alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : তের

শিকিবু

আবুল কাসেম

: শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

তেইশ.

তেইশির দরবার মুরাসাকির ব্যাপারে তেমন কিছু অবগত নয়, তা বলা যাবে না। সেই শোনাগন সবকিছুর খোঁজখবর রাখেন। তিনি ইমনের প্রচারণায় গেঞ্জি উপন্যাসের কথা জানেন না তা নয়। তবে অন্যদের মত এতটা গুরুত্ব দেন না। তার অবস্থান দরবারে যেমন শক্ত, সাহিত্যে তেমনি বেশ সংহত। আত্মবিশ্বাসও প্রচুর। ইমনের দেখা পেয়ে বললেন, শুনলাম তাকাকু এখন সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে, ইঝোমির মতই ঝরে যাবে।

ইমন বললেন, কী জানি, হতেও পারে। তবে সম্রাটমাতারও আশীর্বাদ আছে, শুধু সম্রাটের শ্বশুরের না।

লেডি সেনশি পছন্দ করলেন তাকে। আমি তো জানি বিচক্ষণ এবং বিদগ্ধ রমণী তিনি।

তোমার জানায় কোনো ভুল নেই শোনাগন, সম্ভবত এক্ষেত্রেও ভুল হবে না।

বেশ, দেখা যাক।

এরকম মন্তব্য করলেও সেই শোনাগন ভেতরে ভেতরে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তেইশির দরবারের উচ্চভাবমূর্তি বুঝি হুমকির সম্মুখীন। কিছু দিন আগে ইঝোমি একবার চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন, তার বিদায়ে স্বস্তি এলেও এখন আবার অস্বস্তি শুরু হয়েছে।

এদিকে নদীর বাঁকের মতো ইঝোমির মনের বাঁকে ভাঙন ধরেছে। নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না তিনি। স্বপ্নে অতসুমিচির জোর করার আলামাত দেখলেও বাস্তবে তিনি বড় ও সত্যিকার প্রেমিকের নিষ্কাম প্রেম নিয়ে ইঝোমির সামনে আবির্ভূত হয়েছেন। পত্র লেখা লেখি হচ্ছে তাদের মধ্যে। দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে। মান-অভিমানও চলছে। ডায়েরিতে তৃতীয় ব্যক্তির জবানিতে ব্যাপারগুলো লিখে রাখছেন ইঝোমি। লিখেছেন:

এভাবে মাসের পর মাস যাচ্ছে শোকে, স্বপ্নের চেয়েও বেশি ঝাপসা সবকিছু। একদিন গাছগুলোর নিচে ঘনছায়া বিস্তার করেছে। বাঁধের ওপরকার ঘাসগুলো হয়ে উঠেছে গাঢ়-সবুজ। এই পরিবর্তনগুলো জানান দিয়ে আসেনি। তবু তার কাছে সুন্দর মনে হলো যখন দীর্ঘ তরুর সারি পার হয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে আলো ছড়িয়ে আসা প্রয়াত প্রিন্সের চাকরের পদক্ষেপ দৃষ্টি গোচরে এলো। তিনি অলসভরে কৌতূহলী, কিন্তু যখন সে তার দিকে এগিয়ে আসছে তখন স্মৃতি তার পাতা উল্টে পরলোকগত প্রিন্সের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কত কষ্ট তার, ভেতর পুড়ে মরছে। তাই তিনি বললেন, এত বিলম্বে এলে?

অতীতের কথা বলতে ঝুঁকে পড়তে হয়। এটা কি গায়ে পড়ে কথা বলা নয়? আমাকে ভুলে যাও, ভুলে যাও পর্বত প্যাগোডায় প্রার্থনার কথা। কথা না রাখা দুঃখজনক। সুতরাং সেবার জন্য আমি পুনরায় প্রিন্স সোচি-নো-সিয়ার কাছে ফিরে যাই।

চমৎকার। প্রিন্স সত্যই মার্জিত, আমি তাকে চিনি। সে তো অবিবাহিত, না?

না, তিনি খুবই সদয় এবং উদার। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আজকাল এখানে আসি কিনা, আমি বললাম, হ্যাঁ, যাই তো। তখন তিনি একটি তাচিবানা ফুলের ডাল ভেঙে পরিষ্কার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,এটি তাকে দিয়ো, দেখো সে কিভাবে তা গ্রহণ করে। মে মাসে তাচিবানা ফুলের গুচ্ছ তার হাতার সুগন্ধ মনে করিয়ে দেয়, সে আজ এখানে নেই। পুরোনো কবিতাটি আওরাতে আওরাতে সে আবার বলল, এজন্যে আমি এখানে এসেছি, তাঁকে কি বলব?

ইঝোমি ভাবলেন মৌখিকভাবে বার্তা বাহকের মাধ্যমে কোনো বার্তা প্রেরণ বিব্রতকর হতে পারে। প্রিন্স এখনো কিছু লিখে পাঠাননি। তিনি একটি কবিতা লিখে পাঠালেন বার্তা বাহকের মাধ্যমে। কবিতাটি এরকম :

সে সুবাস প্রকৃতই স্মৃতি বয়ে আনে

কিন্তু আবার তা অন্য কিছুও মনে করিয়ে দেয়

কোকিলের কণ্ঠ কি শুনতে পান।

প্রিন্স তখন তার প্রাসাদের বারান্দায় ছিলেন। বার্তাবাহককে দেখে তাকে ভেতরের কক্ষে নিয়ে গেলেন। বললেন, এটা কি? সে কবিতাটি তার হাতে দিল। কবিতা পড়ে প্রিন্স উত্তর লিখলেন, তা এরকম :

কোকিল গান গাইছে একই শাখায় বসে

অপরিবর্তিত কণ্ঠে,

তা তোমার জানা উচিত।

প্রিন্স বার্তাবাহককে তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কারো কাছে এর কথা বলবে না। আমাকে প্রেমাকুল মনে করতে পারে। সে তা ইঝোমির কাছে নিয়ে এলো। ইঝোমি ভাবলেন এখনই কিছু লেখা ঠিক হবে না। পর দিন প্রিন্স আবার কবিতাপত্র পাঠালেন,

তোমার জন্য আমার

অন্তর অবাধ্য হয়ে গেছে

হায়! স্বীকার করছি

গভীর শোকতাপ নিয়ে

শোক করারই দিন।

কথাগুলো, অনুভূতিগুলো অমূলক তবু লিখলেন:

যদি আপনি শোকার্তই আজ

এই মুহূর্তে হৃদয় আপনার

আসার জন্য অনুভব করে

দুঃখজনক।

মাস এবং দিনগুলো দৈর্ঘ্যে জীর্ণ এবং ক্লান্ত।

এভাবে তাদের মধ্যে লেখালেখি চলতে থাকে। এক সময় প্রিন্স লিখলেন, যদি কথাই ব্যর্থ হয়ে যায়। পত্রবিনিময় আর দীর্ঘায়িত করা যাবে না।

ইঝোমি বললেন, তিনি কথা বলতে চান। কিন্তু তিনি যেতে পারবেন না।

প্রিন্সই আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। সূর্যাস্তের আগে তখনও দিনের আলো ঝলমলে। তিনি তার কর্মচারী উকোন নো ঝোকে ডেকে বললেন, আমি এক জায়গায় যাচ্ছি। লোকটি বুঝতে পারলো। কারণ তার মাধ্যমেই পত্র আদান-প্রদান হয়।

প্রিন্স এলেন একটি সাধারণ বাহনে চড়ে এবং বার্তা বাহককে বললেন, ইঝোমিকে জানাতে। এটা ছিল বিব্রতরকর। ইঝোমি বুঝতে পারছেন না তার কী করা উচিত। তাকে গৃহে প্রবেশ না করে ফিরে যেতে বলা হবে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। পশ্চিম দিকের বারান্দার দরজা বরাবর দুটো বসার আসন (কুশন) পাঠিয়ে প্রিন্সকে আসতে বললেন। সতর্কতার জন্যই তা করা হলো। এরা যখন আলাপ শুরু করেন চাঁদ উঠতে থাকে এবং অস্বস্তিকর উজ্জ্বল আলো ছড়াতে থাকে।

প্রিন্স বললেন, আমি সমাজের বাইরে, ছায়ায় বাস করি। আমি এরকম আলোকময় স্থানে বসতে পারি না। এটা বড়ই বিব্রতকর। আমাকে ভেতরে আসতে দাও যেখানে তুমি বসো। অন্যদের মত আমি অমার্জিত বা রূঢ় নই। আমাকে কি তুমি এভাবে গ্রহণ করতে পার?

কোনো দরকার নেই। কী অদ্ভূত ধারণা। শুধু আজ রাতেই দুজন কথা বলব। আর কখনোই নয়। ভাবলেন তিনি।

কথা হচ্ছে হালকাভাবে। রাত গভীর হচ্ছে। প্রিন্স বললেন, এখানেই কি আমরা রাতটা পার করে দেব? কবিতায় বললেন,

রাত হচ্ছে

আমরা দেখছিনা সামান্য স্বপ্নও

আমার কাছে এই গ্রীষ্ম রাতে কী আর বাকী আছে।

ইঝোমি বললেন,

বিশ্বের কথা ভাবুন।

জামার হাতা ভেজা, চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে সঙ্গী-বিছানা

নিস্তরঙ্গ স্বপ্ন, মিষ্টি স্বপ্নই-

আমার জন্য কোনো রাত নেই সেরকম।

প্রিন্স বললেন, আমি সে রকম ব্যক্তি না যে চাইলেই প্রাসাদ থেকে বের হতে পারব। তুমি ভাবতে পারো আমি একটা রূঢ় ব্যক্তি, কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতি ব্যাকুলভাবে বাড়ছে। বলে তিনি চুপিসারে ইঝোমির কক্ষে প্রবেশ করলেন। খুবই বিব্রত হলেন বটে কিন্তু উভয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকলেন ভোরবেলায় প্রিন্স ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত।

ইঝোমি এখন আর বললেন না সর্বনাশ। কারণ হৃদয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সকল শক্তি অতসুমিচি হরণ করে নিয়ে গেছেন। তবে আত্মসমর্পণের এখনো অনেক বাকি।

সকালে মুরাসাকি ইমনের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। ইমন তার আগেই বের হয়ে গেছেন। রাস্তায় তাদের দেখা হলো। মুরাসাকি জোরে ডেকে বললেন, ইমন আপু, কথা আছে একটু দাঁড়ান।

ইমন বললেন, আমি তোমার ওখানেই যাচ্ছিলাম। তোমার থাকার ব্যবস্থা প্রাসাদে হয়ে গেছে। মহামান্যার ইচ্ছে মতোই হয়েছে। তোমারও পছন্দ হবে। তবে এজন্য তোমাকে আমি খোঁজ করিনি, সে কথা পরে বলছি। এখন তুমি বলো, তুমি কি বলতে চাচ্ছো?

আমি যা বলতে চাচ্ছিলাম তা আপনি বলে দিয়েছেন। প্রাসাদে থাকা কি খুব জরুরি?

কেন, সমস্যা কোথায়?

আমি ইশিয়ামা ডেরায়ই থাকতে চেয়েছিলাম।

তা, কি করে হয়? প্রাসাদের কিছু নিয়ম আছে। তা প্রাসাদের মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত। তুমি প্রাসাদে অবস্থান করলে তোমার ব্যক্তিত্বেও পদমর্যাদা অনুসারে পরিবর্তন আসবে। তুমি সম্রাজ্ঞীর সহচরী।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু...

পিছুটান? হেসে ইমন আবার বললেন, কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ছাড়তে হয়; যা আজ ছাড়বে, তা সব সময় মূল্যবান থাকবে। যাক, আসল কথাটাই বলি, আজকে সেই শোনাগনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।

কখন?

দরবারে আগে চলো।

চব্বিশ.

সেই সোনাগন সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন-ওয়েটিং। জ্যেষ্ঠ সম্রাজ্ঞীর সহচরী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তার অহংকার থাকার কথা। তার বাইরেও তিনি কবি এবং লেখিকা। ইতোমধ্যেই চারদিকে সুখ্যাতি ছড়িয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারের আলোকবর্তিকা হিসেবে হেইয়ান সম্রাট ইচিঝোর দরবার আলোকিত করছেন।

ইমন মুরাসাকিকে নিয়ে তার দপ্তরে যাওয়ার পর এরা দেখলেন তিনি অতিমাত্রায় আত্মগর্ব নিয়ে আছেন। নিজের সম্পর্কে ধারণা বেশ উঁচু।

ইমন ভালোভাবেই জানেন এটা তাকে দেখানোর জন্য নয়, মুরাসাকিকে দেখাবার জন্য। তিনি এই নবাগত লেডি-ইন-ওয়েটিংকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন, এই বনে আমিই রাজা, যা কিছু করো বুঝে-শুনে করো। বললেন, আমার লেখা পড়? মুরাসাকির লেখা যে তিনি পড়েন এবং ভালো মানের লেখা, এগুলো তিনি একবারও বললেন না।

মুরাসাকি বললেন, না, পড়িনি।

না পড়ে লিখবে কী করে? আগে বড় লেখকদের লেখা পড়, তারপর লিখ। না পড়েই লেখা শুরু করা ঠিক না, একদম বোকামি। তোমার লেখায় আমি এই বোকামির আলামত দেখেছি। মনে হয়েছে কেন এরা লিখে কাগজ-কালি নষ্ট করে। আমি আমার লেখায় দু’রকম জিনিসের কথা বলেছি, একটি সুন্দর বা সৌন্দর্যের কথা, অন্যটি অপছন্দ বা ঘৃণার কথা। এখনো লিখছি। তোমার লেখা অপছন্দের তালিকায় এসে যেতে পারে।

মুরাসাকি চুপ করে শুনছেন। তিনি যে রাজ্যের বই পড়ে এসেছেন এবং বই পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, তা কিন্তু বললেন না। সেই শোনাগনের কথায় একটুও মন খারাপ করলেন না। তিনি জানেন তিনি কোন পর্যায়ের লেখক, তার আত্মবিশ্বাস প্রবল। তাই সেই শোনাগনের কথায় শুধু হাসছেন।

সেই শোনাগন বললেন, বোকার মতো হাসছ কেন?

মুরাসাকি এবারও কিছু না বলে হাসলেন। কারণ তিনি জানেন, বোকারাই অন্যকে বোকা বলে এবং আত্মগর্বে আস্ফালন করে।

সেই শোনাগনের মুরাসাকিকে হেয় প্রতিপন্ন করায় ইমন বেশ কষ্ট পেয়েছেন এবং অবাকও হয়েছেন। কিন্তু সর্বদা গাম্ভীর্য ধারণ করে থাকা মুরাসাকি এ অবস্থায়ও কেন হাসছেন তা বুঝতে পারছেন না। তাতে রাগ হচ্ছে। সেই শোনাগন এবারে অন্যদিকে তার কথা বলতে শুরু করলেন। সম্রাজ্ঞী শোশি...

বলাতেই ইমন তাকে থামালেন। বললেন, শোনাগন, ওসব নিয়ে তোমার কিছু না বলাই ভালো। আমরা আমাদের নিয়ে যা খুশি বলতে পারি, যেমন এতক্ষণ তুমি বলছিলে, মহামান্যাদের নিয়ে নয়। চল আমরা এখন আসি। শেষের কথাটা মুরাসাকির উদ্দেশ্যে বললেন ইমন।

শোনাগন বললেন, একেবারে ঠিক বলেছেন। তাতে নিজের ব্যক্তিত্বও ক্ষুণ্ন হয়।

এরা উঠে যাচ্ছিলেন, শোনাগন আবার বললেন, চা পান করে যাবেন।

ইমন চা পান না করার পক্ষে। মুরাসাকি বললেন, চা যত তেতোই হোক না কেন, পান করে যাব।

হেইয়ান সম্রাটের প্রাসাদে চা পানের একটা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য রয়েছে। এটা সাধারণ চা পান নয়। সম্রাজ্ঞীদের প্রতিটি দরবারেও এ রীতি অনুসরণ করা হয়। মেঝেতে বসে আছেন এরা পদ্ম আসন করে। চা পানের জন্য হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন। তাতে কিমোনোর পজিশন পরিবর্তন করতে হল। দাসীরা ছুটে এসে কিমোনো ঠিকঠাক করে দিল। মুরাসাকি নিজেই ঠিকঠাক করে নিলেন।

শোনাগন বললেন, ওরা কি জন্য আছে? হেইয়ান প্রাসাদের আভিজাত্য মেনে চলতে হবে, তাকাকু। ওদের কাজ ওদের করতে দাও।

চা পরিবেশন করার পর মুরাসাকি তা পান করতে যাবেন, শোনাগন বললেন, থামো তাকাকু, আমার এখানে চা পানের একটা প্রাচীন রীতি অনুসরণ করা হয়। প্রাচীন চীনে মুনি ঋষিরা চা পানকে আরাধনার অনুসঙ্গ মনে করতেন। ধ্যানমগ্ন আরাধনার মাঝে চায়ে চুমুক দিতেন। তার আগে চায়ের ধোঁয়া যেন ওপরে উঠে গিয়ে ঐশ্বরিক এক স্বর্গীয় আভা তৈরি করতো।

মুরাসাকি এসব ভালোভাবেই জানেন। মজা করে বললেন, আমরা কি এখন ধ্যান করব?

এখন ধ্যান করতে হবে না। তা হলে আবার পদ্মাসনে ফিরে যেতে হবে।

তা হলে কি কবিতার উচ্চমার্গে পৌঁছার কাব্যসোপান খুঁজতে হবে চোখ বন্ধ করে?

তুমি তো দেখছি সবই জানো।

এবারে নিশ্চয়ই পানপাত্র ধরার নিয়মটা বলে দেয়ার জন্য দাসীদের বলবেন।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

এটাও তুমি জানো মনে হয়। দারুণ জব্ধ হয়েছেন দেখে ইমন বেশ খুশি। তাই চাচ্ছিলেন তিনি। তবে কিছু বলছেন না নিজের বড়ত্বের সম্মান বজায় রাখার জন্য। সেই শোনাগন ভালো লেখক, ভালো লেডি নন। আত্মসম্মানের দিকে সচেতন নন।

ফিরে আসার সময় কথাটা বললেনও ইমন। আচ্ছা জব্ধ করেছ, তাকাকু। তার কাছে তোমাকে নিয়ে যাওয়াই আমার ঠিক হয়নি।

না, না, আপু, ঠিক হয়েছে। তাকে আমার জানার দরকার ছিল। আমি তার সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। তার কথা হঠাৎই জানতে পারি এবং প্রভাবান্বিত হই।

বলনি কেন?

বলিনি কারণ, প্রয়োজন মনে করিনি। এখন মনে হচ্ছে বললে তিনি শিষ্য ভেবে আরো অনেক জ্ঞান দিতেন।

তার সমস্যা এটাই। তবে তিনি লেখেন ভালো। তুমি চা পান সম্পর্কে এতকিছু জানো কী করে?

বাবার কাছ থেকে। তিনি মস্ত একটা ভুল বলেছেন।

কি ভুল?

চা পানকে ধ্যান সাধনার অনুষঙ্গ করেছেন জাপানি কবি ঋষিরা। চীনের সিদ্ধাচার্যরা নন। আমাদের কারো কারো বাজে প্রবণতা এই যে, যা কিছু ভালো তা জাপানের না বলে চীনের ওপর আরোপ করা। তারা মনে করেন এতে তাদের আভিজাত্য বাড়ে। কত হীনমন্যতায়ই না এরা ভোগেন। ভাষার কথাটাই ধরুন। চীনা ধ্রুপদি না বললে অভিজাত হওয়া যায় না, একে সম্রাটের দরবারি ভাষা করতে হবে, কেন? এ এক অদ্ভুত মানসিকতা।

তুমি নাকি চীনা ধ্রুপদি জানো?

কে বলল? ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার জন্য বললেন, আমাদের নিজেদেরই গৌরব ও গর্ব করার জন্য হেইয়ান জাপান অনেক কিছু দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, চীনা ভাষার গরুত্বকে খাটো করে দেখা যাবে না দু’টি কারণে : আমাদের প্রাচীন এবং বর্তমানের অনেক কিছু এই ভাষায় লিপিবদ্ধ। দ্বিতীয়ত: চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এরা এখনও জাপানি কানা শিখবে না, অহংকারে। ভাষায় নিজেদের এগিয়ে রাখতে চাইবে। আমরা যখন তাদের অতিক্রম করে যাব তখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ভাষারও গুরুত্ব বাড়বে, এ ভাষা শিখতে এগিয়ে আসবে।

এরা সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে এসে দেখলেন সম্রাজ্ঞী তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। শোশির বয়স কম হলেও তিনি খুবই তদগতচিত্ত ও গুরুতর প্রকৃতির মহিলা। তার মধ্যে সবসময় অতিক্রম করে যাবার মানসিকতা কাজ করে। অতিক্রম করে যাওয়া মানে, সম্রাজ্ঞী তেইশিকে অতিক্রম করে যাওয়া। অবশ্য তার বাবা তাকে এ কাজে প্রেরণা দিয়ে চলেছেন এবং নানামুখি সাহায্য সহায়তা করছেন।

তার মধ্যেই সম্রাজ্ঞীর মাতা রিনশি এলেন। বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। লেডি-ইন-ওয়েটিং এবং দাসদাসীরা দরবারের বাইরে চলে এলেন।

বিনশি বললেন, ওঝা নিয়ে এসেছি।

ওঝা কেন?

শোনো মেয়ের কথা। সম্রাজ্ঞী হয়েছ বলে কি লোকসংস্কার, বিশ্বাস, ভাগ্য, নিয়তি সব ভুলে যেতে হবে? আমরা সেসব সংস্কার নিয়ে বেঁচে আছি। ডাকবো?

বেশ ডাকুন।

ওঝা সম্রাজ্ঞীর কাছে আসতে পেরে বেশ খুশি।

কিন্তু তার প্রকাশ নেই, গাম্ভীর্য ধারণ করে আছেন। তিনি জানেন ওজন কমানো যাবে না, তা হলে আস্থা হারাতে হবে। দাম থাকবে না।

বিয়ে হল কয়েক বছর সন্তান নেই। অপর সম্রাজ্ঞী তেইশির প্রিন্স, প্রিন্সেস দুই-ই আছে। সম্রাজ্ঞীর সন্তান নেই, তার কোনো মূল্যও নেই। সন্তান নেই তো ভবিষ্যতের সিংহাসন কেন্দ্রিক যুদ্ধটা কিভাবে হবে, এ নিয়ে মিচিনাগাও চিন্তার মধ্যে আছেন। তেইশির সন্তানদের দেখে পিত্ত জ্বলে যায়। মহিষীকে তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ওঝা দেখে শুনে বললেন, আগে কি কোনো চিকিৎসা করিয়েছেন?

দরবারের বৈদ্যরা দেখছে।

এটা বৈদ্যদের কাজ না। আপনারা ভুল করলে সাধারণ মানুষেরা কী করবে?

শ্রাইন প্যাগোডায়ও যাচ্ছে নিয়মিত।

আরেকটা ভুল বললেন। দেবতারা যা দেবার দিয়ে দিয়েছেন। পরের কাজটা তো আমাদের। তাদের কাছে চেয়ে কেন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছেন। রাগও করতে পারেন। আর তা তো মঙ্গলজনক হবে না।

শোশি বিরক্ত হয়ে বললেন, মঙ্গলজনক যা হবে তাই করুন। ক্রমশ...

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক উপন্যাস : তের

শিকিবু

আবুল কাসেম

শুক্রবার, ০৬ আগস্ট ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

তেইশ.

তেইশির দরবার মুরাসাকির ব্যাপারে তেমন কিছু অবগত নয়, তা বলা যাবে না। সেই শোনাগন সবকিছুর খোঁজখবর রাখেন। তিনি ইমনের প্রচারণায় গেঞ্জি উপন্যাসের কথা জানেন না তা নয়। তবে অন্যদের মত এতটা গুরুত্ব দেন না। তার অবস্থান দরবারে যেমন শক্ত, সাহিত্যে তেমনি বেশ সংহত। আত্মবিশ্বাসও প্রচুর। ইমনের দেখা পেয়ে বললেন, শুনলাম তাকাকু এখন সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে, ইঝোমির মতই ঝরে যাবে।

ইমন বললেন, কী জানি, হতেও পারে। তবে সম্রাটমাতারও আশীর্বাদ আছে, শুধু সম্রাটের শ্বশুরের না।

লেডি সেনশি পছন্দ করলেন তাকে। আমি তো জানি বিচক্ষণ এবং বিদগ্ধ রমণী তিনি।

তোমার জানায় কোনো ভুল নেই শোনাগন, সম্ভবত এক্ষেত্রেও ভুল হবে না।

বেশ, দেখা যাক।

এরকম মন্তব্য করলেও সেই শোনাগন ভেতরে ভেতরে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তেইশির দরবারের উচ্চভাবমূর্তি বুঝি হুমকির সম্মুখীন। কিছু দিন আগে ইঝোমি একবার চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন, তার বিদায়ে স্বস্তি এলেও এখন আবার অস্বস্তি শুরু হয়েছে।

এদিকে নদীর বাঁকের মতো ইঝোমির মনের বাঁকে ভাঙন ধরেছে। নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না তিনি। স্বপ্নে অতসুমিচির জোর করার আলামাত দেখলেও বাস্তবে তিনি বড় ও সত্যিকার প্রেমিকের নিষ্কাম প্রেম নিয়ে ইঝোমির সামনে আবির্ভূত হয়েছেন। পত্র লেখা লেখি হচ্ছে তাদের মধ্যে। দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে। মান-অভিমানও চলছে। ডায়েরিতে তৃতীয় ব্যক্তির জবানিতে ব্যাপারগুলো লিখে রাখছেন ইঝোমি। লিখেছেন:

এভাবে মাসের পর মাস যাচ্ছে শোকে, স্বপ্নের চেয়েও বেশি ঝাপসা সবকিছু। একদিন গাছগুলোর নিচে ঘনছায়া বিস্তার করেছে। বাঁধের ওপরকার ঘাসগুলো হয়ে উঠেছে গাঢ়-সবুজ। এই পরিবর্তনগুলো জানান দিয়ে আসেনি। তবু তার কাছে সুন্দর মনে হলো যখন দীর্ঘ তরুর সারি পার হয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে আলো ছড়িয়ে আসা প্রয়াত প্রিন্সের চাকরের পদক্ষেপ দৃষ্টি গোচরে এলো। তিনি অলসভরে কৌতূহলী, কিন্তু যখন সে তার দিকে এগিয়ে আসছে তখন স্মৃতি তার পাতা উল্টে পরলোকগত প্রিন্সের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কত কষ্ট তার, ভেতর পুড়ে মরছে। তাই তিনি বললেন, এত বিলম্বে এলে?

অতীতের কথা বলতে ঝুঁকে পড়তে হয়। এটা কি গায়ে পড়ে কথা বলা নয়? আমাকে ভুলে যাও, ভুলে যাও পর্বত প্যাগোডায় প্রার্থনার কথা। কথা না রাখা দুঃখজনক। সুতরাং সেবার জন্য আমি পুনরায় প্রিন্স সোচি-নো-সিয়ার কাছে ফিরে যাই।

চমৎকার। প্রিন্স সত্যই মার্জিত, আমি তাকে চিনি। সে তো অবিবাহিত, না?

না, তিনি খুবই সদয় এবং উদার। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আজকাল এখানে আসি কিনা, আমি বললাম, হ্যাঁ, যাই তো। তখন তিনি একটি তাচিবানা ফুলের ডাল ভেঙে পরিষ্কার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,এটি তাকে দিয়ো, দেখো সে কিভাবে তা গ্রহণ করে। মে মাসে তাচিবানা ফুলের গুচ্ছ তার হাতার সুগন্ধ মনে করিয়ে দেয়, সে আজ এখানে নেই। পুরোনো কবিতাটি আওরাতে আওরাতে সে আবার বলল, এজন্যে আমি এখানে এসেছি, তাঁকে কি বলব?

ইঝোমি ভাবলেন মৌখিকভাবে বার্তা বাহকের মাধ্যমে কোনো বার্তা প্রেরণ বিব্রতকর হতে পারে। প্রিন্স এখনো কিছু লিখে পাঠাননি। তিনি একটি কবিতা লিখে পাঠালেন বার্তা বাহকের মাধ্যমে। কবিতাটি এরকম :

সে সুবাস প্রকৃতই স্মৃতি বয়ে আনে

কিন্তু আবার তা অন্য কিছুও মনে করিয়ে দেয়

কোকিলের কণ্ঠ কি শুনতে পান।

প্রিন্স তখন তার প্রাসাদের বারান্দায় ছিলেন। বার্তাবাহককে দেখে তাকে ভেতরের কক্ষে নিয়ে গেলেন। বললেন, এটা কি? সে কবিতাটি তার হাতে দিল। কবিতা পড়ে প্রিন্স উত্তর লিখলেন, তা এরকম :

কোকিল গান গাইছে একই শাখায় বসে

অপরিবর্তিত কণ্ঠে,

তা তোমার জানা উচিত।

প্রিন্স বার্তাবাহককে তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কারো কাছে এর কথা বলবে না। আমাকে প্রেমাকুল মনে করতে পারে। সে তা ইঝোমির কাছে নিয়ে এলো। ইঝোমি ভাবলেন এখনই কিছু লেখা ঠিক হবে না। পর দিন প্রিন্স আবার কবিতাপত্র পাঠালেন,

তোমার জন্য আমার

অন্তর অবাধ্য হয়ে গেছে

হায়! স্বীকার করছি

গভীর শোকতাপ নিয়ে

শোক করারই দিন।

কথাগুলো, অনুভূতিগুলো অমূলক তবু লিখলেন:

যদি আপনি শোকার্তই আজ

এই মুহূর্তে হৃদয় আপনার

আসার জন্য অনুভব করে

দুঃখজনক।

মাস এবং দিনগুলো দৈর্ঘ্যে জীর্ণ এবং ক্লান্ত।

এভাবে তাদের মধ্যে লেখালেখি চলতে থাকে। এক সময় প্রিন্স লিখলেন, যদি কথাই ব্যর্থ হয়ে যায়। পত্রবিনিময় আর দীর্ঘায়িত করা যাবে না।

ইঝোমি বললেন, তিনি কথা বলতে চান। কিন্তু তিনি যেতে পারবেন না।

প্রিন্সই আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। সূর্যাস্তের আগে তখনও দিনের আলো ঝলমলে। তিনি তার কর্মচারী উকোন নো ঝোকে ডেকে বললেন, আমি এক জায়গায় যাচ্ছি। লোকটি বুঝতে পারলো। কারণ তার মাধ্যমেই পত্র আদান-প্রদান হয়।

প্রিন্স এলেন একটি সাধারণ বাহনে চড়ে এবং বার্তা বাহককে বললেন, ইঝোমিকে জানাতে। এটা ছিল বিব্রতরকর। ইঝোমি বুঝতে পারছেন না তার কী করা উচিত। তাকে গৃহে প্রবেশ না করে ফিরে যেতে বলা হবে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। পশ্চিম দিকের বারান্দার দরজা বরাবর দুটো বসার আসন (কুশন) পাঠিয়ে প্রিন্সকে আসতে বললেন। সতর্কতার জন্যই তা করা হলো। এরা যখন আলাপ শুরু করেন চাঁদ উঠতে থাকে এবং অস্বস্তিকর উজ্জ্বল আলো ছড়াতে থাকে।

প্রিন্স বললেন, আমি সমাজের বাইরে, ছায়ায় বাস করি। আমি এরকম আলোকময় স্থানে বসতে পারি না। এটা বড়ই বিব্রতকর। আমাকে ভেতরে আসতে দাও যেখানে তুমি বসো। অন্যদের মত আমি অমার্জিত বা রূঢ় নই। আমাকে কি তুমি এভাবে গ্রহণ করতে পার?

কোনো দরকার নেই। কী অদ্ভূত ধারণা। শুধু আজ রাতেই দুজন কথা বলব। আর কখনোই নয়। ভাবলেন তিনি।

কথা হচ্ছে হালকাভাবে। রাত গভীর হচ্ছে। প্রিন্স বললেন, এখানেই কি আমরা রাতটা পার করে দেব? কবিতায় বললেন,

রাত হচ্ছে

আমরা দেখছিনা সামান্য স্বপ্নও

আমার কাছে এই গ্রীষ্ম রাতে কী আর বাকী আছে।

ইঝোমি বললেন,

বিশ্বের কথা ভাবুন।

জামার হাতা ভেজা, চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে সঙ্গী-বিছানা

নিস্তরঙ্গ স্বপ্ন, মিষ্টি স্বপ্নই-

আমার জন্য কোনো রাত নেই সেরকম।

প্রিন্স বললেন, আমি সে রকম ব্যক্তি না যে চাইলেই প্রাসাদ থেকে বের হতে পারব। তুমি ভাবতে পারো আমি একটা রূঢ় ব্যক্তি, কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতি ব্যাকুলভাবে বাড়ছে। বলে তিনি চুপিসারে ইঝোমির কক্ষে প্রবেশ করলেন। খুবই বিব্রত হলেন বটে কিন্তু উভয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকলেন ভোরবেলায় প্রিন্স ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত।

ইঝোমি এখন আর বললেন না সর্বনাশ। কারণ হৃদয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সকল শক্তি অতসুমিচি হরণ করে নিয়ে গেছেন। তবে আত্মসমর্পণের এখনো অনেক বাকি।

সকালে মুরাসাকি ইমনের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। ইমন তার আগেই বের হয়ে গেছেন। রাস্তায় তাদের দেখা হলো। মুরাসাকি জোরে ডেকে বললেন, ইমন আপু, কথা আছে একটু দাঁড়ান।

ইমন বললেন, আমি তোমার ওখানেই যাচ্ছিলাম। তোমার থাকার ব্যবস্থা প্রাসাদে হয়ে গেছে। মহামান্যার ইচ্ছে মতোই হয়েছে। তোমারও পছন্দ হবে। তবে এজন্য তোমাকে আমি খোঁজ করিনি, সে কথা পরে বলছি। এখন তুমি বলো, তুমি কি বলতে চাচ্ছো?

আমি যা বলতে চাচ্ছিলাম তা আপনি বলে দিয়েছেন। প্রাসাদে থাকা কি খুব জরুরি?

কেন, সমস্যা কোথায়?

আমি ইশিয়ামা ডেরায়ই থাকতে চেয়েছিলাম।

তা, কি করে হয়? প্রাসাদের কিছু নিয়ম আছে। তা প্রাসাদের মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত। তুমি প্রাসাদে অবস্থান করলে তোমার ব্যক্তিত্বেও পদমর্যাদা অনুসারে পরিবর্তন আসবে। তুমি সম্রাজ্ঞীর সহচরী।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু...

পিছুটান? হেসে ইমন আবার বললেন, কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ছাড়তে হয়; যা আজ ছাড়বে, তা সব সময় মূল্যবান থাকবে। যাক, আসল কথাটাই বলি, আজকে সেই শোনাগনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।

কখন?

দরবারে আগে চলো।

চব্বিশ.

সেই সোনাগন সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন-ওয়েটিং। জ্যেষ্ঠ সম্রাজ্ঞীর সহচরী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তার অহংকার থাকার কথা। তার বাইরেও তিনি কবি এবং লেখিকা। ইতোমধ্যেই চারদিকে সুখ্যাতি ছড়িয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারের আলোকবর্তিকা হিসেবে হেইয়ান সম্রাট ইচিঝোর দরবার আলোকিত করছেন।

ইমন মুরাসাকিকে নিয়ে তার দপ্তরে যাওয়ার পর এরা দেখলেন তিনি অতিমাত্রায় আত্মগর্ব নিয়ে আছেন। নিজের সম্পর্কে ধারণা বেশ উঁচু।

ইমন ভালোভাবেই জানেন এটা তাকে দেখানোর জন্য নয়, মুরাসাকিকে দেখাবার জন্য। তিনি এই নবাগত লেডি-ইন-ওয়েটিংকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন, এই বনে আমিই রাজা, যা কিছু করো বুঝে-শুনে করো। বললেন, আমার লেখা পড়? মুরাসাকির লেখা যে তিনি পড়েন এবং ভালো মানের লেখা, এগুলো তিনি একবারও বললেন না।

মুরাসাকি বললেন, না, পড়িনি।

না পড়ে লিখবে কী করে? আগে বড় লেখকদের লেখা পড়, তারপর লিখ। না পড়েই লেখা শুরু করা ঠিক না, একদম বোকামি। তোমার লেখায় আমি এই বোকামির আলামত দেখেছি। মনে হয়েছে কেন এরা লিখে কাগজ-কালি নষ্ট করে। আমি আমার লেখায় দু’রকম জিনিসের কথা বলেছি, একটি সুন্দর বা সৌন্দর্যের কথা, অন্যটি অপছন্দ বা ঘৃণার কথা। এখনো লিখছি। তোমার লেখা অপছন্দের তালিকায় এসে যেতে পারে।

মুরাসাকি চুপ করে শুনছেন। তিনি যে রাজ্যের বই পড়ে এসেছেন এবং বই পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, তা কিন্তু বললেন না। সেই শোনাগনের কথায় একটুও মন খারাপ করলেন না। তিনি জানেন তিনি কোন পর্যায়ের লেখক, তার আত্মবিশ্বাস প্রবল। তাই সেই শোনাগনের কথায় শুধু হাসছেন।

সেই শোনাগন বললেন, বোকার মতো হাসছ কেন?

মুরাসাকি এবারও কিছু না বলে হাসলেন। কারণ তিনি জানেন, বোকারাই অন্যকে বোকা বলে এবং আত্মগর্বে আস্ফালন করে।

সেই শোনাগনের মুরাসাকিকে হেয় প্রতিপন্ন করায় ইমন বেশ কষ্ট পেয়েছেন এবং অবাকও হয়েছেন। কিন্তু সর্বদা গাম্ভীর্য ধারণ করে থাকা মুরাসাকি এ অবস্থায়ও কেন হাসছেন তা বুঝতে পারছেন না। তাতে রাগ হচ্ছে। সেই শোনাগন এবারে অন্যদিকে তার কথা বলতে শুরু করলেন। সম্রাজ্ঞী শোশি...

বলাতেই ইমন তাকে থামালেন। বললেন, শোনাগন, ওসব নিয়ে তোমার কিছু না বলাই ভালো। আমরা আমাদের নিয়ে যা খুশি বলতে পারি, যেমন এতক্ষণ তুমি বলছিলে, মহামান্যাদের নিয়ে নয়। চল আমরা এখন আসি। শেষের কথাটা মুরাসাকির উদ্দেশ্যে বললেন ইমন।

শোনাগন বললেন, একেবারে ঠিক বলেছেন। তাতে নিজের ব্যক্তিত্বও ক্ষুণ্ন হয়।

এরা উঠে যাচ্ছিলেন, শোনাগন আবার বললেন, চা পান করে যাবেন।

ইমন চা পান না করার পক্ষে। মুরাসাকি বললেন, চা যত তেতোই হোক না কেন, পান করে যাব।

হেইয়ান সম্রাটের প্রাসাদে চা পানের একটা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য রয়েছে। এটা সাধারণ চা পান নয়। সম্রাজ্ঞীদের প্রতিটি দরবারেও এ রীতি অনুসরণ করা হয়। মেঝেতে বসে আছেন এরা পদ্ম আসন করে। চা পানের জন্য হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন। তাতে কিমোনোর পজিশন পরিবর্তন করতে হল। দাসীরা ছুটে এসে কিমোনো ঠিকঠাক করে দিল। মুরাসাকি নিজেই ঠিকঠাক করে নিলেন।

শোনাগন বললেন, ওরা কি জন্য আছে? হেইয়ান প্রাসাদের আভিজাত্য মেনে চলতে হবে, তাকাকু। ওদের কাজ ওদের করতে দাও।

চা পরিবেশন করার পর মুরাসাকি তা পান করতে যাবেন, শোনাগন বললেন, থামো তাকাকু, আমার এখানে চা পানের একটা প্রাচীন রীতি অনুসরণ করা হয়। প্রাচীন চীনে মুনি ঋষিরা চা পানকে আরাধনার অনুসঙ্গ মনে করতেন। ধ্যানমগ্ন আরাধনার মাঝে চায়ে চুমুক দিতেন। তার আগে চায়ের ধোঁয়া যেন ওপরে উঠে গিয়ে ঐশ্বরিক এক স্বর্গীয় আভা তৈরি করতো।

মুরাসাকি এসব ভালোভাবেই জানেন। মজা করে বললেন, আমরা কি এখন ধ্যান করব?

এখন ধ্যান করতে হবে না। তা হলে আবার পদ্মাসনে ফিরে যেতে হবে।

তা হলে কি কবিতার উচ্চমার্গে পৌঁছার কাব্যসোপান খুঁজতে হবে চোখ বন্ধ করে?

তুমি তো দেখছি সবই জানো।

এবারে নিশ্চয়ই পানপাত্র ধরার নিয়মটা বলে দেয়ার জন্য দাসীদের বলবেন।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

এটাও তুমি জানো মনে হয়। দারুণ জব্ধ হয়েছেন দেখে ইমন বেশ খুশি। তাই চাচ্ছিলেন তিনি। তবে কিছু বলছেন না নিজের বড়ত্বের সম্মান বজায় রাখার জন্য। সেই শোনাগন ভালো লেখক, ভালো লেডি নন। আত্মসম্মানের দিকে সচেতন নন।

ফিরে আসার সময় কথাটা বললেনও ইমন। আচ্ছা জব্ধ করেছ, তাকাকু। তার কাছে তোমাকে নিয়ে যাওয়াই আমার ঠিক হয়নি।

না, না, আপু, ঠিক হয়েছে। তাকে আমার জানার দরকার ছিল। আমি তার সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। তার কথা হঠাৎই জানতে পারি এবং প্রভাবান্বিত হই।

বলনি কেন?

বলিনি কারণ, প্রয়োজন মনে করিনি। এখন মনে হচ্ছে বললে তিনি শিষ্য ভেবে আরো অনেক জ্ঞান দিতেন।

তার সমস্যা এটাই। তবে তিনি লেখেন ভালো। তুমি চা পান সম্পর্কে এতকিছু জানো কী করে?

বাবার কাছ থেকে। তিনি মস্ত একটা ভুল বলেছেন।

কি ভুল?

চা পানকে ধ্যান সাধনার অনুষঙ্গ করেছেন জাপানি কবি ঋষিরা। চীনের সিদ্ধাচার্যরা নন। আমাদের কারো কারো বাজে প্রবণতা এই যে, যা কিছু ভালো তা জাপানের না বলে চীনের ওপর আরোপ করা। তারা মনে করেন এতে তাদের আভিজাত্য বাড়ে। কত হীনমন্যতায়ই না এরা ভোগেন। ভাষার কথাটাই ধরুন। চীনা ধ্রুপদি না বললে অভিজাত হওয়া যায় না, একে সম্রাটের দরবারি ভাষা করতে হবে, কেন? এ এক অদ্ভুত মানসিকতা।

তুমি নাকি চীনা ধ্রুপদি জানো?

কে বলল? ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার জন্য বললেন, আমাদের নিজেদেরই গৌরব ও গর্ব করার জন্য হেইয়ান জাপান অনেক কিছু দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, চীনা ভাষার গরুত্বকে খাটো করে দেখা যাবে না দু’টি কারণে : আমাদের প্রাচীন এবং বর্তমানের অনেক কিছু এই ভাষায় লিপিবদ্ধ। দ্বিতীয়ত: চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এরা এখনও জাপানি কানা শিখবে না, অহংকারে। ভাষায় নিজেদের এগিয়ে রাখতে চাইবে। আমরা যখন তাদের অতিক্রম করে যাব তখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ভাষারও গুরুত্ব বাড়বে, এ ভাষা শিখতে এগিয়ে আসবে।

এরা সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে এসে দেখলেন সম্রাজ্ঞী তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। শোশির বয়স কম হলেও তিনি খুবই তদগতচিত্ত ও গুরুতর প্রকৃতির মহিলা। তার মধ্যে সবসময় অতিক্রম করে যাবার মানসিকতা কাজ করে। অতিক্রম করে যাওয়া মানে, সম্রাজ্ঞী তেইশিকে অতিক্রম করে যাওয়া। অবশ্য তার বাবা তাকে এ কাজে প্রেরণা দিয়ে চলেছেন এবং নানামুখি সাহায্য সহায়তা করছেন।

তার মধ্যেই সম্রাজ্ঞীর মাতা রিনশি এলেন। বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। লেডি-ইন-ওয়েটিং এবং দাসদাসীরা দরবারের বাইরে চলে এলেন।

বিনশি বললেন, ওঝা নিয়ে এসেছি।

ওঝা কেন?

শোনো মেয়ের কথা। সম্রাজ্ঞী হয়েছ বলে কি লোকসংস্কার, বিশ্বাস, ভাগ্য, নিয়তি সব ভুলে যেতে হবে? আমরা সেসব সংস্কার নিয়ে বেঁচে আছি। ডাকবো?

বেশ ডাকুন।

ওঝা সম্রাজ্ঞীর কাছে আসতে পেরে বেশ খুশি।

কিন্তু তার প্রকাশ নেই, গাম্ভীর্য ধারণ করে আছেন। তিনি জানেন ওজন কমানো যাবে না, তা হলে আস্থা হারাতে হবে। দাম থাকবে না।

বিয়ে হল কয়েক বছর সন্তান নেই। অপর সম্রাজ্ঞী তেইশির প্রিন্স, প্রিন্সেস দুই-ই আছে। সম্রাজ্ঞীর সন্তান নেই, তার কোনো মূল্যও নেই। সন্তান নেই তো ভবিষ্যতের সিংহাসন কেন্দ্রিক যুদ্ধটা কিভাবে হবে, এ নিয়ে মিচিনাগাও চিন্তার মধ্যে আছেন। তেইশির সন্তানদের দেখে পিত্ত জ্বলে যায়। মহিষীকে তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ওঝা দেখে শুনে বললেন, আগে কি কোনো চিকিৎসা করিয়েছেন?

দরবারের বৈদ্যরা দেখছে।

এটা বৈদ্যদের কাজ না। আপনারা ভুল করলে সাধারণ মানুষেরা কী করবে?

শ্রাইন প্যাগোডায়ও যাচ্ছে নিয়মিত।

আরেকটা ভুল বললেন। দেবতারা যা দেবার দিয়ে দিয়েছেন। পরের কাজটা তো আমাদের। তাদের কাছে চেয়ে কেন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছেন। রাগও করতে পারেন। আর তা তো মঙ্গলজনক হবে না।

শোশি বিরক্ত হয়ে বললেন, মঙ্গলজনক যা হবে তাই করুন। ক্রমশ...

back to top