ধারাবাহিক উপন্যাস : একুশ
আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
সাঁইত্রিশ.
অতসুমিচি তাঁর পত্র বাহককে ডাকালেন। বললেন, অনেক দিন হয়ে গেল। কোনো পত্র আসেনি? এখানে তার জন্য একটি পত্র রয়েছে, নিয়ে যাও।
সে বলল, আমি একদিন গিয়েছিলাম ঐ বাড়িতে। শুনলাম তিনি ইশিয়ামা প্যাগোডায় গেছেন এবং সেখানে অবস্থান করছেন।
তুমি আজই প্যাগোডায় যাবে। প্রিন্স প্রাসাদে চলে গেছে। ভাবছেন প্রথম দিককার দিনগুলোর কথা। তখন এত ঝামেলা ছিল না। এসব ভেবে খুব কষ্ট হলো। তিনি এ চিন্তা বাদ দিয়ে বুদ্ধের প্রার্থনায় মনোসংযোগের চেষ্টা করলেন।
কার যেন পদধ্বনি শুনতে পেলেন নিচে। তিনি উঠে এসে নিচের দিকে তাকালেন। দেখলেন কেউ একজন হাঁটাহাঁটি করছে। তাড়াতাড়ি দাসীকে পাঠাবেন। বললেন, প্রিন্সের লোক হতে পারে। পত্র দিলে নিয়ে এসো। পত্র এলো। ইঝোমি অন্য সময় থেকে আরো তড়িঘড়ি করে খুললেন। প্রিন্স লিখেছেন :
তুমি দেখছি বুদ্ধের শিক্ষায় ডুবে গেছ। তা শুনে আনন্দ পেলাম। তবে এটাও বুঝলাম , আমাকে এত ভালোবাসোনি যে, আমি বুদ্ধের প্রতি তোমার ভক্তির অন্তরায় হয়ে গেছি। কেবল তোমার শান্তির কথা ভাবলে আমার ঈর্ষা হয়।
সঙ্গে একটি কবিতাও এসেছে :
তুমি কি অনুভব কর, আমার আত্মা তোমাতেই ভর করে আছে
সকল বাধা পেরিয়ে
অন্তহীন, ব্যাকুল আকাক্সক্ষা নিয়ে
কখন তুমি ফিরবে?
ইঝোমি ভাবলেন, যখন খুব কাছাকাছি ছিলাম তিনি খুব কমই লিখতেন। কৃতজ্ঞ যে অনেক দেরিতে হলেও লিখেছেন।
জবাব দিলেন :
ভেবেছিলাম সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন-
কে আছে এমন বাধা পেরিয়ে আসতে পারে?
আপনি জানতে চেয়েছেন কখন ফিরছি, এখনো অনিশ্চিত। তারপর ভাবাত্মক আরেকটি কবিতা :
দেখা হওয়ার পথ
নাগারা পর্বত যখন ছিল
আমার আকাক্সক্ষা বিওয়া হ্রদের উন্মুক্ত জল
বের হবার সৈকত হামা অতিশয়
মিয়াকোর রাজকীয় নগরের দিকে নয়।
প্রিন্স অতসুমিচি তার পত্রে দুটি কবিতা লিখে পাঠালেন :
আমি তোমাকে ওসাকা ইয়ামায় চাই, সাক্ষাতের পর্বত।
কিন্তু কখনোই তোমাকে ভুলে নয়,
আমার পথ হারিয়ে গেছে পদচিহ্নহীন উপত্যকায়।
দ্বিতীয় কবিতা :
দুঃখভারে নিমজ্জিত থেকেও
আমি অবসরেই থাকতে চেয়েছি
কিন্তু ইউমি, সেই সাক্ষাতের হ্রদ
পেছনে যে হামা, বের হয়ে আসার সৈকত।
ইঝোমি একটি ছোট্ট কবিতা পাঠালেন। মার্জিনে একটি টোকা।
অশ্রু বাঁধ মানছে না কোনো বাধায়
ধারা বইছে ইউমির দিকে, সাক্ষাতের হ্রদ।
টোকা :
চেষ্টা করতে দিন আপনি আমাকে
আমার নিজের অন্তরও
এসে প্রলুব্ধ করছে আমাকে আপনার নগরের দিকে।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
প্রিন্স ভেবেছিলেন কখনোই এত দূর আর দৃষ্টি যাবে না। পত্রটি হাতে পেয়ে পণ রক্ষা করতে পারলেন না, ভাবলেন যাবেন তিনি। তিনি এলেন এবং দু’জন একসঙ্গে বের হলেন।
কিন্তু কি সমস্যার শেষ হলো? না, এ পথের যেন শেষ নেই, যে পথ বন্ধুর এবং কণ্ঠকাকীর্ণ।
মুরাসাকি বসেছেন লেখাটা নিয়ে। দ্রুত আগাতে হবে। গত রাতের কথা ইমন তাকে বিস্তারিত বলেছেন। কখন কার মত পাল্টে যায়, আবার নিজেরও মনের পরিবর্তন আসে কিনা কে বলবে। লিখলেন, সম্রাট রেইঝেই আসল পিতার পরিচয় পেয়ে প্রথমে হতাশ হলেন। চিন্তা করলেন তার কী করা উচিত। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন গেঞ্জিকেই পিতার আসনে অধিষ্ঠিত করবেন। পিতার স্বীকৃতিসহ ভাবমূর্তি উদ্ধারকল্পে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চপদে অধিষ্ঠিত করলেন।
বয়সের কারণে অথবা জীবনে অকল্পনীয় প্রাপ্তির জন্য গেঞ্জির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। স্ত্রী মুরাসাকি এ সময় পাশে থেকে তার সেবাযত্নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তার রাজকীয় মর্যাদার একটুও ক্ষুণ্ন হয় না। তার প্রেম ও আবেগময় জীবনে ধীরে ধীরে অধপতন নেমে আসে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে গেঞ্জি আরেকটি বিয়ে করে। তাকে ‘অন্যা সান নো মিয়া’ অর্থাৎ তৃতীয় রাজকুমারী বলা হয়। মুরাসাকি গেঞ্জির সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়। রাগে-অভিমানে সে ‘বিকুনি’র (সন্ন্যাসিনীর) জীবন বেছে নেয় (সংক্ষেপিত)।
নানা ঘটনা এবং কাহিনীর বিস্তারে কয়েকটি পর্বই হয়ে গেল, মুরাসাকি স্ক্রলগুলোর অনুলিপি করে ছড়িয়ে দিলেন। লিপিকরদের সাহায্যও নিলেন অনুলিপি করাতে।
এদিকে মুরাসাকির বিরুদ্ধে সম্রাটকে খেপাতে ব্যর্থ হয়ে শোনাগন অনুসারীরা ষড়যন্ত্রের নতুন পথ খুঁজতে থাকে। তাদের মিথ্যা রটনা যেন আর শেষ হয় না। লেগেই থাকে এরা।
শোনাগন বললেন, শোনো, এসব আর করা যাবে না এখন।
লেডি সানুকি বললেন কেন?
ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ওর পক্ষ নিয়েছে। সময় ও সুযোগ মত তেতে উঠবো আমরা। তোমাদেরকে ঠা-াপানি গরম পানি বুঝতে হবে।
তৎপরতা বন্ধ হলো বটে, কিন্তু ছিদ্র অনুসন্ধান বন্ধ হলো না।
এ সময় একদিন লেডি সেনশির দরবারে গেলেন মুরাসাকি। সেনশি মুখ ভার করে আছেন। ভালোমতো কথাও বলছেন না। মুরাসাকি ভাবলেন চলে আসবেন। বিদায় নিতেই সেনশি বললেন দাঁড়াও। লেখার সর্বশেষ স্ক্রলটা এনে বললেন, এগুলো কি লিখেছ? একজন অপরাধিকে এত ওপরে তুললে? আবার সম্পূর্ণ সঙ্গতিহীনভাবে তাকে আরেকটা বিয়ে দিলে মুরাসাকি মেয়েটাকে পাঠালে প্যাগোডায়- এসব আমার একদম ভালো লাগেনি।
মুরাসাকি একবার মনে করলেন বলবেন- আমি তো শুধু আপনার ভালো লাগার জন্য লিখি না। কিন্তু বললেন না। বিদায় নিয়ে চলে এলেন।
নিজের দপ্তরে এসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার খুব কান্না পেল। কয়েকবার হাতায় চোখ মুছলেন। বাইরে বাগানে ফুলগুলো দুলছে শরতের বাতাসে। এ দৃশ্য কতভালো লাগতে পারতো, লাগল না। এতটা খারাপ তার কখনো লাগেনি।
সম্রাজ্ঞী শোশির দরবার থেকে একদাসী এল। সম্রাজ্ঞী তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি অসুস্থতা বোধ করছি, তুমি সম্রাজ্ঞীকে বলো সুস্থবোধ করলে যাব।
সে চলে গেল। কিন্তু একি! কিছুক্ষণ পর সম্রাজ্ঞী স্বয়ং চলে এলেন। বললেন, তোমার অসুস্থতার কথা শুনে এলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম আমার চিকিৎসককে।
তিনি চিকিৎসককে বললেন, দেখো তো কী সমস্যা। তার সুস্থতা ছাড়া এখন আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।
চিকিৎসক পরীক্ষা করে বললেন, শরীর অতটা খারাপ না, মনে হয় মানসিক চাপে আছেন, একটু বিশ্রাম নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সম্রাজ্ঞী বললেন, খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে কিছু বলবে না?
চিকিৎসক সবই বললেন। সম্রাজ্ঞী বিশ্রামের পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিলেন। মুরাসাকি তাকে এগিয়ে দিতে যাবেন, সম্রাজ্ঞী বললেন, না আসার দরকার নেই, বিশ্রাম নাও এখন।
সম্রাজ্ঞীর এতটা ব্যস্ততা এবং আনুকূল্যে অবাকই হলেন মুরাসাকি। পাশে ছিল তার মেয়ে। তাকে কাছে টেনে নিলেন। তিনি যদি না থাকেন তাহলে এ মেয়েটার কী হবে; ভাবলেন তিনি। তার বাবা বেঁচে আছেন, বড় ভাই নোবুনোরিও আছে। তারপরও সন্তান মায়ের ডানার নিচেই থাকা দরকার। অস্ফুটে যেন বললেনও।
সংবাদটা মিচিনাগাও পেয়েছেন। মুরাসাকি জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনি বাগানের পথ ধরে এদিকেই আসছেন।
বড্ড বিরক্ত হলেন মুরাসাকি।
আটত্রিশ.
সম্রাজ্ঞী শোশির মাতা রিনশির মন খুব খারাপ। সম্রাজ্ঞীর কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। নাতি-নাতনি না দেখে তার শান্তি হচ্ছে না। মিচিনাগা তার স্ত্রীকে ব্যর্থ মানুষ বলে তিরস্কার করেছেন। বলেছেন, একটি কাজই দিলাম, মেয়েলি কাজ, না হয় আমিই ব্যাপারটা দেখতাম।
রিনশি বললেন, হেইয়ান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রী- করুন না মেয়ের জন্য এটুকু কাজই করুন, আমি তো পেটে ধরেছি।
পেটে ধরলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
শুধু জন্ম দিলেও দায়িত্ব শেষ হয় না।
তাদের সম্পর্ক কলহপ্রবণ নয়। তবুও কলহের কারণ উত্তাপ। সম্রাজ্ঞী তেইশি আবার সন্তান সম্ভাবা এই সংবাদ তাদের মধ্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে।
ওঝাঁ, বৈদ্য, চিকিৎসক কেউ কিছু করতে পারেনি। শোশির সন্তান হচ্ছে না। এখন যদি সম্রাট মারা যান তাহলে সম্রাজ্ঞী তেইশির ছয় বছরের পুত্রই সম্রাট হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না, এমনকি শক্তিধর প্রধানমন্ত্রীও না। তখন তেইশি পূর্ণক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন। এই নজির সামনেই রয়েছে। বর্তমান সম্রাটও ছয় বছর বয়সে সিংহাসনে বসেছেন। মিচিনাগাদের তখন কর্তৃত্ব তো দূরের কথা, প্রাসাদ কিংবা দরবারেও স্থান হবে না, তেইশির ভ্রাতা (যাকে এরা বের করে দিয়েছিলেন) এখান থেকে তাড়িয়ে দেবেন। হত্যাও করতে পারেন।
শোশির একটা ছেলে থাকলে কোনো ফন্দিফিকির করে, দরবারের লোকজন ও সামুরাই সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব খাটিয়ে হেইয়ান কিয়োর এক লাখ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে তাকে সম্রাট করে ফেলা যেতো। সে সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। তাই এত আস্ফালন, এত আহাজারী, এত উত্তাপ এবং একে অন্যের প্রতি এত দোষারোপ।
রিনশি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন, ওঝাঁ, বদ্যি, চিকিৎসক, শ্রাইন, প্যাগোডা সব ঠিক আছে, সমস্যা অন্য জায়গায়।
কোথায়?
রিনশি মিচিনাগার কাছে সরে এসে আস্তে আস্তে সমস্যার কথা বললেন।
কেন? তার সমস্যা কি?
সমস্যা করেছে তেইশি। সন্তান নষ্ট হবার পর সম্রাট তাকে কথা দিয়েছে, ও সন্তান সম্ভবা না হওয়া পর্যন্ত সম্রাটের বিছানায় অন্য কোনো সম্রাজ্ঞী বা স্ত্রী যাবে না।
সর্বনাশ! সে কথা আগে বলোনি কেন?
সেও আমাকে কী আর বলেছে?
এত চেষ্টা তদ্বিরের এই হাল?
আপনি ভাববেন না। আমি আশাবাদী।
এখন তোমরা আশাবাদী হয়ে তেইশির পুত্র সন্তানই দেখো। একজন না হলে আরেকজন সম্রাট হবে, তাও দেখো।
তার ছেলে হবে, একথা আপনাকে কে বলেছে?
সময় খারাপ হলে তাই হবে।
সম্রাট বেশ খুশি। তিনি তার কথা রাখতে পেরেছেন। তাই উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বললেন। তেইশির দরবারে আনন্দের বন্যা। মিচিনাগা এই উৎসবের আয়োজনে মূল দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। শোনাগন বললেন, এই প্রাসাদে যত উৎসব হয়েছে, এবার সবগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।
সম্রাটের দরবারে উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগের প্রধান এখন ইঝোমির বাবা। তার ওপর একজন মন্ত্রীও রয়েছেন। মিচিনাগা মন্ত্রীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। তা নিতান্ত সম্রাটের ব্যক্তিগত বিষয় বলে ধৈর্য ধারণ করতে পরামর্শ দিলেন উৎসব মন্ত্রী।
অনুষ্ঠানটা শুরু হয়ে গেল। লোক দেখানো আগ্রহ নিয়ে এসে সবাই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। এখানেও প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগাই নিয়ন্ত্রক এবং প্রধান ব্যক্তি। তিনি যেন শুরুতেই আনন্দের অনুষ্ঠানেও প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিলেন। শুধু ব্যর্থতা এক জায়গায় কন্যাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারেননি, হতে পারেননি মাতামহ।
শোশির দরবার অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুখে হাসি নেই। তেইশির দরবারের লেডিদের উচ্ছ্বাসে এরা যেন নিষ্প্রভ। কিন্তু এদের পক্ষে অনুষ্ঠান ত্যাগ করা সম্ভব নয়, কষ্ট হজম করা ছাড়া। তেইশি মনে মনে হাসছেন, আর বলছেন, অপরিপক্বের দল।
ইমন অবশ্য মানিয়ে নিয়েছেন। তার দুশ্চিন্তা হলো মহামান্যাকে আবার ভুল বুঝিয়ে কেউ উত্তেজিত করে তোলে কিনা। তা হলে সর্বনাশ হবে। তার দৃষ্টি সাইশির দিকে। তাকে তৎপর হতে দেখলেই এগিয়ে যাবেন তিনি সম্রাজ্ঞীর পাশে।
দামি পোশাকে সজ্জিত শোনাগন বাতিক গ্রস্থের মতো উৎসবমুখর হলেও মুরাসাকি তা নিয়ে মাথা ঘামান না। এছাড়া তিনি এরকম উৎসবকে অর্থহীন মনে করেন। কারণ তাকে একজন চিকিৎসক বলেছেন, এ সময় তেইশির সন্তান নেয়া ঠিক হয়নি, ফল ভালো নাও হতে পারে, সন্তানটি গর্ভপাতে নষ্ট হয়। মুরাসাকি কাউকে তা বলেননি, সম্রাজ্ঞী শোশি বা ইমনকেও নয়। এছাড়া এ বিষয়টি নিয়ে কেন এরা দলবদ্ধভাবে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়েছে তাও বুঝতে পারছেন না। এটা তার কাছে একটি অনাবশ্যক কাজ।
অনাবশ্যক কাজে তাকে সঙ্গে পাচ্ছেন না বলে কোনো কোনো লেডি তার সমালোচনা করছেন। তাকে আত্মঅহংকারী এবং কাটাযুক্ত বলে মন্দ বলছেন। ইমন তাদের থামানোর চেষ্টা করছেন। এটা শোশির দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি বাম দিকে ঘুরে জানতে চাইলেন। ইমনরা তা চেপে গেলেন।
আগে প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে ইঝোমি এসব অনুষ্ঠানে রাজপ্রাসাদে এলেও এখন প্রিন্স অতসুমিচির সঙ্গে আসেন না, প্রিন্সের প্রিন্সেসই আসেন। ইঝোমি যেন প্রেমের জন্য সত্যিই সমাজচ্যুত হয়ে গেছেন। তাকে কোনো রাজকীয় অনুষ্ঠানেই দেখা যায় না। এটা কোনো পাপবোধের জন্য হচ্ছে কিনা কে জানে। তিনি অবশ্য সামাজিক সমালোচনা এবং পাপানুভূতিকে কমই পাত্তা দেন। প্রিন্সের বাইরেও শোশির দরবারের লেডি হিসেবে তিনি যোগ দিতে পারেন, সে পদ এখনো বহাল আছে। তবে তার কাছে সবসময়ই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা অর্থহীন মনে হয়েছে। রাজকীয় উৎসবে সেই ছোটবেলায়ও তাকে ছেলেবন্ধুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
উৎসবের পরের দিনের কথা। সম্রাজ্ঞী শোশি মুরাসাকিকে নিয়ে বসলেন। কারণ হলো তিনি সম্রাটের বাম দিকে এবং তেইশি বসেছিলেন ডানদিকে। তেইশির এক লেডি-ইন-ওয়েটিং তেইশির সঙ্গে অমার্জিত একটি চীনা শব্দ ব্যবহার করে কথা বলেন। তাতে মনে হলো তেইশির ব্যাপারটায় অহংকার আরো বৃদ্ধি পায়। তা কি এবং কেন, তিনি তা বুঝতে পারলেন না, এ নিয়ে কথা বলতে চান।
তেইশির দরবারে চীনাভাষার ব্যবহার আছে সম্রাজ্ঞী তাও জানেন। হেইয়ান প্রাসাদে চীনা ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটা স্ববিরোধী অবস্থা বিরাজ করছে। সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারে তা সদর্পে বিরাজ করছে- যদিও ভুলে ভরা এবং অগোছালো সে ভাষা। সম্রাটের দরবারের তা না জানার কথা নয়।
মুরাসাকিকে এই প্রেক্ষাপটে রীতিমতো চীনা ভাষার ক্লাশ করতে হলো। শোশি সব বাদ দিয়ে ভাষা শিক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন।
চীনা ভাষাটা সহজ নয় বেশ কঠিন। তাকে বার বার বুঝাতে হয়। মুরাসাকির ধৈর্য রয়েছে। তিনি বেশ আন্তরিকও। সম্রাজ্ঞী শব্দটা মনে করতে পারলেন না। ভাব অর্থ তাই জানা গেল না। এতে লাভ হল এই যে, মুরাসাকির এই ছাত্রীটি ক্লাশে নিয়মিত হয়ে গেলেন।
সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে ফিরে এসে মুরাসাকি আবার লেখা নিয়ে বসলেন। কিন্তু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। লেডি সেনশির কথা মনে হচ্ছে। তিনি কি আসলেই লেখাকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছেন? এটাতো সত্য যে, ভোগের বিপরীতে আছে দুঃখ এবং যন্ত্রণা। কিন্তু মানুষ যে যন্ত্রটা চায়, যে অনৈতিক ভোগাকাক্সক্ষার শাস্তি চায়, শাস্তি তো প্রকৃত অর্থে তা নয়। তিনি নৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন, তার দৃষ্টিতে তাই সঠিক। ‘গেঞ্জি’ শাস্তি পাবে, তা আরোপিত হবে না, তবে নিয়তি নির্ধারিত। সে দিকেই গল্প আগাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না ভুলটা কোথায় হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবেই লেখা এগিয়ে নেবেন। (ক্রমশ...)
ধারাবাহিক উপন্যাস : একুশ
আবুল কাসেম
শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১
(পূর্ব প্রকাশের পর)
সাঁইত্রিশ.
অতসুমিচি তাঁর পত্র বাহককে ডাকালেন। বললেন, অনেক দিন হয়ে গেল। কোনো পত্র আসেনি? এখানে তার জন্য একটি পত্র রয়েছে, নিয়ে যাও।
সে বলল, আমি একদিন গিয়েছিলাম ঐ বাড়িতে। শুনলাম তিনি ইশিয়ামা প্যাগোডায় গেছেন এবং সেখানে অবস্থান করছেন।
তুমি আজই প্যাগোডায় যাবে। প্রিন্স প্রাসাদে চলে গেছে। ভাবছেন প্রথম দিককার দিনগুলোর কথা। তখন এত ঝামেলা ছিল না। এসব ভেবে খুব কষ্ট হলো। তিনি এ চিন্তা বাদ দিয়ে বুদ্ধের প্রার্থনায় মনোসংযোগের চেষ্টা করলেন।
কার যেন পদধ্বনি শুনতে পেলেন নিচে। তিনি উঠে এসে নিচের দিকে তাকালেন। দেখলেন কেউ একজন হাঁটাহাঁটি করছে। তাড়াতাড়ি দাসীকে পাঠাবেন। বললেন, প্রিন্সের লোক হতে পারে। পত্র দিলে নিয়ে এসো। পত্র এলো। ইঝোমি অন্য সময় থেকে আরো তড়িঘড়ি করে খুললেন। প্রিন্স লিখেছেন :
তুমি দেখছি বুদ্ধের শিক্ষায় ডুবে গেছ। তা শুনে আনন্দ পেলাম। তবে এটাও বুঝলাম , আমাকে এত ভালোবাসোনি যে, আমি বুদ্ধের প্রতি তোমার ভক্তির অন্তরায় হয়ে গেছি। কেবল তোমার শান্তির কথা ভাবলে আমার ঈর্ষা হয়।
সঙ্গে একটি কবিতাও এসেছে :
তুমি কি অনুভব কর, আমার আত্মা তোমাতেই ভর করে আছে
সকল বাধা পেরিয়ে
অন্তহীন, ব্যাকুল আকাক্সক্ষা নিয়ে
কখন তুমি ফিরবে?
ইঝোমি ভাবলেন, যখন খুব কাছাকাছি ছিলাম তিনি খুব কমই লিখতেন। কৃতজ্ঞ যে অনেক দেরিতে হলেও লিখেছেন।
জবাব দিলেন :
ভেবেছিলাম সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন-
কে আছে এমন বাধা পেরিয়ে আসতে পারে?
আপনি জানতে চেয়েছেন কখন ফিরছি, এখনো অনিশ্চিত। তারপর ভাবাত্মক আরেকটি কবিতা :
দেখা হওয়ার পথ
নাগারা পর্বত যখন ছিল
আমার আকাক্সক্ষা বিওয়া হ্রদের উন্মুক্ত জল
বের হবার সৈকত হামা অতিশয়
মিয়াকোর রাজকীয় নগরের দিকে নয়।
প্রিন্স অতসুমিচি তার পত্রে দুটি কবিতা লিখে পাঠালেন :
আমি তোমাকে ওসাকা ইয়ামায় চাই, সাক্ষাতের পর্বত।
কিন্তু কখনোই তোমাকে ভুলে নয়,
আমার পথ হারিয়ে গেছে পদচিহ্নহীন উপত্যকায়।
দ্বিতীয় কবিতা :
দুঃখভারে নিমজ্জিত থেকেও
আমি অবসরেই থাকতে চেয়েছি
কিন্তু ইউমি, সেই সাক্ষাতের হ্রদ
পেছনে যে হামা, বের হয়ে আসার সৈকত।
ইঝোমি একটি ছোট্ট কবিতা পাঠালেন। মার্জিনে একটি টোকা।
অশ্রু বাঁধ মানছে না কোনো বাধায়
ধারা বইছে ইউমির দিকে, সাক্ষাতের হ্রদ।
টোকা :
চেষ্টা করতে দিন আপনি আমাকে
আমার নিজের অন্তরও
এসে প্রলুব্ধ করছে আমাকে আপনার নগরের দিকে।
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান
প্রিন্স ভেবেছিলেন কখনোই এত দূর আর দৃষ্টি যাবে না। পত্রটি হাতে পেয়ে পণ রক্ষা করতে পারলেন না, ভাবলেন যাবেন তিনি। তিনি এলেন এবং দু’জন একসঙ্গে বের হলেন।
কিন্তু কি সমস্যার শেষ হলো? না, এ পথের যেন শেষ নেই, যে পথ বন্ধুর এবং কণ্ঠকাকীর্ণ।
মুরাসাকি বসেছেন লেখাটা নিয়ে। দ্রুত আগাতে হবে। গত রাতের কথা ইমন তাকে বিস্তারিত বলেছেন। কখন কার মত পাল্টে যায়, আবার নিজেরও মনের পরিবর্তন আসে কিনা কে বলবে। লিখলেন, সম্রাট রেইঝেই আসল পিতার পরিচয় পেয়ে প্রথমে হতাশ হলেন। চিন্তা করলেন তার কী করা উচিত। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন গেঞ্জিকেই পিতার আসনে অধিষ্ঠিত করবেন। পিতার স্বীকৃতিসহ ভাবমূর্তি উদ্ধারকল্পে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চপদে অধিষ্ঠিত করলেন।
বয়সের কারণে অথবা জীবনে অকল্পনীয় প্রাপ্তির জন্য গেঞ্জির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। স্ত্রী মুরাসাকি এ সময় পাশে থেকে তার সেবাযত্নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তার রাজকীয় মর্যাদার একটুও ক্ষুণ্ন হয় না। তার প্রেম ও আবেগময় জীবনে ধীরে ধীরে অধপতন নেমে আসে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে গেঞ্জি আরেকটি বিয়ে করে। তাকে ‘অন্যা সান নো মিয়া’ অর্থাৎ তৃতীয় রাজকুমারী বলা হয়। মুরাসাকি গেঞ্জির সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়। রাগে-অভিমানে সে ‘বিকুনি’র (সন্ন্যাসিনীর) জীবন বেছে নেয় (সংক্ষেপিত)।
নানা ঘটনা এবং কাহিনীর বিস্তারে কয়েকটি পর্বই হয়ে গেল, মুরাসাকি স্ক্রলগুলোর অনুলিপি করে ছড়িয়ে দিলেন। লিপিকরদের সাহায্যও নিলেন অনুলিপি করাতে।
এদিকে মুরাসাকির বিরুদ্ধে সম্রাটকে খেপাতে ব্যর্থ হয়ে শোনাগন অনুসারীরা ষড়যন্ত্রের নতুন পথ খুঁজতে থাকে। তাদের মিথ্যা রটনা যেন আর শেষ হয় না। লেগেই থাকে এরা।
শোনাগন বললেন, শোনো, এসব আর করা যাবে না এখন।
লেডি সানুকি বললেন কেন?
ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ওর পক্ষ নিয়েছে। সময় ও সুযোগ মত তেতে উঠবো আমরা। তোমাদেরকে ঠা-াপানি গরম পানি বুঝতে হবে।
তৎপরতা বন্ধ হলো বটে, কিন্তু ছিদ্র অনুসন্ধান বন্ধ হলো না।
এ সময় একদিন লেডি সেনশির দরবারে গেলেন মুরাসাকি। সেনশি মুখ ভার করে আছেন। ভালোমতো কথাও বলছেন না। মুরাসাকি ভাবলেন চলে আসবেন। বিদায় নিতেই সেনশি বললেন দাঁড়াও। লেখার সর্বশেষ স্ক্রলটা এনে বললেন, এগুলো কি লিখেছ? একজন অপরাধিকে এত ওপরে তুললে? আবার সম্পূর্ণ সঙ্গতিহীনভাবে তাকে আরেকটা বিয়ে দিলে মুরাসাকি মেয়েটাকে পাঠালে প্যাগোডায়- এসব আমার একদম ভালো লাগেনি।
মুরাসাকি একবার মনে করলেন বলবেন- আমি তো শুধু আপনার ভালো লাগার জন্য লিখি না। কিন্তু বললেন না। বিদায় নিয়ে চলে এলেন।
নিজের দপ্তরে এসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার খুব কান্না পেল। কয়েকবার হাতায় চোখ মুছলেন। বাইরে বাগানে ফুলগুলো দুলছে শরতের বাতাসে। এ দৃশ্য কতভালো লাগতে পারতো, লাগল না। এতটা খারাপ তার কখনো লাগেনি।
সম্রাজ্ঞী শোশির দরবার থেকে একদাসী এল। সম্রাজ্ঞী তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি অসুস্থতা বোধ করছি, তুমি সম্রাজ্ঞীকে বলো সুস্থবোধ করলে যাব।
সে চলে গেল। কিন্তু একি! কিছুক্ষণ পর সম্রাজ্ঞী স্বয়ং চলে এলেন। বললেন, তোমার অসুস্থতার কথা শুনে এলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম আমার চিকিৎসককে।
তিনি চিকিৎসককে বললেন, দেখো তো কী সমস্যা। তার সুস্থতা ছাড়া এখন আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।
চিকিৎসক পরীক্ষা করে বললেন, শরীর অতটা খারাপ না, মনে হয় মানসিক চাপে আছেন, একটু বিশ্রাম নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সম্রাজ্ঞী বললেন, খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে কিছু বলবে না?
চিকিৎসক সবই বললেন। সম্রাজ্ঞী বিশ্রামের পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিলেন। মুরাসাকি তাকে এগিয়ে দিতে যাবেন, সম্রাজ্ঞী বললেন, না আসার দরকার নেই, বিশ্রাম নাও এখন।
সম্রাজ্ঞীর এতটা ব্যস্ততা এবং আনুকূল্যে অবাকই হলেন মুরাসাকি। পাশে ছিল তার মেয়ে। তাকে কাছে টেনে নিলেন। তিনি যদি না থাকেন তাহলে এ মেয়েটার কী হবে; ভাবলেন তিনি। তার বাবা বেঁচে আছেন, বড় ভাই নোবুনোরিও আছে। তারপরও সন্তান মায়ের ডানার নিচেই থাকা দরকার। অস্ফুটে যেন বললেনও।
সংবাদটা মিচিনাগাও পেয়েছেন। মুরাসাকি জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনি বাগানের পথ ধরে এদিকেই আসছেন।
বড্ড বিরক্ত হলেন মুরাসাকি।
আটত্রিশ.
সম্রাজ্ঞী শোশির মাতা রিনশির মন খুব খারাপ। সম্রাজ্ঞীর কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। নাতি-নাতনি না দেখে তার শান্তি হচ্ছে না। মিচিনাগা তার স্ত্রীকে ব্যর্থ মানুষ বলে তিরস্কার করেছেন। বলেছেন, একটি কাজই দিলাম, মেয়েলি কাজ, না হয় আমিই ব্যাপারটা দেখতাম।
রিনশি বললেন, হেইয়ান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রী- করুন না মেয়ের জন্য এটুকু কাজই করুন, আমি তো পেটে ধরেছি।
পেটে ধরলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
শুধু জন্ম দিলেও দায়িত্ব শেষ হয় না।
তাদের সম্পর্ক কলহপ্রবণ নয়। তবুও কলহের কারণ উত্তাপ। সম্রাজ্ঞী তেইশি আবার সন্তান সম্ভাবা এই সংবাদ তাদের মধ্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে।
ওঝাঁ, বৈদ্য, চিকিৎসক কেউ কিছু করতে পারেনি। শোশির সন্তান হচ্ছে না। এখন যদি সম্রাট মারা যান তাহলে সম্রাজ্ঞী তেইশির ছয় বছরের পুত্রই সম্রাট হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না, এমনকি শক্তিধর প্রধানমন্ত্রীও না। তখন তেইশি পূর্ণক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন। এই নজির সামনেই রয়েছে। বর্তমান সম্রাটও ছয় বছর বয়সে সিংহাসনে বসেছেন। মিচিনাগাদের তখন কর্তৃত্ব তো দূরের কথা, প্রাসাদ কিংবা দরবারেও স্থান হবে না, তেইশির ভ্রাতা (যাকে এরা বের করে দিয়েছিলেন) এখান থেকে তাড়িয়ে দেবেন। হত্যাও করতে পারেন।
শোশির একটা ছেলে থাকলে কোনো ফন্দিফিকির করে, দরবারের লোকজন ও সামুরাই সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব খাটিয়ে হেইয়ান কিয়োর এক লাখ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে তাকে সম্রাট করে ফেলা যেতো। সে সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। তাই এত আস্ফালন, এত আহাজারী, এত উত্তাপ এবং একে অন্যের প্রতি এত দোষারোপ।
রিনশি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন, ওঝাঁ, বদ্যি, চিকিৎসক, শ্রাইন, প্যাগোডা সব ঠিক আছে, সমস্যা অন্য জায়গায়।
কোথায়?
রিনশি মিচিনাগার কাছে সরে এসে আস্তে আস্তে সমস্যার কথা বললেন।
কেন? তার সমস্যা কি?
সমস্যা করেছে তেইশি। সন্তান নষ্ট হবার পর সম্রাট তাকে কথা দিয়েছে, ও সন্তান সম্ভবা না হওয়া পর্যন্ত সম্রাটের বিছানায় অন্য কোনো সম্রাজ্ঞী বা স্ত্রী যাবে না।
সর্বনাশ! সে কথা আগে বলোনি কেন?
সেও আমাকে কী আর বলেছে?
এত চেষ্টা তদ্বিরের এই হাল?
আপনি ভাববেন না। আমি আশাবাদী।
এখন তোমরা আশাবাদী হয়ে তেইশির পুত্র সন্তানই দেখো। একজন না হলে আরেকজন সম্রাট হবে, তাও দেখো।
তার ছেলে হবে, একথা আপনাকে কে বলেছে?
সময় খারাপ হলে তাই হবে।
সম্রাট বেশ খুশি। তিনি তার কথা রাখতে পেরেছেন। তাই উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বললেন। তেইশির দরবারে আনন্দের বন্যা। মিচিনাগা এই উৎসবের আয়োজনে মূল দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। শোনাগন বললেন, এই প্রাসাদে যত উৎসব হয়েছে, এবার সবগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।
সম্রাটের দরবারে উৎসব অনুষ্ঠান বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগের প্রধান এখন ইঝোমির বাবা। তার ওপর একজন মন্ত্রীও রয়েছেন। মিচিনাগা মন্ত্রীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। তা নিতান্ত সম্রাটের ব্যক্তিগত বিষয় বলে ধৈর্য ধারণ করতে পরামর্শ দিলেন উৎসব মন্ত্রী।
অনুষ্ঠানটা শুরু হয়ে গেল। লোক দেখানো আগ্রহ নিয়ে এসে সবাই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। এখানেও প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগাই নিয়ন্ত্রক এবং প্রধান ব্যক্তি। তিনি যেন শুরুতেই আনন্দের অনুষ্ঠানেও প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিলেন। শুধু ব্যর্থতা এক জায়গায় কন্যাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারেননি, হতে পারেননি মাতামহ।
শোশির দরবার অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুখে হাসি নেই। তেইশির দরবারের লেডিদের উচ্ছ্বাসে এরা যেন নিষ্প্রভ। কিন্তু এদের পক্ষে অনুষ্ঠান ত্যাগ করা সম্ভব নয়, কষ্ট হজম করা ছাড়া। তেইশি মনে মনে হাসছেন, আর বলছেন, অপরিপক্বের দল।
ইমন অবশ্য মানিয়ে নিয়েছেন। তার দুশ্চিন্তা হলো মহামান্যাকে আবার ভুল বুঝিয়ে কেউ উত্তেজিত করে তোলে কিনা। তা হলে সর্বনাশ হবে। তার দৃষ্টি সাইশির দিকে। তাকে তৎপর হতে দেখলেই এগিয়ে যাবেন তিনি সম্রাজ্ঞীর পাশে।
দামি পোশাকে সজ্জিত শোনাগন বাতিক গ্রস্থের মতো উৎসবমুখর হলেও মুরাসাকি তা নিয়ে মাথা ঘামান না। এছাড়া তিনি এরকম উৎসবকে অর্থহীন মনে করেন। কারণ তাকে একজন চিকিৎসক বলেছেন, এ সময় তেইশির সন্তান নেয়া ঠিক হয়নি, ফল ভালো নাও হতে পারে, সন্তানটি গর্ভপাতে নষ্ট হয়। মুরাসাকি কাউকে তা বলেননি, সম্রাজ্ঞী শোশি বা ইমনকেও নয়। এছাড়া এ বিষয়টি নিয়ে কেন এরা দলবদ্ধভাবে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়েছে তাও বুঝতে পারছেন না। এটা তার কাছে একটি অনাবশ্যক কাজ।
অনাবশ্যক কাজে তাকে সঙ্গে পাচ্ছেন না বলে কোনো কোনো লেডি তার সমালোচনা করছেন। তাকে আত্মঅহংকারী এবং কাটাযুক্ত বলে মন্দ বলছেন। ইমন তাদের থামানোর চেষ্টা করছেন। এটা শোশির দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি বাম দিকে ঘুরে জানতে চাইলেন। ইমনরা তা চেপে গেলেন।
আগে প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে ইঝোমি এসব অনুষ্ঠানে রাজপ্রাসাদে এলেও এখন প্রিন্স অতসুমিচির সঙ্গে আসেন না, প্রিন্সের প্রিন্সেসই আসেন। ইঝোমি যেন প্রেমের জন্য সত্যিই সমাজচ্যুত হয়ে গেছেন। তাকে কোনো রাজকীয় অনুষ্ঠানেই দেখা যায় না। এটা কোনো পাপবোধের জন্য হচ্ছে কিনা কে জানে। তিনি অবশ্য সামাজিক সমালোচনা এবং পাপানুভূতিকে কমই পাত্তা দেন। প্রিন্সের বাইরেও শোশির দরবারের লেডি হিসেবে তিনি যোগ দিতে পারেন, সে পদ এখনো বহাল আছে। তবে তার কাছে সবসময়ই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা অর্থহীন মনে হয়েছে। রাজকীয় উৎসবে সেই ছোটবেলায়ও তাকে ছেলেবন্ধুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
উৎসবের পরের দিনের কথা। সম্রাজ্ঞী শোশি মুরাসাকিকে নিয়ে বসলেন। কারণ হলো তিনি সম্রাটের বাম দিকে এবং তেইশি বসেছিলেন ডানদিকে। তেইশির এক লেডি-ইন-ওয়েটিং তেইশির সঙ্গে অমার্জিত একটি চীনা শব্দ ব্যবহার করে কথা বলেন। তাতে মনে হলো তেইশির ব্যাপারটায় অহংকার আরো বৃদ্ধি পায়। তা কি এবং কেন, তিনি তা বুঝতে পারলেন না, এ নিয়ে কথা বলতে চান।
তেইশির দরবারে চীনাভাষার ব্যবহার আছে সম্রাজ্ঞী তাও জানেন। হেইয়ান প্রাসাদে চীনা ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটা স্ববিরোধী অবস্থা বিরাজ করছে। সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারে তা সদর্পে বিরাজ করছে- যদিও ভুলে ভরা এবং অগোছালো সে ভাষা। সম্রাটের দরবারের তা না জানার কথা নয়।
মুরাসাকিকে এই প্রেক্ষাপটে রীতিমতো চীনা ভাষার ক্লাশ করতে হলো। শোশি সব বাদ দিয়ে ভাষা শিক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন।
চীনা ভাষাটা সহজ নয় বেশ কঠিন। তাকে বার বার বুঝাতে হয়। মুরাসাকির ধৈর্য রয়েছে। তিনি বেশ আন্তরিকও। সম্রাজ্ঞী শব্দটা মনে করতে পারলেন না। ভাব অর্থ তাই জানা গেল না। এতে লাভ হল এই যে, মুরাসাকির এই ছাত্রীটি ক্লাশে নিয়মিত হয়ে গেলেন।
সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে ফিরে এসে মুরাসাকি আবার লেখা নিয়ে বসলেন। কিন্তু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। লেডি সেনশির কথা মনে হচ্ছে। তিনি কি আসলেই লেখাকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছেন? এটাতো সত্য যে, ভোগের বিপরীতে আছে দুঃখ এবং যন্ত্রণা। কিন্তু মানুষ যে যন্ত্রটা চায়, যে অনৈতিক ভোগাকাক্সক্ষার শাস্তি চায়, শাস্তি তো প্রকৃত অর্থে তা নয়। তিনি নৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন, তার দৃষ্টিতে তাই সঠিক। ‘গেঞ্জি’ শাস্তি পাবে, তা আরোপিত হবে না, তবে নিয়তি নির্ধারিত। সে দিকেই গল্প আগাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না ভুলটা কোথায় হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবেই লেখা এগিয়ে নেবেন। (ক্রমশ...)