alt

সাময়িকী

অন্তরালের কবি নূরুল হক

অজিত দাশ

: বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১

“কবিতার আঙুলের মুঠি ধরে

সারাটি জনম হেঁটে

প্রতি মুহূর্তেই আমি

সয়ে গেছি নৈঃশব্দ্যের তোলপাড়।”

নৈঃশব্দ্যের তোলপাড়? হ্যাঁ, কবিতার আঙুলের মুঠি ধরে সারা জনম এই তোলপাড় যিনি সয়ে যান; নিবিড় নিস্তব্ধের তরঙ্গে যিনি প্রতি মুহূর্তে ডুব দিয়ে ফুল হয়ে ভাসেন কিংবা মানুষ থেকে মানুষে পিছলে গিয়ে ফড়িং এর পাখনার আলোয় যিনি হাত দুটি মুছে ফেলেন তিনিই তো হবেন অন্তরালের কবি। এই অন্তরালের কবির নাম নূরুল হক। গত বাইশ জুলাই বিকেল চারটায় সাতাত্তর বছর বয়সে করোনাক্রান্ত হয়ে মিলিয়ে গেছেন থমথমে, অতিকায় পরিহাস, অভিমানী শূন্য নীল আকাশে যেখানে ডানার কোনো রেখা নেই। এক অবলুপ্ত পাখি হয়ে মুছে গেছেন এক মুহূর্তের ব্যবধানে। যদিও এই মুছে যাওয়া নিয়ে কবির তেমন কোনো আক্ষেপ ছিলো না। মৃত্যুতে তাঁর কোনো গড়িমসি ছিলো না। মৃত্যুকে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর কাছেই ব্যায়মূল্যসহ।

কবির কবিতা পাঠ করা মাত্রই পাঠক একটা বিষয় স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারবেন, তিনি জীবন থেকে ক্রমাগত ছেঁকে নিয়ে নির্মেদ শব্দ আর ধ্যানীর নীরবতা দিয়ে কবিতা লিখেছেন সময়ে অসময়ে। তাঁর কবিতায় শব্দের কাঠিন্য নেই, আছে শব্দের বিস্তৃতি আর রহস্যময় এক দৃশ্যকল্প। বাংলা কবিতায় ভাষার নিজস্ব বুনন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আর অনুভবের মগ্নতা নিয়েই তৈরি করেছেন নিজের মৌলিকত্ব। তাঁর কবিতার পঙক্তিগুলো টুকে রাখতেন বুকপকেটে রাখা একটি ছোট্ট নোটবুকে অথবা বিছানার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট টুকরো কাগজে, খাতার মলাটের সামনে অথবা পেছনে। কখনো আজিজ সুপার মার্কেট কিংবা শাহবাগের পথে অথবা তাঁর বাসায় সাক্ষাৎ হলে লক্ষ্য করেছি তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাগজে টুকে রাখতেন কবিতার ছোট ছোট পঙক্তি। ‘এ জীবন খসড়া জীবন’ কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতায় লিখেছেন- ‘তারাগুলি ফুলগুলি/ খাতার ওপরে এসে পড়ে/ ভোরগুলি সন্ধ্যাগুলি/ প্রাণের ওপরে এসে পড়ে/ চোখগুলি মনগুলি/ টুপটুপ করে পড়ে/ আমার খাতায়।’

তাঁর কবিতায় শব্দের কাঠিন্য নেই, আছে শব্দের বিস্তৃতি আর রহস্যময় এক দৃশ্যকল্প। বাংলা কবিতায় ভাষার নিজস্ব বুনন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আর অনুভবের মগ্নতা নিয়েই তৈরি করেছেন নিজের মৌলিকত্ব

নিরন্তর সমাজ-দর্শন, সভ্যতা, শিল্প, রাজনীতি, মাটি ও প্রাণ-প্রকৃতির কথা তাঁর কবিতায় এতটাই ভাস্বর যে বাংলা কবিতার সবচেয়ে ক্ষুদ্র পাঠকটিও তাঁর কবিতা পাঠ করে তাঁকে চিনে নিতে ভুল করবেন না। কবিতার সহজিয়া স্বাদে পুলকিত হবেন। আর কবির সত্তায় তো লেগেই রয়েছে জন্মভূমি ভাটি অঞ্চলের মাটির সুবাস। হৃদয়ে হাওড়-বিলের থই থই জলের স্পন্দন, গায়ে শাপলা শালুক আর পাখির পালকের গন্ধ নিয়েই তিনি কবিতায় এভাবে বলতে পারেন-

কারো যেনো তীর্থভূমি ছিলো/ এই দেশ / তাই ফুল সাজতো বাতাসে/ নাচাতো বৈষ্ণব হাওয়া দীর্ঘতম লেজ/ জন্মপারাপার থেকে স্রোতে যেতো ভেসে... অথবা কবি নিজের মাতৃকোলের জলের ছায়ায় জীবনের ময়লা ধুয়ে দিতে চান তাই বিনা সংকোচে বলতে পারেন, ... জলের ভেতর গ্রাম, পড়শি গ্রাম/ টলমল করে/ গ্রামের গভীর নিচে বনরাজি/ ছায়া দেখা যায়/ আমি অবাক হয়ে জানতে পাই/ সে ছায়া আমার মায়ের.../ সে ছায়ায় হাত রেখে কত দেশে/ নৌকা ভাসাই/ কত জনম-পেরোনো নদী/ আকাশ জমিন/ রোদে-মেঘে জীবনের ময়লা ধুয়ে যাই।

এই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ প্রকাশিত হয়েছিলো কবির ৬৩ বছর বয়সে ২০০৭ সালে। তারপর একে একে প্রকাশ পায়- একটি গাছের পদপ্রান্তে (২০১১), মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা (২০১২), শাহবাগ থেকে মালোপাড়া (২০১৪), এ জীবন খসড়া জীবন (২০১৫)। এছাড়াও কবিকে নিয়ে ২০১৭ সালে ছোটকাগজ ‘খেয়া’র নূরুল হক সংখ্যাটি প্রকাশ করেন কবি ও সম্পাদক পুলক হাসান। একই বছর মে মাসে কবির কবিতা পাঠ এবং আলোচনা নিয়ে ঢাকার লালমাটিয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ আড্ডার আয়োজন করেছিলেন জ্ঞাতিজন নামের একটি সংগঠন। তাছাড়া এই কবিকে নিয়ে আর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া কোথাও খুব একটা চোখে পড়েনি। জীবদ্দশায় ২০১৪ সালে পেয়েছেন নেত্রকোনা থেকে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার। সর্বশেষ গত বছর বই মেলায় চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা সমগ্র। আর এ বছর কবি নিজেই নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু হুট করেই কবিকে বাড়ি ফিরতে হলো। জীবনের অপূর্ব দৃশ্য দেখে থেকে যাওয়ার কোনো উপায় হলো না।

মূলত ষাটের দশকের কবি হলেও প্রায় চার দশক পর কবির আত্মপ্রকাশের এক অন্যতম কারণ ছিলো তাঁর জীবন জার্নি। আত্মপ্রকাশে বিলম্ব হলেও বিশাল এক প্রস্তুতির পথ পাড়ি দিয়েই উঠে এসেছেন তিনি। স্কুল জীবন থেকেই সাহিত্য চর্চার হাত পাকিয়ে ফেলেছিলেন আশুজিয়া হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া মনস্বী চিন্তাবিদ যতীন সরকারের কাছে। সেটাকে আরো ক্ষুরধার করে দিয়েছিলো মরমী কবি জালাল উদ্দিন খাঁ-র বাড়ির সাহিত্য আসর আর পাঠচক্রগুলো। কিন্তু ষাটের দশকের শেষভাগে, সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলা কবিতার মেরুকরণে আধুনিকতাবাদ, কলাকৈবল্যবাদকে পাশ কাটিয়ে প্রতিরোধের দীপ্ত চেতনা আর সামাজিক রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন তিনি। তারপর এক পর্যায়ে বলা যায় ‘এসবের কোনো মানে নেই’ এমন একটি ধারণায় অভিমান করেই নিজের শিক্ষকতা পেশা আর গভীর পাঠে ডুবে নিমজ্জিত হয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিলেও একটা নিস্তব্ধ কবিতা জীবন তিনি যাপন করেছেন। তারপর নব্বইয়ের শুরু থেকে কবিতার ভেতর দিয়ে এমন এক জীবন জার্নিতে তিনি ডুবে ছিলেন যেখানে শব্দ এক অসীম নীরবতার বোঁটায় থমকে থাকে আর কবি সেটিকে ধরার চেষ্টা করছিলেন জগতের তুচ্ছ অতি তুচ্ছ প্রাণের সারল্যে মিশে গিয়ে। আদতে কবিতায় যে সুর বা শব্দ ধরতে চেয়েছিলেন কবি তখনো ঠিকঠাক ধরতে পারেননি। হয়তো সে প্রস্তুতিই নিয়েছিলেন। অথবা বলতে পারি এই ধরতে না পারার অপেক্ষাই মূলত করেছিলেন তিনি। নিজের সময়কালে আত্মপ্রকাশ না করেও যে কোনো কবির কবিত্ব শক্তি বা কবিতা দশক বিচারের গ-িকে পাশ কাটিয়ে তার সমকালীনদের সঙ্গে স্বনামে পাল্লা দিতে পারে কিংবা এক ভিন্নরকম কাব্যভাষার মৌলিকত্বে তাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে সম্ভবত কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে এমনই একটি বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন কবি নূরুল হক। সদা হাস্যোজ্জ্বল, স্বল্পভাষী এই কবির সঙ্গে ছিলো আমার প্রতিদিনকার যোগাযোগ। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের মাধ্যমে ২০১১ সালে প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত কবির সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে তাঁর কবিতা আর ব্যক্তিত্বের প্রতি ভালবাসা থেকে। স্নেহ করেছেন সন্তানের মতোই। এমনকি মৃত্যুর সাত আটদিন আগে আইসিইউতে শয্যাশায়ী মানুষটি যেন আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন এক অপরিমেয় শক্তি আর সাহস নিয়ে। অথচ অতিমারির এই অদ্ভুত অন্ধকার মাত্র অল্প কদিনেই আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে একেকটি নক্ষত্রের মতো প্রাণ। কবিও নিঃশব্দ চরণে চলে গেলেন ‘ঝরা পাতা আর মরা বাতাসের গভীর বিস্তীর্ণ পথে, যেখানে পবিত্র মৃত্যুর চিহ্ন লেখা?’ কিন্তু তিনি পবিত্র মৃত্যু চিহ্ন গভীর বিস্তীর্ণ পথে রেখে যেতে যেতে নিজেরই নাম উচ্চারণ করে ফেলে রেখে গেছেন পাখির বুকের মধ্যে, অখ্যাত নদী ঘাটে ঢেউয়ে ঢেউয়ে। সাম্প্রতিক জগতের কল্লোলিত কররেখা বরাবর কূল পথ ধরে রেখে গেছেন পায়ের বিহ্বল দাগ। তিনি যে সেই আশ্চর্য সীমারেখা প্রকৃত বাংলা কবিতার পাঠক তাঁকে ঠিকই আবিষ্কার করে নিতে ভুলবেন না কখনো আর এটিই হলো কবি নূরুল হকের কাব্যপ্রতিভার শক্তি।

২.

২০১১ সালে কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে স্বকণ্ঠে তাঁর ‘ডাব’ কবিতাটি শুনে থমকে গিয়েছিলাম। এক মহাকাব্যিক প্রসারতায় শোষিত বঞ্চিত জীবনের শূন্যতাকে এমন মিস্টিক সুরে তিনি গেঁথেছিলেন যে, মুহূর্তে সেটি দৃশ্যমান হয়ে উঠে আমাদের মননে- ‘এসেছ আমার কাছে, কাক,/ খাবারের খোঁজে/ বন থেকে থেকে বনে/ ওড়াওড়ি করে/ ক্লান্ত হয়ে,/ এইখানে এসে/ ডাকছ অধীর হয়ে/ জানালার শিকে,/ জানিতো তোমার কেউ নেই।’ এমন সহজ কথা সহজে বলার ক্ষমতা একজন প্রকৃত কবির পক্ষেই সম্ভব। কবিতাটি পাঠ করে একটুকরো অনুভূতির দ্যুতি গেঁথে গিয়েছিল আমার চেতনায়। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে কোথাও দেখা হলে কবিতার আকর্ষণে তাঁর সংশ্রব এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে খুব মুশকিল হতো। দীর্ঘ দিনের জানাশোনায় তাঁর কবিতা থেকে তাঁকে আলাদা করতে গিয়ে বরাবরই হিমশিম খেয়েছি।

ভাবনার গা ঘেঁষে উঠে যে শব্দের জঞ্জাল সে জঞ্জাল ছিঁড়ে ফেলে কবিতায় কী বলা হচ্ছে এবং তা মানুষকে কোনো গভীরে যুক্ত করছে কিনা সেটাকে দেখবার এবং সেই অন্তর্নিহিত সত্যে আনন্দের মুখোমুখি করে দেওয়াই বোধহয় সহজিয়া কবিদের কাজ। যেমন- ‘শিউলি থোকার গন্ধের ভেতর স্থানে/ যেতে চেয়ে আমি/ একদিন পথ হারিয়েছিলাম/ নিজের মধ্যে।’ মূলত কবি নূরুল হক কবিতায় এভাবেই চলতে থাকেন সুনম্র ধাবমানতা নিয়ে। অথবা ‘বসে আছি/ শুকনো ধুলোর মতো,/ উড়ে যেতে হবে কোনোদিকে।/ আকাশের ঝুলানো আধারে/ জীবনের শত মিথ্যা/ মিট মিট করে,/ দূরের তারার মতো।/সমুদ্রের মতিগতি দেখে/ বোঝো না কি/ কার ঘণ্টা বাজে এইখানে?’

এভাবে কবিতায় তিনি এক অসীম শূন্যতা থেকে এমন এক তীর ছুড়ে দেন পাঠকের হৃদয়ে আদতে তাঁর কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে পাঠকও সেই তীরবিদ্ধ হয়ে প্রশ্ন খোঁজেন নিজের সত্তার গভীরে। তিনি কবিতায় ছোট ছোট পঙক্তির নিরেট বুননে এমন এক কাব্যভাষায় কথা বলেন- যা তাঁর একান্ত নিজস্ব কাব্যভাষা। তাঁরই প্রতিফলিত রূপ। আবার দেখা যায় আপাত সারল্যেভরা তাঁর কবিতা আদৌ সরল নয়। এর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে বহু স্তরিত অনুভব ও চিন্তা, যা কোনোভাবেই সহজলভ্য নয়। সততা ও সাধনার পারস্পরিক মেলবন্ধন না ঘটলে নিজের কণ্ঠকে যে নিজের করে তোলা যায় না- কবি তাঁর কবিতায় সেই নিপুণ কারিগরি অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গেই প্রকাশ করেছেন।

একটা কথা বলে রাখা ভাল এই কবিকে নিয়ে লিখতে গেলে তাঁর কবিতা ঘোরগ্রস্ত করে ফেলে। হয়তো এই কারণেই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ আলোচনা করতে গিয়ে প্রাজ্ঞ বোদ্ধা জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও বলেছেন- এই কবির আলোচনায় উদ্ধৃতির লোভ সামলানো সত্যি কঠিন। কবিতার পাঠক কতটুকু বুঝেছেন আর কতুটুকু বোঝেননি সেই হিসেব মুলতবী রাখতে বাধ্য হয়ে কবিতার লাবণ্যের দিকেই চোখ ফেরান।

একটা ট্রেন্ড এখনো চালু আছে যে, মেধাবী কবিরা বোধহয় স্বভাবজাত ভাল কবিতা লিখতে পারেন। তাদের কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। কবির যে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে এই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে আমাদের অনেক কবিই কবিতার দ্রুতগতির হাইওয়েতে চড়ে নিজের স্বাক্ষর রাখতে চান। ফলে সেই কবিতার কবি-পাঠক থাকলেও সাধারণ পাঠক নেই। কিন্তু নূরুল হকের কবিতার বেলায় কথাটা আলাদাভাবে বলতে হবে।

শৈল্পিকতা আর নান্দনিকতার প্রয়াসে কখনো কখনো অনেক প্রতিভাবান কবিরও সমাজ বাস্তবতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা লুপ্ত হয়ে পড়ে। শিল্পের সীমাবদ্ধতা আর সমাজ বাস্তবতার স্বরূপ এই দুইয়ের সমতা থেকে কবিকে নতুনভাবে নিজেকে জন্ম দিতে হয়। সহজিয়া ভঙ্গিতে নৈঃশব্দ্যের গভীর থেকে শব্দ আর দৃশ্য নিয়ে খেলার পাশাপাশি কবি নূরুল হকও দায়বদ্ধতা নিয়ে রাজনীতি আর সমাজ সচেতনতার পরিচয়ও দিয়েছেন তাঁর কবিতায়। কবির দীর্ঘ কবিতার সংখ্যা প্রায় নগণ্য বলতে হয়। কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প এবং অন্যান্য কবিতা’ নামক কাব্যটিতে দুঃসহ মুক্তিযুদ্ধের নিগূঢ় যাতনাকে সুনিবিড়ভাবে উপস্থাপন করেছেন কবি। হয়তো মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন বলে দেশকে নিয়ে কবির সংবেদনশীলতা আরো বেশি ও অন্তর্ভেদী। সেই ধারাবাহিকতায় ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’ কাব্যগ্রন্থটি কবির সামাজিক দায়বদ্ধতার এক জ্যান্ত পরিণাম। অসাম্প্রদায়িক ভূখণ্ডের লড়াইয়ে দেশমাতৃকা রক্ষায় যে সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন নতুন দেশ, মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার হিং¯্র থাবায় দহনে দহনে কবির সহনশীলতার মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো, কবির হাত ধরে শোকের মতো বেরিয়ে এসেছিলো প্রতিটি কবিতা। সালতামামি, শাহবাগে উচ্চারণ, টক-শোর ঠোঁটগুলিকে জিন্দাবাদ, শাপলা চত্বর, ৪২ বৎসর, সাক্ষী, ঘুমোতে ঘুমোতে মালোপাড়াসহ বইটির ৪৮ টি কবিতাই যেনো সেই সময়ের একেকটা ঘটনার ছাপচিত্র।

পরিশেষে বলা যায় প্রায় একই সুরে বাঁধা কবি নূরুল হকের কবিতার বাকভঙ্গি কখনো কখনো একঘেয়েমির কবির শিক্ষক যতীন সরকার ‘কেউ খ্যাতির পেছনে না দৌড়ালে তার কর্ম যথার্থ জনগণের কাছে পৌঁছুতে পারে না’ বলে যে আশঙ্কা করেছিলেন সম্ভবত কবি নূরুল হক সেটিকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাংলা কবিতায় পাঠকের হৃদয়ে নিজের ঠাঁই করে নেবেন।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

অন্তরালের কবি নূরুল হক

অজিত দাশ

বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১

“কবিতার আঙুলের মুঠি ধরে

সারাটি জনম হেঁটে

প্রতি মুহূর্তেই আমি

সয়ে গেছি নৈঃশব্দ্যের তোলপাড়।”

নৈঃশব্দ্যের তোলপাড়? হ্যাঁ, কবিতার আঙুলের মুঠি ধরে সারা জনম এই তোলপাড় যিনি সয়ে যান; নিবিড় নিস্তব্ধের তরঙ্গে যিনি প্রতি মুহূর্তে ডুব দিয়ে ফুল হয়ে ভাসেন কিংবা মানুষ থেকে মানুষে পিছলে গিয়ে ফড়িং এর পাখনার আলোয় যিনি হাত দুটি মুছে ফেলেন তিনিই তো হবেন অন্তরালের কবি। এই অন্তরালের কবির নাম নূরুল হক। গত বাইশ জুলাই বিকেল চারটায় সাতাত্তর বছর বয়সে করোনাক্রান্ত হয়ে মিলিয়ে গেছেন থমথমে, অতিকায় পরিহাস, অভিমানী শূন্য নীল আকাশে যেখানে ডানার কোনো রেখা নেই। এক অবলুপ্ত পাখি হয়ে মুছে গেছেন এক মুহূর্তের ব্যবধানে। যদিও এই মুছে যাওয়া নিয়ে কবির তেমন কোনো আক্ষেপ ছিলো না। মৃত্যুতে তাঁর কোনো গড়িমসি ছিলো না। মৃত্যুকে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর কাছেই ব্যায়মূল্যসহ।

কবির কবিতা পাঠ করা মাত্রই পাঠক একটা বিষয় স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারবেন, তিনি জীবন থেকে ক্রমাগত ছেঁকে নিয়ে নির্মেদ শব্দ আর ধ্যানীর নীরবতা দিয়ে কবিতা লিখেছেন সময়ে অসময়ে। তাঁর কবিতায় শব্দের কাঠিন্য নেই, আছে শব্দের বিস্তৃতি আর রহস্যময় এক দৃশ্যকল্প। বাংলা কবিতায় ভাষার নিজস্ব বুনন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আর অনুভবের মগ্নতা নিয়েই তৈরি করেছেন নিজের মৌলিকত্ব। তাঁর কবিতার পঙক্তিগুলো টুকে রাখতেন বুকপকেটে রাখা একটি ছোট্ট নোটবুকে অথবা বিছানার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট টুকরো কাগজে, খাতার মলাটের সামনে অথবা পেছনে। কখনো আজিজ সুপার মার্কেট কিংবা শাহবাগের পথে অথবা তাঁর বাসায় সাক্ষাৎ হলে লক্ষ্য করেছি তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাগজে টুকে রাখতেন কবিতার ছোট ছোট পঙক্তি। ‘এ জীবন খসড়া জীবন’ কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতায় লিখেছেন- ‘তারাগুলি ফুলগুলি/ খাতার ওপরে এসে পড়ে/ ভোরগুলি সন্ধ্যাগুলি/ প্রাণের ওপরে এসে পড়ে/ চোখগুলি মনগুলি/ টুপটুপ করে পড়ে/ আমার খাতায়।’

তাঁর কবিতায় শব্দের কাঠিন্য নেই, আছে শব্দের বিস্তৃতি আর রহস্যময় এক দৃশ্যকল্প। বাংলা কবিতায় ভাষার নিজস্ব বুনন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আর অনুভবের মগ্নতা নিয়েই তৈরি করেছেন নিজের মৌলিকত্ব

নিরন্তর সমাজ-দর্শন, সভ্যতা, শিল্প, রাজনীতি, মাটি ও প্রাণ-প্রকৃতির কথা তাঁর কবিতায় এতটাই ভাস্বর যে বাংলা কবিতার সবচেয়ে ক্ষুদ্র পাঠকটিও তাঁর কবিতা পাঠ করে তাঁকে চিনে নিতে ভুল করবেন না। কবিতার সহজিয়া স্বাদে পুলকিত হবেন। আর কবির সত্তায় তো লেগেই রয়েছে জন্মভূমি ভাটি অঞ্চলের মাটির সুবাস। হৃদয়ে হাওড়-বিলের থই থই জলের স্পন্দন, গায়ে শাপলা শালুক আর পাখির পালকের গন্ধ নিয়েই তিনি কবিতায় এভাবে বলতে পারেন-

কারো যেনো তীর্থভূমি ছিলো/ এই দেশ / তাই ফুল সাজতো বাতাসে/ নাচাতো বৈষ্ণব হাওয়া দীর্ঘতম লেজ/ জন্মপারাপার থেকে স্রোতে যেতো ভেসে... অথবা কবি নিজের মাতৃকোলের জলের ছায়ায় জীবনের ময়লা ধুয়ে দিতে চান তাই বিনা সংকোচে বলতে পারেন, ... জলের ভেতর গ্রাম, পড়শি গ্রাম/ টলমল করে/ গ্রামের গভীর নিচে বনরাজি/ ছায়া দেখা যায়/ আমি অবাক হয়ে জানতে পাই/ সে ছায়া আমার মায়ের.../ সে ছায়ায় হাত রেখে কত দেশে/ নৌকা ভাসাই/ কত জনম-পেরোনো নদী/ আকাশ জমিন/ রোদে-মেঘে জীবনের ময়লা ধুয়ে যাই।

এই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ প্রকাশিত হয়েছিলো কবির ৬৩ বছর বয়সে ২০০৭ সালে। তারপর একে একে প্রকাশ পায়- একটি গাছের পদপ্রান্তে (২০১১), মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা (২০১২), শাহবাগ থেকে মালোপাড়া (২০১৪), এ জীবন খসড়া জীবন (২০১৫)। এছাড়াও কবিকে নিয়ে ২০১৭ সালে ছোটকাগজ ‘খেয়া’র নূরুল হক সংখ্যাটি প্রকাশ করেন কবি ও সম্পাদক পুলক হাসান। একই বছর মে মাসে কবির কবিতা পাঠ এবং আলোচনা নিয়ে ঢাকার লালমাটিয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ আড্ডার আয়োজন করেছিলেন জ্ঞাতিজন নামের একটি সংগঠন। তাছাড়া এই কবিকে নিয়ে আর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া কোথাও খুব একটা চোখে পড়েনি। জীবদ্দশায় ২০১৪ সালে পেয়েছেন নেত্রকোনা থেকে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার। সর্বশেষ গত বছর বই মেলায় চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা সমগ্র। আর এ বছর কবি নিজেই নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু হুট করেই কবিকে বাড়ি ফিরতে হলো। জীবনের অপূর্ব দৃশ্য দেখে থেকে যাওয়ার কোনো উপায় হলো না।

মূলত ষাটের দশকের কবি হলেও প্রায় চার দশক পর কবির আত্মপ্রকাশের এক অন্যতম কারণ ছিলো তাঁর জীবন জার্নি। আত্মপ্রকাশে বিলম্ব হলেও বিশাল এক প্রস্তুতির পথ পাড়ি দিয়েই উঠে এসেছেন তিনি। স্কুল জীবন থেকেই সাহিত্য চর্চার হাত পাকিয়ে ফেলেছিলেন আশুজিয়া হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া মনস্বী চিন্তাবিদ যতীন সরকারের কাছে। সেটাকে আরো ক্ষুরধার করে দিয়েছিলো মরমী কবি জালাল উদ্দিন খাঁ-র বাড়ির সাহিত্য আসর আর পাঠচক্রগুলো। কিন্তু ষাটের দশকের শেষভাগে, সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলা কবিতার মেরুকরণে আধুনিকতাবাদ, কলাকৈবল্যবাদকে পাশ কাটিয়ে প্রতিরোধের দীপ্ত চেতনা আর সামাজিক রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন তিনি। তারপর এক পর্যায়ে বলা যায় ‘এসবের কোনো মানে নেই’ এমন একটি ধারণায় অভিমান করেই নিজের শিক্ষকতা পেশা আর গভীর পাঠে ডুবে নিমজ্জিত হয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিলেও একটা নিস্তব্ধ কবিতা জীবন তিনি যাপন করেছেন। তারপর নব্বইয়ের শুরু থেকে কবিতার ভেতর দিয়ে এমন এক জীবন জার্নিতে তিনি ডুবে ছিলেন যেখানে শব্দ এক অসীম নীরবতার বোঁটায় থমকে থাকে আর কবি সেটিকে ধরার চেষ্টা করছিলেন জগতের তুচ্ছ অতি তুচ্ছ প্রাণের সারল্যে মিশে গিয়ে। আদতে কবিতায় যে সুর বা শব্দ ধরতে চেয়েছিলেন কবি তখনো ঠিকঠাক ধরতে পারেননি। হয়তো সে প্রস্তুতিই নিয়েছিলেন। অথবা বলতে পারি এই ধরতে না পারার অপেক্ষাই মূলত করেছিলেন তিনি। নিজের সময়কালে আত্মপ্রকাশ না করেও যে কোনো কবির কবিত্ব শক্তি বা কবিতা দশক বিচারের গ-িকে পাশ কাটিয়ে তার সমকালীনদের সঙ্গে স্বনামে পাল্লা দিতে পারে কিংবা এক ভিন্নরকম কাব্যভাষার মৌলিকত্বে তাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে সম্ভবত কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে এমনই একটি বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন কবি নূরুল হক। সদা হাস্যোজ্জ্বল, স্বল্পভাষী এই কবির সঙ্গে ছিলো আমার প্রতিদিনকার যোগাযোগ। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের মাধ্যমে ২০১১ সালে প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত কবির সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে তাঁর কবিতা আর ব্যক্তিত্বের প্রতি ভালবাসা থেকে। স্নেহ করেছেন সন্তানের মতোই। এমনকি মৃত্যুর সাত আটদিন আগে আইসিইউতে শয্যাশায়ী মানুষটি যেন আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন এক অপরিমেয় শক্তি আর সাহস নিয়ে। অথচ অতিমারির এই অদ্ভুত অন্ধকার মাত্র অল্প কদিনেই আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে একেকটি নক্ষত্রের মতো প্রাণ। কবিও নিঃশব্দ চরণে চলে গেলেন ‘ঝরা পাতা আর মরা বাতাসের গভীর বিস্তীর্ণ পথে, যেখানে পবিত্র মৃত্যুর চিহ্ন লেখা?’ কিন্তু তিনি পবিত্র মৃত্যু চিহ্ন গভীর বিস্তীর্ণ পথে রেখে যেতে যেতে নিজেরই নাম উচ্চারণ করে ফেলে রেখে গেছেন পাখির বুকের মধ্যে, অখ্যাত নদী ঘাটে ঢেউয়ে ঢেউয়ে। সাম্প্রতিক জগতের কল্লোলিত কররেখা বরাবর কূল পথ ধরে রেখে গেছেন পায়ের বিহ্বল দাগ। তিনি যে সেই আশ্চর্য সীমারেখা প্রকৃত বাংলা কবিতার পাঠক তাঁকে ঠিকই আবিষ্কার করে নিতে ভুলবেন না কখনো আর এটিই হলো কবি নূরুল হকের কাব্যপ্রতিভার শক্তি।

২.

২০১১ সালে কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে স্বকণ্ঠে তাঁর ‘ডাব’ কবিতাটি শুনে থমকে গিয়েছিলাম। এক মহাকাব্যিক প্রসারতায় শোষিত বঞ্চিত জীবনের শূন্যতাকে এমন মিস্টিক সুরে তিনি গেঁথেছিলেন যে, মুহূর্তে সেটি দৃশ্যমান হয়ে উঠে আমাদের মননে- ‘এসেছ আমার কাছে, কাক,/ খাবারের খোঁজে/ বন থেকে থেকে বনে/ ওড়াওড়ি করে/ ক্লান্ত হয়ে,/ এইখানে এসে/ ডাকছ অধীর হয়ে/ জানালার শিকে,/ জানিতো তোমার কেউ নেই।’ এমন সহজ কথা সহজে বলার ক্ষমতা একজন প্রকৃত কবির পক্ষেই সম্ভব। কবিতাটি পাঠ করে একটুকরো অনুভূতির দ্যুতি গেঁথে গিয়েছিল আমার চেতনায়। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে কোথাও দেখা হলে কবিতার আকর্ষণে তাঁর সংশ্রব এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে খুব মুশকিল হতো। দীর্ঘ দিনের জানাশোনায় তাঁর কবিতা থেকে তাঁকে আলাদা করতে গিয়ে বরাবরই হিমশিম খেয়েছি।

ভাবনার গা ঘেঁষে উঠে যে শব্দের জঞ্জাল সে জঞ্জাল ছিঁড়ে ফেলে কবিতায় কী বলা হচ্ছে এবং তা মানুষকে কোনো গভীরে যুক্ত করছে কিনা সেটাকে দেখবার এবং সেই অন্তর্নিহিত সত্যে আনন্দের মুখোমুখি করে দেওয়াই বোধহয় সহজিয়া কবিদের কাজ। যেমন- ‘শিউলি থোকার গন্ধের ভেতর স্থানে/ যেতে চেয়ে আমি/ একদিন পথ হারিয়েছিলাম/ নিজের মধ্যে।’ মূলত কবি নূরুল হক কবিতায় এভাবেই চলতে থাকেন সুনম্র ধাবমানতা নিয়ে। অথবা ‘বসে আছি/ শুকনো ধুলোর মতো,/ উড়ে যেতে হবে কোনোদিকে।/ আকাশের ঝুলানো আধারে/ জীবনের শত মিথ্যা/ মিট মিট করে,/ দূরের তারার মতো।/সমুদ্রের মতিগতি দেখে/ বোঝো না কি/ কার ঘণ্টা বাজে এইখানে?’

এভাবে কবিতায় তিনি এক অসীম শূন্যতা থেকে এমন এক তীর ছুড়ে দেন পাঠকের হৃদয়ে আদতে তাঁর কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে পাঠকও সেই তীরবিদ্ধ হয়ে প্রশ্ন খোঁজেন নিজের সত্তার গভীরে। তিনি কবিতায় ছোট ছোট পঙক্তির নিরেট বুননে এমন এক কাব্যভাষায় কথা বলেন- যা তাঁর একান্ত নিজস্ব কাব্যভাষা। তাঁরই প্রতিফলিত রূপ। আবার দেখা যায় আপাত সারল্যেভরা তাঁর কবিতা আদৌ সরল নয়। এর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে বহু স্তরিত অনুভব ও চিন্তা, যা কোনোভাবেই সহজলভ্য নয়। সততা ও সাধনার পারস্পরিক মেলবন্ধন না ঘটলে নিজের কণ্ঠকে যে নিজের করে তোলা যায় না- কবি তাঁর কবিতায় সেই নিপুণ কারিগরি অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গেই প্রকাশ করেছেন।

একটা কথা বলে রাখা ভাল এই কবিকে নিয়ে লিখতে গেলে তাঁর কবিতা ঘোরগ্রস্ত করে ফেলে। হয়তো এই কারণেই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ আলোচনা করতে গিয়ে প্রাজ্ঞ বোদ্ধা জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও বলেছেন- এই কবির আলোচনায় উদ্ধৃতির লোভ সামলানো সত্যি কঠিন। কবিতার পাঠক কতটুকু বুঝেছেন আর কতুটুকু বোঝেননি সেই হিসেব মুলতবী রাখতে বাধ্য হয়ে কবিতার লাবণ্যের দিকেই চোখ ফেরান।

একটা ট্রেন্ড এখনো চালু আছে যে, মেধাবী কবিরা বোধহয় স্বভাবজাত ভাল কবিতা লিখতে পারেন। তাদের কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। কবির যে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে এই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে আমাদের অনেক কবিই কবিতার দ্রুতগতির হাইওয়েতে চড়ে নিজের স্বাক্ষর রাখতে চান। ফলে সেই কবিতার কবি-পাঠক থাকলেও সাধারণ পাঠক নেই। কিন্তু নূরুল হকের কবিতার বেলায় কথাটা আলাদাভাবে বলতে হবে।

শৈল্পিকতা আর নান্দনিকতার প্রয়াসে কখনো কখনো অনেক প্রতিভাবান কবিরও সমাজ বাস্তবতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা লুপ্ত হয়ে পড়ে। শিল্পের সীমাবদ্ধতা আর সমাজ বাস্তবতার স্বরূপ এই দুইয়ের সমতা থেকে কবিকে নতুনভাবে নিজেকে জন্ম দিতে হয়। সহজিয়া ভঙ্গিতে নৈঃশব্দ্যের গভীর থেকে শব্দ আর দৃশ্য নিয়ে খেলার পাশাপাশি কবি নূরুল হকও দায়বদ্ধতা নিয়ে রাজনীতি আর সমাজ সচেতনতার পরিচয়ও দিয়েছেন তাঁর কবিতায়। কবির দীর্ঘ কবিতার সংখ্যা প্রায় নগণ্য বলতে হয়। কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প এবং অন্যান্য কবিতা’ নামক কাব্যটিতে দুঃসহ মুক্তিযুদ্ধের নিগূঢ় যাতনাকে সুনিবিড়ভাবে উপস্থাপন করেছেন কবি। হয়তো মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন বলে দেশকে নিয়ে কবির সংবেদনশীলতা আরো বেশি ও অন্তর্ভেদী। সেই ধারাবাহিকতায় ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’ কাব্যগ্রন্থটি কবির সামাজিক দায়বদ্ধতার এক জ্যান্ত পরিণাম। অসাম্প্রদায়িক ভূখণ্ডের লড়াইয়ে দেশমাতৃকা রক্ষায় যে সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন নতুন দেশ, মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার হিং¯্র থাবায় দহনে দহনে কবির সহনশীলতার মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো, কবির হাত ধরে শোকের মতো বেরিয়ে এসেছিলো প্রতিটি কবিতা। সালতামামি, শাহবাগে উচ্চারণ, টক-শোর ঠোঁটগুলিকে জিন্দাবাদ, শাপলা চত্বর, ৪২ বৎসর, সাক্ষী, ঘুমোতে ঘুমোতে মালোপাড়াসহ বইটির ৪৮ টি কবিতাই যেনো সেই সময়ের একেকটা ঘটনার ছাপচিত্র।

পরিশেষে বলা যায় প্রায় একই সুরে বাঁধা কবি নূরুল হকের কবিতার বাকভঙ্গি কখনো কখনো একঘেয়েমির কবির শিক্ষক যতীন সরকার ‘কেউ খ্যাতির পেছনে না দৌড়ালে তার কর্ম যথার্থ জনগণের কাছে পৌঁছুতে পারে না’ বলে যে আশঙ্কা করেছিলেন সম্ভবত কবি নূরুল হক সেটিকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাংলা কবিতায় পাঠকের হৃদয়ে নিজের ঠাঁই করে নেবেন।

back to top