সরকার মাসুদ
গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েন সেই বিরল লেখকদের একজন যিনি কবিতার জন্য দু’দু’বার গভর্নর জেনারেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এটা অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কার। গুয়েনডলিন শুধু কবি নন, একজন প্রথম শ্রেণির কথাসাহিত্যিকও। ষাটের প্রজন্মের এই কানাডীয় সাহিত্যিক তাঁর সময়ের এক অগ্রদূত ভাবুক।
বয়স কুড়ি বছর হওয়ার অনেক আগেই তরুণী গুয়েনডলিন কবিত্বের স্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ১৯৬১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরুনোর মাধ্যমে সেই পরিচয় গাঢ়ত্ব লাভ করে। একই বছর প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত কথাশিল্পী ও কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কাব্যগ্রন্থও। ১৯৬৩ সালে তেইশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। এর আট বছর পর ১৯৭১-এ বেরোয় King of Egypt, King of Dreams নামের উপন্যাস। এই বইটিতে আমরা কথাসাহিত্যিক গুয়েনডলিনকে বেশ ভালোভাবেই পাই। প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে, লেখকের মাতৃভাষা ইংরেজি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি দুর্মর আকর্ষণের কারণে তিনি হিব্রু ভাষা শেখেন এবং ওই ভাষার সাহিত্য পড়েন। রোজমেরি সুলিভান রচিত জীবনী Shadow maker : The life of gwendolyn Mac-Ewen থেকে জানা গেছে, হাইস্কুলের ওপরের ক্লাসে পড়ার সময় এক আবর সহপাঠী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের বন্ধুত্ব এতটাই ভালো ছিল যে, গুয়েনডলিন ওই বন্ধুর কথায় প্রভাবিত হয়ে কুরআন পাঠ করেছিলেন। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যে নেতিবাচক পরিবর্তন আসে গুয়েন তাঁর এক নিবিড় পর্যবেক্ষক। তাছাড়া মিসর, মিসরের প্রাচীনকালের রাজা-রাণী, পিরামিড এসবের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। এই সবকিছুই তাঁর কবিতার ভাবনা ও ভাষা নির্মাণের পেছনে দান রেখেছে। অকালপ্রয়াত গুয়েনডলিন ম্যাকইয়েনকে কানাডার আধুনিক কবিতার একজন স্থপতি মনে করা হয়ে থাকে।
Jan Bartley তাঁর সম্বন্ধে Sophisticated, সমালোচক Wide-ranging and thoughtful, শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। গুয়েনডলিনের ছাব্বিশ বছরের সাহিত্যিক জীবনের ফসল ১৪টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধের বই ও শিশুদের বই ৩টি। এছাড়া তিনি অনুবাদ করেছিলেন ইউরিপিডিস ও অ্যারিস্টোফেনিসের নাটক। ১৯৮৫ সালে Noman’s Land নামে যে উপন্যাসটি বেরিয়েছিল সেটা তাঁকে কথাশিল্পী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর কথাসাহিত্যচর্চার আরম্ভ মোটামুটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময়েই। ১৯৮১-৮২ সাল নাগাদ তাঁকে সব্যসাচী লেখকের বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম After worlds, এই বইয়ের You can study It if you wan’t কবিতায় ‘তুমি লেখ কেন’ এই আত্মপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন Poetry has nothing to do with poetry/Poetry is how the air goes green before thunder/is the sound you make when, and/the sound you make on don’t when you die. ওই যে তিনি লিখেছেন ‘বজ্রপাতের আগে বাতাস কেমন সবুজ হয়ে ওঠে’ সেটাই কবিতা। ব্যতিক্রমী ভাবনা, কখনো কখনো বিস্ময়কর চিন্তা লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায়-
১. ‘তুমি যখন খোলা প্রান্তরের দিকে তাকাও, আবার লক্ষ্য করো/বলছি না তোমাকে মানচিত্র পুড়িয়ে ফেলতে হবে/আমি বলতে চাই সেই মুহূর্তটির কথা যখন ওই ভূমিকে খুব সমতল দেখায়/আর এতো সেই সময় যখন তোমাকে আবার শুরু করতেই হবে’।
২. ‘ঈশ্বর উন্মাদ ছিলেন শুরুতে আর তিনি তা জানতেন/একটুও সাবধান হননি তিনি অতিকায়/ব্রহ্মা-জুড়ে বীর্য উপচে পড়তে দিয়েছেন হায়’
৩. ‘যে বিষয়গুলোকে এযাবৎ গুরুত্ব দিয়েছি/আর তোমারও উচিত যেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া/তা হচ্ছে, কী ঘটে যায় তুমি যখন বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে চোখ সরিয়ে নাও’।
ওপরের উদ্ধৃতি তিনটি থেকে, আশা করি, পাঠক একটু হলেও গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েনের ভাবনা-কল্পনা সম্বন্ধে ধারণা পেয়েছেন। এই কবি শুধু ভিন্ন ধরনের চিত্রকল্প, উপমা, ইঙ্গিত ও বাকপ্রতিমা সৃষ্টি করেনননি। তাঁর কাব্যের ভুবনকে মিথ-এর কুহেলী দিয়েও সাজিয়েছেন। বিষয়টি তাঁর কবিতার প্রতি আকর্ষণের আরেক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। লেখক নিজের জীবনকে মিথে পরিণত করেননি; বরং মিথ-এর রহস্য ও স্বপ্নকল্পনাকে জীবনে যুক্ত করে জীবনকে অনন্য করে তুলতে পেরেছেন। মধ্যপ্রাচ্য, মিসর, সিরিয়া প্রভৃতির প্রতি তাঁর যে অনুরাগ সেটার সঙ্গে ওই মিথ ব্যাপারটার যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ। The Arabs say that when you pray, two angels stand/On either side of you. recording good and bad deeds, /and you should acknowledge the./Lying here, I decide that now/ The world can have me any way it pleases./ I will celebrate my perfect death here. আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস এই কবিতায় বিধৃত হয়েছে লেখকের অননুকরণীয় কাব্যভাষায়। গুয়েনডলিন তাঁর কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর সুস্পষ্টভাবে মুদ্রিত করতে পেরেছিলেন The Rising Fire (১৯৬৩) গ্রন্থে। তাঁর সবচেয়ে প্রশংসিত গ্রন্থ মনে করা হয়। Shadow Maker-কে। Shadow... এবং After worlds-এর মাঝখানে চারটা উল্লেখযোগ্য বই আছে। সেগুলো হচ্ছে, The armies of the moon (1972), Magic animals : selected Paems : old and new (1974), The Fire eaters (1982) I The man with three violines (1986).
প্রথম উপন্যাস জুলিয়ান দ্য ম্যাজিশিয়ান (১৯৬৩) পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। সেটা সম্ভব হয়েছে ‘কিং প্রকাশিত ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’-এ আমরা পাচ্ছি পরিণত এক কথাকোবিদকে, অভিজ্ঞতা ও শৈলী দুদিক থেকেই।
বারবার মনে পড়ে ‘জেনেসিস’ নামের সেই কবিতাটা যেখানে ঈশ্বরের গোড়ার দিকের সময় নিয়ে অদ্ভুত কবিকল্পনার জাল বুনেছেন কবি। লেখাটি Magic Animals... কাব্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। আর Discovery নামে ওই একই গ্রন্থে একটি কবিতা আছে। সেখানেই তো বলা হয়েছে ‘আমি বোঝাতে চাইছি সেই মুহূর্তটি যখন তোমাকে আবার শুরু করতেই হবে।’ অনূর্ধ্ব চৌত্রিশ বছর বয়সে ওয়েনডলিনের ভাবুকতা এরকম প্রত্যয়ী দার্শনিকতার স্তরে পৌঁছাতে পেরেছিল। চল্লিশের ঘরে পৌঁছানোর পর তা হয়ে উঠেছিল যথেষ্ট পরিপক্ব। Dark Pines Under water কবিতাটি তার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। প্রথম স্তবকটি পড়–ন (This Land Like a mirror turns yos inward/And you become a forest in a furtive lake;/ The dark pines of your mind reach’ downward, /you dream in the green of your time, /your memory is a row of sinking pines.) ইংরেজিটা মোটামুটি সুবোধ্য। সেজন্য এই অংশটির অনুবাদ করলাম না। এতে করে পাঠক গুয়েনডলিনের কবিতার ভাষাসৌন্দর্য ধরতে পারবেন। উচ্চারণের আট-পৌঢ়ে ভঙ্গির মধ্য দিয়েই কাব্যের ভাষারহস্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর অনেক কৃতী কবি। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে তারাপদ রায় ও AR Ammons এর কথা। গুয়েনডলিনের কিছু কবিতা ওই জাতের। একটা উদাহরণ দিচ্ছি- You cannot do this to them, these are my people;/ Iam not speaking of poetry, Iam not speaking of art./ You can not do this to them, these are my people./you cannot hack away the horizon in fornt of their eyes, (you can not do this) এই কবিতার তৃতীয় ও শেষ স্তবকের শুরুতে বলা হয়েছে- it has something to do with horses/ and signet rings and school trophies;/it has something to do with pride of the loins; এ পর্যায়ে এসে রচনাটি রহস্যময়তার ভেতর থেকেও এক বা একাধিক অর্থ পরিবেশন করে। লক্ষ করুন শক্তি ও সৌন্দয়ের প্রতীক horse এবং যৌন উত্তেজক অঙ্গ-প্রতঙ্গ বোধক loins শব্দ দুটির অনন্য প্রয়োগ।
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তিন দশকে আধুনিক সাহিত্যের যে বিচিত্র ও ঋদ্ধ রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তারই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যময় প্রকাশ দেখতে পাই গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েনের কবিতা কথাসাহিত্যে।
তাঁর ছেচল্লিশ বছরের অত্যন্ত সৃষ্টিশীল জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৮৭ সালে। রোজমেরির জীবনী থেকে জানতে পারি, মৃত্যুর ঠিক আগের এক সপ্তাহে গুয়েনডলিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন সকলের কাছ থেকে। রুবেন নামের এক বন্ধু ৩০ নভেম্বর তাঁর বাসায় যান। দরজায় আঘাত করার পরেও কেউ সাড়া না দেয়ায় তিনি দরজা খোলার ব্যবস্থা করেন। দেখা যায় গুয়েনডলিন তাঁর বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে পড়ে আছেন। ডাক্তার ডাকার জন্য ফোন করতে গিয়ে রুবেন বুঝতে পারেন ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। আর তিনি দেখেছেন গুয়েনডলিনের শরীর ভয়ানক শীতল।
King of Egypt, King of Dreams উপন্যাসের এক স্থানে লেখক বলছেন, ‘মরে যাওয়া খুব সোজা- এত সোজা যে আমরা ভাবতেও পারি না। আমি যদি উপোস থাকি, যদি শরীরটাকে ক্রমে ক্রমে ধ্বংস হতে দিই এবং মোমবাতির মতো ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলি নিজেকে তাহলেই হবে। আমার এই অধিকার থেকে আমাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না।’
এতটুকু পড়ার পর মানিক কথিত ‘আত্মহত্যার অধিকার’ শব্দবন্ধটি তীব্রভাবে মনে আসে। হ্যাঁ গুয়েনডলিনকে সেই অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত করতে পারেননি। পারলে কী ঘটতো আমরা জানি না। আমরা কেবল জানি, তার মৃত্যু সম্পর্কিত ডাক্তারি রিপোর্ট লেখা ছিল-
Couses of death : Metabolic Aciodosis, resulting from a recent history of bing drinking and no food intake।
মৃত্যুর ছয় বছর পর ১৯৯৩ সালে মার্গারেট অ্যাটউড ও বেরি কালাহানের সম্পাদনায় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েনের কবিতা সমগ্র। কাব্যবোধ ও লিখনরীতি উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ব্যতিক্রমী স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। কানাডার প্রধান কবিদের পাশাপাশি তাঁর নামটিও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে আসছে। জীবনী তো লেখা হয়েছেই; তাঁকে নিয়ে ‘মাইটিও কস’ নামের একটা উপন্যাসও লেখা হয়েছে। মার্গারেট অ্যাটউডেরও এক গল্পের উপজীব্য হয়েছেন গুয়েনডলিন। অন্য অনেক কিছুর সমান্তরালে এই লেখক মৃত্যু নিয়ে ভেবেছেন বারবার। অল্প বয়সে রচিত পুস্তক The pising Fire কাব্যগ্রন্থেও এ বিষয়ে ভাবঋদ্ধ কবিতা আছে। সেই মৃত্যুকেই তিনি বরণ করে নিয়েছেন বেপরোয়ার মতো। এ অকাল প্রয়াণ আমাদের ব্যথিত করে, কেননা তিনি তো সেই লেখক যাকে দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল Afterworlds বইটির জন্য।
সরকার মাসুদ
রোববার, ২২ আগস্ট ২০২১
গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েন সেই বিরল লেখকদের একজন যিনি কবিতার জন্য দু’দু’বার গভর্নর জেনারেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এটা অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কার। গুয়েনডলিন শুধু কবি নন, একজন প্রথম শ্রেণির কথাসাহিত্যিকও। ষাটের প্রজন্মের এই কানাডীয় সাহিত্যিক তাঁর সময়ের এক অগ্রদূত ভাবুক।
বয়স কুড়ি বছর হওয়ার অনেক আগেই তরুণী গুয়েনডলিন কবিত্বের স্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ১৯৬১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরুনোর মাধ্যমে সেই পরিচয় গাঢ়ত্ব লাভ করে। একই বছর প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত কথাশিল্পী ও কবি মার্গারেট অ্যাটউডের কাব্যগ্রন্থও। ১৯৬৩ সালে তেইশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। এর আট বছর পর ১৯৭১-এ বেরোয় King of Egypt, King of Dreams নামের উপন্যাস। এই বইটিতে আমরা কথাসাহিত্যিক গুয়েনডলিনকে বেশ ভালোভাবেই পাই। প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে, লেখকের মাতৃভাষা ইংরেজি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি দুর্মর আকর্ষণের কারণে তিনি হিব্রু ভাষা শেখেন এবং ওই ভাষার সাহিত্য পড়েন। রোজমেরি সুলিভান রচিত জীবনী Shadow maker : The life of gwendolyn Mac-Ewen থেকে জানা গেছে, হাইস্কুলের ওপরের ক্লাসে পড়ার সময় এক আবর সহপাঠী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের বন্ধুত্ব এতটাই ভালো ছিল যে, গুয়েনডলিন ওই বন্ধুর কথায় প্রভাবিত হয়ে কুরআন পাঠ করেছিলেন। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যে নেতিবাচক পরিবর্তন আসে গুয়েন তাঁর এক নিবিড় পর্যবেক্ষক। তাছাড়া মিসর, মিসরের প্রাচীনকালের রাজা-রাণী, পিরামিড এসবের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। এই সবকিছুই তাঁর কবিতার ভাবনা ও ভাষা নির্মাণের পেছনে দান রেখেছে। অকালপ্রয়াত গুয়েনডলিন ম্যাকইয়েনকে কানাডার আধুনিক কবিতার একজন স্থপতি মনে করা হয়ে থাকে।
Jan Bartley তাঁর সম্বন্ধে Sophisticated, সমালোচক Wide-ranging and thoughtful, শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। গুয়েনডলিনের ছাব্বিশ বছরের সাহিত্যিক জীবনের ফসল ১৪টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধের বই ও শিশুদের বই ৩টি। এছাড়া তিনি অনুবাদ করেছিলেন ইউরিপিডিস ও অ্যারিস্টোফেনিসের নাটক। ১৯৮৫ সালে Noman’s Land নামে যে উপন্যাসটি বেরিয়েছিল সেটা তাঁকে কথাশিল্পী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর কথাসাহিত্যচর্চার আরম্ভ মোটামুটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময়েই। ১৯৮১-৮২ সাল নাগাদ তাঁকে সব্যসাচী লেখকের বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম After worlds, এই বইয়ের You can study It if you wan’t কবিতায় ‘তুমি লেখ কেন’ এই আত্মপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন Poetry has nothing to do with poetry/Poetry is how the air goes green before thunder/is the sound you make when, and/the sound you make on don’t when you die. ওই যে তিনি লিখেছেন ‘বজ্রপাতের আগে বাতাস কেমন সবুজ হয়ে ওঠে’ সেটাই কবিতা। ব্যতিক্রমী ভাবনা, কখনো কখনো বিস্ময়কর চিন্তা লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায়-
১. ‘তুমি যখন খোলা প্রান্তরের দিকে তাকাও, আবার লক্ষ্য করো/বলছি না তোমাকে মানচিত্র পুড়িয়ে ফেলতে হবে/আমি বলতে চাই সেই মুহূর্তটির কথা যখন ওই ভূমিকে খুব সমতল দেখায়/আর এতো সেই সময় যখন তোমাকে আবার শুরু করতেই হবে’।
২. ‘ঈশ্বর উন্মাদ ছিলেন শুরুতে আর তিনি তা জানতেন/একটুও সাবধান হননি তিনি অতিকায়/ব্রহ্মা-জুড়ে বীর্য উপচে পড়তে দিয়েছেন হায়’
৩. ‘যে বিষয়গুলোকে এযাবৎ গুরুত্ব দিয়েছি/আর তোমারও উচিত যেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া/তা হচ্ছে, কী ঘটে যায় তুমি যখন বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে চোখ সরিয়ে নাও’।
ওপরের উদ্ধৃতি তিনটি থেকে, আশা করি, পাঠক একটু হলেও গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েনের ভাবনা-কল্পনা সম্বন্ধে ধারণা পেয়েছেন। এই কবি শুধু ভিন্ন ধরনের চিত্রকল্প, উপমা, ইঙ্গিত ও বাকপ্রতিমা সৃষ্টি করেনননি। তাঁর কাব্যের ভুবনকে মিথ-এর কুহেলী দিয়েও সাজিয়েছেন। বিষয়টি তাঁর কবিতার প্রতি আকর্ষণের আরেক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। লেখক নিজের জীবনকে মিথে পরিণত করেননি; বরং মিথ-এর রহস্য ও স্বপ্নকল্পনাকে জীবনে যুক্ত করে জীবনকে অনন্য করে তুলতে পেরেছেন। মধ্যপ্রাচ্য, মিসর, সিরিয়া প্রভৃতির প্রতি তাঁর যে অনুরাগ সেটার সঙ্গে ওই মিথ ব্যাপারটার যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ। The Arabs say that when you pray, two angels stand/On either side of you. recording good and bad deeds, /and you should acknowledge the./Lying here, I decide that now/ The world can have me any way it pleases./ I will celebrate my perfect death here. আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস এই কবিতায় বিধৃত হয়েছে লেখকের অননুকরণীয় কাব্যভাষায়। গুয়েনডলিন তাঁর কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর সুস্পষ্টভাবে মুদ্রিত করতে পেরেছিলেন The Rising Fire (১৯৬৩) গ্রন্থে। তাঁর সবচেয়ে প্রশংসিত গ্রন্থ মনে করা হয়। Shadow Maker-কে। Shadow... এবং After worlds-এর মাঝখানে চারটা উল্লেখযোগ্য বই আছে। সেগুলো হচ্ছে, The armies of the moon (1972), Magic animals : selected Paems : old and new (1974), The Fire eaters (1982) I The man with three violines (1986).
প্রথম উপন্যাস জুলিয়ান দ্য ম্যাজিশিয়ান (১৯৬৩) পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। সেটা সম্ভব হয়েছে ‘কিং প্রকাশিত ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’-এ আমরা পাচ্ছি পরিণত এক কথাকোবিদকে, অভিজ্ঞতা ও শৈলী দুদিক থেকেই।
বারবার মনে পড়ে ‘জেনেসিস’ নামের সেই কবিতাটা যেখানে ঈশ্বরের গোড়ার দিকের সময় নিয়ে অদ্ভুত কবিকল্পনার জাল বুনেছেন কবি। লেখাটি Magic Animals... কাব্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। আর Discovery নামে ওই একই গ্রন্থে একটি কবিতা আছে। সেখানেই তো বলা হয়েছে ‘আমি বোঝাতে চাইছি সেই মুহূর্তটি যখন তোমাকে আবার শুরু করতেই হবে।’ অনূর্ধ্ব চৌত্রিশ বছর বয়সে ওয়েনডলিনের ভাবুকতা এরকম প্রত্যয়ী দার্শনিকতার স্তরে পৌঁছাতে পেরেছিল। চল্লিশের ঘরে পৌঁছানোর পর তা হয়ে উঠেছিল যথেষ্ট পরিপক্ব। Dark Pines Under water কবিতাটি তার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। প্রথম স্তবকটি পড়–ন (This Land Like a mirror turns yos inward/And you become a forest in a furtive lake;/ The dark pines of your mind reach’ downward, /you dream in the green of your time, /your memory is a row of sinking pines.) ইংরেজিটা মোটামুটি সুবোধ্য। সেজন্য এই অংশটির অনুবাদ করলাম না। এতে করে পাঠক গুয়েনডলিনের কবিতার ভাষাসৌন্দর্য ধরতে পারবেন। উচ্চারণের আট-পৌঢ়ে ভঙ্গির মধ্য দিয়েই কাব্যের ভাষারহস্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর অনেক কৃতী কবি। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে তারাপদ রায় ও AR Ammons এর কথা। গুয়েনডলিনের কিছু কবিতা ওই জাতের। একটা উদাহরণ দিচ্ছি- You cannot do this to them, these are my people;/ Iam not speaking of poetry, Iam not speaking of art./ You can not do this to them, these are my people./you cannot hack away the horizon in fornt of their eyes, (you can not do this) এই কবিতার তৃতীয় ও শেষ স্তবকের শুরুতে বলা হয়েছে- it has something to do with horses/ and signet rings and school trophies;/it has something to do with pride of the loins; এ পর্যায়ে এসে রচনাটি রহস্যময়তার ভেতর থেকেও এক বা একাধিক অর্থ পরিবেশন করে। লক্ষ করুন শক্তি ও সৌন্দয়ের প্রতীক horse এবং যৌন উত্তেজক অঙ্গ-প্রতঙ্গ বোধক loins শব্দ দুটির অনন্য প্রয়োগ।
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তিন দশকে আধুনিক সাহিত্যের যে বিচিত্র ও ঋদ্ধ রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তারই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যময় প্রকাশ দেখতে পাই গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েনের কবিতা কথাসাহিত্যে।
তাঁর ছেচল্লিশ বছরের অত্যন্ত সৃষ্টিশীল জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৮৭ সালে। রোজমেরির জীবনী থেকে জানতে পারি, মৃত্যুর ঠিক আগের এক সপ্তাহে গুয়েনডলিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন সকলের কাছ থেকে। রুবেন নামের এক বন্ধু ৩০ নভেম্বর তাঁর বাসায় যান। দরজায় আঘাত করার পরেও কেউ সাড়া না দেয়ায় তিনি দরজা খোলার ব্যবস্থা করেন। দেখা যায় গুয়েনডলিন তাঁর বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে পড়ে আছেন। ডাক্তার ডাকার জন্য ফোন করতে গিয়ে রুবেন বুঝতে পারেন ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। আর তিনি দেখেছেন গুয়েনডলিনের শরীর ভয়ানক শীতল।
King of Egypt, King of Dreams উপন্যাসের এক স্থানে লেখক বলছেন, ‘মরে যাওয়া খুব সোজা- এত সোজা যে আমরা ভাবতেও পারি না। আমি যদি উপোস থাকি, যদি শরীরটাকে ক্রমে ক্রমে ধ্বংস হতে দিই এবং মোমবাতির মতো ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলি নিজেকে তাহলেই হবে। আমার এই অধিকার থেকে আমাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না।’
এতটুকু পড়ার পর মানিক কথিত ‘আত্মহত্যার অধিকার’ শব্দবন্ধটি তীব্রভাবে মনে আসে। হ্যাঁ গুয়েনডলিনকে সেই অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত করতে পারেননি। পারলে কী ঘটতো আমরা জানি না। আমরা কেবল জানি, তার মৃত্যু সম্পর্কিত ডাক্তারি রিপোর্ট লেখা ছিল-
Couses of death : Metabolic Aciodosis, resulting from a recent history of bing drinking and no food intake।
মৃত্যুর ছয় বছর পর ১৯৯৩ সালে মার্গারেট অ্যাটউড ও বেরি কালাহানের সম্পাদনায় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় গুয়েনডলিন ম্যাকইওয়েনের কবিতা সমগ্র। কাব্যবোধ ও লিখনরীতি উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ব্যতিক্রমী স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। কানাডার প্রধান কবিদের পাশাপাশি তাঁর নামটিও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে আসছে। জীবনী তো লেখা হয়েছেই; তাঁকে নিয়ে ‘মাইটিও কস’ নামের একটা উপন্যাসও লেখা হয়েছে। মার্গারেট অ্যাটউডেরও এক গল্পের উপজীব্য হয়েছেন গুয়েনডলিন। অন্য অনেক কিছুর সমান্তরালে এই লেখক মৃত্যু নিয়ে ভেবেছেন বারবার। অল্প বয়সে রচিত পুস্তক The pising Fire কাব্যগ্রন্থেও এ বিষয়ে ভাবঋদ্ধ কবিতা আছে। সেই মৃত্যুকেই তিনি বরণ করে নিয়েছেন বেপরোয়ার মতো। এ অকাল প্রয়াণ আমাদের ব্যথিত করে, কেননা তিনি তো সেই লেখক যাকে দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল Afterworlds বইটির জন্য।