সরকার আবদুল মান্নান
পরিশেষে বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয়ের আচার্যের পদেও বৃত হয়েছিলেন তিনি। প্রতিভার এই মূল্যায়ন আজ আর কল্পনাও করা যায় না।
সেই শৈশব থেকে তাঁর ছবি আঁকার ঝোঁক। বাড়িতেও ছিল বিপুল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ। গানে চর্চা, অভিনয়ের চর্চা, চিত্রশিল্পের চর্চা আর শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডার আয়োজন- এসব ছিল তখনকার ঠাকুরবাড়ির নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ। পুরো বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মিলনমেলা যেন অনুষ্ঠিত হতো ওই ঠাকুরবাড়িতে। আর সেই বিপুল প্রাণপ্রবাহ থেকে রবীন্দ্রনাথের পরে সব চেয়ে বেশি রস যিনি আহরণ করেছেন তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন অবনঠাকুর। কি চিত্রকলা, কি সংগীত কি কথাসাহিত্য ও গদ্যসাহিত্য- সর্বত্রই সোনা ফলিয়েছেন তিনি। তাঁর এই মহৎ সৃষ্টির পটভূমিতে ছিল জীবন ও জগতের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ। ফলে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হওয়া মানেই হলো আনন্দের সঙ্গে, রসের সঙ্গে, সুন্দরের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। তাঁর সৃষ্টির সর্বত্রই বহু রঙের আলোর ফোয়ারা। বহু কৌণিক প্রিজমের মতো তার সকল সৃষ্টি থেকে চারদিকে ঠিকরে পরে অফুরন্ত আলো। সেই আলোয় আমরা আলোকিত হতে পারি, রাঙিয়ে নিতে পারি আমাদের মন ও মননের জগৎ। তাঁর কলজয়ীর সৃষ্টিশীল প্রতিভার স্পর্শে লুপ্তপ্রায় ভারতীয় শিল্পকলা সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল নতুন নতুন সম্ভাবনায়। রবীন্দ্রনাথের খুব নেওটা ছিলেন অবনঠাকুর। সারাক্ষণ তাঁর কাছে কাছেই থাকতেন। ‘রবিকা’ নামে অজ্ঞান ছিলেন এই ভ্রতুষ্পুটি। সব ধরনের প্রেরণাও পেয়েছেন কাকার কাছ থেকেই। বিশেষ করে লেখালেখির উৎসাহদাতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়িতে শখের গড়া নাট্যদল ‘খামখেয়ালি’তে তখন নিয়ম ছিল সভ্যদের নিয়মিত নিজের লেখা নাটক, প্রবন্ধ কিংবা অন্য যে কোনো লেখা পড়তে হবে। সেখানেই অবনীন্দ্রনাথ প্রথম পড়েছিলেন ‘দেবীপ্রতিমা’ নামে একটি গল্প। আর ওই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর ভেতরে যে লুকিয়ে ছিল একজন প্রতিভাধর কথাশিল্পী, তার খোঁজ পান পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রায়ই বলতেন, “অবন, তোমার লেখাটি কিন্তু বেশ হয়েছিল।” এই আশীর্বাদটুকু অবনঠাকুরের জন্য দেবতার বর। আর “ছবি লিখিয়ে অবনঠাকুর” মনেপ্রাণে হয়ে ওঠেন কথাশিল্পের রসের কারবারি। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল, নালক, রাজকাহিনী, আপনকথা, ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ, ঘরোয়া, জোড়াসাঁকোর ধারে নামক এক একটি রসের ফোয়ারা। ওই গদ্যও যেন ছবিরই আরেক পরত। গদ্য এতটা চিত্রময় হয়ে উঠতে পারে, রূপ আর রূপকল্পে এতটা সমৃদ্ধ ও প্রগাঢ় হয়ে উঠতে পারে অবনঠাকুরের আগে তাকি কেউ ভাবতে পেরেছে! আর চিত্রকলার রসের জগৎ নিয়ে, রূপত্ত্ব নিয়ে তিনি যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন ভূ-ভারতে তার কোনো দ্বিতীয় নজির নেই। শিল্পকে এমনভাবে বোঝার, অনুভব করার, বোঝানোর, অনুভব করানোর শক্তি মনে হয় ঈশ^র সবাইকে দেন না। বাগীশ^রী শিল্প প্রবন্ধাবলী গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধের মধ্যে অবনঠাকুরের এই অসাধারণ শক্তিমত্তার পরিচয় আছে। এইসব প্রবন্ধে পা-িত্যের সঙ্গে মিশেছে মমত্ববোধ, গভীর জীবনদর্শন, অসাধারণ প্রজ্ঞা, বিস্ময়কর বিনয়বোধ। আর যে ভাষায় তিনি এই রসের জগৎ তুলে ধরেছেন ওই ভাষা কবিতার, সংগীতের, দর্শনের, প্রেমের, রসের। শিল্পবিচারে, শিল্পের স্বরূপ উন্মোচনে এমন ভাষার খোঁজ কী করে তিনি পেলেন তাও এক অন্বেষার বিষয়। সব মিলিয়ে তাঁর লেখার পরিমাণ বেশি নয়, ২৬-২৭ খানি বই। রবীন্দ্রনাথের তুলনায় অতি সামান্য। লীলা মজুমদার বলেছিলেন, “এ যেন কবিগুরুর কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশে পাথরের ঢিবি। কিন্তু পাথর এত ঝকঝকে, তার ভিতর থেকে এমনি আলো ঠিকরোয় যে, মন বলে হীরে নয় তো?”
‘রবিকা’কে যেমন খুব ভালোবাসতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তেমনি রবীন্দ্রনাথও এই ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে সবচেয়ে ভাল বুঝতেন। কি প্রখর প্রতিভাধর যে এই মানুষটি তার খোঁজ রাখতেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে সব কাজেই প্রেরণা যোগাতেন, লিখতে তাড়া দিতেন। অবনও পদে পদে রবিকার কথা শুনে চলতেন। কিন্তু কখনোই তাঁর কাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুব বেশি লেখেননি তিনি। কিন্তু ওই অল্প লেখার মধ্যে যে জগৎ তিনি তৈরি করেছেন তার বর্ণে বর্ণে অবনঠাকুরের রূপ-রং-রেখা প্রবলভাবে উচ্চকিত।
ছেলেবেলায় অবনীন্দ্রনাথকে বলা হতো বোম্বেটে। ভীষণ দুষ্টুমির জন্য এই উপাধি। রবীন্দ্রনাথ বলতেন পাগলা। ভীষণ দুরন্ত ছিলেন। দস্যিপনায় তাঁর কোনো তুলনা চলত না। বাবা গুণেন্দ্রনাথের বহু শখের মধ্যে ছিল এ্যাকোরিয়ামে নানা রঙের মাছ সংরক্ষণ। অবনঠাকুর ভাবলেন, রঙিন মাছগুলোর রঙিন জলের মধ্যেই থাকা উচিত। দেখাবেও সুন্দর। সুতরাং লাল রং মিশিয়ে দিলেন এ্যাকোরিয়ারে জলের সঙ্গে। দু মিনিটের মধ্যে লাল-নীল মাছগুলো মরে ভেসে উঠছে। বুড়ো দারোয়ানের দাড়িতে হাত দিয়ে দেখতে গেছেন কেমন লাগে। কিন্তু বকুনি খেয়ে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল। বাড়ির পোষা পাখির খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিয়েছেন সব পাখি। বাটালি দিয়ে গোপনে কাঠের কাজ করতে গিয়ে আঙ্গুল কেটে ফেলেছেন। রক্তারক্তি অবস্থা। সেই কাটার দাগ বহন করতে হয়েছে সারা জীবন।
কিন্তু এই দুষ্টুমি তার মধ্যে কোথাও রুক্ষতা ছিল না, উন্মত্ততা ছিল না। ছিল ¯িœগ্ধতা। সর্বত্রই ছিল নিজের মতো করে ভাবনার পরিচয়। সবকিছুর মধ্যে নিজেকে খোঁজা, নিজেকে আবিষ্কার করা। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল প্রতিভা তাঁকে সর্বদাই মুগ্ধ করত। তাঁর সঙ্গ উপভোগ করতেন। নাটকের দল গড়বেন, আছেন রবীন্দনাথ- শিল্প নির্দেশনায়, মঞ্চসজ্জায় কাজ করেছেন দুজনে মিলিয়ে। ড্রামাটিক ক্লাব করতে হবে। সেখানেও ওই রবীন্দ্রনাথ। এরপর নানা কারণে সেটি উঠে গেলে জমানো চাদার টাকায় ড্রামাটিক ক্লাবের তিরোধানে আয়োজন করেন শ্রাদ্ধের। যেনতেন শ্রাদ্ধ নয়- নামি হোটেলে এলাহি ভোজের আয়োজন করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন। ভেতরে ভেতরে কী যে রসিক মানুষ ছিলেন অবনঠাকুর তার পরিচয় মুদ্রিত আছে এইসব ঘটনার মধ্যে। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “রবিকা বলতেন অবন একটা পাগল। সে কথা সত্যি। রবিকা যে বৈকুণ্ঠের খাতায় তিন কড়ির মুখ দিয়ে আমায় বলিয়েছেন, জন্মে অবধি আমার জন্যে কেউ ভাবেনি। আমিও কারো জন্য ভাবতে শিখিনি। এই হচ্ছে আমার সত্যিকারের রূপ। রবিকা আমাকে ঠিক ধরেছিলেন। আমি নিজের মনে নিজে থাকতেই ভালবাসি।” অবনঠাকুরের এই বক্তব্যের মধ্যে বিনয় আছে কিন্তু সঠিকতা নেই। তিনি নিজেকে নিয়ে যতনা ভাবতেন তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবতেন পরিবার-পরিজনদের নিয়ে, কাছেপিঠের মানুষদের নিয়ে, পরিচিতজনদের নিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে। মমতারসের একটি মিষ্টি আলোয় তাঁর হৃদয় ছিল পরিপূর্ণ। বড় মেয়ে উমাদেবী বাবার কথা নামক বইতে লিখেছেন, তিনি যেমন স্নেহশীল বাবা, তেমনি কর্তব্যপরায়ণ সন্তান, পত্নীগতপ্রাণ স্বামী এবং পরিবার-পরিজন সকলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা মস্ত বড় মনের একজন মানুষ। কেউ যে কোনো বিপদে-আপদে- সে বাড়ির দাস-দাসী, আমলা-সরকার, আত্মীয়-পরিজন যেই হোন না কেন, সবার আগে তিনিই গিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। মেয়ে উমাকে বলেছিলেন, “জানিস, কোথা থেকে না আমন্ত্রণ পেয়েছি। দিল্লি, লাহোর, জয়পুর, বম্বে, মাদ্রাজ, মহীশূর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, চীন সব জায়গা থেকে আমায় ডেকেছে। কেন যাইনি জানিস? তোর মাকে একলা রেখে যেতে হবে বলে। বড়ো ভীতু ছিল সে।” এই মানুষটি শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবেন তা কিছুতেই হতে পারে না। কত বিখ্যাত মানুষ ছিলেন তিনি। দেশে-বিদেশে কত যে তাঁর পরিচয়। পৃথিবীখ্যাত শিল্পী, উস্তাদ সারিঙ্গী বাদক, খ্যাতিমান অভিনেতা, বিখ্যাত শিল্পতাত্ত্বিক, অসম্ভব জনপ্রিয় শিক্ষক। সেই মানুষটি শুধু স্ত্রীর মঙ্গলের কথা ভেবে দেশ-বিদেশের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করছেন। তখন মনে হয় আমাদের ঘরের আটপৌরে চেনা মানুষটি, একান্তই ছাপোষা এক অতি সাধারণ বাঙালি।
কলকাতায় তখন প্লেগ মহামারির আকার নিয়েছে। আদরের ছোট মেয়েটি প্লেগে আক্রন্ত হয়ে চলে গেল চিরদিনের জন্য। কী যে শোক, আহা! কিন্তু নিজের সেই শোক লুকিয়ে রেখে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলেন স্ত্রীর প্রতি। সন্তান হারানো শোকে পাগলপ্রায় স্ত্রীর মন ভুলিয়ে রাখবার জন্য তাঁকে অনেক রকম পাখি কিনে দিতেন অবনীন্দ্রনাথ। বাচ্চা টিয়া, চন্দনা, ময়না- কত পাখি! পাখিগুলোকে খুব যতœ করে বড় করতেন। রুটিন করে খেতে দিতেন মুসুর ডাল সিদ্ধ, ছাতু এবং আরও কত কী। এর পর ওরা যখন খেতে শিখত, ডানা মেলে উড়তে পারত, তখন আকাশে উড়িয়ে দিতেন। কোনো পাখির অসুখ হলে বইপত্র ঘেঁটে ওষুধ বার করতেন। নিজে ওষুধ বানাতেন এবং পাখিদের খাইয়ে সুস্থ করে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু যখন দেখতেন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং তাঁর আর কিছুই করার নেই তখন ওই মুমূর্ষু পাখি সামনে নিয়ে অসহায়ের মতো নির্বাক বসে থাকতেন।
পরিবার ছেড়ে যদি তাঁর ছাত্রদের দিকে তাকাই, সেখানেও দেখব একই কা-। প্রিয় শিষ্য নন্দলাল বসু- পরে বিশ^জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি একবার ‘উমার তপস্যা’ নামে একটি ছবি এঁকে এনে দেখালেন গুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ছবি দেখে অবনঠাকুর বললেন, “রং এত কম কেন? আর কিছু না করো উমাকে একটু চন্দন, ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দাও।”
শিষ্য ফিরে গেলেন। গুরুর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে ছবিটিতে। এদিকে সারারাত ঘুম নেই অবনঠাকুরের চোখে। কেন তিনি নন্দকে ও কথা বলতে গেলেন? উমাকে ও যেভাবে দেখেছে, যেভাবে ভেবেছে সেভাবেই তো আঁকবে। তাঁর চোখ দিয়ে ছাত্রকে কেন তিনি দেখতে বলবেন? আর তপস্যায় বিভোর উমা কেনই বা চন্দন ফুলে সাজবে? এইসব ভেবে ভেবে গুরু সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোর হতেই ছুটলেন ছাত্রের ঘরে। ছাত্র নন্দলাল তখন সেই ছবিখানি সামনে রেখে উমাকে নতুন করে সাজানোর জন্য রং তুলি হাতে নিয়ে ভাবছিলেন। এমন সময়, “আহা করো কী করো কী নন্দ, থামো থামো। তোমার উমা ঠিকই আছে। আর হাত লাগিয়ো না। আর একটু হলেই ভালো ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিলুম আর কী!” এই হলেন শিক্ষক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিক্ষকতা নিয়ে প্রশিক্ষণের যুগ তখন ছিল না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি সহজাত মমত্ববোধ থেকে বুঝতে পারতেন যে, ওদেরকে নিজের মতো করে কাজ করতে দেওয়া দরকার। না হলে ওদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিকশিত হবে না। আর ছাত্রের কাছে নিজের ভুলি স্বীকার করার মাধ্যমে যে মাহাত্ম্যের পরিচয় দিয়েছেন তা ছাত্রের জন্যও ছিল এক ধরনের শিক্ষা।
শুধু নন্দলাল বসুকে নয়, নিজ হাতে শিখিয়েছেন যামিনী রায়কেও। পরে তাঁরা কত বড় শিল্পী হয়েছেন তা আমরা জানি। মেয়ে উমা একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “বাবা, তুমি এত ছবি আঁকো, এগজিবিশনে দাও না কেন?” তাঁর উত্তর ছিল, “ওরে, আমার ছবি দিলে ছাত্রদের ছবি বিক্রি হবে না যে।” আজকে আর এই মাহাত্ম্য চিন্তাও করা যায় না। ছাত্ররা পরিচিত হবে, খ্যাত হবে এই আকাক্সক্ষা থেকেই তিনি ছাত্রদের কাজগুলোকে লোকসম্মুখে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এ যেন ছাত্রদের কাজের ভেতরে দিয়ে নিজেকেই উন্মোচন করা, সন্তানের ভেতর দিয়ে নিজেকেই রেখে যাওয়া।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট। নিরন্তর উত্তরপুরুষদের সমৃদ্ধ করতে হবে স্বদেশের অসামান্য শিল্প-ঐতিহ্যে। তাই সারা দেশ থেকে প্রাচ্যের শিল্প নিদর্শনের নানা নমুনা খুঁজে খুঁজে বের করেছেন তিনি। তৈরি করেছেন বিপুল এক সংগ্রহশালা। সেই অন্বেষণে তাঁর নিষ্ঠা, সততা, শ্রম ও নৈপুণ্য দেখে অবাক হয়েছেন সহকর্মীরা। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়েরর পৃষ্ঠপোষকতা এবং উৎসাহে চেষ্টা চালিয়েছেন দেশীয় ছবিকে সাধারণ মানুষের মাঝেও পরিচিত করে তুলতে। শেষ জীবনে মেতেছিলেন নিজের উদ্ভাবিত আরেক শিল্পসাধনায়। নাম তার কাটুম কুটুম। এই পদ্ধতি অনেকটা কোলাজ পদ্ধতির মতোই। বাতিল ও ফেলে দেওয়া জিনিসপত্রের টুকরো, ভাঙা কাঠের টুকরো, গাছের ছাল, শুকনো ডাল, গাছের গুঁড়ি, শাখা-প্রশাখা, শিকড়, বাঁশের গাঁট ইত্যাদির মাধ্যমে বস্তু ও প্রাণীর অবয়ব তুলে ধরাই ছিল তাঁর কাটুম কুটুমের জগৎ। সেই জগতেই তিনি নিবিষ্ট থেকেছেন সুর ও ছন্দের সাধনায়; তাল, লয় ও ঐক্যের সাধনায়। বাঁশের গাঁট থেকে উড়ন্ত পাখি, গাছের শাখা-প্রশাখা থেকে চপ্পল হরিণ এবং গাছের বাকল, সুপারির খোসা, নারকেলের ছোবড়া, আমের আঁটি, তালের আঁটি, নারকেলের মালা, পাথরের টুকরো, দড়ি ইত্যাদি থেকে গিরগিটি, কুকুর, বেড়াল, মাছ, প্রজাপতি ইত্যাদি তৈরি করতেন তিনি আর তাদের নামও দিতেন। শিল্পের নতুন এক জগৎ তিনি তৈরি করেন, যে ধারা আজও অব্যাহত আছে।
ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে নাটক করার ঐতিহ্য আরও পুরোনো। এইসব ঘরোয়া নাটকে বরাবরই দাপুটে অভিনয় করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পছন্দ করতেন কমিক চরিত্র। ওই ধরনের চরিত্রের ভেতর দিয়ে তিনি রসের যোগান দিতে পারতেন সাফল্যের সঙ্গে। চারপাশের লোকজনদের তিনি দেখতেন মমত্বের সঙ্গে, দেখতেন শিল্পীচোখের তন্ময়তায়। আর পোশাকআশাকে, কথা বলবার ধরনে, অভিন-নৈপুণ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলতে চাইতেন ওইসব মানুষের আকাক্সক্ষার গড়নটিকে। তিনি বলতেন, “শখের আবার ঠিক বা ভুল রাস্তা কী! এর কি আর নিয়মকানুন আছে? আপনিই সে বেরিয়ে আসে, পথ করে নেয়। যার ভিতরে শখ নেই, তাকে ও কথা বুঝিয়ে বলা যায় না। ছবিও তাই, টেকনিক, স্টাইল ওসব কিছু নয়। আসল কথা হচ্ছে ওই ভেতরের শখ। আমার বাজনার বেলাতেও হয়েছিল তাই।”
শখ মানে ভালো লাগার বিষয়। শখ যদি না-ই থাকল, ভালো যদি না-ই লাগল তবে কিসের টেকনিক, কিসের স্টাইল। অবনঠাকুর সারাটা জীবন এঁকেছেন, লিখেছেন, গেয়েছেন তার সবটুকু ভালো লাগা থেকে। ভালো লাগেনি তো করেননি। জোড় করে লেগে থেকে ভালো লাগাতে চাননি কখনোই। ঠাকুরবাড়িব সদস্যদের শখ আর শৌখিনতা ছিল একেবারে মজ্জাগত। কিন্তু সেই শখ ও শৌখিনতা সে সময়ের জমিদারপুত্রেদের মতো পায়রা ওড়ানো, দামি পাথর সংগ্রহ, দুর্লভ ছবি বা মূর্তি সংগ্রহ, দেশি-বিদেশি পশুপাখি পোষা এবং আরও অসংখ্য উদ্ভট বিলাস-ব্যসনের মধ্যে জীবনযাপন করা। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের তেমন অরুচিকর ও স্থ’ল শখ কারোরই ছিল না। তাদের শখ ছিল শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে। অবনঠাকুরের শৈশবে শখ ছিল এস্রাজ বাজানো, অভিনয়, শিল্পরচর্চা, সাহিত্যচর্চা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল্য দিয়েছেন নিজের ভালো লাগার প্রতি। চেষ্টা করে ক্যাতিমান হতে হবে এই দূরাকাক্সক্ষা তাঁর কখনোই ছিল না। ফলে যা কিছু করেছেন তার পেছনে ছিল ভালোবাসা, প্রাণের তাগিদ, গভীর মমত্ববোধ। এবং এ জন্যই বুঝি তাঁর বিচিত্র কর্মের মূল সুর যেন ধ্বনিত হয় কোনো এক একতারর তার থেকে। গান, অভিনয়, চিত্রশিল্প, সাহিত্য- একটি থেকে আরেকটি কত ফারাক, কিন্তু অবনঠাকুরের বিচিত্র এই কর্মের ভেতরগত আবেদন যেন অভিন্ন; সুর, তাল, লয়, রং, রেখা- সব যেন একই উৎস থেকে বিকশিত হওয়া।
সরকার আবদুল মান্নান
শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১
পরিশেষে বিশ^ভারতী বিশ^বিদ্যালয়ের আচার্যের পদেও বৃত হয়েছিলেন তিনি। প্রতিভার এই মূল্যায়ন আজ আর কল্পনাও করা যায় না।
সেই শৈশব থেকে তাঁর ছবি আঁকার ঝোঁক। বাড়িতেও ছিল বিপুল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ। গানে চর্চা, অভিনয়ের চর্চা, চিত্রশিল্পের চর্চা আর শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডার আয়োজন- এসব ছিল তখনকার ঠাকুরবাড়ির নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ। পুরো বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মিলনমেলা যেন অনুষ্ঠিত হতো ওই ঠাকুরবাড়িতে। আর সেই বিপুল প্রাণপ্রবাহ থেকে রবীন্দ্রনাথের পরে সব চেয়ে বেশি রস যিনি আহরণ করেছেন তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন অবনঠাকুর। কি চিত্রকলা, কি সংগীত কি কথাসাহিত্য ও গদ্যসাহিত্য- সর্বত্রই সোনা ফলিয়েছেন তিনি। তাঁর এই মহৎ সৃষ্টির পটভূমিতে ছিল জীবন ও জগতের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ। ফলে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হওয়া মানেই হলো আনন্দের সঙ্গে, রসের সঙ্গে, সুন্দরের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। তাঁর সৃষ্টির সর্বত্রই বহু রঙের আলোর ফোয়ারা। বহু কৌণিক প্রিজমের মতো তার সকল সৃষ্টি থেকে চারদিকে ঠিকরে পরে অফুরন্ত আলো। সেই আলোয় আমরা আলোকিত হতে পারি, রাঙিয়ে নিতে পারি আমাদের মন ও মননের জগৎ। তাঁর কলজয়ীর সৃষ্টিশীল প্রতিভার স্পর্শে লুপ্তপ্রায় ভারতীয় শিল্পকলা সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল নতুন নতুন সম্ভাবনায়। রবীন্দ্রনাথের খুব নেওটা ছিলেন অবনঠাকুর। সারাক্ষণ তাঁর কাছে কাছেই থাকতেন। ‘রবিকা’ নামে অজ্ঞান ছিলেন এই ভ্রতুষ্পুটি। সব ধরনের প্রেরণাও পেয়েছেন কাকার কাছ থেকেই। বিশেষ করে লেখালেখির উৎসাহদাতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়িতে শখের গড়া নাট্যদল ‘খামখেয়ালি’তে তখন নিয়ম ছিল সভ্যদের নিয়মিত নিজের লেখা নাটক, প্রবন্ধ কিংবা অন্য যে কোনো লেখা পড়তে হবে। সেখানেই অবনীন্দ্রনাথ প্রথম পড়েছিলেন ‘দেবীপ্রতিমা’ নামে একটি গল্প। আর ওই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর ভেতরে যে লুকিয়ে ছিল একজন প্রতিভাধর কথাশিল্পী, তার খোঁজ পান পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রায়ই বলতেন, “অবন, তোমার লেখাটি কিন্তু বেশ হয়েছিল।” এই আশীর্বাদটুকু অবনঠাকুরের জন্য দেবতার বর। আর “ছবি লিখিয়ে অবনঠাকুর” মনেপ্রাণে হয়ে ওঠেন কথাশিল্পের রসের কারবারি। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল, নালক, রাজকাহিনী, আপনকথা, ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ, ঘরোয়া, জোড়াসাঁকোর ধারে নামক এক একটি রসের ফোয়ারা। ওই গদ্যও যেন ছবিরই আরেক পরত। গদ্য এতটা চিত্রময় হয়ে উঠতে পারে, রূপ আর রূপকল্পে এতটা সমৃদ্ধ ও প্রগাঢ় হয়ে উঠতে পারে অবনঠাকুরের আগে তাকি কেউ ভাবতে পেরেছে! আর চিত্রকলার রসের জগৎ নিয়ে, রূপত্ত্ব নিয়ে তিনি যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন ভূ-ভারতে তার কোনো দ্বিতীয় নজির নেই। শিল্পকে এমনভাবে বোঝার, অনুভব করার, বোঝানোর, অনুভব করানোর শক্তি মনে হয় ঈশ^র সবাইকে দেন না। বাগীশ^রী শিল্প প্রবন্ধাবলী গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধের মধ্যে অবনঠাকুরের এই অসাধারণ শক্তিমত্তার পরিচয় আছে। এইসব প্রবন্ধে পা-িত্যের সঙ্গে মিশেছে মমত্ববোধ, গভীর জীবনদর্শন, অসাধারণ প্রজ্ঞা, বিস্ময়কর বিনয়বোধ। আর যে ভাষায় তিনি এই রসের জগৎ তুলে ধরেছেন ওই ভাষা কবিতার, সংগীতের, দর্শনের, প্রেমের, রসের। শিল্পবিচারে, শিল্পের স্বরূপ উন্মোচনে এমন ভাষার খোঁজ কী করে তিনি পেলেন তাও এক অন্বেষার বিষয়। সব মিলিয়ে তাঁর লেখার পরিমাণ বেশি নয়, ২৬-২৭ খানি বই। রবীন্দ্রনাথের তুলনায় অতি সামান্য। লীলা মজুমদার বলেছিলেন, “এ যেন কবিগুরুর কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশে পাথরের ঢিবি। কিন্তু পাথর এত ঝকঝকে, তার ভিতর থেকে এমনি আলো ঠিকরোয় যে, মন বলে হীরে নয় তো?”
‘রবিকা’কে যেমন খুব ভালোবাসতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তেমনি রবীন্দ্রনাথও এই ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে সবচেয়ে ভাল বুঝতেন। কি প্রখর প্রতিভাধর যে এই মানুষটি তার খোঁজ রাখতেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে সব কাজেই প্রেরণা যোগাতেন, লিখতে তাড়া দিতেন। অবনও পদে পদে রবিকার কথা শুনে চলতেন। কিন্তু কখনোই তাঁর কাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুব বেশি লেখেননি তিনি। কিন্তু ওই অল্প লেখার মধ্যে যে জগৎ তিনি তৈরি করেছেন তার বর্ণে বর্ণে অবনঠাকুরের রূপ-রং-রেখা প্রবলভাবে উচ্চকিত।
ছেলেবেলায় অবনীন্দ্রনাথকে বলা হতো বোম্বেটে। ভীষণ দুষ্টুমির জন্য এই উপাধি। রবীন্দ্রনাথ বলতেন পাগলা। ভীষণ দুরন্ত ছিলেন। দস্যিপনায় তাঁর কোনো তুলনা চলত না। বাবা গুণেন্দ্রনাথের বহু শখের মধ্যে ছিল এ্যাকোরিয়ামে নানা রঙের মাছ সংরক্ষণ। অবনঠাকুর ভাবলেন, রঙিন মাছগুলোর রঙিন জলের মধ্যেই থাকা উচিত। দেখাবেও সুন্দর। সুতরাং লাল রং মিশিয়ে দিলেন এ্যাকোরিয়ারে জলের সঙ্গে। দু মিনিটের মধ্যে লাল-নীল মাছগুলো মরে ভেসে উঠছে। বুড়ো দারোয়ানের দাড়িতে হাত দিয়ে দেখতে গেছেন কেমন লাগে। কিন্তু বকুনি খেয়ে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল। বাড়ির পোষা পাখির খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিয়েছেন সব পাখি। বাটালি দিয়ে গোপনে কাঠের কাজ করতে গিয়ে আঙ্গুল কেটে ফেলেছেন। রক্তারক্তি অবস্থা। সেই কাটার দাগ বহন করতে হয়েছে সারা জীবন।
কিন্তু এই দুষ্টুমি তার মধ্যে কোথাও রুক্ষতা ছিল না, উন্মত্ততা ছিল না। ছিল ¯িœগ্ধতা। সর্বত্রই ছিল নিজের মতো করে ভাবনার পরিচয়। সবকিছুর মধ্যে নিজেকে খোঁজা, নিজেকে আবিষ্কার করা। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল প্রতিভা তাঁকে সর্বদাই মুগ্ধ করত। তাঁর সঙ্গ উপভোগ করতেন। নাটকের দল গড়বেন, আছেন রবীন্দনাথ- শিল্প নির্দেশনায়, মঞ্চসজ্জায় কাজ করেছেন দুজনে মিলিয়ে। ড্রামাটিক ক্লাব করতে হবে। সেখানেও ওই রবীন্দ্রনাথ। এরপর নানা কারণে সেটি উঠে গেলে জমানো চাদার টাকায় ড্রামাটিক ক্লাবের তিরোধানে আয়োজন করেন শ্রাদ্ধের। যেনতেন শ্রাদ্ধ নয়- নামি হোটেলে এলাহি ভোজের আয়োজন করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন। ভেতরে ভেতরে কী যে রসিক মানুষ ছিলেন অবনঠাকুর তার পরিচয় মুদ্রিত আছে এইসব ঘটনার মধ্যে। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “রবিকা বলতেন অবন একটা পাগল। সে কথা সত্যি। রবিকা যে বৈকুণ্ঠের খাতায় তিন কড়ির মুখ দিয়ে আমায় বলিয়েছেন, জন্মে অবধি আমার জন্যে কেউ ভাবেনি। আমিও কারো জন্য ভাবতে শিখিনি। এই হচ্ছে আমার সত্যিকারের রূপ। রবিকা আমাকে ঠিক ধরেছিলেন। আমি নিজের মনে নিজে থাকতেই ভালবাসি।” অবনঠাকুরের এই বক্তব্যের মধ্যে বিনয় আছে কিন্তু সঠিকতা নেই। তিনি নিজেকে নিয়ে যতনা ভাবতেন তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবতেন পরিবার-পরিজনদের নিয়ে, কাছেপিঠের মানুষদের নিয়ে, পরিচিতজনদের নিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে। মমতারসের একটি মিষ্টি আলোয় তাঁর হৃদয় ছিল পরিপূর্ণ। বড় মেয়ে উমাদেবী বাবার কথা নামক বইতে লিখেছেন, তিনি যেমন স্নেহশীল বাবা, তেমনি কর্তব্যপরায়ণ সন্তান, পত্নীগতপ্রাণ স্বামী এবং পরিবার-পরিজন সকলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা মস্ত বড় মনের একজন মানুষ। কেউ যে কোনো বিপদে-আপদে- সে বাড়ির দাস-দাসী, আমলা-সরকার, আত্মীয়-পরিজন যেই হোন না কেন, সবার আগে তিনিই গিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। মেয়ে উমাকে বলেছিলেন, “জানিস, কোথা থেকে না আমন্ত্রণ পেয়েছি। দিল্লি, লাহোর, জয়পুর, বম্বে, মাদ্রাজ, মহীশূর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, চীন সব জায়গা থেকে আমায় ডেকেছে। কেন যাইনি জানিস? তোর মাকে একলা রেখে যেতে হবে বলে। বড়ো ভীতু ছিল সে।” এই মানুষটি শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবেন তা কিছুতেই হতে পারে না। কত বিখ্যাত মানুষ ছিলেন তিনি। দেশে-বিদেশে কত যে তাঁর পরিচয়। পৃথিবীখ্যাত শিল্পী, উস্তাদ সারিঙ্গী বাদক, খ্যাতিমান অভিনেতা, বিখ্যাত শিল্পতাত্ত্বিক, অসম্ভব জনপ্রিয় শিক্ষক। সেই মানুষটি শুধু স্ত্রীর মঙ্গলের কথা ভেবে দেশ-বিদেশের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করছেন। তখন মনে হয় আমাদের ঘরের আটপৌরে চেনা মানুষটি, একান্তই ছাপোষা এক অতি সাধারণ বাঙালি।
কলকাতায় তখন প্লেগ মহামারির আকার নিয়েছে। আদরের ছোট মেয়েটি প্লেগে আক্রন্ত হয়ে চলে গেল চিরদিনের জন্য। কী যে শোক, আহা! কিন্তু নিজের সেই শোক লুকিয়ে রেখে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলেন স্ত্রীর প্রতি। সন্তান হারানো শোকে পাগলপ্রায় স্ত্রীর মন ভুলিয়ে রাখবার জন্য তাঁকে অনেক রকম পাখি কিনে দিতেন অবনীন্দ্রনাথ। বাচ্চা টিয়া, চন্দনা, ময়না- কত পাখি! পাখিগুলোকে খুব যতœ করে বড় করতেন। রুটিন করে খেতে দিতেন মুসুর ডাল সিদ্ধ, ছাতু এবং আরও কত কী। এর পর ওরা যখন খেতে শিখত, ডানা মেলে উড়তে পারত, তখন আকাশে উড়িয়ে দিতেন। কোনো পাখির অসুখ হলে বইপত্র ঘেঁটে ওষুধ বার করতেন। নিজে ওষুধ বানাতেন এবং পাখিদের খাইয়ে সুস্থ করে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু যখন দেখতেন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং তাঁর আর কিছুই করার নেই তখন ওই মুমূর্ষু পাখি সামনে নিয়ে অসহায়ের মতো নির্বাক বসে থাকতেন।
পরিবার ছেড়ে যদি তাঁর ছাত্রদের দিকে তাকাই, সেখানেও দেখব একই কা-। প্রিয় শিষ্য নন্দলাল বসু- পরে বিশ^জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি একবার ‘উমার তপস্যা’ নামে একটি ছবি এঁকে এনে দেখালেন গুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ছবি দেখে অবনঠাকুর বললেন, “রং এত কম কেন? আর কিছু না করো উমাকে একটু চন্দন, ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দাও।”
শিষ্য ফিরে গেলেন। গুরুর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে ছবিটিতে। এদিকে সারারাত ঘুম নেই অবনঠাকুরের চোখে। কেন তিনি নন্দকে ও কথা বলতে গেলেন? উমাকে ও যেভাবে দেখেছে, যেভাবে ভেবেছে সেভাবেই তো আঁকবে। তাঁর চোখ দিয়ে ছাত্রকে কেন তিনি দেখতে বলবেন? আর তপস্যায় বিভোর উমা কেনই বা চন্দন ফুলে সাজবে? এইসব ভেবে ভেবে গুরু সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোর হতেই ছুটলেন ছাত্রের ঘরে। ছাত্র নন্দলাল তখন সেই ছবিখানি সামনে রেখে উমাকে নতুন করে সাজানোর জন্য রং তুলি হাতে নিয়ে ভাবছিলেন। এমন সময়, “আহা করো কী করো কী নন্দ, থামো থামো। তোমার উমা ঠিকই আছে। আর হাত লাগিয়ো না। আর একটু হলেই ভালো ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিলুম আর কী!” এই হলেন শিক্ষক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিক্ষকতা নিয়ে প্রশিক্ষণের যুগ তখন ছিল না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি সহজাত মমত্ববোধ থেকে বুঝতে পারতেন যে, ওদেরকে নিজের মতো করে কাজ করতে দেওয়া দরকার। না হলে ওদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিকশিত হবে না। আর ছাত্রের কাছে নিজের ভুলি স্বীকার করার মাধ্যমে যে মাহাত্ম্যের পরিচয় দিয়েছেন তা ছাত্রের জন্যও ছিল এক ধরনের শিক্ষা।
শুধু নন্দলাল বসুকে নয়, নিজ হাতে শিখিয়েছেন যামিনী রায়কেও। পরে তাঁরা কত বড় শিল্পী হয়েছেন তা আমরা জানি। মেয়ে উমা একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “বাবা, তুমি এত ছবি আঁকো, এগজিবিশনে দাও না কেন?” তাঁর উত্তর ছিল, “ওরে, আমার ছবি দিলে ছাত্রদের ছবি বিক্রি হবে না যে।” আজকে আর এই মাহাত্ম্য চিন্তাও করা যায় না। ছাত্ররা পরিচিত হবে, খ্যাত হবে এই আকাক্সক্ষা থেকেই তিনি ছাত্রদের কাজগুলোকে লোকসম্মুখে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এ যেন ছাত্রদের কাজের ভেতরে দিয়ে নিজেকেই উন্মোচন করা, সন্তানের ভেতর দিয়ে নিজেকেই রেখে যাওয়া।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট। নিরন্তর উত্তরপুরুষদের সমৃদ্ধ করতে হবে স্বদেশের অসামান্য শিল্প-ঐতিহ্যে। তাই সারা দেশ থেকে প্রাচ্যের শিল্প নিদর্শনের নানা নমুনা খুঁজে খুঁজে বের করেছেন তিনি। তৈরি করেছেন বিপুল এক সংগ্রহশালা। সেই অন্বেষণে তাঁর নিষ্ঠা, সততা, শ্রম ও নৈপুণ্য দেখে অবাক হয়েছেন সহকর্মীরা। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়েরর পৃষ্ঠপোষকতা এবং উৎসাহে চেষ্টা চালিয়েছেন দেশীয় ছবিকে সাধারণ মানুষের মাঝেও পরিচিত করে তুলতে। শেষ জীবনে মেতেছিলেন নিজের উদ্ভাবিত আরেক শিল্পসাধনায়। নাম তার কাটুম কুটুম। এই পদ্ধতি অনেকটা কোলাজ পদ্ধতির মতোই। বাতিল ও ফেলে দেওয়া জিনিসপত্রের টুকরো, ভাঙা কাঠের টুকরো, গাছের ছাল, শুকনো ডাল, গাছের গুঁড়ি, শাখা-প্রশাখা, শিকড়, বাঁশের গাঁট ইত্যাদির মাধ্যমে বস্তু ও প্রাণীর অবয়ব তুলে ধরাই ছিল তাঁর কাটুম কুটুমের জগৎ। সেই জগতেই তিনি নিবিষ্ট থেকেছেন সুর ও ছন্দের সাধনায়; তাল, লয় ও ঐক্যের সাধনায়। বাঁশের গাঁট থেকে উড়ন্ত পাখি, গাছের শাখা-প্রশাখা থেকে চপ্পল হরিণ এবং গাছের বাকল, সুপারির খোসা, নারকেলের ছোবড়া, আমের আঁটি, তালের আঁটি, নারকেলের মালা, পাথরের টুকরো, দড়ি ইত্যাদি থেকে গিরগিটি, কুকুর, বেড়াল, মাছ, প্রজাপতি ইত্যাদি তৈরি করতেন তিনি আর তাদের নামও দিতেন। শিল্পের নতুন এক জগৎ তিনি তৈরি করেন, যে ধারা আজও অব্যাহত আছে।
ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে নাটক করার ঐতিহ্য আরও পুরোনো। এইসব ঘরোয়া নাটকে বরাবরই দাপুটে অভিনয় করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পছন্দ করতেন কমিক চরিত্র। ওই ধরনের চরিত্রের ভেতর দিয়ে তিনি রসের যোগান দিতে পারতেন সাফল্যের সঙ্গে। চারপাশের লোকজনদের তিনি দেখতেন মমত্বের সঙ্গে, দেখতেন শিল্পীচোখের তন্ময়তায়। আর পোশাকআশাকে, কথা বলবার ধরনে, অভিন-নৈপুণ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলতে চাইতেন ওইসব মানুষের আকাক্সক্ষার গড়নটিকে। তিনি বলতেন, “শখের আবার ঠিক বা ভুল রাস্তা কী! এর কি আর নিয়মকানুন আছে? আপনিই সে বেরিয়ে আসে, পথ করে নেয়। যার ভিতরে শখ নেই, তাকে ও কথা বুঝিয়ে বলা যায় না। ছবিও তাই, টেকনিক, স্টাইল ওসব কিছু নয়। আসল কথা হচ্ছে ওই ভেতরের শখ। আমার বাজনার বেলাতেও হয়েছিল তাই।”
শখ মানে ভালো লাগার বিষয়। শখ যদি না-ই থাকল, ভালো যদি না-ই লাগল তবে কিসের টেকনিক, কিসের স্টাইল। অবনঠাকুর সারাটা জীবন এঁকেছেন, লিখেছেন, গেয়েছেন তার সবটুকু ভালো লাগা থেকে। ভালো লাগেনি তো করেননি। জোড় করে লেগে থেকে ভালো লাগাতে চাননি কখনোই। ঠাকুরবাড়িব সদস্যদের শখ আর শৌখিনতা ছিল একেবারে মজ্জাগত। কিন্তু সেই শখ ও শৌখিনতা সে সময়ের জমিদারপুত্রেদের মতো পায়রা ওড়ানো, দামি পাথর সংগ্রহ, দুর্লভ ছবি বা মূর্তি সংগ্রহ, দেশি-বিদেশি পশুপাখি পোষা এবং আরও অসংখ্য উদ্ভট বিলাস-ব্যসনের মধ্যে জীবনযাপন করা। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের তেমন অরুচিকর ও স্থ’ল শখ কারোরই ছিল না। তাদের শখ ছিল শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে। অবনঠাকুরের শৈশবে শখ ছিল এস্রাজ বাজানো, অভিনয়, শিল্পরচর্চা, সাহিত্যচর্চা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল্য দিয়েছেন নিজের ভালো লাগার প্রতি। চেষ্টা করে ক্যাতিমান হতে হবে এই দূরাকাক্সক্ষা তাঁর কখনোই ছিল না। ফলে যা কিছু করেছেন তার পেছনে ছিল ভালোবাসা, প্রাণের তাগিদ, গভীর মমত্ববোধ। এবং এ জন্যই বুঝি তাঁর বিচিত্র কর্মের মূল সুর যেন ধ্বনিত হয় কোনো এক একতারর তার থেকে। গান, অভিনয়, চিত্রশিল্প, সাহিত্য- একটি থেকে আরেকটি কত ফারাক, কিন্তু অবনঠাকুরের বিচিত্র এই কর্মের ভেতরগত আবেদন যেন অভিন্ন; সুর, তাল, লয়, রং, রেখা- সব যেন একই উৎস থেকে বিকশিত হওয়া।