আরণ্যক শামছ
চলে গেলেন কবি নূরুল হক। এক বুনো ফুল। এক ‘ছেঁড়া পাতা’! কিন্তু পৃথিবীতে রেখে গেলেন এক ‘অমর বুদ্বুদ’! সেই ‘বুদ্বুদ’ থেকে জন্ম নেবে বিশেষ এক ‘বোধ’, হয়তো কোন এক দিন!
আমরা ‘বোধ’ নিয়ে ‘বুঁদ’ হয়ে থাকি। কিন্তু ‘পাখিটা’ চলে যায় ‘না ফেরার দেশে’!
আমরা হারালাম গত শতকের ষাটের দশকের এক প্রচারবিমুখ ও নিভৃতচারী প্রতিভাবান কবিকে। কালের বিবর্তনে ও সময়ের স্রোতধারায় হয়তো কোনো একদিন তাঁর কবিতা নোঙর ফেলবে ‘বিশেষ সময়ের চরে’। সেই সময়ের সাথ্যসারথীরা মূল্যায়ন করবে তাঁর কাব্য-সৌন্দর্য্য, আর ছড়িয়ে দেবে ‘শব্দের সুগন্ধ’ চতুর্দিকে। হয়তো কোন এক ‘গল্প বাড়ি’র উঠোনে সাঁঝের বেলা বসবে তাঁর কবিতা পাঠের আসর। ফুল, পাখি আর মানুষ বয়ে বেড়াবে তাঁর ‘কবিতার স্নিগ্ধতা’। সে দিন তিনি ফুটবেন নতুন বাগানে ‘চিরকালের ফুল’। তিনি হবেন অমৃতের সন্তান।
তাঁর “এখানে দাঁড়াই” কবিতা পাঠ করে দাঁড়িয়েছিলাম এক ‘নিস্তব্ধতার নিপীডন’ হয়ে। টেনিসন যাকে বলেছিলেন ‘Torturing Silence’. তিনি লিখলেন- “আমার শেষ সংবর্ধনা আরেক জন্মদিনে।” কী এক নিদারুণ আত্মোপলব্ধি। আসলেও তাই। চলে যাওয়ার আরেক নাম নতুন জন্ম। চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়।
“এখানে দাঁড?াই,
বাহিরে,
হৃদয়ে,
হাহাকার ভরা দিগন্তে।
ফুলের মালা দেই শূন্যতাকে,
খালি জায়গাকে,
যেখানে আমার শেষ সংবর্ধনা
আরেক জন্মদিনে,
সাজগোজ করে।”
‘ঘড়ি, কাঁটা ও স্মৃতি’ কবিতাটি কখন লিখেছেন জানি না কিন্তু তাঁর জীবন নাটকের যবনিকাপাত যেন এক মঞ্চস্থ নাটকের ‘soliloqyu’-এর মতো বলে দিলেন:
“জগত ভাসে যে দিক দিয়ে
সে দিকে নেই আমি
ঝরঝর দুঃখ শুধু মনে
লুকিয়ে কি রবো তবে
দূর কোন স্মৃতির গুহায়?”
আজ কবি কথা রেখে লুকিয়ে গেলেন। চিরতরে। আমাদের স্মৃতির গুহায়। ঝরঝর দুঃখ মনে। আষাঢ় মেঘের বাদল কোণে। যূথি বনের গন্ধেভরা শ্রাবণমেঘের দিনে। ভোলা দিনের বাহন হয়ে।
কবির এ চলে যাওয়া, চলে যাওয়া নয়। এ এক তিরোধান। এ এক প্রত্যাশিত ফিরে আসা সময়ের স্রোতধারা বেয়ে। কবিতার ‘বুদ্বুদে’। আমাদের ‘বোধগম্যতায়, মননে, মগজে ও কৃপণতায়’।
কবির ‘লাল রাত্রির গান’ তাঁর চতুর্থ কবিতার বই। গদ্য, পদ্য ও গীতিকবিতা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা আমাদের প্রভাবিত করে। আমরা কান পেতে শুনি। জীবনের গভীরতম উপলব্ধি নিংড়ানো ভাবনা থেকে লেখা বইটি সম্পর্কে নূরুল হক বলেন, “আমি বরাবর যেমন বলে থাকি, ছন্দহীন রচনা কবিতা নয়, আবর্জনা। এখনো তাই বলছি। আমার এই বইতে বাংলা ছন্দের নিরূপিত তিনটি রূপ ছাড়াও রয়েছে গদ্যছন্দের কবিতাও। রয়েছে বেশকিছু গীতি কবিতা। যারা কবিতার মতো দেখতে কিছু রচনা নয়, সত্যিকার অর্থেই কবিতা পড়তে চান, আশা করি তাদের ভালো লাগবে।”
‘লাল রাত্রির গান’ গ্রন্থ থেকে দুটি কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
১.
চৈত্রে কেন দুলিয়ে কোমর
শাড়ির ভাঁজে তুললে যখন ঢেউ,
আমার তখন দৃষ্টিজুড়ে উড়ন্ত গাঙচিল,
ফেললে ছায়া প্রেমিক হাঙর মাতাল কোনো রাতে
নদীর বুকে স্রোতের পদ্যে ছায়ারা ঝিলমিল...
চৈত্রমাসে হঠাৎ কেন কোকিল ডেকেছিল?
কথা ছিল বুকের বামে সমস্ত রাত রেখে
সিঁদুররাঙা গালের যায় মধুর ভাবে, কাব্যব্যঞ্জনায়। ভালোবাসার পাশাপাশি তাঁর ‘জ্বলে-ওঠা সাহসী উচ্চারণ’ ও প্রতিবাদের ভাষা আমাদের উদ্দীপ্ত করে। মাথা নত না করা এক উচ্চ শিরের কণ্ঠনিঃসৃত দৃপ্ত অঙ্গীকার প্রতিধ্বনিত হয়, যখন তিনি বলেন,
“কিসের শেকল ভয় জন্মস্বাধীন পাখির মতো আমি,
ভালোবাসার আকাশ করবো জয়।”
শাহবাগের শহীদ রাজীবকে তিনি যে মহিমায় চিত্রিত করেছেন তা অভিনব, মানবিক ও এক ‘রাজনৈতিক চপেটাঘাত’ হিসাবে। রাজীবকে নিয়ে তাঁর লেখা একাধিক কবিতার (শাহবাগের উচ্চারণ) একটি থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি:
“...দেখা যাচ্ছে মৃত্যুতেও তাকে
পরাস্ত করা যাচ্ছে না
তাই তার কৃমিকীট নাড়িভুঁড়ি
খেতে শুরু করেছে শবভুকেরা
রাজীব এখন আমাদের চেতনায় ধ্রুবতারা
রাজীব তুমি চলো
আমরাও ছুরিতে চুমু খেতে খেতে
তোমার দেখানো পথ ধরে
চলতে থাকব।”
এককথায় বলা যাবে যে তাঁর জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা, আচার, অনাচার ও দুরাচারের প্রতিটি বিষয় তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। সেটা হেফাজতের হামলাই হোক, হরতাল হোক আর নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই হোক। সমস্ত দেশ যখন সন্ত্রাস-হরতাল-অবরোধে সন্ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত, তখন নূরুল হকের কলম দিয়ে বেরুলো ‘হালুয়া’ কবিতাটি। তিনি লিখলেন: “হরতাল এবং অবরোধ এক ধরনের হালুয়া/ যা রাস্তায় ছিটিয়ে দিলে/ কতই না জীবজন্তু ছুটে আসে।” টিভির টকশো নিয়ে নূরুল হকের ক্ষোভের সীমা পরিসীমা ছিলো না। তিনি এই সব জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক বিক্রি করে দেয়া বুদ্ধিজীবীদের এক চুল ছাড? দিতে রাজি নন। তাই লিখলেন সহজিয়া ভাষায়: ‘নোংরা কোমলতার ফাঁক দিয়ে দানবের হিং¯্র নিঃশ্বাসের মতো/ বেরিয়ে আসছে বিষাক্ত মিথ্যা।’...
পরিশেষে বলবো, নূরুল হকের কবিতা পড়লে অভিধান খুঁজতে হয় না। তাঁর শব্দেরা বাস করে হৃদয়ের কাছাকাছি। নিঃশ্বাসে ও বিশ্বাসে তাঁর পরিপুষ্টি। তিনি আমাদের কাছের মিতা। সহজিয়া। সত্য ও সুন্দরে আলোকিত এক ‘বয়োবৃদ্ধ শিশুপ্রাণ’! প্রাণ আছে। প্রাণচাঞ্চল্য আছে। হৃদয় আছে। স্পন্দন আছে। বুকের চাতালে তার পদধ্বনি শুনি। প্রতিনিয়ত। আর অপেক্ষায় থাকি বিশেষ সময়ের। যে দিন সময়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার কীর্তির প্রজাপতি উড়াল দেবে অনন্তের পথে।
“সাহিত্যের আদর্শ মূলত সাহিত্যই”- এটাকে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি স্থানু ছিলেন না। জীবনের চলার পথে কুড়িয়ে পাওয়া সকল উপকরণ তাঁর লেখার কাঁচামাল হিসেবে আমরা দেখতে পাই। তাঁর জীবন, আশপাশের পরিবেশ প্রকৃতি, তার ভেতরের চৈতন্য ও সৌন্দর্যের স্বরূপ ইত্যাদি যেন শিল্প হয়ে আমাদের চোখের সামনে ‘হাঁসের ডানায় ভর করে’ আমাদের চোখের সম্মুখে উড়ে বেড়িয়েছে। আমরা দেখতে পাইনি। সবকিছুতেই আমরা দেরি করে ফেলি। প্লাটফর্মে পৌঁছানোর আগেই আমাদের ট্রেন চলে যায়। নিয়ে যায় প্রিয়মুখ। পিকাসোর ছবি। নিষিদ্ধ করতালি। প্রতিবাদের ভাষা। সীমান্তহীন ভাষার সংলাপ। জন্ম-স্বাধীন পাখির উচ্ছ্বাস। চলে যায় সাহিত্যের বনমালী। আর আমরা? পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করি নতুন সাহিত্যের রসদ ও কাঁচামাল। ভুলে যাই, কেউ একজন, কোন একদিন আমাদের জন্য ভালোবেসে শব্দ বুনেছিল একটু উষ্ণতার। শীতের কুয়াশামাখা রাতের কোনো এক ‘বারভিকিউ’তে কিংবা আগুন পোহাতে পোহাতে হাতে নেই তার কবিতার বই আর বলি, “লোকটি বড় ভালো ছিল।”
ষাটের দশকের প্রতিভাবান কবি নূরুল হকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’, ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’, ‘মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প’, ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’, ‘এ জীবন খসড়া জীবন’, ‘কবিতাসমগ্র’ ও ‘কবিতার দিকে একজন: শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়’।
অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও নিজের লেখা একটি কবিতা দিয়ে ‘এই সুন্দরের বিন¤্র বিদায়’!
“একটি সুন্দরের মৃত্যু
শত আগাছার ভিড়ে ছিল একটি বুনো ফুল,
বুনো ঘ্রাণে মাতাল পথিক অনিমেষ চেয়ে থাকতো,
একটি বুনো পাপড়ি ঝরা দেখবে বলে অনন্তকাল...
একটি বুনো বাতাসে বুনো পাপড়ি হঠাৎ ঝরে যায়,
একটি বুনো বোঁটা ছিঁড়ে পড়ে বুনো মাটিতে অকস্মাৎ।
ভোরের সবুজ কচি দূর্বা ঘাসের ডগায়,
ঝলমলে এক ফোঁটা বুনো শিশির হাসছিল,
আর সেই বুনো শিশিরের আকস্মিক প্রয়াণে...
বিভ্রান্ত পথিক ভাবে,
বুনো ফুল,
বুনো গ্রাণ,
ঝরা পাপড়ি,
ঝলমলে শিশির সুন্দর এমনি করে কেন মরে হায়?”
কবির এপিটাফে কী লেখা হবে জানি না। তাঁর শেষের দিকে লেখা (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) “অভাজনের এপিটাফ” কবিতায় জীবনের উপসংহার টানলেন নিজেই। বলে গেলেন জীবনের শেষ কথাগুলো।
“সূর্যের দুয়ারে যদি
হাত পেতে থাকি
কোনোদিন,
যদি বাঁধা পড়ে থাকি মুহূর্তেও
কারো প্রাণে
এই পৃথিবীর,
তবে দাঁড়িয়ো এখানে।
যদি
তোমার শরীরে যদি
চোখ হতে পারি একবার
তবে দেখব সুন্দর পৃথিবী
ফুল আরো টুকটুক করে
ঝরবে মাটিতে
নিজের নামের নিচে দাঁড়িয়ে খানিক
জীবনের বাগ্মিতা শুনবো
জেনে নেব
তুমি আছো কাছেই কোথাও
ভূমণ্ডল আলোকিত
স্বতঃস্ফূর্ত পথে।”
ভূমণ্ডল আলোকিত করে তাঁর কাব্য-ব্যঞ্জনার দ্যুতি, শব্দের সারল্য, ভাষার অনবদ্য শিল্পশৈলী, ছড়িয়ে পড়ুক জগতময় ‘জাগ্রত চিরসুন্দর’ হয়ে। বেঁচে থাকুক “শিশিরসিক্ত সবুজ ঘাসের অন্তরঙ্গ বসবাসে”।
আরণ্যক শামছ
বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১
চলে গেলেন কবি নূরুল হক। এক বুনো ফুল। এক ‘ছেঁড়া পাতা’! কিন্তু পৃথিবীতে রেখে গেলেন এক ‘অমর বুদ্বুদ’! সেই ‘বুদ্বুদ’ থেকে জন্ম নেবে বিশেষ এক ‘বোধ’, হয়তো কোন এক দিন!
আমরা ‘বোধ’ নিয়ে ‘বুঁদ’ হয়ে থাকি। কিন্তু ‘পাখিটা’ চলে যায় ‘না ফেরার দেশে’!
আমরা হারালাম গত শতকের ষাটের দশকের এক প্রচারবিমুখ ও নিভৃতচারী প্রতিভাবান কবিকে। কালের বিবর্তনে ও সময়ের স্রোতধারায় হয়তো কোনো একদিন তাঁর কবিতা নোঙর ফেলবে ‘বিশেষ সময়ের চরে’। সেই সময়ের সাথ্যসারথীরা মূল্যায়ন করবে তাঁর কাব্য-সৌন্দর্য্য, আর ছড়িয়ে দেবে ‘শব্দের সুগন্ধ’ চতুর্দিকে। হয়তো কোন এক ‘গল্প বাড়ি’র উঠোনে সাঁঝের বেলা বসবে তাঁর কবিতা পাঠের আসর। ফুল, পাখি আর মানুষ বয়ে বেড়াবে তাঁর ‘কবিতার স্নিগ্ধতা’। সে দিন তিনি ফুটবেন নতুন বাগানে ‘চিরকালের ফুল’। তিনি হবেন অমৃতের সন্তান।
তাঁর “এখানে দাঁড়াই” কবিতা পাঠ করে দাঁড়িয়েছিলাম এক ‘নিস্তব্ধতার নিপীডন’ হয়ে। টেনিসন যাকে বলেছিলেন ‘Torturing Silence’. তিনি লিখলেন- “আমার শেষ সংবর্ধনা আরেক জন্মদিনে।” কী এক নিদারুণ আত্মোপলব্ধি। আসলেও তাই। চলে যাওয়ার আরেক নাম নতুন জন্ম। চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়।
“এখানে দাঁড?াই,
বাহিরে,
হৃদয়ে,
হাহাকার ভরা দিগন্তে।
ফুলের মালা দেই শূন্যতাকে,
খালি জায়গাকে,
যেখানে আমার শেষ সংবর্ধনা
আরেক জন্মদিনে,
সাজগোজ করে।”
‘ঘড়ি, কাঁটা ও স্মৃতি’ কবিতাটি কখন লিখেছেন জানি না কিন্তু তাঁর জীবন নাটকের যবনিকাপাত যেন এক মঞ্চস্থ নাটকের ‘soliloqyu’-এর মতো বলে দিলেন:
“জগত ভাসে যে দিক দিয়ে
সে দিকে নেই আমি
ঝরঝর দুঃখ শুধু মনে
লুকিয়ে কি রবো তবে
দূর কোন স্মৃতির গুহায়?”
আজ কবি কথা রেখে লুকিয়ে গেলেন। চিরতরে। আমাদের স্মৃতির গুহায়। ঝরঝর দুঃখ মনে। আষাঢ় মেঘের বাদল কোণে। যূথি বনের গন্ধেভরা শ্রাবণমেঘের দিনে। ভোলা দিনের বাহন হয়ে।
কবির এ চলে যাওয়া, চলে যাওয়া নয়। এ এক তিরোধান। এ এক প্রত্যাশিত ফিরে আসা সময়ের স্রোতধারা বেয়ে। কবিতার ‘বুদ্বুদে’। আমাদের ‘বোধগম্যতায়, মননে, মগজে ও কৃপণতায়’।
কবির ‘লাল রাত্রির গান’ তাঁর চতুর্থ কবিতার বই। গদ্য, পদ্য ও গীতিকবিতা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা আমাদের প্রভাবিত করে। আমরা কান পেতে শুনি। জীবনের গভীরতম উপলব্ধি নিংড়ানো ভাবনা থেকে লেখা বইটি সম্পর্কে নূরুল হক বলেন, “আমি বরাবর যেমন বলে থাকি, ছন্দহীন রচনা কবিতা নয়, আবর্জনা। এখনো তাই বলছি। আমার এই বইতে বাংলা ছন্দের নিরূপিত তিনটি রূপ ছাড়াও রয়েছে গদ্যছন্দের কবিতাও। রয়েছে বেশকিছু গীতি কবিতা। যারা কবিতার মতো দেখতে কিছু রচনা নয়, সত্যিকার অর্থেই কবিতা পড়তে চান, আশা করি তাদের ভালো লাগবে।”
‘লাল রাত্রির গান’ গ্রন্থ থেকে দুটি কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
১.
চৈত্রে কেন দুলিয়ে কোমর
শাড়ির ভাঁজে তুললে যখন ঢেউ,
আমার তখন দৃষ্টিজুড়ে উড়ন্ত গাঙচিল,
ফেললে ছায়া প্রেমিক হাঙর মাতাল কোনো রাতে
নদীর বুকে স্রোতের পদ্যে ছায়ারা ঝিলমিল...
চৈত্রমাসে হঠাৎ কেন কোকিল ডেকেছিল?
কথা ছিল বুকের বামে সমস্ত রাত রেখে
সিঁদুররাঙা গালের যায় মধুর ভাবে, কাব্যব্যঞ্জনায়। ভালোবাসার পাশাপাশি তাঁর ‘জ্বলে-ওঠা সাহসী উচ্চারণ’ ও প্রতিবাদের ভাষা আমাদের উদ্দীপ্ত করে। মাথা নত না করা এক উচ্চ শিরের কণ্ঠনিঃসৃত দৃপ্ত অঙ্গীকার প্রতিধ্বনিত হয়, যখন তিনি বলেন,
“কিসের শেকল ভয় জন্মস্বাধীন পাখির মতো আমি,
ভালোবাসার আকাশ করবো জয়।”
শাহবাগের শহীদ রাজীবকে তিনি যে মহিমায় চিত্রিত করেছেন তা অভিনব, মানবিক ও এক ‘রাজনৈতিক চপেটাঘাত’ হিসাবে। রাজীবকে নিয়ে তাঁর লেখা একাধিক কবিতার (শাহবাগের উচ্চারণ) একটি থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি:
“...দেখা যাচ্ছে মৃত্যুতেও তাকে
পরাস্ত করা যাচ্ছে না
তাই তার কৃমিকীট নাড়িভুঁড়ি
খেতে শুরু করেছে শবভুকেরা
রাজীব এখন আমাদের চেতনায় ধ্রুবতারা
রাজীব তুমি চলো
আমরাও ছুরিতে চুমু খেতে খেতে
তোমার দেখানো পথ ধরে
চলতে থাকব।”
এককথায় বলা যাবে যে তাঁর জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা, আচার, অনাচার ও দুরাচারের প্রতিটি বিষয় তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। সেটা হেফাজতের হামলাই হোক, হরতাল হোক আর নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই হোক। সমস্ত দেশ যখন সন্ত্রাস-হরতাল-অবরোধে সন্ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত, তখন নূরুল হকের কলম দিয়ে বেরুলো ‘হালুয়া’ কবিতাটি। তিনি লিখলেন: “হরতাল এবং অবরোধ এক ধরনের হালুয়া/ যা রাস্তায় ছিটিয়ে দিলে/ কতই না জীবজন্তু ছুটে আসে।” টিভির টকশো নিয়ে নূরুল হকের ক্ষোভের সীমা পরিসীমা ছিলো না। তিনি এই সব জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক বিক্রি করে দেয়া বুদ্ধিজীবীদের এক চুল ছাড? দিতে রাজি নন। তাই লিখলেন সহজিয়া ভাষায়: ‘নোংরা কোমলতার ফাঁক দিয়ে দানবের হিং¯্র নিঃশ্বাসের মতো/ বেরিয়ে আসছে বিষাক্ত মিথ্যা।’...
পরিশেষে বলবো, নূরুল হকের কবিতা পড়লে অভিধান খুঁজতে হয় না। তাঁর শব্দেরা বাস করে হৃদয়ের কাছাকাছি। নিঃশ্বাসে ও বিশ্বাসে তাঁর পরিপুষ্টি। তিনি আমাদের কাছের মিতা। সহজিয়া। সত্য ও সুন্দরে আলোকিত এক ‘বয়োবৃদ্ধ শিশুপ্রাণ’! প্রাণ আছে। প্রাণচাঞ্চল্য আছে। হৃদয় আছে। স্পন্দন আছে। বুকের চাতালে তার পদধ্বনি শুনি। প্রতিনিয়ত। আর অপেক্ষায় থাকি বিশেষ সময়ের। যে দিন সময়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার কীর্তির প্রজাপতি উড়াল দেবে অনন্তের পথে।
“সাহিত্যের আদর্শ মূলত সাহিত্যই”- এটাকে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি স্থানু ছিলেন না। জীবনের চলার পথে কুড়িয়ে পাওয়া সকল উপকরণ তাঁর লেখার কাঁচামাল হিসেবে আমরা দেখতে পাই। তাঁর জীবন, আশপাশের পরিবেশ প্রকৃতি, তার ভেতরের চৈতন্য ও সৌন্দর্যের স্বরূপ ইত্যাদি যেন শিল্প হয়ে আমাদের চোখের সামনে ‘হাঁসের ডানায় ভর করে’ আমাদের চোখের সম্মুখে উড়ে বেড়িয়েছে। আমরা দেখতে পাইনি। সবকিছুতেই আমরা দেরি করে ফেলি। প্লাটফর্মে পৌঁছানোর আগেই আমাদের ট্রেন চলে যায়। নিয়ে যায় প্রিয়মুখ। পিকাসোর ছবি। নিষিদ্ধ করতালি। প্রতিবাদের ভাষা। সীমান্তহীন ভাষার সংলাপ। জন্ম-স্বাধীন পাখির উচ্ছ্বাস। চলে যায় সাহিত্যের বনমালী। আর আমরা? পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করি নতুন সাহিত্যের রসদ ও কাঁচামাল। ভুলে যাই, কেউ একজন, কোন একদিন আমাদের জন্য ভালোবেসে শব্দ বুনেছিল একটু উষ্ণতার। শীতের কুয়াশামাখা রাতের কোনো এক ‘বারভিকিউ’তে কিংবা আগুন পোহাতে পোহাতে হাতে নেই তার কবিতার বই আর বলি, “লোকটি বড় ভালো ছিল।”
ষাটের দশকের প্রতিভাবান কবি নূরুল হকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’, ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’, ‘মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প’, ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’, ‘এ জীবন খসড়া জীবন’, ‘কবিতাসমগ্র’ ও ‘কবিতার দিকে একজন: শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়’।
অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও নিজের লেখা একটি কবিতা দিয়ে ‘এই সুন্দরের বিন¤্র বিদায়’!
“একটি সুন্দরের মৃত্যু
শত আগাছার ভিড়ে ছিল একটি বুনো ফুল,
বুনো ঘ্রাণে মাতাল পথিক অনিমেষ চেয়ে থাকতো,
একটি বুনো পাপড়ি ঝরা দেখবে বলে অনন্তকাল...
একটি বুনো বাতাসে বুনো পাপড়ি হঠাৎ ঝরে যায়,
একটি বুনো বোঁটা ছিঁড়ে পড়ে বুনো মাটিতে অকস্মাৎ।
ভোরের সবুজ কচি দূর্বা ঘাসের ডগায়,
ঝলমলে এক ফোঁটা বুনো শিশির হাসছিল,
আর সেই বুনো শিশিরের আকস্মিক প্রয়াণে...
বিভ্রান্ত পথিক ভাবে,
বুনো ফুল,
বুনো গ্রাণ,
ঝরা পাপড়ি,
ঝলমলে শিশির সুন্দর এমনি করে কেন মরে হায়?”
কবির এপিটাফে কী লেখা হবে জানি না। তাঁর শেষের দিকে লেখা (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) “অভাজনের এপিটাফ” কবিতায় জীবনের উপসংহার টানলেন নিজেই। বলে গেলেন জীবনের শেষ কথাগুলো।
“সূর্যের দুয়ারে যদি
হাত পেতে থাকি
কোনোদিন,
যদি বাঁধা পড়ে থাকি মুহূর্তেও
কারো প্রাণে
এই পৃথিবীর,
তবে দাঁড়িয়ো এখানে।
যদি
তোমার শরীরে যদি
চোখ হতে পারি একবার
তবে দেখব সুন্দর পৃথিবী
ফুল আরো টুকটুক করে
ঝরবে মাটিতে
নিজের নামের নিচে দাঁড়িয়ে খানিক
জীবনের বাগ্মিতা শুনবো
জেনে নেব
তুমি আছো কাছেই কোথাও
ভূমণ্ডল আলোকিত
স্বতঃস্ফূর্ত পথে।”
ভূমণ্ডল আলোকিত করে তাঁর কাব্য-ব্যঞ্জনার দ্যুতি, শব্দের সারল্য, ভাষার অনবদ্য শিল্পশৈলী, ছড়িয়ে পড়ুক জগতময় ‘জাগ্রত চিরসুন্দর’ হয়ে। বেঁচে থাকুক “শিশিরসিক্ত সবুজ ঘাসের অন্তরঙ্গ বসবাসে”।