alt

সাময়িকী

কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক

আদনান সৈয়দ

: শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/14Aug21/news/mahbubulhaque-1.jpg

মাহমুদুল হকের সঙ্গে তাঁর কানাডা প্রবাসী কন্যা মলি

২০০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কবি শহীদ কাদরী এবং মাহমুদুল হক ছিলেন পরস্পর বন্ধু। আমার সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে মাহমুদুল হকের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব কিছু তথ্য জোগার করা। ২১ জুলাই মাহমুদুল হকের মৃত্যু দিন। আবার ১৪ আগস্ট কবি শহীদ কাদরীর জন্মদিন। এই সাক্ষাতকারে দুজনকেই এক সঙ্গে স্মরণ করছি।]

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ঢাকার বিকেলে তখনো সূর্যের আলতো আলোর ছটা। রাস্তায় রিক্সার টুংটাং, ভালোবাসা দিবসের কপোত-কপোতীর উচ্ছলতায় ভরা ফাগুনের পাগলা বাতাসকে পেছনে ফেলে যাচ্ছি ঝিকাতলার বাড়িতে ষাট দশকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, গল্পকার মাহমুদুল হক অর্থাৎ বটু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য একটাই। কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে কিছু তথ্য আদায় করা। মাহমুদুল হক বয়সে শহীদ কাদরীর চেয়ে একটু বড় হলেও তাঁদের ছিল তুইতোকারির সম্পর্ক। কলিংবেল টিপতেই দরজাটা খুলে দিয়ে আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন মলি। মলি হলেন বটু ভাইয়ের কন্যা। কানাডা প্রবাসী। ড্রয়িং রুমটা অগোছালো। ডানপাশটায় নতুন পুরাতন বইপত্রে একরকম ঠাসা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে উনি বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন। বটু ভাইয়ের স্ত্রী তখন সদ্যই মারা গেছেন। স্ত্রী বিয়োগে বাড়ির প্রতিটা আনাচে কানাচে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ পর এলেন সাহিত্যিক মাহমুদুল হক। হালকা পাতলা শরীর। দেখতে শক্ত সামর্র্থ্য, লম্বা শুকনো, শ্যমবর্ণ গায়ে নীল রংয়ের ফতোয়া। প্রথম দেখাতেই তিনি যে অস্থিমজ্জায় আড্ডাবাজ তা বেশ বোঝা গেল। আমাদের দেখেই আয়েস করে সিগারেটে একটা টান দিয়ে বিশেষ কায়দা করে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর প্রাথমিক আনুষ্ঠানিক কুশলাদির পর তাঁর সঙ্গে কথপোকথন শুরু হয়।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/14Aug21/news/mahbubulhaque-2.jpg

শহীদ কাদরী আর আমি নিউইয়র্ক বার্নস এন্ড নবোলস বইয়ের দোকানে

- কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে নানান গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আপনি ছিলেন তাঁর খুব প্রিয় একজন মানুষ এবং বন্ধু। আপনার কাছ থেকে কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে জানতে চাই।

মাহমুদুল হক: এক অসাধারণ মানুষ শহীদ কাদরী। বিশাল তাঁর ব্যক্তিত্ব। মেধায়, আড্ডায় সব মিলিয়ে একজন মানুষ হিসেবে শহীদ কাদরীর কোনো তুলনা চলে না। আমার জীবনে আমি যা কিছু কিঞ্চিৎ শিখেছি তা শহীদের জন্যেই।

- শহীদ কাদরীর সঙ্গে আপনার পরিচয় সূত্রটা কীভাবে হয়েছিল? একটু বলবেন?
মাহমুদুল হক: আমার বন্ধু ছিলেন কবি ওমর আলী। আমরা সবসময় একসাথে আড্ডা দিতাম আর ঘোরাফেরা করতাম। একদিন আড্ডা দিতে আমরা নদীর ওপারে চলে গেলাম। ফেরার পথে ওমর আলী বললেন চল আজ তোমাকে একজন কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব। তা ওমর এর সাথে পুরান ঢাকার একটা বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি শহীদ কাদরী একটা খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আমার সাথে তখনো তাঁর আলাপ হয়নি। ওমর এর সাথেই অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলো। এভাবেই আমি ধীরে ধীরে শহীদ কাদরী নামে এক অসাধারণ পণ্ডিত আড্ডাবাজ কবির দেখা পেয়ে যাই।

- শহীদ কাদরীকে আপনার মতো অনেকেই পণ্ডিত বলেন। কেন?
মাহমুদুল হক: শহীদ ছিল একাধারে কবি আবার পড়ুয়া। গুরুগম্ভীর আলোচনা শহীদের ধাতে ছিল না; তবে তাঁর জ্ঞানের বিস্তার ছিল অসম্ভব রকমের। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতো। একটা ঘটনা বলি। চার্লি চ্যাপলিন সদ্য গত হয়েছেন। ঢাকার ফিল্ম সেন্টারের মুহাম্মদ খসরু এ উপলক্ষে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রধান আলোচক ছিলেন ফিল্ম সেন্টারের একজন বড় কর্মকর্তা। হঠাৎ কোত্থেকে যেন শহীদ কাদরী উদয় হলো। শহীদ কাদরীকে দেখে তাঁকে অনুরোধ করা হলো কিছু বলার জন্যে। নিমরাজি শহীদ কাদরী চার্লি চ্যাপলিন নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। সেদিন সে চার্লি চ্যাপলিন নিয়ে যে বক্তৃতি দিয়েছিল সেটি আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ একটি বক্তৃতা হিসেবে স্মৃতিতে গেঁথে ছিল। শহীদ ছিল এমনই।

শহীদ ছিল একাধারে কবি আবার পড়ুয়া। গুরুগম্ভীর আলোচনা শহীদের ধাতে ছিল না; তবে তাঁর জ্ঞানের বিস্তার ছিল অসম্ভব রকমের। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতো

- আপনাদের আড্ডার কথা বলবেন?
মাহমুদুল হক: শহীদ কাদরী আর আড্ডা পাশাপাশি দুটো বিষয়। একটাকে ছাড়া আরেকটা যায় না। এমন আড্ডাবাজ মানুষের দেখা পাওয়া এ যুগে কঠিন। বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা শেষ হয়ে গেলে স্রফে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে আড্ডা দিতাম আমরা। আমার ছিল স্টেডিয়ামে সোনার দোকান। রাত ৯টার দিকে দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে সোজা বিউটি বোর্ডিং চলে যেতাম। তারপর টো টো করে রাতভর আড্ডা। ভোর পাঁচটার দিকে বাসায় এসে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমানোর পর আবার দোকান আবার আড্ডা। কখনো কখনো কাজেই যেতমা না। তখন আমাদের সবার আকর্ষণ ছিল শহীদ। কখনো কখনো বাড়ি থেকে বাজার করতে যেয়ে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে তিন চারদিন পর বাসায় ফিরেছি। শুধু আড্ডাই ছিল এর প্রধান কারণ। তবে এটা সত্য যে, শহীদের বন্ধু হওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। সে ছিল অসম্ভব রকমের ঠোঁটকাটা লোক। সারাক্ষণ ইয়ার্কি আর মস্করা করতে ব্যস্ত থাকতো। কাউকে আঘাত বা ছোট করার জন্যে নয়, এটা ছিল শহীদের স্বভাব। তবে তাঁর ঠাট্টা মষ্করা অনেক সময় এতই নির্মম হতো যে মানুষজন তার থেকে একটু দূরেই থাকতো। তার সাথে মানুষজন একটু দূরত্ব নিয়েই মিশতো। আরেকটা কথা হলো শহীদ কাদরীর মতো এরকম গল্প খুব লোককেই বলতে দেখেছি। বানিয়ে হোক যেভাবেই হোক ইনস্ট্যান্ট গল্প বানিয়ে আড্ডার আসরে কেন্দ্রবিন্দু হতে সে ছিল ওস্তাদ। এমনভাবে সে গল্পটা বলবে যে হয়তো গল্পটার আশি ভাগই মিথ্যা; কিন্তু গল্পটা যারা শুনতেন তারা ততক্ষণে গল্পটা বিশ্বাস করে বসে আছেন। এই ছিল শহীদ কাদরী।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/14Aug21/news/mahbubulhaque-3.jpg

- শামসুর রাহমানের সঙ্গে শহীদ কাদরীর সম্পর্ক ছিল মধুর- এ খবর আমাদের সবারই জানা। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
মাহমুদুল হক: একদম সত্য কথা। একদিনের ঘটনা। কবি শামসুর রাহমানের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমানের কবিতার উপর আবদুল মান্নান সৈয়দ একটা প্রবন্ধ পাঠ করছেন। শহীদ কাদরীকেও বলা হলো শামসুর রাহমনের কবিতার উপর কিছু আলোচনা করতে। কিন্তু শহীদ নিমরাজি। উল্টো শহীদের কথা হলো, “শামসুর রাহমান কি আমাদের সম্পর্কে কোথাও কিছু বলেন নাকি যে আমরা তাঁর কবিতা নিয়ে কথা বলতে যাবো? এদিকে মান্নান সৈয়দের গোটা প্রবন্ধটাই ছিল শামসুর রাহমানের কবিতার উপর তীব্র আক্রমণাত্মক ভাষায় ভরা। এদিকে শামসুর রাহমান মান্নান সৈয়দের তীব্র সমালোচনা শুনতে শুনতে মাটিতে মিশে যান আর কি! আব্দুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ পাঠ শেষ হতে না হতেই এবার শহীদ আর চেয়ারে বসে থাকতে পারেনি। সে মাইক হাতে নিল। দেখতে পেলাম শহীদের সব মান অভিমান কোথায় যেন মুহূর্তেই মিশে গেল! শহীদ তাঁর স্বভাবসুলভ ভাষায় শামসুর রাহমানের কবিতার উপর আলোচনা শুরু করে দিল। সেদিন শামসুর রাহমানের উপর এমন সুন্দর অকাট্য যুক্তি দিয়ে উচ্চারিত শহীদের বক্তৃতাটি আমার মনে হয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি বক্তৃতা হয়ে থাকবে। সেদিন বুঝেছিলাম শামসুর রাহমানের প্রতি তাঁর যে কত দরদ।

- আবার আড্ডা প্রসঙ্গ। বিউটি বোর্র্ডিংয়ের আড্ডার পাশাপাশি আপনারা আর কোথায় আড্ডা দিতেন?
মাহমুদুল হক: ঢাকা শহর বলতে তো আগে ওল্ড টাউনকেই বোঝানো হতো। খুব সংক্ষিপ্ত পরিসর। তা বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কখনো চুচিংচু চাইনিজ রেস্তোরাঁ আবার কখনো স্রফে পায়ে হেঁটে ফুলবাড়িয়া পার হয়ে বাংলাবাজার পর্যন্ত আড্ডা দিতে যেতাম।

- শহীদ কাদরীর সঙ্গে কখনো ঝগড়া হয়নি আপনার?
মাহমুদুল হক: প্রচুর ঝগড়াঝাটি হতো। তবে কয়েক মুহূর্তের জন্যে। একদিন রাগ করে শহীদকে থাপ্পড় মেরেছিলাম। যখনই ঘটনাটি মনে হয় মন খারাপ হয়ে যায়।

- কবিতা, আড্ডা ছাড়া শহীদ কাদরীর আর কী কী করার ক্ষমতা ছিল?
মাহমুদুল হক: ওই যে বললাম। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতো। একটা ঘটনা বলি। ছাত্রলীগের একটা কালচারাল অনুষ্ঠান হচ্ছে। কবি রফিকুল ইসলাম, আসাদ চৌধুরী, এঁরা সবাই ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করবেন নির্মলেন্দু গুণ। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আমি আর শহীদ অনুষ্ঠানে হাজির। আমরা কেউই ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলাম না। হঠাৎ মোবাশ্বের আলীর চোখ পড়লো শহীদের উপর। শহীদকে দেখেই তিনি অনুরোধ জানালেন অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে। শহীদ রাজি হয়ে গেলেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম শহীদ কত দক্ষতার সাথে অনুষ্ঠনাটি পরিচালনা করলো। আর শুধুই কি অনুষ্ঠন পরিচালনা? সেই সঙ্গে সে কবিতার চুল চেরা বিশ্লেষণ করলো। শামসুর রাহমান অথবা আল মাহমুদের চেয়েও কবিতার সুন্দর ব্যখ্যা করতে পারতো শহীদ।

- শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এবং শহীদ কাদরী। এই তিন কবির মধ্যে কার কবিতা আপনার বেশি ভালো লাগে?
মাহমুদুল হক: কঠিন প্রশ্ন! এঁরা সবাই আমার বন্ধু। আল মাহমুদ সম্পর্কে আমরা অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পছন্দ করতাম। তবে আল মাহমুদের কবিতায় কিছু একটা আলাদা সত্তা যে আছে এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। ওঁ একটা জাত স্বভাব কবি। ওঁর সোনালি কাবিন কবিতায় উঠে এসেছে একদম বাংলার মাটির নির্যাস। আল মাহমুদকে নিয়ে হয়তো হাসি ঠাট্টা করা যায় কিন্তু তাঁর কবিতা নিয়ে নয়। আর এই সত্য কথাটি আল মাহমুদ জানে বলেই কবিতা নিয়ে তাঁর অহংকারও অনেক। তবে এঁরা সবাই অনেক উঁচু মাপের কবি।

- একটা বিষয় খুব লক্ষণীয়। শামসুর রাহমানের সঙ্গে শহীদ কাদরীর এত আন্তরিক সম্পর্ক ছিল অথচ শামসুর রাহমান তাঁর স্মৃতিকথা ‘কালের ধুলোয় লেখা’তে শহীদ কাদরীর নামটিই নেই। কী কারণ হতে পারে? আপনার কী মনে হয়?
মাহমুদুল হক: কবিরাও তো মানুষ! তাদেরও মান-অভিমানের পালা আছে। আর এটাই স্বাভাবিক। যতদূর জানি শহীদ শামসুর রাহমানকে খুব বড় কোনো কবি মনে করতো না। আবার শামসুর রাহমানও নিজেকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। সব মিলিয়ে হয়তো এটা হয়েছে। যতদূর মনে হয় শামসুর রাহমান নিজের সম্পর্কে খুবই ভীত ছিলেন। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সবসময়ই ভাবতেন। এই বুঝি স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়লেন- এই ভয়টি তাঁর মাঝে সাংঘাতিক রকম ছিল।

- আপনাদের সময়ের জনপ্রিয় কবিদের কথা কিছু বলেন।
মাহমুদুল হক: আমাদের সময়ে বিখ্যাত কবি যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন- কবি তালিম হোসেন, কবি ফররুখ আহমেদ। এঁদের ভেতর আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী উঠে এসেছিলেন তারুণ্যের এক দীপ্তি নিয়ে। আল মাহমুদ এঁদের ভেতর ছিলেন একটু ব্যতিক্রম। তাঁর আচরণে এক ধরনের গ্রাম্যতা হয়তো ছিল কিন্তু তিনি ছিলেন কবিতায় সিদ্ধহস্ত। তাঁর তুলনা শুধু তাঁর সঙ্গেই করা যায়।

- শুনেছি শহীদ কাদরী বই চুরিতে ওস্তাদ ছিলেন। আপনার সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে?
মাহমুদুল হক: অবশ্যই! তা আর বলতে! (হেসে হেসে) তখন ১৯৭৮ সাল। শহীদ বিদেশ চলে যাচ্ছে। আমরা সবাই এয়ারপোর্টে শহীদকে বিদায় জানাতে গেলাম। আমাদের দেখেই সে দেখি কী যেন একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। পরে দেখি আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের যে সব বই শহীদের কাছে ছিল এর সব নিয়েই সে বিদেশের দিকে ছুটছে। শুধু আমাদের বইপত্র নয়। ঢাকার বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে ধার করা বইও তার ব্যাগে শোভা পাচ্ছে। আবার বইটার প্রকৃত মালিক যাতে দাবি না করতে পারে সে জন্যে বইয়ের প্রতিটি মলাট সে ছিড়ে ফেলেছিল। এই হলো শহীদ কাদরী।

- তা বইগুলো কি উদ্ধার করতে পেরেছিলেন?
মাহমুদুল হক: বই? তারপরও আবার শহীদের কাছ থেকে? কেউ কি তা কখনো করতে পেরেছে? না পারবে?

- আবার আড্ডা নিয়ে একটা প্রশ্ন। বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডাটা কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মাহমুদুল হক: এটা আমি বলতে পারবো না। কে কখন শুরু করেছিল। তবে এটুকু জানি যে, খালেদ চৌধুরী ছিলেন এই আড্ডার মূল আয়োজক। আমার ধারণা শহীদ আড্ডাবাজ হয়েছিল খালেদ চৌধুরীর জন্যেই। মনে আছে খালেদ চৌধুরী মানে প্রভু যখন আড্ডা দিতেন তখন সত্য অসত্য বিভিন্ন ঘটনা আমাদের সামনে তুলে ধরতেন। শহীদ আর খালেদ মুখোমুখি বসতেন। খালেদ চৌধুরী যখন একই গল্প একাধিকবার বলার চেষ্টা করতেন শহীদ তখন আঙুল তুলে সংখ্যা নির্দেশ করে খালেদ চৌধুরীকে সতর্ক করে দিত।

- শহীদ কাদরী তো খুব আরামপ্রিয় মানুষ। আপানার কী মনে হয়!
মাহমুদুল হক: আর সে কথা বলতে? একটু উদাহরণ দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। শহীদ কীভাবে জানি একটা ব্যবসা জুটালো। বিদেশ থেকে শাকসব্জি এসব রপ্তানি করার ডিলারশিপ সে পেয়েছিল। শহীদ সেই কাজটা তার বন্ধু মোশাররফ বুড়ো আর বিপ্লবকে দিল। তারা কাজ করতো আর শহীদ মাঝে মাঝে তাদের কাজের খবর নিত। একদিন শহীদ দেখে বিপ্লবের পড়নে নতুন প্যান্ট। শহীদ তো রেগে আগুন! “বিপ্লব? কী ব্যাপার জয়েন একাউন্ট থেকে টাকা নিয়ে কি এই প্যান্ট কিনেছো নাকি? শহীদ গালমন্দ করতে শুরু করলো। শহীদ এতই আরামপ্রিয় যে সে তার নিজের ব্যবসার খোঁজখবর পর্যন্ত রাখার সময় পেত না। আড্ডা ছাড়া সে কিছুই বুঝতো না।

- আপনার প্রিয় লেখক কে?
মাহমুদুল হক: আমি মানিকের লেখার প্রচণ্ড ভক্ত। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে অনেক ভালো লাগে।

লেখালেখিতে কীভাবে এলেন?
মাহমুদুল হক: কখনো লেখক হবো ভাবিনি। আমার বেশিরভাগ লেখালেখি হয়েছে আমার স্বর্ণের দোকানে বসে বসে।

- কবি শহীদ কাদরীকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাহমুদুল হক: অনেক বড়মাপের কবি। তাঁর কবিতাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার নেই।

- শহীদ কাদরী অনেককে নিয়েই অনেক নির্মম রসিকতা করতেন। এমন কোনো ঘটনা আপনি দেখেছেন বা মনে আছে?
মাহমুদুল হক: অবশ্যই। বিউটি বোর্ডিংয়ে একটা ঝাড়ুদার ছিল। ও শহীদকে খুব পছন্দ করতো। শহীদের ফুটফরমাস সব সময় করে দিত। বিউটি বোর্ডিংয়ের এক বড় কর্তা হঠাৎ এসে বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতে শুরু করলেন। শহীদ কোনো কারণে তাকে পছন্দ করতো না। একদিন শহীদ ঐ ঝাড়ুদারকে দিয়ে সেই বড়কর্তাকে ফোন করালো। “আমি বিউটি বোর্র্ডিংয়ের ঝাড়ুদার বলছি।” সেই লোকতো রেগেমেগে আগুন। এই ছিল আমাদের বন্ধু শহীদ। একদম অন্যরকম এক জিনিস।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক

আদনান সৈয়দ

শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/14Aug21/news/mahbubulhaque-1.jpg

মাহমুদুল হকের সঙ্গে তাঁর কানাডা প্রবাসী কন্যা মলি

২০০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কবি শহীদ কাদরী এবং মাহমুদুল হক ছিলেন পরস্পর বন্ধু। আমার সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে মাহমুদুল হকের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব কিছু তথ্য জোগার করা। ২১ জুলাই মাহমুদুল হকের মৃত্যু দিন। আবার ১৪ আগস্ট কবি শহীদ কাদরীর জন্মদিন। এই সাক্ষাতকারে দুজনকেই এক সঙ্গে স্মরণ করছি।]

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ঢাকার বিকেলে তখনো সূর্যের আলতো আলোর ছটা। রাস্তায় রিক্সার টুংটাং, ভালোবাসা দিবসের কপোত-কপোতীর উচ্ছলতায় ভরা ফাগুনের পাগলা বাতাসকে পেছনে ফেলে যাচ্ছি ঝিকাতলার বাড়িতে ষাট দশকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, গল্পকার মাহমুদুল হক অর্থাৎ বটু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য একটাই। কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে কিছু তথ্য আদায় করা। মাহমুদুল হক বয়সে শহীদ কাদরীর চেয়ে একটু বড় হলেও তাঁদের ছিল তুইতোকারির সম্পর্ক। কলিংবেল টিপতেই দরজাটা খুলে দিয়ে আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন মলি। মলি হলেন বটু ভাইয়ের কন্যা। কানাডা প্রবাসী। ড্রয়িং রুমটা অগোছালো। ডানপাশটায় নতুন পুরাতন বইপত্রে একরকম ঠাসা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে উনি বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন। বটু ভাইয়ের স্ত্রী তখন সদ্যই মারা গেছেন। স্ত্রী বিয়োগে বাড়ির প্রতিটা আনাচে কানাচে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ পর এলেন সাহিত্যিক মাহমুদুল হক। হালকা পাতলা শরীর। দেখতে শক্ত সামর্র্থ্য, লম্বা শুকনো, শ্যমবর্ণ গায়ে নীল রংয়ের ফতোয়া। প্রথম দেখাতেই তিনি যে অস্থিমজ্জায় আড্ডাবাজ তা বেশ বোঝা গেল। আমাদের দেখেই আয়েস করে সিগারেটে একটা টান দিয়ে বিশেষ কায়দা করে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর প্রাথমিক আনুষ্ঠানিক কুশলাদির পর তাঁর সঙ্গে কথপোকথন শুরু হয়।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/14Aug21/news/mahbubulhaque-2.jpg

শহীদ কাদরী আর আমি নিউইয়র্ক বার্নস এন্ড নবোলস বইয়ের দোকানে

- কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে নানান গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আপনি ছিলেন তাঁর খুব প্রিয় একজন মানুষ এবং বন্ধু। আপনার কাছ থেকে কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে জানতে চাই।

মাহমুদুল হক: এক অসাধারণ মানুষ শহীদ কাদরী। বিশাল তাঁর ব্যক্তিত্ব। মেধায়, আড্ডায় সব মিলিয়ে একজন মানুষ হিসেবে শহীদ কাদরীর কোনো তুলনা চলে না। আমার জীবনে আমি যা কিছু কিঞ্চিৎ শিখেছি তা শহীদের জন্যেই।

- শহীদ কাদরীর সঙ্গে আপনার পরিচয় সূত্রটা কীভাবে হয়েছিল? একটু বলবেন?
মাহমুদুল হক: আমার বন্ধু ছিলেন কবি ওমর আলী। আমরা সবসময় একসাথে আড্ডা দিতাম আর ঘোরাফেরা করতাম। একদিন আড্ডা দিতে আমরা নদীর ওপারে চলে গেলাম। ফেরার পথে ওমর আলী বললেন চল আজ তোমাকে একজন কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব। তা ওমর এর সাথে পুরান ঢাকার একটা বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি শহীদ কাদরী একটা খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আমার সাথে তখনো তাঁর আলাপ হয়নি। ওমর এর সাথেই অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলো। এভাবেই আমি ধীরে ধীরে শহীদ কাদরী নামে এক অসাধারণ পণ্ডিত আড্ডাবাজ কবির দেখা পেয়ে যাই।

- শহীদ কাদরীকে আপনার মতো অনেকেই পণ্ডিত বলেন। কেন?
মাহমুদুল হক: শহীদ ছিল একাধারে কবি আবার পড়ুয়া। গুরুগম্ভীর আলোচনা শহীদের ধাতে ছিল না; তবে তাঁর জ্ঞানের বিস্তার ছিল অসম্ভব রকমের। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতো। একটা ঘটনা বলি। চার্লি চ্যাপলিন সদ্য গত হয়েছেন। ঢাকার ফিল্ম সেন্টারের মুহাম্মদ খসরু এ উপলক্ষে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রধান আলোচক ছিলেন ফিল্ম সেন্টারের একজন বড় কর্মকর্তা। হঠাৎ কোত্থেকে যেন শহীদ কাদরী উদয় হলো। শহীদ কাদরীকে দেখে তাঁকে অনুরোধ করা হলো কিছু বলার জন্যে। নিমরাজি শহীদ কাদরী চার্লি চ্যাপলিন নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। সেদিন সে চার্লি চ্যাপলিন নিয়ে যে বক্তৃতি দিয়েছিল সেটি আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ একটি বক্তৃতা হিসেবে স্মৃতিতে গেঁথে ছিল। শহীদ ছিল এমনই।

শহীদ ছিল একাধারে কবি আবার পড়ুয়া। গুরুগম্ভীর আলোচনা শহীদের ধাতে ছিল না; তবে তাঁর জ্ঞানের বিস্তার ছিল অসম্ভব রকমের। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতো

- আপনাদের আড্ডার কথা বলবেন?
মাহমুদুল হক: শহীদ কাদরী আর আড্ডা পাশাপাশি দুটো বিষয়। একটাকে ছাড়া আরেকটা যায় না। এমন আড্ডাবাজ মানুষের দেখা পাওয়া এ যুগে কঠিন। বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা শেষ হয়ে গেলে স্রফে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে আড্ডা দিতাম আমরা। আমার ছিল স্টেডিয়ামে সোনার দোকান। রাত ৯টার দিকে দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে সোজা বিউটি বোর্ডিং চলে যেতাম। তারপর টো টো করে রাতভর আড্ডা। ভোর পাঁচটার দিকে বাসায় এসে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমানোর পর আবার দোকান আবার আড্ডা। কখনো কখনো কাজেই যেতমা না। তখন আমাদের সবার আকর্ষণ ছিল শহীদ। কখনো কখনো বাড়ি থেকে বাজার করতে যেয়ে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে তিন চারদিন পর বাসায় ফিরেছি। শুধু আড্ডাই ছিল এর প্রধান কারণ। তবে এটা সত্য যে, শহীদের বন্ধু হওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। সে ছিল অসম্ভব রকমের ঠোঁটকাটা লোক। সারাক্ষণ ইয়ার্কি আর মস্করা করতে ব্যস্ত থাকতো। কাউকে আঘাত বা ছোট করার জন্যে নয়, এটা ছিল শহীদের স্বভাব। তবে তাঁর ঠাট্টা মষ্করা অনেক সময় এতই নির্মম হতো যে মানুষজন তার থেকে একটু দূরেই থাকতো। তার সাথে মানুষজন একটু দূরত্ব নিয়েই মিশতো। আরেকটা কথা হলো শহীদ কাদরীর মতো এরকম গল্প খুব লোককেই বলতে দেখেছি। বানিয়ে হোক যেভাবেই হোক ইনস্ট্যান্ট গল্প বানিয়ে আড্ডার আসরে কেন্দ্রবিন্দু হতে সে ছিল ওস্তাদ। এমনভাবে সে গল্পটা বলবে যে হয়তো গল্পটার আশি ভাগই মিথ্যা; কিন্তু গল্পটা যারা শুনতেন তারা ততক্ষণে গল্পটা বিশ্বাস করে বসে আছেন। এই ছিল শহীদ কাদরী।

http://sangbad.net.bd/images/2021/August/14Aug21/news/mahbubulhaque-3.jpg

- শামসুর রাহমানের সঙ্গে শহীদ কাদরীর সম্পর্ক ছিল মধুর- এ খবর আমাদের সবারই জানা। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
মাহমুদুল হক: একদম সত্য কথা। একদিনের ঘটনা। কবি শামসুর রাহমানের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমানের কবিতার উপর আবদুল মান্নান সৈয়দ একটা প্রবন্ধ পাঠ করছেন। শহীদ কাদরীকেও বলা হলো শামসুর রাহমনের কবিতার উপর কিছু আলোচনা করতে। কিন্তু শহীদ নিমরাজি। উল্টো শহীদের কথা হলো, “শামসুর রাহমান কি আমাদের সম্পর্কে কোথাও কিছু বলেন নাকি যে আমরা তাঁর কবিতা নিয়ে কথা বলতে যাবো? এদিকে মান্নান সৈয়দের গোটা প্রবন্ধটাই ছিল শামসুর রাহমানের কবিতার উপর তীব্র আক্রমণাত্মক ভাষায় ভরা। এদিকে শামসুর রাহমান মান্নান সৈয়দের তীব্র সমালোচনা শুনতে শুনতে মাটিতে মিশে যান আর কি! আব্দুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ পাঠ শেষ হতে না হতেই এবার শহীদ আর চেয়ারে বসে থাকতে পারেনি। সে মাইক হাতে নিল। দেখতে পেলাম শহীদের সব মান অভিমান কোথায় যেন মুহূর্তেই মিশে গেল! শহীদ তাঁর স্বভাবসুলভ ভাষায় শামসুর রাহমানের কবিতার উপর আলোচনা শুরু করে দিল। সেদিন শামসুর রাহমানের উপর এমন সুন্দর অকাট্য যুক্তি দিয়ে উচ্চারিত শহীদের বক্তৃতাটি আমার মনে হয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি বক্তৃতা হয়ে থাকবে। সেদিন বুঝেছিলাম শামসুর রাহমানের প্রতি তাঁর যে কত দরদ।

- আবার আড্ডা প্রসঙ্গ। বিউটি বোর্র্ডিংয়ের আড্ডার পাশাপাশি আপনারা আর কোথায় আড্ডা দিতেন?
মাহমুদুল হক: ঢাকা শহর বলতে তো আগে ওল্ড টাউনকেই বোঝানো হতো। খুব সংক্ষিপ্ত পরিসর। তা বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কখনো চুচিংচু চাইনিজ রেস্তোরাঁ আবার কখনো স্রফে পায়ে হেঁটে ফুলবাড়িয়া পার হয়ে বাংলাবাজার পর্যন্ত আড্ডা দিতে যেতাম।

- শহীদ কাদরীর সঙ্গে কখনো ঝগড়া হয়নি আপনার?
মাহমুদুল হক: প্রচুর ঝগড়াঝাটি হতো। তবে কয়েক মুহূর্তের জন্যে। একদিন রাগ করে শহীদকে থাপ্পড় মেরেছিলাম। যখনই ঘটনাটি মনে হয় মন খারাপ হয়ে যায়।

- কবিতা, আড্ডা ছাড়া শহীদ কাদরীর আর কী কী করার ক্ষমতা ছিল?
মাহমুদুল হক: ওই যে বললাম। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতো। একটা ঘটনা বলি। ছাত্রলীগের একটা কালচারাল অনুষ্ঠান হচ্ছে। কবি রফিকুল ইসলাম, আসাদ চৌধুরী, এঁরা সবাই ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করবেন নির্মলেন্দু গুণ। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আমি আর শহীদ অনুষ্ঠানে হাজির। আমরা কেউই ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলাম না। হঠাৎ মোবাশ্বের আলীর চোখ পড়লো শহীদের উপর। শহীদকে দেখেই তিনি অনুরোধ জানালেন অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে। শহীদ রাজি হয়ে গেলেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম শহীদ কত দক্ষতার সাথে অনুষ্ঠনাটি পরিচালনা করলো। আর শুধুই কি অনুষ্ঠন পরিচালনা? সেই সঙ্গে সে কবিতার চুল চেরা বিশ্লেষণ করলো। শামসুর রাহমান অথবা আল মাহমুদের চেয়েও কবিতার সুন্দর ব্যখ্যা করতে পারতো শহীদ।

- শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এবং শহীদ কাদরী। এই তিন কবির মধ্যে কার কবিতা আপনার বেশি ভালো লাগে?
মাহমুদুল হক: কঠিন প্রশ্ন! এঁরা সবাই আমার বন্ধু। আল মাহমুদ সম্পর্কে আমরা অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পছন্দ করতাম। তবে আল মাহমুদের কবিতায় কিছু একটা আলাদা সত্তা যে আছে এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। ওঁ একটা জাত স্বভাব কবি। ওঁর সোনালি কাবিন কবিতায় উঠে এসেছে একদম বাংলার মাটির নির্যাস। আল মাহমুদকে নিয়ে হয়তো হাসি ঠাট্টা করা যায় কিন্তু তাঁর কবিতা নিয়ে নয়। আর এই সত্য কথাটি আল মাহমুদ জানে বলেই কবিতা নিয়ে তাঁর অহংকারও অনেক। তবে এঁরা সবাই অনেক উঁচু মাপের কবি।

- একটা বিষয় খুব লক্ষণীয়। শামসুর রাহমানের সঙ্গে শহীদ কাদরীর এত আন্তরিক সম্পর্ক ছিল অথচ শামসুর রাহমান তাঁর স্মৃতিকথা ‘কালের ধুলোয় লেখা’তে শহীদ কাদরীর নামটিই নেই। কী কারণ হতে পারে? আপনার কী মনে হয়?
মাহমুদুল হক: কবিরাও তো মানুষ! তাদেরও মান-অভিমানের পালা আছে। আর এটাই স্বাভাবিক। যতদূর জানি শহীদ শামসুর রাহমানকে খুব বড় কোনো কবি মনে করতো না। আবার শামসুর রাহমানও নিজেকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। সব মিলিয়ে হয়তো এটা হয়েছে। যতদূর মনে হয় শামসুর রাহমান নিজের সম্পর্কে খুবই ভীত ছিলেন। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সবসময়ই ভাবতেন। এই বুঝি স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়লেন- এই ভয়টি তাঁর মাঝে সাংঘাতিক রকম ছিল।

- আপনাদের সময়ের জনপ্রিয় কবিদের কথা কিছু বলেন।
মাহমুদুল হক: আমাদের সময়ে বিখ্যাত কবি যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন- কবি তালিম হোসেন, কবি ফররুখ আহমেদ। এঁদের ভেতর আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী উঠে এসেছিলেন তারুণ্যের এক দীপ্তি নিয়ে। আল মাহমুদ এঁদের ভেতর ছিলেন একটু ব্যতিক্রম। তাঁর আচরণে এক ধরনের গ্রাম্যতা হয়তো ছিল কিন্তু তিনি ছিলেন কবিতায় সিদ্ধহস্ত। তাঁর তুলনা শুধু তাঁর সঙ্গেই করা যায়।

- শুনেছি শহীদ কাদরী বই চুরিতে ওস্তাদ ছিলেন। আপনার সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে?
মাহমুদুল হক: অবশ্যই! তা আর বলতে! (হেসে হেসে) তখন ১৯৭৮ সাল। শহীদ বিদেশ চলে যাচ্ছে। আমরা সবাই এয়ারপোর্টে শহীদকে বিদায় জানাতে গেলাম। আমাদের দেখেই সে দেখি কী যেন একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। পরে দেখি আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের যে সব বই শহীদের কাছে ছিল এর সব নিয়েই সে বিদেশের দিকে ছুটছে। শুধু আমাদের বইপত্র নয়। ঢাকার বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে ধার করা বইও তার ব্যাগে শোভা পাচ্ছে। আবার বইটার প্রকৃত মালিক যাতে দাবি না করতে পারে সে জন্যে বইয়ের প্রতিটি মলাট সে ছিড়ে ফেলেছিল। এই হলো শহীদ কাদরী।

- তা বইগুলো কি উদ্ধার করতে পেরেছিলেন?
মাহমুদুল হক: বই? তারপরও আবার শহীদের কাছ থেকে? কেউ কি তা কখনো করতে পেরেছে? না পারবে?

- আবার আড্ডা নিয়ে একটা প্রশ্ন। বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডাটা কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মাহমুদুল হক: এটা আমি বলতে পারবো না। কে কখন শুরু করেছিল। তবে এটুকু জানি যে, খালেদ চৌধুরী ছিলেন এই আড্ডার মূল আয়োজক। আমার ধারণা শহীদ আড্ডাবাজ হয়েছিল খালেদ চৌধুরীর জন্যেই। মনে আছে খালেদ চৌধুরী মানে প্রভু যখন আড্ডা দিতেন তখন সত্য অসত্য বিভিন্ন ঘটনা আমাদের সামনে তুলে ধরতেন। শহীদ আর খালেদ মুখোমুখি বসতেন। খালেদ চৌধুরী যখন একই গল্প একাধিকবার বলার চেষ্টা করতেন শহীদ তখন আঙুল তুলে সংখ্যা নির্দেশ করে খালেদ চৌধুরীকে সতর্ক করে দিত।

- শহীদ কাদরী তো খুব আরামপ্রিয় মানুষ। আপানার কী মনে হয়!
মাহমুদুল হক: আর সে কথা বলতে? একটু উদাহরণ দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। শহীদ কীভাবে জানি একটা ব্যবসা জুটালো। বিদেশ থেকে শাকসব্জি এসব রপ্তানি করার ডিলারশিপ সে পেয়েছিল। শহীদ সেই কাজটা তার বন্ধু মোশাররফ বুড়ো আর বিপ্লবকে দিল। তারা কাজ করতো আর শহীদ মাঝে মাঝে তাদের কাজের খবর নিত। একদিন শহীদ দেখে বিপ্লবের পড়নে নতুন প্যান্ট। শহীদ তো রেগে আগুন! “বিপ্লব? কী ব্যাপার জয়েন একাউন্ট থেকে টাকা নিয়ে কি এই প্যান্ট কিনেছো নাকি? শহীদ গালমন্দ করতে শুরু করলো। শহীদ এতই আরামপ্রিয় যে সে তার নিজের ব্যবসার খোঁজখবর পর্যন্ত রাখার সময় পেত না। আড্ডা ছাড়া সে কিছুই বুঝতো না।

- আপনার প্রিয় লেখক কে?
মাহমুদুল হক: আমি মানিকের লেখার প্রচণ্ড ভক্ত। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে অনেক ভালো লাগে।

লেখালেখিতে কীভাবে এলেন?
মাহমুদুল হক: কখনো লেখক হবো ভাবিনি। আমার বেশিরভাগ লেখালেখি হয়েছে আমার স্বর্ণের দোকানে বসে বসে।

- কবি শহীদ কাদরীকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাহমুদুল হক: অনেক বড়মাপের কবি। তাঁর কবিতাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার নেই।

- শহীদ কাদরী অনেককে নিয়েই অনেক নির্মম রসিকতা করতেন। এমন কোনো ঘটনা আপনি দেখেছেন বা মনে আছে?
মাহমুদুল হক: অবশ্যই। বিউটি বোর্ডিংয়ে একটা ঝাড়ুদার ছিল। ও শহীদকে খুব পছন্দ করতো। শহীদের ফুটফরমাস সব সময় করে দিত। বিউটি বোর্ডিংয়ের এক বড় কর্তা হঠাৎ এসে বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতে শুরু করলেন। শহীদ কোনো কারণে তাকে পছন্দ করতো না। একদিন শহীদ ঐ ঝাড়ুদারকে দিয়ে সেই বড়কর্তাকে ফোন করালো। “আমি বিউটি বোর্র্ডিংয়ের ঝাড়ুদার বলছি।” সেই লোকতো রেগেমেগে আগুন। এই ছিল আমাদের বন্ধু শহীদ। একদম অন্যরকম এক জিনিস।

back to top