alt

সাময়িকী

তারাশঙ্করের ‘কবি’ এবং উত্তরহীন অনন্ত জিজ্ঞাসা

: সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় / জন্ম : ২৩ জুলাই ১৮৯৮; মৃত্যু : ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস ‘কবি’ জীবন জিজ্ঞাসার এক অনিঃশেষ লহরি। তারাশঙ্কর জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাঢ় বাংলার ভৌগোলিক সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যমণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে। তারাশঙ্কর যে অঞ্চলের সেথায় বাঙালি সংস্কৃতির অমৃত ধারায় ঋদ্ধ কবিগান ও ঝুমুর গানের প্রচলন ছিল। কবিগান পরিবেশনকারীরাই হলো কবিয়াল। এই উপন্যাসটির উপজীব্যতা কবিয়াল ও ঝুমুর দলকে ঘিরেই। কবির নায়ক নিতাইচরণ কবিয়াল থেকে কবিতে উত্তীর্ণ। রাজনীতি নিরপেক্ষ উপন্যাস ‘কবি’ নিঃসন্দেহে নিতাইচরণের স্বোপার্জিত কাক্সিক্ষত সামাজিক মর্যাদায় উত্তীর্ণ হওয়ার ইতিহাস।

নিতাই অন্ত্যজ শ্রেণির অশিক্ষিত যুবক হলেও তার রয়েছে অসাধারণ কবি প্রতিভা ও আবেগ-আপ্লুত হৃদয়। ফলে কবিগান শোনার অদম্য নেশা থেকে নিতাইয়ের সত্তায় কবিত্বের জাগরণ ঘটে।

“অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার”- রবীন্দ্রনাথের এ উক্তিটির যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে কবিয়াল নিতাইয়ের চরিত্রালেখ্যে।

ছন্দ ও সুরের লালিত্যে অমিয় ব্যঞ্জনায় যখন নিতাইয়ের মুখ থেকে কবিতার চরণ ঝংকৃত হয় তখন রবীন্দ্রনাথের এ উক্তিটি নিতাইয়ের জীবনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। মূলত নিতাইয়ের মহত্ত্ব ও প্রণয়াবেগ হলো উপন্যসের মূল সুর।

কে এই নিতাই!

এক বাক্যে বলা চলে নিতাই ‘গোবরে পদ্মফুল’। তার শেকড় ধরে টানলে যে চিত্রকল্প মঞ্চস্থ হয় তাতে চোখ ছানাবড়া হওয়ার যোগাড়। হিন্দু সমাজের প্রায় পতিততম স্তরের অন্তর্গত ডোম বংশের ছেলে সে, খুনির দৌহিত্র, ডাকাতের ভাগিনেয়, ঠ্যাঙাড়ের পৌত্র, সিঁধেল চোরের পুত্র। শহরাঞ্চলে ডোম বলতে শ্মশানচারি যে শ্রেণিকে বোঝায়, এই ডোম মোটেই তা নয়। এই ডোমেরা বীরবংশী উপাধিধারী, বাংলার বিখ্যাত লাঠিয়াল। তাদের বীরত্বের জন্য নবাবি পল্টনে তাদের ছিল প্রচুর কদর। তবে পরবর্তীতে তারা কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার কারণে নবাবের আশ্রয়চ্যুত হয়।

এই বীরবংশী ডোমদেরই উত্তরাধিকারী কবিয়াল নিতাই। মায়ের অনুরোধ কিংবা মামার শাসনও নিতাইকে তার মনোভাব থেকে টলাতে পারেনি। সে পড়াশোনা ছেড়ে ডাকাতির দলে নাম লেখায়নি।

নিতাইয়ের উত্থান দৃষ্টান্ত বিরল নয়। প্রহ্লাদ দৈত্যকুলে জন্ম নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রহ্লাদের পিতা হিরণ্যকশিপু দৈত্য হলেও রাজা ছিলেন। মৌলিক মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ রচয়িতা ছিলেন দস্যু রতœাকর। তিনি বাল্মিকী নাম ধারণ করলেও তিনি ছিলেন সদ্বংশীয় ব্রাহ্মণ সন্তান। সে তুলনায় নিতাইয়ের বংশ সমাজ কর্তৃক আরো অবহেলিত ও অবজ্ঞাত।

রাত্রির অন্ধকারের মতো কালো নিতাইয়ের গায়ের রঙ। দেহ বড়ই কঠিন-সবল ও দীর্ঘ। তার দৃষ্টিতে আছে সকরুণ্য বিনয়। হীন বংশের সন্তান হয়েও নিতাই কখনো চুরি ডাকাতি করেনি।

বিদ্যানুরাগী নিতাই সকল প্রতিকূলতাকে পায়ে ঠেলে, অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলেই বছর তিনেক পাঠশালায় পড়ার সুবাদে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী আয়ত্ত করে ফেলে। উপন্যাসের ভাষায়, “নিতাইয়ের গুণাগুণ কবিয়ালরা জানিত, কবিগান যেখানেই হোক, সে গিয়া ঐ দোয়ারদের দলে মিশিয়া বসিয়া পড়িত, কখনো কাঁসি বাজাইতো- আর দোয়ারের কাজে তো প্রথম হইতে শেষপর্যন্ত বেগার দিয়া যাইতো।”

এক্ষণে বলে রাখি, কবিগান তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করা হয়। সেইসাথে সুরারোপ করে উন্মুক্ত আসরে শত শত শ্রোতার সামনে নির্দিষ্ট বিষয় ধরে বিতর্ক-বিত-ার ঢংয়ে পরিবেশন করা হয়। বিতর্কমান দুটো দলে বিভক্ত হয়ে কবিগান প্রতিযোগিতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার শৈলীতে পরিবেশিত ও মঞ্চস্থ হয়। প্রতিদ্বন্দ্বি দুটো দলেই একজন করে কবিয়াল বা সরকার থাকেন। আরো থাকেন দোহার বা দোহারি, যে মূল কবিয়ালের কথাকে বার বার পুনরাবৃত্তি করে সময়ক্ষেপণ করেন, যাতে মূল কবিয়াল নতুন পদ বাঁধতে পারেন।

আলোচ্য উপন্যাসে নিতাই শখবশত দোহার থাকলেও পরে নিজ আগ্রহ ও চেষ্টায় কবিয়াল হিসেবে আবির্ভূত হয়। কবিয়াল হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সাধারণত একজন কবিয়াল স্বল্প শিক্ষিত হলেও তিনি একাধারে কবি ও শিল্পী। তিনি গান-ছন্দ-লয়-তাল-পর্ব-মাত্রা সম্পর্কে সিদ্ধহস্ত এবং কবিতার অন্ত্যমিলে পারদর্শী। একদিকে খেটে খাওয়া মানুষের আনন্দ-বেদনা সম্পর্কে যেমন ওয়াকিবহাল তেমনি অন্যদিকে মেধাগুণে-চর্চাগুণে ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, লৌকিকতা, আধ্যাত্মিকতা- সকল বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও বোধের অধিকারী।

তো নিচু বংশের জন্মানো সেই নিতাই চরণ গ্রামের সবাইকে চমকে দিয়ে কবি হয়ে ওঠে! সে আরেক কাহিনী। অট্টহাস গ্রামের কবি গানের পালায় নোটন দাস ও মহাদেব পাল ছিলেন খ্যাতনামা কবিয়াল এবং দুজনেই এখানকার পালাগানে বাঁধা ছিলেন। এবারের মেলায় প্রতিষ্ঠিত কবিয়াল নোটনদাসের অনুপস্থিতিতে নিতাইয়ের সামনে নিজের কবিয়াল পরিচয় দেয়ার সুযোগ খুলে যায়। যদিও মহাদেবের কাছে নিতাই হেরে গিয়ে ছিল। তাতে কী! পরোক্ষভাবে জয় হয়ে ছিল নিতাই চরণের। তাই অভিজাত বাবুরাও বিস্ময়ে স্বীকার করলেন, “ণবং! এ রীতিমতো একটা বিস্ময়! ঝড়হ ড়ভ ধ উড়স-অ্যাঁ-ঐব রং ধ ঢ়ড়বঃ!”

নিতাইয়ের রক্তকণিকায় আত্মীয়-স্বজনের গভীর রাত্রে নিঃশব্দপদসঞ্চারে নির্ভয় বিচরণ ছিল অজ্ঞাত। বীরবংশীরা নীতি ও ধর্মের কথা শুনলে ব্যঙ্গ করে হাসতো। তারা নিতাইয়ের চৌর্যবৃত্তি বিমুখতার জন্য তার ভীরুতাকে দায়ী করতো এবং তারা তাকে ঘৃণা করতো। এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারাশঙ্কর জীবনের এক সুদূর রহস্য প্রকাশের নিমিত্তেই যেন নিতাইকে গড়ে নিলেন।

বাবুদের কাছে সরল অথচ গভীর বোধসম্পন্ন স্বীকারোক্তি নিতাইচরণের চরিত্রের আরেক মহানুভবতা। হাতজোড় করে সে বলেছিল, “আজ্ঞে প্রভু, চুরি জীবনে আমি করি নাই। মিছে কথাও আমি বলি না হুজুর, নেশা পর্যন্ত আমি করিনা। জাত-জ্ঞাত মা ভাইয়ের সঙ্গেও এইজন্যে বনে না আমার। ঘর তো ঘর, আমি পাড়া পর্যন্ত ত্যাজ্য করেছি একরকম। আমি থাকি ইস্টিশানে রাজন পয়েন্টসম্যানের কাছে। কুলিগিরি করে খাই।”

নিজ পরিবার পরিজনের অন্ধকার আহ্বান থেকে বের হয়ে নিতাই তার ভ্রাম্যমাণ দপ্তর হাতে পাড়ি দিয়ে ছিল জীবনের অন্য দিগন্তে। রাস্তাঘাট থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মুদ্রিত ছিন্নপত্র এবং বিচিত্র উৎস থেকে সংগৃহীত বই ছিল এই ভ্রাম্যমাণ দপ্তরের ধনরাশি। জীবনব্যাপি নিতাইয়ের সঙ্গী ছিল এই দপ্তর।

প্রথমে সে গ্রামের ঘনশ্যাম গোঁসাইয়ের বাড়ি মাহিন্দারের কাজ নেয়। কিন্তু গোঁসাইজীর গোপন হীন ব্যবসার শরিক হতে পারলো না বলে এখানে স্থিতি হলো না। অবশেষে বন্ধু রাজালালের সান্নিধ্যকেই মনপ্রাণ সঁপে গ্রহণ করেছিল নিতাই। রাজালাল পার্শ্ববর্তী রেলওয়ে স্টেশনের পয়েন্টসম্যান, গানের সমঝদার। ভরণপোষণের তাগিদে পেশা হিসেবে নিতাই বেছে নিলো কুলিগিরি।

তারপরেই এলো নিতাইয়ের জীবনে চিরন্তন প্রেম। যে প্রেম ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। আসা-যাওয়ার পথে কখন যে কে কার নয়নে লেগে যায়; যেমনটি রাজনের শ্যালিকা ঠাকুরজি লেগে গিয়ে ছিল নিতাইয়ের নয়নে। ‘দীঘল দেহভঙ্গিতে ভুঁইচাপার সবুজ সরল ডাঁটার মতো অপরূপশ্রী’ ঠাকুরঝি কবিয়াল নিতাইয়ের জীবনব্যাপি প্রেরণাময় এক অনিঃশেষ সঞ্চয়।

ঠাকুরঝি পার্শ্ববর্তী গ্রামের গৃহবধূ। ঘটি মাথায় দুধের পসরা নিয়ে প্রতিদিন আসে সে এ গ্রামে। নিতাই ঠাকুরঝি থেকে একপোয়া করে দুধ নেয়।

তারপর ভালোবাসার টানে প্রতিদিন সে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঠাকুরঝির প্রতীক্ষায় থাকে। নিতাইয়ের চোখে রেললাইন ধরে, ক্ষারে কাচা তাঁতের মোটা সুতার খাটো কাপড়খানি আঁটসাঁট করে পরা কালো দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে ঠাকুরঝি পিতলের ঘটি মাথায় ক্রমে এগিয়ে আসা ‘স্বর্ণবিন্দুশীর্ষ শুভ্র চলন্ত রেখা’র মতো।

অবসরে চলে ‘বেনেমামা’র দোকানে আড্ডা। সেখানে কবিপ্রতিভা নিয়ে বিপ্রপদের পরিহাস ও বিদ্রুপ প্রতিদিন নিতাইকে সহ্য করতে হয়। কিন্তু এতোসব প্রতিকূলতা নিতাইয়ের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। ঠাকুরঝির প্রতি প্রেমের মগ্নতাই তাকে সৃষ্টির পথে উত্তরোত্তর এগিয়ে নেয়। ঠাকুরঝির প্রেরণা তাকে কবিত্বের জগতে বুঁদ করে রাখে।

যেদিন থেকে নিতাই জনসমক্ষে কবিয়াল হিসেবে নতুন পরিচিতি পেলো, সেদিন থেকেই এক অপার সম্ভ্রমবোধে সে আচ্ছন্ন হলো।

মোট বহন করাকে নিতাই অশোভন মনে করে ছেড়ে দিলো। ফলে নিতাইয়ের একাকী জীবনের নামমাত্র সংসারেও অভাব হানা দিলো।

অভাব-অনটনের মধ্যে নিতাইয়ের অন্তর্জগতে ঠাকুরঝির ছবি ভেসে ওঠে। নিতাই অনুভব করে ঠাকুরঝি তার ‘মনের মানুষ’। ঠাকুরঝিকে উপলক্ষ করেই তার অন্তরে গান আসে।

একদিন রাজন ঠাকুরঝিকে তার গায়ের রং প্রসঙ্গে ভর্ৎসনা করে। নিতাই তাতে পীড়িত হয়ে গুনগুন করে, ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদো কেনে?’

অন্যদিন ঠাকুরঝির খোঁপায় কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখে আবার গেয়ে ওঠে, “কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?” এ যেন অসমাপ্ত কলির অভূতপূর্ব সমাপ্তি! কবিয়াল নিতাই ক্রমশঃ কবি হয়ে উঠার পথপরিক্রমায় এ যে সাফল্যের পদচিহ্ন বৈ কিছু নয়!

তারাশঙ্করের এই ‘কবি’ উপন্যাসে একজন কবির শক্তিমত্তা ফুটে উঠেছে নিতাইয়ের কবিত্বে। উপন্যাসখানিতে তারাশঙ্কর তাঁর কল্পনা ও অভিজ্ঞতার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়েছেন।

গল্প এবং চরিত্রের জন্য তিনি এ দু’সূচকেই হাত পেতেছেন। প্রকৃতপক্ষে কবিত্বের কৃতিত্ব পুরোটাই তারাশঙ্করের। নিতাই জীবনের পথ খুঁজে বেড়ায়। চুরি-ডাকাতির মোহ তার মামার রক্তে যে উল্লাস সৃষ্টি করে তা থেকে সে মুক্তি চায়। দিশা খুঁজে বেড়ানো নিতাইকে খুঁজে পাওয়া যায় তার গানে। উপন্যাসের প্রত্যেকটি গান যেন নিতাইয়ের জীবনের অর্জিত এক একটি আলোকবর্তিকা।

নিতাইয়ের গানের যিনি স্রষ্টা সেই তারাশঙ্কর নিজেই ‘কবি’ উপন্যাসের গান প্রসঙ্গে বলেছেন, “কবি-র গানগুলি কিন্তু সংগ্রহ নয়। ওগুলি সবই আমি রচনা করেছি। কীভাবে করেছি বলতে পারিনা। মোহিতলাল ‘কবি’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে গানগুলির কথাই আগে বলেছেন। বলেছেন, এই গানগুলিই কবির প্রাণশক্তি। আমি সেসময় নিতাইয়ের মতোই ভাবতে পেরেছিলাম। ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো ক্যানে’- এই লাইনের সঙ্গে অনেক লাইন বেঁধেছি। যেমন- ‘কালো চোখের তারায় তবে আলো এমন হাসে ক্যানে?’

‘কালাচাঁদের কোলের লাগি সোনার রাধা কাঁদে ক্যানে?’ অনেক লাইন। কিন্তু কেটে দিয়েছি। ও নিতাইয়ের রচনা হয়নি।...”

মনে হয় যেন তারাশঙ্কর দূরলোকের কোনো মন্ত্রবলে কবিয়াল নিতাইয়ের মনোলোকে প্রবেশ করে তার জীবনব্যাপি অপূর্ব কাব্যরস আর সুরের ভাষা আপনা আপনি বুনে দিয়েছেন।

সমগ্র উপন্যাসখানি জুড়ে যে অন্তর্লোকের ভাবমন্ডল তা নিঃসন্দেহে নিতাইয়ের স্বরচিত গানের জন্য। আর এই কাব্য প্রেরণার সঞ্চার হয়েছে ঠাকুরঝির প্রতি তার অমোঘ টান থেকে।

সে অনুভব করে ঠাকুরঝিকে সে ভালোবাসে। কিন্তু এ ভালোবাসার সামাজিক কঠিন বাস্তবতা তাকে মহাসংকটে নিপতিত করে। ঠাকুরঝি ভিন্ন জাতি এবং অন্যের স্ত্রী। নিতাই দারিদ্র্যক্লিষ্ট হলেও নৈতিকতার মোড়কে আবদ্ধ সৃজনপ্রয়াসী। পাপপুণ্য ভেবে ভেবে অস্থির হয় সে। ফলে ঠাকুরঝির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাকে সে মহাপাপ ধরে নেয়। পরিস্থিতির জটিলতায় নিতাই গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠাকুরঝিকে সে ভালোবাসলেও আকাশের চাঁদরূপেই মনের গহীনে রেখে দেয়।

তারপর শুরু হয় কাহিনির দ্বিতীয় পর্যায়। নিতাইয়ের জীবনে আসে দ্বিতীয় ভালোবাসা। বন্ধু রাজন যে কিনা সঙ্গীতের সমঝদার সে এক ভ্রাম্যমাণ ঝুমুরদলকে নিয়ে এসে হাজির হয়।

এবার কবিগান ও ঝুমুরদল সম্পর্কে তারাশঙ্করের বয়ান শুনে নেই। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের, বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলের মেলায় ঘুরে ঘুরে নিম্নস্তরের দেহপণ্যাদের নিদারুণ দুর্দশা আমি দেখেছি। এদের অধিকাংশ অবশ্য প্রেমের ছলনায় ভুলে গৃহত্যাগ করে এই পাপ-পঙ্কিল চোরাবালিতে এসে পড়ে তিলে তিলে ডুবে মরে যায়।...

মেলার পর মেলা ঘুরেছি, তথ্য সংগ্রহ করেছি। দেখেছি। ঝুমুরদলের মেয়েরা এ থেকে কিছু স্বতন্ত্র। ঐ নিছক দেহপণ্যাদের অস্তিত্ব তো অনেক পরে জেনেছি। কিন্তু ঝুমুর দেখে আসছি বাল্যবয়স থেকে। আমাদের গ্রামে বা কাছাকাছি গ্রামে মেলায় এইসব দেহপণ্যাদের প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। কিন্তু ঝুমুর আসতো। ঝুমুর না-হলে মেলা হয় না। সে ঐ দোয়ারকির জন্য।

ঝুমুরদলের মেয়েরা কবিগানে দোয়ারকি করত এবং নাচত। আমাদের বাল্যবয়সে এই কারণে কবিগান শোনা নিষিদ্ধ ছিল এবং সন্ধের পর এক যাত্রা বা থিয়েটারের আসরে অভিভাবক ছাড়া থাকতে পেতাম না।”

এই ঝুমুরদলের মেয়ে কৃষতনু গৌরাঙ্গী বসন্ত। সবাই তাকে ‘বসন’ নামে ডাকে। কবিয়াল নিতাই একপর্যায়ে ঝুমুরদলটির প্রধান কবির পদে অধিষ্ঠিত হলো। স্টেশন ছেড়ে নিতাই আলেপুরে ঝুমুরদলের বাসিন্দা হয়ে গেলো। ঝুমুরদলের মেয়েগুলো নিম্নশ্রেণীর বারাঙ্গনা। বসন্ত ব্যতীত তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ‘মনের মানুষ’। অবশেষে ঝুমুর দলের প্রাঙ্গণ হলো কবিয়াল নিতাইয়ের সাধন-ক্ষেত্র। ‘বসন’ হলো নিতাইয়ের সাধনার উত্তরসাধিকা।

মাঝে মাঝে ঠাকুরঝির স্মৃতি উঁকি দিলেও ঝুমুর দলের জন্য গড়ে ওঠা অস্থায়ী বেশ্যা-পল্লিতে নিতাই তাদের অসঙ্গত জীবনের সাথে ক্রমে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। রাত বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় মেলার বিভৎস দৃশ্য। শুরু হয় মানুষের আদিম প্রবৃত্তির নগ্ন প্রকাশ!

বসন্ত-নির্মলা-ললিতার খুপড়িতে আগন্তুকের আসা-যাওয়া দেখে, নিতাইয়ের কবি সত্তার অনুষঙ্গী নীতিবোধের সাথে অবিরাম যুদ্ধ চলে। নিতাই পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে।

একরাতে ঝুমুর দলের ‘নগ্ন জীবনের প্রমত্ত তৃষ্ণার গান’ অর্থাৎ খেউড়, অশ্লীল রসে উন্মাতাল হয়ে উঠার আসরে নিতাইয়ের নিজস্ব রুচিমাফিক গান জনতাকে তুষ্ট করতে পারছিলো না। মঞ্চে নৃত্যরত বসন্ত অপমানিত বোধ করলো। আক্রোশে চপোটাঘাত করে বসলো সে নিতাইকে। তারপর নিতাই আকণ্ঠ মদ পান করে ছন্দোবদ্ধ অশ্লীল ছড়ায় ফিরিয়ে আনলো ভাঙ্গা আসরের প্রাণ। তারাশঙ্করের ভাষায় এ যেন “বীরবংশী রক্তের বর্বরত্বের মৃতপ্রায় বীজাণুগুলি মদের স্পর্শে- জলের স্পর্শে মহামারির বীজাণুর মতো, পুরাণের রক্তবীজ হইয়া অধীর চঞ্চলতায় জাগিয়া উঠিতেছে।”

ইতোমধ্যে বসন্ত বুঝে যায়, সে নিতাইকে ভালোবেসে ফেলেছে। পরম মমতায় নিতাইয়ের বমিক্লিষ্ট কাপড় বসন ধুয়ে দেয়। দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সুখ-দুঃখের কথায় মগ্ন হয়। বসন্ত নিজের কোনো কিছুই গোপন করে না। অকপটে জানিয়ে দেয় তার ক্ষয়রোগের কথা।

নিজের অদৃষ্টের পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন বসন্ত। নিতাই বসন্তের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে। বসন্তের প্রতি সহানুভূতি জানায়। অবশেষে নিতাই এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একপর্যায়ে বসন্তের কথায় আবেগ-আপ্লুত হয়ে বসন্তের আঁচল টেনে নিজের চাদরের খুঁটে বেঁধে নেয়। নিতাই প্রত্যয়ের সুরে বলে, “আমি যদি আগে মরি, তবে তুমি সেদিন খুলে নিও এ গিঁট; আর তুমি যদি আগে মর, তবে সেইদিন আমি খুলে নোব গিঁট।” তারপর গাঁটছড়া বাঁধা অবস্থাতেই সলজ্জ বসন্ত নিতাইকে নিয়ে ফিরে আসে।

ক্ষণেক্ষণে অভিমানী বসন্ত অভিমান করে। কখনো কাঁদে। নিতাইয়ের মন উদাসীন হয়। বসন্তকে নিয়ে মুখে মুখে বাঁধা গানগুলো শেষ হয় না, লেখাও হয় না, অসমাপ্ত গান হারিয়ে যায়। আবার ঠাকুরঝির কথা মনে করে আনমনা হয়।

হঠাৎ কোনো এক মুহূর্তে নিতাই বসন্তকে এক অসমাপ্ত কলি শোনায়-

“এই খেদ আমার মনে মনে।

ভালোবেসে মিটলনা আশ-

কুলাল না এ জীবনে।

হায়, জীবন এত ছোট কেনে?

এ ভুবনে?”

গানটি শোনার সাথে সাথে বসন্তর দুই চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। বসন্তর প্রেম-পিয়াসী মন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দুজনার আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

তারপরেও দিন যায়, দিন আসে। বসন্ত সেবা ও চিকিৎসায় ভালো হয়। নিজের ঘরে আগন্তুকের প্রবেশ প্রতিহত করতে চাইলেও মাসির কঠোর শাসনের কারণে পেরে ওঠে না। আবারো রোগে কাহিল হয়। নিতাই পরম মমতায় পরিচর্যা করে। এমতাবস্থায় বেহালাদারের করুণ সুর বসনকে অস্থির করে তোলে। নির্মলার ‘মনের মানুষ’ এই বেহালাদার। নির্মলার ঘরে যেদিন আগন্তুকের প্রবেশ ঘটে সেদিন বেহালাদারের বেহালায় এক অদ্ভুত করুণ সুর ধ্বনিত হয়। বসন চিৎকার করে নিতাইকে বলে, বেহালাদারের ওই সুর বাজানো বন্ধ করতে।

সমগ্র উপন্যাস জুড়ে প্রেম-ভালোবাসার যে আর্তি, বেহালাদারের করুণ সুরে তার এক ভিন্ন ঝংকার ঝরে পড়ে। এই ঝংকারে প্রেমের সুমন্দ বাতাস বহে না; এই ঝংকারে কেবল প্রেমের পথ চাওয়াতে কান্না ঠিকরে ওঠে। যেন মনের মানুষকে একজীবনে পেয়েও হারানোর বেদনার দহন, থেকে থেকে পরাণ মাঝে গভীর সর্বনাশের ঝড় তোলে।

পুরো এক মাস রোগ ভোগের পর বসন তার দেহবর্ণের উজ্জ্বলতা ও লাবণ্য হারায়। একদা ভালোবাসায় বিমুখ নারী আজ ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসাময় জীবন যাপনের তৃষ্ণায় কাতর বসন কেবল কাঁদে। সে তার অনিবার্য অভিযাত্রার কথা ভেবে মুষড়ে পড়ে। কুৎসিত ব্যাধি মৃত্যুকে তার দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে। নিতাইয়ের বাঁধা অসমাপ্ত গান তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়,- “জীবন এত ছোট কেনে- হায়।”

সেদিন রাত্রির শেষ প্রহরে বসন্ত রোগের বিকারে প্রলাপ বকতে শুরু করে। তার শরীর হিম হয়ে আসে। নিতাই বুঝতে পারে, এ যে মৃত্যুবিকার। নিতাই বসনের নাড়ির মন্থর গতি অনুভব করে তাকে ‘গোবিন্দের’ নাম স্মরণ করতে বলে। সাথে সাথে ভালোবাসার অতৃপ্তি নিয়ে বসন নিতাইয়ের অনুরোধ প্রত্যাখান করে।

কি দিয়েছে ভগবান তাকে!

ঘর-সংসার কিছুই পায়নি সে!

কিন্তু মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে মানবের সংশয় চিরকালীন। সে রহস্যময় জীবনের প্রতি অজানা ভয়, অজানা আশঙ্কা মৃত্যুকালে মানবকে কঠিন হস্তে চেপে ধরে। ইহজগতে যত দুঃখ-কষ্টই ভোগ করুক না কেনো; স্রষ্টাকে নিয়ে যত অবিশ্বাসের দোলাচলে দোলুক না কেনো; দুর্বল মানব অবশেষে সেই অদৃশ্য শক্তির কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে। জীবনের এ অমোঘ নিয়তি থেকে মানবের রেহাই নেই। যেমন আলোচ্য উপন্যাসের বসন প্রথমে বলে, সে গোবিন্দের শরণার্থী হবে না; কিন্তু জীবন সায়াহ্নে সে গোবিন্দের কাছেই দয়া প্রার্থনা করে। এমনি ভালোবাসাপূর্ণ পুনর্জন্মের আকুল প্রার্থনার মাঝেই বসনের জীবনপ্রবাহকে থামিয়ে দেয় মৃত্যুর করাল থাবা।

বিপর্যস্ত মর্মাহত নিতাই গঙ্গাতীরবর্তী শ্মশানে দাহ করে বসনের মরদেহ। নিতাইয়ের বাঁধা অসমাপ্ত সেই গান অবিরত নিতাইয়ের মননে উঁকি দিতে থাকে। কবিয়াল নিতাই আরো গভীরভাবে পড়ে যায় জীবন-মৃত্যু ও স্বর্গ-নরকের প্রশ্নবাণে। নিতাইয়ের অন্তর্লোকে ধ্বনিত হয় প্রজ্ঞার ঐকতান। একপর্যায়ে অনুধাবন করে, মৃত্যু যেন তার মনের কাছে হেরে গেলো। এ অনুভূতি তাকে খানিক তৃপ্ত করতে পারলেও তার কবিমনের বিষণœতা খোঁচাতে লাগলো। এখন সে জীবনের কোন পথ খুঁজে নেবে!

অবশেষে নিতাই বিবাগী-বৈরাগী হওয়ার মধ্যে মুক্তি খুঁজে নেয়। কবিয়াল নিতাই ‘মুসাফের’ হিসেবে চলে আসে কাশীতে। এখানে এক বাঙালি মা ঠাকরুন তাকে স্বদেশে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। তাছাড়া অচিরেই কাশীর প্রতি দীর্ঘদিনের মোহে নিতাইর ভাটা পড়ে। কাশীর ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোর ইহজীবনের গানের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই; ভাষাগত সমস্যা ও বিরূপ পরিবেশতো আছেই। তাই নিতাই মাসখানেক কোনোমতে কাশীতে কাটিয়ে তার নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চাপে।

নিতাই বসনকে হারিয়েছে। সে বুঝতে পেরেছে, ছোট্ট এ জীবনে মানবের ভালোবেসে আশ কভু মেটে না। গভীর প্রেম মানব জীবনের ক্ষুদ্র ক্যানভাসে সংকুলান হয় না। আসলে মৃত্যুই ভালোবাসার যবনিকা টানে।

নিতাই স্টেশনে নামে। শেকড়ে ফেরার আনন্দে তার চোখে জলের ধারা। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় রাজাসহ বসে। দূরে দুটি লাইন যেখানে একটি বিন্দুতে মিশে গেছে বলে মনে হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতেই ঠাকুরঝির স্মৃতি তাকে আন্দোলিত করে। উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয়ে ঠাকুরঝির মৃত্যুর কথা রাজন তাকে জানায়। নিতাইয়ের বুকে ঝড় নামে, নয়নে বারি। ক্লিষ্ট কবিয়ালের হৃদয়ে আবার অনুরনিত হয়, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’

কৃষ্ণচূড়া গাছের স্মৃতিরা একের পর এক নিতাইয়ের মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে। ঠাকুরঝির পাশাপাশি বসনের কথাও মনে পড়ে। নিতাইয়ের উদ্দেশ্যে বসন্তর প্রথম সংলাপটি উচ্চারিত হয়েছিল ঠিক এখানেই। কবিয়াল নিতাইয়ের মানসপটে এখন ঠাকুরঝি ও বসন মিলেমিশে একাকার। এ যেন ভালোবাসার দুটি ফুল- একটি কাশফুল ও অন্যটি শিমুল- আমৃত্যু ভালোবাসার আকুতি নিয়ে নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে।

নিতাই রওনা দিলো চ-ী মায়ের দরবারে। সেখানে মাকে শুধাবে- ‘জীবন এত ছোট কেনে?’

এ জিজ্ঞাসা কেবল নিতাইয়ের নয়, এ জিজ্ঞসা তাবত মানবকুলের। মহৎ সাহিত্য হিসেবে ‘কবি’র বিশ্বজনীনতা এখানেই।

‘কবি’র বিশ্লেষণে আরো প্রতীয়মান হয়, প্রেমে বিফলতা বলে কিছু নেই। প্রেম মিলনে সফল, বিরহে সফল, হারানোতে সফল। নিতাই ঠাকুরঝিকে পেলো না, বসনকে পেলো না। কিন্তু জীবনের বাঁকেবাঁকে প্রেমের আনন্দ-দুঃখ তাকে দার্শনিক পূর্ণতার দিকে উত্তরন ঘটিয়েছে। কাক্সিক্ষতজনকে না পাওয়ার বেদনা নিতাইয়ের জীবনে এনে দিয়েছে নিজেকে চেনার এক ভুবনমোহনীয় সুর।

জীবনের প্রতি অগাধ বাসনা নিয়ে বসন মারা গেলো। তার দেহের যেখানে যতটুকু সোনা ছিল, সবটুকু মাসী খুলে নিল। নিতাই ভাবে, মরণ সত্যি বড় অদ্ভুত! তার মনে প্রশ্ন জাগলো, এক জীবনের অচরিতার্থ যত আকিঞ্চন, মরণের পরে তা কি মেটে? আর সেইসাথে তার অসমাপ্ত গানের বাকি কলিগুলি অদ্ভুতভাবে মনের দুয়ারে হানা দিলো-

“জীবনে যা মিটলো নাকো

মিটবে কি হায় তাই মরণে-

এ ভুবনে ডুবলো যে চাঁদ

সে ভুবনে উঠবে কি তা?

হেথায় সাঁঝে ঝরল যে ফুল

হোথায় প্রাতে ফুটলো কি তা?

এ জীবনের কান্না যত-

হয় কি হাসি সে ভুবনে?

হায়? জীবন এত ছোট কেনে?

এ ভুবনে?”

এ উপন্যাসের কাহিনি দুটি ধারায় প্রবাহিত। একদিকে ঠাকুরঝি-নিতাই এবং অপরদিকে নিতাই-বসন্ত। দুটি কাহিনির শূন্যস্থান যেন পূরণ হয়েও কিছুটা ফাঁক থেকে যায়।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ‘কবি’ গল্প আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’ মাসিক পত্রিকায়। পরবর্তীতে ১৩৪৮ সালে ‘প্রভাতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘কবি’ উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়। নিতাই-বসন্ত পর্বটি কিন্তু আদি গল্পে ছিল না। ‘কবি’ যখন উপন্যাসের কলেবরে প্রকাশিত হয় তখন তারাশঙ্কর তাঁর নির্মাণক্ষম প্রতিভা দিয়ে এই অদ্বিতীয় মহীরুহ গড়ে তোলেন। অনেকের মতে, ঠাকুরঝি-নিতাই কাহিনি রাধাকৃষ্ণ মিথের আলোকে এবং বসন্ত-নিতাই কাহিনি চিন্তামণি-বিল্বমঙ্গল মিথের আলোকে রচিত।

বেশ্যাপল্লির অসঙ্গত জীবনের ক্লেদ, রাতের অন্ধকারে মাটির তলার সরীসৃপের মতো মানুষের আদিম প্রকৃতির নগ্ন আত্মপ্রকাশ, আলেপুর মেলার বীভৎস পরিবেশ- এসবই নিতাইয়ের মনে নেতিবাচক উত্তাপ তৈরি করে।

তার কবিসুলভ নীতিবোধ বিচলিত হয়ে পড়ে। সে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। শেষে পার্শ্ববর্তী রাধাগোবিন্দের মন্দিরে উপস্থিত হয়। এখানে সে ‘রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপের স্তবগান’ পরিবেশন করে। তার কণ্ঠের মধুবর্ষণে মন্দিরের মোহান্ত মুগ্ধ হয়। নিতাইয়ের পরিচয় জানতে চায়। এমনি একটা আবহে নিতাই তার বর্তমান অসঙ্গত বসবাস এবং বেশ্যা সহবাসের প্রসঙ্গ তুলেছিল।

প্রত্যুত্তরে মোহান্ত বলেন, “কর্ম তোমার তো অতি উচ্চ কর্মই বাবা। তোমার ভাবনা কি! যাঁরা কবি, তাঁরাই তো সংসারে মহাজন, তাঁরাইতো সাধক। ...প্রভুর সংসারে নীচ কেউ নাই বাবা। ...তোমার চোখের চশমার রঙের মতো তোমার মনের ঘৃণা পরকে ঘৃণ্য করে তোলে। মনের বিমারে এমন সুন্দর পৃথিবীর উপর রাগ করে মানুষ আত্মহত্যা করে। আর বেশ্যা? বাবা, চিন্তামণি বেশ্যা সাধক বিল্বমঙ্গলের প্রেমের গুরু। জান বাবা, বিল্বমঙ্গলের কাহিনি?”

গ্রামের বাবুদের থিয়েটারে নিতাই বিল্বমঙ্গলের পালা দেখেছে। তার সব মনে পড়ে গেলো। বেশ্যা চিন্তামণি প্রদর্শিত পথ ধরে বেশ্যাসক্ত বিল্বমঙ্গল কৃষ্ণসান্নিধ্য লাভ করে। সাধনার জীবন সম্পর্কে মোহান্তের ব্যাখ্যা বিপর্যস্ত নিতাইয়ের অনুভবকে দারুণভাবে নাড়া দিলো। নিতাইয়ের অভিব্যক্তি প্রসন্ন এক জীবনবোধে আচ্ছন্ন হলো। সে অনুধাবন করে, জীবনে আলোর পাশাপাশি অন্ধকারও আছে। আর সবার উপরে মানুষ সত্য। জীবনবোধে পুনর্জাত নিতাই অবশেষে ঝুমুরদলের অস্থায়ী আবাসে ফিরে আসে।

কী আশ্চর্য! গতকাল এখানকার পাত্র-পাত্রীরা নিতাইয়ের কাছে যেরকম ছিল আজ তাদের অন্যরকম মনে হলো। নিতাইয়ের অন্তর্লোকে ঝুমুরদলের স্বাধীন জীবন যাপনের অসঙ্গতি নিয়ে আর কোনো দ্বিধা কিংবা পাপবোধ নেই।

আরো অবাক হলো, বসন্ত-নির্মলা-ললিতাদের লক্ষ্মীপুজো পালনের মৃদু আড়ম্বরতায়। নিতাই ভাবে, এরা ধর্মকর্মও করে। এই দৃশ্য নিতাইয়ের অস্থিরতা একদম প্রশমিত করে দেয়। নিতাইয়ের সৃজনশীল মন পরিশুদ্ধ হতে হতে জীবন-জিজ্ঞাসার অনিঃশেষ ঐশ্বর্যের দিকে ধাবিত হয়।

জীবনভর নিতাই এক আলোকিত ভুবনের সন্ধান করে গেছে। সত্যিই কি নিতাই জীবনভর যা খুঁজেছিল তা পেয়েছিলো!

নিতাইয়ের মতো জগতের মানবকূল সারা জীবন কাকে খুঁজে!

কী খোঁজে! কিসের নেশায় খোঁজে! কোন তাড়না তাদের এ ঘর থেকে ও ঘরে ছুঁড়ে দেয়! অবশেষে মানবজীবন কোথায় গিয়ে ঠেকে!

তবে কি মানব চিরকাল তার মনের মানুষের সন্ধানে পৃথিবীর পান্থপথে বিচরণ করে? জীবন সঙ্গীতের অদ্ভুত বাজনা কিংবা কম্পমান সুর লয়ে তার মনের মানুষ ধরা দিলেও কি মানবের সুরলোকের তৃষ্ণা মেটে?

আসলে একজীবনে কোনো মানব তার তৃষ্ণার সবটুকু মেটাতে পারে না। প্রকৃতি সে তৃষ্ণা মিটিয়ে মানব জীবনকে পরিপূর্ণ হতে দেয় না। তাই তো ‘জীবন এতো ছোট কেনে?’ এ প্রশ্নের উত্তর আর মেলে না। জীবন নিয়ে এ খেদ কেবল নিতাইয়ের নয়; এ যে প্রতিটি বোধসম্পন্ন মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেজে চলা মর্ম যাতনার সঙ্গীত।

উত্তরহীন অনন্ত এই জিজ্ঞাসার বেদনা নিয়েই মানব ভক্তিভরে আশ্রয় খোঁজে অদৃশ্যলোকের অজানা পরাক্রমশালীর কাছে। যেমনটা নিতাই তার প্রশ্নের উত্তরের আশায় চ-ী মায়ের দরবারে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

তারাশঙ্করের ‘কবি’ এবং উত্তরহীন অনন্ত জিজ্ঞাসা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় / জন্ম : ২৩ জুলাই ১৮৯৮; মৃত্যু : ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১

তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস ‘কবি’ জীবন জিজ্ঞাসার এক অনিঃশেষ লহরি। তারাশঙ্কর জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাঢ় বাংলার ভৌগোলিক সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যমণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে। তারাশঙ্কর যে অঞ্চলের সেথায় বাঙালি সংস্কৃতির অমৃত ধারায় ঋদ্ধ কবিগান ও ঝুমুর গানের প্রচলন ছিল। কবিগান পরিবেশনকারীরাই হলো কবিয়াল। এই উপন্যাসটির উপজীব্যতা কবিয়াল ও ঝুমুর দলকে ঘিরেই। কবির নায়ক নিতাইচরণ কবিয়াল থেকে কবিতে উত্তীর্ণ। রাজনীতি নিরপেক্ষ উপন্যাস ‘কবি’ নিঃসন্দেহে নিতাইচরণের স্বোপার্জিত কাক্সিক্ষত সামাজিক মর্যাদায় উত্তীর্ণ হওয়ার ইতিহাস।

নিতাই অন্ত্যজ শ্রেণির অশিক্ষিত যুবক হলেও তার রয়েছে অসাধারণ কবি প্রতিভা ও আবেগ-আপ্লুত হৃদয়। ফলে কবিগান শোনার অদম্য নেশা থেকে নিতাইয়ের সত্তায় কবিত্বের জাগরণ ঘটে।

“অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার”- রবীন্দ্রনাথের এ উক্তিটির যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে কবিয়াল নিতাইয়ের চরিত্রালেখ্যে।

ছন্দ ও সুরের লালিত্যে অমিয় ব্যঞ্জনায় যখন নিতাইয়ের মুখ থেকে কবিতার চরণ ঝংকৃত হয় তখন রবীন্দ্রনাথের এ উক্তিটি নিতাইয়ের জীবনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। মূলত নিতাইয়ের মহত্ত্ব ও প্রণয়াবেগ হলো উপন্যসের মূল সুর।

কে এই নিতাই!

এক বাক্যে বলা চলে নিতাই ‘গোবরে পদ্মফুল’। তার শেকড় ধরে টানলে যে চিত্রকল্প মঞ্চস্থ হয় তাতে চোখ ছানাবড়া হওয়ার যোগাড়। হিন্দু সমাজের প্রায় পতিততম স্তরের অন্তর্গত ডোম বংশের ছেলে সে, খুনির দৌহিত্র, ডাকাতের ভাগিনেয়, ঠ্যাঙাড়ের পৌত্র, সিঁধেল চোরের পুত্র। শহরাঞ্চলে ডোম বলতে শ্মশানচারি যে শ্রেণিকে বোঝায়, এই ডোম মোটেই তা নয়। এই ডোমেরা বীরবংশী উপাধিধারী, বাংলার বিখ্যাত লাঠিয়াল। তাদের বীরত্বের জন্য নবাবি পল্টনে তাদের ছিল প্রচুর কদর। তবে পরবর্তীতে তারা কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার কারণে নবাবের আশ্রয়চ্যুত হয়।

এই বীরবংশী ডোমদেরই উত্তরাধিকারী কবিয়াল নিতাই। মায়ের অনুরোধ কিংবা মামার শাসনও নিতাইকে তার মনোভাব থেকে টলাতে পারেনি। সে পড়াশোনা ছেড়ে ডাকাতির দলে নাম লেখায়নি।

নিতাইয়ের উত্থান দৃষ্টান্ত বিরল নয়। প্রহ্লাদ দৈত্যকুলে জন্ম নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রহ্লাদের পিতা হিরণ্যকশিপু দৈত্য হলেও রাজা ছিলেন। মৌলিক মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ রচয়িতা ছিলেন দস্যু রতœাকর। তিনি বাল্মিকী নাম ধারণ করলেও তিনি ছিলেন সদ্বংশীয় ব্রাহ্মণ সন্তান। সে তুলনায় নিতাইয়ের বংশ সমাজ কর্তৃক আরো অবহেলিত ও অবজ্ঞাত।

রাত্রির অন্ধকারের মতো কালো নিতাইয়ের গায়ের রঙ। দেহ বড়ই কঠিন-সবল ও দীর্ঘ। তার দৃষ্টিতে আছে সকরুণ্য বিনয়। হীন বংশের সন্তান হয়েও নিতাই কখনো চুরি ডাকাতি করেনি।

বিদ্যানুরাগী নিতাই সকল প্রতিকূলতাকে পায়ে ঠেলে, অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলেই বছর তিনেক পাঠশালায় পড়ার সুবাদে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী আয়ত্ত করে ফেলে। উপন্যাসের ভাষায়, “নিতাইয়ের গুণাগুণ কবিয়ালরা জানিত, কবিগান যেখানেই হোক, সে গিয়া ঐ দোয়ারদের দলে মিশিয়া বসিয়া পড়িত, কখনো কাঁসি বাজাইতো- আর দোয়ারের কাজে তো প্রথম হইতে শেষপর্যন্ত বেগার দিয়া যাইতো।”

এক্ষণে বলে রাখি, কবিগান তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করা হয়। সেইসাথে সুরারোপ করে উন্মুক্ত আসরে শত শত শ্রোতার সামনে নির্দিষ্ট বিষয় ধরে বিতর্ক-বিত-ার ঢংয়ে পরিবেশন করা হয়। বিতর্কমান দুটো দলে বিভক্ত হয়ে কবিগান প্রতিযোগিতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার শৈলীতে পরিবেশিত ও মঞ্চস্থ হয়। প্রতিদ্বন্দ্বি দুটো দলেই একজন করে কবিয়াল বা সরকার থাকেন। আরো থাকেন দোহার বা দোহারি, যে মূল কবিয়ালের কথাকে বার বার পুনরাবৃত্তি করে সময়ক্ষেপণ করেন, যাতে মূল কবিয়াল নতুন পদ বাঁধতে পারেন।

আলোচ্য উপন্যাসে নিতাই শখবশত দোহার থাকলেও পরে নিজ আগ্রহ ও চেষ্টায় কবিয়াল হিসেবে আবির্ভূত হয়। কবিয়াল হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সাধারণত একজন কবিয়াল স্বল্প শিক্ষিত হলেও তিনি একাধারে কবি ও শিল্পী। তিনি গান-ছন্দ-লয়-তাল-পর্ব-মাত্রা সম্পর্কে সিদ্ধহস্ত এবং কবিতার অন্ত্যমিলে পারদর্শী। একদিকে খেটে খাওয়া মানুষের আনন্দ-বেদনা সম্পর্কে যেমন ওয়াকিবহাল তেমনি অন্যদিকে মেধাগুণে-চর্চাগুণে ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, লৌকিকতা, আধ্যাত্মিকতা- সকল বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও বোধের অধিকারী।

তো নিচু বংশের জন্মানো সেই নিতাই চরণ গ্রামের সবাইকে চমকে দিয়ে কবি হয়ে ওঠে! সে আরেক কাহিনী। অট্টহাস গ্রামের কবি গানের পালায় নোটন দাস ও মহাদেব পাল ছিলেন খ্যাতনামা কবিয়াল এবং দুজনেই এখানকার পালাগানে বাঁধা ছিলেন। এবারের মেলায় প্রতিষ্ঠিত কবিয়াল নোটনদাসের অনুপস্থিতিতে নিতাইয়ের সামনে নিজের কবিয়াল পরিচয় দেয়ার সুযোগ খুলে যায়। যদিও মহাদেবের কাছে নিতাই হেরে গিয়ে ছিল। তাতে কী! পরোক্ষভাবে জয় হয়ে ছিল নিতাই চরণের। তাই অভিজাত বাবুরাও বিস্ময়ে স্বীকার করলেন, “ণবং! এ রীতিমতো একটা বিস্ময়! ঝড়হ ড়ভ ধ উড়স-অ্যাঁ-ঐব রং ধ ঢ়ড়বঃ!”

নিতাইয়ের রক্তকণিকায় আত্মীয়-স্বজনের গভীর রাত্রে নিঃশব্দপদসঞ্চারে নির্ভয় বিচরণ ছিল অজ্ঞাত। বীরবংশীরা নীতি ও ধর্মের কথা শুনলে ব্যঙ্গ করে হাসতো। তারা নিতাইয়ের চৌর্যবৃত্তি বিমুখতার জন্য তার ভীরুতাকে দায়ী করতো এবং তারা তাকে ঘৃণা করতো। এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারাশঙ্কর জীবনের এক সুদূর রহস্য প্রকাশের নিমিত্তেই যেন নিতাইকে গড়ে নিলেন।

বাবুদের কাছে সরল অথচ গভীর বোধসম্পন্ন স্বীকারোক্তি নিতাইচরণের চরিত্রের আরেক মহানুভবতা। হাতজোড় করে সে বলেছিল, “আজ্ঞে প্রভু, চুরি জীবনে আমি করি নাই। মিছে কথাও আমি বলি না হুজুর, নেশা পর্যন্ত আমি করিনা। জাত-জ্ঞাত মা ভাইয়ের সঙ্গেও এইজন্যে বনে না আমার। ঘর তো ঘর, আমি পাড়া পর্যন্ত ত্যাজ্য করেছি একরকম। আমি থাকি ইস্টিশানে রাজন পয়েন্টসম্যানের কাছে। কুলিগিরি করে খাই।”

নিজ পরিবার পরিজনের অন্ধকার আহ্বান থেকে বের হয়ে নিতাই তার ভ্রাম্যমাণ দপ্তর হাতে পাড়ি দিয়ে ছিল জীবনের অন্য দিগন্তে। রাস্তাঘাট থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মুদ্রিত ছিন্নপত্র এবং বিচিত্র উৎস থেকে সংগৃহীত বই ছিল এই ভ্রাম্যমাণ দপ্তরের ধনরাশি। জীবনব্যাপি নিতাইয়ের সঙ্গী ছিল এই দপ্তর।

প্রথমে সে গ্রামের ঘনশ্যাম গোঁসাইয়ের বাড়ি মাহিন্দারের কাজ নেয়। কিন্তু গোঁসাইজীর গোপন হীন ব্যবসার শরিক হতে পারলো না বলে এখানে স্থিতি হলো না। অবশেষে বন্ধু রাজালালের সান্নিধ্যকেই মনপ্রাণ সঁপে গ্রহণ করেছিল নিতাই। রাজালাল পার্শ্ববর্তী রেলওয়ে স্টেশনের পয়েন্টসম্যান, গানের সমঝদার। ভরণপোষণের তাগিদে পেশা হিসেবে নিতাই বেছে নিলো কুলিগিরি।

তারপরেই এলো নিতাইয়ের জীবনে চিরন্তন প্রেম। যে প্রেম ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। আসা-যাওয়ার পথে কখন যে কে কার নয়নে লেগে যায়; যেমনটি রাজনের শ্যালিকা ঠাকুরজি লেগে গিয়ে ছিল নিতাইয়ের নয়নে। ‘দীঘল দেহভঙ্গিতে ভুঁইচাপার সবুজ সরল ডাঁটার মতো অপরূপশ্রী’ ঠাকুরঝি কবিয়াল নিতাইয়ের জীবনব্যাপি প্রেরণাময় এক অনিঃশেষ সঞ্চয়।

ঠাকুরঝি পার্শ্ববর্তী গ্রামের গৃহবধূ। ঘটি মাথায় দুধের পসরা নিয়ে প্রতিদিন আসে সে এ গ্রামে। নিতাই ঠাকুরঝি থেকে একপোয়া করে দুধ নেয়।

তারপর ভালোবাসার টানে প্রতিদিন সে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঠাকুরঝির প্রতীক্ষায় থাকে। নিতাইয়ের চোখে রেললাইন ধরে, ক্ষারে কাচা তাঁতের মোটা সুতার খাটো কাপড়খানি আঁটসাঁট করে পরা কালো দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে ঠাকুরঝি পিতলের ঘটি মাথায় ক্রমে এগিয়ে আসা ‘স্বর্ণবিন্দুশীর্ষ শুভ্র চলন্ত রেখা’র মতো।

অবসরে চলে ‘বেনেমামা’র দোকানে আড্ডা। সেখানে কবিপ্রতিভা নিয়ে বিপ্রপদের পরিহাস ও বিদ্রুপ প্রতিদিন নিতাইকে সহ্য করতে হয়। কিন্তু এতোসব প্রতিকূলতা নিতাইয়ের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। ঠাকুরঝির প্রতি প্রেমের মগ্নতাই তাকে সৃষ্টির পথে উত্তরোত্তর এগিয়ে নেয়। ঠাকুরঝির প্রেরণা তাকে কবিত্বের জগতে বুঁদ করে রাখে।

যেদিন থেকে নিতাই জনসমক্ষে কবিয়াল হিসেবে নতুন পরিচিতি পেলো, সেদিন থেকেই এক অপার সম্ভ্রমবোধে সে আচ্ছন্ন হলো।

মোট বহন করাকে নিতাই অশোভন মনে করে ছেড়ে দিলো। ফলে নিতাইয়ের একাকী জীবনের নামমাত্র সংসারেও অভাব হানা দিলো।

অভাব-অনটনের মধ্যে নিতাইয়ের অন্তর্জগতে ঠাকুরঝির ছবি ভেসে ওঠে। নিতাই অনুভব করে ঠাকুরঝি তার ‘মনের মানুষ’। ঠাকুরঝিকে উপলক্ষ করেই তার অন্তরে গান আসে।

একদিন রাজন ঠাকুরঝিকে তার গায়ের রং প্রসঙ্গে ভর্ৎসনা করে। নিতাই তাতে পীড়িত হয়ে গুনগুন করে, ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদো কেনে?’

অন্যদিন ঠাকুরঝির খোঁপায় কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখে আবার গেয়ে ওঠে, “কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?” এ যেন অসমাপ্ত কলির অভূতপূর্ব সমাপ্তি! কবিয়াল নিতাই ক্রমশঃ কবি হয়ে উঠার পথপরিক্রমায় এ যে সাফল্যের পদচিহ্ন বৈ কিছু নয়!

তারাশঙ্করের এই ‘কবি’ উপন্যাসে একজন কবির শক্তিমত্তা ফুটে উঠেছে নিতাইয়ের কবিত্বে। উপন্যাসখানিতে তারাশঙ্কর তাঁর কল্পনা ও অভিজ্ঞতার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়েছেন।

গল্প এবং চরিত্রের জন্য তিনি এ দু’সূচকেই হাত পেতেছেন। প্রকৃতপক্ষে কবিত্বের কৃতিত্ব পুরোটাই তারাশঙ্করের। নিতাই জীবনের পথ খুঁজে বেড়ায়। চুরি-ডাকাতির মোহ তার মামার রক্তে যে উল্লাস সৃষ্টি করে তা থেকে সে মুক্তি চায়। দিশা খুঁজে বেড়ানো নিতাইকে খুঁজে পাওয়া যায় তার গানে। উপন্যাসের প্রত্যেকটি গান যেন নিতাইয়ের জীবনের অর্জিত এক একটি আলোকবর্তিকা।

নিতাইয়ের গানের যিনি স্রষ্টা সেই তারাশঙ্কর নিজেই ‘কবি’ উপন্যাসের গান প্রসঙ্গে বলেছেন, “কবি-র গানগুলি কিন্তু সংগ্রহ নয়। ওগুলি সবই আমি রচনা করেছি। কীভাবে করেছি বলতে পারিনা। মোহিতলাল ‘কবি’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে গানগুলির কথাই আগে বলেছেন। বলেছেন, এই গানগুলিই কবির প্রাণশক্তি। আমি সেসময় নিতাইয়ের মতোই ভাবতে পেরেছিলাম। ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো ক্যানে’- এই লাইনের সঙ্গে অনেক লাইন বেঁধেছি। যেমন- ‘কালো চোখের তারায় তবে আলো এমন হাসে ক্যানে?’

‘কালাচাঁদের কোলের লাগি সোনার রাধা কাঁদে ক্যানে?’ অনেক লাইন। কিন্তু কেটে দিয়েছি। ও নিতাইয়ের রচনা হয়নি।...”

মনে হয় যেন তারাশঙ্কর দূরলোকের কোনো মন্ত্রবলে কবিয়াল নিতাইয়ের মনোলোকে প্রবেশ করে তার জীবনব্যাপি অপূর্ব কাব্যরস আর সুরের ভাষা আপনা আপনি বুনে দিয়েছেন।

সমগ্র উপন্যাসখানি জুড়ে যে অন্তর্লোকের ভাবমন্ডল তা নিঃসন্দেহে নিতাইয়ের স্বরচিত গানের জন্য। আর এই কাব্য প্রেরণার সঞ্চার হয়েছে ঠাকুরঝির প্রতি তার অমোঘ টান থেকে।

সে অনুভব করে ঠাকুরঝিকে সে ভালোবাসে। কিন্তু এ ভালোবাসার সামাজিক কঠিন বাস্তবতা তাকে মহাসংকটে নিপতিত করে। ঠাকুরঝি ভিন্ন জাতি এবং অন্যের স্ত্রী। নিতাই দারিদ্র্যক্লিষ্ট হলেও নৈতিকতার মোড়কে আবদ্ধ সৃজনপ্রয়াসী। পাপপুণ্য ভেবে ভেবে অস্থির হয় সে। ফলে ঠাকুরঝির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাকে সে মহাপাপ ধরে নেয়। পরিস্থিতির জটিলতায় নিতাই গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠাকুরঝিকে সে ভালোবাসলেও আকাশের চাঁদরূপেই মনের গহীনে রেখে দেয়।

তারপর শুরু হয় কাহিনির দ্বিতীয় পর্যায়। নিতাইয়ের জীবনে আসে দ্বিতীয় ভালোবাসা। বন্ধু রাজন যে কিনা সঙ্গীতের সমঝদার সে এক ভ্রাম্যমাণ ঝুমুরদলকে নিয়ে এসে হাজির হয়।

এবার কবিগান ও ঝুমুরদল সম্পর্কে তারাশঙ্করের বয়ান শুনে নেই। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের, বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলের মেলায় ঘুরে ঘুরে নিম্নস্তরের দেহপণ্যাদের নিদারুণ দুর্দশা আমি দেখেছি। এদের অধিকাংশ অবশ্য প্রেমের ছলনায় ভুলে গৃহত্যাগ করে এই পাপ-পঙ্কিল চোরাবালিতে এসে পড়ে তিলে তিলে ডুবে মরে যায়।...

মেলার পর মেলা ঘুরেছি, তথ্য সংগ্রহ করেছি। দেখেছি। ঝুমুরদলের মেয়েরা এ থেকে কিছু স্বতন্ত্র। ঐ নিছক দেহপণ্যাদের অস্তিত্ব তো অনেক পরে জেনেছি। কিন্তু ঝুমুর দেখে আসছি বাল্যবয়স থেকে। আমাদের গ্রামে বা কাছাকাছি গ্রামে মেলায় এইসব দেহপণ্যাদের প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। কিন্তু ঝুমুর আসতো। ঝুমুর না-হলে মেলা হয় না। সে ঐ দোয়ারকির জন্য।

ঝুমুরদলের মেয়েরা কবিগানে দোয়ারকি করত এবং নাচত। আমাদের বাল্যবয়সে এই কারণে কবিগান শোনা নিষিদ্ধ ছিল এবং সন্ধের পর এক যাত্রা বা থিয়েটারের আসরে অভিভাবক ছাড়া থাকতে পেতাম না।”

এই ঝুমুরদলের মেয়ে কৃষতনু গৌরাঙ্গী বসন্ত। সবাই তাকে ‘বসন’ নামে ডাকে। কবিয়াল নিতাই একপর্যায়ে ঝুমুরদলটির প্রধান কবির পদে অধিষ্ঠিত হলো। স্টেশন ছেড়ে নিতাই আলেপুরে ঝুমুরদলের বাসিন্দা হয়ে গেলো। ঝুমুরদলের মেয়েগুলো নিম্নশ্রেণীর বারাঙ্গনা। বসন্ত ব্যতীত তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ‘মনের মানুষ’। অবশেষে ঝুমুর দলের প্রাঙ্গণ হলো কবিয়াল নিতাইয়ের সাধন-ক্ষেত্র। ‘বসন’ হলো নিতাইয়ের সাধনার উত্তরসাধিকা।

মাঝে মাঝে ঠাকুরঝির স্মৃতি উঁকি দিলেও ঝুমুর দলের জন্য গড়ে ওঠা অস্থায়ী বেশ্যা-পল্লিতে নিতাই তাদের অসঙ্গত জীবনের সাথে ক্রমে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। রাত বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় মেলার বিভৎস দৃশ্য। শুরু হয় মানুষের আদিম প্রবৃত্তির নগ্ন প্রকাশ!

বসন্ত-নির্মলা-ললিতার খুপড়িতে আগন্তুকের আসা-যাওয়া দেখে, নিতাইয়ের কবি সত্তার অনুষঙ্গী নীতিবোধের সাথে অবিরাম যুদ্ধ চলে। নিতাই পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে।

একরাতে ঝুমুর দলের ‘নগ্ন জীবনের প্রমত্ত তৃষ্ণার গান’ অর্থাৎ খেউড়, অশ্লীল রসে উন্মাতাল হয়ে উঠার আসরে নিতাইয়ের নিজস্ব রুচিমাফিক গান জনতাকে তুষ্ট করতে পারছিলো না। মঞ্চে নৃত্যরত বসন্ত অপমানিত বোধ করলো। আক্রোশে চপোটাঘাত করে বসলো সে নিতাইকে। তারপর নিতাই আকণ্ঠ মদ পান করে ছন্দোবদ্ধ অশ্লীল ছড়ায় ফিরিয়ে আনলো ভাঙ্গা আসরের প্রাণ। তারাশঙ্করের ভাষায় এ যেন “বীরবংশী রক্তের বর্বরত্বের মৃতপ্রায় বীজাণুগুলি মদের স্পর্শে- জলের স্পর্শে মহামারির বীজাণুর মতো, পুরাণের রক্তবীজ হইয়া অধীর চঞ্চলতায় জাগিয়া উঠিতেছে।”

ইতোমধ্যে বসন্ত বুঝে যায়, সে নিতাইকে ভালোবেসে ফেলেছে। পরম মমতায় নিতাইয়ের বমিক্লিষ্ট কাপড় বসন ধুয়ে দেয়। দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সুখ-দুঃখের কথায় মগ্ন হয়। বসন্ত নিজের কোনো কিছুই গোপন করে না। অকপটে জানিয়ে দেয় তার ক্ষয়রোগের কথা।

নিজের অদৃষ্টের পরিণাম সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন বসন্ত। নিতাই বসন্তের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে। বসন্তের প্রতি সহানুভূতি জানায়। অবশেষে নিতাই এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একপর্যায়ে বসন্তের কথায় আবেগ-আপ্লুত হয়ে বসন্তের আঁচল টেনে নিজের চাদরের খুঁটে বেঁধে নেয়। নিতাই প্রত্যয়ের সুরে বলে, “আমি যদি আগে মরি, তবে তুমি সেদিন খুলে নিও এ গিঁট; আর তুমি যদি আগে মর, তবে সেইদিন আমি খুলে নোব গিঁট।” তারপর গাঁটছড়া বাঁধা অবস্থাতেই সলজ্জ বসন্ত নিতাইকে নিয়ে ফিরে আসে।

ক্ষণেক্ষণে অভিমানী বসন্ত অভিমান করে। কখনো কাঁদে। নিতাইয়ের মন উদাসীন হয়। বসন্তকে নিয়ে মুখে মুখে বাঁধা গানগুলো শেষ হয় না, লেখাও হয় না, অসমাপ্ত গান হারিয়ে যায়। আবার ঠাকুরঝির কথা মনে করে আনমনা হয়।

হঠাৎ কোনো এক মুহূর্তে নিতাই বসন্তকে এক অসমাপ্ত কলি শোনায়-

“এই খেদ আমার মনে মনে।

ভালোবেসে মিটলনা আশ-

কুলাল না এ জীবনে।

হায়, জীবন এত ছোট কেনে?

এ ভুবনে?”

গানটি শোনার সাথে সাথে বসন্তর দুই চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। বসন্তর প্রেম-পিয়াসী মন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দুজনার আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

তারপরেও দিন যায়, দিন আসে। বসন্ত সেবা ও চিকিৎসায় ভালো হয়। নিজের ঘরে আগন্তুকের প্রবেশ প্রতিহত করতে চাইলেও মাসির কঠোর শাসনের কারণে পেরে ওঠে না। আবারো রোগে কাহিল হয়। নিতাই পরম মমতায় পরিচর্যা করে। এমতাবস্থায় বেহালাদারের করুণ সুর বসনকে অস্থির করে তোলে। নির্মলার ‘মনের মানুষ’ এই বেহালাদার। নির্মলার ঘরে যেদিন আগন্তুকের প্রবেশ ঘটে সেদিন বেহালাদারের বেহালায় এক অদ্ভুত করুণ সুর ধ্বনিত হয়। বসন চিৎকার করে নিতাইকে বলে, বেহালাদারের ওই সুর বাজানো বন্ধ করতে।

সমগ্র উপন্যাস জুড়ে প্রেম-ভালোবাসার যে আর্তি, বেহালাদারের করুণ সুরে তার এক ভিন্ন ঝংকার ঝরে পড়ে। এই ঝংকারে প্রেমের সুমন্দ বাতাস বহে না; এই ঝংকারে কেবল প্রেমের পথ চাওয়াতে কান্না ঠিকরে ওঠে। যেন মনের মানুষকে একজীবনে পেয়েও হারানোর বেদনার দহন, থেকে থেকে পরাণ মাঝে গভীর সর্বনাশের ঝড় তোলে।

পুরো এক মাস রোগ ভোগের পর বসন তার দেহবর্ণের উজ্জ্বলতা ও লাবণ্য হারায়। একদা ভালোবাসায় বিমুখ নারী আজ ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসাময় জীবন যাপনের তৃষ্ণায় কাতর বসন কেবল কাঁদে। সে তার অনিবার্য অভিযাত্রার কথা ভেবে মুষড়ে পড়ে। কুৎসিত ব্যাধি মৃত্যুকে তার দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে। নিতাইয়ের বাঁধা অসমাপ্ত গান তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়,- “জীবন এত ছোট কেনে- হায়।”

সেদিন রাত্রির শেষ প্রহরে বসন্ত রোগের বিকারে প্রলাপ বকতে শুরু করে। তার শরীর হিম হয়ে আসে। নিতাই বুঝতে পারে, এ যে মৃত্যুবিকার। নিতাই বসনের নাড়ির মন্থর গতি অনুভব করে তাকে ‘গোবিন্দের’ নাম স্মরণ করতে বলে। সাথে সাথে ভালোবাসার অতৃপ্তি নিয়ে বসন নিতাইয়ের অনুরোধ প্রত্যাখান করে।

কি দিয়েছে ভগবান তাকে!

ঘর-সংসার কিছুই পায়নি সে!

কিন্তু মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে মানবের সংশয় চিরকালীন। সে রহস্যময় জীবনের প্রতি অজানা ভয়, অজানা আশঙ্কা মৃত্যুকালে মানবকে কঠিন হস্তে চেপে ধরে। ইহজগতে যত দুঃখ-কষ্টই ভোগ করুক না কেনো; স্রষ্টাকে নিয়ে যত অবিশ্বাসের দোলাচলে দোলুক না কেনো; দুর্বল মানব অবশেষে সেই অদৃশ্য শক্তির কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে। জীবনের এ অমোঘ নিয়তি থেকে মানবের রেহাই নেই। যেমন আলোচ্য উপন্যাসের বসন প্রথমে বলে, সে গোবিন্দের শরণার্থী হবে না; কিন্তু জীবন সায়াহ্নে সে গোবিন্দের কাছেই দয়া প্রার্থনা করে। এমনি ভালোবাসাপূর্ণ পুনর্জন্মের আকুল প্রার্থনার মাঝেই বসনের জীবনপ্রবাহকে থামিয়ে দেয় মৃত্যুর করাল থাবা।

বিপর্যস্ত মর্মাহত নিতাই গঙ্গাতীরবর্তী শ্মশানে দাহ করে বসনের মরদেহ। নিতাইয়ের বাঁধা অসমাপ্ত সেই গান অবিরত নিতাইয়ের মননে উঁকি দিতে থাকে। কবিয়াল নিতাই আরো গভীরভাবে পড়ে যায় জীবন-মৃত্যু ও স্বর্গ-নরকের প্রশ্নবাণে। নিতাইয়ের অন্তর্লোকে ধ্বনিত হয় প্রজ্ঞার ঐকতান। একপর্যায়ে অনুধাবন করে, মৃত্যু যেন তার মনের কাছে হেরে গেলো। এ অনুভূতি তাকে খানিক তৃপ্ত করতে পারলেও তার কবিমনের বিষণœতা খোঁচাতে লাগলো। এখন সে জীবনের কোন পথ খুঁজে নেবে!

অবশেষে নিতাই বিবাগী-বৈরাগী হওয়ার মধ্যে মুক্তি খুঁজে নেয়। কবিয়াল নিতাই ‘মুসাফের’ হিসেবে চলে আসে কাশীতে। এখানে এক বাঙালি মা ঠাকরুন তাকে স্বদেশে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। তাছাড়া অচিরেই কাশীর প্রতি দীর্ঘদিনের মোহে নিতাইর ভাটা পড়ে। কাশীর ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোর ইহজীবনের গানের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই; ভাষাগত সমস্যা ও বিরূপ পরিবেশতো আছেই। তাই নিতাই মাসখানেক কোনোমতে কাশীতে কাটিয়ে তার নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চাপে।

নিতাই বসনকে হারিয়েছে। সে বুঝতে পেরেছে, ছোট্ট এ জীবনে মানবের ভালোবেসে আশ কভু মেটে না। গভীর প্রেম মানব জীবনের ক্ষুদ্র ক্যানভাসে সংকুলান হয় না। আসলে মৃত্যুই ভালোবাসার যবনিকা টানে।

নিতাই স্টেশনে নামে। শেকড়ে ফেরার আনন্দে তার চোখে জলের ধারা। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় রাজাসহ বসে। দূরে দুটি লাইন যেখানে একটি বিন্দুতে মিশে গেছে বলে মনে হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতেই ঠাকুরঝির স্মৃতি তাকে আন্দোলিত করে। উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয়ে ঠাকুরঝির মৃত্যুর কথা রাজন তাকে জানায়। নিতাইয়ের বুকে ঝড় নামে, নয়নে বারি। ক্লিষ্ট কবিয়ালের হৃদয়ে আবার অনুরনিত হয়, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’

কৃষ্ণচূড়া গাছের স্মৃতিরা একের পর এক নিতাইয়ের মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে। ঠাকুরঝির পাশাপাশি বসনের কথাও মনে পড়ে। নিতাইয়ের উদ্দেশ্যে বসন্তর প্রথম সংলাপটি উচ্চারিত হয়েছিল ঠিক এখানেই। কবিয়াল নিতাইয়ের মানসপটে এখন ঠাকুরঝি ও বসন মিলেমিশে একাকার। এ যেন ভালোবাসার দুটি ফুল- একটি কাশফুল ও অন্যটি শিমুল- আমৃত্যু ভালোবাসার আকুতি নিয়ে নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে।

নিতাই রওনা দিলো চ-ী মায়ের দরবারে। সেখানে মাকে শুধাবে- ‘জীবন এত ছোট কেনে?’

এ জিজ্ঞাসা কেবল নিতাইয়ের নয়, এ জিজ্ঞসা তাবত মানবকুলের। মহৎ সাহিত্য হিসেবে ‘কবি’র বিশ্বজনীনতা এখানেই।

‘কবি’র বিশ্লেষণে আরো প্রতীয়মান হয়, প্রেমে বিফলতা বলে কিছু নেই। প্রেম মিলনে সফল, বিরহে সফল, হারানোতে সফল। নিতাই ঠাকুরঝিকে পেলো না, বসনকে পেলো না। কিন্তু জীবনের বাঁকেবাঁকে প্রেমের আনন্দ-দুঃখ তাকে দার্শনিক পূর্ণতার দিকে উত্তরন ঘটিয়েছে। কাক্সিক্ষতজনকে না পাওয়ার বেদনা নিতাইয়ের জীবনে এনে দিয়েছে নিজেকে চেনার এক ভুবনমোহনীয় সুর।

জীবনের প্রতি অগাধ বাসনা নিয়ে বসন মারা গেলো। তার দেহের যেখানে যতটুকু সোনা ছিল, সবটুকু মাসী খুলে নিল। নিতাই ভাবে, মরণ সত্যি বড় অদ্ভুত! তার মনে প্রশ্ন জাগলো, এক জীবনের অচরিতার্থ যত আকিঞ্চন, মরণের পরে তা কি মেটে? আর সেইসাথে তার অসমাপ্ত গানের বাকি কলিগুলি অদ্ভুতভাবে মনের দুয়ারে হানা দিলো-

“জীবনে যা মিটলো নাকো

মিটবে কি হায় তাই মরণে-

এ ভুবনে ডুবলো যে চাঁদ

সে ভুবনে উঠবে কি তা?

হেথায় সাঁঝে ঝরল যে ফুল

হোথায় প্রাতে ফুটলো কি তা?

এ জীবনের কান্না যত-

হয় কি হাসি সে ভুবনে?

হায়? জীবন এত ছোট কেনে?

এ ভুবনে?”

এ উপন্যাসের কাহিনি দুটি ধারায় প্রবাহিত। একদিকে ঠাকুরঝি-নিতাই এবং অপরদিকে নিতাই-বসন্ত। দুটি কাহিনির শূন্যস্থান যেন পূরণ হয়েও কিছুটা ফাঁক থেকে যায়।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ‘কবি’ গল্প আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’ মাসিক পত্রিকায়। পরবর্তীতে ১৩৪৮ সালে ‘প্রভাতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘কবি’ উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়। নিতাই-বসন্ত পর্বটি কিন্তু আদি গল্পে ছিল না। ‘কবি’ যখন উপন্যাসের কলেবরে প্রকাশিত হয় তখন তারাশঙ্কর তাঁর নির্মাণক্ষম প্রতিভা দিয়ে এই অদ্বিতীয় মহীরুহ গড়ে তোলেন। অনেকের মতে, ঠাকুরঝি-নিতাই কাহিনি রাধাকৃষ্ণ মিথের আলোকে এবং বসন্ত-নিতাই কাহিনি চিন্তামণি-বিল্বমঙ্গল মিথের আলোকে রচিত।

বেশ্যাপল্লির অসঙ্গত জীবনের ক্লেদ, রাতের অন্ধকারে মাটির তলার সরীসৃপের মতো মানুষের আদিম প্রকৃতির নগ্ন আত্মপ্রকাশ, আলেপুর মেলার বীভৎস পরিবেশ- এসবই নিতাইয়ের মনে নেতিবাচক উত্তাপ তৈরি করে।

তার কবিসুলভ নীতিবোধ বিচলিত হয়ে পড়ে। সে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। শেষে পার্শ্ববর্তী রাধাগোবিন্দের মন্দিরে উপস্থিত হয়। এখানে সে ‘রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপের স্তবগান’ পরিবেশন করে। তার কণ্ঠের মধুবর্ষণে মন্দিরের মোহান্ত মুগ্ধ হয়। নিতাইয়ের পরিচয় জানতে চায়। এমনি একটা আবহে নিতাই তার বর্তমান অসঙ্গত বসবাস এবং বেশ্যা সহবাসের প্রসঙ্গ তুলেছিল।

প্রত্যুত্তরে মোহান্ত বলেন, “কর্ম তোমার তো অতি উচ্চ কর্মই বাবা। তোমার ভাবনা কি! যাঁরা কবি, তাঁরাই তো সংসারে মহাজন, তাঁরাইতো সাধক। ...প্রভুর সংসারে নীচ কেউ নাই বাবা। ...তোমার চোখের চশমার রঙের মতো তোমার মনের ঘৃণা পরকে ঘৃণ্য করে তোলে। মনের বিমারে এমন সুন্দর পৃথিবীর উপর রাগ করে মানুষ আত্মহত্যা করে। আর বেশ্যা? বাবা, চিন্তামণি বেশ্যা সাধক বিল্বমঙ্গলের প্রেমের গুরু। জান বাবা, বিল্বমঙ্গলের কাহিনি?”

গ্রামের বাবুদের থিয়েটারে নিতাই বিল্বমঙ্গলের পালা দেখেছে। তার সব মনে পড়ে গেলো। বেশ্যা চিন্তামণি প্রদর্শিত পথ ধরে বেশ্যাসক্ত বিল্বমঙ্গল কৃষ্ণসান্নিধ্য লাভ করে। সাধনার জীবন সম্পর্কে মোহান্তের ব্যাখ্যা বিপর্যস্ত নিতাইয়ের অনুভবকে দারুণভাবে নাড়া দিলো। নিতাইয়ের অভিব্যক্তি প্রসন্ন এক জীবনবোধে আচ্ছন্ন হলো। সে অনুধাবন করে, জীবনে আলোর পাশাপাশি অন্ধকারও আছে। আর সবার উপরে মানুষ সত্য। জীবনবোধে পুনর্জাত নিতাই অবশেষে ঝুমুরদলের অস্থায়ী আবাসে ফিরে আসে।

কী আশ্চর্য! গতকাল এখানকার পাত্র-পাত্রীরা নিতাইয়ের কাছে যেরকম ছিল আজ তাদের অন্যরকম মনে হলো। নিতাইয়ের অন্তর্লোকে ঝুমুরদলের স্বাধীন জীবন যাপনের অসঙ্গতি নিয়ে আর কোনো দ্বিধা কিংবা পাপবোধ নেই।

আরো অবাক হলো, বসন্ত-নির্মলা-ললিতাদের লক্ষ্মীপুজো পালনের মৃদু আড়ম্বরতায়। নিতাই ভাবে, এরা ধর্মকর্মও করে। এই দৃশ্য নিতাইয়ের অস্থিরতা একদম প্রশমিত করে দেয়। নিতাইয়ের সৃজনশীল মন পরিশুদ্ধ হতে হতে জীবন-জিজ্ঞাসার অনিঃশেষ ঐশ্বর্যের দিকে ধাবিত হয়।

জীবনভর নিতাই এক আলোকিত ভুবনের সন্ধান করে গেছে। সত্যিই কি নিতাই জীবনভর যা খুঁজেছিল তা পেয়েছিলো!

নিতাইয়ের মতো জগতের মানবকূল সারা জীবন কাকে খুঁজে!

কী খোঁজে! কিসের নেশায় খোঁজে! কোন তাড়না তাদের এ ঘর থেকে ও ঘরে ছুঁড়ে দেয়! অবশেষে মানবজীবন কোথায় গিয়ে ঠেকে!

তবে কি মানব চিরকাল তার মনের মানুষের সন্ধানে পৃথিবীর পান্থপথে বিচরণ করে? জীবন সঙ্গীতের অদ্ভুত বাজনা কিংবা কম্পমান সুর লয়ে তার মনের মানুষ ধরা দিলেও কি মানবের সুরলোকের তৃষ্ণা মেটে?

আসলে একজীবনে কোনো মানব তার তৃষ্ণার সবটুকু মেটাতে পারে না। প্রকৃতি সে তৃষ্ণা মিটিয়ে মানব জীবনকে পরিপূর্ণ হতে দেয় না। তাই তো ‘জীবন এতো ছোট কেনে?’ এ প্রশ্নের উত্তর আর মেলে না। জীবন নিয়ে এ খেদ কেবল নিতাইয়ের নয়; এ যে প্রতিটি বোধসম্পন্ন মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেজে চলা মর্ম যাতনার সঙ্গীত।

উত্তরহীন অনন্ত এই জিজ্ঞাসার বেদনা নিয়েই মানব ভক্তিভরে আশ্রয় খোঁজে অদৃশ্যলোকের অজানা পরাক্রমশালীর কাছে। যেমনটা নিতাই তার প্রশ্নের উত্তরের আশায় চ-ী মায়ের দরবারে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবে।

back to top