alt

সাময়িকী

রাজবন্দি নজরুল

বিশ্বজিৎ ঘোষ

: সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) স্বকালবিদ্ধ যুগন্ধর কবি। সাহিত্যের কালজয়ী আবেদন এবং প্রবহমান প্রাসঙ্গিকতার বিচারে কেবল যুগন্ধরই নন, তিনি যুগোত্তীর্ণও বটে। নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চৈতন্যের সাগরমন্থন শেষে বাংলা কাব্যে তাঁর উজ্জ্বল আবির্ভাব। উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত অন্তর্দ্বন্দ্বময় সমাজপ্রবাহে কাজী নজরুল ইসলাম উপাগত হন পরাক্রমশালী বিদ্রোহীর ভূমিকায়। নজরুল ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ-তূর্য’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছেন। রোমান্টিক অনুভবে তিনি প্রত্যাশা করেছেন সুষম সুন্দর কল্যাণময় সমাজ। তাই তিনি বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়, অসত্য আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে; কবিতায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, সামন্তপ্রথা শাস্ত্রাচার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়েই নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রাজরোষে পতিত হন এবং এক সময় তাঁকে বরণ করে নিতে হয় বন্দিদশা। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা নজরুলের রাজবন্দি-জীবন নিয়েই আলোচনা করবো।

‘আনন্দময়ীর আগমেন’ শীর্ষক কবিতা রচনার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কবিতাটি নজরুল প্রতিষ্ঠিত ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) পত্রিকার ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পূজাসংখ্যা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির মূল ভাব ছিল ব্রিটিশ-বিরোধিতা। ভারতীয় পুরাণের চণ্ডী-চরিত্রকে অবলম্বন করে লেখা কবিতাটির কয়েকটি চরণ ছিলো এরকম-

আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাড়াল।

দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, -আসবি কখন সর্বনাশী? ...

তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে

রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হুঁ’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে। ...

‘ময় ভুখা হুঁ মারি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী

কৈলাশ হতে গিরি রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!

আয় উমা আনন্দময়ী।

‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনার জন্য নজরুল ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারাবলে তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কলকাতার তদানীন্তন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে কবির বিচার হয়। ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি সুইনহো মামলার রায় ঘোষণা করেন। তৎকালীন প্রখ্যাত আইনজীবী মলিন মুখোপাধ্যায় বিনা পারিশ্রমিকে নজরুলের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো নিজেও একজন কবি ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি নজরুলকে কারাগারে কোন ডিভিশন না দিয়ে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে দণ্ড জারি করেন।

নজরুল ইসলামের ব্যক্তি-জীবন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে নজরুলের কারাজীবন এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একজন কবির রচনাকে ভয় পেয়ে তাঁকে বন্দি করেছে। অন্যদিকে তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল প্রতিবাদী চেতনা

অভিযোগের বিরুদ্ধে সুইনহোর আদালতে নজরুল যে জবানবন্দি প্রদান করেন, বাংলার রাজনৈতিক চেতনা ও প্রতিবাদী সাহিত্যের ইতিহাসে তা এক উজ্জ্বল দলিল। নজরুলের এই জবানবন্দি ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। ওই জবানবন্দিতে নজরুল বলেন- “আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি রাজ কারাগারে বন্দি ও রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে-রাজার মুকুট, আর একধারে ধূমকেতুর শিখা, একজন-রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর একজন-সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড।... আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই, কেননা ভগবান আমার সাথে আছেন। আমার অসমাপ্ত কর্তব্য অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। সত্যের প্রকাশ পীড়া নিরুদ্ধ হবে না। আমার ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতে অগ্নিমশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচারকে দগ্ধ করবে। আমার বহ্নি-এরোপ্লেনের সারথি হবেন স্বয়ং রুদ্র ভগবান। তারপর মাভৈঃ। ভয় নাই।”

বিচারাধীন থাকার সময় নজরুলকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি রাখা হয়। কারাদণ্ডের পর তাঁকে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলে বন্দি নজরুলের কাছে পাঠিয়ে দেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কিছুদিন রাখার পর নজরুলকে হুগলি জেলে পাঠানো হয়। হুগলি জেলে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এবং বন্দিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল বিদ্রোহ করেন এবং দাবি আদায়ের উপায় হিসেবে অনশন আরম্ভ করেন। জেল-কর্তৃপক্ষ নজরুলের দাবি মানতে নারাজ, অন্যদিকে দাবি না মানা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যেতে নজরুল অটল। নজরুল দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডাকে কলকাতার গোলদীঘিতে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা থেকে দাবি জানানো হলো- ‘নজরুলকে বাঁচানো বাংলাদেশ ও সাহিত্যের পক্ষে প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে হবে নজরুল যাতে অনশন ভঙ্গ করেন।’ নজরুলের অনশন ভঙ্গের আহ্বান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। ওই তারবার্তায় তিনি লেখেন- ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ।’ শেষ পর্যন্ত ৩৯ দিন অনশনের পর ১৯২৩ সালের ২২ মে নজরুল অনশন ভাঙেন মাতৃসমা বিরজাসুন্দরীর অনুরোধে। অনশন ভঙ্গের পর কবিকে বহরমপুর জেলে বদলি করা হয়। এখানে কবিকে বিশেষ শ্রেণীর কয়েদী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। বহরমপুর জেল থেকেই ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল মুক্তি লাভ করেন।

নজরুল ইসলামের ব্যক্তি-জীবন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে নজরুলের কারাজীবন এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একজন কবির রচনাকে ভয় পেয়ে তাঁকে বন্দি করেছে। অন্যদিকে তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল প্রতিবাদী চেতনা। নজরুলের বন্দিদশা ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জেল-জীবনে বসে নজরুল যা রচনা করেছেন, বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারায় তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারাগারের বাইরে যেমন, তেমনি কারাগারের ভিতরেও নজরুল ছিলেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর জীবনবাদী এক প্রবল বিদ্রোহী।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

রাজবন্দি নজরুল

বিশ্বজিৎ ঘোষ

সোমবার, ৩০ আগস্ট ২০২১

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) স্বকালবিদ্ধ যুগন্ধর কবি। সাহিত্যের কালজয়ী আবেদন এবং প্রবহমান প্রাসঙ্গিকতার বিচারে কেবল যুগন্ধরই নন, তিনি যুগোত্তীর্ণও বটে। নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চৈতন্যের সাগরমন্থন শেষে বাংলা কাব্যে তাঁর উজ্জ্বল আবির্ভাব। উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত অন্তর্দ্বন্দ্বময় সমাজপ্রবাহে কাজী নজরুল ইসলাম উপাগত হন পরাক্রমশালী বিদ্রোহীর ভূমিকায়। নজরুল ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ-তূর্য’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছেন। রোমান্টিক অনুভবে তিনি প্রত্যাশা করেছেন সুষম সুন্দর কল্যাণময় সমাজ। তাই তিনি বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়, অসত্য আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে; কবিতায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, সামন্তপ্রথা শাস্ত্রাচার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়েই নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রাজরোষে পতিত হন এবং এক সময় তাঁকে বরণ করে নিতে হয় বন্দিদশা। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা নজরুলের রাজবন্দি-জীবন নিয়েই আলোচনা করবো।

‘আনন্দময়ীর আগমেন’ শীর্ষক কবিতা রচনার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কবিতাটি নজরুল প্রতিষ্ঠিত ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) পত্রিকার ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পূজাসংখ্যা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির মূল ভাব ছিল ব্রিটিশ-বিরোধিতা। ভারতীয় পুরাণের চণ্ডী-চরিত্রকে অবলম্বন করে লেখা কবিতাটির কয়েকটি চরণ ছিলো এরকম-

আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাড়াল।

দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, -আসবি কখন সর্বনাশী? ...

তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে

রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হুঁ’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে। ...

‘ময় ভুখা হুঁ মারি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী

কৈলাশ হতে গিরি রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!

আয় উমা আনন্দময়ী।

‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনার জন্য নজরুল ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারাবলে তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কলকাতার তদানীন্তন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে কবির বিচার হয়। ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি সুইনহো মামলার রায় ঘোষণা করেন। তৎকালীন প্রখ্যাত আইনজীবী মলিন মুখোপাধ্যায় বিনা পারিশ্রমিকে নজরুলের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো নিজেও একজন কবি ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি নজরুলকে কারাগারে কোন ডিভিশন না দিয়ে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে দণ্ড জারি করেন।

নজরুল ইসলামের ব্যক্তি-জীবন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে নজরুলের কারাজীবন এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একজন কবির রচনাকে ভয় পেয়ে তাঁকে বন্দি করেছে। অন্যদিকে তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল প্রতিবাদী চেতনা

অভিযোগের বিরুদ্ধে সুইনহোর আদালতে নজরুল যে জবানবন্দি প্রদান করেন, বাংলার রাজনৈতিক চেতনা ও প্রতিবাদী সাহিত্যের ইতিহাসে তা এক উজ্জ্বল দলিল। নজরুলের এই জবানবন্দি ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। ওই জবানবন্দিতে নজরুল বলেন- “আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি রাজ কারাগারে বন্দি ও রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে-রাজার মুকুট, আর একধারে ধূমকেতুর শিখা, একজন-রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর একজন-সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড।... আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই, কেননা ভগবান আমার সাথে আছেন। আমার অসমাপ্ত কর্তব্য অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। সত্যের প্রকাশ পীড়া নিরুদ্ধ হবে না। আমার ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতে অগ্নিমশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচারকে দগ্ধ করবে। আমার বহ্নি-এরোপ্লেনের সারথি হবেন স্বয়ং রুদ্র ভগবান। তারপর মাভৈঃ। ভয় নাই।”

বিচারাধীন থাকার সময় নজরুলকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি রাখা হয়। কারাদণ্ডের পর তাঁকে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলে বন্দি নজরুলের কাছে পাঠিয়ে দেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কিছুদিন রাখার পর নজরুলকে হুগলি জেলে পাঠানো হয়। হুগলি জেলে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এবং বন্দিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল বিদ্রোহ করেন এবং দাবি আদায়ের উপায় হিসেবে অনশন আরম্ভ করেন। জেল-কর্তৃপক্ষ নজরুলের দাবি মানতে নারাজ, অন্যদিকে দাবি না মানা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যেতে নজরুল অটল। নজরুল দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডাকে কলকাতার গোলদীঘিতে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা থেকে দাবি জানানো হলো- ‘নজরুলকে বাঁচানো বাংলাদেশ ও সাহিত্যের পক্ষে প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে হবে নজরুল যাতে অনশন ভঙ্গ করেন।’ নজরুলের অনশন ভঙ্গের আহ্বান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। ওই তারবার্তায় তিনি লেখেন- ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ।’ শেষ পর্যন্ত ৩৯ দিন অনশনের পর ১৯২৩ সালের ২২ মে নজরুল অনশন ভাঙেন মাতৃসমা বিরজাসুন্দরীর অনুরোধে। অনশন ভঙ্গের পর কবিকে বহরমপুর জেলে বদলি করা হয়। এখানে কবিকে বিশেষ শ্রেণীর কয়েদী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। বহরমপুর জেল থেকেই ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল মুক্তি লাভ করেন।

নজরুল ইসলামের ব্যক্তি-জীবন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে নজরুলের কারাজীবন এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একজন কবির রচনাকে ভয় পেয়ে তাঁকে বন্দি করেছে। অন্যদিকে তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল প্রতিবাদী চেতনা। নজরুলের বন্দিদশা ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জেল-জীবনে বসে নজরুল যা রচনা করেছেন, বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারায় তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারাগারের বাইরে যেমন, তেমনি কারাগারের ভিতরেও নজরুল ছিলেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর জীবনবাদী এক প্রবল বিদ্রোহী।

back to top