alt

সাময়িকী

রবীন্দ্রনাথের মুকুন্দচর্চা

গৌতম হাজরা

: শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

বাল্যকাল থেকেই চণ্ডীমঙ্গল বা অভয়ামঙ্গল গ্রন্থের প্রতি রবীন্দ্রনাথ অতিরিক্ত আকর্ষণ অনুভব করতেন। সুহৃদ অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে প্রায়শই এই গ্রন্থ নিয়ে আলোচনাও করতেন তিনি। পরবর্তীকালে পরিণত জীবনে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে পুনরায় ঐ গ্রন্থের সঙ্গে এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হয় রবীন্দ্রনাথের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১৯ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক স্নাতকোত্তর বিভাগের পাঠক্রম হিসাবে চণ্ডীমঙ্গল অন্তর্ভুক্ত হয়। এই বিষয়টি পড়াবার ভার বিশ্ববিদ্যালয় চারুচন্দ্রের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি সানন্দে সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। চারুচন্দ্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে গ্রন্থের সম্পর্কে মতামত জানতে চান। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি চণ্ডীমঙ্গল গ্রন্থ প্রেরণ করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ কালকেতুর কাহিনীটিই আদ্যোপান্ত পাঠ করে স্থানে স্থানে কিছু মন্তব্য লিখে বইটি ফেরত দেন। ধনপতির কাহিনী সম্পর্কেও সংক্ষপ্তভাবে কয়েকটি মন্তব্যও লিখে দেন। ১৭ মে ১৯১৯ তারিখে চারুচন্দ্রকে লিখিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানান যে তিনি কবিকঙ্কণ এবং অন্নদামঙ্গল কাব্য পড়ে নোট করে রেখেছেন। এক কপি মনসামঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্য পেলে মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে তাঁর যা বক্তব্য তা তিনি জানাতে পারবেন। শুধু এই নোটদানই নয়, জীবনের বিভিন্ন স্থানে বিবিধ আলোচনায় তিনি উদ্ধৃতি করেছেন চণ্ডীমঙ্গলের উদাহরণ।

“আমাদের চক্ষে বঙ্গসাহিত্যমঞ্চের প্রথম যবনিকাটি যখন উঠিয়া গেল তখন দেখি সমাজে একটি কলহ বাধিয়াছে, সে দেবতার কলহ।... এই সকল স্থানীয় দেবদেবীরা জনসাধারণের কাছে বল পাইয়া কিরূপ দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়াছিলেন তাহা বঙ্গসাহিত্যে তাঁহাদের ব্যবহারে দেখিতে পাওয়া যায়। প্রথমেই চোখে পড়ে, দেবী চণ্ডী নিজের পূজা স্থাপনের জন্য অস্থির। যেমন করিয়া হউক, ছলেবলে কৌশলে মর্তে পূজা প্রচার করিতে হইবেই। ইহাতে বোঝা যায়, পূজা লইয়া একটা বাদবিবাদ আছে। তাহার পর দেখি যাহাদিগকে আশ্রয় করিয়া দেবী পূজা প্রচার করিতে উদ্যত তাহারা উচ্চশ্রেণির লোক নহে। যে নীচের তাহাকেই উপরে উঠাইবেন, ইহাতেই দেবীর শক্তির পরিচয়। নিম্নশ্রেণীর পক্ষে এমন সান্ত্বনা এমন বলের কথা আর কী আছে! যে দরিদ্র দুইবেলা আহার জোটাইতে পারে না সেই শক্তির লীলায় সোনার ঘড়া পাইল, যে ব্যাধ নীচ জাতীয়, ভদ্রজনের অবজ্ঞাভাজন, সেই মহত্ত্ব লাভ করিয়া কলিঙ্গরাজের কন্যাকে বিবাহ করিল।... ইহাই শক্তির লীলা।... তখন নীচের লোকের আকস্মিক অভ্যুত্থান ও উপরের লোকের হঠাৎ পতন সর্বদাই দেখা যাইত। হীনাবস্থার লোক কোথা হইতে শক্তি সংগ্রহ করিয়া অরণ্য কাটিয়া নগর বানাইয়া এবং প্রতাপশালী রাজা হঠাৎ পরাস্ত হইয়া লাঞ্ছিত হইয়াছে। তখনকার নবাব-বাদশাহদের ক্ষমতাও বিধিবিধানের অতীত ছিল, তাঁহাদের খেয়ালমাত্রে সমস্ত হইতে পারিত। ইঁহারা দয়া করিলেই সকল বাধা অতিক্রম করিয়া নীচ মহৎ হইত ভিক্ষুক রাজা হইত। ইঁহারা নির্দয় হইলে ধর্মের দোহাইও কাহাকেও বিনাশ হইতে রক্ষা করিতে পারিত না। ইহাই শক্তি।” (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৮০) এই উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে সাহিত্যের অভ্যন্তরে নিহিত সমাজসত্য অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছেন দেবী চণ্ডী নিজের পুজো প্রচারের জন্য বিশেষভাবে অস্থির। যেমন করে হোক, ছলে বলে তাঁকে মর্তে পুজো প্রচার করতেই হবে। এজন্য তিনি কালকেতুর মতো নিম্নবর্গীয়কে যেমন বিনা কারণেই রাজার উচ্চ সিংহাসনে বসিয়েছেন, তেমনি কলিঙ্গরাজের কারণ ছাড়াই সর্বস্বান্ত করেছেন

আজকের পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যের মধ্যে সমাজ-বাস্তবকে খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস বহুল প্রচলিত। এই ধারার যথার্থ প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ। আজ থেকে শতাধিক বছর পূর্বের এই বিশ্লেষণ সেই প্রবণতা স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছেন দেবী চণ্ডী নিজের পুজো প্রচারের জন্য বিশেষভাবে অস্থির। যেমন করে হোক, ছলে বলে তাঁকে মর্তে পুজো প্রচার করতেই হবে। এইজন্য তিনি কালকেতুর মতো নিম্নবর্গীয়কে যেমন বিনা কারণেই রাজার উচ্চ সিংহাসনে বসিয়েছেন, তেমনি কলিঙ্গরাজের কারণ ছাড়াই সর্বস্বান্ত করেছেন। তখন নবাব বাদশাহের আচরণে এই ধরনের খামখেয়ালি পরিলক্ষিত হতো। তাদের খেয়ালে সমস্তই হতে পারত।

রবীন্দ্রনাথ কবি মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল বা অভয়ামঙ্গল প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন ১২৮৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় “ভারতী” পত্রিকায় “বাঙালি কবি নয়” প্রবন্ধটিতে। এই প্রবন্ধটি পরে ১২৮৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় “বাঙ্গালী কবি নয় কেন” প্রবন্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে “নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি” শিরোনামে “সমালোচনা” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রবন্ধে কবি মুকুন্দের সমালোচনায় মুখরিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অভিযোগ কমলেকামিনী মূর্তিটির কল্পনায় সৌন্দর্যহীনতা কাব্যরসের হানি ঘটিয়েছে। “কবিকঙ্কনের কমলেকামিনীতে একটি রূপসী ষোড়শী হস্তি গ্রাম ও উদ্গার করিতেছে, ইহাতে এমন পরিমাণ সামঞ্জস্যের অভাব হইয়াছে যে, আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞানে অত্যন্ত আঘাত দেয়। শিক্ষিত, সংযত, মার্জিত কল্পনায় একটি রূপসী যুবতীর সহিত গজাহার ও উদগীরণ কোনোমতেই একত্রে উদয় হইতে পারে না” (নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি, সমালোচনা, রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩)। প্রবন্ধটির পদটিকায় রবি কবির আক্রমণ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে “যখন কবি অগাধ সমুদ্রের মধ্যে মরাল শোভিত কুমুদ কহ্লার পদ্মবনের মধ্যে এক রূপসী ষোড়শী প্রতিষ্ঠিত করিলেন- সমস্তই সুন্দর, নীল জল, সুকুমার পদ্ম, পুষ্পের সুগন্ধ, ভ্রমরের গুঞ্জন ইত্যাদি- তখন মধ্য হইতে এক গজাহার আনিয়া আমাদের কল্পনায় অমন একটি নিদারুণ আঘাত দিবার তাৎপর্য কী? সুন্দর পদার্থ যেমন কবিত্বপূর্ণ বিস্ময় উৎপন্ন করিতে পারে, এমন কি আর কিছুতে পারে? অপার সমুদ্রের মধ্যে পদ্মসীনা ষোড়শী রমনা কি যথেষ্ট বিস্ময়ের কারণ নহে?

মঙ্গলকাব্যধারার প্রখ্যাত সমালোচক শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য কবিকঙ্কণ মুকুন্দের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই অভিযোগকে সঠিক বলে মনে করেননি। তাঁর কথায়- “রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীমঙ্গলে বর্ণিত কমলেকামিনীর চিত্রটির মধ্যে সৌন্দর্য এবং বীভৎসতা এই দুইটি পরস্পর বিরোধী চিত্র দেখিতে পাইয়া ইহার নিন্দা করিয়াছেন। কিন্তু ইহার পরিকল্পনার জন্য মুকুন্দরামকে ব্যক্তিগতভাবে কিছুতেই দায়ী করা যায় না। কারণ, একটি ঐতিহ্যমূলক কাহিনীর ধারা অনুসরণ করিয়াই মুকুন্দরাম তাঁহার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী রচনা করিয়াছেন। সেই পূর্ব প্রচলিত কাহিনীর মধ্যে কোনো অংশ পরিবর্তন করা তাঁহার সাধ্য ছিল না। ধর্ম এবং অলৌকিকতা মঙ্গলকাব্যের কাহিনীর ভিত্তি। ধর্মের ক্ষেত্রে অনেক সময় যে রূপকের ব্যবহার হইয়া থাকে কমলেকামিনীর কাহিনী সেই রূপকের উপর পরিকল্পিত।” (বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস। শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য। এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১০৭)

“সাহিত্যের পথে” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “সাহিত্যরূপ” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ অভিযোগের তীর হেনেছেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দের প্রতি। তিনি বলেছেন, “আর একজন কবি দারিদ্র্য দুঃখ বর্ণনা করেছেন। বিষয় হিসাবে স্বভাবতই মনের উপর তার প্রভাব আছে। দরিদ্র ঘরের মেয়ে, অন্নের অভাবে আমানি খেয়ে তাকে পেট ভরাতে হয়- তাও যে পাত্রে করে খাবে এমন সম্বল নেই, মেঝেতে গর্ত করে আমানি ঢেলে খায়- দরিদ্র নারায়ণকে আর্তস্বরে দোহাই পাড়বার মতো ব্যাপার। কবি লিখলেন-

দুঃখ করো অবধান,

দুঃখ করো অবধান,

আমানি খাবার গর্ত দেখো বিদ্যমান।

কথাটা রিপোর্ট করা হলো মাত্র। তা রূপ ধরল না। কিম্ভূত সাহিত্যে ধনী বা দরিদ্রকে বিষয় করায় তার উৎকর্ষ ঘটে না; ভাব ভাষাভঙ্গি সমস্তটা জড়িয়ে একটা মূর্তি সৃষ্টি হলো কিনা এইটেই লক্ষ্য করবার যোগ্য। ‘তুমি খাও ভাঁড়ের জল, আমি খাই ঘাটে’ দারিদ্র্যদুঃখের বিষয় হিসাবে এত শোচনীয়তা অতি নিবিড়, কিন্তু তবু কাব্য হিসাবে এতে অনেকখানি বাকি রইল।” (সাহিত্যরূপ। সাহিত্যের পথে। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। দ্বাদশ খণ্ড। পৃষ্ঠা ৫১৭)। এই একই অভিযোগ তিনি “কাব্য : স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট” নামক প্রবন্ধের করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেন উক্ত পংক্তিগুলিতে দারিদ্র্যের প্রতি কবির সহানুভূতি ব্যক্ত হয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র সহানুভূতি প্রকাশ কখনোই কাব্য হতে পারে না। কাব্য হতে গেলে সরল অভিব্যক্তি প্রয়োজন যা এখানে অনুপস্থিত। তাই একে যথার্থ কাব্য বলা যায় না। আসলে রবীন্দ্রনাথ এবং কবিকঙ্কণ মুকুন্দের কবিমানস ভিন্ন। একজন ভাববাদী, অন্যজন বস্তুবাদী। সুতরাং উভয়ের প্রকাশের ভিন্নতা তো থাকবেই।

“সাহিত্যের পথে” গ্রন্থে ‘সাহিত্যতত্ত্ব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ভাঁড়–দত্ত চরিত্রটির প্রশংসা উল্লেখ করেছেন। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে অপছন্দের চরিত্র সম্ভবত কালকেতু। বিশেষত কালকেতুর অতিশয় ভোজন প্রভৃতি বর্ণনা রবীন্দ্রনাথকে কখনোই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তার সাক্ষ্য মেলে “জাপানযাত্রী”-র ১১ সংখ্যক পত্রে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ কালকেতুর এই ভোজন উপমান হিসেবে ব্যবহার করেছেন- “কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ব্যাধের আহারের যে বর্ণনা আছে সে এক এক গ্লাসে এক এক তাল গিলছে, তার ভোজন উৎকট, তার শব্দ উৎকট, এও সেই রকম, এই বাণিজ্য ব্যাধটাও হাঁস ফাঁস করতে করতে এক এক পিণ্ড মুখে যা পুরুষ সে দেখে ভয় হয়।” (জাপান যাত্রী। পত্র সংখ্যা ১১। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। দশম খণ্ড। পৃষ্ঠা ৪১৫)।

চণ্ডীমঙ্গলের চরিত্রগুলি নিয়েও রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময় আলোচনা করেছেন। “পঞ্চভূত” গ্রন্থের “নরনারী” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “কবিকঙ্কণ চণ্ডীর সুবৃহৎ সমভূমির মধ্যে কেবল ফুল্লরা এবং খুল্লনা একটু নড়িয়া বেড়ায়, নতুবা ব্যাধটাও একটু বিকৃত বৃহৎ স্থানুমাত্র এবং ধনপতি ও তাহার পুত্র কোনো কাজের নহে।” (নরনারী। পঞ্চভূত। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ৮৯৫)

মুকুন্দ গ্রন্থ রচনা শুরু করেছিলেন দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশে। এই স্বপ্নাদেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার বিচিত্র ইঙ্গিত- “মহাকাব্যের ভূমিকাতেই দেখি কবি চলেছেন দেশ ছেড়ে। রাজ্যে কোনো ব্যবস্থা নেই, শাসনকর্তা যথেচ্ছাচারী। নিজের জীবনে মুকুন্দরাম রাষ্ট্রশক্তির যে পরিচয় পেয়েছেন তাতে তিনি সবচেয়ে প্রবল করে অনুভব করেছেন অন্যায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা, বিদেশে উপবাসের পর স্নান করে তিনি যখন ঘুমালেন, দেবী স্বপ্নে তাঁকে আদেশ করলেন দেবীর মহিমাগান রচনা করিবার জন্যে। সেই মহিমাকীর্তন ক্ষমাহীন ন্যায়ধর্মহীন ঈর্ষাপরায়ণ ক্রূরতার জয়কীর্তন কাব্যে জানালেন, যে শিবকে কল্যাণময় বলে ভক্তি করা যায়। কারণ তিনি নিশ্চেষ্ট তাঁর ভক্তদের পথে পথে পরাভব। ভক্তের অপমানের বিষয় এই যে, অন্যায়কারী শক্তির কাছে সে ভয়ে মাথা করেছে নতুন, সেই সঙ্গে নিজের আরাধ্য দেবতাকে করেছে অশ্রদ্ধেয়। শিবশক্তিকে সে মেনে নিয়েছে অশক্তি বলেই।” (বাংলাভাষা পরিচয়। পরিচ্ছদ ৫। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৮) “কালান্তর”-এর “বাতায়নিকের পত্র” প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ একই কথা বলেছেন। মালিনী নাটকের সূচনাতেও কবিকঙ্কনের স্বপ্নের প্রসঙ্গ এসেছে। তবে “বাংলা ভাষা পরিচয়” এবং “বাতায়নিকের পত্র”তে এই স্বপ্ন বিশ্লেষিত হয়েছে সমাজতাত্ত্বিক ভঙ্গিতে আর “মালিনী”তে তার বিশ্লেষণের মাত্রা স্বতন্ত্র।

রবীন্দ্রনাথের দুটি ছোটগল্পে আমরা চণ্ডীমঙ্গলের উল্লেখ পাই। গল্প দুটি যথাক্রমে “তারাপ্রসন্নের কীর্তি” এবং “নষ্টনীড়”। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “বাংলা কাব্য পরিচয়” গ্রন্থেও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলের ঘুমপাড়ানি গান (বাছাই আয় রে আয়... ) “মেঘে কৈল অন্ধকার” এবং “বারমাস্যা” (বৈশাখের বসন্ত ঋতু) নামক তিনটি অংশ স্থান পেয়েছে। এই সংকলনে কবিকঙ্কণকে স্থান দেওয়ার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মুকুন্দপ্রীতি খেলায় ধরা পড়েছে।

সহায়ক গ্রন্থ :
১) চণ্ডীমঙ্গল। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত, সুকুমার সেন সম্পাদিত।

২) বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস। শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য।

৩) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ। সুধাংশুশেখর মুখোপাধ্যায়।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

রবীন্দ্রনাথের মুকুন্দচর্চা

গৌতম হাজরা

শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১

বাল্যকাল থেকেই চণ্ডীমঙ্গল বা অভয়ামঙ্গল গ্রন্থের প্রতি রবীন্দ্রনাথ অতিরিক্ত আকর্ষণ অনুভব করতেন। সুহৃদ অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে প্রায়শই এই গ্রন্থ নিয়ে আলোচনাও করতেন তিনি। পরবর্তীকালে পরিণত জীবনে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে পুনরায় ঐ গ্রন্থের সঙ্গে এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হয় রবীন্দ্রনাথের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১৯ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক স্নাতকোত্তর বিভাগের পাঠক্রম হিসাবে চণ্ডীমঙ্গল অন্তর্ভুক্ত হয়। এই বিষয়টি পড়াবার ভার বিশ্ববিদ্যালয় চারুচন্দ্রের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি সানন্দে সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। চারুচন্দ্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে গ্রন্থের সম্পর্কে মতামত জানতে চান। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি চণ্ডীমঙ্গল গ্রন্থ প্রেরণ করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ কালকেতুর কাহিনীটিই আদ্যোপান্ত পাঠ করে স্থানে স্থানে কিছু মন্তব্য লিখে বইটি ফেরত দেন। ধনপতির কাহিনী সম্পর্কেও সংক্ষপ্তভাবে কয়েকটি মন্তব্যও লিখে দেন। ১৭ মে ১৯১৯ তারিখে চারুচন্দ্রকে লিখিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানান যে তিনি কবিকঙ্কণ এবং অন্নদামঙ্গল কাব্য পড়ে নোট করে রেখেছেন। এক কপি মনসামঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্য পেলে মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে তাঁর যা বক্তব্য তা তিনি জানাতে পারবেন। শুধু এই নোটদানই নয়, জীবনের বিভিন্ন স্থানে বিবিধ আলোচনায় তিনি উদ্ধৃতি করেছেন চণ্ডীমঙ্গলের উদাহরণ।

“আমাদের চক্ষে বঙ্গসাহিত্যমঞ্চের প্রথম যবনিকাটি যখন উঠিয়া গেল তখন দেখি সমাজে একটি কলহ বাধিয়াছে, সে দেবতার কলহ।... এই সকল স্থানীয় দেবদেবীরা জনসাধারণের কাছে বল পাইয়া কিরূপ দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়াছিলেন তাহা বঙ্গসাহিত্যে তাঁহাদের ব্যবহারে দেখিতে পাওয়া যায়। প্রথমেই চোখে পড়ে, দেবী চণ্ডী নিজের পূজা স্থাপনের জন্য অস্থির। যেমন করিয়া হউক, ছলেবলে কৌশলে মর্তে পূজা প্রচার করিতে হইবেই। ইহাতে বোঝা যায়, পূজা লইয়া একটা বাদবিবাদ আছে। তাহার পর দেখি যাহাদিগকে আশ্রয় করিয়া দেবী পূজা প্রচার করিতে উদ্যত তাহারা উচ্চশ্রেণির লোক নহে। যে নীচের তাহাকেই উপরে উঠাইবেন, ইহাতেই দেবীর শক্তির পরিচয়। নিম্নশ্রেণীর পক্ষে এমন সান্ত্বনা এমন বলের কথা আর কী আছে! যে দরিদ্র দুইবেলা আহার জোটাইতে পারে না সেই শক্তির লীলায় সোনার ঘড়া পাইল, যে ব্যাধ নীচ জাতীয়, ভদ্রজনের অবজ্ঞাভাজন, সেই মহত্ত্ব লাভ করিয়া কলিঙ্গরাজের কন্যাকে বিবাহ করিল।... ইহাই শক্তির লীলা।... তখন নীচের লোকের আকস্মিক অভ্যুত্থান ও উপরের লোকের হঠাৎ পতন সর্বদাই দেখা যাইত। হীনাবস্থার লোক কোথা হইতে শক্তি সংগ্রহ করিয়া অরণ্য কাটিয়া নগর বানাইয়া এবং প্রতাপশালী রাজা হঠাৎ পরাস্ত হইয়া লাঞ্ছিত হইয়াছে। তখনকার নবাব-বাদশাহদের ক্ষমতাও বিধিবিধানের অতীত ছিল, তাঁহাদের খেয়ালমাত্রে সমস্ত হইতে পারিত। ইঁহারা দয়া করিলেই সকল বাধা অতিক্রম করিয়া নীচ মহৎ হইত ভিক্ষুক রাজা হইত। ইঁহারা নির্দয় হইলে ধর্মের দোহাইও কাহাকেও বিনাশ হইতে রক্ষা করিতে পারিত না। ইহাই শক্তি।” (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৮০) এই উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে সাহিত্যের অভ্যন্তরে নিহিত সমাজসত্য অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছেন দেবী চণ্ডী নিজের পুজো প্রচারের জন্য বিশেষভাবে অস্থির। যেমন করে হোক, ছলে বলে তাঁকে মর্তে পুজো প্রচার করতেই হবে। এজন্য তিনি কালকেতুর মতো নিম্নবর্গীয়কে যেমন বিনা কারণেই রাজার উচ্চ সিংহাসনে বসিয়েছেন, তেমনি কলিঙ্গরাজের কারণ ছাড়াই সর্বস্বান্ত করেছেন

আজকের পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যের মধ্যে সমাজ-বাস্তবকে খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস বহুল প্রচলিত। এই ধারার যথার্থ প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ। আজ থেকে শতাধিক বছর পূর্বের এই বিশ্লেষণ সেই প্রবণতা স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছেন দেবী চণ্ডী নিজের পুজো প্রচারের জন্য বিশেষভাবে অস্থির। যেমন করে হোক, ছলে বলে তাঁকে মর্তে পুজো প্রচার করতেই হবে। এইজন্য তিনি কালকেতুর মতো নিম্নবর্গীয়কে যেমন বিনা কারণেই রাজার উচ্চ সিংহাসনে বসিয়েছেন, তেমনি কলিঙ্গরাজের কারণ ছাড়াই সর্বস্বান্ত করেছেন। তখন নবাব বাদশাহের আচরণে এই ধরনের খামখেয়ালি পরিলক্ষিত হতো। তাদের খেয়ালে সমস্তই হতে পারত।

রবীন্দ্রনাথ কবি মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল বা অভয়ামঙ্গল প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন ১২৮৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় “ভারতী” পত্রিকায় “বাঙালি কবি নয়” প্রবন্ধটিতে। এই প্রবন্ধটি পরে ১২৮৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় “বাঙ্গালী কবি নয় কেন” প্রবন্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে “নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি” শিরোনামে “সমালোচনা” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রবন্ধে কবি মুকুন্দের সমালোচনায় মুখরিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অভিযোগ কমলেকামিনী মূর্তিটির কল্পনায় সৌন্দর্যহীনতা কাব্যরসের হানি ঘটিয়েছে। “কবিকঙ্কনের কমলেকামিনীতে একটি রূপসী ষোড়শী হস্তি গ্রাম ও উদ্গার করিতেছে, ইহাতে এমন পরিমাণ সামঞ্জস্যের অভাব হইয়াছে যে, আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞানে অত্যন্ত আঘাত দেয়। শিক্ষিত, সংযত, মার্জিত কল্পনায় একটি রূপসী যুবতীর সহিত গজাহার ও উদগীরণ কোনোমতেই একত্রে উদয় হইতে পারে না” (নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি, সমালোচনা, রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩)। প্রবন্ধটির পদটিকায় রবি কবির আক্রমণ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে “যখন কবি অগাধ সমুদ্রের মধ্যে মরাল শোভিত কুমুদ কহ্লার পদ্মবনের মধ্যে এক রূপসী ষোড়শী প্রতিষ্ঠিত করিলেন- সমস্তই সুন্দর, নীল জল, সুকুমার পদ্ম, পুষ্পের সুগন্ধ, ভ্রমরের গুঞ্জন ইত্যাদি- তখন মধ্য হইতে এক গজাহার আনিয়া আমাদের কল্পনায় অমন একটি নিদারুণ আঘাত দিবার তাৎপর্য কী? সুন্দর পদার্থ যেমন কবিত্বপূর্ণ বিস্ময় উৎপন্ন করিতে পারে, এমন কি আর কিছুতে পারে? অপার সমুদ্রের মধ্যে পদ্মসীনা ষোড়শী রমনা কি যথেষ্ট বিস্ময়ের কারণ নহে?

মঙ্গলকাব্যধারার প্রখ্যাত সমালোচক শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য কবিকঙ্কণ মুকুন্দের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই অভিযোগকে সঠিক বলে মনে করেননি। তাঁর কথায়- “রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীমঙ্গলে বর্ণিত কমলেকামিনীর চিত্রটির মধ্যে সৌন্দর্য এবং বীভৎসতা এই দুইটি পরস্পর বিরোধী চিত্র দেখিতে পাইয়া ইহার নিন্দা করিয়াছেন। কিন্তু ইহার পরিকল্পনার জন্য মুকুন্দরামকে ব্যক্তিগতভাবে কিছুতেই দায়ী করা যায় না। কারণ, একটি ঐতিহ্যমূলক কাহিনীর ধারা অনুসরণ করিয়াই মুকুন্দরাম তাঁহার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী রচনা করিয়াছেন। সেই পূর্ব প্রচলিত কাহিনীর মধ্যে কোনো অংশ পরিবর্তন করা তাঁহার সাধ্য ছিল না। ধর্ম এবং অলৌকিকতা মঙ্গলকাব্যের কাহিনীর ভিত্তি। ধর্মের ক্ষেত্রে অনেক সময় যে রূপকের ব্যবহার হইয়া থাকে কমলেকামিনীর কাহিনী সেই রূপকের উপর পরিকল্পিত।” (বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস। শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য। এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১০৭)

“সাহিত্যের পথে” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “সাহিত্যরূপ” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ অভিযোগের তীর হেনেছেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দের প্রতি। তিনি বলেছেন, “আর একজন কবি দারিদ্র্য দুঃখ বর্ণনা করেছেন। বিষয় হিসাবে স্বভাবতই মনের উপর তার প্রভাব আছে। দরিদ্র ঘরের মেয়ে, অন্নের অভাবে আমানি খেয়ে তাকে পেট ভরাতে হয়- তাও যে পাত্রে করে খাবে এমন সম্বল নেই, মেঝেতে গর্ত করে আমানি ঢেলে খায়- দরিদ্র নারায়ণকে আর্তস্বরে দোহাই পাড়বার মতো ব্যাপার। কবি লিখলেন-

দুঃখ করো অবধান,

দুঃখ করো অবধান,

আমানি খাবার গর্ত দেখো বিদ্যমান।

কথাটা রিপোর্ট করা হলো মাত্র। তা রূপ ধরল না। কিম্ভূত সাহিত্যে ধনী বা দরিদ্রকে বিষয় করায় তার উৎকর্ষ ঘটে না; ভাব ভাষাভঙ্গি সমস্তটা জড়িয়ে একটা মূর্তি সৃষ্টি হলো কিনা এইটেই লক্ষ্য করবার যোগ্য। ‘তুমি খাও ভাঁড়ের জল, আমি খাই ঘাটে’ দারিদ্র্যদুঃখের বিষয় হিসাবে এত শোচনীয়তা অতি নিবিড়, কিন্তু তবু কাব্য হিসাবে এতে অনেকখানি বাকি রইল।” (সাহিত্যরূপ। সাহিত্যের পথে। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। দ্বাদশ খণ্ড। পৃষ্ঠা ৫১৭)। এই একই অভিযোগ তিনি “কাব্য : স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট” নামক প্রবন্ধের করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেন উক্ত পংক্তিগুলিতে দারিদ্র্যের প্রতি কবির সহানুভূতি ব্যক্ত হয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র সহানুভূতি প্রকাশ কখনোই কাব্য হতে পারে না। কাব্য হতে গেলে সরল অভিব্যক্তি প্রয়োজন যা এখানে অনুপস্থিত। তাই একে যথার্থ কাব্য বলা যায় না। আসলে রবীন্দ্রনাথ এবং কবিকঙ্কণ মুকুন্দের কবিমানস ভিন্ন। একজন ভাববাদী, অন্যজন বস্তুবাদী। সুতরাং উভয়ের প্রকাশের ভিন্নতা তো থাকবেই।

“সাহিত্যের পথে” গ্রন্থে ‘সাহিত্যতত্ত্ব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ভাঁড়–দত্ত চরিত্রটির প্রশংসা উল্লেখ করেছেন। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে অপছন্দের চরিত্র সম্ভবত কালকেতু। বিশেষত কালকেতুর অতিশয় ভোজন প্রভৃতি বর্ণনা রবীন্দ্রনাথকে কখনোই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তার সাক্ষ্য মেলে “জাপানযাত্রী”-র ১১ সংখ্যক পত্রে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ কালকেতুর এই ভোজন উপমান হিসেবে ব্যবহার করেছেন- “কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে ব্যাধের আহারের যে বর্ণনা আছে সে এক এক গ্লাসে এক এক তাল গিলছে, তার ভোজন উৎকট, তার শব্দ উৎকট, এও সেই রকম, এই বাণিজ্য ব্যাধটাও হাঁস ফাঁস করতে করতে এক এক পিণ্ড মুখে যা পুরুষ সে দেখে ভয় হয়।” (জাপান যাত্রী। পত্র সংখ্যা ১১। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। দশম খণ্ড। পৃষ্ঠা ৪১৫)।

চণ্ডীমঙ্গলের চরিত্রগুলি নিয়েও রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময় আলোচনা করেছেন। “পঞ্চভূত” গ্রন্থের “নরনারী” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “কবিকঙ্কণ চণ্ডীর সুবৃহৎ সমভূমির মধ্যে কেবল ফুল্লরা এবং খুল্লনা একটু নড়িয়া বেড়ায়, নতুবা ব্যাধটাও একটু বিকৃত বৃহৎ স্থানুমাত্র এবং ধনপতি ও তাহার পুত্র কোনো কাজের নহে।” (নরনারী। পঞ্চভূত। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ৮৯৫)

মুকুন্দ গ্রন্থ রচনা শুরু করেছিলেন দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশে। এই স্বপ্নাদেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার বিচিত্র ইঙ্গিত- “মহাকাব্যের ভূমিকাতেই দেখি কবি চলেছেন দেশ ছেড়ে। রাজ্যে কোনো ব্যবস্থা নেই, শাসনকর্তা যথেচ্ছাচারী। নিজের জীবনে মুকুন্দরাম রাষ্ট্রশক্তির যে পরিচয় পেয়েছেন তাতে তিনি সবচেয়ে প্রবল করে অনুভব করেছেন অন্যায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা, বিদেশে উপবাসের পর স্নান করে তিনি যখন ঘুমালেন, দেবী স্বপ্নে তাঁকে আদেশ করলেন দেবীর মহিমাগান রচনা করিবার জন্যে। সেই মহিমাকীর্তন ক্ষমাহীন ন্যায়ধর্মহীন ঈর্ষাপরায়ণ ক্রূরতার জয়কীর্তন কাব্যে জানালেন, যে শিবকে কল্যাণময় বলে ভক্তি করা যায়। কারণ তিনি নিশ্চেষ্ট তাঁর ভক্তদের পথে পথে পরাভব। ভক্তের অপমানের বিষয় এই যে, অন্যায়কারী শক্তির কাছে সে ভয়ে মাথা করেছে নতুন, সেই সঙ্গে নিজের আরাধ্য দেবতাকে করেছে অশ্রদ্ধেয়। শিবশক্তিকে সে মেনে নিয়েছে অশক্তি বলেই।” (বাংলাভাষা পরিচয়। পরিচ্ছদ ৫। রবীন্দ্র রচনাবলী। সুলভ সংস্করণ। ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৮) “কালান্তর”-এর “বাতায়নিকের পত্র” প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ একই কথা বলেছেন। মালিনী নাটকের সূচনাতেও কবিকঙ্কনের স্বপ্নের প্রসঙ্গ এসেছে। তবে “বাংলা ভাষা পরিচয়” এবং “বাতায়নিকের পত্র”তে এই স্বপ্ন বিশ্লেষিত হয়েছে সমাজতাত্ত্বিক ভঙ্গিতে আর “মালিনী”তে তার বিশ্লেষণের মাত্রা স্বতন্ত্র।

রবীন্দ্রনাথের দুটি ছোটগল্পে আমরা চণ্ডীমঙ্গলের উল্লেখ পাই। গল্প দুটি যথাক্রমে “তারাপ্রসন্নের কীর্তি” এবং “নষ্টনীড়”। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “বাংলা কাব্য পরিচয়” গ্রন্থেও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলের ঘুমপাড়ানি গান (বাছাই আয় রে আয়... ) “মেঘে কৈল অন্ধকার” এবং “বারমাস্যা” (বৈশাখের বসন্ত ঋতু) নামক তিনটি অংশ স্থান পেয়েছে। এই সংকলনে কবিকঙ্কণকে স্থান দেওয়ার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মুকুন্দপ্রীতি খেলায় ধরা পড়েছে।

সহায়ক গ্রন্থ :
১) চণ্ডীমঙ্গল। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত, সুকুমার সেন সম্পাদিত।

২) বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস। শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য।

৩) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ। সুধাংশুশেখর মুখোপাধ্যায়।

back to top