সনোজ কুণ্ডু
মহল্লার রাস্তাটির ওলি-গলির অভাব নেই। কোন রাস্তা কোন দিক গিয়ে ঠেকেছে আন্দাজ করা কঠিন। তবে কাচামাটির সরু রাস্তাটি সবারই চেনা। অজগর সাপের মতো কোমড় বাঁকিয়ে চলে গেছে শোভারামপুর শ্মশানঘাটা কালি মন্দিরের দিকে। এ পথে যারা কোনোদিন পা রাখেনি, তারাও মন্দিরের পথে হন্যে হয়ে ছুটছে। এমন লোমহর্ষক ঘটনা চোখে দেখা দূরে থাক, কানেও কেউ শোনেনি। ঠিক কালি সন্ধ্যায় সেবায়েত গান্ধারীকে কে বা কারা ধর্ষণ করে গলা কেটে হত্যা করেছে। খুনি মুণ্ডটাও সাথে নিয়ে গেছে। রক্তাক্ত উলঙ্গ ধড়টা মন্দিরের মাঝখানে চিৎ হয়ে আছে। মন্দিরের পুরোহিত গুরুদাস ব্যানার্জী এ দৃশ্য দেখে চিৎকার শুরু করে। কাউকে না দেখে দৌড়ে ছুটে যায় টহলরত পুলিশের কাছে। মুহূর্তে মহল্লার মানুষ জড়ো হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে টর্চলাইট হাতে মন্দিরের চারপাশে মুণ্ডটা খোঁজ করে। পুলিশ মহল্লার মানুষের কাছে জানতে চায় তারা কেউ খুনের বিষয়ে কিছু জানে কিনা। ঘটনাস্থলে ছুটে আসে মাস্টার মশাই। মহল্লার মানুষের কাছে তিনি দেবতুল্য। তার কথাতেই মহল্লার মানুষ ওঠে বসে। মাস্টার মশাই থানার দারোগার উদ্দেশ্যে বলেন- ‘দারোগা সাহেব, কিছুক্ষণ আগে আমি মন্দিরের দিকে পায়ে হেঁটে আসছি, তখন তিন মাথা রাস্তায় আমার পাশ দিয়ে একটি ছেলেকে উন্মাদের ম হেঁটে যেতে দেখেছি। মুখে চাপদাঁড়ি। সে বিড়ি টানছিল। ধোঁয়াতে গাঁজার গন্ধ। পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি। গেঞ্জির পেছনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি।’
একজন এস.আই মাস্টার মশাইয়ের এই প্রাথমিক তথ্য গুরুত্বের সাথে নোটবুকে লিখছে। দারোগা সাহেব গান্ধারীর গলাকাটা লাশ জিপে তোলার নির্দেশ দেন। পুরোহিত মশাইকেও তারা থানায় নিয়ে যেতে চায়। কারণ তিনিও সন্দেহের উর্ধে ছিলেন না। কিন্তু থানায় যেতে তার ঘোর আপত্তি। অঝোরে কাঁদছেন। গায়ের রামাবলী চাদর দিয়ে পুরোহিত মশাই চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন-
‘আমি থানায় যাব কেন হুজুর? খুনের বিষয়ে আমি তো কিছুই জানি না!’
‘আপনি ভয় পাবেন না পুরোহিত মশাই। থানায় মামলা করতে হবে যে!’
পুরোহিত মশাই এবার শিরদাড়া সোজা করে বলেন-
‘আমি মামলা করব!’
‘হ্যাঁ, মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে আপনিও যে বাদী হতে পারেন।’
‘না আমি তা পারব না। আর মামলা যদি করতেই হয় একজনের বিরুদ্ধেই করা উচিৎ। যে গান্ধারীর খুনের একমাত্র প্রতক্ষ্যদর্শী।’ সবাই বিস্ফারিত চোখে পুরোহিত মশাইকে দেখে।
‘তাই নাকি? এতক্ষণ বলেননি কেন! তার নামটা বলুন পুরোহিত মশাই?’ দারোগার কণ্ঠে স্বস্তির সংলাপ।
‘পুরোহিত মশাই তর্জনী আঙ্গুল টান টান করে মন্দিরে দাঁড়িয়ে থাকা মা কালীর মূর্তি দেখায়।
‘হ্যাঁ, মামলা যদি করতেই হয় মা কালীর বিরুদ্ধেই করব। যে গান্ধারী আজ দুই যুগ ধরে তার সেবা যত্ন করে আসছে, আজ তারই চোখের সামনে খুনি গান্ধারীকে ধর্ষণ করে খুন করল। মা কালী কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধর্ষণের দৃশ্য উপভোগ করছিল, নাকি গান্ধারীর রক্ত দিয়ে সে স্নান করতে চেয়েছিল বলুন তো?’
খবর পেয়ে সিরাজ ছুটে আসে। প্রথমেই সে মাস্টার মশাইকে পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানায়। সিরাজ মহল্লার নেতা। মাস্টার মশাইর প্রিয় ছাত্র। মহল্লার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী। সবার আপদ-বিপদে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। মহল্লার মানুষের জন্য সে জেলও খেটেছে। এক ডাকে এলাকার সবাই তাকে চেনে। সিরাজ দারোগার উদ্দেশ্যে মিনতির সুরে বলে, ‘যে করেই হোক দারোগা সাহেব, খুনিকে জলদি গ্রেফতার করুন।’
পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যাবার সময় মাস্টার মশাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে যায়, যে কোনো সময় তাকে প্রয়োজন হলে তিনি যেন থানায় আসেন। সবার চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা। দেশের অবস্থা এমনিতেই টালমাটাল। দেশ ভাগের পর ভারত-পাকিস্তান এমনিতেই উত্তপ্ত। বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। সেই রক্তের ঢেউ পূর্ব বাংলাতেও আছড়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘুরা খুন হচ্ছে। দেশ ছেড়েও পালিয়ে যাচ্ছে। এই তিন মাসে এ অঞ্চল থেকেই বহু সংখ্যালঘু পরিবার রাতের অন্ধকারে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। সিরাজ সবাইকে ধৈর্যের সাথে বিপদ মোকাবেলা করার জন্য পরামর্শ দেয়। এই মহল্লা থেকে আর একটি হিন্দু পরিবারও যেন দেশ ত্যাগ না করে সে দিকে খেয়াল রাখার কথা বলে।
সকালেই মহল্লার মানুষ প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হয়। মাস্টার মশাইয়ের নেতৃত্বে গান্ধারী হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করে। পুলিশের উর্ধতন একজন কর্তা খুনিকে গ্রেফতারের বিষয়ে আশ^স্ত করলে আন্দোলনকারীরা স্থান ত্যাগ করে। মানববন্ধনকে সবাই যে বাহবা দিচ্ছে সেটা ভাবাও ভুল। তারই জের এসে পড়ে মাস্টার মশাইয়ের পরিবারের উপর। সন্ধ্যারাতে তাকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তার স্ত্রী তুলসী রানী তখন ঠাকুর ঘরে পুজোয় ব্যস্ত। ঝাঁকে ঝাঁকে উলুধ্বনি দিচ্ছে। পার্টির নেতা ওহাব তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এ বাড়ি আসে। ওদের হাতে হাতে চাকু-ছুরি। ওহাবের হাতে ধারালো খুর। চোখে-মুখে হিংস্রতা। এর আগেই সে দুটি খুনের আসামী ছিল। কিছুদিন জেল খাটার পর কী করে যেন জামিন পেয়ে যায়। ওদের মতিগতি দেখে মাস্টার মশাইর পরানে ধড়ফড় শুরু হয়। গলা শুকিয়ে আসে।
‘শোনেন মাস্টার মশাই, গান্ধারী খুন হবার পরে তিন মাথা পথে আপনি কাকে দেখেছিলেন?’ ওহাব রক্তবর্ণ চোখে বলে।
‘না বাবা, আমি তো কাউকে চিনিনি।’ মাস্টার মশাই শঙ্কিত গলায় বলে।
‘খুব ভাল কথা, আপনি চিনে থাকলেও মুখ ফুটে কিছুই বলবেন না। কারণ আপনি না চিনলেও যাকে দেখেছেন সেও তো আপনাকে চিনতে পারে! যা হোক, আপনি কিছুই দেখেননি। আর মানববন্ধন করে আপনি বড় ভুল করেছেন। গান্ধারী খুন হয়েছে আপনার কী? আজ আপনি খুন হলে কেউ তো প্রতিবাদ করবে না। আপনি কেন করেন? ’
‘ভুলে গেলে ওহাব, একদিন তুমিও কিন্তু আমার ছাত্র ছিলে?’
‘রাখেন আপনার ছাত্র। আগে দেশ। তারপর অন্যকিছু।’
‘আজকাল দেশ রক্ষার দায়িত্বে তাহলে তোমরাও আছ! ভাল!’
ওহাব রেগেমেগে অস্থির। ব্যাগ থেকে একটি নামাজ শিক্ষার বই বের করে তার মাস্টার মশাইকে দেয়।
‘বেঁচে থাকার একটা শেষ সুযোগ আপনাকে দিচ্ছি মাস্টার মশাই। হয় আপনাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। না হয় মরতে হবে। ভেবে দেখুন, আপনি ধর্মান্তরিত হলে মহল্লার সংখ্যালঘু পরিবারগুলো আতঙ্কে থাকবে। তখন আপনার পথেই হাঁটবে নয়তো দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এই বই থেকে আপনি কলেমা তৈয়বা মুখস্থ করবেন। কাল মহিম স্কুল মাঠে মিলাদে আপনাকে দেখতে চাই। সকালে আমার ছেলেরা পাঞ্জাবি, টুপি দিয়ে যাবে।’
সকালেই মহিম স্কুল মাঠে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রোগমুক্তি কামনায় মিলাদ মাহফিল শুরু হয়। মাস্টার মশাই টুপি পাঞ্জাবি পরে সবার সাথে ঠোঁট মিলিয়ে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করার চেষ্টা করেন- ‘ইয়ানবী সালামালাইকা।’ মিলাদ শেষে ওহাব বলে, ‘আপনারা জেনে খুশি হবেন, আমাদের মাস্টার মশাই স্বপরিবারে খুব তাড়াতাড়ি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন। আমি মাস্টার মশাইয়ের নতুন নাম রাখতে চাই আকবর আলী।’
এদিকে পুলিশ বাদী হয়ে গান্ধারী হত্যার মামলা করে। মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান শেষে পুলিশ ওহাবকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। ওহাবের গ্রেফতারের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। মার্কেটের একজন হিন্দু ব্যবসায়ীকে দুর্বৃত্তরা পিটিয়ে হত্যা করে। ওহাব ধৃত হওয়ায় মহল্লার মানুষের ভেতর কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসে।
পাশের বাড়ির আব্বাসের ছোট ছেলে তরু মাস্টার মশাইয়ের ঘরে আসে। প্রতিদিন তুলসীর কণ্ঠের উলুধ্বনি শুনলেই সে এ ঘরে ছুটে আসে। তুলসীকে ধলা আম্মা বলে ডাকে। তরু জানে ধলা আম্মার উলুধ্বনি শেষ হওয়া মানেই পুজো শেষ হয়ে যাওয়া। ঠাকুর ঘরে বসে খুশিমতো নকুলদানা, নারু, ক্ষীর খাওয়া। তরু মাঝে মাঝে তার ধলা আম্মার কাছে আদর্শলিপি বই নিয়ে পড়তেও আসে।
কিন্তু আজ তরুর মুখখানা ভার। মুখে টুঁ শব্দ নেই। বগবগানি নেই। একেবারের শান্ত সুবোধ বালক যেন। কেবল ঠাকুরগুলোর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে। তুলসী নিজেও প্রতিদিন পূজা শেষ হলে ধূপতির পবিত্র ধূপের ধোঁয়া তরুর কপালে মেখে দেয়। তরু ধলা আম্মার কথা শুনে মাঝে মাঝে ঠাকুর ঘরে মাথা ঠেকিয়ে ভক্তিও দেয়। কিন্তু আজ ধূপতিটা তরুর কপালে ধরতে গেলে সে উঠে দাঁড়ায়। রাগে গদগদ করে। একসময় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে- ‘ও ধলা আম্মা, আমার আর নকুলদানা, নারু, ক্ষীর খাওয়া হবে না?’
‘কেন তরু! খাবি না কেন! রোজ খাবি তো!’
‘না তোমরা নাকি মুসলমান হয়ে যাবে। আম্মা বলল।’
তুলসী রানী তরুকে বুকে টেনে শব্দ করেই কেঁদে উঠল।
মাস্টার মশাই মন্দির থেকে ফেরার পথে জাকিরের সাথে দেখা করে। তার শিক্ষকতার জীবনে যত ছাত্র পেয়েছে তার মধ্যে সিরাজ আর জাকির সেরা। দুজনের বি.এ পাস করে সরকারি চাকুরি করছে। জাকির মাস্টার মশাইকে বলে, ‘মাস্টার মশাই, আপনি কেনো মিলাদ মাহফিলে গেলেন? শয়তানেরা বলে বেড়াচ্ছে আপনি নাকি খুব তাড়াতাড়ি ধর্মান্তরিত হবেন।’
মাস্টার মশাই কী এক নিদারুণ ব্যথায় মুষড়ে পড়েন- একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলেন, ‘বাবারে, হিন্দু-মুসলমান সে তো জীবনের চেয়ে বড় কিছু নয়; আগে বেঁচে থাকতে তো দাও!’
‘তবুও আপনি কাজটি ভাল করেনি!’ জাকির বলে।
প্রিয় ছাত্রের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মাস্টার মশাই বলেন- ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো। সর্বনাশটা এখানেই বুঝলে। গোড়ায় গলদ। দেশভাগ তো নয় যেন ধর্ম ভাগ, মানুষ ভাগ। তারা ভাগ করল দেশ, আমরা হারাতে থাকি বাস্তুভিটা! হয়ে পড়ছি শেকড়শূন্য। কী অদ্ভুত বিষয় তাই না!’
‘ঠিক বলেছেন মাস্টার মশাই, দেশ ভাগটা কি খুবই জরুরি ছিল?’ জাকির বলে।
‘ভেবে দেখ জাকির, উগ্রপন্থিরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আজ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের জন্ম দিচ্ছে। হিন্দুরা রাষ্ট্রীয় সেবা সংগঠনের নামে ভারতের লালবাগ, অমৃতস্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। আবার মুসলমানেরা মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সৃষ্টি করে কোহাট, মাসশেরা, পেশোয়ার থেকে হিন্দুদের কচুকাটা করছে। শিয়াল-শকুনে খাচ্ছে তাদের লাশ। স্বাধীনতার নামে আজ সতীত্ব কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে মানবতাকে। রক্তের হোলিখেলায় সবাই যেন মত্ত। শিশুরা হামাগুড়ি দিতে দিতে শিখে যাচ্ছে জাতি ভেদ; হিংসা-বিদ্বেষ।’ মাস্টার মশাইয়ের গমন পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাকিরের দুচোখে জল জমে যায়।
গভীর রাত পর্যন্ত মাস্টার মশাইয়ের চোখে এতটুকু ঘুম নেই। সারাক্ষণ কেবল শঙ্কা। কী যেন কী হয়। দুচোখে একটু তন্দ্রা লেগে এলেই পাহারাদারের খাখাড়ি গলায় আবার লাফিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়িও টহলে আসছে। কিন্তু প্রশাসন কতক্ষণই বা নাগরিকদের রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারে। দিনের পর দিন এই মহল্লা ছেড়ে যাচ্ছে হিন্দুরা। এই শোভারামপুর মহল্লাকে হিন্দুশূন্য করতে একটা মহল বেশ উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের ধারণা, মাস্টার মশাই সব নাটের গুরু। সে নড়ছে না বলেই কিছু হিন্দুরা আঁট-ঘাঁট বেঁধেই বসে আছে। তখনি জানলার ওপ্রান্ত থেকে সিরাজের কণ্ঠ ভেসে আসে। মাস্টার মশাই দরজা খুলে ওদের ঘরে আনে। সাথে জাকিরও আছে। ওদের চোখেমুখে সীমাহীন হতাশা। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে যেন।
‘একটা খারাপ খবর আছে মাস্টার মশাই। আপনি একদম ঘাবড়াবেন না।’ সিরাজ দ্বিধা জড়ানো গলায় বলে।
‘বলো সিরাজ, আমি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত আছি।’
‘সত্যি করে বলুন তো মাস্টার মশাই, গান্ধারী খুন হবার কিছুক্ষণ পর আপনি তিন রাস্তা মোড়ে কাকে দেখেছিলেন?’
মাস্টার মশাই তার প্রিয় ছাত্রদের কাছে আজ যেন কাঠগড়ার আসামী। কী বলবে সে!
‘বলুন মাস্টার মশাই, এর সাথে জড়িয়ে আছে আপনার জীবন।’
‘ঐ বদমাশটা। ওহাব। ওর গেঞ্জিতেই সেদিন জিন্নাহর ছবি দেখেছি!’
‘আপনি যে ওহাবকে দেখেছিলেন, ও কি বুঝতে পেরেছিল?’
‘জানি না।’
‘ওহাবের ধারণা, পুলিশের কাছে আপনি তার নাম বলে দিয়েছেন বলেই সে গ্রেফতার হয়েছে।’
‘কী বলো বাবা, আমি তো কারো নাম বলিনি!’
‘শুনুন মাস্টার মশাই, পার্টির একজন ছেলে আমার বন্ধু। ও আমাকে সব জানিয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে ওহাবকে কোর্টে তুলবে। পুলিশ সাক্ষী হিসেবে আপনাকে কোর্টে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার আগেই পার্টির ছেলেরা আপনাকে খুন করবে। গান্ধারী খুন হবার কিঞ্চিৎ প্রমাণ থাকলেও ওরা সব ধ্বংস করতে চাইবে। এমনিতেই দেশের পরিস্থিতি ভাল না। আপনার খুনটাও দেশের অশান্তির কারণ হিসেবে চালিয়ে দেবে। পুলিশও তাই বিশ্বাস করতে বাধ্য।’
হঠাৎ ঘর থেকে তুলসী রানীর চাপা কান্নার আওয়াজ ওদের কানে ভেসে আসে। মাস্টার মশাই বিষণ্ন চিত্তে বারান্দায় পাতা মাদুরে ধপাস করে বসে পড়লেন।
‘শুনুন মাস্টার মশাই, যেহেতু পুলিশ আপনাকেই সাক্ষী হিসেবে কোর্টে চাইবে- আমাদের ধারণা, সকালেই পুলিশ আপনার নিরাপত্তা দিয়ে তাদের হেফাজতে রাখবে। তার চেয়ে মঙ্গল হবে সেটাই আপনি আজ রাতেই এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। জাকির ব্যাগ থেকে টুপি-পাঞ্জাবি এবং একটি বোরকা বের করে দিয়ে বলে, ‘কাকিমাকে বলবেন, সে যেন হাতের শাখা ভেঙে, সিঁথির সিঁদুর মুছে বোরকা পরে বের হন। মহল্লার বাইরে গেলে তখন কেউ চিনতে পারবে না।’
তুলসী রানী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ঠাকুর ঘরের মাটি ভেজায়। জেলেদের জালের ঘেরে আটকা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ যেমন ছটফট করে মাস্টার মশাইয়ের পরিবারের অবস্থা ঠিক তেমন। হৃদয়টা আঘাতে আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে। এই মুহূর্ত থেকেই তারা যেন শিকড়হীন। বাস্তুহারা। মাস্টার মশাই ভাবে, ওহাবের কথা শোনাই ভাল ছিল। বাস্তুহারা কষ্টের চেয়ে ধর্মান্তরিত হওয়া মন্দ ছিল না। তুলসি রানী হাতের শাখা ভাঙল। কিন্তু নিজ হাতে সিঁথির সিঁদুর সে মুছল না। মাস্টার মশাই নিজ হাতে স্ত্রীর কপালের সিঁদুর ডলে মুছে দিলেন। একটা কৌটায় করে ভিটের একমুষ্টি মাটি নিয়ে ব্যাগে ভরলেন। এই মাটিতে যে বাপ-দাদার পদচিহ্ন রয়েছে।
গভীর রাত পর্যন্ত মাস্টার মশাইয়ের চোখে এতটুকু ঘুম নেই। সারাক্ষণ কেবল শঙ্কা। কী যেন কী হয়। দুচোখে একটু তন্দ্রা লেগে এলেই পাহারাদারের খাখাড়ি গলায় আবার লাফিয়ে ওঠে
মাস্টার মশাইয়ের জীবনটা হুমকির মুখে ভেবে সিরাজের দুচোখে ঘুম ছিল না। শেষরাতে আবার তার কাছে ছুটে আসে।
‘আপনি কোথায় যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলুন মাস্টার মশাই-’
‘কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।’
‘ভারতে চলে যান। সেটাই আপনাদের জন্য মঙ্গল হবে। কারণ দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, ওরা আপনাকে ঠিক খুঁজে বের করবে।’
‘বাবারে, যে দেশেই যাই না কেন আমাদের যে শরণার্থী হয়েই বাঁচতে হবে!’
‘তবুও জীবনটাতো রক্ষা হোক আগে!’
সিরাজ স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে আরও বলে- ‘চলুন, আমি নিজে আপনাদের সীমান্ত পার করে দিয়ে আসব। আমার বন্ধুর একটি খালি ট্রাক আজ শেষরাতেই যশোরের দিকে যাচ্ছে।’ মাস্টার মশাই একধ্যানে তার নিজ হাতে গড়া ছাত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তখন বিদায় গোধূলি। সীমান্ত এলাকায় একটি জঙ্গল বেষ্টিত সরু পথে সিরাজ তার গুরুর হাত ধরে হাঁটছে। মাস্টার মশাই কেঁদে চলেছে একটানা। তার প্রিয় ছাত্রের বিশ^স্ত হাত যেন ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। সিরাজের বুকেও বিচ্ছিন্নতার তোলপাড়। মাথার উপর থেকে বটবৃক্ষটা আজ যেন ধ্বসে পড়ছে। পা ছুঁয়ে মাস্টার মশাইকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। সিরাজের কান্নারত চোখে শেষ দৃষ্টি বিনিময় করে মাস্টার মশাই সীমান্তের ওপারে ডান পা ফেলে মাটি স্পর্শ করলেন। সিরাজ তার মাস্টার মশাইয়ের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে মনে করে জসীম উদ্দীনের ‘বাস্তুভিটা কবিতাটি। যে কবিতা মাস্টার মশাই একদিন ক্লাসে পড়িয়েছেন-
‘দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারির খোঁজ করি,
ফিরে এসো যারা গাঁ ছেড়ে গেছো তরু লতিবার বাঁধে
তোমাদের কত অতীত দিনের মায়া-মমতা কাঁদে।’
সীমান্তে তখন দেশভাগের উত্তেজনা। হিংসার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈন্যদের মধ্যেও। মুহূর্তেই বিকট একটি গুলির শব্দ এলাকা প্রকম্পিত করে। মাস্টার মশাই পেছন ফিরে দেখে, তার প্রিয় ছাত্র সিরাজের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে জবজবে। সে দৌড়ে সিরাজের দিকে ছুটে আসতে চাইল। সিরাজ দম ফাটিয়ে শেষবারের মত চিৎকার করে বলল-
‘খবরদার মাস্টার মশাই, আপনি এদিকে আসবেন না!’
কিছুক্ষণ ছটফট করে সিরাজের রক্তাক্ত দেহটা ধপাস করে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ল।
সনোজ কুণ্ডু
শনিবার, ১৪ আগস্ট ২০২১
মহল্লার রাস্তাটির ওলি-গলির অভাব নেই। কোন রাস্তা কোন দিক গিয়ে ঠেকেছে আন্দাজ করা কঠিন। তবে কাচামাটির সরু রাস্তাটি সবারই চেনা। অজগর সাপের মতো কোমড় বাঁকিয়ে চলে গেছে শোভারামপুর শ্মশানঘাটা কালি মন্দিরের দিকে। এ পথে যারা কোনোদিন পা রাখেনি, তারাও মন্দিরের পথে হন্যে হয়ে ছুটছে। এমন লোমহর্ষক ঘটনা চোখে দেখা দূরে থাক, কানেও কেউ শোনেনি। ঠিক কালি সন্ধ্যায় সেবায়েত গান্ধারীকে কে বা কারা ধর্ষণ করে গলা কেটে হত্যা করেছে। খুনি মুণ্ডটাও সাথে নিয়ে গেছে। রক্তাক্ত উলঙ্গ ধড়টা মন্দিরের মাঝখানে চিৎ হয়ে আছে। মন্দিরের পুরোহিত গুরুদাস ব্যানার্জী এ দৃশ্য দেখে চিৎকার শুরু করে। কাউকে না দেখে দৌড়ে ছুটে যায় টহলরত পুলিশের কাছে। মুহূর্তে মহল্লার মানুষ জড়ো হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে টর্চলাইট হাতে মন্দিরের চারপাশে মুণ্ডটা খোঁজ করে। পুলিশ মহল্লার মানুষের কাছে জানতে চায় তারা কেউ খুনের বিষয়ে কিছু জানে কিনা। ঘটনাস্থলে ছুটে আসে মাস্টার মশাই। মহল্লার মানুষের কাছে তিনি দেবতুল্য। তার কথাতেই মহল্লার মানুষ ওঠে বসে। মাস্টার মশাই থানার দারোগার উদ্দেশ্যে বলেন- ‘দারোগা সাহেব, কিছুক্ষণ আগে আমি মন্দিরের দিকে পায়ে হেঁটে আসছি, তখন তিন মাথা রাস্তায় আমার পাশ দিয়ে একটি ছেলেকে উন্মাদের ম হেঁটে যেতে দেখেছি। মুখে চাপদাঁড়ি। সে বিড়ি টানছিল। ধোঁয়াতে গাঁজার গন্ধ। পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি। গেঞ্জির পেছনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি।’
একজন এস.আই মাস্টার মশাইয়ের এই প্রাথমিক তথ্য গুরুত্বের সাথে নোটবুকে লিখছে। দারোগা সাহেব গান্ধারীর গলাকাটা লাশ জিপে তোলার নির্দেশ দেন। পুরোহিত মশাইকেও তারা থানায় নিয়ে যেতে চায়। কারণ তিনিও সন্দেহের উর্ধে ছিলেন না। কিন্তু থানায় যেতে তার ঘোর আপত্তি। অঝোরে কাঁদছেন। গায়ের রামাবলী চাদর দিয়ে পুরোহিত মশাই চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন-
‘আমি থানায় যাব কেন হুজুর? খুনের বিষয়ে আমি তো কিছুই জানি না!’
‘আপনি ভয় পাবেন না পুরোহিত মশাই। থানায় মামলা করতে হবে যে!’
পুরোহিত মশাই এবার শিরদাড়া সোজা করে বলেন-
‘আমি মামলা করব!’
‘হ্যাঁ, মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে আপনিও যে বাদী হতে পারেন।’
‘না আমি তা পারব না। আর মামলা যদি করতেই হয় একজনের বিরুদ্ধেই করা উচিৎ। যে গান্ধারীর খুনের একমাত্র প্রতক্ষ্যদর্শী।’ সবাই বিস্ফারিত চোখে পুরোহিত মশাইকে দেখে।
‘তাই নাকি? এতক্ষণ বলেননি কেন! তার নামটা বলুন পুরোহিত মশাই?’ দারোগার কণ্ঠে স্বস্তির সংলাপ।
‘পুরোহিত মশাই তর্জনী আঙ্গুল টান টান করে মন্দিরে দাঁড়িয়ে থাকা মা কালীর মূর্তি দেখায়।
‘হ্যাঁ, মামলা যদি করতেই হয় মা কালীর বিরুদ্ধেই করব। যে গান্ধারী আজ দুই যুগ ধরে তার সেবা যত্ন করে আসছে, আজ তারই চোখের সামনে খুনি গান্ধারীকে ধর্ষণ করে খুন করল। মা কালী কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধর্ষণের দৃশ্য উপভোগ করছিল, নাকি গান্ধারীর রক্ত দিয়ে সে স্নান করতে চেয়েছিল বলুন তো?’
খবর পেয়ে সিরাজ ছুটে আসে। প্রথমেই সে মাস্টার মশাইকে পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানায়। সিরাজ মহল্লার নেতা। মাস্টার মশাইর প্রিয় ছাত্র। মহল্লার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী। সবার আপদ-বিপদে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। মহল্লার মানুষের জন্য সে জেলও খেটেছে। এক ডাকে এলাকার সবাই তাকে চেনে। সিরাজ দারোগার উদ্দেশ্যে মিনতির সুরে বলে, ‘যে করেই হোক দারোগা সাহেব, খুনিকে জলদি গ্রেফতার করুন।’
পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যাবার সময় মাস্টার মশাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে যায়, যে কোনো সময় তাকে প্রয়োজন হলে তিনি যেন থানায় আসেন। সবার চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা। দেশের অবস্থা এমনিতেই টালমাটাল। দেশ ভাগের পর ভারত-পাকিস্তান এমনিতেই উত্তপ্ত। বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। সেই রক্তের ঢেউ পূর্ব বাংলাতেও আছড়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘুরা খুন হচ্ছে। দেশ ছেড়েও পালিয়ে যাচ্ছে। এই তিন মাসে এ অঞ্চল থেকেই বহু সংখ্যালঘু পরিবার রাতের অন্ধকারে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। সিরাজ সবাইকে ধৈর্যের সাথে বিপদ মোকাবেলা করার জন্য পরামর্শ দেয়। এই মহল্লা থেকে আর একটি হিন্দু পরিবারও যেন দেশ ত্যাগ না করে সে দিকে খেয়াল রাখার কথা বলে।
সকালেই মহল্লার মানুষ প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হয়। মাস্টার মশাইয়ের নেতৃত্বে গান্ধারী হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করে। পুলিশের উর্ধতন একজন কর্তা খুনিকে গ্রেফতারের বিষয়ে আশ^স্ত করলে আন্দোলনকারীরা স্থান ত্যাগ করে। মানববন্ধনকে সবাই যে বাহবা দিচ্ছে সেটা ভাবাও ভুল। তারই জের এসে পড়ে মাস্টার মশাইয়ের পরিবারের উপর। সন্ধ্যারাতে তাকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তার স্ত্রী তুলসী রানী তখন ঠাকুর ঘরে পুজোয় ব্যস্ত। ঝাঁকে ঝাঁকে উলুধ্বনি দিচ্ছে। পার্টির নেতা ওহাব তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এ বাড়ি আসে। ওদের হাতে হাতে চাকু-ছুরি। ওহাবের হাতে ধারালো খুর। চোখে-মুখে হিংস্রতা। এর আগেই সে দুটি খুনের আসামী ছিল। কিছুদিন জেল খাটার পর কী করে যেন জামিন পেয়ে যায়। ওদের মতিগতি দেখে মাস্টার মশাইর পরানে ধড়ফড় শুরু হয়। গলা শুকিয়ে আসে।
‘শোনেন মাস্টার মশাই, গান্ধারী খুন হবার পরে তিন মাথা পথে আপনি কাকে দেখেছিলেন?’ ওহাব রক্তবর্ণ চোখে বলে।
‘না বাবা, আমি তো কাউকে চিনিনি।’ মাস্টার মশাই শঙ্কিত গলায় বলে।
‘খুব ভাল কথা, আপনি চিনে থাকলেও মুখ ফুটে কিছুই বলবেন না। কারণ আপনি না চিনলেও যাকে দেখেছেন সেও তো আপনাকে চিনতে পারে! যা হোক, আপনি কিছুই দেখেননি। আর মানববন্ধন করে আপনি বড় ভুল করেছেন। গান্ধারী খুন হয়েছে আপনার কী? আজ আপনি খুন হলে কেউ তো প্রতিবাদ করবে না। আপনি কেন করেন? ’
‘ভুলে গেলে ওহাব, একদিন তুমিও কিন্তু আমার ছাত্র ছিলে?’
‘রাখেন আপনার ছাত্র। আগে দেশ। তারপর অন্যকিছু।’
‘আজকাল দেশ রক্ষার দায়িত্বে তাহলে তোমরাও আছ! ভাল!’
ওহাব রেগেমেগে অস্থির। ব্যাগ থেকে একটি নামাজ শিক্ষার বই বের করে তার মাস্টার মশাইকে দেয়।
‘বেঁচে থাকার একটা শেষ সুযোগ আপনাকে দিচ্ছি মাস্টার মশাই। হয় আপনাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। না হয় মরতে হবে। ভেবে দেখুন, আপনি ধর্মান্তরিত হলে মহল্লার সংখ্যালঘু পরিবারগুলো আতঙ্কে থাকবে। তখন আপনার পথেই হাঁটবে নয়তো দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এই বই থেকে আপনি কলেমা তৈয়বা মুখস্থ করবেন। কাল মহিম স্কুল মাঠে মিলাদে আপনাকে দেখতে চাই। সকালে আমার ছেলেরা পাঞ্জাবি, টুপি দিয়ে যাবে।’
সকালেই মহিম স্কুল মাঠে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রোগমুক্তি কামনায় মিলাদ মাহফিল শুরু হয়। মাস্টার মশাই টুপি পাঞ্জাবি পরে সবার সাথে ঠোঁট মিলিয়ে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করার চেষ্টা করেন- ‘ইয়ানবী সালামালাইকা।’ মিলাদ শেষে ওহাব বলে, ‘আপনারা জেনে খুশি হবেন, আমাদের মাস্টার মশাই স্বপরিবারে খুব তাড়াতাড়ি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন। আমি মাস্টার মশাইয়ের নতুন নাম রাখতে চাই আকবর আলী।’
এদিকে পুলিশ বাদী হয়ে গান্ধারী হত্যার মামলা করে। মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান শেষে পুলিশ ওহাবকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। ওহাবের গ্রেফতারের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। মার্কেটের একজন হিন্দু ব্যবসায়ীকে দুর্বৃত্তরা পিটিয়ে হত্যা করে। ওহাব ধৃত হওয়ায় মহল্লার মানুষের ভেতর কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসে।
পাশের বাড়ির আব্বাসের ছোট ছেলে তরু মাস্টার মশাইয়ের ঘরে আসে। প্রতিদিন তুলসীর কণ্ঠের উলুধ্বনি শুনলেই সে এ ঘরে ছুটে আসে। তুলসীকে ধলা আম্মা বলে ডাকে। তরু জানে ধলা আম্মার উলুধ্বনি শেষ হওয়া মানেই পুজো শেষ হয়ে যাওয়া। ঠাকুর ঘরে বসে খুশিমতো নকুলদানা, নারু, ক্ষীর খাওয়া। তরু মাঝে মাঝে তার ধলা আম্মার কাছে আদর্শলিপি বই নিয়ে পড়তেও আসে।
কিন্তু আজ তরুর মুখখানা ভার। মুখে টুঁ শব্দ নেই। বগবগানি নেই। একেবারের শান্ত সুবোধ বালক যেন। কেবল ঠাকুরগুলোর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে। তুলসী নিজেও প্রতিদিন পূজা শেষ হলে ধূপতির পবিত্র ধূপের ধোঁয়া তরুর কপালে মেখে দেয়। তরু ধলা আম্মার কথা শুনে মাঝে মাঝে ঠাকুর ঘরে মাথা ঠেকিয়ে ভক্তিও দেয়। কিন্তু আজ ধূপতিটা তরুর কপালে ধরতে গেলে সে উঠে দাঁড়ায়। রাগে গদগদ করে। একসময় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে- ‘ও ধলা আম্মা, আমার আর নকুলদানা, নারু, ক্ষীর খাওয়া হবে না?’
‘কেন তরু! খাবি না কেন! রোজ খাবি তো!’
‘না তোমরা নাকি মুসলমান হয়ে যাবে। আম্মা বলল।’
তুলসী রানী তরুকে বুকে টেনে শব্দ করেই কেঁদে উঠল।
মাস্টার মশাই মন্দির থেকে ফেরার পথে জাকিরের সাথে দেখা করে। তার শিক্ষকতার জীবনে যত ছাত্র পেয়েছে তার মধ্যে সিরাজ আর জাকির সেরা। দুজনের বি.এ পাস করে সরকারি চাকুরি করছে। জাকির মাস্টার মশাইকে বলে, ‘মাস্টার মশাই, আপনি কেনো মিলাদ মাহফিলে গেলেন? শয়তানেরা বলে বেড়াচ্ছে আপনি নাকি খুব তাড়াতাড়ি ধর্মান্তরিত হবেন।’
মাস্টার মশাই কী এক নিদারুণ ব্যথায় মুষড়ে পড়েন- একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলেন, ‘বাবারে, হিন্দু-মুসলমান সে তো জীবনের চেয়ে বড় কিছু নয়; আগে বেঁচে থাকতে তো দাও!’
‘তবুও আপনি কাজটি ভাল করেনি!’ জাকির বলে।
প্রিয় ছাত্রের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মাস্টার মশাই বলেন- ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো। সর্বনাশটা এখানেই বুঝলে। গোড়ায় গলদ। দেশভাগ তো নয় যেন ধর্ম ভাগ, মানুষ ভাগ। তারা ভাগ করল দেশ, আমরা হারাতে থাকি বাস্তুভিটা! হয়ে পড়ছি শেকড়শূন্য। কী অদ্ভুত বিষয় তাই না!’
‘ঠিক বলেছেন মাস্টার মশাই, দেশ ভাগটা কি খুবই জরুরি ছিল?’ জাকির বলে।
‘ভেবে দেখ জাকির, উগ্রপন্থিরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আজ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের জন্ম দিচ্ছে। হিন্দুরা রাষ্ট্রীয় সেবা সংগঠনের নামে ভারতের লালবাগ, অমৃতস্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। আবার মুসলমানেরা মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সৃষ্টি করে কোহাট, মাসশেরা, পেশোয়ার থেকে হিন্দুদের কচুকাটা করছে। শিয়াল-শকুনে খাচ্ছে তাদের লাশ। স্বাধীনতার নামে আজ সতীত্ব কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে মানবতাকে। রক্তের হোলিখেলায় সবাই যেন মত্ত। শিশুরা হামাগুড়ি দিতে দিতে শিখে যাচ্ছে জাতি ভেদ; হিংসা-বিদ্বেষ।’ মাস্টার মশাইয়ের গমন পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাকিরের দুচোখে জল জমে যায়।
গভীর রাত পর্যন্ত মাস্টার মশাইয়ের চোখে এতটুকু ঘুম নেই। সারাক্ষণ কেবল শঙ্কা। কী যেন কী হয়। দুচোখে একটু তন্দ্রা লেগে এলেই পাহারাদারের খাখাড়ি গলায় আবার লাফিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়িও টহলে আসছে। কিন্তু প্রশাসন কতক্ষণই বা নাগরিকদের রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারে। দিনের পর দিন এই মহল্লা ছেড়ে যাচ্ছে হিন্দুরা। এই শোভারামপুর মহল্লাকে হিন্দুশূন্য করতে একটা মহল বেশ উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের ধারণা, মাস্টার মশাই সব নাটের গুরু। সে নড়ছে না বলেই কিছু হিন্দুরা আঁট-ঘাঁট বেঁধেই বসে আছে। তখনি জানলার ওপ্রান্ত থেকে সিরাজের কণ্ঠ ভেসে আসে। মাস্টার মশাই দরজা খুলে ওদের ঘরে আনে। সাথে জাকিরও আছে। ওদের চোখেমুখে সীমাহীন হতাশা। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে যেন।
‘একটা খারাপ খবর আছে মাস্টার মশাই। আপনি একদম ঘাবড়াবেন না।’ সিরাজ দ্বিধা জড়ানো গলায় বলে।
‘বলো সিরাজ, আমি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত আছি।’
‘সত্যি করে বলুন তো মাস্টার মশাই, গান্ধারী খুন হবার কিছুক্ষণ পর আপনি তিন রাস্তা মোড়ে কাকে দেখেছিলেন?’
মাস্টার মশাই তার প্রিয় ছাত্রদের কাছে আজ যেন কাঠগড়ার আসামী। কী বলবে সে!
‘বলুন মাস্টার মশাই, এর সাথে জড়িয়ে আছে আপনার জীবন।’
‘ঐ বদমাশটা। ওহাব। ওর গেঞ্জিতেই সেদিন জিন্নাহর ছবি দেখেছি!’
‘আপনি যে ওহাবকে দেখেছিলেন, ও কি বুঝতে পেরেছিল?’
‘জানি না।’
‘ওহাবের ধারণা, পুলিশের কাছে আপনি তার নাম বলে দিয়েছেন বলেই সে গ্রেফতার হয়েছে।’
‘কী বলো বাবা, আমি তো কারো নাম বলিনি!’
‘শুনুন মাস্টার মশাই, পার্টির একজন ছেলে আমার বন্ধু। ও আমাকে সব জানিয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে ওহাবকে কোর্টে তুলবে। পুলিশ সাক্ষী হিসেবে আপনাকে কোর্টে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার আগেই পার্টির ছেলেরা আপনাকে খুন করবে। গান্ধারী খুন হবার কিঞ্চিৎ প্রমাণ থাকলেও ওরা সব ধ্বংস করতে চাইবে। এমনিতেই দেশের পরিস্থিতি ভাল না। আপনার খুনটাও দেশের অশান্তির কারণ হিসেবে চালিয়ে দেবে। পুলিশও তাই বিশ্বাস করতে বাধ্য।’
হঠাৎ ঘর থেকে তুলসী রানীর চাপা কান্নার আওয়াজ ওদের কানে ভেসে আসে। মাস্টার মশাই বিষণ্ন চিত্তে বারান্দায় পাতা মাদুরে ধপাস করে বসে পড়লেন।
‘শুনুন মাস্টার মশাই, যেহেতু পুলিশ আপনাকেই সাক্ষী হিসেবে কোর্টে চাইবে- আমাদের ধারণা, সকালেই পুলিশ আপনার নিরাপত্তা দিয়ে তাদের হেফাজতে রাখবে। তার চেয়ে মঙ্গল হবে সেটাই আপনি আজ রাতেই এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। জাকির ব্যাগ থেকে টুপি-পাঞ্জাবি এবং একটি বোরকা বের করে দিয়ে বলে, ‘কাকিমাকে বলবেন, সে যেন হাতের শাখা ভেঙে, সিঁথির সিঁদুর মুছে বোরকা পরে বের হন। মহল্লার বাইরে গেলে তখন কেউ চিনতে পারবে না।’
তুলসী রানী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ঠাকুর ঘরের মাটি ভেজায়। জেলেদের জালের ঘেরে আটকা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ যেমন ছটফট করে মাস্টার মশাইয়ের পরিবারের অবস্থা ঠিক তেমন। হৃদয়টা আঘাতে আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে। এই মুহূর্ত থেকেই তারা যেন শিকড়হীন। বাস্তুহারা। মাস্টার মশাই ভাবে, ওহাবের কথা শোনাই ভাল ছিল। বাস্তুহারা কষ্টের চেয়ে ধর্মান্তরিত হওয়া মন্দ ছিল না। তুলসি রানী হাতের শাখা ভাঙল। কিন্তু নিজ হাতে সিঁথির সিঁদুর সে মুছল না। মাস্টার মশাই নিজ হাতে স্ত্রীর কপালের সিঁদুর ডলে মুছে দিলেন। একটা কৌটায় করে ভিটের একমুষ্টি মাটি নিয়ে ব্যাগে ভরলেন। এই মাটিতে যে বাপ-দাদার পদচিহ্ন রয়েছে।
গভীর রাত পর্যন্ত মাস্টার মশাইয়ের চোখে এতটুকু ঘুম নেই। সারাক্ষণ কেবল শঙ্কা। কী যেন কী হয়। দুচোখে একটু তন্দ্রা লেগে এলেই পাহারাদারের খাখাড়ি গলায় আবার লাফিয়ে ওঠে
মাস্টার মশাইয়ের জীবনটা হুমকির মুখে ভেবে সিরাজের দুচোখে ঘুম ছিল না। শেষরাতে আবার তার কাছে ছুটে আসে।
‘আপনি কোথায় যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলুন মাস্টার মশাই-’
‘কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।’
‘ভারতে চলে যান। সেটাই আপনাদের জন্য মঙ্গল হবে। কারণ দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, ওরা আপনাকে ঠিক খুঁজে বের করবে।’
‘বাবারে, যে দেশেই যাই না কেন আমাদের যে শরণার্থী হয়েই বাঁচতে হবে!’
‘তবুও জীবনটাতো রক্ষা হোক আগে!’
সিরাজ স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে আরও বলে- ‘চলুন, আমি নিজে আপনাদের সীমান্ত পার করে দিয়ে আসব। আমার বন্ধুর একটি খালি ট্রাক আজ শেষরাতেই যশোরের দিকে যাচ্ছে।’ মাস্টার মশাই একধ্যানে তার নিজ হাতে গড়া ছাত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তখন বিদায় গোধূলি। সীমান্ত এলাকায় একটি জঙ্গল বেষ্টিত সরু পথে সিরাজ তার গুরুর হাত ধরে হাঁটছে। মাস্টার মশাই কেঁদে চলেছে একটানা। তার প্রিয় ছাত্রের বিশ^স্ত হাত যেন ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। সিরাজের বুকেও বিচ্ছিন্নতার তোলপাড়। মাথার উপর থেকে বটবৃক্ষটা আজ যেন ধ্বসে পড়ছে। পা ছুঁয়ে মাস্টার মশাইকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। সিরাজের কান্নারত চোখে শেষ দৃষ্টি বিনিময় করে মাস্টার মশাই সীমান্তের ওপারে ডান পা ফেলে মাটি স্পর্শ করলেন। সিরাজ তার মাস্টার মশাইয়ের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে মনে করে জসীম উদ্দীনের ‘বাস্তুভিটা কবিতাটি। যে কবিতা মাস্টার মশাই একদিন ক্লাসে পড়িয়েছেন-
‘দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারির খোঁজ করি,
ফিরে এসো যারা গাঁ ছেড়ে গেছো তরু লতিবার বাঁধে
তোমাদের কত অতীত দিনের মায়া-মমতা কাঁদে।’
সীমান্তে তখন দেশভাগের উত্তেজনা। হিংসার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈন্যদের মধ্যেও। মুহূর্তেই বিকট একটি গুলির শব্দ এলাকা প্রকম্পিত করে। মাস্টার মশাই পেছন ফিরে দেখে, তার প্রিয় ছাত্র সিরাজের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে জবজবে। সে দৌড়ে সিরাজের দিকে ছুটে আসতে চাইল। সিরাজ দম ফাটিয়ে শেষবারের মত চিৎকার করে বলল-
‘খবরদার মাস্টার মশাই, আপনি এদিকে আসবেন না!’
কিছুক্ষণ ছটফট করে সিরাজের রক্তাক্ত দেহটা ধপাস করে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ল।