alt

সাময়িকী

শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অর্জন

এম আবদুল আলীম

: বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/July/08Jul21/news/raju-scuplpture.jpg

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অর্জন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে- বিশ্ববিদ্যালয় কী এবং তার কাজ কী? এ প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব না হলেও সাধারণভাবে বলা যায়, যেখানে জ্ঞানের প্রায় সকল শাখার পঠন-পাঠন ও চর্চার ব্যবস্থা আছে এবং যা বিবেচিত হয় উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে, তা-ই বিশ্ববিদ্যালয়। বিচিত্র বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি জ্ঞানবিস্তার, জ্ঞানের সংরক্ষণ, জ্ঞানসৃষ্টি বা জ্ঞানের প্রবাহকে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করা এবং গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য। বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে জাতির মস্তিষ্ক হিসেবে; এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের থাকে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; জাতির দুর্দিনে বিশ্ববিদ্যালয় দেয় যথাযথ দিক-নির্দেশনা। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় হয় বিশ্বজনীন, বিশে^র জ্ঞানভাণ্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত হয়; জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে তা বৃহত্তর মানবতার মহাসমুদ্রে মিশে যায়।

পূর্ববঙ্গ তথা এ অঞ্চলে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই, বর্তমানে এর সংখ্যা এক শ’ ছাড়িয়ে গেছে। বঙ্গভঙ্গ রদের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় ‘অপূর্ব রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গের মানুষের শিক্ষা এবং শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধির সরল রাজপথ চিহ্নিত করা এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পথ নিষ্কণ্টক ছিল না; শ্রীহট্টের বিপিন পাল, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বর্ধমানের রাসবিহারী ঘোষ প্রবল বিরোধিতা করেন। এছাড়া ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, পিয়ারী মোহন মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চরণ মজুমদার, দ্বারকানাথ চক্রবর্তী, মতিলাল ঘোষ, আশুতোষ মুখার্জীসহ অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এঁদের কাতারে শামিল করলেও তার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই। যা হোক, সকল বাধা অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বহু মানুষের অবদান থাকলেও নবাব সলিমুল্লাহর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে; শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদানের কথাও এক্ষেত্রে স্মর্তব্য, যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সকল পরিকল্পনা ও প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।

পূর্ববঙ্গের মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও ভাগ্যপরিবর্তনের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পদার্পণের কালে নানা সমস্যায় জর্জরিত। ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী এটিসহ বাংলাদেশের বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হলেও বাস্তবে এ বর্ম ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠানে সম্পন্ন করা হয় নানা অপকর্ম; সৃষ্টি করা হয় বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-সাধনা অপেক্ষা নীল, সাদা, হলুদ দল এবং সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষে বিভক্ত হয়ে দলাদলি, রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়েছে। সামরিক স্বৈরশাসকেরা তো বটেই, নির্বাচিত সরকারগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর খবরদারি করে স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন করেছে। এর ফলে বিদ্যাতন্ত্রের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রমাগত কায়েম হয়েছে মাস্তানতন্ত্র। এমন বাস্তবতায় শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে নানাকৌণিক দৃষ্টিতে পর্যালোচনা ও মূল্যায়িত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের গৌরবময় অতীত, অবক্ষয়িত বর্তমান; আর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে সম্ভাবনাময় ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।

১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও ডি-লিট উপাধি প্রদান করে এই বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। এক-শ’ বছরের পথচলায় নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের আকাশে জ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিষ্ঠার পরপরই এটি যে সুদৃঢ় একাডেমিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়, তার মূলে ছিলো জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও গবেষণায় ঋদ্ধ অধ্যাপকবৃন্দ; যাঁদের মধ্যে ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, এ. সি. টার্নার, জি. এইচ. ল্যাংলী, হরিদাস ভট্টাচার্য, এ. এফ. রহমান, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ফিদা আলী খান, ডব্লিউ. এ. জেঙ্কিংস, সত্যেন বোস, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। পূর্ববঙ্গ তথা এ অঞ্চলের মানুষের সকল অর্জনের সঙ্গী হয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য- এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মেধা-মনন-প্রতিভা এবং কর্মের স্পর্শ নেই। শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্জন নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ; তা ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় দৃষ্টিতেই হচ্ছে। সমালোচনার মাত্রা কখনো কখনো এতটাই তীব্র হচ্ছে যে, কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই! বাস্তবেই কি তাই? সম্ভবত না, কারণ; দৈশিক-বৈশ্বিক বাস্তবতার অভিঘাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান অবক্ষয় আছড়ে পড়েছে বটে, তবে এটি এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, এমন কথা বলা অতি বাগাড়ম্বর বলেই মনে হয়। প্রত্যাশানুযায়ী অনেক কাজই এ বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারে নি, তবুও এর অর্জনের পাল্লা কম ভারি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সূর্যের তেজে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে জ্বলে উঠতে পারেনি বটে; তবে চন্দ্রের মতো এর যেমন কলঙ্কের চেয়ে জ্যোৎস্না বেশি, তেমনি অন্ধকারের চেয়ে আলো এবং ব্যর্থতার চেয়ে বেশি সাফল্য। এই সাফল্যের সামগ্রিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অর্জন সম্পর্কে আলোকপাত মানসেই লেখাটির অবতারণা।

http://sangbad.net.bd/images/2021/July/08Jul21/news/du.jpg

দুই.

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বহুমুখী; ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ- এসব তো আছেই, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শরীরিক-মানসিক বিকাশের দিকেও বিশ্ববিদ্যালয়কে খেয়াল রাখতে হয়। কারণ, শ্রেণিকক্ষে এসে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানের জগতে সামান্যই প্রবেশ করতে পারে। তাই তাকে লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে কিংবা নিজের পড়ার টেবিলে গভীর সাধনায় নিবিষ্ট থাকতে হয়। কেবল চিত্ত-মননের পরিপুষ্টি সাধনই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবেলার শিক্ষাটাও বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হয়। এজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম থাকে, খেলার মাঠ থাকে; আয়োজন করা হয় শিক্ষাসফর এবং সাংস্কৃতিক সপ্তাহ; পরিচালিত হয় সহশিক্ষামূলক নানা কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই এসব কাজ করে এসেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এটিকে একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়; যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে নারী-পুরুষ সবাই শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ লাভ করে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য আদর্শের সম্মিলন অর্থাৎ- পাশ্চাত্যের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে প্রাচ্যের প্রজ্ঞা, মহত্তম আদর্শ এবং নীতিবাদের মিলন ঘটিয়ে মানবজ্ঞানের জগতে যোগ করা হয় নতুন মাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম বলেছেন : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকে কেবল শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক বা ক্লাসে পাঠ্যক্রমের কিংবা লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরির সুব্যবস্থা করেনি; একই সঙ্গে নিয়মিত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ক্রীড়া, বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠান এবং নৈশভোজ সভার ব্যবস্থা করেছে। সূচনা পর্ব থেকেই ঢাকা নগরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ড, বাৎসরিক ভোজ ও নাটক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন প্রাণের ছোঁয়া লাগে। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ঢাকা শহর বারবার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করলেও এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর কাতারে স্থান করে নিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় এটি নানান দিক থেকে ছিল একটি পশ্চাৎপদ শহর। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর এখানে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি হলেও কলকাতার বর্ণহিন্দুদের অবিমৃশ্যকারিতায় তা রদ হয়ে যাওয়ায় সবকিছু স্তিমিত হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়, লাগে নবজাগরণের নতুন হাওয়া। তখন ঢাকা শহরে ‘পূর্ববঙ্গ সারস্বত সমাজ’, ‘পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সমাজ’, ‘নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ’, ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’, ‘পূর্ণিমা বাসর’, ‘ঢাকা সাহিত্য পরিষদ’ প্রভৃতি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের কার্যক্রম চালু ছিল। এমন বাস্তবতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের কয়েজন অধ্যাপক ও ঢাকার সাংস্কৃতিক জগতের প্রাগ্রসর চিন্তার ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯২৬ সালে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এক আলোড়ন-সৃষ্টিকারী অধ্যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি চলে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিচিত্র কার্যক্রম। নাটক, বিতর্ক, সংগীত এসবের চর্চায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা। এখানে ১৯২৭ সালে ভর্তি হওয়া ছাত্র বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন : ‘ভেতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস- ফাঁকে ফাঁকে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ।... সেখানে আছে গ্রন্থাগার, রঙ্গালয় ও ক্রীড়াঙ্গন; অনুষ্ঠিত হয় বিতর্কসভা, সঙ্গীত-প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ভোজ ও আরো অনেক সময়োচিত অধিবেশন; সেখানকার নাট্যাভিনয় দেখতে নগরবাসী সোৎসাহে সমবেত হন।’ হলগুলোতে ছিল স্বতন্ত্র বিনোদন-কক্ষ, সন্ধ্যায় বসতো বক্তৃতা-বিতর্ক, সাহিত্যসভা ও সংগীতের আসর। রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন : ‘প্রত্যেক হলে ছাত্ররা নানারকম অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করত। এজন্য কয়েকটি আলাদা আলাদা বিভাগ ছিল। যেমন-(১) ক্রীড়া (ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, টেনিস); (২) সাহিত্য ও পত্রিকা; (৩) বিতর্কসভা; (৪) নাট্যাভিনয়; (৫) সমাজসেবা ইত্যাদি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাতচল্লিশের দেশবিভাগের কাল পর্যন্ত এখানে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে বিভিন্ন সংঘ ও সমিতি; যেমন- সাহিত্য সংঘ, ক্রীড়া সংঘ, হল সংসদ, সামাজিক সেবা পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ, ড্রামাটিক ক্লাব, ইংরেজি সমিতি প্রভৃতি। সাহিত্য সংঘ প্রতিবছর সাহিত্য-প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো। তাতে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ বসু প্রমুখের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা ও রচনা-প্রতিযোগিতা হতো। বর্ষা-উৎসব, শরৎ-উৎসব, বসন্ত-উৎসব, বিদায়-অনুষ্ঠান প্রভৃতি উপলক্ষে বিতর্ক-প্রতিযোগিতা আয়োজন হতো সাড়ম্বরে। দেশভাগের আগে এখানে বহু নাটক মঞ্চস্থ করা হয়; উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো : নতুন-তারা, রীতিমত, আলমগীর, চারুকণ্ঠ সভা, বন্ধু, বৈকুণ্ঠের খাতা, দ্বৈরথ ইত্যাদি। বন্দে মাতরমসহ বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গানের আসর বসতো; বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তা পরিবেশিত হতো। বক্তৃতানুষ্ঠানগুলো হতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে। এর মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ উপস্থাপিত ‘সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য’, রামমোহন লোহিয়া উপস্থাপিত ‘আগামী ১০ বছরের বিশ্বরাজনীতি’র কথা বিশেষভাব উল্লেখ করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময় আয়োজন করা হয় ‘রবীন্দ্র কবিতায় ইংরেজি কবিতার প্রভাব’, ‘কবি নারায়ণ দেব’, ‘আমাদের শিক্ষা সমস্যা’ প্রভৃতি শিরোনামের সাহিত্য-প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকাও প্রকাশিত হয় এই শিক্ষাঙ্গন থেকে; যার মধ্যে জগন্নাথ হলের বার্ষিক পত্রিকা বাসন্তিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার্থীদের কমনরুমে রাখা হতো ‘সম্ভ্রান্ত বাংলা মাসিক’ এবং পাঞ্চ থেকে রিভিয়ু অব রিভিয়ুজসহ নানা পত্র-পত্রিকা। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন : “এই কমনরুমে বসেই আমি প্রথম পড়েছিলাম ‘প্রবাসী’র পৃষ্ঠায় ধারাবাহিক ‘শেষের কবিতা’, আর ‘বিচিত্রা’য় ‘তিন পুরুষ’, দু-কিস্তি পরে রবীন্দ্রনাথ যার নাম বদলে ‘যোগাযোগ’ রাখলেন; পাশের একটি জনবিরল ঘরে, ছাত্রপরিচালিত ‘ঢাকা য়ুনিভিার্সিটি জার্নাল’-এর কার্যালয়ে, ইংল-জাত কিছু উঁচকপাল ও আধা-উঁচকপালে পত্রিকাও চেখেছিলাম।” বিভিন্ন সময়ে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিককে সংবর্ধনা প্রদান ও সম্মাননা জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও ডি-লিট উপাধি প্রদান করে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

তিন.

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বেগবানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত নির্মাণকারী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমুদ্দন মজলিস’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম, নূরুল হক ভূইয়া প্রমুখ। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দীন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তার যুক্তিগ্রাহ্য প্রতিবাদ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের যশস্বী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। ১৯৪৮ সালে ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আয়োজিত সাহিত্য-সম্মেলনে তিনি বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে উচ্চারণ করেন : ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ বাঙালির মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। একুশের বর্ষপূর্তি উদযাপন, প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী প্রকাশ, চুয়ান্নর নির্বাচনসহ পরবর্তী কালের নানা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বাপক অবদান রেখেছেন। দেশভাগের পর থেকে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শক্তিসঞ্চার করে বিবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা। প্রতিবছরই শহীদ দিবস পালিত হয় বাড়তি উদ্দীপনা নিয়ে। মুনীর চৌধুরীর কবর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তপোতী, শরৎচন্দ্রের বিন্দুর ছেলে প্রভৃতি নাটক মঞ্চায়ন হয়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবাধ চর্চা, মুক্তবুদ্ধির বিস্তার, চিন্তার নবদিগন্ত উন্মোচন তখনকার বিশেষ অর্জন। ১৯৫১ সালে ‘সংস্কৃতি সংসদ’ নামে যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুন্দর’ ও ‘শুভ সাংস্কৃতিক আবহাওয়া’ সঞ্চালিত করে। ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত তার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নবজীবনের দ্বার উন্মুক্ত করে। এছাড়া ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা হাতে একুশের চেতনা বিস্তারে যেসব সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাতেও বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংস্কৃতির অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পঞ্চাশের দশকের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সেই স্মৃতিচারণ করে অজয় রায় লিখেছেন : “তখনকার দিনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দুভাবে হতো। একটা হলভিত্তিক- হলের নাটক, হলের গান-বাজনা, ডিবেট ইত্যাদি। আরেকটা যেটকে ডাকসু বলে, সেই ডাকসু পরিচালিত কিছু কর্মকাণ্ড ছিল। আমি দুটোতেই অংশগ্রহণ করেছিলাম; ডাকসুতে এবং হলে। সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা-সহায়ক কর্মকাণ্ডের মধ্যে নাটক করতাম, ডিবেট করতাম, আবৃত্তি করতাম।” বস্তুত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো তখন হয়ে উঠেছিলো সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। হলবার্ষিকী প্রকাশ ছাড়াও সাংস্কৃতিক বহুবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ঐ সময়ের স্মৃতিচারণ করে আনিসুজ্জামান লিখেছেন : “আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাথে যুক্ত ছিলাম, অনাবাসিক ছাত্ররূপে। আমাদের সময় তখন সব হলেই ছাত্রদের সাহিত্য সংকলন বা বার্ষিকী প্রকাশিত হতো। বার্ষিক নাটক হতো, সাহিত্য প্রতিযোগিতা এবং বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব হতো, নাটক অভিনয় হতো ইত্যাদি।”

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৩ সালে বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ আয়োজন ঐ সময়ের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় এক বিরাট মাইল ফলক। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার প্রচার-মাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। পূর্ববঙ্গের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিবৃতি প্রদান করে তাঁরা বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুসলিম লীগ সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এভাবেই জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি, ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাগরণ এবং চিত্তের সমৃদ্ধি-সাধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালন করে অগ্রণী ভূমিকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা যেমন এগিয়ে গেছে, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনও বেগবান হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে যে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলেছে, পাকিস্তানি দুঃশাসনে এসে তা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এর মাধ্যমে তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের যৌক্তিক ভিত নির্মাণ করেছে এবং জাতিকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত করেছে। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশেও নববর্ষ, বিভিন্ন জাতীয় উৎসব এবং পার্বণগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জেগে উঠেছে তাঁর নিজস্ব তেজ ও সাংস্কৃতিক শক্তির বলে। যখনই এদেশের বুকে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছে, তখনই বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির তেজে দীপ্যমান হয়ে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠ নিয়ে মাঠে নেমেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবাধ চর্চা, মুক্তবুদ্ধির বিস্তার, চিন্তার নবদিগন্ত উন্মোচন তখনকার বিশেষ অর্জন। ১৯৫১ সালে ‘সংস্কৃতি সংসদ’ নামে যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুন্দর’ ও ‘শুভ সাংস্কৃতিক আবহাওয়া’ সঞ্চালিত করে

চার.

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ববঙ্গের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ ও সৃজনশীলতায় লাগে নতুন ঢেউ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপকেরা প্রথম থেকেই সংস্কৃতি, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের নানাবিষয়ে যেমন গবেষণা শুরু করেন তেমনি সাহিত্যের বিচিত্র পঠন-পাঠন আরম্ভ করেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মননশীল ও সৃজনশীল সাহিত্যের ফল্গুধারা প্রবাহিত করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, রাধাগোবিন্দ বসাক, গুরুপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, সি. এল. রোন. বি. কে. রায়, পরিমল রায়, অমলেন্দু বসু, অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী, কাজী মোতাহার হোসেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ। পরবর্তীকালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই হয়ে ওঠেন ঢাকাকেন্দ্রিক নতুনধারার সাহিত্যের ধারক-বাহক। এঁদের মধ্যে জসীম উদ্দীন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, বদরুদ্দীন উমর, আনিসুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, সন্জীদা খাতুন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ নুরুদ্দিন, সৈয়দ আলী আহসান, মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আহসান হাবীব, হায়াৎ মামুদ, মনজুরে মাওলা, শামসুজ্জামান খান, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, সৈয়দ আকরম হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, দাউদ খান মজলিস, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আবুল কাসেম ফজলুল হক, রফিক আজাদ, দিলারা হাশেম, আতাউর রহমান, নীলিমা ইব্রাহীম, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, নূহ-উল-আলম লেনিন, আকতার কামাল,বিশ্বজিৎ ঘোষ, সৈয়দ আজিজুল হক, গিয়াস শামীম, অসীম সাহা, মুহাম্মদ সামাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদ, কামাল চৌধুরী, নাসির আহমেদ, রফিকউল্লাহ খান, সরকার আমিন, সৌমিত্র শেখর, বায়তুল্লাহ কাদেরী, আহমাদ মাযহার, লুৎফর রহমান রিটনসহ অগণিত কবি-সাহিত্যিককে জন্ম দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত এক শ’ বছরে বাংলা সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করেছে। এসব কবি-সাহিত্যিক, পণ্ডিত ও গবেষকবৃন্দ কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, গবেষণা প্রভৃতি রচনা করে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারা যতটা বেগবান ছিল, বর্তমান সময়ে তা অনেকটাই ম্রিয়মাণ ও নিষ্প্রভ মনে হয়। পুঁজিবাদী অবক্ষয়ের নানা অভিঘাত এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও আছড়ে পড়েছে। যথাযথ সাধনা আর দৃঢ় প্রত্যয় দ্বারা এর উত্তরণ ঘটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার হৃৎগৌরব ফিরিয়ে আনবে। শতাব্দীর বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শতবর্ষে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অর্জন

এম আবদুল আলীম

বৃহস্পতিবার, ০৮ জুলাই ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/July/08Jul21/news/raju-scuplpture.jpg

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অর্জন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে- বিশ্ববিদ্যালয় কী এবং তার কাজ কী? এ প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব না হলেও সাধারণভাবে বলা যায়, যেখানে জ্ঞানের প্রায় সকল শাখার পঠন-পাঠন ও চর্চার ব্যবস্থা আছে এবং যা বিবেচিত হয় উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে, তা-ই বিশ্ববিদ্যালয়। বিচিত্র বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি জ্ঞানবিস্তার, জ্ঞানের সংরক্ষণ, জ্ঞানসৃষ্টি বা জ্ঞানের প্রবাহকে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করা এবং গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য। বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে জাতির মস্তিষ্ক হিসেবে; এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের থাকে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; জাতির দুর্দিনে বিশ্ববিদ্যালয় দেয় যথাযথ দিক-নির্দেশনা। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় হয় বিশ্বজনীন, বিশে^র জ্ঞানভাণ্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত হয়; জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে তা বৃহত্তর মানবতার মহাসমুদ্রে মিশে যায়।

পূর্ববঙ্গ তথা এ অঞ্চলে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই, বর্তমানে এর সংখ্যা এক শ’ ছাড়িয়ে গেছে। বঙ্গভঙ্গ রদের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় ‘অপূর্ব রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গের মানুষের শিক্ষা এবং শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধির সরল রাজপথ চিহ্নিত করা এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পথ নিষ্কণ্টক ছিল না; শ্রীহট্টের বিপিন পাল, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বর্ধমানের রাসবিহারী ঘোষ প্রবল বিরোধিতা করেন। এছাড়া ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, পিয়ারী মোহন মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চরণ মজুমদার, দ্বারকানাথ চক্রবর্তী, মতিলাল ঘোষ, আশুতোষ মুখার্জীসহ অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এঁদের কাতারে শামিল করলেও তার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই। যা হোক, সকল বাধা অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বহু মানুষের অবদান থাকলেও নবাব সলিমুল্লাহর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে; শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদানের কথাও এক্ষেত্রে স্মর্তব্য, যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সকল পরিকল্পনা ও প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।

পূর্ববঙ্গের মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও ভাগ্যপরিবর্তনের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পদার্পণের কালে নানা সমস্যায় জর্জরিত। ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী এটিসহ বাংলাদেশের বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হলেও বাস্তবে এ বর্ম ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠানে সম্পন্ন করা হয় নানা অপকর্ম; সৃষ্টি করা হয় বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-সাধনা অপেক্ষা নীল, সাদা, হলুদ দল এবং সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষে বিভক্ত হয়ে দলাদলি, রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়েছে। সামরিক স্বৈরশাসকেরা তো বটেই, নির্বাচিত সরকারগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর খবরদারি করে স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন করেছে। এর ফলে বিদ্যাতন্ত্রের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রমাগত কায়েম হয়েছে মাস্তানতন্ত্র। এমন বাস্তবতায় শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে নানাকৌণিক দৃষ্টিতে পর্যালোচনা ও মূল্যায়িত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের গৌরবময় অতীত, অবক্ষয়িত বর্তমান; আর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে সম্ভাবনাময় ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।

১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও ডি-লিট উপাধি প্রদান করে এই বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। এক-শ’ বছরের পথচলায় নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের আকাশে জ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিষ্ঠার পরপরই এটি যে সুদৃঢ় একাডেমিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়, তার মূলে ছিলো জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও গবেষণায় ঋদ্ধ অধ্যাপকবৃন্দ; যাঁদের মধ্যে ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, এ. সি. টার্নার, জি. এইচ. ল্যাংলী, হরিদাস ভট্টাচার্য, এ. এফ. রহমান, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ফিদা আলী খান, ডব্লিউ. এ. জেঙ্কিংস, সত্যেন বোস, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। পূর্ববঙ্গ তথা এ অঞ্চলের মানুষের সকল অর্জনের সঙ্গী হয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য- এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মেধা-মনন-প্রতিভা এবং কর্মের স্পর্শ নেই। শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্জন নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ; তা ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় দৃষ্টিতেই হচ্ছে। সমালোচনার মাত্রা কখনো কখনো এতটাই তীব্র হচ্ছে যে, কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই! বাস্তবেই কি তাই? সম্ভবত না, কারণ; দৈশিক-বৈশ্বিক বাস্তবতার অভিঘাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান অবক্ষয় আছড়ে পড়েছে বটে, তবে এটি এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, এমন কথা বলা অতি বাগাড়ম্বর বলেই মনে হয়। প্রত্যাশানুযায়ী অনেক কাজই এ বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারে নি, তবুও এর অর্জনের পাল্লা কম ভারি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সূর্যের তেজে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে জ্বলে উঠতে পারেনি বটে; তবে চন্দ্রের মতো এর যেমন কলঙ্কের চেয়ে জ্যোৎস্না বেশি, তেমনি অন্ধকারের চেয়ে আলো এবং ব্যর্থতার চেয়ে বেশি সাফল্য। এই সাফল্যের সামগ্রিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অর্জন সম্পর্কে আলোকপাত মানসেই লেখাটির অবতারণা।

http://sangbad.net.bd/images/2021/July/08Jul21/news/du.jpg

দুই.

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বহুমুখী; ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ- এসব তো আছেই, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শরীরিক-মানসিক বিকাশের দিকেও বিশ্ববিদ্যালয়কে খেয়াল রাখতে হয়। কারণ, শ্রেণিকক্ষে এসে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানের জগতে সামান্যই প্রবেশ করতে পারে। তাই তাকে লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে কিংবা নিজের পড়ার টেবিলে গভীর সাধনায় নিবিষ্ট থাকতে হয়। কেবল চিত্ত-মননের পরিপুষ্টি সাধনই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবেলার শিক্ষাটাও বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হয়। এজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম থাকে, খেলার মাঠ থাকে; আয়োজন করা হয় শিক্ষাসফর এবং সাংস্কৃতিক সপ্তাহ; পরিচালিত হয় সহশিক্ষামূলক নানা কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই এসব কাজ করে এসেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এটিকে একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়; যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে নারী-পুরুষ সবাই শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ লাভ করে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য আদর্শের সম্মিলন অর্থাৎ- পাশ্চাত্যের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে প্রাচ্যের প্রজ্ঞা, মহত্তম আদর্শ এবং নীতিবাদের মিলন ঘটিয়ে মানবজ্ঞানের জগতে যোগ করা হয় নতুন মাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম বলেছেন : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকে কেবল শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক বা ক্লাসে পাঠ্যক্রমের কিংবা লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরির সুব্যবস্থা করেনি; একই সঙ্গে নিয়মিত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ক্রীড়া, বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠান এবং নৈশভোজ সভার ব্যবস্থা করেছে। সূচনা পর্ব থেকেই ঢাকা নগরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ড, বাৎসরিক ভোজ ও নাটক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন প্রাণের ছোঁয়া লাগে। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ঢাকা শহর বারবার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করলেও এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর কাতারে স্থান করে নিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় এটি নানান দিক থেকে ছিল একটি পশ্চাৎপদ শহর। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর এখানে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি হলেও কলকাতার বর্ণহিন্দুদের অবিমৃশ্যকারিতায় তা রদ হয়ে যাওয়ায় সবকিছু স্তিমিত হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়, লাগে নবজাগরণের নতুন হাওয়া। তখন ঢাকা শহরে ‘পূর্ববঙ্গ সারস্বত সমাজ’, ‘পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সমাজ’, ‘নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ’, ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’, ‘পূর্ণিমা বাসর’, ‘ঢাকা সাহিত্য পরিষদ’ প্রভৃতি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের কার্যক্রম চালু ছিল। এমন বাস্তবতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের কয়েজন অধ্যাপক ও ঢাকার সাংস্কৃতিক জগতের প্রাগ্রসর চিন্তার ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯২৬ সালে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এক আলোড়ন-সৃষ্টিকারী অধ্যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি চলে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিচিত্র কার্যক্রম। নাটক, বিতর্ক, সংগীত এসবের চর্চায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা। এখানে ১৯২৭ সালে ভর্তি হওয়া ছাত্র বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন : ‘ভেতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস- ফাঁকে ফাঁকে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ।... সেখানে আছে গ্রন্থাগার, রঙ্গালয় ও ক্রীড়াঙ্গন; অনুষ্ঠিত হয় বিতর্কসভা, সঙ্গীত-প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ভোজ ও আরো অনেক সময়োচিত অধিবেশন; সেখানকার নাট্যাভিনয় দেখতে নগরবাসী সোৎসাহে সমবেত হন।’ হলগুলোতে ছিল স্বতন্ত্র বিনোদন-কক্ষ, সন্ধ্যায় বসতো বক্তৃতা-বিতর্ক, সাহিত্যসভা ও সংগীতের আসর। রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন : ‘প্রত্যেক হলে ছাত্ররা নানারকম অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করত। এজন্য কয়েকটি আলাদা আলাদা বিভাগ ছিল। যেমন-(১) ক্রীড়া (ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, টেনিস); (২) সাহিত্য ও পত্রিকা; (৩) বিতর্কসভা; (৪) নাট্যাভিনয়; (৫) সমাজসেবা ইত্যাদি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাতচল্লিশের দেশবিভাগের কাল পর্যন্ত এখানে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে বিভিন্ন সংঘ ও সমিতি; যেমন- সাহিত্য সংঘ, ক্রীড়া সংঘ, হল সংসদ, সামাজিক সেবা পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ, ড্রামাটিক ক্লাব, ইংরেজি সমিতি প্রভৃতি। সাহিত্য সংঘ প্রতিবছর সাহিত্য-প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো। তাতে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ বসু প্রমুখের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা ও রচনা-প্রতিযোগিতা হতো। বর্ষা-উৎসব, শরৎ-উৎসব, বসন্ত-উৎসব, বিদায়-অনুষ্ঠান প্রভৃতি উপলক্ষে বিতর্ক-প্রতিযোগিতা আয়োজন হতো সাড়ম্বরে। দেশভাগের আগে এখানে বহু নাটক মঞ্চস্থ করা হয়; উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো : নতুন-তারা, রীতিমত, আলমগীর, চারুকণ্ঠ সভা, বন্ধু, বৈকুণ্ঠের খাতা, দ্বৈরথ ইত্যাদি। বন্দে মাতরমসহ বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গানের আসর বসতো; বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তা পরিবেশিত হতো। বক্তৃতানুষ্ঠানগুলো হতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে। এর মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ উপস্থাপিত ‘সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য’, রামমোহন লোহিয়া উপস্থাপিত ‘আগামী ১০ বছরের বিশ্বরাজনীতি’র কথা বিশেষভাব উল্লেখ করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময় আয়োজন করা হয় ‘রবীন্দ্র কবিতায় ইংরেজি কবিতার প্রভাব’, ‘কবি নারায়ণ দেব’, ‘আমাদের শিক্ষা সমস্যা’ প্রভৃতি শিরোনামের সাহিত্য-প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকাও প্রকাশিত হয় এই শিক্ষাঙ্গন থেকে; যার মধ্যে জগন্নাথ হলের বার্ষিক পত্রিকা বাসন্তিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার্থীদের কমনরুমে রাখা হতো ‘সম্ভ্রান্ত বাংলা মাসিক’ এবং পাঞ্চ থেকে রিভিয়ু অব রিভিয়ুজসহ নানা পত্র-পত্রিকা। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন : “এই কমনরুমে বসেই আমি প্রথম পড়েছিলাম ‘প্রবাসী’র পৃষ্ঠায় ধারাবাহিক ‘শেষের কবিতা’, আর ‘বিচিত্রা’য় ‘তিন পুরুষ’, দু-কিস্তি পরে রবীন্দ্রনাথ যার নাম বদলে ‘যোগাযোগ’ রাখলেন; পাশের একটি জনবিরল ঘরে, ছাত্রপরিচালিত ‘ঢাকা য়ুনিভিার্সিটি জার্নাল’-এর কার্যালয়ে, ইংল-জাত কিছু উঁচকপাল ও আধা-উঁচকপালে পত্রিকাও চেখেছিলাম।” বিভিন্ন সময়ে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিককে সংবর্ধনা প্রদান ও সম্মাননা জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও ডি-লিট উপাধি প্রদান করে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

তিন.

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বেগবানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত নির্মাণকারী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমুদ্দন মজলিস’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম, নূরুল হক ভূইয়া প্রমুখ। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দীন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তার যুক্তিগ্রাহ্য প্রতিবাদ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের যশস্বী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। ১৯৪৮ সালে ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আয়োজিত সাহিত্য-সম্মেলনে তিনি বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে উচ্চারণ করেন : ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ বাঙালির মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। একুশের বর্ষপূর্তি উদযাপন, প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী প্রকাশ, চুয়ান্নর নির্বাচনসহ পরবর্তী কালের নানা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বাপক অবদান রেখেছেন। দেশভাগের পর থেকে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শক্তিসঞ্চার করে বিবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা। প্রতিবছরই শহীদ দিবস পালিত হয় বাড়তি উদ্দীপনা নিয়ে। মুনীর চৌধুরীর কবর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তপোতী, শরৎচন্দ্রের বিন্দুর ছেলে প্রভৃতি নাটক মঞ্চায়ন হয়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবাধ চর্চা, মুক্তবুদ্ধির বিস্তার, চিন্তার নবদিগন্ত উন্মোচন তখনকার বিশেষ অর্জন। ১৯৫১ সালে ‘সংস্কৃতি সংসদ’ নামে যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুন্দর’ ও ‘শুভ সাংস্কৃতিক আবহাওয়া’ সঞ্চালিত করে। ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত তার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নবজীবনের দ্বার উন্মুক্ত করে। এছাড়া ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা হাতে একুশের চেতনা বিস্তারে যেসব সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাতেও বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংস্কৃতির অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পঞ্চাশের দশকের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সেই স্মৃতিচারণ করে অজয় রায় লিখেছেন : “তখনকার দিনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দুভাবে হতো। একটা হলভিত্তিক- হলের নাটক, হলের গান-বাজনা, ডিবেট ইত্যাদি। আরেকটা যেটকে ডাকসু বলে, সেই ডাকসু পরিচালিত কিছু কর্মকাণ্ড ছিল। আমি দুটোতেই অংশগ্রহণ করেছিলাম; ডাকসুতে এবং হলে। সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা-সহায়ক কর্মকাণ্ডের মধ্যে নাটক করতাম, ডিবেট করতাম, আবৃত্তি করতাম।” বস্তুত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো তখন হয়ে উঠেছিলো সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। হলবার্ষিকী প্রকাশ ছাড়াও সাংস্কৃতিক বহুবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ঐ সময়ের স্মৃতিচারণ করে আনিসুজ্জামান লিখেছেন : “আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাথে যুক্ত ছিলাম, অনাবাসিক ছাত্ররূপে। আমাদের সময় তখন সব হলেই ছাত্রদের সাহিত্য সংকলন বা বার্ষিকী প্রকাশিত হতো। বার্ষিক নাটক হতো, সাহিত্য প্রতিযোগিতা এবং বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব হতো, নাটক অভিনয় হতো ইত্যাদি।”

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৩ সালে বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ আয়োজন ঐ সময়ের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় এক বিরাট মাইল ফলক। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার প্রচার-মাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। পূর্ববঙ্গের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিবৃতি প্রদান করে তাঁরা বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুসলিম লীগ সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এভাবেই জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি, ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাগরণ এবং চিত্তের সমৃদ্ধি-সাধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালন করে অগ্রণী ভূমিকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা যেমন এগিয়ে গেছে, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনও বেগবান হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে যে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলেছে, পাকিস্তানি দুঃশাসনে এসে তা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এর মাধ্যমে তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের যৌক্তিক ভিত নির্মাণ করেছে এবং জাতিকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত করেছে। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশেও নববর্ষ, বিভিন্ন জাতীয় উৎসব এবং পার্বণগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জেগে উঠেছে তাঁর নিজস্ব তেজ ও সাংস্কৃতিক শক্তির বলে। যখনই এদেশের বুকে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছে, তখনই বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির তেজে দীপ্যমান হয়ে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠ নিয়ে মাঠে নেমেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবাধ চর্চা, মুক্তবুদ্ধির বিস্তার, চিন্তার নবদিগন্ত উন্মোচন তখনকার বিশেষ অর্জন। ১৯৫১ সালে ‘সংস্কৃতি সংসদ’ নামে যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুন্দর’ ও ‘শুভ সাংস্কৃতিক আবহাওয়া’ সঞ্চালিত করে

চার.

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ববঙ্গের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ ও সৃজনশীলতায় লাগে নতুন ঢেউ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপকেরা প্রথম থেকেই সংস্কৃতি, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের নানাবিষয়ে যেমন গবেষণা শুরু করেন তেমনি সাহিত্যের বিচিত্র পঠন-পাঠন আরম্ভ করেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মননশীল ও সৃজনশীল সাহিত্যের ফল্গুধারা প্রবাহিত করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, রাধাগোবিন্দ বসাক, গুরুপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, সি. এল. রোন. বি. কে. রায়, পরিমল রায়, অমলেন্দু বসু, অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী, কাজী মোতাহার হোসেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ। পরবর্তীকালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই হয়ে ওঠেন ঢাকাকেন্দ্রিক নতুনধারার সাহিত্যের ধারক-বাহক। এঁদের মধ্যে জসীম উদ্দীন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, বদরুদ্দীন উমর, আনিসুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, সন্জীদা খাতুন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ নুরুদ্দিন, সৈয়দ আলী আহসান, মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আহসান হাবীব, হায়াৎ মামুদ, মনজুরে মাওলা, শামসুজ্জামান খান, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, সৈয়দ আকরম হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, দাউদ খান মজলিস, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আবুল কাসেম ফজলুল হক, রফিক আজাদ, দিলারা হাশেম, আতাউর রহমান, নীলিমা ইব্রাহীম, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, নূহ-উল-আলম লেনিন, আকতার কামাল,বিশ্বজিৎ ঘোষ, সৈয়দ আজিজুল হক, গিয়াস শামীম, অসীম সাহা, মুহাম্মদ সামাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদ, কামাল চৌধুরী, নাসির আহমেদ, রফিকউল্লাহ খান, সরকার আমিন, সৌমিত্র শেখর, বায়তুল্লাহ কাদেরী, আহমাদ মাযহার, লুৎফর রহমান রিটনসহ অগণিত কবি-সাহিত্যিককে জন্ম দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত এক শ’ বছরে বাংলা সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করেছে। এসব কবি-সাহিত্যিক, পণ্ডিত ও গবেষকবৃন্দ কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, গবেষণা প্রভৃতি রচনা করে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারা যতটা বেগবান ছিল, বর্তমান সময়ে তা অনেকটাই ম্রিয়মাণ ও নিষ্প্রভ মনে হয়। পুঁজিবাদী অবক্ষয়ের নানা অভিঘাত এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও আছড়ে পড়েছে। যথাযথ সাধনা আর দৃঢ় প্রত্যয় দ্বারা এর উত্তরণ ঘটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার হৃৎগৌরব ফিরিয়ে আনবে। শতাব্দীর বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শতবর্ষে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

back to top