মূল গল্প: রোয়াল্ড ডাল অনুবাদ: মনিজা রহমান
কোটিপতির তালিকায় নাম লেখানো-মাত্র জর্জ ক্লিভার তার স্ত্রীকে নিয়ে শহরতলির ভিলা ছেড়ে লন্ডনের অভিজাত এলাকায় বাড়ি নিলেন। সেই বাড়িতে মঁশিয়ে এস্ট্রাগনকে বাবুর্চি ও টিবসকে খানসামা পদে বিপুল অঙ্কের অর্থে নিয়োগ দেয়া হলো। এই দুইজনের সাহায্যে কীভাবে সমাজের কেউকেটা একজন হওয়া যায় সেটাই ছিল মালিকের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য পূরণে সপ্তাহে কয়েকবার মিস্টার ক্লিভার বাড়িতে জমকালো ডিনারের পার্টি দিতে আরম্ভ করলেন।
দিন যায়। কিন্তু ডিনারের পার্টিতে কিসের যেন একটা অভাব অনুভব করছিলেন মিস্টার ক্লিভার! তার মনে হচ্ছিল লোকজন সবাই একঘেয়েমিতে ভুগছে। ঠিক যেন জমে উঠছে না। অথচ খাবার ছিল দুর্দান্ত, অতিথিদের সেবায়ও কোনো ত্রুটি ছিল না।
‘টিবস, বলতো আমাদের সমস্যাটা কোথায়?’ মিস্টার ক্লিভার তার খানসামার কাছে জানতে চাইলেন, ‘কেন পার্টিতে এসে কেউ নিজেকে হারিয়ে ফেলে না। জড়পদার্থের মতো সবাই দাঁড়িয়ে থাকে!’
টিবস তার মাথা একদিকে ঝুঁকিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। ‘আশা করি স্যার, যদি আমি একটি ছোট পরামর্শ দিই তবে আপনি বিরক্ত হবেন না।’
‘কী সেটা?’
‘সেটা হলো ওয়াইন, স্যার।’
‘ওয়াইন আবার কী করল?’
‘জি স্যার, মঁশিয়ে এস্ট্রাগন সন্দেহ নেই দুর্দান্ত খাবার পরিবেশন করে। কিন্তু এই দুর্দান্ত খাবারের সঙ্গে দুর্দান্ত ওয়াইন থাকা উচিত। কিন্তু আপনি তাদের জন্য সস্তা স্প্যানিশ রেড ওয়াইন পরিবেশন করেন।’
‘খোদার কসম আমি বুঝতে পারছি না, এই কথাটা বলতে তোমার এতদিন কেন লাগল! কেন কথাটা এতদিন পেটে চেপে রেখেছ।’
মি. ক্লিভার রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠলেন- ‘আমার টাকার অভাব নেই। দরকার হলে পার্টিতে বিশ্বের সেরা ফ্লিপিং ওয়াইনের ব্যবস্থা করা হবে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা ওয়াইন কী?’
‘ক্লারেট স্যার।’ খানসামা উত্তর দিলেন। ‘বোর্দোর সর্বশ্রেষ্ঠ চ্যাটেক্স থেকে লাফাইট, লাটোর, হাউট-ব্রায়ান, মাগাক্স, মাউটন রথসচাইল্ড ও শেভাল ব্লাঙ্ক। আর বছরের কথা বললে ১৯০৬, ১৯১৪, ১৯২৯ ও ১৯৪৫ সালের কথা বলব আমি।’
‘তাহলে সব কিনে ফেল।’ মি ক্লিভার বললেন। ‘ওপর থেকে নিচ পর্য়ন্ত পুরো সেলারটি ভরে ফেল ওয়াইন দিয়ে।’
‘চেষ্টা করতে পারি স্যার।’ খানসামা বললেন। ‘কিন্তু কি জানেন, এই ধরনের ওয়াইন অত্যন্ত বিরল, ভাগ্যক্রমে পাওয়া যায়।’
‘দাম বেশির কথা আমি শুনতে চাই না। যেখানে পারো কিনে ফেলবে।’
কথাটা বলতে যত সহজ, কাজে ততটাই কঠিন ছিল। ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের কোথাও টিবস ১৮৯৫, ১৯০৬, ১৯১৪ বা ১৯২১ সালের কোনো ওয়াইন খুঁজে পেল না। শেষমেশ সে ১৯২৯ ও ১৯৪৫ সালের কিছু ওয়াইন পেল, যার দাম ছিল আকাশছোঁয়া। ওয়াইনের বিল দেখে এমনকি মিস্টার ক্লিভারও ধপ করে বসে পড়লেন। কিন্তু একটু পরেই উঠে দাঁড়ালেন, যখন খানসামা তাকে বলতে লাগল ভালো ওয়াইন সম্পর্কে জ্ঞান এক ধরনের বনেদীপনার মধ্যে পড়ে।
মিস্টার ক্লিভার ওয়াইন বিষয়ক একের পর এক বই কিনে আগাগোড়া বার বার পড়তে লাগলেন। বই মুখস্থ করা ছাড়াও টিবস তাকে হাতে কলমে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। ঠিক কীভাবে ওয়াইনের স্বাদ নিতে হবে- যেটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
‘প্রথমে স্যার, আপনি গ্লাসের ওপরের ডানদিকে নাক দিয়ে লম্বা ও গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে শুঁকবেন, ঠিক এভাবে। তারপর ওয়াইন মুখে নিয়ে রেখে দেবেন, আপনার ঠোঁট থাকবে সামান্য খোলা, বাতাস মুখে প্রবেশ করে বুদ্বুদ সৃষ্টি করবে, এই যে আমি কীভাবে পান করছি দেখুন, মুখের চারপাশে ওয়াইনের স্বাদ নিতে হবে, তারপর এটিকে কোত করে গিলে ফেলুন।’
মিস্টার ক্লিভার কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে একজন ওয়াইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করলেন। অনিবার্যভাবে সবার প্রচ- রকম বিরক্তির কারণ হলেন।
‘ভদ্রমহোদয়গণ’, তিনি নৈশভোজনের সময় তার গ্লাস হাতে নিয়ে ঘোষণা করতেন, ‘এটা হলো মারগাক্স ’২৯! শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ বছর। যার একটু স্বাদ আপনাকে গৌরবময় আনন্দের অংশীদার করবে। অসাধারণ না?’
অতিথিরা তার কথায় সামান্য মাথা নাড়ত, কেউ চুমুক দিত তার মতো, কেউ কেউ প্রশংসা করত, কিন্তু খুব বেশি মাতামাতি ছিল না।
‘সবার এমন মূর্খ আচরণের কারণ কী?’ মিস্টার ক্লিভার টিবসকে প্রশ্ন করলেন। ‘তাদের কেউই এই দুর্দান্ত ওয়াইনের মূল্যই বুঝল না!’
‘আমি মনে করি তারা এই ওয়াইনের প্রশংসা করবে স্যার।’ খানসামা মাথা একদিকে নিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল। ‘যদি তারা ওয়াইনের সত্যিকারের স্বাদ নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু তারা সেটা পারছে না।’
‘কী বলতে চাও তুমি, তারা এরা স্বাদ নিতে পারছে না?’
‘যত দূর জানি, আপনি মঁশিয়ে এস্ট্রাগনকে সালাদ ড্রেসিংয়ে হাত খুলে ভিনেগার দিতে বলেছেন।’
‘তাতে কী হয়েছে! ভিনেগার আমার পছন্দ।’
‘ভিনেগার হলো মদের শত্রু।’ খানসামা উত্তর দিলেন। ‘এটা মুখের রুচি নষ্ট করে দেয়। ড্রেসিংটি অলিভ অয়েল ও সামান্য লেবুর রস দিয়ে তৈরি করা উচিত। আর কিছু না!’
‘একদম আজেবাজে কথা!’ মি: ক্লিভার বললেন।
‘আপনি যেমন মনে করেন, স্যার।’
‘আবারও বলব টিবস, তুমি আজেবাজে কথা বলছ। ভিনেগার আমার খাবারের রুচি একটুও নষ্ট করেনি।’
‘আপনি সত্যি ভাগ্যবান, স্যার।’
খানসামা তর্কাতর্কি এড়াতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
ওই রাতে নৈশভোজনের সময় মি: ক্লিভার অতিথিদের সামনে তার খানসামাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করলেন। ‘মিস্টার টিবস, আমাকে বলার চেষ্টা করছে যে সালাদ ড্রেসিংয়ে ভিনেগার দিলে আমি আমার ওয়াইনের স্বাদ ঠিকভাবে নিতে পারব না! ঠিক কিনা টিবস?’
‘হ্যাঁ, স্যার,’ টিবস গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন।
‘আমি তাকে আজেবাজে কথা না বলতে বলেছি। তাই না টিবস?’
‘জী জনাব।’
‘আমিতো সালাদ খাবার পরে ওয়াইনের স্বাদ ঠিকঠাক মতোই পাচ্ছি। এই ওয়াইনের স্বাদ আমার কাছে ঠিক চ্যাটেউ লাফাইট ’৪৫-এর মতো মনে হচ্ছে। না না তারচেয়েও বেশি কিছু।’
খানসামা টিবস খুব স্থির হয়ে সাইডবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখ লজ্জায়-অপমানে ফ্যাকাসে।
‘আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। এটা ল্যাফাইট ’৪৫ নয়।’
মিস্টার ক্লিভার তার চেয়ার নিয়ে ঘুরে গেলেন। খানসামার দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাইছ? প্রমাণ হিসেবে খালি বোতল তো পড়ে আছে।’
ডিনার শুরুর আগে টিবস নিজের তৈরি ওয়াইনের একটি মিশ্রণ পরিবেশন করতেন। যে কারণে খালি বোতলগুলি সাইডবোর্ডে রেখে দিতেন তিনি। সাইডবোর্ডে একটি লাফাইট ’৪৫ সবাইকে দেখানোর জন্য রাখা ছিল।
‘স্যার আপনি যে মদ পান করছেন...,’ খানসামা শান্তভাবে বললেন, ‘সেটা ছিল সস্তা দুর্গন্ধযুক্ত স্প্যানিশ রেড।’
মিস্টার ক্লিভার তার গ্লাসে রাখা ওয়াইনের দিকে একবার, আরেকবার খানসামার দিকে তাকাচ্ছিলেন। রাগে তার মুখ লাল। ‘তুমি মিথ্যা বলছ টিবস।’
উত্তরে টিবস বলল, ‘না স্যার, আমি মিথ্যা বলছি না। আসলে এখানে কাজ নেবার পরে স্প্যানিশ রেড ছাড়া অন্য কোনো মদ আপনাকে কখনো পরিবেশন করিনি। কারণ, আমি জানতাম- আপনি ওয়াইনের পার্থক্য বুঝতে পারবেন না।’
‘আমি তোকে বিশ্বাস করি না।’ মিস্টার ক্লিভার অতিথিদের ওপর চোখ বুলিয়ে খানসামার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘তুই একটা মিথ্যাবাদী। তুই নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছিস।’
‘দুর্দান্ত মদ।’ মিস্টার ক্লিভারের কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘এই ধরনের মদ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পান করতে হয়। রাতের খাবারের আগে তিন চারটে ককটেল পান করলে এমনিতে খাবারের রুচি নষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি আপনি প্রত্যেকটি খাবারে ভিনেগার মেশান তো সব শেষ। তখন মনে হবে আপনি ওয়াইনের পরিবর্তে কলের পানি খাচ্ছেন।’
টেবিলের চারপাশে দশটি ক্ষুব্ধ মুখ খানসামার দিকে তাকিয়ে আছে। টিবস হতচ্ছাড়া তাদের রাগে দিশেহারা করে ফেলেছে। রীতিমতো বাকরুদ্ধ তারা।
‘এটা দেখেন।’ খানসামা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ভালোবেসে যেন ছুঁয়ে দিল খালি বোতলগুলির একটিকে, ‘লাফাইট ৪৫-এর শেষ বোতল এটি। ঊনত্রিশ বোতল ইতিমধ্যে উদরপূর্তি করেছি আমরা। আমরা মানে মঁশিয়ে এস্ট্রাগন ও আমি খুবই উপভোগ করেছি পানীয়গুলি। আসলে উপভোগ করার মতোই উচুঁমানের স্বাদ তাদের। টাকা থাকলেই সেই স্বাদ বোঝা যায় না।’
কথা শেষ করে খানসামা হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হলরুম অতিক্রম করে বাড়ির দরজা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পা রাখল। মঁশিয়ে এস্ট্রাগন সেখানে দুজনের দুই স্যুটকেস গাড়িতে নিয়ে রওনা দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল।
*
রোয়াল্ড ডাল (১৯১৬-১৯৯০) একজন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি। তিনি ওয়েলসে এক ধনী নরওয়েজিয়ান অভিবাসী পিতামাতার গৃহে জন্ম নেন; এবং বেশিরভাগ সময় ইংল্যান্ডে কাটান। তিনি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় রয়েল এয়ারফোর্সে পাইলটের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন বীর যোদ্ধা। ১৯৪০ সালে তিনি সর্বাধিক বিক্রিত লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাকে “বিশ শতকের অন্যতম সেরা শিশুতোষ লেখক” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল গল্প: রোয়াল্ড ডাল অনুবাদ: মনিজা রহমান
বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১
কোটিপতির তালিকায় নাম লেখানো-মাত্র জর্জ ক্লিভার তার স্ত্রীকে নিয়ে শহরতলির ভিলা ছেড়ে লন্ডনের অভিজাত এলাকায় বাড়ি নিলেন। সেই বাড়িতে মঁশিয়ে এস্ট্রাগনকে বাবুর্চি ও টিবসকে খানসামা পদে বিপুল অঙ্কের অর্থে নিয়োগ দেয়া হলো। এই দুইজনের সাহায্যে কীভাবে সমাজের কেউকেটা একজন হওয়া যায় সেটাই ছিল মালিকের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য পূরণে সপ্তাহে কয়েকবার মিস্টার ক্লিভার বাড়িতে জমকালো ডিনারের পার্টি দিতে আরম্ভ করলেন।
দিন যায়। কিন্তু ডিনারের পার্টিতে কিসের যেন একটা অভাব অনুভব করছিলেন মিস্টার ক্লিভার! তার মনে হচ্ছিল লোকজন সবাই একঘেয়েমিতে ভুগছে। ঠিক যেন জমে উঠছে না। অথচ খাবার ছিল দুর্দান্ত, অতিথিদের সেবায়ও কোনো ত্রুটি ছিল না।
‘টিবস, বলতো আমাদের সমস্যাটা কোথায়?’ মিস্টার ক্লিভার তার খানসামার কাছে জানতে চাইলেন, ‘কেন পার্টিতে এসে কেউ নিজেকে হারিয়ে ফেলে না। জড়পদার্থের মতো সবাই দাঁড়িয়ে থাকে!’
টিবস তার মাথা একদিকে ঝুঁকিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। ‘আশা করি স্যার, যদি আমি একটি ছোট পরামর্শ দিই তবে আপনি বিরক্ত হবেন না।’
‘কী সেটা?’
‘সেটা হলো ওয়াইন, স্যার।’
‘ওয়াইন আবার কী করল?’
‘জি স্যার, মঁশিয়ে এস্ট্রাগন সন্দেহ নেই দুর্দান্ত খাবার পরিবেশন করে। কিন্তু এই দুর্দান্ত খাবারের সঙ্গে দুর্দান্ত ওয়াইন থাকা উচিত। কিন্তু আপনি তাদের জন্য সস্তা স্প্যানিশ রেড ওয়াইন পরিবেশন করেন।’
‘খোদার কসম আমি বুঝতে পারছি না, এই কথাটা বলতে তোমার এতদিন কেন লাগল! কেন কথাটা এতদিন পেটে চেপে রেখেছ।’
মি. ক্লিভার রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠলেন- ‘আমার টাকার অভাব নেই। দরকার হলে পার্টিতে বিশ্বের সেরা ফ্লিপিং ওয়াইনের ব্যবস্থা করা হবে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা ওয়াইন কী?’
‘ক্লারেট স্যার।’ খানসামা উত্তর দিলেন। ‘বোর্দোর সর্বশ্রেষ্ঠ চ্যাটেক্স থেকে লাফাইট, লাটোর, হাউট-ব্রায়ান, মাগাক্স, মাউটন রথসচাইল্ড ও শেভাল ব্লাঙ্ক। আর বছরের কথা বললে ১৯০৬, ১৯১৪, ১৯২৯ ও ১৯৪৫ সালের কথা বলব আমি।’
‘তাহলে সব কিনে ফেল।’ মি ক্লিভার বললেন। ‘ওপর থেকে নিচ পর্য়ন্ত পুরো সেলারটি ভরে ফেল ওয়াইন দিয়ে।’
‘চেষ্টা করতে পারি স্যার।’ খানসামা বললেন। ‘কিন্তু কি জানেন, এই ধরনের ওয়াইন অত্যন্ত বিরল, ভাগ্যক্রমে পাওয়া যায়।’
‘দাম বেশির কথা আমি শুনতে চাই না। যেখানে পারো কিনে ফেলবে।’
কথাটা বলতে যত সহজ, কাজে ততটাই কঠিন ছিল। ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের কোথাও টিবস ১৮৯৫, ১৯০৬, ১৯১৪ বা ১৯২১ সালের কোনো ওয়াইন খুঁজে পেল না। শেষমেশ সে ১৯২৯ ও ১৯৪৫ সালের কিছু ওয়াইন পেল, যার দাম ছিল আকাশছোঁয়া। ওয়াইনের বিল দেখে এমনকি মিস্টার ক্লিভারও ধপ করে বসে পড়লেন। কিন্তু একটু পরেই উঠে দাঁড়ালেন, যখন খানসামা তাকে বলতে লাগল ভালো ওয়াইন সম্পর্কে জ্ঞান এক ধরনের বনেদীপনার মধ্যে পড়ে।
মিস্টার ক্লিভার ওয়াইন বিষয়ক একের পর এক বই কিনে আগাগোড়া বার বার পড়তে লাগলেন। বই মুখস্থ করা ছাড়াও টিবস তাকে হাতে কলমে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। ঠিক কীভাবে ওয়াইনের স্বাদ নিতে হবে- যেটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
‘প্রথমে স্যার, আপনি গ্লাসের ওপরের ডানদিকে নাক দিয়ে লম্বা ও গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে শুঁকবেন, ঠিক এভাবে। তারপর ওয়াইন মুখে নিয়ে রেখে দেবেন, আপনার ঠোঁট থাকবে সামান্য খোলা, বাতাস মুখে প্রবেশ করে বুদ্বুদ সৃষ্টি করবে, এই যে আমি কীভাবে পান করছি দেখুন, মুখের চারপাশে ওয়াইনের স্বাদ নিতে হবে, তারপর এটিকে কোত করে গিলে ফেলুন।’
মিস্টার ক্লিভার কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে একজন ওয়াইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করলেন। অনিবার্যভাবে সবার প্রচ- রকম বিরক্তির কারণ হলেন।
‘ভদ্রমহোদয়গণ’, তিনি নৈশভোজনের সময় তার গ্লাস হাতে নিয়ে ঘোষণা করতেন, ‘এটা হলো মারগাক্স ’২৯! শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ বছর। যার একটু স্বাদ আপনাকে গৌরবময় আনন্দের অংশীদার করবে। অসাধারণ না?’
অতিথিরা তার কথায় সামান্য মাথা নাড়ত, কেউ চুমুক দিত তার মতো, কেউ কেউ প্রশংসা করত, কিন্তু খুব বেশি মাতামাতি ছিল না।
‘সবার এমন মূর্খ আচরণের কারণ কী?’ মিস্টার ক্লিভার টিবসকে প্রশ্ন করলেন। ‘তাদের কেউই এই দুর্দান্ত ওয়াইনের মূল্যই বুঝল না!’
‘আমি মনে করি তারা এই ওয়াইনের প্রশংসা করবে স্যার।’ খানসামা মাথা একদিকে নিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল। ‘যদি তারা ওয়াইনের সত্যিকারের স্বাদ নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু তারা সেটা পারছে না।’
‘কী বলতে চাও তুমি, তারা এরা স্বাদ নিতে পারছে না?’
‘যত দূর জানি, আপনি মঁশিয়ে এস্ট্রাগনকে সালাদ ড্রেসিংয়ে হাত খুলে ভিনেগার দিতে বলেছেন।’
‘তাতে কী হয়েছে! ভিনেগার আমার পছন্দ।’
‘ভিনেগার হলো মদের শত্রু।’ খানসামা উত্তর দিলেন। ‘এটা মুখের রুচি নষ্ট করে দেয়। ড্রেসিংটি অলিভ অয়েল ও সামান্য লেবুর রস দিয়ে তৈরি করা উচিত। আর কিছু না!’
‘একদম আজেবাজে কথা!’ মি: ক্লিভার বললেন।
‘আপনি যেমন মনে করেন, স্যার।’
‘আবারও বলব টিবস, তুমি আজেবাজে কথা বলছ। ভিনেগার আমার খাবারের রুচি একটুও নষ্ট করেনি।’
‘আপনি সত্যি ভাগ্যবান, স্যার।’
খানসামা তর্কাতর্কি এড়াতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
ওই রাতে নৈশভোজনের সময় মি: ক্লিভার অতিথিদের সামনে তার খানসামাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করলেন। ‘মিস্টার টিবস, আমাকে বলার চেষ্টা করছে যে সালাদ ড্রেসিংয়ে ভিনেগার দিলে আমি আমার ওয়াইনের স্বাদ ঠিকভাবে নিতে পারব না! ঠিক কিনা টিবস?’
‘হ্যাঁ, স্যার,’ টিবস গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন।
‘আমি তাকে আজেবাজে কথা না বলতে বলেছি। তাই না টিবস?’
‘জী জনাব।’
‘আমিতো সালাদ খাবার পরে ওয়াইনের স্বাদ ঠিকঠাক মতোই পাচ্ছি। এই ওয়াইনের স্বাদ আমার কাছে ঠিক চ্যাটেউ লাফাইট ’৪৫-এর মতো মনে হচ্ছে। না না তারচেয়েও বেশি কিছু।’
খানসামা টিবস খুব স্থির হয়ে সাইডবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখ লজ্জায়-অপমানে ফ্যাকাসে।
‘আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। এটা ল্যাফাইট ’৪৫ নয়।’
মিস্টার ক্লিভার তার চেয়ার নিয়ে ঘুরে গেলেন। খানসামার দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাইছ? প্রমাণ হিসেবে খালি বোতল তো পড়ে আছে।’
ডিনার শুরুর আগে টিবস নিজের তৈরি ওয়াইনের একটি মিশ্রণ পরিবেশন করতেন। যে কারণে খালি বোতলগুলি সাইডবোর্ডে রেখে দিতেন তিনি। সাইডবোর্ডে একটি লাফাইট ’৪৫ সবাইকে দেখানোর জন্য রাখা ছিল।
‘স্যার আপনি যে মদ পান করছেন...,’ খানসামা শান্তভাবে বললেন, ‘সেটা ছিল সস্তা দুর্গন্ধযুক্ত স্প্যানিশ রেড।’
মিস্টার ক্লিভার তার গ্লাসে রাখা ওয়াইনের দিকে একবার, আরেকবার খানসামার দিকে তাকাচ্ছিলেন। রাগে তার মুখ লাল। ‘তুমি মিথ্যা বলছ টিবস।’
উত্তরে টিবস বলল, ‘না স্যার, আমি মিথ্যা বলছি না। আসলে এখানে কাজ নেবার পরে স্প্যানিশ রেড ছাড়া অন্য কোনো মদ আপনাকে কখনো পরিবেশন করিনি। কারণ, আমি জানতাম- আপনি ওয়াইনের পার্থক্য বুঝতে পারবেন না।’
‘আমি তোকে বিশ্বাস করি না।’ মিস্টার ক্লিভার অতিথিদের ওপর চোখ বুলিয়ে খানসামার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘তুই একটা মিথ্যাবাদী। তুই নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছিস।’
‘দুর্দান্ত মদ।’ মিস্টার ক্লিভারের কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘এই ধরনের মদ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পান করতে হয়। রাতের খাবারের আগে তিন চারটে ককটেল পান করলে এমনিতে খাবারের রুচি নষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি আপনি প্রত্যেকটি খাবারে ভিনেগার মেশান তো সব শেষ। তখন মনে হবে আপনি ওয়াইনের পরিবর্তে কলের পানি খাচ্ছেন।’
টেবিলের চারপাশে দশটি ক্ষুব্ধ মুখ খানসামার দিকে তাকিয়ে আছে। টিবস হতচ্ছাড়া তাদের রাগে দিশেহারা করে ফেলেছে। রীতিমতো বাকরুদ্ধ তারা।
‘এটা দেখেন।’ খানসামা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ভালোবেসে যেন ছুঁয়ে দিল খালি বোতলগুলির একটিকে, ‘লাফাইট ৪৫-এর শেষ বোতল এটি। ঊনত্রিশ বোতল ইতিমধ্যে উদরপূর্তি করেছি আমরা। আমরা মানে মঁশিয়ে এস্ট্রাগন ও আমি খুবই উপভোগ করেছি পানীয়গুলি। আসলে উপভোগ করার মতোই উচুঁমানের স্বাদ তাদের। টাকা থাকলেই সেই স্বাদ বোঝা যায় না।’
কথা শেষ করে খানসামা হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হলরুম অতিক্রম করে বাড়ির দরজা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পা রাখল। মঁশিয়ে এস্ট্রাগন সেখানে দুজনের দুই স্যুটকেস গাড়িতে নিয়ে রওনা দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল।
*
রোয়াল্ড ডাল (১৯১৬-১৯৯০) একজন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি। তিনি ওয়েলসে এক ধনী নরওয়েজিয়ান অভিবাসী পিতামাতার গৃহে জন্ম নেন; এবং বেশিরভাগ সময় ইংল্যান্ডে কাটান। তিনি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় রয়েল এয়ারফোর্সে পাইলটের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন বীর যোদ্ধা। ১৯৪০ সালে তিনি সর্বাধিক বিক্রিত লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাকে “বিশ শতকের অন্যতম সেরা শিশুতোষ লেখক” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।