alt

সাময়িকী

একজীবন কবিতার সঙ্গে মহাদেব সাহা

রাহাত রাব্বানী

: শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১

মহাদেব সাহা / জন্ম : ৫ আগস্ট ১৯৪৪

ষাটের দশক বাংলা কবিতার মূল্যবান দশক। ষাট যেন কবিদের উপচে পড়া দশক। কবিতা উৎপাদনেরও। দুই পর্বে ষাটের দশকে বাংলা কবিতার একটা অন্য রকম ইতিহাস রচনা হয়। একঝাঁক নতুন কবি কল্লোলিত করে তোলে বাংলা কবিতাকে। এই কবিতা আগের মতো নয়, একেবারেই অন্য রকম ঘ্রাণ। যা পাঠককে শিহরিত করে, অভিভূত করে। প্রথম পর্বে যারা এলেন ‘গতানুগতিক জীবনের নিরাপত্তা ফেলে এক সামগ্রিক সর্বনাশের দিকে তারা নতজানু।’ তবে দ্বিতীয় পর্বের লেখকরা ‘আগাপাশতলা অবক্ষয়ী’ নয়।

ষাটের লেখকেরা প্রায় পুরোপুরি যখন দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন, ‘শেষ বাসের যাত্রী’ হয়ে আসেন সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি মহাদেব সাহা। উত্তাল ষাটের কবি হলেও চিন্তায় ছিলেন অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা।

দ্বিতীয় পর্বের কবিদের মধ্যে সহজ ভাষায়, সূক্ষ্ম হৃদয়ানুভূতির ঋজু প্রকাশভঙ্গিতে মহাদেব সাহা জয় করেছেন অগণিত পাঠক হৃদয়। দুর্বোধ্যতার অজুহাতে যখন পাঠক কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তখন মহাদেব তাঁর কাব্যের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশুষ্ক ও বিশীর্ণ কাব্যধারায় ফিরিয়ে আনেন বর্ষণের ধারা।

সত্তরের দশকে প্রথম গ্রন্থ ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’ প্রকাশ পেলেও লেখালেখির শুরু ষাটের শুরুতেই। মাত্র ছয়-সাত মাসের ব্যবধানে বাজারে আসে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ। মহাদেব সাহার এই গ্রন্থের নামকরণ থেকেই কবির পরিচয় পাওয়া যায় অনেকটা। কবিতাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান; একমাত্র আরাধনা: “এই কবিতার জন্যে খোয়ালাম পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি/ যা কিছু সম্বল কানাকড়ি।”

জীবনের গোধূলিতে দাঁড়িয়ে ধ্যানমগ্ন এই কবি মোহনীয় ভাষায় আমাদের নিবিড় জীবনভাষ্য লিখে চলছেন এখনো। ছয় দশকের অধিক সময় ধরে বাংলা কবিতাকে করে চলছেন সমৃদ্ধ। এখনো তাকিয়ে আছেন পথের দিকে, নির্লিপ্ত; কখনো বিষণ্ন ও অভিমানী, কখনো হাস্যোজ্জ্বল। কিন্তু সর্বদাই ভালোবাসায় নত।

মহাদেব সাহার কবিতায় যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চিরপরিচিত জীবন, তেমনি উন্মোচিত হয়েছে এক অজানা রহস্যের জগৎ। এই বোধ ও অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন নিজেকে ক্ষয় করে। সে জন্যই এই আত্মোন্মচন এতো প্রখর

বিশুদ্ধ আবেগে উৎসারিত মহাদেব সাহার প্রেমের কবিতা। তাঁর কবিতায় যে প্রেম, তা কামগন্ধহীন ভালোবাসা। অন্তর্লীন বেদনাবোধকে প্রধান আকর্ষণ করে বিচিত্র জীবনানুভূতির অনুপম কাব্যস্রষ্টা তিনি। তাঁর কবিতায় অবারিতভাবে উঠে এসেছে বাংলার শাশ্বত প্রকৃতি। মানব-মানবীর জীবনরহস্যের সবচেয়ে গাঢ় ও সংবেদনশীল রূপটিও উদঘাটিত হয় তার কবিতায়। প্রসঙ্গতই উল্লেখ করা যায়: “একটা স্পর্শকাতর যৌবন রয়েছে মহাদেবের মধ্যে। চাঁদ, ফুল, প্রকৃতি, দেশ, নারী- এসব সুকুমার জিনিসের সাথে অনুভূতিশীল মনের স্নিগ্ধ সমাহারে যেন ওর কবিতাগুলো তৈরি। তবে যে-শব্দটি নিয়তির মতো ওর সারাজীবনকে অধিকার করে রেখেছে তা হলো ‘প্রেম’। ভালোবাসার জন্য একটা অভিমানী মৃদু আহত কাতরতায় ওর কবিতা বিষণ্ন।... ওর প্রেমের এই কাতরতা অসংখ্য পাঠকের মন ছুঁয়েছে।

অস্ফুটে
আরণ্যক শামছ

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি

মনভাঙা ঝড়ে হবে জামরুল গাছ,

টুঁটি ধরে এনে দেবো ‘জয় গোস্বামী’,

ভুল পথে হেঁটে যাবো দীর্ঘ বারো-মাস।

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি

চেনা অক্ষরে লেখো খামের ঠিকানা,

সময়ের স্মৃতিপটে হয়ে যাবো মমি

নিথর নিভৃত এক গোপন অজানা।

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি

এনে দাও মেঘে ঢাকা আধখানা চাঁদ,

আমৃত্যু গোপন করে রেখে যাবো আমি,

নিজের স্বযত্নে গড়া মৃত্যুর ফাঁদ।

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি,

হয়ে থাকো বিস্মৃতির বিমল-বিনাশ,

বাংলার মহাদেব সাহা হবো আমি

তোমার বৈরাগ্য ঘেরা ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’।

আশির, বিশেষ করে নব্বই দশকের দিকে এসে ওর কবিতা অসম্ভব পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই জনপ্রিয়তা ঐ সময়কার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের কথা স্মরণ করায়।” [ভালোবাসার সাম্পান/ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।]

জন কিটস মহাদেব সাহার প্রিয় কবিদের অন্যতম। তাঁর কবিতা যেন স্বর্গলোকের গান, স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের মিলিত শিল্পকলা। জীবনের বিষাদ, কষ্ট অনুধাবন করে Ode to a nightangle এ বলেছেন: My heart aches and a drowsy numbness pains /My sense; as though of hemlock I had drunk.

কিটসের কবিতা, জীবন, তাঁর করুণ মৃত্যু মহাদেবকে আলোড়িত করে। তাঁর বেদনাহত জীবনের কথা ভেবে ব্যথিত হন। এই বেদনাবোধ মহাদেব সাহার কবিতায় প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে; আছে কাতরতা। সব মানুষেরই না-পাওয়ার বেদনাবোধ থাকে। এই বেদনাবোধ থেকেই হতে পারে কবিতার বিষয়। মহাদেব সাহার প্রেমের কবিতার গভীরেও এক ধরনের বিষাদ আছে। আমাদের সব প্রাপ্তি, প্রতিষ্ঠা, সুখ সবই তাৎক্ষণিক। পর মুহূর্তে তা না পাওয়ায় পরিণত হয়। একজন কবিকে তা জানতে হয় বলেই তার গভীরে দুঃখবোধ থাকে। সবার মনেই না পাওয়া আছে। একটা ‘তুমি’ আছে। সেই ‘তুমি’কে খোঁজেন মহাদেব সাহা। একার ‘তুমি’ নয়, যে ‘তুমি’কে পেলে জীবন একেবারে সম্পূর্ণ হয়, কবিতাময় হয়। সেই পরিশুদ্ধ ব্যখ্যাতীত ‘তুমি’ই মহাদেব সাহার কবিতাজুড়ে:

“তোমার সাথে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি গোপন কটাক্ষই/ অনিঃশেষ বসন্তকাল”

কবিতাপাঠক মাত্রই জানেন, চিঠি মহাদেবের প্রিয় প্রসঙ্গ। আজকের আধুনিক প্রযুক্তি যদিও চিঠির জায়গাটা দখল করে নিয়েছে, তবুও চিঠি, পোস্ট অফিস মহাদেব সাহাকে আচ্ছন্ন করে, নস্টালজিক করে। তার চিঠি বিষয়ক কবিতার তালিকা দীর্ঘ। প্রেমিকার কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার ব্যাকুলতা নিয়ে মহাদেব সাহার বিখ্যাত একটি প্রেমের কবিতা ‘চিঠি দিও’- “করুণা করে হলেও চিঠি দিও খামে ভরে তুলে দিও/ আঙুরের মিহিন সেলাই/ ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,/ এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও।”

মহাদেব সাহা সৌন্দর্য সচেতন কবি। সুন্দরের প্রকাশে তাঁর কবিতায় এসেছে প্রেম ও প্রকৃতি। প্রেম ও প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পান জীবনের অন্যরকম মাদকতা। প্রেম ও প্রকৃতি মানুষের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী প্রকৃতিরই অন্যতম শৈল্পিক উপাদান। দু’টোর মাঝেই সৌন্দর্য আছে, আকর্ষণ আছে। নারীর মুখের শিল্পে অপার মুগ্ধতা খুঁজে পান মহাদেব সাহা। প্রাবন্ধিক মানবর্দ্ধন পাল অবশ্য তার কবিতার বিষয় সম্বন্ধে তিন ‘ন’- এর কথা বলেছেন; নদী, নারী, নিসর্গ।

“নারীমন্ত্র ছাড়া আমি আর অন্য কোনো মন্ত্র জানি না

নারীচিত্র ছাড়া অন্য কোনো চিত্র আমি চোখেই দেখি না,

আজীবন নারীতে আচ্ছন্ন হয়ে আছি

নারী বৃক্ষ, নারী নদী, নারী এই বেঁচে থাকা”

নারী প্রেমের চেয়ে মানবপ্রেম কখনো কখনো সবকিছুকে ছাপিয়ে কবিসত্তাকে মহিমান্বিত করে। জুঁইফুলের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়ে ওঠে সাদা ভাত। জীবনের উপলব্ধি থেকে কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন মহাদেব সাহা। তাঁর কবিতা ‘উইজডম’, নলেজ নয়। কবিতার জন্য বারবার ফিরে যান প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে। শুধু নলেজের মধ্য দিয়ে নয়, প্রজ্ঞার উপলব্ধিই মহাদেবের কবিতার উপকরণ:

“এতো হৃদয় সম্পন্ন কোনো নিবিড় বকুল/ আমি পাইনি কোথাও/ এমন বেদনা শুধু দেখেছি তো মানুষেরই বুকে/ দুঃখে সুখে তাই বারবার ফিরে যাই মানুষের কাছে।”

নিঃসঙ্গ মানুষের ভয়াবহ একাকীত্বের বেদনা, তার অন্তর্জগতের ছবি প্রকাশ পেয়েছে মহাদেব সাহার কবিতাবলীতে। মানুষ জানে না কোথায় যাবে, কোথায় তার দুঃখ-তাপ থেকে একটু শান্তি, একটু আশ্রয়; সে শুধু এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছোটে, ছায়া পায় না, ভালোবাসা পায় না, অসহায় কাতর মানুষের করুণ জিজ্ঞাসা, কোথায় যাই কার কাছে যাই: “এই সর্বত্র তালা-লাগানো শহরে/ এই নিঃসঙ্গ সাইকেলে চেপে অবিরাম বেল বাজাতে বাজাতে/ বলো আমি কোথায় যাই, কার কাছে যাই,/ কোন নরকে যাই!”

আবার মানুষের জীবনে অতীত কোনো অতীত নয় সততই বর্তমান। যে কোনো মুহূর্তে সে উপস্থিত হয়, মধুর, ভয়ঙ্কর; এই অভিজ্ঞতা মানব জীবনের এক নিদারুণ সত্য স্মৃতি তাই সুখেরও, দুঃখেরও। বোধহয় দুঃখেরই অধিক; কবি তাই আশ্রয় খোঁজেন অদৃশ্য বিস্মৃতিতে; এ এক সম্পূর্ণ পৃথক উপলব্ধি, স্বতন্ত্র অনুসন্ধান:

“ভুলে যাও কাকে কী দিয়েছ কথা, কোথায় কী প্রতিজ্ঞা করেছ/ রুমাল নিয়েছ কার, কার হাতে দিয়েছ গোলাপ,/ এই সব গন্ধ-স্পর্শ মনে রাখবার মতো কিছু নয়।”

সব মানুষই সযতেœ গোপন একটি স্বপ্ন তার অন্তরে লালন করে। স্বপ্নটা হলো তার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টানো। আমূল বদলে ফেলতে চায় নিজেকে। হয়ে উঠতে চায় আরও শুদ্ধ, আরও সম্পূর্ণ। মানুষ তার এই স্বপ্নের ভেতর জীবনের সাধ খুঁজে পায়।

“পুরোপুরি পাল্টে দাও আমার জীবন, আমি ফের/ গোড়া থেকে শুরু করি-/ একেবারে পরিশুদ্ধ মানুষের মতো করি আরম্ভ জীবন”

মহাদেব সাহার কবিতায় যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চিরপরিচিত জীবন, তেমনি উন্মোচিত হয়েছে এক অজানা রহস্যের জগৎ। এই বোধ ও অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন নিজেকে ক্ষয় করে। সে জন্যই এই আত্মোন্মোচন এতো প্রখর। নৈরাশ্যের মাঝেও জাগিয়ে রাখেন আশা ও প্রত্যয়। মানুষকে উন্নীত করেন মানবিক মৌলিক শুদ্ধতায়। যা একই সাথে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক।

“গোলাপের গায়ে কী গন্ধ, ময়লা কী পাপড়িতে/সুস্থতা কোথায় পাই এই নষ্ট জলে আর স্থলে / পরিশুদ্ধ কিছু নেই ফুলও দূষিত,/সুন্দরের গায়ে কী যে লেগেছে জঞ্জাল।”

মহাদেব সাহার কাব্যভাষা বিকেলের নরম রোদের মতো, রমণীয়। তিনি প্রতিবাদী তবে তা উচ্চকণ্ঠের বিদ্রোহ না। ষাটের কবিতায় রাজনীতির প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। মহাদেব সাহার কবিতার বিষয় হিসেবে রাজনীতি ধরা দিলেও তিনি সমসাময়িক কবিদের মতো রাজনীতিতে ডুবে যাননি। বরং শিল্পমাধুর্যে তা উপস্থাপন করেছেন। এদেশের সকল গণ-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে অসামান্য ব্যঞ্জনায়, যুক্ত হয়েছে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে; ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো তা ফুটে উঠেছে তার কবিতায়: “দেহ ছিন্ন, ম্লান মুখ/চোখ ঘিরে সন্ত্রাসের ঘাম/এই ঢাকা যুদ্ধরত।”

পঁচাত্তর বাঙালি জাতির জীবনে সর্ববৃহৎ কলঙ্কের কাল। বাঙালির হাজার বছরের অমূল্য অর্জন মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। জাতির জনকের সাথে সাথে যেন হত্যা করা হয় একটি মানচিত্র। “চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর /একজন বললো দেখো ভিতরে কী স্থির/ মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে”

অশ্রু, বেদনা, প্রতিবাদ ও শোকের এক ব্যঞ্জনাময় মর্মস্পর্শী শব্দভাষ্যে জাতির জনককে নিয়ে মহাদেব সাহা রচনা করেছেন অজস্র কবিতা। লিখেছেন ‘আত্মস্মৃতি ১৯৭৫: সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা’র মতো অনবদ্য গদ্য।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার কবিতা দিয়ে রচিত হয়েছে পোস্টার। বুকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে পুলিশ কর্তৃক নিহত হন নূর হোসেন। ‘আসাদের শার্ট’ যেমন আমাদের প্রাণের পতাকা, তেমনি ‘নূর হোসেন এই ইতিহাসের অমর অধ্যায়’। মহাদেব সাহা লেখেন: “আমি যদি আজ তোমাদের কোনো প্রিয় কবিতার কথা বলি,/ তাহলে সেই কবিতার নাম নূর হোসেন/

আহা নূর হোসেন আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা”

স্বৈরশাসক এরশাদকে উদ্দেশ্য করে মহাদেব সাহা কবিতায় সরাসরি এরশাদকে এই মানচিত্র ছেড়ে চলে যেতে বলেন। স্বৈরাচারবিরোধী সভায় ড. মিলনের মা ও স্ত্রীর সামনে মহাদেব সাহা পাঠ করেন সেই কবিতা: “বাংলাদেশ চায় না তোমাকে, তুমি চলে যাও, যাও/

কতো যে মায়ের খালি বুক ফেলে দীর্ঘশ্বাস-/ রক্তমাখা হাত, তুমি ক্ষমা চাও, ক্ষমা ভিক্ষা চাও।”

যুগের অসুখকে ধারণ করেও তিনি এক যুগোত্তরের স্বপ্ন দেখেন। জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার’ যখন নেমে এসেছে পৃথিবীতে; মহাদেব সাহা তখন পৃথিবীর দুঃখে ব্যাকুল, ব্যথিত : “পৃথিবীর দিকে আর তাকানো যায় না,/ বড়ো কষ্ট হয়”

একই সাথে পৃথিবীর দুঃখ মোচনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন কবিতায়- “...পৃথিবী, আবার তুমি সুখি হও, সঞ্জীবিত হও।”

এভাবে ক্রমাগত মহৎ কবিতার উপাদান ও বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ও ফলবান হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা, যা শেষ পর্যন্ত হয়ে বাংলা কবিতারই অমূল্য সম্পদ। কবিতার মতোই স্বাদু ও প্রাঞ্জল তার গদ্য; স্নিগ্ধ লাবণ্যময়।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অসীম মুগ্ধতা; কেবল কবি জীবনে নয়, সমগ্র ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্পষ্ট: “রবীন্দ্র-পরবর্তী বহু দশকের সাহিত্য ও দর্শনের প্রভাব আমার জীবনে, বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তির বহু রূপান্তর ও বিকাশ আমার মনোজগতকে আন্দোলিত ও আলোড়িত করেছে, বহু সামাজিক পরিবর্তনের অনিবার্য ঘটনাও প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে, চিন্তা ও মনোজগতের এই বিপুল পরিবর্তন সত্ত্বেও এখনো রবীন্দ্রনাথই আমার জীবনে সংর্বাধিক প্রাসঙ্গিক, ভাবনা ও চেতনার দিক থেকে এখনো আমরা অনেকেই রবীন্দ্রবিশ্বেরই মানুষ।”

রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার এই বর্ষা মহাদেব সাহার জন্মঋতু। তিনি বর্ষাকাতর, বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকেন, বৃষ্টির শব্দে শিউলি ঝরার শব্দ শুনতে পান, এই একেকটি বৃষ্টির ফোঁটা যেন সদ্য ফোটা ফুল, মাতাল বৃষ্টিতে ফিরে যান হারানো শৈশবে, ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে। “তোমার জন্য, কেবল তোমার জন্য বর্ষা,/ আমি কোটি কোটি বার জন্ম নিতে চাই, দুঃখ/ পেতে চাই, চোখের জলে ভাসতে চাই, তুমি/আমাকে ভাসিয়ে নাও আমিও অনন্তকালের বর্ষা,/ জন্মমৃত্যুর ওপার হতে তোমার মুখচ্ছবি দেখে আমি/ জেগে উঠি; বর্ষা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছ,/ ভরিয়ে দিয়েছ, তোমার জন্য কবে একটি ভালোবাসার/ পঙ্ক্তি লিখতে পারব, আর কবে?”

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

একজীবন কবিতার সঙ্গে মহাদেব সাহা

রাহাত রাব্বানী

মহাদেব সাহা / জন্ম : ৫ আগস্ট ১৯৪৪

শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১

ষাটের দশক বাংলা কবিতার মূল্যবান দশক। ষাট যেন কবিদের উপচে পড়া দশক। কবিতা উৎপাদনেরও। দুই পর্বে ষাটের দশকে বাংলা কবিতার একটা অন্য রকম ইতিহাস রচনা হয়। একঝাঁক নতুন কবি কল্লোলিত করে তোলে বাংলা কবিতাকে। এই কবিতা আগের মতো নয়, একেবারেই অন্য রকম ঘ্রাণ। যা পাঠককে শিহরিত করে, অভিভূত করে। প্রথম পর্বে যারা এলেন ‘গতানুগতিক জীবনের নিরাপত্তা ফেলে এক সামগ্রিক সর্বনাশের দিকে তারা নতজানু।’ তবে দ্বিতীয় পর্বের লেখকরা ‘আগাপাশতলা অবক্ষয়ী’ নয়।

ষাটের লেখকেরা প্রায় পুরোপুরি যখন দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন, ‘শেষ বাসের যাত্রী’ হয়ে আসেন সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি মহাদেব সাহা। উত্তাল ষাটের কবি হলেও চিন্তায় ছিলেন অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা।

দ্বিতীয় পর্বের কবিদের মধ্যে সহজ ভাষায়, সূক্ষ্ম হৃদয়ানুভূতির ঋজু প্রকাশভঙ্গিতে মহাদেব সাহা জয় করেছেন অগণিত পাঠক হৃদয়। দুর্বোধ্যতার অজুহাতে যখন পাঠক কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তখন মহাদেব তাঁর কাব্যের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশুষ্ক ও বিশীর্ণ কাব্যধারায় ফিরিয়ে আনেন বর্ষণের ধারা।

সত্তরের দশকে প্রথম গ্রন্থ ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’ প্রকাশ পেলেও লেখালেখির শুরু ষাটের শুরুতেই। মাত্র ছয়-সাত মাসের ব্যবধানে বাজারে আসে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ। মহাদেব সাহার এই গ্রন্থের নামকরণ থেকেই কবির পরিচয় পাওয়া যায় অনেকটা। কবিতাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান; একমাত্র আরাধনা: “এই কবিতার জন্যে খোয়ালাম পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি/ যা কিছু সম্বল কানাকড়ি।”

জীবনের গোধূলিতে দাঁড়িয়ে ধ্যানমগ্ন এই কবি মোহনীয় ভাষায় আমাদের নিবিড় জীবনভাষ্য লিখে চলছেন এখনো। ছয় দশকের অধিক সময় ধরে বাংলা কবিতাকে করে চলছেন সমৃদ্ধ। এখনো তাকিয়ে আছেন পথের দিকে, নির্লিপ্ত; কখনো বিষণ্ন ও অভিমানী, কখনো হাস্যোজ্জ্বল। কিন্তু সর্বদাই ভালোবাসায় নত।

মহাদেব সাহার কবিতায় যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চিরপরিচিত জীবন, তেমনি উন্মোচিত হয়েছে এক অজানা রহস্যের জগৎ। এই বোধ ও অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন নিজেকে ক্ষয় করে। সে জন্যই এই আত্মোন্মচন এতো প্রখর

বিশুদ্ধ আবেগে উৎসারিত মহাদেব সাহার প্রেমের কবিতা। তাঁর কবিতায় যে প্রেম, তা কামগন্ধহীন ভালোবাসা। অন্তর্লীন বেদনাবোধকে প্রধান আকর্ষণ করে বিচিত্র জীবনানুভূতির অনুপম কাব্যস্রষ্টা তিনি। তাঁর কবিতায় অবারিতভাবে উঠে এসেছে বাংলার শাশ্বত প্রকৃতি। মানব-মানবীর জীবনরহস্যের সবচেয়ে গাঢ় ও সংবেদনশীল রূপটিও উদঘাটিত হয় তার কবিতায়। প্রসঙ্গতই উল্লেখ করা যায়: “একটা স্পর্শকাতর যৌবন রয়েছে মহাদেবের মধ্যে। চাঁদ, ফুল, প্রকৃতি, দেশ, নারী- এসব সুকুমার জিনিসের সাথে অনুভূতিশীল মনের স্নিগ্ধ সমাহারে যেন ওর কবিতাগুলো তৈরি। তবে যে-শব্দটি নিয়তির মতো ওর সারাজীবনকে অধিকার করে রেখেছে তা হলো ‘প্রেম’। ভালোবাসার জন্য একটা অভিমানী মৃদু আহত কাতরতায় ওর কবিতা বিষণ্ন।... ওর প্রেমের এই কাতরতা অসংখ্য পাঠকের মন ছুঁয়েছে।

অস্ফুটে
আরণ্যক শামছ

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি

মনভাঙা ঝড়ে হবে জামরুল গাছ,

টুঁটি ধরে এনে দেবো ‘জয় গোস্বামী’,

ভুল পথে হেঁটে যাবো দীর্ঘ বারো-মাস।

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি

চেনা অক্ষরে লেখো খামের ঠিকানা,

সময়ের স্মৃতিপটে হয়ে যাবো মমি

নিথর নিভৃত এক গোপন অজানা।

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি

এনে দাও মেঘে ঢাকা আধখানা চাঁদ,

আমৃত্যু গোপন করে রেখে যাবো আমি,

নিজের স্বযত্নে গড়া মৃত্যুর ফাঁদ।

অস্ফুট হেসে শুধু একবার বলো তুমি,

হয়ে থাকো বিস্মৃতির বিমল-বিনাশ,

বাংলার মহাদেব সাহা হবো আমি

তোমার বৈরাগ্য ঘেরা ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’।

আশির, বিশেষ করে নব্বই দশকের দিকে এসে ওর কবিতা অসম্ভব পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই জনপ্রিয়তা ঐ সময়কার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের কথা স্মরণ করায়।” [ভালোবাসার সাম্পান/ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।]

জন কিটস মহাদেব সাহার প্রিয় কবিদের অন্যতম। তাঁর কবিতা যেন স্বর্গলোকের গান, স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের মিলিত শিল্পকলা। জীবনের বিষাদ, কষ্ট অনুধাবন করে Ode to a nightangle এ বলেছেন: My heart aches and a drowsy numbness pains /My sense; as though of hemlock I had drunk.

কিটসের কবিতা, জীবন, তাঁর করুণ মৃত্যু মহাদেবকে আলোড়িত করে। তাঁর বেদনাহত জীবনের কথা ভেবে ব্যথিত হন। এই বেদনাবোধ মহাদেব সাহার কবিতায় প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে; আছে কাতরতা। সব মানুষেরই না-পাওয়ার বেদনাবোধ থাকে। এই বেদনাবোধ থেকেই হতে পারে কবিতার বিষয়। মহাদেব সাহার প্রেমের কবিতার গভীরেও এক ধরনের বিষাদ আছে। আমাদের সব প্রাপ্তি, প্রতিষ্ঠা, সুখ সবই তাৎক্ষণিক। পর মুহূর্তে তা না পাওয়ায় পরিণত হয়। একজন কবিকে তা জানতে হয় বলেই তার গভীরে দুঃখবোধ থাকে। সবার মনেই না পাওয়া আছে। একটা ‘তুমি’ আছে। সেই ‘তুমি’কে খোঁজেন মহাদেব সাহা। একার ‘তুমি’ নয়, যে ‘তুমি’কে পেলে জীবন একেবারে সম্পূর্ণ হয়, কবিতাময় হয়। সেই পরিশুদ্ধ ব্যখ্যাতীত ‘তুমি’ই মহাদেব সাহার কবিতাজুড়ে:

“তোমার সাথে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি গোপন কটাক্ষই/ অনিঃশেষ বসন্তকাল”

কবিতাপাঠক মাত্রই জানেন, চিঠি মহাদেবের প্রিয় প্রসঙ্গ। আজকের আধুনিক প্রযুক্তি যদিও চিঠির জায়গাটা দখল করে নিয়েছে, তবুও চিঠি, পোস্ট অফিস মহাদেব সাহাকে আচ্ছন্ন করে, নস্টালজিক করে। তার চিঠি বিষয়ক কবিতার তালিকা দীর্ঘ। প্রেমিকার কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার ব্যাকুলতা নিয়ে মহাদেব সাহার বিখ্যাত একটি প্রেমের কবিতা ‘চিঠি দিও’- “করুণা করে হলেও চিঠি দিও খামে ভরে তুলে দিও/ আঙুরের মিহিন সেলাই/ ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,/ এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও।”

মহাদেব সাহা সৌন্দর্য সচেতন কবি। সুন্দরের প্রকাশে তাঁর কবিতায় এসেছে প্রেম ও প্রকৃতি। প্রেম ও প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পান জীবনের অন্যরকম মাদকতা। প্রেম ও প্রকৃতি মানুষের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী প্রকৃতিরই অন্যতম শৈল্পিক উপাদান। দু’টোর মাঝেই সৌন্দর্য আছে, আকর্ষণ আছে। নারীর মুখের শিল্পে অপার মুগ্ধতা খুঁজে পান মহাদেব সাহা। প্রাবন্ধিক মানবর্দ্ধন পাল অবশ্য তার কবিতার বিষয় সম্বন্ধে তিন ‘ন’- এর কথা বলেছেন; নদী, নারী, নিসর্গ।

“নারীমন্ত্র ছাড়া আমি আর অন্য কোনো মন্ত্র জানি না

নারীচিত্র ছাড়া অন্য কোনো চিত্র আমি চোখেই দেখি না,

আজীবন নারীতে আচ্ছন্ন হয়ে আছি

নারী বৃক্ষ, নারী নদী, নারী এই বেঁচে থাকা”

নারী প্রেমের চেয়ে মানবপ্রেম কখনো কখনো সবকিছুকে ছাপিয়ে কবিসত্তাকে মহিমান্বিত করে। জুঁইফুলের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়ে ওঠে সাদা ভাত। জীবনের উপলব্ধি থেকে কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন মহাদেব সাহা। তাঁর কবিতা ‘উইজডম’, নলেজ নয়। কবিতার জন্য বারবার ফিরে যান প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে। শুধু নলেজের মধ্য দিয়ে নয়, প্রজ্ঞার উপলব্ধিই মহাদেবের কবিতার উপকরণ:

“এতো হৃদয় সম্পন্ন কোনো নিবিড় বকুল/ আমি পাইনি কোথাও/ এমন বেদনা শুধু দেখেছি তো মানুষেরই বুকে/ দুঃখে সুখে তাই বারবার ফিরে যাই মানুষের কাছে।”

নিঃসঙ্গ মানুষের ভয়াবহ একাকীত্বের বেদনা, তার অন্তর্জগতের ছবি প্রকাশ পেয়েছে মহাদেব সাহার কবিতাবলীতে। মানুষ জানে না কোথায় যাবে, কোথায় তার দুঃখ-তাপ থেকে একটু শান্তি, একটু আশ্রয়; সে শুধু এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছোটে, ছায়া পায় না, ভালোবাসা পায় না, অসহায় কাতর মানুষের করুণ জিজ্ঞাসা, কোথায় যাই কার কাছে যাই: “এই সর্বত্র তালা-লাগানো শহরে/ এই নিঃসঙ্গ সাইকেলে চেপে অবিরাম বেল বাজাতে বাজাতে/ বলো আমি কোথায় যাই, কার কাছে যাই,/ কোন নরকে যাই!”

আবার মানুষের জীবনে অতীত কোনো অতীত নয় সততই বর্তমান। যে কোনো মুহূর্তে সে উপস্থিত হয়, মধুর, ভয়ঙ্কর; এই অভিজ্ঞতা মানব জীবনের এক নিদারুণ সত্য স্মৃতি তাই সুখেরও, দুঃখেরও। বোধহয় দুঃখেরই অধিক; কবি তাই আশ্রয় খোঁজেন অদৃশ্য বিস্মৃতিতে; এ এক সম্পূর্ণ পৃথক উপলব্ধি, স্বতন্ত্র অনুসন্ধান:

“ভুলে যাও কাকে কী দিয়েছ কথা, কোথায় কী প্রতিজ্ঞা করেছ/ রুমাল নিয়েছ কার, কার হাতে দিয়েছ গোলাপ,/ এই সব গন্ধ-স্পর্শ মনে রাখবার মতো কিছু নয়।”

সব মানুষই সযতেœ গোপন একটি স্বপ্ন তার অন্তরে লালন করে। স্বপ্নটা হলো তার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টানো। আমূল বদলে ফেলতে চায় নিজেকে। হয়ে উঠতে চায় আরও শুদ্ধ, আরও সম্পূর্ণ। মানুষ তার এই স্বপ্নের ভেতর জীবনের সাধ খুঁজে পায়।

“পুরোপুরি পাল্টে দাও আমার জীবন, আমি ফের/ গোড়া থেকে শুরু করি-/ একেবারে পরিশুদ্ধ মানুষের মতো করি আরম্ভ জীবন”

মহাদেব সাহার কবিতায় যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চিরপরিচিত জীবন, তেমনি উন্মোচিত হয়েছে এক অজানা রহস্যের জগৎ। এই বোধ ও অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন নিজেকে ক্ষয় করে। সে জন্যই এই আত্মোন্মোচন এতো প্রখর। নৈরাশ্যের মাঝেও জাগিয়ে রাখেন আশা ও প্রত্যয়। মানুষকে উন্নীত করেন মানবিক মৌলিক শুদ্ধতায়। যা একই সাথে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক।

“গোলাপের গায়ে কী গন্ধ, ময়লা কী পাপড়িতে/সুস্থতা কোথায় পাই এই নষ্ট জলে আর স্থলে / পরিশুদ্ধ কিছু নেই ফুলও দূষিত,/সুন্দরের গায়ে কী যে লেগেছে জঞ্জাল।”

মহাদেব সাহার কাব্যভাষা বিকেলের নরম রোদের মতো, রমণীয়। তিনি প্রতিবাদী তবে তা উচ্চকণ্ঠের বিদ্রোহ না। ষাটের কবিতায় রাজনীতির প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। মহাদেব সাহার কবিতার বিষয় হিসেবে রাজনীতি ধরা দিলেও তিনি সমসাময়িক কবিদের মতো রাজনীতিতে ডুবে যাননি। বরং শিল্পমাধুর্যে তা উপস্থাপন করেছেন। এদেশের সকল গণ-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে অসামান্য ব্যঞ্জনায়, যুক্ত হয়েছে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে; ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো তা ফুটে উঠেছে তার কবিতায়: “দেহ ছিন্ন, ম্লান মুখ/চোখ ঘিরে সন্ত্রাসের ঘাম/এই ঢাকা যুদ্ধরত।”

পঁচাত্তর বাঙালি জাতির জীবনে সর্ববৃহৎ কলঙ্কের কাল। বাঙালির হাজার বছরের অমূল্য অর্জন মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। জাতির জনকের সাথে সাথে যেন হত্যা করা হয় একটি মানচিত্র। “চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর /একজন বললো দেখো ভিতরে কী স্থির/ মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে”

অশ্রু, বেদনা, প্রতিবাদ ও শোকের এক ব্যঞ্জনাময় মর্মস্পর্শী শব্দভাষ্যে জাতির জনককে নিয়ে মহাদেব সাহা রচনা করেছেন অজস্র কবিতা। লিখেছেন ‘আত্মস্মৃতি ১৯৭৫: সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা’র মতো অনবদ্য গদ্য।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার কবিতা দিয়ে রচিত হয়েছে পোস্টার। বুকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে পুলিশ কর্তৃক নিহত হন নূর হোসেন। ‘আসাদের শার্ট’ যেমন আমাদের প্রাণের পতাকা, তেমনি ‘নূর হোসেন এই ইতিহাসের অমর অধ্যায়’। মহাদেব সাহা লেখেন: “আমি যদি আজ তোমাদের কোনো প্রিয় কবিতার কথা বলি,/ তাহলে সেই কবিতার নাম নূর হোসেন/

আহা নূর হোসেন আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা”

স্বৈরশাসক এরশাদকে উদ্দেশ্য করে মহাদেব সাহা কবিতায় সরাসরি এরশাদকে এই মানচিত্র ছেড়ে চলে যেতে বলেন। স্বৈরাচারবিরোধী সভায় ড. মিলনের মা ও স্ত্রীর সামনে মহাদেব সাহা পাঠ করেন সেই কবিতা: “বাংলাদেশ চায় না তোমাকে, তুমি চলে যাও, যাও/

কতো যে মায়ের খালি বুক ফেলে দীর্ঘশ্বাস-/ রক্তমাখা হাত, তুমি ক্ষমা চাও, ক্ষমা ভিক্ষা চাও।”

যুগের অসুখকে ধারণ করেও তিনি এক যুগোত্তরের স্বপ্ন দেখেন। জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার’ যখন নেমে এসেছে পৃথিবীতে; মহাদেব সাহা তখন পৃথিবীর দুঃখে ব্যাকুল, ব্যথিত : “পৃথিবীর দিকে আর তাকানো যায় না,/ বড়ো কষ্ট হয়”

একই সাথে পৃথিবীর দুঃখ মোচনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন কবিতায়- “...পৃথিবী, আবার তুমি সুখি হও, সঞ্জীবিত হও।”

এভাবে ক্রমাগত মহৎ কবিতার উপাদান ও বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ও ফলবান হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা, যা শেষ পর্যন্ত হয়ে বাংলা কবিতারই অমূল্য সম্পদ। কবিতার মতোই স্বাদু ও প্রাঞ্জল তার গদ্য; স্নিগ্ধ লাবণ্যময়।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অসীম মুগ্ধতা; কেবল কবি জীবনে নয়, সমগ্র ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্পষ্ট: “রবীন্দ্র-পরবর্তী বহু দশকের সাহিত্য ও দর্শনের প্রভাব আমার জীবনে, বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তির বহু রূপান্তর ও বিকাশ আমার মনোজগতকে আন্দোলিত ও আলোড়িত করেছে, বহু সামাজিক পরিবর্তনের অনিবার্য ঘটনাও প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে, চিন্তা ও মনোজগতের এই বিপুল পরিবর্তন সত্ত্বেও এখনো রবীন্দ্রনাথই আমার জীবনে সংর্বাধিক প্রাসঙ্গিক, ভাবনা ও চেতনার দিক থেকে এখনো আমরা অনেকেই রবীন্দ্রবিশ্বেরই মানুষ।”

রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার এই বর্ষা মহাদেব সাহার জন্মঋতু। তিনি বর্ষাকাতর, বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকেন, বৃষ্টির শব্দে শিউলি ঝরার শব্দ শুনতে পান, এই একেকটি বৃষ্টির ফোঁটা যেন সদ্য ফোটা ফুল, মাতাল বৃষ্টিতে ফিরে যান হারানো শৈশবে, ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে। “তোমার জন্য, কেবল তোমার জন্য বর্ষা,/ আমি কোটি কোটি বার জন্ম নিতে চাই, দুঃখ/ পেতে চাই, চোখের জলে ভাসতে চাই, তুমি/আমাকে ভাসিয়ে নাও আমিও অনন্তকালের বর্ষা,/ জন্মমৃত্যুর ওপার হতে তোমার মুখচ্ছবি দেখে আমি/ জেগে উঠি; বর্ষা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছ,/ ভরিয়ে দিয়েছ, তোমার জন্য কবে একটি ভালোবাসার/ পঙ্ক্তি লিখতে পারব, আর কবে?”

back to top