alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : এক

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

: শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১

শিল্পী : সমর মজুমদার

বাউলি এবং আমরা স্কুলের মাঠে খেলছি। বই-খাতা হলো আমাদের গোলপোস্ট। গোল পোস্টটাকে উঁচু করার জন্য কেউ কেউ গায়ের জামা-কাপড় বই খাতার উপর রেখে খেলতে নেমেছে। খেলা মানে বলে এলোপাতাড়ি লাথি মারা। খেলোয়াড় ২২ জনের পরিবর্তে চুয়াল্লিশ জন। তার চেয়েও বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। পক্ষ-বিপক্ষের কোনো বালাই নেই। যে যেদিকে পারছে বল মারছে। আমাদের শিক্ষকগণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা উপভোগ করছেন। তাঁরা খেলার নিয়ম-কানুন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। কারণ, তাঁরাও বেশ আনন্দিত। আনন্দের কারণ, তাঁরা আমাদেরকে একটা নূতন বল টিইও অফিস থেকে এনে দিতে পেরেছেন। সেই খুশিতে পারলে তাঁরাও আমাদের সাথে নেমে পড়েন আর কি! কিন্তু লজ্জায় নামতে পারছেন না। বলটি ছাত্রদের পায়ে দেয়ার আগে তাঁরা নিজেরা লাথি দিয়ে পরখ করেই তবে ছাত্রদেরকে বলটি দিয়েছেন।

বলটি একটু লাল রঙের আর রাবারের। গায়ে ছোট ছোট দানা মতো তবে পায়ে লাগে না। এর আগে আমরা এ জাতীয় কোনো বল দেখিনি। ইউনিসেফ না কে যেনো বলটি আমাদের স্কুলে পাঠিয়েছে সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে। আমরা ইউনিসেফের উপর খুব খুশি হই। এর আগে আমরা খেলতাম খড়ের কিংবা জাম্বুরার বল দিয়ে। আর আমাদের বড়রা খেলতো ব্লাডার ওয়ালা চামড়ার বল দিয়ে। কিছুক্ষণ পরপর সে বলের ব্লাডার কুকুরের জিবের মতো বের হয়ে আসতো। খেলা থামিয়ে সেটাকে নানা কসরত করে ঢুকিয়ে তারপর আবার খেলা শুরু করা হতো। যাক, যা বলছিলাম, বেচারি বল! গোলের জন্য নয় যেনো লাথি খাওয়ার জন্যই তার জন্ম।

আমাদের মচ্ছবের এই খেলার মধ্যেই হঠাৎ করেই বাউলি উঠল। বেশ বড়োসড়ো বাউলি। বাউলি মানে হলো ঘূর্ণি বায়ু। ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিলে এ জিনিসটা দেখা যায় আমাদের অঞ্চলে। গোলাকারের বায়ু ঘুরতে ঘুরতে এঁকেবেঁকে চলতে থাকে। মাটির দিকে এর ব্যাস বড় হয়ে থাকে যতই উঠে এর আকার চোঙার মতো সরু হয়ে যায়। সে সামনে যা পায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, গাছের পাতা, ছেঁড়া কাগজ, বালু, কাপড় চোপড় ইত্যাদি। বড় বড় বাউলি (টর্নেডো) ঘরবাড়ি পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যায়। ছোট বাউলিদের সাথে আমরা তখন খেলা করি, আমরা দুহাত বাড়িয়ে ওদের ধরতে যাই, ওদের ভিতরে ঢুকতে চাই। ওরা আমাদের চেয়ে অনেক চালাক। আমাদেরকে ধরা দেবে কেনো? ওরা আমাদের আগে আগে ঘুরতে থাকে। কানামাছি ‘ভোঁ ভোঁ যারে পাবি তারে ছোঁ’ খেলা। আমরা সহজে তাদেরকে নাগালে পাই না। আমাদের চোখ মুখ নাকে ঢুকে যায় ধুলা-বালি। আমরা এতে ভ্রুক্ষেপ করি না। ওরা ডানে যায় তো আমরা ডানে, ওরা বামে যায় তো আমরা বামে। এ এক লুকোচুরি খেলা। অনেক সময় বাউলি ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূরে চলে যায়, আবার কখনো কখনো হঠাৎ করেই শূন্যে মিলিয়ে যায়।

বাউলি সম্পর্কে আমাদের ধারণা- এগুলো হলো দেও (দৈত্য) বাচ্চাদের কা-। দেও-এর বাচ্চারা খেলার জন্যই পৃথিবীতে নেমে আসে কোহকাফ না কোনো এক শহর থেকে। খেলা শেষে আবার তারা তাদের মা বাবার কাছে ফিরে যায়। এরা এতো দ্রুত আসে আর যায় যে আমাদের আফসোসের সীমা থাকে না। আমরা যদি আরো একটুখানি এদের সাথে আউলি বাউলি খেলা খেলতে পারতাম!

আমাদের স্কুল মাঠের সাথেই বিরাট এক ফসলের মাঠ। কিছু ছেলেপিলে ফুটবলে লাথি মারা ভুলে হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠে ‘বাউলি আইতেছে রে, বাউলি’ বলে লাথি মারা ভুলে গিয়ে সবাই বাউলি দেখতে থাকে। বেশ বড়সড় বাউলি চষাক্ষেতের ধূলি উড়িয়ে এঁকেবেঁকে মাঠ পেরিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। আমাদের আর আনন্দ ধরে না। কয়েক জন বাউলির দিকে দৌড় লাগালো। এঁকেবেঁকে বাউলি তখন ঢুকে পড়ল মাঠে। উড়িয়ে নিয়ে গেলো আমাদের গোলপোস্ট। বই খাতা ছিড়ে উড়ছে বাউলির সাথে। উড়ছে সাদা কাগজ, বইয়ের পাতা, শার্ট, গেঞ্জি। অনেকেই তাদের পরনের শার্ট, গেঞ্জি, ফতুয়া, গোলপোস্টের উপর রেখে মাঠে নেমেছিল। তখন তাদের হাহাকার দেখে কে? বাউলি যেমন করে এসেছিল তেমন করেই আবার চলে গেল। পাশ্ববর্তী বাঁশঝাড়ের বাঁশের আগায় ঝুলে থাকতে দেখা গেল অনেকের শার্ট, গেঞ্জি, কিংবা ফতুয়া ।

বাঙালির জীবন ছিন্ন ভিন্ন করা এক মহাবাউলির আগমন যে ঘটে গেছে কে জানত তখন!

বাউলি সম্পর্কে আমাদের ধারণা- এগুলো হলো দেও (দৈত্য) বাচ্চাদের কাণ্ড। দেও-এর বাচ্চারা খেলার জন্যই পৃথিবীতে নেমে আসে কোহকাফ না কোনো এক শহর থেকে। খেলা শেষে আবার তারা তাদের মা বাবার কাছে ফিরে যায়

বাউলি শেষ। ছেলে পিলে মাঠের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে কী যেন দেখছে। মাঠের মাঝ দিয়ে কারা আসছে? এরা আসছে খেত কোনাকুনি, আইল ঘুরে নয়। এদেরকে পিছন থেকে কেউ যেনো তাড়া করছে। কাছে আসতেই দেখা গেল এরা এ গ্রামেরই লোক। এরা এসেছে ঢাকা থেকে। এদের কারো পায়ে জুতা নেই, এরা ক্ষুধার্ত, ক্লাস্ত। চোখমুখ বসে গিয়েছে, চেহারায় দারুণ ভয়। ঢাকা থেকে এসেছে তারা পায়ে হেঁটে, কখনো চড়েছে বাসে, কখনো নৌকায়। তারা জানালো- ঢাকায় কেয়ামত হয়ে গিয়েছে। সকল মানুষ মেরে সাফ, বুড়িগঙ্গায় পানি নেই, বুড়িগঙ্গা এখন রক্তের নদী। তারা কেনো মতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। ঢাকায় যুদ্ধ লেগে গেছে, ভয়ানক এক যুদ্ধ।

যুদ্ধ! যুদ্ধ জিনিসটা কী সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। না কল্পনায়, না বাস্তবে। শুধু গ্রামের কিছু যুদ্ধ ছাড়া। সেটিকে যুদ্ধ বলা যায় না, বলা যায় গোষ্ঠিতে গোষ্ঠিতে মারামারি। দা, কোচ, বল্লম, লাঠি নিয়ে মারামারি। এক দুই ঘণ্টার সে মারামারিতে কিছু লোকের হাত-পা ভাঙে, মাথা ফাটে, কেউ হাসাপাতালে যায়, কেউ বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যায়। খুন তেমন একটা হয় না বললেই চলে। আমাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

তবে ঢাকায় যে একটা ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এদের মধ্যে একজন সবচেয়ে বেশি কথা বলছিল। তার বয়স বাইশ তেইশ বছরের বেশি নয়। ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় সে বুট-বাদাম বিক্রি করত। তাকে সবাই ঘিরে ধরেছে। সে জানালো দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ, শেখ সাহেব পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়েছেন সাতই মার্চের ভাষণে। সে নিজে গিয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে। বুট-বাদাম বিক্রি করতে করতে সে সাতই মার্চের ভাষণ পুরোটাই শুনেছে।

শেখ সাহেব কী বলেছিলেন সেদিনের ভাষণে? আমাদের একজন শিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করলেন।

ফেরিওয়ালা ভাই বলল, তিনি কি বলেছিলেন তার সব কথা মনে নেই। ফেরি করতে করতে সব কথা সে মন দিয়ে শুনতে পারেনি। তবে কিছুকিছু কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। যেমন তিনি যার যা আছে তা নিয়ে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলেছেন।

তিনি সবশেষে বলেছেন-

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

স্বাধীনতা জিনিসটি কী তা আমাদের ক্ষুদ্র মাথায় ঢুকে না। সংগ্রাম সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। তবে আমরা আমাদের শিক্ষক আর বড়দের মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়তে দেখি। শিক্ষকগণ বলাবলি করেছেন, স্কুল কলেজ সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা আমোদিত হই। স্কুল বন্ধ হলে বেশ ভালো হবে। অনু মিয়া স্যার এবং নোয়াখালীর সেই রাগী স্যারের ধমক আর জালিবেতের মার খেতে হবে না। তবে খারাপ লাগবে জুমলা ফুটবল খেলাটা আর আমরা খেলতে পারব না। ক্রমশ...

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : এক

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

শিল্পী : সমর মজুমদার

শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১

বাউলি এবং আমরা স্কুলের মাঠে খেলছি। বই-খাতা হলো আমাদের গোলপোস্ট। গোল পোস্টটাকে উঁচু করার জন্য কেউ কেউ গায়ের জামা-কাপড় বই খাতার উপর রেখে খেলতে নেমেছে। খেলা মানে বলে এলোপাতাড়ি লাথি মারা। খেলোয়াড় ২২ জনের পরিবর্তে চুয়াল্লিশ জন। তার চেয়েও বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। পক্ষ-বিপক্ষের কোনো বালাই নেই। যে যেদিকে পারছে বল মারছে। আমাদের শিক্ষকগণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা উপভোগ করছেন। তাঁরা খেলার নিয়ম-কানুন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। কারণ, তাঁরাও বেশ আনন্দিত। আনন্দের কারণ, তাঁরা আমাদেরকে একটা নূতন বল টিইও অফিস থেকে এনে দিতে পেরেছেন। সেই খুশিতে পারলে তাঁরাও আমাদের সাথে নেমে পড়েন আর কি! কিন্তু লজ্জায় নামতে পারছেন না। বলটি ছাত্রদের পায়ে দেয়ার আগে তাঁরা নিজেরা লাথি দিয়ে পরখ করেই তবে ছাত্রদেরকে বলটি দিয়েছেন।

বলটি একটু লাল রঙের আর রাবারের। গায়ে ছোট ছোট দানা মতো তবে পায়ে লাগে না। এর আগে আমরা এ জাতীয় কোনো বল দেখিনি। ইউনিসেফ না কে যেনো বলটি আমাদের স্কুলে পাঠিয়েছে সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে। আমরা ইউনিসেফের উপর খুব খুশি হই। এর আগে আমরা খেলতাম খড়ের কিংবা জাম্বুরার বল দিয়ে। আর আমাদের বড়রা খেলতো ব্লাডার ওয়ালা চামড়ার বল দিয়ে। কিছুক্ষণ পরপর সে বলের ব্লাডার কুকুরের জিবের মতো বের হয়ে আসতো। খেলা থামিয়ে সেটাকে নানা কসরত করে ঢুকিয়ে তারপর আবার খেলা শুরু করা হতো। যাক, যা বলছিলাম, বেচারি বল! গোলের জন্য নয় যেনো লাথি খাওয়ার জন্যই তার জন্ম।

আমাদের মচ্ছবের এই খেলার মধ্যেই হঠাৎ করেই বাউলি উঠল। বেশ বড়োসড়ো বাউলি। বাউলি মানে হলো ঘূর্ণি বায়ু। ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিলে এ জিনিসটা দেখা যায় আমাদের অঞ্চলে। গোলাকারের বায়ু ঘুরতে ঘুরতে এঁকেবেঁকে চলতে থাকে। মাটির দিকে এর ব্যাস বড় হয়ে থাকে যতই উঠে এর আকার চোঙার মতো সরু হয়ে যায়। সে সামনে যা পায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, গাছের পাতা, ছেঁড়া কাগজ, বালু, কাপড় চোপড় ইত্যাদি। বড় বড় বাউলি (টর্নেডো) ঘরবাড়ি পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যায়। ছোট বাউলিদের সাথে আমরা তখন খেলা করি, আমরা দুহাত বাড়িয়ে ওদের ধরতে যাই, ওদের ভিতরে ঢুকতে চাই। ওরা আমাদের চেয়ে অনেক চালাক। আমাদেরকে ধরা দেবে কেনো? ওরা আমাদের আগে আগে ঘুরতে থাকে। কানামাছি ‘ভোঁ ভোঁ যারে পাবি তারে ছোঁ’ খেলা। আমরা সহজে তাদেরকে নাগালে পাই না। আমাদের চোখ মুখ নাকে ঢুকে যায় ধুলা-বালি। আমরা এতে ভ্রুক্ষেপ করি না। ওরা ডানে যায় তো আমরা ডানে, ওরা বামে যায় তো আমরা বামে। এ এক লুকোচুরি খেলা। অনেক সময় বাউলি ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূরে চলে যায়, আবার কখনো কখনো হঠাৎ করেই শূন্যে মিলিয়ে যায়।

বাউলি সম্পর্কে আমাদের ধারণা- এগুলো হলো দেও (দৈত্য) বাচ্চাদের কা-। দেও-এর বাচ্চারা খেলার জন্যই পৃথিবীতে নেমে আসে কোহকাফ না কোনো এক শহর থেকে। খেলা শেষে আবার তারা তাদের মা বাবার কাছে ফিরে যায়। এরা এতো দ্রুত আসে আর যায় যে আমাদের আফসোসের সীমা থাকে না। আমরা যদি আরো একটুখানি এদের সাথে আউলি বাউলি খেলা খেলতে পারতাম!

আমাদের স্কুল মাঠের সাথেই বিরাট এক ফসলের মাঠ। কিছু ছেলেপিলে ফুটবলে লাথি মারা ভুলে হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠে ‘বাউলি আইতেছে রে, বাউলি’ বলে লাথি মারা ভুলে গিয়ে সবাই বাউলি দেখতে থাকে। বেশ বড়সড় বাউলি চষাক্ষেতের ধূলি উড়িয়ে এঁকেবেঁকে মাঠ পেরিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। আমাদের আর আনন্দ ধরে না। কয়েক জন বাউলির দিকে দৌড় লাগালো। এঁকেবেঁকে বাউলি তখন ঢুকে পড়ল মাঠে। উড়িয়ে নিয়ে গেলো আমাদের গোলপোস্ট। বই খাতা ছিড়ে উড়ছে বাউলির সাথে। উড়ছে সাদা কাগজ, বইয়ের পাতা, শার্ট, গেঞ্জি। অনেকেই তাদের পরনের শার্ট, গেঞ্জি, ফতুয়া, গোলপোস্টের উপর রেখে মাঠে নেমেছিল। তখন তাদের হাহাকার দেখে কে? বাউলি যেমন করে এসেছিল তেমন করেই আবার চলে গেল। পাশ্ববর্তী বাঁশঝাড়ের বাঁশের আগায় ঝুলে থাকতে দেখা গেল অনেকের শার্ট, গেঞ্জি, কিংবা ফতুয়া ।

বাঙালির জীবন ছিন্ন ভিন্ন করা এক মহাবাউলির আগমন যে ঘটে গেছে কে জানত তখন!

বাউলি সম্পর্কে আমাদের ধারণা- এগুলো হলো দেও (দৈত্য) বাচ্চাদের কাণ্ড। দেও-এর বাচ্চারা খেলার জন্যই পৃথিবীতে নেমে আসে কোহকাফ না কোনো এক শহর থেকে। খেলা শেষে আবার তারা তাদের মা বাবার কাছে ফিরে যায়

বাউলি শেষ। ছেলে পিলে মাঠের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে কী যেন দেখছে। মাঠের মাঝ দিয়ে কারা আসছে? এরা আসছে খেত কোনাকুনি, আইল ঘুরে নয়। এদেরকে পিছন থেকে কেউ যেনো তাড়া করছে। কাছে আসতেই দেখা গেল এরা এ গ্রামেরই লোক। এরা এসেছে ঢাকা থেকে। এদের কারো পায়ে জুতা নেই, এরা ক্ষুধার্ত, ক্লাস্ত। চোখমুখ বসে গিয়েছে, চেহারায় দারুণ ভয়। ঢাকা থেকে এসেছে তারা পায়ে হেঁটে, কখনো চড়েছে বাসে, কখনো নৌকায়। তারা জানালো- ঢাকায় কেয়ামত হয়ে গিয়েছে। সকল মানুষ মেরে সাফ, বুড়িগঙ্গায় পানি নেই, বুড়িগঙ্গা এখন রক্তের নদী। তারা কেনো মতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। ঢাকায় যুদ্ধ লেগে গেছে, ভয়ানক এক যুদ্ধ।

যুদ্ধ! যুদ্ধ জিনিসটা কী সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। না কল্পনায়, না বাস্তবে। শুধু গ্রামের কিছু যুদ্ধ ছাড়া। সেটিকে যুদ্ধ বলা যায় না, বলা যায় গোষ্ঠিতে গোষ্ঠিতে মারামারি। দা, কোচ, বল্লম, লাঠি নিয়ে মারামারি। এক দুই ঘণ্টার সে মারামারিতে কিছু লোকের হাত-পা ভাঙে, মাথা ফাটে, কেউ হাসাপাতালে যায়, কেউ বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যায়। খুন তেমন একটা হয় না বললেই চলে। আমাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

তবে ঢাকায় যে একটা ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এদের মধ্যে একজন সবচেয়ে বেশি কথা বলছিল। তার বয়স বাইশ তেইশ বছরের বেশি নয়। ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় সে বুট-বাদাম বিক্রি করত। তাকে সবাই ঘিরে ধরেছে। সে জানালো দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ, শেখ সাহেব পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়েছেন সাতই মার্চের ভাষণে। সে নিজে গিয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে। বুট-বাদাম বিক্রি করতে করতে সে সাতই মার্চের ভাষণ পুরোটাই শুনেছে।

শেখ সাহেব কী বলেছিলেন সেদিনের ভাষণে? আমাদের একজন শিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করলেন।

ফেরিওয়ালা ভাই বলল, তিনি কি বলেছিলেন তার সব কথা মনে নেই। ফেরি করতে করতে সব কথা সে মন দিয়ে শুনতে পারেনি। তবে কিছুকিছু কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। যেমন তিনি যার যা আছে তা নিয়ে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলেছেন।

তিনি সবশেষে বলেছেন-

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

স্বাধীনতা জিনিসটি কী তা আমাদের ক্ষুদ্র মাথায় ঢুকে না। সংগ্রাম সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। তবে আমরা আমাদের শিক্ষক আর বড়দের মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়তে দেখি। শিক্ষকগণ বলাবলি করেছেন, স্কুল কলেজ সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা আমোদিত হই। স্কুল বন্ধ হলে বেশ ভালো হবে। অনু মিয়া স্যার এবং নোয়াখালীর সেই রাগী স্যারের ধমক আর জালিবেতের মার খেতে হবে না। তবে খারাপ লাগবে জুমলা ফুটবল খেলাটা আর আমরা খেলতে পারব না। ক্রমশ...

back to top