শেলী সেনগুপ্তা
তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মা, একদম পুতুল পুতুল। রোহান মা’র চিবুক নেড়ে দিয়ে কথাটা বলে ভেতরে চলে গেলো। পারমিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মুচকি হেসে আয়নার কাছ থেকেও পালিয়ে গেলো।
পারমিতা আজ খুব সেজেছে। টুকটুকে লাল শাড়ি আর লাল টিপে পারমিতাকে পরীর মতো লাগছে। সকাল থেকে অনেক রান্না করলো। টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। অনেক দিন পর মৈনাক আসছে। এতোদিন ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে ছিলো। পারমিতা চাতকের মতো পথ চেয়ে ছিলো, কখন আসবে মৈনাক। প্রতিবার বিদেশ থেকে আসার সময় হলে এভাবেই পারমিতার অপেক্ষা শুরু হয়। মৈনাক ফিরে এলে খুব ভালো লাগে আবার অপেক্ষার দিনগুলোও উপভোগ করে। মুখ থেকে সবসময়ই হাসি ঝরে পড়ছে।
পারমিতা আর মৈনাকের বিশ বছরের সংসার। ওদের একমাত্র সন্তান রোহান। তিনজনের সংসার বেশ ভালোই কাটছে।
মৈনাক আর পারমিতা একসাথে পড়াশোনা করতো। কখন যে একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলেছে বুঝতেও পারে নি। একসময় মনে হলো এখন আর দূরে দূরে থাকা যাবে না। একসাথে এক ঘরে থাকতে হবে। ওরা বিয়ে করে ফেললো। দুই পরিবারের কেউই ওদের বিয়েটা মেনে নেয় নি। ওরাও তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো জীবনযাপন করতে শুরু করলো।
পারমিতার কিছু গয়না আর মৈনাকের জমানো টাকা দিয়ে ওরা একটা ব্যবসা শুরু করলো। দেখতে দেখতে বেশ উন্নতিও হলো। এর মধ্যে পারমিতা সন্তানসম্ভবা। ডাক্তার বললো,
: বিশ্রাম দরকার।
মৈনাকও বললো,
: বিশ্রাম দরকার।
পারমিতা আর অফিস করে না। সংসার সামলে একটা নতুন প্রাণের অপেক্ষা করছে। মৈনাকও চেষ্টা করে ওকে সময় দিতে। কখনো পারে কখনো পারে না। পারমিতা একাই সব সামলে নিচ্ছে। শুধু কষ্ট হয় মৈনাকের কাজে সহযোগিতা করতে পারছে না তাই। এর মধ্যে এক মধ্যরাতে রোহানের জন্ম হলো। চাঁদের মতো ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ওরা দু’জনেই খুব খুশি। পারমিতা এখন সারাক্ষণ রোহানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর মৈনাক ব্যবসা নিয়ে। ঘরে ফিরে ছেলেকে মাঝখানে নিয়ে দু’জন গল্প করে।
ক্লান্ত মৈনাকের মাথায় হাত বুলিয়ে পারমিতা ঘুম পাড়িয়ে দেয় আর অপেক্ষা করে আরো একটা সুখের দিনের।
রোহান বড় হলো, স্কুল শেষ করে কলেজে গেলো, একসময় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হলো। পারমিতা এখন ঢলোঢলো গিন্নিবান্নি, সংসার সামলায় আর স্বামী সন্তানের দেখাশোনা করে, যেন এক সুখী রাজহংসী ডানার নিচে সোনালি ডিম সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে।
ব্যবসা বড় হয়েছে, মৈনাক এখন অনেক ব্যস্ত। সংসারে বড় বড় জানালা খুলে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিমাসেই ব্যবসার কাজে বিদেশে যেতে হয়। পারমিতা ব্যাগ গুছিয়ে দেয়, দরজায় দাঁড়িয়ে মঙ্গল কামনা করে বিদায় দেয়।
পারমিতা আর মৈনাকের নতুন ফ্ল্যাট হয়েছে, বেশ বড়। ‘পারমিতা নিবাস’, পারমিতার স্বপ্নের ফ্ল্যাট। প্রতিদিন ফ্ল্যাটে যাচ্ছে, ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর দিয়ে সাজাচ্ছে। সে কী ব্যস্ততা! প্রতিদিন বাইরে যাচ্ছে, কত কী কিনছে! ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে ঝর্ণা, বাহারী আলো, পাখির কলতানের কলিং বেল, কী নেই!
সময় পেলেই ফোন করে কাজের ফিরিস্তি দেয়, আর মৈনাক শোনে আর হাসে। রোহানও বাদ যায় না। মাঝে মাঝে রোহানের মতামত চায়, মায়ের উচ্ছ্বাসে আনন্দ পায়, এমন মতামতই দেয় যা মা পছন্দ করবে।
মৈনাক বলে দিয়েছে রোহানের রুমটা খুব সুন্দর হতে হবে। সব আসবাব নতুন করে কেনা হয়েছে। দেয়ালজোড়া আলমারী, মিউজিক সেট। এখানেও পারমিতার আগ্রহের অন্ত নেই। সারাক্ষণ ছোটাছুটি করে ঘর সাজাচ্ছে।
এ সুযোগে রোহান বাবার কাছে একটা নতুন ল্যাপটপ দাবি করেছে। বাজারের সবচেয়ে দামী ল্যাপটপটাই চাই ওর। মৈনাক কখনোই রোহানের কোনো ইচ্ছাতে বাধা দেয় না, এখনও দিলো না।
: বেশ তো বাবাসোনা, কালই তুমি অফিসে আসবে, তোমার পছন্দের ল্যাপটপটা কিনে দেবো। মাকেও নিয়ে এসো। কাল আমরা বাইরে লাঞ্চ করবো। ওকে?
: ওকে বাবাই, তুমি খুব ভালো।
: মাই সুইট বাবাসোনা, তুই আমার প্রাণরে।
পারমিতা হাসতে হাসতে রোহান এবং মৈনাককে একসাথে জড়িয়ে ধরলো।
সকাল থেকে অপেক্ষা করছে রোহান, বাবার অফিসে যাবে। পারমিতা খুব ব্যস্ত, পেস্ট কন্ট্রোল থেকে লোকজন এসেছে, কাঠের কাজে যেন ঘুনপোকা না আসে সেজন্য ঔষধ ছিটাচ্ছে। অনেকগুলো রুম, একটা একটা করে ঔষধ ছিটাতে সময় লাগছে। এদিকে রোহান অস্থির হয়ে আছে। মাকে বারবার ডাকছে, পেছন পেছন হাঁটছে।
পারমিতা শুধু ‘এই যাই, এই যাই’ করছে। দু’টো বেজে গেছে, রোহানের পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে গেছে।
কাজের ধরন দেখে বোঝা গেলো আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। রোহান রেগেমেগে বের হয়ে গেলো। পারমিতা পেছন পেছন দরজা পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এলো, পেস্ট কন্ট্রোলের লোকরা ডাকছে, জানতে চাইছে আর কোথায় কোথায় ঘুণপোকার ঔষধ দেবে।
বাইরে বেশ গরম পড়েছে। রোদে তেতে রোহান বাবার অফিসে ঢুকলো। সোজা বাবার চেম্বারে গিয়ে বসলো। পিয়ন পলাশ ছুটে এসে এসি চালিয়ে দিলো। টেবিলে এক গ্লাস ঠা-া লাচ্ছি রেখে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন রোহান বললেই আকাশ থেকে চাঁদটা পেড়ে এনে দেবে।
লাচ্ছিতে চুমুক দিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে রোহান বললো,
: চেয়ারম্যান সাহেব কোথায়?
: স্যার তো মিনিস্ট্রিতে গেছেন, ফরেন মিনিস্ট্রিতে, সচিব মহোদয়ের সাথে মিটিং আছে।
: সে কী! আজ তো আমার আসার কথা এখানে, তাও চলে গেলো- বলেই আরো গম্ভীর হয়ে গেলো।
খালি গ্লাসটা নিয়ে পলাশ চলে গেলো, বেশ ভয় পেয়েছে, চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র ছেলে রেগে আছে, না জানি কখন কী বলে বসে।
বাবার চেয়ারে চোখ বুজে বসে দোল খাচ্ছে, লাচ্ছি খেয়ে পেট একটু শান্ত হলো। এদিক ওদিক দেখছে, রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো, কিছুক্ষণ বসলে মন ভালো হয়ে যায়।
হঠাৎ চোখ পড়লো, বাবার টেবিলের নিচে একটা ল্যাপটপ ব্যাগ। রোহান লাফিয়ে উঠে ব্যাগটা নিলো, তারপর পায়ের আঙ্গুলের ওপর বেশ কয়েকটা পাক খেয়ে একছুটে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
হতভম্ব পলাশ দরজা পর্যন্ত এসে তাকিয়ে আছে, মাথামু- কিছুই বুঝতে পারছে না। রোহান একটা চলন্ত রিক্সায় লাফিয়ে উঠে বাসায় চলে এলো। বাবার দেয়া সারপ্রাইজটা খুব উপভোগ করছে সে।
মা তখনও নতুন ফ্ল্যাট থেকে ফেরে নি। ব্যাগ হাতে নিজের শোবার ঘরে চলে এলো। একটানে ব্যাগের চেনটা খুলে ফেললো,
: এ কী! এখানে একটা নকশি কাঁথা, কফি কালারের কাঁথাতে রংবেরঙ্গের সুতোর কাজ, বাবা কি কাঁথার ভেতরে ল্যাপটপটা রেখেছে? দেখি তো ভাঁজ খুলে।
রোহান কাঁথাটা খুলে ফেললো, বুঝতেই পারে নি ওর জন্য এমন একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। কাঁথার ভাঁজে মেয়েদের রাত পোশাক, একটা নীল রঙের জামা আর লাল রঙের পাজামা।
রোহান ঘোলাটে চোখে রাত পোশাকের দিকে তাকিয়ে আছে, ছোটখাটো আকৃতির কোন নারীর পোশাক এটা।
রোহান মেঝেতে বসে পড়েছে। চোখের সামনে ভাসছে মা’র ঢলোঢলো মুখ, সুখের বানডাকা একজোড়া চোখ আর সংসারে সবার জন্য শান্তি কুড়ানো ত্রস্ত পদচারণা। বাবার চারপাশে বাকবাকুম করে গলা ফোলানো পায়রাটা ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে, একটা ঝড় ক্রমশ ওকে ঘিরে ফেলছে।
বাইরে মা’র গলা শোনা যাচ্ছে, রোহান ঘোর থেকে বের হয়ে আসছে। মা কাকে যেন ফোনে বলছে,
: হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই মাত্র ফিরলাম। হ্যাঁরে সব রুমেই ঘুণপোকার ঔষধ ছিটিয়ে দিয়েছি, ওরা তো বলেছে, আগামী বিশ বছরেও কাঠের কাজে কোজে রকম ঘুণপোকা আসবে না।
রোহানের চোখ থেকে কান্না নয়, উত্তাপ বের হচ্ছে, মা এ কী করছে! জানেই না মা, কবে কখন এতো যত্নে গড়া সংসারে ঘুণপোকা ঢুকে গেছে।
নতুন ফ্ল্যাটে ঘুণপোকার ঔষধ ছিটাচ্ছে, নিজের সংসারকে ঘুণপোকার কবল থেকে বাঁচাতে পারলো না।
রোহান এখন কাঁদছে, মায়ের ঢলোঢলো মুখটা মনে করে কাঁদছে, কাঁদছে বাবার অফিস থেকে আনা ব্যাগের ভেতরের রাত পোশাকের দিকে তাকিয়ে। কাঁদছে অজানা সে ঘুণপোকার কথা ভেবে।
শেলী সেনগুপ্তা
বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মা, একদম পুতুল পুতুল। রোহান মা’র চিবুক নেড়ে দিয়ে কথাটা বলে ভেতরে চলে গেলো। পারমিতা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মুচকি হেসে আয়নার কাছ থেকেও পালিয়ে গেলো।
পারমিতা আজ খুব সেজেছে। টুকটুকে লাল শাড়ি আর লাল টিপে পারমিতাকে পরীর মতো লাগছে। সকাল থেকে অনেক রান্না করলো। টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। অনেক দিন পর মৈনাক আসছে। এতোদিন ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে ছিলো। পারমিতা চাতকের মতো পথ চেয়ে ছিলো, কখন আসবে মৈনাক। প্রতিবার বিদেশ থেকে আসার সময় হলে এভাবেই পারমিতার অপেক্ষা শুরু হয়। মৈনাক ফিরে এলে খুব ভালো লাগে আবার অপেক্ষার দিনগুলোও উপভোগ করে। মুখ থেকে সবসময়ই হাসি ঝরে পড়ছে।
পারমিতা আর মৈনাকের বিশ বছরের সংসার। ওদের একমাত্র সন্তান রোহান। তিনজনের সংসার বেশ ভালোই কাটছে।
মৈনাক আর পারমিতা একসাথে পড়াশোনা করতো। কখন যে একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলেছে বুঝতেও পারে নি। একসময় মনে হলো এখন আর দূরে দূরে থাকা যাবে না। একসাথে এক ঘরে থাকতে হবে। ওরা বিয়ে করে ফেললো। দুই পরিবারের কেউই ওদের বিয়েটা মেনে নেয় নি। ওরাও তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো জীবনযাপন করতে শুরু করলো।
পারমিতার কিছু গয়না আর মৈনাকের জমানো টাকা দিয়ে ওরা একটা ব্যবসা শুরু করলো। দেখতে দেখতে বেশ উন্নতিও হলো। এর মধ্যে পারমিতা সন্তানসম্ভবা। ডাক্তার বললো,
: বিশ্রাম দরকার।
মৈনাকও বললো,
: বিশ্রাম দরকার।
পারমিতা আর অফিস করে না। সংসার সামলে একটা নতুন প্রাণের অপেক্ষা করছে। মৈনাকও চেষ্টা করে ওকে সময় দিতে। কখনো পারে কখনো পারে না। পারমিতা একাই সব সামলে নিচ্ছে। শুধু কষ্ট হয় মৈনাকের কাজে সহযোগিতা করতে পারছে না তাই। এর মধ্যে এক মধ্যরাতে রোহানের জন্ম হলো। চাঁদের মতো ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ওরা দু’জনেই খুব খুশি। পারমিতা এখন সারাক্ষণ রোহানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর মৈনাক ব্যবসা নিয়ে। ঘরে ফিরে ছেলেকে মাঝখানে নিয়ে দু’জন গল্প করে।
ক্লান্ত মৈনাকের মাথায় হাত বুলিয়ে পারমিতা ঘুম পাড়িয়ে দেয় আর অপেক্ষা করে আরো একটা সুখের দিনের।
রোহান বড় হলো, স্কুল শেষ করে কলেজে গেলো, একসময় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হলো। পারমিতা এখন ঢলোঢলো গিন্নিবান্নি, সংসার সামলায় আর স্বামী সন্তানের দেখাশোনা করে, যেন এক সুখী রাজহংসী ডানার নিচে সোনালি ডিম সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে।
ব্যবসা বড় হয়েছে, মৈনাক এখন অনেক ব্যস্ত। সংসারে বড় বড় জানালা খুলে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিমাসেই ব্যবসার কাজে বিদেশে যেতে হয়। পারমিতা ব্যাগ গুছিয়ে দেয়, দরজায় দাঁড়িয়ে মঙ্গল কামনা করে বিদায় দেয়।
পারমিতা আর মৈনাকের নতুন ফ্ল্যাট হয়েছে, বেশ বড়। ‘পারমিতা নিবাস’, পারমিতার স্বপ্নের ফ্ল্যাট। প্রতিদিন ফ্ল্যাটে যাচ্ছে, ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর দিয়ে সাজাচ্ছে। সে কী ব্যস্ততা! প্রতিদিন বাইরে যাচ্ছে, কত কী কিনছে! ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে ঝর্ণা, বাহারী আলো, পাখির কলতানের কলিং বেল, কী নেই!
সময় পেলেই ফোন করে কাজের ফিরিস্তি দেয়, আর মৈনাক শোনে আর হাসে। রোহানও বাদ যায় না। মাঝে মাঝে রোহানের মতামত চায়, মায়ের উচ্ছ্বাসে আনন্দ পায়, এমন মতামতই দেয় যা মা পছন্দ করবে।
মৈনাক বলে দিয়েছে রোহানের রুমটা খুব সুন্দর হতে হবে। সব আসবাব নতুন করে কেনা হয়েছে। দেয়ালজোড়া আলমারী, মিউজিক সেট। এখানেও পারমিতার আগ্রহের অন্ত নেই। সারাক্ষণ ছোটাছুটি করে ঘর সাজাচ্ছে।
এ সুযোগে রোহান বাবার কাছে একটা নতুন ল্যাপটপ দাবি করেছে। বাজারের সবচেয়ে দামী ল্যাপটপটাই চাই ওর। মৈনাক কখনোই রোহানের কোনো ইচ্ছাতে বাধা দেয় না, এখনও দিলো না।
: বেশ তো বাবাসোনা, কালই তুমি অফিসে আসবে, তোমার পছন্দের ল্যাপটপটা কিনে দেবো। মাকেও নিয়ে এসো। কাল আমরা বাইরে লাঞ্চ করবো। ওকে?
: ওকে বাবাই, তুমি খুব ভালো।
: মাই সুইট বাবাসোনা, তুই আমার প্রাণরে।
পারমিতা হাসতে হাসতে রোহান এবং মৈনাককে একসাথে জড়িয়ে ধরলো।
সকাল থেকে অপেক্ষা করছে রোহান, বাবার অফিসে যাবে। পারমিতা খুব ব্যস্ত, পেস্ট কন্ট্রোল থেকে লোকজন এসেছে, কাঠের কাজে যেন ঘুনপোকা না আসে সেজন্য ঔষধ ছিটাচ্ছে। অনেকগুলো রুম, একটা একটা করে ঔষধ ছিটাতে সময় লাগছে। এদিকে রোহান অস্থির হয়ে আছে। মাকে বারবার ডাকছে, পেছন পেছন হাঁটছে।
পারমিতা শুধু ‘এই যাই, এই যাই’ করছে। দু’টো বেজে গেছে, রোহানের পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে গেছে।
কাজের ধরন দেখে বোঝা গেলো আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। রোহান রেগেমেগে বের হয়ে গেলো। পারমিতা পেছন পেছন দরজা পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এলো, পেস্ট কন্ট্রোলের লোকরা ডাকছে, জানতে চাইছে আর কোথায় কোথায় ঘুণপোকার ঔষধ দেবে।
বাইরে বেশ গরম পড়েছে। রোদে তেতে রোহান বাবার অফিসে ঢুকলো। সোজা বাবার চেম্বারে গিয়ে বসলো। পিয়ন পলাশ ছুটে এসে এসি চালিয়ে দিলো। টেবিলে এক গ্লাস ঠা-া লাচ্ছি রেখে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন রোহান বললেই আকাশ থেকে চাঁদটা পেড়ে এনে দেবে।
লাচ্ছিতে চুমুক দিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে রোহান বললো,
: চেয়ারম্যান সাহেব কোথায়?
: স্যার তো মিনিস্ট্রিতে গেছেন, ফরেন মিনিস্ট্রিতে, সচিব মহোদয়ের সাথে মিটিং আছে।
: সে কী! আজ তো আমার আসার কথা এখানে, তাও চলে গেলো- বলেই আরো গম্ভীর হয়ে গেলো।
খালি গ্লাসটা নিয়ে পলাশ চলে গেলো, বেশ ভয় পেয়েছে, চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র ছেলে রেগে আছে, না জানি কখন কী বলে বসে।
বাবার চেয়ারে চোখ বুজে বসে দোল খাচ্ছে, লাচ্ছি খেয়ে পেট একটু শান্ত হলো। এদিক ওদিক দেখছে, রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো, কিছুক্ষণ বসলে মন ভালো হয়ে যায়।
হঠাৎ চোখ পড়লো, বাবার টেবিলের নিচে একটা ল্যাপটপ ব্যাগ। রোহান লাফিয়ে উঠে ব্যাগটা নিলো, তারপর পায়ের আঙ্গুলের ওপর বেশ কয়েকটা পাক খেয়ে একছুটে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
হতভম্ব পলাশ দরজা পর্যন্ত এসে তাকিয়ে আছে, মাথামু- কিছুই বুঝতে পারছে না। রোহান একটা চলন্ত রিক্সায় লাফিয়ে উঠে বাসায় চলে এলো। বাবার দেয়া সারপ্রাইজটা খুব উপভোগ করছে সে।
মা তখনও নতুন ফ্ল্যাট থেকে ফেরে নি। ব্যাগ হাতে নিজের শোবার ঘরে চলে এলো। একটানে ব্যাগের চেনটা খুলে ফেললো,
: এ কী! এখানে একটা নকশি কাঁথা, কফি কালারের কাঁথাতে রংবেরঙ্গের সুতোর কাজ, বাবা কি কাঁথার ভেতরে ল্যাপটপটা রেখেছে? দেখি তো ভাঁজ খুলে।
রোহান কাঁথাটা খুলে ফেললো, বুঝতেই পারে নি ওর জন্য এমন একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। কাঁথার ভাঁজে মেয়েদের রাত পোশাক, একটা নীল রঙের জামা আর লাল রঙের পাজামা।
রোহান ঘোলাটে চোখে রাত পোশাকের দিকে তাকিয়ে আছে, ছোটখাটো আকৃতির কোন নারীর পোশাক এটা।
রোহান মেঝেতে বসে পড়েছে। চোখের সামনে ভাসছে মা’র ঢলোঢলো মুখ, সুখের বানডাকা একজোড়া চোখ আর সংসারে সবার জন্য শান্তি কুড়ানো ত্রস্ত পদচারণা। বাবার চারপাশে বাকবাকুম করে গলা ফোলানো পায়রাটা ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে, একটা ঝড় ক্রমশ ওকে ঘিরে ফেলছে।
বাইরে মা’র গলা শোনা যাচ্ছে, রোহান ঘোর থেকে বের হয়ে আসছে। মা কাকে যেন ফোনে বলছে,
: হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই মাত্র ফিরলাম। হ্যাঁরে সব রুমেই ঘুণপোকার ঔষধ ছিটিয়ে দিয়েছি, ওরা তো বলেছে, আগামী বিশ বছরেও কাঠের কাজে কোজে রকম ঘুণপোকা আসবে না।
রোহানের চোখ থেকে কান্না নয়, উত্তাপ বের হচ্ছে, মা এ কী করছে! জানেই না মা, কবে কখন এতো যত্নে গড়া সংসারে ঘুণপোকা ঢুকে গেছে।
নতুন ফ্ল্যাটে ঘুণপোকার ঔষধ ছিটাচ্ছে, নিজের সংসারকে ঘুণপোকার কবল থেকে বাঁচাতে পারলো না।
রোহান এখন কাঁদছে, মায়ের ঢলোঢলো মুখটা মনে করে কাঁদছে, কাঁদছে বাবার অফিস থেকে আনা ব্যাগের ভেতরের রাত পোশাকের দিকে তাকিয়ে। কাঁদছে অজানা সে ঘুণপোকার কথা ভেবে।