alt

সাময়িকী

‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’

মুষলধারে বর্ষিত, সাবলীল সহজিয়া উচ্চারণ

ওবায়েদ আকাশ

: মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১

‘ভেঙে যাচ্ছে সব কিছু / মানুষ ভাঙছে / বিষণ্নতার কঠিন আঘাতে।’ আর এই ভেঙে পড়া মানুষেরা নির্মাণ করছেন শিল্পের অম্লান সৌধ। পড়ে যেতে হয় গতায়ু ঝরনাধারার মতো, ভেঙে যেতে হয় বজ্রপাতের মতো। তারপর বেরিয়ে আসে বিদ্যুচ্চমকের মতো শিল্পের আভাস। আর তা-ই একদিন ঝুলে থাকে আকাশে, নক্ষত্রলোকে। তার সরল সমীকরণে বলা যায় সুখের জন্য শিল্প নয়, কিংবা শিল্পের জন্য নয় সুখ। শিল্প শুধু আনন্দ সৃষ্টি করে, তা যেমন বিষাদের তেমনি হরষের। এই আনন্দ শাশ্বত, অমলিন। এর স্থায়িত্ব বুদ্বুদের মতো নয়। কঠিন শিলাস্তম্ভের মতো কিংবা হিমালয়ের মতো, দৃঢ়।

কবিতা এমনই এক শিল্প, কিংবা শিল্প এমনই এক কবিতা যা সত্যানুষঙ্গে মানুষের ব্যথিত হৃদয়ের নির্যাস। কিন্তু কোনো কোনো আনন্দানুভূতিও কবিতায় প্রকাশিত হয়। তা ক্ষণিকের এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ক্ষণস্থায়ী গর্জমান।

প্রকৃত কবিতা রচিত হয় অনেক বিষাদ, অজস্র ক্ষয়, অভাবিত বিয়োগব্যথার ভিতর থেকে সংগ্রামী অঙ্কুরোদ্গমের মাধ্যমে।

আমরা সামান্য আনন্দ পেলে বিষাদকে ভুলে যাই। এই হচ্ছে প্রকৃত মানবপ্রকৃতি। আবার অগাধ ব্যথার ভিতর দিয়েও পুলকের আনন্দ উঁকি দিতে দেখি। এ বড় অদ্ভুত রসায়ন। কবি আবুল হাসান তাই বলেছিলেন শেষ পর্যন্ত মিলনই মৌলিক। এ মৌলিকত্ব শুধু সাধারণ পাঠকের জন্য।

কিন্তু কবির মৌলিকত্ব বস্তুত বিরহের চাষাবাদে। তার কাছে বিচ্ছিন্নতাই শিল্পের অকাট মানদ-। শূন্য দশকের শক্তিমান কবি আদিত্য নজরুল এ কথা যে এতটা আগেভাগেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তা তার প্রকৃত কবিসত্তাকে শনাক্ত করে। তার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ এমনই একটি কাব্যগ্রন্থ যা পাঠককে বিষাদের সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে শেখাবে। দুঃখের তিমিরে আনন্দের সাম্পানে ঘোরাবে। আর পাঠক খুঁজে পাবেন যে, জীবনে যন্ত্রণা থাকবে, বিষ থাকবে, দুঃখ থাকবে- তবু জীবন আনন্দময়। যা তার বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে। স্বপ্ন দেখতে শেখায়।

এ গ্রন্থের তার প্রথম কবিতাটিই পাঠককে যারপরনাই ভাবতে শেখাবে।

‘ধরো, আজ থেকে-
সঙ্গত কারণে
তোমাদের সুখি সংসারে
আমি এক কীর্তিমান লাশ!

কী করে বল তো
তোমাদের সুখের সংসারে যাবো!’
[সন্তপ্ত কুসুম, পৃ: ৯]

কবি সুখের সংসার ত্যাগ করে চিরআড়ালে চলে যাবেন। কিন্তু তিনি জানেন সব জায়গার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, যা তাকে সেখানে ঠাঁই দিতে বাধ্য করে। তাকে বঞ্চিত করে না। সেই আড়ালেরও যে সৌন্দর্য আছে, তা কবি দুঃখের ভেতর দিয়ে ঘোষণা করেন। মানুষ সুখের সংসার ছেড়ে যেখানে যায়, সেটাও মূলত এক নিরাভরণ সংসার। সে সংসারের কি সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা নেই? মূলত মানুষ পৃথিবীতে যেমন আসে, তেমনি স্থান পরিবর্তন করে আবার চলে যায়। এ এক অভাবনীয় নিয়তি। এ এক তির্যক রোমান্টিকতা।

আবার আদিত্য নজরুল যখন প্রবল আনন্দের ঘোষণা দিচ্ছেন- সেখানেও তিনি কান্নার প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন। বলছেন-

‘নবজাতকের কান্নাতুল্য
এতো বড় প্রাপ্তি
পৃথিবীতে একটিও নেই।

তবু কেন আমি
কান্না চেপে নিজেকে এতোটা
অসহায় করে তুলি।’
[আশা, পৃ: ১৭]

কান্নার অবদমন কবি সহ্য করেন না। তিনি কেঁদে কেঁদে মূলত আনন্দাশ্রুই ঝরাতে চান। কান্নার তরীতে ভর দিয়ে আরেক আনন্দসঙ্গমে ডুবে যেতে চান।

কবি আদিত্য নজরুলের কবিতার আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি এই গ্রাম বাংলার মাটিনিসৃত একজন সহজিয়া প্রকরণের কবি। তার কবিতায় হারানো শৈশব, রূপকথা, কল্পকথা, গ্রামীণ মিথ, গ্রামপ্রকৃতির বিবিধ অনুষঙ্গ অনায়াসে শৈল্পিক ডানায় ঢুকে পড়ে। বলছেন-

‘কী করছো মানুষ?
বাউলের কাছে পাঠ নিচ্ছি
কী করে অন্তর বাজাতে হয়।’
[উপস্থাপক, পৃ: ১২]

মানুষের নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের কথায় কবির ভিন্নতর ভাবনা পাঠককে ভাবিত করে। মানুষের অধিকারের মূল্য কবির কাছে সর্বাগ্রে গ্রাহ্য। তেমনি প্রকৃতিতে বাস করে নদী, নদীতে ঘিরে থাকে কতনা প্রাণিজগত।

‘নদীর তীরে বাস করে যে
পানকৌড়ি, মাছরাঙা প্রাজতির নাগরিক
নদীর মৃত্যুতে তারা কাঁদে।

নদীর বুকের স্পন্দনের মতো
গণতন্ত্র বয়ে যায়
ঢেউয়ের কুলুধ্বনি তুলে

স্বদেশের বাঁকে বাঁকে।’
[নাগরিক অধিকার, পৃ: ৫০]

সমকালীন নাগরিক ক্ষুধায় মরে যাচ্ছে নদী। অসহায় হয়ে পড়েছে নদীবর্তী অসহায় প্রাণিজগত। কবিকে তাই ব্যথিত করে। এই ব্যথাকে আবার তিনি গণতন্ত্রের ব্যথার সঙ্গে মিলিয়ে এক মহার্ঘ শিল্প রচনা করেন। যার নাম কবিতা।

কবি আদিত্য নজরুলের কবিতার উচ্চারণ টানটান, ঋজু। মেদহীন জীবন থেকে তুলে নেয়া তার কবিতার ভাষা নিজস্ব ও সহজাত।

তার উচ্চারণের সাবলীলতা পাঠক হৃদয় তরঙ্গায়িত করে।

১.
তোমার চোখের নিচে
ঘাস ফরিঙের চঞ্চলতা নিয়ে
নাচানাচি করে যাচ্ছে ক্লান্তি।
[চিরন্তন, পৃ: ২৮]

২.
এবার বিজ্ঞের গম্ভীরতা নিয়ে
বললে- ভালোই তো হবে
ফুলস্টপগুলো ব্যবহার করে
আমাদের অসহায়ত্বগুলো চিরকালের জন্য থামিয়ে রাখবো।
[সম্মুখীন, পৃ: ৩৯]

৩.
মাথা নিচু করে বাঁচা যায়
বাদুড়তলা না গেলে

হয়তো বিশ্বাস হতো না।
[পুঁজিবাদ, পৃ: ৪১]

৪.
লজ্জা এবং সৌন্দর্য
চিরায়ত মূল্যবান এ সম্পদ
যারা ঢেকে রাখো
আমি সে দলেরই লোক।
[পরিধেয়, পৃ: ৬৮]

৫.
দূরত্ব ছড়িয়ে রাখো...
দূরে যেতে যেতে
পাহাড়ও বিন্দুতে রূপান্তরিত হয়।
দূরত্বে থাকলে তোমার চিন্তায় ঘুম আসে না কেন?
[এক ঠাঁই, পৃ: ৭৫]

সমগ্র গ্রন্থে আদিত্যর কণ্ঠস্বর থেকে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিসকল পাঠককে তার স্বাতন্ত্র্য বিবেচনায় ধারণা দেবে। ভাবতে শেখাবে তার চিন্তার জগত-অধিজগত।

আদিত্য নজরুল তার সময়ের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ধারার একজন সক্রিয় কবিতাকর্মী। তিনি প্রচুর লেখেন, প্রচুর ভাবেন। মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে ভাবি, তিনি এতটা কীভাবে পারেন। আসলে সৃজনশীলদের ক্ষমতা দুরকমের, কেউ বেশি লিখে ভালো লেখেন আবার কেউ কম লিখে ভালো লেখেন। আবার এর বিপরীত চিত্রও চোখে পড়ে। তবে আদিত্য নজরুল প্রথম কাতারের একজন। তার কবিতাই এর জাজ্বল্য উদাহরণ।

‘কথা হচ্ছে মুষলধারে।/ বেশ শোরগোল করে / কথা হচ্ছিলো রাস্তার দোকানে।’ এমনি এক শোরগোলের মধ্যে নিজে থেকেই আদিত্য নজরুলের ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ বইটি সম্পর্কে লেখার আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। বিলম্বে হলেও সেই আগ্রহ আজ পূর্ণ হলো।

দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে ॥ আদিত্য নজরুল ॥ প্রকাশক: পরিবার পাবলিকেশনস, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০২১ ॥ প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মৌমিতা রহমান ॥ মূল্য : ৩৬০ টাকা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’

মুষলধারে বর্ষিত, সাবলীল সহজিয়া উচ্চারণ

ওবায়েদ আকাশ

মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১

‘ভেঙে যাচ্ছে সব কিছু / মানুষ ভাঙছে / বিষণ্নতার কঠিন আঘাতে।’ আর এই ভেঙে পড়া মানুষেরা নির্মাণ করছেন শিল্পের অম্লান সৌধ। পড়ে যেতে হয় গতায়ু ঝরনাধারার মতো, ভেঙে যেতে হয় বজ্রপাতের মতো। তারপর বেরিয়ে আসে বিদ্যুচ্চমকের মতো শিল্পের আভাস। আর তা-ই একদিন ঝুলে থাকে আকাশে, নক্ষত্রলোকে। তার সরল সমীকরণে বলা যায় সুখের জন্য শিল্প নয়, কিংবা শিল্পের জন্য নয় সুখ। শিল্প শুধু আনন্দ সৃষ্টি করে, তা যেমন বিষাদের তেমনি হরষের। এই আনন্দ শাশ্বত, অমলিন। এর স্থায়িত্ব বুদ্বুদের মতো নয়। কঠিন শিলাস্তম্ভের মতো কিংবা হিমালয়ের মতো, দৃঢ়।

কবিতা এমনই এক শিল্প, কিংবা শিল্প এমনই এক কবিতা যা সত্যানুষঙ্গে মানুষের ব্যথিত হৃদয়ের নির্যাস। কিন্তু কোনো কোনো আনন্দানুভূতিও কবিতায় প্রকাশিত হয়। তা ক্ষণিকের এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ক্ষণস্থায়ী গর্জমান।

প্রকৃত কবিতা রচিত হয় অনেক বিষাদ, অজস্র ক্ষয়, অভাবিত বিয়োগব্যথার ভিতর থেকে সংগ্রামী অঙ্কুরোদ্গমের মাধ্যমে।

আমরা সামান্য আনন্দ পেলে বিষাদকে ভুলে যাই। এই হচ্ছে প্রকৃত মানবপ্রকৃতি। আবার অগাধ ব্যথার ভিতর দিয়েও পুলকের আনন্দ উঁকি দিতে দেখি। এ বড় অদ্ভুত রসায়ন। কবি আবুল হাসান তাই বলেছিলেন শেষ পর্যন্ত মিলনই মৌলিক। এ মৌলিকত্ব শুধু সাধারণ পাঠকের জন্য।

কিন্তু কবির মৌলিকত্ব বস্তুত বিরহের চাষাবাদে। তার কাছে বিচ্ছিন্নতাই শিল্পের অকাট মানদ-। শূন্য দশকের শক্তিমান কবি আদিত্য নজরুল এ কথা যে এতটা আগেভাগেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তা তার প্রকৃত কবিসত্তাকে শনাক্ত করে। তার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ এমনই একটি কাব্যগ্রন্থ যা পাঠককে বিষাদের সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে শেখাবে। দুঃখের তিমিরে আনন্দের সাম্পানে ঘোরাবে। আর পাঠক খুঁজে পাবেন যে, জীবনে যন্ত্রণা থাকবে, বিষ থাকবে, দুঃখ থাকবে- তবু জীবন আনন্দময়। যা তার বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে। স্বপ্ন দেখতে শেখায়।

এ গ্রন্থের তার প্রথম কবিতাটিই পাঠককে যারপরনাই ভাবতে শেখাবে।

‘ধরো, আজ থেকে-
সঙ্গত কারণে
তোমাদের সুখি সংসারে
আমি এক কীর্তিমান লাশ!

কী করে বল তো
তোমাদের সুখের সংসারে যাবো!’
[সন্তপ্ত কুসুম, পৃ: ৯]

কবি সুখের সংসার ত্যাগ করে চিরআড়ালে চলে যাবেন। কিন্তু তিনি জানেন সব জায়গার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, যা তাকে সেখানে ঠাঁই দিতে বাধ্য করে। তাকে বঞ্চিত করে না। সেই আড়ালেরও যে সৌন্দর্য আছে, তা কবি দুঃখের ভেতর দিয়ে ঘোষণা করেন। মানুষ সুখের সংসার ছেড়ে যেখানে যায়, সেটাও মূলত এক নিরাভরণ সংসার। সে সংসারের কি সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা নেই? মূলত মানুষ পৃথিবীতে যেমন আসে, তেমনি স্থান পরিবর্তন করে আবার চলে যায়। এ এক অভাবনীয় নিয়তি। এ এক তির্যক রোমান্টিকতা।

আবার আদিত্য নজরুল যখন প্রবল আনন্দের ঘোষণা দিচ্ছেন- সেখানেও তিনি কান্নার প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন। বলছেন-

‘নবজাতকের কান্নাতুল্য
এতো বড় প্রাপ্তি
পৃথিবীতে একটিও নেই।

তবু কেন আমি
কান্না চেপে নিজেকে এতোটা
অসহায় করে তুলি।’
[আশা, পৃ: ১৭]

কান্নার অবদমন কবি সহ্য করেন না। তিনি কেঁদে কেঁদে মূলত আনন্দাশ্রুই ঝরাতে চান। কান্নার তরীতে ভর দিয়ে আরেক আনন্দসঙ্গমে ডুবে যেতে চান।

কবি আদিত্য নজরুলের কবিতার আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি এই গ্রাম বাংলার মাটিনিসৃত একজন সহজিয়া প্রকরণের কবি। তার কবিতায় হারানো শৈশব, রূপকথা, কল্পকথা, গ্রামীণ মিথ, গ্রামপ্রকৃতির বিবিধ অনুষঙ্গ অনায়াসে শৈল্পিক ডানায় ঢুকে পড়ে। বলছেন-

‘কী করছো মানুষ?
বাউলের কাছে পাঠ নিচ্ছি
কী করে অন্তর বাজাতে হয়।’
[উপস্থাপক, পৃ: ১২]

মানুষের নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের কথায় কবির ভিন্নতর ভাবনা পাঠককে ভাবিত করে। মানুষের অধিকারের মূল্য কবির কাছে সর্বাগ্রে গ্রাহ্য। তেমনি প্রকৃতিতে বাস করে নদী, নদীতে ঘিরে থাকে কতনা প্রাণিজগত।

‘নদীর তীরে বাস করে যে
পানকৌড়ি, মাছরাঙা প্রাজতির নাগরিক
নদীর মৃত্যুতে তারা কাঁদে।

নদীর বুকের স্পন্দনের মতো
গণতন্ত্র বয়ে যায়
ঢেউয়ের কুলুধ্বনি তুলে

স্বদেশের বাঁকে বাঁকে।’
[নাগরিক অধিকার, পৃ: ৫০]

সমকালীন নাগরিক ক্ষুধায় মরে যাচ্ছে নদী। অসহায় হয়ে পড়েছে নদীবর্তী অসহায় প্রাণিজগত। কবিকে তাই ব্যথিত করে। এই ব্যথাকে আবার তিনি গণতন্ত্রের ব্যথার সঙ্গে মিলিয়ে এক মহার্ঘ শিল্প রচনা করেন। যার নাম কবিতা।

কবি আদিত্য নজরুলের কবিতার উচ্চারণ টানটান, ঋজু। মেদহীন জীবন থেকে তুলে নেয়া তার কবিতার ভাষা নিজস্ব ও সহজাত।

তার উচ্চারণের সাবলীলতা পাঠক হৃদয় তরঙ্গায়িত করে।

১.
তোমার চোখের নিচে
ঘাস ফরিঙের চঞ্চলতা নিয়ে
নাচানাচি করে যাচ্ছে ক্লান্তি।
[চিরন্তন, পৃ: ২৮]

২.
এবার বিজ্ঞের গম্ভীরতা নিয়ে
বললে- ভালোই তো হবে
ফুলস্টপগুলো ব্যবহার করে
আমাদের অসহায়ত্বগুলো চিরকালের জন্য থামিয়ে রাখবো।
[সম্মুখীন, পৃ: ৩৯]

৩.
মাথা নিচু করে বাঁচা যায়
বাদুড়তলা না গেলে

হয়তো বিশ্বাস হতো না।
[পুঁজিবাদ, পৃ: ৪১]

৪.
লজ্জা এবং সৌন্দর্য
চিরায়ত মূল্যবান এ সম্পদ
যারা ঢেকে রাখো
আমি সে দলেরই লোক।
[পরিধেয়, পৃ: ৬৮]

৫.
দূরত্ব ছড়িয়ে রাখো...
দূরে যেতে যেতে
পাহাড়ও বিন্দুতে রূপান্তরিত হয়।
দূরত্বে থাকলে তোমার চিন্তায় ঘুম আসে না কেন?
[এক ঠাঁই, পৃ: ৭৫]

সমগ্র গ্রন্থে আদিত্যর কণ্ঠস্বর থেকে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিসকল পাঠককে তার স্বাতন্ত্র্য বিবেচনায় ধারণা দেবে। ভাবতে শেখাবে তার চিন্তার জগত-অধিজগত।

আদিত্য নজরুল তার সময়ের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ধারার একজন সক্রিয় কবিতাকর্মী। তিনি প্রচুর লেখেন, প্রচুর ভাবেন। মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে ভাবি, তিনি এতটা কীভাবে পারেন। আসলে সৃজনশীলদের ক্ষমতা দুরকমের, কেউ বেশি লিখে ভালো লেখেন আবার কেউ কম লিখে ভালো লেখেন। আবার এর বিপরীত চিত্রও চোখে পড়ে। তবে আদিত্য নজরুল প্রথম কাতারের একজন। তার কবিতাই এর জাজ্বল্য উদাহরণ।

‘কথা হচ্ছে মুষলধারে।/ বেশ শোরগোল করে / কথা হচ্ছিলো রাস্তার দোকানে।’ এমনি এক শোরগোলের মধ্যে নিজে থেকেই আদিত্য নজরুলের ‘দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে’ বইটি সম্পর্কে লেখার আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। বিলম্বে হলেও সেই আগ্রহ আজ পূর্ণ হলো।

দুঃখ পেলে পাথরও কাঁদে ॥ আদিত্য নজরুল ॥ প্রকাশক: পরিবার পাবলিকেশনস, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০২১ ॥ প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মৌমিতা রহমান ॥ মূল্য : ৩৬০ টাকা।

back to top