গালিকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানান ধরনের বই। দেশ বিদেশের অসংখ্য গবেষকদের বিষয় হয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন নানাবৈচিত্র্যে ভরপুর। ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এই মানুষকে নিয়ে সেলিনা হোসেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’র তুলে এনেছেন শিল্পের সাথে ইতিহাসের যোগ।

সেলিনা হোসেনের লেখার বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, উঠে এসেছে মানবিকতা। মা-মেয়ের গভীর সম্পর্কের সফল উদাহরণ তার ‘লারা’ উপন্যাস। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে পোস্তাগোলায় এরার পারাবতের সেসাস-১৫০ প্রকৃতির বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন লেখকের প্রিয় কন্যা, দেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে লারা লিখেন, ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমরা হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ ফারিয়া লারার দৈহিক প্রস্থান হলেও তার স্বপ্ন এখনো জাগিয়ে রেখেছে মা সেলিনা হোসেন এবং বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান। লারা গণমানুষের কথা ভাবতো। তার ভাবনা আর স্মৃতি আঁকড়ে অই একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয়

‘লারা ফাউন্ডেশন।’ “দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঞ্চনা ও আবহেলার শিকার প্রান্তিক নারী-মেয়ে-শিশু ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক সহায়তা দান” - এই লক্ষ্যে দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি।

ফারিয়া লারার এই মৃত্যুতে প্রচণ্ড ভেঙেও পড়েছিলেন সেলিনা হোসেন। স্তব্ধ হয়ে যায় তার কলম। দেহ-মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অস্থিরাবস্থায়ও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে ফিরে আসেন আবার। লিখেন নিয়মিত। শুধু উপন্যাস নয় গল্প, শিশুসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর সরব উপস্থিতি। মননশীল প্রবন্ধেও জয় করেছেন পাঠকহৃদয়। তাঁর সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে দেশ, সমাজ আর মানুষের কথা। যেখানে খুব সহজেই ধরা পড়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজের আলো কিংবা অন্ধকার।

জীবনের চুয়াত্তর বছর ফেলে আসা প্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কলম থেকে আরও অনেক ‘মগ্ন চৈতন্যের শিস’ বেরিয়ে আসুক। পঁচাত্তরে এই শুভ প্রত্যাশা।

back to top