alt

সাময়িকী

নাগরিকতাকে অতিক্রম করে মানুষের কবি হয়ে ওঠা

গৌতম রায়

: শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১

ডান দিক থেকে-শামসুর রাহমান, অন্নদাশঙ্কর রায় ও লেখক

সমকালীনতার বুকে শামসুর রাহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তাঁর সৃষ্টির মতোই স্বচ্ছ ছিল তাঁর গোটা জীবনটা। সমকালীন, অনুজ বা আগের প্রজন্মের কারো প্রতিই কবি কখনো মনের কোনো কখনো এতোটুকু বিদ্বেষ জমতে দেখনি। তাঁর সমকালীন একপশ্চিমবঙ্গীয় কবি মুখে মধু হৃদয়ে ক্ষুর নিয়ে সমকালীন স্রষ্ঠাদের ভাতে মেরে তাঁদের সৃষ্টিকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। জানি না, এপার বাংলায় শামসুরের বই তাঁর জীবিতাবস্থাতেও অমিল থাকার পিছনে সেই মানুষটির কোনো অদৃশ্য হাত ছিল কি না!! কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন একাধিকবার শামসুরকে করে দেখেছি, একটি ব্যক্তি বিদ্বেষ সূচক শব্দ কখনো তিনি বলেন নি। এমনকি আল মাহমুদকে ঘিরেও কখনো তাঁকে একটা অমর্যাদা সূচক কথা বলতে শুনি নি।

চটকদারি জানতেন না তিনি। তৈলমর্দনও নয়। আর কখনো আপোস করতে শেখেননি সমকালের অনেকেরই মতো। তাই জাগতিক বৈভবের ঠাঁট তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি। আর সেই না পারা থেকেই কবিতা-সৃষ্টির-মেরুদণ্ডের এক অদৃশ্য জ্যোতির্বলয়ে আবৃত থেকেছেন শামসুর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

এপার বাংলার সঙ্গে শামসুরের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এপার ওপার, দুইপার ছাপানো বাঙালি জীবনানন্দ আর অন্নদাশঙ্কর ছিলেন প্রধান সেতুবন্ধন। ইস্কুল জীবনে শিশুকালের নানা মজাদার আবার কখনো বিষণ্নতা মাখানো অনুভূতি মাহুতটুলির বাচ্চুর মননলোকের উদ্ভাসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যখন হঠাৎই শিশু শামসুরের ইস্কুল পরিম-লে নাম হয়ে গিয়েছিল, ‘চিন্তাহরণের জামাই’, তখনকার মজাদার পরিবেশেই শামসুর ইস্কুলের জল খাওয়ার জায়গায় জাত-ধর্মের উপর জলের গেলাসের ঠাঁই দেখে চমকে উঠেছিলেন। ইস্কুল শিক্ষক চিন্তাহরণ বাবুর কোনো কন্যা ছিল কিনা, জানা না থাকলেও, চিন্তাহরণের জামাই নামে শামসুরের ইস্কুল জীবনের নামকরণ তাঁকে বেশ মজাদার অভিব্যক্তির ভিতর দিয়েই জীবনকে বইয়ে নিয়ে চলার রসদ জুগিয়েছিল। আর তাই পুরান ঢাকার মুহররমের মিছিলের নাড়া; ‘এক নাড়া, দো নাড়া, বোলো বোলো ভিস্তা’র জনরব আর জন্মাষ্টমীর মিছিলের একটা ভিন্নস্বাদ- এইসবই হয়তো কেবলমাত্র নাগরিক সত্তায় আবদ্ধ না থেকে, ছন্দের নিত্যনতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত না করে সর্বার্থে ‘মানুষের কবি’তে উত্তরিত করেছিল শামসুর রাহমানকে।

এপার বাংলার সঙ্গে শামসুরের প্রত্যক্ষ সংযোগের সূচনা অন্নদাশঙ্করের হাত ধরে ’৫৩ সালে শান্তিনিকেতনের ‘সাহিত্য মেলা’র ভিতর দিয়ে। দেশভাগের নিদারুণ যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট ছিলেন অন্নদাশঙ্কর। বাংলা ও বাঙালির বিভাজন তাঁর বুককে ফালাফালা করে দিয়েছিল। সেই বেদনাবিহ্বল ক্ষতে যেন একটু হলেও পূর্ণতার প্রলেপ দিয়েছিল ’৫২’র মহান ভাষা আন্দোলন। সেই সাহিত্যমেলায় অন্নদাশঙ্করের আমন্ত্রণে এসে এপার বাংলার কবিতাভুবনের কুশীলবদের সঙ্গে ব্যক্তি পরিচয়ের যে সূচনা হয়েছিল কবির, আমৃত্যু তা বজায় ছিল। সেদানের তরুণ শামসুর ছুটে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে। তরুণ শামসুরের যে প্রাণবন্ত ছবি প্রৌঢ় বুদ্ধদেবকে কতোখানি আপ্লুত করেছিল তা জীবন উপান্তেও ভুলতে পারেন প্রতিভা বসু।

রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করবার যে সুউচ্চ মেরুদণ্ডের পরিচয় শামসুর সারা জীবন ধরে দিয়ে গিয়েছেন, দুই বাংলার কবিতা জগতে তার তুলনা মেলা দুষ্কর। শামসুরের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে একমাত্র তুলনা চলে সুফিয়া কামালের

শামসুরের জীবনের প্রায় শেষপর্বে এপার বাংলা থেকে, এই নিবন্ধকারের সম্পাদিত কবিতা সংগ্রহ, গদ্য সংগ্রহ (পুনশ্চ) প্রকাশের আগে উচ্ছ্বসিত প্রতিভা বসু মুখর ছিলেন সেই ’৫৩ সালে শামসুরকে প্রথম দেখা এবং সেই সময় থেকে ধারাবাহিক ভাবে তাঁর কবিতা, গদ্য পাঠের স্মৃতি রোমান্থনে। ঢাকার মেয়ে প্রতিভার, মাহুতটুলির শামসুরের প্রতি একটা ‘দ্যাশের টান’ ছিল। সেই সঙ্গে ছিল ভারতীয় মিথলজি ঘিরে শামসুরের প্রবল উৎসাহ ঘিরে একটা অন্য রকমের অনুভূতি। প্রতিভা বলেছিলেন মহাকাব্যিক মিথলজি ঘিরে আমার নিজের উৎসাহ, শামসুরের লোকজ মিথলজি ঘিরে উৎসাহের দ্বারা অনেকখানি সজীব হয়েছিল। প্রতিভার মনে হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান, দুই ধর্মের লোকজ মিথলজিকে আত্মস্থ করার ভিতর দিয়েই শামসুরের সৃষ্টিতে এবং সার্বিক মননলোকে বিশ্বমানবতার জয়ের উদ্ভাসনের গতিমুখ আরো অনেক বেশি পরিপক্ব হয়েছে। প্রতিভা বসু একটু মজা করেই বলেছিলেন- আমি ‘মহাভারতের মহাকাব্য’ লিখবার আগে বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা’ পড়ি নি। না পড়বার কারণ; পাছে প্রভাবিত হয়ে যাই। কিন্তু বাংলার মঙ্গলকাব্য, বিশেষ করে মনসা মঙ্গলের চাঁদ সদগর, হেতালের লাঠি (চাঁদ সদাগর, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ- কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত)- এইসব নিয়ে সময়ের প্রেক্ষিতের সঙ্গে অদ্ভুত সাযুজ্য নির্মাণে রচিত শামসুরের কবিতা, আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল নতুন প্রেক্ষিতে দুর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদি মহাভারতের চরিত্রগুলির বিশ্লেষণে।

এই যে আত্মিক সংযোগ- এটাকে জীবন দিয়ে মর্যাদা দিতেন শামসুর। বুদ্ধদেব বসুর প্রতি নিজের প্রদ্ধাকে প্রতিবাহিত করতে কলকাতায় এসে একাধিকবার ছুটে গিয়েছেন বুদ্ধদেবের ছোট মেয়ে দময়ন্তী বসু সিং, আমাদের রুমিদির বাসায়। রুমিদির ব্যক্তি জীবনের নানা ওঠাপড়াতেও পরমাত্মীয়ের মতো পরামর্শ দিয়েছেন শামসুর। রুমিদি যখন ‘বিকল্প’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা খোলেন, তখন তাঁকে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার বিশেষ বিশেষ সংখ্যাগুলির ফ্যাক্সিমিলি এডিশন করবার যাঁরা যাঁরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের ভিতরে অন্যতম ছিলেন শামসুর রাহমান।

খ-িত বাঙালি- এই চেতনাকে একদিনের জন্যে প্রশ্রয় দেননি শামসুর। অখ- বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভূমিকা এবং অবদানের কথা শামসুর রাহমান সব সময়েই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন। শামসুর রাহমান কলকাতায় এসেছেন, আর অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর ফ্ল্যাটে যান নি- এমনটা বোধহয় কখনোই ঘটেনি। আবার শামসুরকে ঘিরে কোনো খবর পেয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে কবির কুশল জানতে চাননি অন্নদাশঙ্কর তেমনটাও কখনো হয় নি। নয়ের দশকের শেষের দিকে কবির বাসায়, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ চালায় ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা। একটু রাতের দিকে খবরটা পাই। অন্নদাশঙ্করকে তখনই জানাই। উনি বলেন; তুমি এক্ষুনি চলে এসো। ফোনে ধরে দাও শামসুরকে। আমি ওঁর সাথে কথা না বলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব না।

রাতেই ছুটে গেলাম অন্নদাশঙ্করের কাছে। সেই সময়ে আই এস ডি কলে সংযোগ পাওয়া খুব সহজ ছিল না। রাত প্রায় দেড়টা পর্যন্ত চেষ্টা করে সংযোগ পাওয়া গেল। এই এতোটা রাত পর্যন্ত নব্বই উত্তীর্ণ অন্নদাশঙ্কর ঠায় বসে আছেন টেলিফোন সেটের কাছে। সংযোগ পাওয়ার পর তিনি শামসুরকে বললেন; আমি হাসিনাকে নিজে বলছি তোমার নিরাপত্তা ঘিরে। তবে আপোস কখনো তুমি করবে না- সেটা জেনেও বলছি, খুব সাবধানে থেকো।

এত রাতে পিতৃপ্রতিম অন্নদাশঙ্করের কাছ থেকে এমন টেলিফোন, এমন আশ্বাস- আবেগ চেপে রাখতে পারেন নি কবি। অন্নদাশঙ্কর ফোন ছাড়বার পর যখন কথা বলছিলাম, কবির কণ্ঠ ছিল বাষ্পরুদ্ধ। পরের দিন সকালে বহুক্ষণের চেষ্টায় টেলিফোনে ধরা সম্ভব হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অন্নদাশঙ্করের শামসুরকে ঘিরে উদ্বেগকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা সেদিন টেলিফোনে কবির নিরাপত্তার জন্যে ইতিমধ্যেই কি ধরনের সতর্কতা নেওয়া হয়েছে, বিস্তারিত জানালেন।

এই যে আত্মার আত্মীয়তার ভূগোল নির্মাণ, যেখানে কোনো সীমান্ত নেই, নেই কাঁটাতার- তার ভিত্তি নির্মাণে নিজের ব্যক্তিত্বের একটা অনিন্দ্যসুন্দর গঠনশৈলিকে প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন কবি। অন্নদাশঙ্করের শেষবারের ঢাকা সফরের উদ্যোগের ক্ষেত্রেও সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী আর শামসুর রাহমানের ভূমিকা ছিল মুখ্য। অন্নদাশঙ্করের সেবার খুব ইচ্ছে ছিল কবিজননীর হাতের রান্না খাওয়ার। কবি জননী ও বয়সকে উপেক্ষা করে নিজের হাতে রেঁধেছিলেন অন্নদাশঙ্করের জন্যে। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সফর, কিছু সরকারী কর্মসূচির জন্যে কবি আবাসে যাওয়া সম্ভব হয় নি অন্নদাশঙ্করের। কিন্তু শামসুর নিজে মায়ের হাতের সেই রান্না সেইসময়ের হোটেল শেরাটনে পৌঁছে দিয়েছিলেন অন্নদাশঙ্করের কাছে। বড় তৃপ্তি সহকারে কবি জননীর নিজের হাতে রাঁধা নানা সুখাদ্য খেয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর।

অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে যেমন কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় নাম লেখান নি শামসুর, তেমনই কখনোই তিনি সময়ের গতিমুখ বিচার করে, বিশ্লেষণ করে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করেননি। মানবতার প্রশ্নে কখনো কোনো রকম দোদুল্যমানতায় ভাসেননি আবার সমকালে দুই বাংলারই অনেক কবি, সাহিত্যিকের মতোই হিসেব কষে, জল মেপে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করেননি। অকপটে সাদাকে ‘সাদা’ বলেছেন। কখনো ‘কালো’কে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে নিজের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করেন নি।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-উত্তরযুগে বাংলা কবিতার জগতে শামসুরের মতো স্পষ্টবাক কবি তাঁর সমকালে একজনও ছিলেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষ আনন্দবাজারকে কখনো ছাপিয়ে, অতিক্রম করে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। যতোখানি এক্তিয়ার তাঁকে আনন্দবাজার দিয়েছে, ঠিক ততোখানিই মুক্তবুদ্ধির জয়গান গেয়েছেন সুনীল। যতোখানি এগোলে নিজের এবং নিজের পরিম-লের কোনো ক্ষতি হবে না, ঠিক ততোখানিই বিদ্রোহী শঙ্খ ঘোষ।

কিন্তু এমন কোনো হিসেবি মাপকাঠির লক্ষণ রেখার ভিতরে একটি দিনের জন্যেও শামসুর নিজেকে বন্দি করেননি। সেই কারনে শঙ্খ ঘোষের কবিতার মতো ছন্দের মারপ্যাঁচের কোনো অনুবর্তন শামসুরের কবিতায় দেখা যায় না। শঙ্খ ছন্দ নিয়ে নিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা করে গিয়েছেন। সেই রকম কোনো নিরাপদ নি-িদ্র আবেষ্টনীর ভিতরে বসে শামসুর কবিতা লেখেননি। কবিতার ভাষা, ছন্দ, শৈলি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাও করেন নি। কবিতা লিখেই ছুটেছেন মিছিলে। মিছিল থেকে ফিরে ঘামে ভেজা শরীর নিয়েই ফিরেছেন কবিতার আশ্রয়ে। নিজেকে নিয়োজিত করেছেন ‘লানতের পঙতিমালা’ রচনায়। আবার হয়তো কবিতা লেখা শেষ করেই ছুটেছেন ঘটনাক্রমের শিকার কোনো মানুষের পাশে।

এই নিয়ত সমসাময়িকতাকে অবলম্বন করেই ছিল শামসুরের যাপনচিত্র। আর সেই যাপনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল তাঁর কবিতার সঙ্গে গেরস্তালি। শামসুর যখন লেখেন-

“বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে- কতিপয় লোক দেবদূতের নগ্নতা

বড়ো বেশি কাম্য ভেবে উন্মাদের মতো নগ্ন হয়ে যায়,

তরুণীর ওষ্ঠে বারবার চুমো খায় কর্কশ কঙ্কাল আর

লোহিত বনের ধারে পাথরের ঘোড়ায় সাওয়ার

অত্যন্ত পাথুরে যোদ্ধা, স্তব্ধ অস্ত্রে চির জ্যোৎস্না বয়।”

এই কবিতার রচনাকাল ১৯৭৭। মাহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে, ‘বন্দি শিবির থেকে’র রচয়িতার কলমে এই শব্দের আঁচর গুলি যখন বেরিয়ে আসছে, তখন বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত উত্তর বাংলাদেশ, শামসুরেরই ভাষায়, ‘বনপোড়া হরিণীর’ মতো আর্তনাদ করছে। সেদিনের সেই আর্তনাদ শুনে শামসুর কিন্তু কবিতার শৈলি নিয়ে সফেদ কাগজে আঁচড়ের পর আঁচড় কাটছেন, আর সেই আঁচলগুলিকে হিজিবিজি করে কলমের খোঁচায় ভরে দিয়ে, ছন্দের আরো গভীর দুরূহতায় আত্মনির্বাসন দিচ্ছেন- এমনটা একটিবারের জন্যেও করেন নি।

’৭৭ সালে বাংলাদেশের যে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিকায় ক্লান্ত-ক্ষুব্ধ কবি শামসুর এই উচ্চারণগুলি করেছিলেন, সেই উচ্চারণ কি আজ, ২০২১ সালের শরৎকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির হিংস্র শ্বাপনসস্কুল পদচারণার প্রেক্ষিতেও সমান প্রাসঙ্গিক নয়? এই কবিতা বা সমগোত্রীয় কবিতা যেগুলি হয়তো এটি রচনার ও কুড়ি, কুড়ি বছর আগে শামসুর রচনা করেছিলেন, বা কুড়ি কুড়ি বছর পরেও রচনা করেছেন, শেষ অসুস্থতার আগের দিন রাতে রচনা করেছেন- সেইসব। সৃষ্টির প্রেক্ষিত, আবেদন, মর্মার্থ অনুধাবন করলে মনে হয় না কি, গুজরাট থেকে দিল্লি গণহত্যা, আসাম থেকে কুমিল্লায় মানবতার টুটি টিপে ধরা দেখতে দেখতে ক্লান্ত, বিষণ্ন অথচ আত্মশক্তিতে ভরপুর কবি তাঁর ‘শ্যামলী’র বাসভবনে প্রিয় লেখার টেবিলে বসে, কাল রাতেই এইসব সৃষ্টি করেন নি?

শামসুর রাহমান কখনো আপোস করেন নি। জীবন-জীবিকা-যাপন-কবিতা, কোনোকিছুর সাথেই শামসুর রাহমান এক মুহূর্তের জন্যেও আপোস করেন নি। কবির এক বন্ধু, স্বনামধন্য কবি, আয়কর জনিত সমস্যায় জর্জরিত হয়েছিলেন। তিনি যে বৃহৎ সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই জরিমানার টাকা ইত্যাদি দিয়ে সেই কবিকে মুক্ত করেন। বিনিময়ে সেই পত্রিকাগোষ্ঠীর কাছে ওই কবিকে প্রায় নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গের অবতারণা করে একদিন শামসুর রাহমানকে প্রশ্ন করেছিলাম। ওঁর অকপট উক্তি ছিল; ভালো কবিতা লেখা ছাড়া, অর্থ-সম্মান-নারী-সামাজিক কৌলিন্য-সুরা-যশ, কোনো কিছুর প্রতি আমার লোভ নেই। বাঁচার জন্যে অর্থের প্রয়োজন। খেয়েপরে বেঁচে থাকলেই হলো। আর বাকি সবটাই আমার কবিতা। আরো ভালো কবিতা লেখার ইচ্ছে আর না লিখতে পারার কষ্ট- এর বাইরে কোনো ইহজাগতিক রশ্মি শামসুর রাহমানের জীবনকে কখনো একমুহূর্তের জন্যেও আবৃত করতে পারে নি।

তাই অফুরন্ত লিখেছেন কবি। কিন্তু সেই লেখা সমাজকে, সংস্কৃতিকে, সভ্যতাকে অনেক অনেক কিছু দিলেও কবিকে কখনো অর্থের প্রাচুর্যে নিমজ্জিত করেন। এই নিমজ্জন কবি নিজেও কখনো চান নি। ফলে দেশ বিদেশের নামীদামী পত্রিকা তাঁর কাছে কবিতা চাইলেও কবির যে অভিব্যক্তি ছিল, তেমনি অচেনা, অজানা কোনো মফস্বল বা অজপাড়া গাঁয়ের কবিতার কাগজের সম্পাদক তাঁর কাছে কবিতা চাইলেও সেই অভিব্যক্তি এতোটুকু অদলবদল দেখা যেতো না। কাউকে কখনো ফেরাতেন না শামসুর। ফলে তাঁর জীবিকার ক্ষেত্রে অর্থের প্রাচুর্য ছিল না। কিন্তু সেই না থাকাটাকে উপভোগ করতেও ছাড়তেন না। বলতেন- দেখেছো, অমুকের মতো খবরের কাগজের মালিকের হুকুমতামিলদারি আমাকে কখনো করতে হয় না!

রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করবার যে সুউচ্চ মেরুদণ্ডের পরিচয় শামসুর সারা জীবন ধরে দিয়ে গিয়েছেন, দুই বাংলার কবিতা জগতে তার তুলনা মেলা দুষ্কর। শামসুরের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে একমাত্র তুলনা চলে সুফিয়া কামালের। আর গদ্য সাহিত্যে অন্নদাশঙ্কর এবং কবীর চৌধুরীর। এই মেরুদ-ের ঋজুতার সঙ্গে এপার বাংলার কোনো কবিরই তুলনা টানা যায় না। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো উপায়ে বৃহৎ পুঁজি পরিচালিত সংবাদমাধ্যম বা রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে মাথা নুইয়ে বসে আছেন। এমনটা শামসুর কখনোই করেন নি। আর এটা না করবার জন্যেই শামসুর এবং তাঁর কবিতা কেবল বাংলা সাহিত্যের পরিম-লেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের আঙ্গিকেও এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। আর এই ব্যতিক্রম রচনার ক্ষেত্রেও শামসুরকে কখনো কৌশলী বা সাবধানী হতে দেখা যায় নি। কলকাতায় অকপটে প্রকাশ্য মঞ্চে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আড্ডা দিতেও যেমন তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তেমনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে অসুস্থ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিকিৎসা নিয়ে অনুরোধ করতেও দ্বিধা করেন নি, আবার সেই সময়ের শাসক সি পি আই (এম) এর সদর দপ্তর আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে গিয়ে আড্ডা জমাতেও পিছপা হননি।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

নাগরিকতাকে অতিক্রম করে মানুষের কবি হয়ে ওঠা

গৌতম রায়

ডান দিক থেকে-শামসুর রাহমান, অন্নদাশঙ্কর রায় ও লেখক

শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১

সমকালীনতার বুকে শামসুর রাহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তাঁর সৃষ্টির মতোই স্বচ্ছ ছিল তাঁর গোটা জীবনটা। সমকালীন, অনুজ বা আগের প্রজন্মের কারো প্রতিই কবি কখনো মনের কোনো কখনো এতোটুকু বিদ্বেষ জমতে দেখনি। তাঁর সমকালীন একপশ্চিমবঙ্গীয় কবি মুখে মধু হৃদয়ে ক্ষুর নিয়ে সমকালীন স্রষ্ঠাদের ভাতে মেরে তাঁদের সৃষ্টিকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। জানি না, এপার বাংলায় শামসুরের বই তাঁর জীবিতাবস্থাতেও অমিল থাকার পিছনে সেই মানুষটির কোনো অদৃশ্য হাত ছিল কি না!! কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন একাধিকবার শামসুরকে করে দেখেছি, একটি ব্যক্তি বিদ্বেষ সূচক শব্দ কখনো তিনি বলেন নি। এমনকি আল মাহমুদকে ঘিরেও কখনো তাঁকে একটা অমর্যাদা সূচক কথা বলতে শুনি নি।

চটকদারি জানতেন না তিনি। তৈলমর্দনও নয়। আর কখনো আপোস করতে শেখেননি সমকালের অনেকেরই মতো। তাই জাগতিক বৈভবের ঠাঁট তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি। আর সেই না পারা থেকেই কবিতা-সৃষ্টির-মেরুদণ্ডের এক অদৃশ্য জ্যোতির্বলয়ে আবৃত থেকেছেন শামসুর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

এপার বাংলার সঙ্গে শামসুরের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এপার ওপার, দুইপার ছাপানো বাঙালি জীবনানন্দ আর অন্নদাশঙ্কর ছিলেন প্রধান সেতুবন্ধন। ইস্কুল জীবনে শিশুকালের নানা মজাদার আবার কখনো বিষণ্নতা মাখানো অনুভূতি মাহুতটুলির বাচ্চুর মননলোকের উদ্ভাসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যখন হঠাৎই শিশু শামসুরের ইস্কুল পরিম-লে নাম হয়ে গিয়েছিল, ‘চিন্তাহরণের জামাই’, তখনকার মজাদার পরিবেশেই শামসুর ইস্কুলের জল খাওয়ার জায়গায় জাত-ধর্মের উপর জলের গেলাসের ঠাঁই দেখে চমকে উঠেছিলেন। ইস্কুল শিক্ষক চিন্তাহরণ বাবুর কোনো কন্যা ছিল কিনা, জানা না থাকলেও, চিন্তাহরণের জামাই নামে শামসুরের ইস্কুল জীবনের নামকরণ তাঁকে বেশ মজাদার অভিব্যক্তির ভিতর দিয়েই জীবনকে বইয়ে নিয়ে চলার রসদ জুগিয়েছিল। আর তাই পুরান ঢাকার মুহররমের মিছিলের নাড়া; ‘এক নাড়া, দো নাড়া, বোলো বোলো ভিস্তা’র জনরব আর জন্মাষ্টমীর মিছিলের একটা ভিন্নস্বাদ- এইসবই হয়তো কেবলমাত্র নাগরিক সত্তায় আবদ্ধ না থেকে, ছন্দের নিত্যনতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত না করে সর্বার্থে ‘মানুষের কবি’তে উত্তরিত করেছিল শামসুর রাহমানকে।

এপার বাংলার সঙ্গে শামসুরের প্রত্যক্ষ সংযোগের সূচনা অন্নদাশঙ্করের হাত ধরে ’৫৩ সালে শান্তিনিকেতনের ‘সাহিত্য মেলা’র ভিতর দিয়ে। দেশভাগের নিদারুণ যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট ছিলেন অন্নদাশঙ্কর। বাংলা ও বাঙালির বিভাজন তাঁর বুককে ফালাফালা করে দিয়েছিল। সেই বেদনাবিহ্বল ক্ষতে যেন একটু হলেও পূর্ণতার প্রলেপ দিয়েছিল ’৫২’র মহান ভাষা আন্দোলন। সেই সাহিত্যমেলায় অন্নদাশঙ্করের আমন্ত্রণে এসে এপার বাংলার কবিতাভুবনের কুশীলবদের সঙ্গে ব্যক্তি পরিচয়ের যে সূচনা হয়েছিল কবির, আমৃত্যু তা বজায় ছিল। সেদানের তরুণ শামসুর ছুটে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে। তরুণ শামসুরের যে প্রাণবন্ত ছবি প্রৌঢ় বুদ্ধদেবকে কতোখানি আপ্লুত করেছিল তা জীবন উপান্তেও ভুলতে পারেন প্রতিভা বসু।

রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করবার যে সুউচ্চ মেরুদণ্ডের পরিচয় শামসুর সারা জীবন ধরে দিয়ে গিয়েছেন, দুই বাংলার কবিতা জগতে তার তুলনা মেলা দুষ্কর। শামসুরের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে একমাত্র তুলনা চলে সুফিয়া কামালের

শামসুরের জীবনের প্রায় শেষপর্বে এপার বাংলা থেকে, এই নিবন্ধকারের সম্পাদিত কবিতা সংগ্রহ, গদ্য সংগ্রহ (পুনশ্চ) প্রকাশের আগে উচ্ছ্বসিত প্রতিভা বসু মুখর ছিলেন সেই ’৫৩ সালে শামসুরকে প্রথম দেখা এবং সেই সময় থেকে ধারাবাহিক ভাবে তাঁর কবিতা, গদ্য পাঠের স্মৃতি রোমান্থনে। ঢাকার মেয়ে প্রতিভার, মাহুতটুলির শামসুরের প্রতি একটা ‘দ্যাশের টান’ ছিল। সেই সঙ্গে ছিল ভারতীয় মিথলজি ঘিরে শামসুরের প্রবল উৎসাহ ঘিরে একটা অন্য রকমের অনুভূতি। প্রতিভা বলেছিলেন মহাকাব্যিক মিথলজি ঘিরে আমার নিজের উৎসাহ, শামসুরের লোকজ মিথলজি ঘিরে উৎসাহের দ্বারা অনেকখানি সজীব হয়েছিল। প্রতিভার মনে হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান, দুই ধর্মের লোকজ মিথলজিকে আত্মস্থ করার ভিতর দিয়েই শামসুরের সৃষ্টিতে এবং সার্বিক মননলোকে বিশ্বমানবতার জয়ের উদ্ভাসনের গতিমুখ আরো অনেক বেশি পরিপক্ব হয়েছে। প্রতিভা বসু একটু মজা করেই বলেছিলেন- আমি ‘মহাভারতের মহাকাব্য’ লিখবার আগে বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা’ পড়ি নি। না পড়বার কারণ; পাছে প্রভাবিত হয়ে যাই। কিন্তু বাংলার মঙ্গলকাব্য, বিশেষ করে মনসা মঙ্গলের চাঁদ সদগর, হেতালের লাঠি (চাঁদ সদাগর, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ- কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত)- এইসব নিয়ে সময়ের প্রেক্ষিতের সঙ্গে অদ্ভুত সাযুজ্য নির্মাণে রচিত শামসুরের কবিতা, আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল নতুন প্রেক্ষিতে দুর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদি মহাভারতের চরিত্রগুলির বিশ্লেষণে।

এই যে আত্মিক সংযোগ- এটাকে জীবন দিয়ে মর্যাদা দিতেন শামসুর। বুদ্ধদেব বসুর প্রতি নিজের প্রদ্ধাকে প্রতিবাহিত করতে কলকাতায় এসে একাধিকবার ছুটে গিয়েছেন বুদ্ধদেবের ছোট মেয়ে দময়ন্তী বসু সিং, আমাদের রুমিদির বাসায়। রুমিদির ব্যক্তি জীবনের নানা ওঠাপড়াতেও পরমাত্মীয়ের মতো পরামর্শ দিয়েছেন শামসুর। রুমিদি যখন ‘বিকল্প’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা খোলেন, তখন তাঁকে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার বিশেষ বিশেষ সংখ্যাগুলির ফ্যাক্সিমিলি এডিশন করবার যাঁরা যাঁরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের ভিতরে অন্যতম ছিলেন শামসুর রাহমান।

খ-িত বাঙালি- এই চেতনাকে একদিনের জন্যে প্রশ্রয় দেননি শামসুর। অখ- বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভূমিকা এবং অবদানের কথা শামসুর রাহমান সব সময়েই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন। শামসুর রাহমান কলকাতায় এসেছেন, আর অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর ফ্ল্যাটে যান নি- এমনটা বোধহয় কখনোই ঘটেনি। আবার শামসুরকে ঘিরে কোনো খবর পেয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে কবির কুশল জানতে চাননি অন্নদাশঙ্কর তেমনটাও কখনো হয় নি। নয়ের দশকের শেষের দিকে কবির বাসায়, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ চালায় ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা। একটু রাতের দিকে খবরটা পাই। অন্নদাশঙ্করকে তখনই জানাই। উনি বলেন; তুমি এক্ষুনি চলে এসো। ফোনে ধরে দাও শামসুরকে। আমি ওঁর সাথে কথা না বলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব না।

রাতেই ছুটে গেলাম অন্নদাশঙ্করের কাছে। সেই সময়ে আই এস ডি কলে সংযোগ পাওয়া খুব সহজ ছিল না। রাত প্রায় দেড়টা পর্যন্ত চেষ্টা করে সংযোগ পাওয়া গেল। এই এতোটা রাত পর্যন্ত নব্বই উত্তীর্ণ অন্নদাশঙ্কর ঠায় বসে আছেন টেলিফোন সেটের কাছে। সংযোগ পাওয়ার পর তিনি শামসুরকে বললেন; আমি হাসিনাকে নিজে বলছি তোমার নিরাপত্তা ঘিরে। তবে আপোস কখনো তুমি করবে না- সেটা জেনেও বলছি, খুব সাবধানে থেকো।

এত রাতে পিতৃপ্রতিম অন্নদাশঙ্করের কাছ থেকে এমন টেলিফোন, এমন আশ্বাস- আবেগ চেপে রাখতে পারেন নি কবি। অন্নদাশঙ্কর ফোন ছাড়বার পর যখন কথা বলছিলাম, কবির কণ্ঠ ছিল বাষ্পরুদ্ধ। পরের দিন সকালে বহুক্ষণের চেষ্টায় টেলিফোনে ধরা সম্ভব হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অন্নদাশঙ্করের শামসুরকে ঘিরে উদ্বেগকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা সেদিন টেলিফোনে কবির নিরাপত্তার জন্যে ইতিমধ্যেই কি ধরনের সতর্কতা নেওয়া হয়েছে, বিস্তারিত জানালেন।

এই যে আত্মার আত্মীয়তার ভূগোল নির্মাণ, যেখানে কোনো সীমান্ত নেই, নেই কাঁটাতার- তার ভিত্তি নির্মাণে নিজের ব্যক্তিত্বের একটা অনিন্দ্যসুন্দর গঠনশৈলিকে প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন কবি। অন্নদাশঙ্করের শেষবারের ঢাকা সফরের উদ্যোগের ক্ষেত্রেও সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী আর শামসুর রাহমানের ভূমিকা ছিল মুখ্য। অন্নদাশঙ্করের সেবার খুব ইচ্ছে ছিল কবিজননীর হাতের রান্না খাওয়ার। কবি জননী ও বয়সকে উপেক্ষা করে নিজের হাতে রেঁধেছিলেন অন্নদাশঙ্করের জন্যে। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সফর, কিছু সরকারী কর্মসূচির জন্যে কবি আবাসে যাওয়া সম্ভব হয় নি অন্নদাশঙ্করের। কিন্তু শামসুর নিজে মায়ের হাতের সেই রান্না সেইসময়ের হোটেল শেরাটনে পৌঁছে দিয়েছিলেন অন্নদাশঙ্করের কাছে। বড় তৃপ্তি সহকারে কবি জননীর নিজের হাতে রাঁধা নানা সুখাদ্য খেয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর।

অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে যেমন কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় নাম লেখান নি শামসুর, তেমনই কখনোই তিনি সময়ের গতিমুখ বিচার করে, বিশ্লেষণ করে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করেননি। মানবতার প্রশ্নে কখনো কোনো রকম দোদুল্যমানতায় ভাসেননি আবার সমকালে দুই বাংলারই অনেক কবি, সাহিত্যিকের মতোই হিসেব কষে, জল মেপে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করেননি। অকপটে সাদাকে ‘সাদা’ বলেছেন। কখনো ‘কালো’কে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে নিজের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করেন নি।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-উত্তরযুগে বাংলা কবিতার জগতে শামসুরের মতো স্পষ্টবাক কবি তাঁর সমকালে একজনও ছিলেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষ আনন্দবাজারকে কখনো ছাপিয়ে, অতিক্রম করে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। যতোখানি এক্তিয়ার তাঁকে আনন্দবাজার দিয়েছে, ঠিক ততোখানিই মুক্তবুদ্ধির জয়গান গেয়েছেন সুনীল। যতোখানি এগোলে নিজের এবং নিজের পরিম-লের কোনো ক্ষতি হবে না, ঠিক ততোখানিই বিদ্রোহী শঙ্খ ঘোষ।

কিন্তু এমন কোনো হিসেবি মাপকাঠির লক্ষণ রেখার ভিতরে একটি দিনের জন্যেও শামসুর নিজেকে বন্দি করেননি। সেই কারনে শঙ্খ ঘোষের কবিতার মতো ছন্দের মারপ্যাঁচের কোনো অনুবর্তন শামসুরের কবিতায় দেখা যায় না। শঙ্খ ছন্দ নিয়ে নিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা করে গিয়েছেন। সেই রকম কোনো নিরাপদ নি-িদ্র আবেষ্টনীর ভিতরে বসে শামসুর কবিতা লেখেননি। কবিতার ভাষা, ছন্দ, শৈলি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাও করেন নি। কবিতা লিখেই ছুটেছেন মিছিলে। মিছিল থেকে ফিরে ঘামে ভেজা শরীর নিয়েই ফিরেছেন কবিতার আশ্রয়ে। নিজেকে নিয়োজিত করেছেন ‘লানতের পঙতিমালা’ রচনায়। আবার হয়তো কবিতা লেখা শেষ করেই ছুটেছেন ঘটনাক্রমের শিকার কোনো মানুষের পাশে।

এই নিয়ত সমসাময়িকতাকে অবলম্বন করেই ছিল শামসুরের যাপনচিত্র। আর সেই যাপনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল তাঁর কবিতার সঙ্গে গেরস্তালি। শামসুর যখন লেখেন-

“বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে- কতিপয় লোক দেবদূতের নগ্নতা

বড়ো বেশি কাম্য ভেবে উন্মাদের মতো নগ্ন হয়ে যায়,

তরুণীর ওষ্ঠে বারবার চুমো খায় কর্কশ কঙ্কাল আর

লোহিত বনের ধারে পাথরের ঘোড়ায় সাওয়ার

অত্যন্ত পাথুরে যোদ্ধা, স্তব্ধ অস্ত্রে চির জ্যোৎস্না বয়।”

এই কবিতার রচনাকাল ১৯৭৭। মাহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে, ‘বন্দি শিবির থেকে’র রচয়িতার কলমে এই শব্দের আঁচর গুলি যখন বেরিয়ে আসছে, তখন বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত উত্তর বাংলাদেশ, শামসুরেরই ভাষায়, ‘বনপোড়া হরিণীর’ মতো আর্তনাদ করছে। সেদিনের সেই আর্তনাদ শুনে শামসুর কিন্তু কবিতার শৈলি নিয়ে সফেদ কাগজে আঁচড়ের পর আঁচড় কাটছেন, আর সেই আঁচলগুলিকে হিজিবিজি করে কলমের খোঁচায় ভরে দিয়ে, ছন্দের আরো গভীর দুরূহতায় আত্মনির্বাসন দিচ্ছেন- এমনটা একটিবারের জন্যেও করেন নি।

’৭৭ সালে বাংলাদেশের যে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিকায় ক্লান্ত-ক্ষুব্ধ কবি শামসুর এই উচ্চারণগুলি করেছিলেন, সেই উচ্চারণ কি আজ, ২০২১ সালের শরৎকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির হিংস্র শ্বাপনসস্কুল পদচারণার প্রেক্ষিতেও সমান প্রাসঙ্গিক নয়? এই কবিতা বা সমগোত্রীয় কবিতা যেগুলি হয়তো এটি রচনার ও কুড়ি, কুড়ি বছর আগে শামসুর রচনা করেছিলেন, বা কুড়ি কুড়ি বছর পরেও রচনা করেছেন, শেষ অসুস্থতার আগের দিন রাতে রচনা করেছেন- সেইসব। সৃষ্টির প্রেক্ষিত, আবেদন, মর্মার্থ অনুধাবন করলে মনে হয় না কি, গুজরাট থেকে দিল্লি গণহত্যা, আসাম থেকে কুমিল্লায় মানবতার টুটি টিপে ধরা দেখতে দেখতে ক্লান্ত, বিষণ্ন অথচ আত্মশক্তিতে ভরপুর কবি তাঁর ‘শ্যামলী’র বাসভবনে প্রিয় লেখার টেবিলে বসে, কাল রাতেই এইসব সৃষ্টি করেন নি?

শামসুর রাহমান কখনো আপোস করেন নি। জীবন-জীবিকা-যাপন-কবিতা, কোনোকিছুর সাথেই শামসুর রাহমান এক মুহূর্তের জন্যেও আপোস করেন নি। কবির এক বন্ধু, স্বনামধন্য কবি, আয়কর জনিত সমস্যায় জর্জরিত হয়েছিলেন। তিনি যে বৃহৎ সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাই জরিমানার টাকা ইত্যাদি দিয়ে সেই কবিকে মুক্ত করেন। বিনিময়ে সেই পত্রিকাগোষ্ঠীর কাছে ওই কবিকে প্রায় নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গের অবতারণা করে একদিন শামসুর রাহমানকে প্রশ্ন করেছিলাম। ওঁর অকপট উক্তি ছিল; ভালো কবিতা লেখা ছাড়া, অর্থ-সম্মান-নারী-সামাজিক কৌলিন্য-সুরা-যশ, কোনো কিছুর প্রতি আমার লোভ নেই। বাঁচার জন্যে অর্থের প্রয়োজন। খেয়েপরে বেঁচে থাকলেই হলো। আর বাকি সবটাই আমার কবিতা। আরো ভালো কবিতা লেখার ইচ্ছে আর না লিখতে পারার কষ্ট- এর বাইরে কোনো ইহজাগতিক রশ্মি শামসুর রাহমানের জীবনকে কখনো একমুহূর্তের জন্যেও আবৃত করতে পারে নি।

তাই অফুরন্ত লিখেছেন কবি। কিন্তু সেই লেখা সমাজকে, সংস্কৃতিকে, সভ্যতাকে অনেক অনেক কিছু দিলেও কবিকে কখনো অর্থের প্রাচুর্যে নিমজ্জিত করেন। এই নিমজ্জন কবি নিজেও কখনো চান নি। ফলে দেশ বিদেশের নামীদামী পত্রিকা তাঁর কাছে কবিতা চাইলেও কবির যে অভিব্যক্তি ছিল, তেমনি অচেনা, অজানা কোনো মফস্বল বা অজপাড়া গাঁয়ের কবিতার কাগজের সম্পাদক তাঁর কাছে কবিতা চাইলেও সেই অভিব্যক্তি এতোটুকু অদলবদল দেখা যেতো না। কাউকে কখনো ফেরাতেন না শামসুর। ফলে তাঁর জীবিকার ক্ষেত্রে অর্থের প্রাচুর্য ছিল না। কিন্তু সেই না থাকাটাকে উপভোগ করতেও ছাড়তেন না। বলতেন- দেখেছো, অমুকের মতো খবরের কাগজের মালিকের হুকুমতামিলদারি আমাকে কখনো করতে হয় না!

রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করবার যে সুউচ্চ মেরুদণ্ডের পরিচয় শামসুর সারা জীবন ধরে দিয়ে গিয়েছেন, দুই বাংলার কবিতা জগতে তার তুলনা মেলা দুষ্কর। শামসুরের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে একমাত্র তুলনা চলে সুফিয়া কামালের। আর গদ্য সাহিত্যে অন্নদাশঙ্কর এবং কবীর চৌধুরীর। এই মেরুদ-ের ঋজুতার সঙ্গে এপার বাংলার কোনো কবিরই তুলনা টানা যায় না। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো উপায়ে বৃহৎ পুঁজি পরিচালিত সংবাদমাধ্যম বা রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে মাথা নুইয়ে বসে আছেন। এমনটা শামসুর কখনোই করেন নি। আর এটা না করবার জন্যেই শামসুর এবং তাঁর কবিতা কেবল বাংলা সাহিত্যের পরিম-লেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের আঙ্গিকেও এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। আর এই ব্যতিক্রম রচনার ক্ষেত্রেও শামসুরকে কখনো কৌশলী বা সাবধানী হতে দেখা যায় নি। কলকাতায় অকপটে প্রকাশ্য মঞ্চে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আড্ডা দিতেও যেমন তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, তেমনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে অসুস্থ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিকিৎসা নিয়ে অনুরোধ করতেও দ্বিধা করেন নি, আবার সেই সময়ের শাসক সি পি আই (এম) এর সদর দপ্তর আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে গিয়ে আড্ডা জমাতেও পিছপা হননি।

back to top