বুদ্ধদেব গুহ
গৌতম রায়
শব্দ দিয়ে চিত্রমালা গাঁথার মানুষটি হারিয়ে গেছেন। পাহাড় থেকে জঙ্গল- সমুদ্র থেকে মরুভূমি- আর কোথাও তাঁর পদচারণা খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা আবেগঋদ্ধ হৃদয় দিয়ে মানুষ, প্রকৃতি আর সময়কে উপলব্ধি করবার নাম ছিল বুদ্ধদেব গুহ। তিনি নিছক অ্যাডভেঞ্চার কেন্দ্রিক একজন সাহিত্যিক নন। অ্যাডভেঞ্চারকে সমকালীনতার কেন্দ্রবিন্দুতে গেঁথে মানুষের মনকে একটা অত্যুচ্চ কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে সময়ের মানদণ্ডে সেই মনকে স্থাপন করবার নাম ছিল বুদ্ধদেব গুহ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’ ইত্যাদিতে অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যকে যে ধ্রুপদিয়ানার বাঙালিত্বে উপনীত করেছিলেন, সেই যাত্রাপথকে আরও সমৃদ্ধ করবার নাম হলো বুদ্ধদেব গুহ। বস্তুত বিভূতিভূষণের আগে বাঙালি পটভূমিতে অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের চর্চার তেমন একটা ছায়া ছিল না। বিদেশি গল্পের ছায়াতে একটা বাঙালি নামকরণই যেন প্রাক-বিভূতি পর্বের অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের ধারা হয়ে উঠেছিল। সেখানে বাঙালিয়ানার চরম পরাকাষ্ঠা হিসেবে আত্মপ্রকাশ বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়ে’ ‘শঙ্কর’ নামক চরিত্রটির। এই চরিত্রসংশ্লেষ করে কোথাও আমাদের অপরিচয়ের অতৃপ্তি থাকে না। শঙ্করকে মনে হয় আমাদের ছাপোষা ঘরের ছেলে। ভাটপাড়ার ন্যায়ালঙ্কার ঠাকুর রোডের ছেলে কিংবা বগুড়ার মালতীনগরের অথবা ঢাকা নিউ ইস্কাটনের ছেলে হিসেবে শঙ্করের ভিতরে এতোটুকু অমিল আমরা খুঁজে পাই না।
এই বাঙালিয়ানার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ‘ঋজু’, ‘ঋভু’ চরিত্রের ভিতর দিয়ে একটা সময়োপযোগী আস্তরণ সহযোগে তুলে ধরবার নামই বুদ্ধদেব গুহ। আর এই চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে পটভূমিকায় যে ঘটনাপ্রবাহ থেকেছে, তার প্রায় প্রতিটিরই সঙ্গে ব্যক্তি বুদ্ধদেবের কোথাও না কোথাও সংযোগের স্পর্শ থেকে। বাস্তক অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিশেলে এই কাহিনিগুলির ঠাস বুনোট বাংলার কিশোরদের উপহার দিয়েছেন বুদ্ধদেব।
তাঁর এই সৃষ্টির আর একটি বড় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো; অপরাধ মনস্তত্ত্ব থেকে বুদ্ধদেবের ছিল শত যোজন দূরের অবস্থান। অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লিখতে গেলেই সেখানে খুন, জখমের বিষয়গুলিকে বেশ বড়োসড়ো করে ঠাঁই দিতে হবে- এই বোধে আদৌ বিশ্বাসী ছিলেন না বুদ্ধদেব গুহ। ফলে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার, সুখলতা রাও, সুকুমার সেন, বন্দে আলি মিঞারা কিশোর মনের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে যে একটা কল্পনাপ্রবণ, সবুজ, সুন্দর বোধকে সবসময়েই জাগিয়ে তুলতে প্রয়াসী ছিলেন, সেই অবস্থানকেই আরো সময় উপযোগী করে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব। সেই উপযোগিতার সংশ্লেষণে তিনি যুক্ত করেছিলেন প্রকৃতি প্রেম। সেই প্রকৃতি প্রেমের ভিতর দিয়েই একটা মাটির তালের মতো শিশু-কিশোর মানের গঠনটি যাতে সময়ের সঙ্গে, বাস্তবের সঙ্গে এবং অবশ্যই বিজ্ঞানমনষ্কতার সঙ্গে একটা আধুনিক, মননশীল প্রত্যয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়- সেই দিকটি কখনই নজর এড়ায়নি তাঁর। এই সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্যে বুদ্ধদেব গুহ বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আজ যখন কিশোর সাহিত্যের প্রাঙ্গণ দখল করে নিচ্ছে কেবলমাত্র ‘হিংসা’র চরম প্রকাশ, তখন বারবারই বলতে হয় যে- অহেতুক হিংসাকে আশ্রয় করে কাহিনির বুননের পথে বুদ্ধদেব গুহ কখনোই হাঁটেননি। কিশোর মনস্তত্ত্বে যে ‘অচেনার আনন্দ’ রয়েছে, সেই আনন্দবোধের উন্মীলন যাতে সঠিক পথ ধরেই কিশোরের মনে বিকাশ লাভ করে সেই সৎ উদ্দেশ্যেই বুদ্ধদেব গুহ নিজের মেধা আর মনন শক্তিকে পরিচালিত করেছিলেন। কাহিনি সূত্রে যখন থ্রিলারের আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, তখন ও কিন্তু মানুষের সৎ প্রবৃত্তির উন্মীলনের কথা একটিবারের জন্যেও বুদ্ধদেব ভুলে যান নি। নিছক হিংসার জন্যে হিংসাকে ফুটিয়ে তুলে সাহিত্যকে অহেতুক চটকদরিত্বে উপনীত করবার সহজ এবং সস্তার পথে বুদ্ধদেব কখনো হাঁটেননি। তাই কেবল কিশোর সমাজই নয়, পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষদের কাছেও বুদ্ধদেব চিত্রিত কিশোর চরিত্রগুলি অত্যন্ত আপন হয়ে উঠেছে।
বুদ্ধদেবের প্রকৃতি প্রেম কখনোই মানুষ-নিরপেক্ষ ছিল না। বস্তুত পক্ষে প্রকৃতি ঘিরে তাঁর অন্যতম সেরা জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কোজাগর’ মানুষ আর প্রকৃতি, বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতাকে এমনভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছে যে আমাদের কালকুট ছদ্মনামে সমরেশ বসুর ‘প্রেম নামে বন’কে খুব মনে করিয়ে দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র যে মাদকতা সেই মাতাল সমীরণে কখনো গা ভাসাচ্ছেন না কালকুট বা বুদ্ধদেব। অথচ সেই মাতাল সমীরণের গন্ধ থেকে এমন একটা আমেজ কালকুটের লেখাতে বুদ্ধদেব গুহের লেখাতে ফুটে উঠছে যা আমাদের খুব সহজেই মনে করিয়ে দিচ্ছে শঙ্খ ঘোষের কবিতার সেই লাইন টি- “মদ খেয়ে তো মাতাল হয় সবাই, কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল।”
আত্মশক্তিতে মাতাল হয়ে চিত্তশক্তিতে জগৎকে চিনবার এক অভিনব শক্তি ছিল সমরেশ, বুদ্ধদেবদের মতো মানুষদের। সেই চিত্তশক্তিতে চেনা মানুষকে নিজের মতো করে মানুষের দরবারে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে সমরেশ, বুদ্ধদেবের দোসর বলতে হয় শামসুর রাহমান আর সৈয়দ শামসুল হককে। শামসুর রাহমান খুব কম গল্প, উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু সেই অল্প লেখার ভিতরেও মধ্যবিত্তের গহীন পরাবাস্তবতাকে তিনি যেভাবে তুলে ধরেছিলেন, সেই আঙ্গিকেরই যেন সমমনষ্ক দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যবিত্ত জনজীবন নিয়ে লেখা সমরেশ বা বুদ্ধদেব গুহের সৃষ্টিগুলির ভিতরও আপন বৈশিষ্ট্যে আমরা ফুটে উঠতে দেখি।
বুদ্ধদেবের লেখায় ভিন্ন আঙ্গিকে এই বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার সম্মিলিত ছবির সঙ্গে তুলনা করা চলে সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটিরও। প্রকৃতির বর্ণনায় চিত্রবিচিত্র ধারায় মানুষকে যখন বুদ্ধদেব উপস্থাপিত করছেন, তখন প্রকৃতিবেত্তার সঙ্গে পাঠকের যে মানসভ্রমণ ঘটে, সেই আঙ্গিকে যদি আমরা বুদ্ধদেবকে দেখি, তাহলে তাঁর বাচনভঙ্গিভার সঙ্গে অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় হিমালয়পথিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। উমাপ্রসাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে যেমন আমাদের মানসভ্রমণ হয়, তেমনভাবেই যেন আমরা ভেসে বেড়াতে পারি হিমালয়ের পাদদেশ হরিদ্বার বুদ্ধদেব গুহের ‘চাপড়াশে’র ভিতর দিয়ে। হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট ভাগিরথীর হিমশীতল বারিধারায় আমাদের শিরা উপশিরাকে সিক্ত করে দেন বুদ্ধদেব। এই বইটি একটু নিবিড়ভাবে পড়লেই মনে হয় যে, আমরা বুঝি হরিদ্বারের কোলাহল মুখরিত হর কি পায়ারিতে বসে আছি। আবার মনে হয়, হিমালয়ের কোনো নীরব গম্ভীর গুহায় সংসার বৈরাগ্যে আত্মনিবেদিত কোনো সাধকের কুঠিয়ায় বসে আত্মবিভাষণে মগ্ন।
উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সময়-প্রকৃতি-বাস্তবতা পরিবেশ আর মানুষকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার অনবদ্য প্রবণতা এটাই ব্যক্তি বুদ্ধদেবের জীবনের যেমন অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তেমনই এই বৈশিষ্ট্যের জন্যেই বুদ্ধদেবের সৃষ্টিগুলি একই বিষয়কেন্দ্রিক হলেও কখনোই তা পাঠকের কাছে পৌনঃপুনিকতার দোষে দূষ্ট বলে মনে হবে না। এই একঘেয়েমিবিহীন একটা স্মার্ট জীবনের সন্ধানই হলো বুদ্ধদেব গুহের বিষয় কেন্দ্রে অবিভাজ্য অবস্থান স্বত্ত্বেও বিষয়ান্তরে বিচরণের এক অভ্রান্ততার ভিতর দিয়ে সাফল্যের শিখরে কালে কালান্তরে স্থিত থাকার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। উচ্চবিত্তের আভিজাত্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকা হাহাকার যে কোনো মানসলোকের রিক্ততার কলকণ্ঠের ভিতরে মুক্তিলোকের চাবি খুঁজে ফেরে- তার সন্ধান আমরা পাই বুদ্ধদেব গুহের সৃষ্টির ভিতর দিয়ে। উচ্চবিত্তের মানুষদের যাপনচিত্রের ভিতরে ও যে শূন্যতার শোকসভা বসে তার সন্ধান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা করি না। আর সেই না করবার জন্যেই সামাজিক বৈষম্যের ছবিটা এমন প্রকট হয়ে, এমনতরই কঙ্কালসার হয়ে আমাদের সামনে বারবার নিজের কপাটখানা খুলে ধরে। সেই খোলা দুয়ার দিয়ে দেখা না দেখা ছবিগুলির পরতের পর পরতে বিশ্লিষ্ট সময়ের আস্তরণ ভেদ করে আমাদের সামনে মেলে ধরেছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। তাঁর এই কপাট উন্মোচনের ভিতরে কখনো চপলতা ছিল না। অথচ ছিল বনের হরিণের মতো গ্রীবা বাঁকানো একটা ভঙ্গিমা।
নাতনী নন্দিনী দেবীর পোষা হরিণ হারিয়ে যাওয়া বেদনাকে ভাষা দিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- আকাশকে সে চমকে দিতো বনে- কে তারে বাঁধলো অকারণে।
বুদ্ধদেব গুহের জীবনাবসানের পর বারবারই কেবল মনে হচ্ছে; আমার মনের সেই বনের হরিণকে কেই বা অকারণে বাঁধলো? যে মানুষটির কলমের চোখে আমরা প্রকৃতির অরূপমাধুরীকে যুগের পর যুগ পান করেছি, হৃদয়ে সেই মাধুরীর সুধারস স্থাপন করে বলেছি; বুকের সুধার অনুসন্ধানে পথিককে ডাক দিয়েছি, গভীর গোপন বেদনায় কেঁদেছি, অভিমানে মুখ ভারি করেছি, আবার আনন্দে খিল খিল করে হেসেছি।
একটা আত্মাভিমানী চিত্ত হয়তো বুদ্ধদেবের ভিতরে ছিল। সেই চিত্তের তারকাঁটা হয়তো অনেক সময়েই ব্যক্তি বুদ্ধদেবের জীবনে অনেক উথালপাথাল ডেকেছে। যার স্পর্শ আমরা পেয়েছি তাঁর সৃষ্টির মাঝেও। ‘একটু উষ্ণতার জন্যে’-তে লেখকের জীবনের যে ওলটপালটের আভাস, সেই আভাস যেন বুদ্ধদেবের প্রথমজীবনের ব্যক্তিপ্রেম কেন্দ্রিক সৃষ্টি ‘খেলা যখনে’র তাপকেন্দ্রিকতার বিত্তকে টেনেছিঁড়ে চুরমার করে দেয়। মধ্যবিত্ত পাঠক চিত্ত হয়তো কখনোই খুঁজে পায় না লেখক চিত্তের তল-অতল। সেই অতলান্তিক বিয়োগ কেন্দ্রিক নবকুমার বসুর উপন্যাস ‘চিরসখা’কেও যেন কখনো কখনো বাঙালি পাঠকের নীতিনিষ্ঠ মননকে একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু সেই জিজ্ঞাসার সব থেকে বড় উত্তর হলো; লেখকের সত্যের কাছে অকপট স্বীকারোক্তি। এই স্বীকারোক্তির জন্যেই নিত্যবিনোদন যে চিত্তবিনোদনে আঘাত ফেলতে পারে না- তা যেমন দেখিয়ে গিয়েছেন সমরেশ বসু, তেমনই দেখিয়ে গেলেন বুদ্ধদেব গুহ।
সুপ্রিয়া গৌরী ছাড়াও মরিয়ম মান্নান নামক এক বিমানবালা প্রায়ই আসতেন কবি শামসুর রাহমানের কাছে। একটু চপল এবং তরল প্রকৃতির মানুষ। গৌরীর মতো থির বিজুরির ঝিলিক নয়। তাই কাউকেই এড়িয়ে না যাওয়া স্বভাবের কবি লিখেছিলেন- ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও।’ তাই হয়তো চলে যাওয়ার আগে কবি লিখেছিলেন;
“দুঃসময় অন্ধ পাখি অতিকায়, কালো
ছায়া ফেলে আমাদের প্রেমের উপর, আমরাতো
ভিন্নতর ছায়া চাই, পুষ্পবৃষ্টি চাই
সুতীক্ষ্ণ কাঁটার আগ্রাসনে, চাই স্বাদু পায়েসান্ন
করাল কাহাতে। শুধু আমরা দু’জন নয়,
সবাইকে নিয়ে
খরায় অভীষ্ট ঝর্না তলায় আঁজলা ভরে
জলপায়ী হবো। (“ক’দিন তোমার আসা যাওয়া”, রচনাকাল ০৯. ০৪. ১৯৯৫)
ভিন্নতর ছায়ার অনুসন্ধানই হলো বুদ্ধদেব গুহের জীবন আর সৃষ্টির পারস্পরিক বিনিসুতোয় বাঁধা মালার সৌষ্ঠব। আবহমানকালের মানুষকে প্রকৃতির সংমিশ্রণে কেবল দেখাই নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করবার যে ধারা বাংলা সাহিত্যে সূচনা করেছিলেন বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর- সেই প্রবাহমানতাকেই বয়ে নিয়ে চলেছিলেন সমরেশ বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সৈয়দ শামসুল হক, বুদ্ধদেব গুহরা। সেই ধারার শেষ প্রদীপটির এই নির্বাপণ বাংলা সাহিত্যে মেধা আর বিনোদনের সংমিশ্রণের সঙ্গে মানুষ-রতনের অনুসন্ধানের ত্রিবেণী ধারার চর্চার শিখাটাও নিভে গেল। অনুসন্ধিৎসা যে কেবল অনুভূতিবিহীন কোনো অভিব্যক্তি হতে পারে না- বুদ্ধদেব গুহ তাঁর উপন্যাস থেকে ছোটগল্পের ধারা অতিক্রম করে কথোপকথনের নিবিড় প্রজ্ঞায় প্রকাশ করেছিলেন।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে নয়ের দশকের শেষের দিকে বুদ্ধদেব গুহের যে সখ্য তৈরি করেছিল- সেই ঘটনাক্রম আমাদের গভীর যন্ত্রণা দিয়েছিল। এই সময়কালে বাঙালির চিত্র চিত্রণে বুদ্ধদেবের যে মানসিক অবস্থান, বাঙালি মুসলমানের প্রতি একটা কৌনিক ভাবনা তা অন্নদাশঙ্কর রায়কে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। অবিভক্ত বাংলার উদার সামাজিক পরিবেশের একটা রেশ বুদ্ধদেবের শৈশবে পড়েছিল। রংপুর কেন্দ্রিক তাঁর একদম প্রথম জীবন উত্তরবঙ্গের সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে চেনাতে এবং চিনতে সহায়ক হয়েছিল বুদ্ধদেব গুহের জীবনে। কিন্তু সেই চেনার রেশটিকে তিনি ধারণ করেছিলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। এই আঙ্গিকের ভিন্নতাকে এক ধরনের বিকৃতি বলেই মনে হয়েছিল অন্নদাশঙ্করের কাছে। যখন বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার রচনার মতো কাজে বুদ্ধদেব গুহের মতো মানুষ নিজের মননশীরতা, ধী শক্তি, বুদ্ধিমত্তাকে খরচ করেছিলেন, তখন আমরা সবাই ব্যথিত হয়েছিলাম। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম।
আবার এই বুদ্ধদেব গুহই জ্যোতি বসুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন অনেকবারই। বামফ্রন্ট সরকার তাঁকে যথোচিত মর্যাদা দিতে এতোটুকু কার্পণ্য কখনোই দেখাননি। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো নেতিবাচক অবস্থানও বুদ্ধদেব গুহ কখনোই নেননি। বামফ্রন্টের উগ্র সমর্থক হিসেবেও যেমন তিনি কখনোই নিজেকে মেলে ধরেননি, তেমনই একটা সময়ের পর থেকে শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষ যেমন বামফ্রন্টের প্রকাশ্য বিরোধিতায় পথে নেমেছিলেন- তেমনটাও কখনোই বুদ্ধদেব গুহ করেননি।
রাজনৈতিক চিন্তনের ক্ষেত্রে একটা অস্থির মতির মানসিকতা নিয়ে চলতেন বুদ্ধদেব গুহ- এই কথা বললে হয়তো খুব একটা সত্যের অপলাপ হবে না। কারণ; বুদ্ধদেবের যে মেধা এবং চপল হরিণের মতো প্রেমিকসত্তা পরিপূর্ণ হৃদয়, সেখানে দলীয় রাজনীতির খুঁটিনাটি সত্যিই বেশ বেমানান। তাই একটা আবেগ নিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সাময়িকভাবে সেই সময়কালে সহনাগরিক মুসলমানদের সম্পর্কে কটু কথা বলে, নেতিবাচক মন্তব্য করে নিজেকে আপামর পাঠক সমাজের কাছে বেশ কিছুটা বিতর্কিত করে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে যখন সখ্য পর্ব চলছিল বুদ্ধদেব গুহের তখন নারী প্রগতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে তিনি দেখেছিলেন তসলিমা নাসরিনকে। পবিত্র ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করে প্রকারান্তে বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদকে মদদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে উঠে আসতে বাঁধা সৃষ্টি করবার যে রাজনীতি সেই সময় থেকেই তসলিমা করে আসছেন, নিজের অপরিণত রাজনৈতিক বোধ থেকে তসলিমার সেই রাজনৈতিক অভীপ্সাকে হয়তো ততোটা বুঝে উঠতে পারেননি বুদ্ধদেব গুহ। সেই সময়কালে মূল ধারার প্রচার মাধ্যমগুলি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির আস্ফালন ঘিরে একটা নব অবস্থান পালন করে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, রাজাকার পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সঞ্জীবিত হয়ে মানুষ শহিদ জননী জাহানারা ইমাম, বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফি, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অনুপম সেন প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের নবপর্যায়ের যে সূচনা করেছেন, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে গণআদালত হয়েছে- এইসব পর্যায়গুলিকে এপার বাংলায় একমাত্র বামপন্থী সংবাদ সাময়িক ‘দেশহিতৈষী’ ছাড়া কেউ তেমন প্রচারই করত না। অপর পক্ষে শিবনারায়ণ রায়, নিখিল সরকারের মতো বুদ্ধিজীবীরা সুফিয়া কামালদের নামোচ্চারণ না করেই তসলিমাকে নিয়ে যে আদিখ্যেতা দেখাতেন, তাতে একটা বড়ো অংশের মানুষের কাছে মনে হয়েছিল, ধর্মান্ধ বাংলাদেশে একমাত্র জ্ঞানের আলো হলেন এই ইসলামফোবিয়া ছড়ানো খ্রিস্টান মৌলবাদের তল্পিবাহক তসলিমাকে। এই পর্যায়ে প্রচলিত ধারাতে নিজেকে মিলিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। এই পর্যায়টি তাঁকে আমজনতার ভালোবাসার আসন থেকে কিছুটা হলেও বিচ্ছিন্ন করেছিল।
বুদ্ধদেব গুহ
গৌতম রায়
সোমবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
শব্দ দিয়ে চিত্রমালা গাঁথার মানুষটি হারিয়ে গেছেন। পাহাড় থেকে জঙ্গল- সমুদ্র থেকে মরুভূমি- আর কোথাও তাঁর পদচারণা খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা আবেগঋদ্ধ হৃদয় দিয়ে মানুষ, প্রকৃতি আর সময়কে উপলব্ধি করবার নাম ছিল বুদ্ধদেব গুহ। তিনি নিছক অ্যাডভেঞ্চার কেন্দ্রিক একজন সাহিত্যিক নন। অ্যাডভেঞ্চারকে সমকালীনতার কেন্দ্রবিন্দুতে গেঁথে মানুষের মনকে একটা অত্যুচ্চ কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে সময়ের মানদণ্ডে সেই মনকে স্থাপন করবার নাম ছিল বুদ্ধদেব গুহ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’ ইত্যাদিতে অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যকে যে ধ্রুপদিয়ানার বাঙালিত্বে উপনীত করেছিলেন, সেই যাত্রাপথকে আরও সমৃদ্ধ করবার নাম হলো বুদ্ধদেব গুহ। বস্তুত বিভূতিভূষণের আগে বাঙালি পটভূমিতে অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের চর্চার তেমন একটা ছায়া ছিল না। বিদেশি গল্পের ছায়াতে একটা বাঙালি নামকরণই যেন প্রাক-বিভূতি পর্বের অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের ধারা হয়ে উঠেছিল। সেখানে বাঙালিয়ানার চরম পরাকাষ্ঠা হিসেবে আত্মপ্রকাশ বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়ে’ ‘শঙ্কর’ নামক চরিত্রটির। এই চরিত্রসংশ্লেষ করে কোথাও আমাদের অপরিচয়ের অতৃপ্তি থাকে না। শঙ্করকে মনে হয় আমাদের ছাপোষা ঘরের ছেলে। ভাটপাড়ার ন্যায়ালঙ্কার ঠাকুর রোডের ছেলে কিংবা বগুড়ার মালতীনগরের অথবা ঢাকা নিউ ইস্কাটনের ছেলে হিসেবে শঙ্করের ভিতরে এতোটুকু অমিল আমরা খুঁজে পাই না।
এই বাঙালিয়ানার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ‘ঋজু’, ‘ঋভু’ চরিত্রের ভিতর দিয়ে একটা সময়োপযোগী আস্তরণ সহযোগে তুলে ধরবার নামই বুদ্ধদেব গুহ। আর এই চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে পটভূমিকায় যে ঘটনাপ্রবাহ থেকেছে, তার প্রায় প্রতিটিরই সঙ্গে ব্যক্তি বুদ্ধদেবের কোথাও না কোথাও সংযোগের স্পর্শ থেকে। বাস্তক অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিশেলে এই কাহিনিগুলির ঠাস বুনোট বাংলার কিশোরদের উপহার দিয়েছেন বুদ্ধদেব।
তাঁর এই সৃষ্টির আর একটি বড় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো; অপরাধ মনস্তত্ত্ব থেকে বুদ্ধদেবের ছিল শত যোজন দূরের অবস্থান। অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লিখতে গেলেই সেখানে খুন, জখমের বিষয়গুলিকে বেশ বড়োসড়ো করে ঠাঁই দিতে হবে- এই বোধে আদৌ বিশ্বাসী ছিলেন না বুদ্ধদেব গুহ। ফলে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার, সুখলতা রাও, সুকুমার সেন, বন্দে আলি মিঞারা কিশোর মনের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে যে একটা কল্পনাপ্রবণ, সবুজ, সুন্দর বোধকে সবসময়েই জাগিয়ে তুলতে প্রয়াসী ছিলেন, সেই অবস্থানকেই আরো সময় উপযোগী করে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব। সেই উপযোগিতার সংশ্লেষণে তিনি যুক্ত করেছিলেন প্রকৃতি প্রেম। সেই প্রকৃতি প্রেমের ভিতর দিয়েই একটা মাটির তালের মতো শিশু-কিশোর মানের গঠনটি যাতে সময়ের সঙ্গে, বাস্তবের সঙ্গে এবং অবশ্যই বিজ্ঞানমনষ্কতার সঙ্গে একটা আধুনিক, মননশীল প্রত্যয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়- সেই দিকটি কখনই নজর এড়ায়নি তাঁর। এই সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্যে বুদ্ধদেব গুহ বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আজ যখন কিশোর সাহিত্যের প্রাঙ্গণ দখল করে নিচ্ছে কেবলমাত্র ‘হিংসা’র চরম প্রকাশ, তখন বারবারই বলতে হয় যে- অহেতুক হিংসাকে আশ্রয় করে কাহিনির বুননের পথে বুদ্ধদেব গুহ কখনোই হাঁটেননি। কিশোর মনস্তত্ত্বে যে ‘অচেনার আনন্দ’ রয়েছে, সেই আনন্দবোধের উন্মীলন যাতে সঠিক পথ ধরেই কিশোরের মনে বিকাশ লাভ করে সেই সৎ উদ্দেশ্যেই বুদ্ধদেব গুহ নিজের মেধা আর মনন শক্তিকে পরিচালিত করেছিলেন। কাহিনি সূত্রে যখন থ্রিলারের আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, তখন ও কিন্তু মানুষের সৎ প্রবৃত্তির উন্মীলনের কথা একটিবারের জন্যেও বুদ্ধদেব ভুলে যান নি। নিছক হিংসার জন্যে হিংসাকে ফুটিয়ে তুলে সাহিত্যকে অহেতুক চটকদরিত্বে উপনীত করবার সহজ এবং সস্তার পথে বুদ্ধদেব কখনো হাঁটেননি। তাই কেবল কিশোর সমাজই নয়, পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষদের কাছেও বুদ্ধদেব চিত্রিত কিশোর চরিত্রগুলি অত্যন্ত আপন হয়ে উঠেছে।
বুদ্ধদেবের প্রকৃতি প্রেম কখনোই মানুষ-নিরপেক্ষ ছিল না। বস্তুত পক্ষে প্রকৃতি ঘিরে তাঁর অন্যতম সেরা জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কোজাগর’ মানুষ আর প্রকৃতি, বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতাকে এমনভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছে যে আমাদের কালকুট ছদ্মনামে সমরেশ বসুর ‘প্রেম নামে বন’কে খুব মনে করিয়ে দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র যে মাদকতা সেই মাতাল সমীরণে কখনো গা ভাসাচ্ছেন না কালকুট বা বুদ্ধদেব। অথচ সেই মাতাল সমীরণের গন্ধ থেকে এমন একটা আমেজ কালকুটের লেখাতে বুদ্ধদেব গুহের লেখাতে ফুটে উঠছে যা আমাদের খুব সহজেই মনে করিয়ে দিচ্ছে শঙ্খ ঘোষের কবিতার সেই লাইন টি- “মদ খেয়ে তো মাতাল হয় সবাই, কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল।”
আত্মশক্তিতে মাতাল হয়ে চিত্তশক্তিতে জগৎকে চিনবার এক অভিনব শক্তি ছিল সমরেশ, বুদ্ধদেবদের মতো মানুষদের। সেই চিত্তশক্তিতে চেনা মানুষকে নিজের মতো করে মানুষের দরবারে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে সমরেশ, বুদ্ধদেবের দোসর বলতে হয় শামসুর রাহমান আর সৈয়দ শামসুল হককে। শামসুর রাহমান খুব কম গল্প, উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু সেই অল্প লেখার ভিতরেও মধ্যবিত্তের গহীন পরাবাস্তবতাকে তিনি যেভাবে তুলে ধরেছিলেন, সেই আঙ্গিকেরই যেন সমমনষ্ক দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যবিত্ত জনজীবন নিয়ে লেখা সমরেশ বা বুদ্ধদেব গুহের সৃষ্টিগুলির ভিতরও আপন বৈশিষ্ট্যে আমরা ফুটে উঠতে দেখি।
বুদ্ধদেবের লেখায় ভিন্ন আঙ্গিকে এই বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার সম্মিলিত ছবির সঙ্গে তুলনা করা চলে সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটিরও। প্রকৃতির বর্ণনায় চিত্রবিচিত্র ধারায় মানুষকে যখন বুদ্ধদেব উপস্থাপিত করছেন, তখন প্রকৃতিবেত্তার সঙ্গে পাঠকের যে মানসভ্রমণ ঘটে, সেই আঙ্গিকে যদি আমরা বুদ্ধদেবকে দেখি, তাহলে তাঁর বাচনভঙ্গিভার সঙ্গে অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় হিমালয়পথিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। উমাপ্রসাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে যেমন আমাদের মানসভ্রমণ হয়, তেমনভাবেই যেন আমরা ভেসে বেড়াতে পারি হিমালয়ের পাদদেশ হরিদ্বার বুদ্ধদেব গুহের ‘চাপড়াশে’র ভিতর দিয়ে। হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট ভাগিরথীর হিমশীতল বারিধারায় আমাদের শিরা উপশিরাকে সিক্ত করে দেন বুদ্ধদেব। এই বইটি একটু নিবিড়ভাবে পড়লেই মনে হয় যে, আমরা বুঝি হরিদ্বারের কোলাহল মুখরিত হর কি পায়ারিতে বসে আছি। আবার মনে হয়, হিমালয়ের কোনো নীরব গম্ভীর গুহায় সংসার বৈরাগ্যে আত্মনিবেদিত কোনো সাধকের কুঠিয়ায় বসে আত্মবিভাষণে মগ্ন।
উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সময়-প্রকৃতি-বাস্তবতা পরিবেশ আর মানুষকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার অনবদ্য প্রবণতা এটাই ব্যক্তি বুদ্ধদেবের জীবনের যেমন অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তেমনই এই বৈশিষ্ট্যের জন্যেই বুদ্ধদেবের সৃষ্টিগুলি একই বিষয়কেন্দ্রিক হলেও কখনোই তা পাঠকের কাছে পৌনঃপুনিকতার দোষে দূষ্ট বলে মনে হবে না। এই একঘেয়েমিবিহীন একটা স্মার্ট জীবনের সন্ধানই হলো বুদ্ধদেব গুহের বিষয় কেন্দ্রে অবিভাজ্য অবস্থান স্বত্ত্বেও বিষয়ান্তরে বিচরণের এক অভ্রান্ততার ভিতর দিয়ে সাফল্যের শিখরে কালে কালান্তরে স্থিত থাকার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। উচ্চবিত্তের আভিজাত্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকা হাহাকার যে কোনো মানসলোকের রিক্ততার কলকণ্ঠের ভিতরে মুক্তিলোকের চাবি খুঁজে ফেরে- তার সন্ধান আমরা পাই বুদ্ধদেব গুহের সৃষ্টির ভিতর দিয়ে। উচ্চবিত্তের মানুষদের যাপনচিত্রের ভিতরে ও যে শূন্যতার শোকসভা বসে তার সন্ধান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা করি না। আর সেই না করবার জন্যেই সামাজিক বৈষম্যের ছবিটা এমন প্রকট হয়ে, এমনতরই কঙ্কালসার হয়ে আমাদের সামনে বারবার নিজের কপাটখানা খুলে ধরে। সেই খোলা দুয়ার দিয়ে দেখা না দেখা ছবিগুলির পরতের পর পরতে বিশ্লিষ্ট সময়ের আস্তরণ ভেদ করে আমাদের সামনে মেলে ধরেছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। তাঁর এই কপাট উন্মোচনের ভিতরে কখনো চপলতা ছিল না। অথচ ছিল বনের হরিণের মতো গ্রীবা বাঁকানো একটা ভঙ্গিমা।
নাতনী নন্দিনী দেবীর পোষা হরিণ হারিয়ে যাওয়া বেদনাকে ভাষা দিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- আকাশকে সে চমকে দিতো বনে- কে তারে বাঁধলো অকারণে।
বুদ্ধদেব গুহের জীবনাবসানের পর বারবারই কেবল মনে হচ্ছে; আমার মনের সেই বনের হরিণকে কেই বা অকারণে বাঁধলো? যে মানুষটির কলমের চোখে আমরা প্রকৃতির অরূপমাধুরীকে যুগের পর যুগ পান করেছি, হৃদয়ে সেই মাধুরীর সুধারস স্থাপন করে বলেছি; বুকের সুধার অনুসন্ধানে পথিককে ডাক দিয়েছি, গভীর গোপন বেদনায় কেঁদেছি, অভিমানে মুখ ভারি করেছি, আবার আনন্দে খিল খিল করে হেসেছি।
একটা আত্মাভিমানী চিত্ত হয়তো বুদ্ধদেবের ভিতরে ছিল। সেই চিত্তের তারকাঁটা হয়তো অনেক সময়েই ব্যক্তি বুদ্ধদেবের জীবনে অনেক উথালপাথাল ডেকেছে। যার স্পর্শ আমরা পেয়েছি তাঁর সৃষ্টির মাঝেও। ‘একটু উষ্ণতার জন্যে’-তে লেখকের জীবনের যে ওলটপালটের আভাস, সেই আভাস যেন বুদ্ধদেবের প্রথমজীবনের ব্যক্তিপ্রেম কেন্দ্রিক সৃষ্টি ‘খেলা যখনে’র তাপকেন্দ্রিকতার বিত্তকে টেনেছিঁড়ে চুরমার করে দেয়। মধ্যবিত্ত পাঠক চিত্ত হয়তো কখনোই খুঁজে পায় না লেখক চিত্তের তল-অতল। সেই অতলান্তিক বিয়োগ কেন্দ্রিক নবকুমার বসুর উপন্যাস ‘চিরসখা’কেও যেন কখনো কখনো বাঙালি পাঠকের নীতিনিষ্ঠ মননকে একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু সেই জিজ্ঞাসার সব থেকে বড় উত্তর হলো; লেখকের সত্যের কাছে অকপট স্বীকারোক্তি। এই স্বীকারোক্তির জন্যেই নিত্যবিনোদন যে চিত্তবিনোদনে আঘাত ফেলতে পারে না- তা যেমন দেখিয়ে গিয়েছেন সমরেশ বসু, তেমনই দেখিয়ে গেলেন বুদ্ধদেব গুহ।
সুপ্রিয়া গৌরী ছাড়াও মরিয়ম মান্নান নামক এক বিমানবালা প্রায়ই আসতেন কবি শামসুর রাহমানের কাছে। একটু চপল এবং তরল প্রকৃতির মানুষ। গৌরীর মতো থির বিজুরির ঝিলিক নয়। তাই কাউকেই এড়িয়ে না যাওয়া স্বভাবের কবি লিখেছিলেন- ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও।’ তাই হয়তো চলে যাওয়ার আগে কবি লিখেছিলেন;
“দুঃসময় অন্ধ পাখি অতিকায়, কালো
ছায়া ফেলে আমাদের প্রেমের উপর, আমরাতো
ভিন্নতর ছায়া চাই, পুষ্পবৃষ্টি চাই
সুতীক্ষ্ণ কাঁটার আগ্রাসনে, চাই স্বাদু পায়েসান্ন
করাল কাহাতে। শুধু আমরা দু’জন নয়,
সবাইকে নিয়ে
খরায় অভীষ্ট ঝর্না তলায় আঁজলা ভরে
জলপায়ী হবো। (“ক’দিন তোমার আসা যাওয়া”, রচনাকাল ০৯. ০৪. ১৯৯৫)
ভিন্নতর ছায়ার অনুসন্ধানই হলো বুদ্ধদেব গুহের জীবন আর সৃষ্টির পারস্পরিক বিনিসুতোয় বাঁধা মালার সৌষ্ঠব। আবহমানকালের মানুষকে প্রকৃতির সংমিশ্রণে কেবল দেখাই নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করবার যে ধারা বাংলা সাহিত্যে সূচনা করেছিলেন বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর- সেই প্রবাহমানতাকেই বয়ে নিয়ে চলেছিলেন সমরেশ বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সৈয়দ শামসুল হক, বুদ্ধদেব গুহরা। সেই ধারার শেষ প্রদীপটির এই নির্বাপণ বাংলা সাহিত্যে মেধা আর বিনোদনের সংমিশ্রণের সঙ্গে মানুষ-রতনের অনুসন্ধানের ত্রিবেণী ধারার চর্চার শিখাটাও নিভে গেল। অনুসন্ধিৎসা যে কেবল অনুভূতিবিহীন কোনো অভিব্যক্তি হতে পারে না- বুদ্ধদেব গুহ তাঁর উপন্যাস থেকে ছোটগল্পের ধারা অতিক্রম করে কথোপকথনের নিবিড় প্রজ্ঞায় প্রকাশ করেছিলেন।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে নয়ের দশকের শেষের দিকে বুদ্ধদেব গুহের যে সখ্য তৈরি করেছিল- সেই ঘটনাক্রম আমাদের গভীর যন্ত্রণা দিয়েছিল। এই সময়কালে বাঙালির চিত্র চিত্রণে বুদ্ধদেবের যে মানসিক অবস্থান, বাঙালি মুসলমানের প্রতি একটা কৌনিক ভাবনা তা অন্নদাশঙ্কর রায়কে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। অবিভক্ত বাংলার উদার সামাজিক পরিবেশের একটা রেশ বুদ্ধদেবের শৈশবে পড়েছিল। রংপুর কেন্দ্রিক তাঁর একদম প্রথম জীবন উত্তরবঙ্গের সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে চেনাতে এবং চিনতে সহায়ক হয়েছিল বুদ্ধদেব গুহের জীবনে। কিন্তু সেই চেনার রেশটিকে তিনি ধারণ করেছিলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। এই আঙ্গিকের ভিন্নতাকে এক ধরনের বিকৃতি বলেই মনে হয়েছিল অন্নদাশঙ্করের কাছে। যখন বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার রচনার মতো কাজে বুদ্ধদেব গুহের মতো মানুষ নিজের মননশীরতা, ধী শক্তি, বুদ্ধিমত্তাকে খরচ করেছিলেন, তখন আমরা সবাই ব্যথিত হয়েছিলাম। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম।
আবার এই বুদ্ধদেব গুহই জ্যোতি বসুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন অনেকবারই। বামফ্রন্ট সরকার তাঁকে যথোচিত মর্যাদা দিতে এতোটুকু কার্পণ্য কখনোই দেখাননি। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো নেতিবাচক অবস্থানও বুদ্ধদেব গুহ কখনোই নেননি। বামফ্রন্টের উগ্র সমর্থক হিসেবেও যেমন তিনি কখনোই নিজেকে মেলে ধরেননি, তেমনই একটা সময়ের পর থেকে শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষ যেমন বামফ্রন্টের প্রকাশ্য বিরোধিতায় পথে নেমেছিলেন- তেমনটাও কখনোই বুদ্ধদেব গুহ করেননি।
রাজনৈতিক চিন্তনের ক্ষেত্রে একটা অস্থির মতির মানসিকতা নিয়ে চলতেন বুদ্ধদেব গুহ- এই কথা বললে হয়তো খুব একটা সত্যের অপলাপ হবে না। কারণ; বুদ্ধদেবের যে মেধা এবং চপল হরিণের মতো প্রেমিকসত্তা পরিপূর্ণ হৃদয়, সেখানে দলীয় রাজনীতির খুঁটিনাটি সত্যিই বেশ বেমানান। তাই একটা আবেগ নিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সাময়িকভাবে সেই সময়কালে সহনাগরিক মুসলমানদের সম্পর্কে কটু কথা বলে, নেতিবাচক মন্তব্য করে নিজেকে আপামর পাঠক সমাজের কাছে বেশ কিছুটা বিতর্কিত করে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে যখন সখ্য পর্ব চলছিল বুদ্ধদেব গুহের তখন নারী প্রগতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে তিনি দেখেছিলেন তসলিমা নাসরিনকে। পবিত্র ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করে প্রকারান্তে বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদকে মদদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে উঠে আসতে বাঁধা সৃষ্টি করবার যে রাজনীতি সেই সময় থেকেই তসলিমা করে আসছেন, নিজের অপরিণত রাজনৈতিক বোধ থেকে তসলিমার সেই রাজনৈতিক অভীপ্সাকে হয়তো ততোটা বুঝে উঠতে পারেননি বুদ্ধদেব গুহ। সেই সময়কালে মূল ধারার প্রচার মাধ্যমগুলি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির আস্ফালন ঘিরে একটা নব অবস্থান পালন করে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, রাজাকার পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সঞ্জীবিত হয়ে মানুষ শহিদ জননী জাহানারা ইমাম, বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফি, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অনুপম সেন প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের নবপর্যায়ের যে সূচনা করেছেন, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে গণআদালত হয়েছে- এইসব পর্যায়গুলিকে এপার বাংলায় একমাত্র বামপন্থী সংবাদ সাময়িক ‘দেশহিতৈষী’ ছাড়া কেউ তেমন প্রচারই করত না। অপর পক্ষে শিবনারায়ণ রায়, নিখিল সরকারের মতো বুদ্ধিজীবীরা সুফিয়া কামালদের নামোচ্চারণ না করেই তসলিমাকে নিয়ে যে আদিখ্যেতা দেখাতেন, তাতে একটা বড়ো অংশের মানুষের কাছে মনে হয়েছিল, ধর্মান্ধ বাংলাদেশে একমাত্র জ্ঞানের আলো হলেন এই ইসলামফোবিয়া ছড়ানো খ্রিস্টান মৌলবাদের তল্পিবাহক তসলিমাকে। এই পর্যায়ে প্রচলিত ধারাতে নিজেকে মিলিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। এই পর্যায়টি তাঁকে আমজনতার ভালোবাসার আসন থেকে কিছুটা হলেও বিচ্ছিন্ন করেছিল।