লম্বা হাত
গোলাম কিবরিয়া পিনু
হাতটা এত লম্বা হয়ে গেল!
দৈর্ঘ্যে ছিল ছোট
তা হঠাৎ লম্বা হয়ে গেল;
মনে হলো তা-আঙুলফুলে কলাগাছ!
যে-হাতে রাখেনি কেউ হাত
সেই হাতে হাত মেলানোর কাতরতা!
কী এক ম্যাজিক!
একসাথে দুটো হাত লম্বা হয়ে গেল!
তার স্তুতিপাঠে কতজন কী নিমগ্ন!
তার চকচকে বাড়ির বাইরেও ভিড়-
স্বর্ণকাররাও অলংকার তৈরি করে নিয়ে বসে আছে,
দর্জিরাও নানা ধরনের জামা নিয়ে উপস্থিত!
তার হাত স্পর্শ করতে না পারলেও-
পায়েয় ধুলোর জন্য কতজনের কী অধীরতা!
তার লম্বা হাত কোথায় না স্পর্শ করতে পারে?
কারো কারো গোপনাঙ্গেও!
সে কথাটা গোপন থাকছে না!
আছে শুধু শূন্যতা
(আমার প্রয়াত মা’কে নিবেদন)
হাইকেল হাশমী
তুমি চলে যাবার পর-
আত্মায় নেমে এসেছে গভীর শূন্যতা, গাঢ় শূন্যতা,
শূন্যতা যার কোন রং নেই আর নেই কোন আভা।
অদৃশ্য শূন্যতার চাদর
ঢেকে রেখেছে আমার সমস্ত অস্তিত্ব,
নিছিদ্র শূন্যতা, নিষ্ঠুর শূন্যতা, আত্মঘাতী শূন্যতা।
তুমি চলে যাবার পর-
শব্দহারা গল্প, কবিতা, গান
বিরাজ করে শুধু গভীর মৌনতা,
সব শব্দ হয়েছে আকৃতিহীন আর দিশেহারা
এখন নিঃশব্দ শব্দ আঁকে মনের আকাশে অদৃশ্য ইতিকথা
সারা অস্তিত্ব জুড়ে রয়েছে শূন্যতা আর খাঁ খাঁ শূন্যতা।
তুমি চলে যাবার পর-
কবিতার সব অক্ষর নিয়েছে স্বেচ্ছা নির্বাসন
গল্পের ভাবনা সবই তো এখন পথহারা
সংগীতর লয়, সুর, তাল সবই ছিন্নছাড়া
ছবির ক্যানভাস ফাঁকা
সব রঙে মিশে আছে মহাশূন্যতা।
তুমি চলে যাবার পর-
দেখো আমার হয়েছে কী যে দশা?
কবিচিরন্তনের চিত্রনাট্য
জামিরুল শরীফ
ভাষা ও ছন্দের স্বরূপে হেঁটে যাই
অপূর্ব ঐশ্বর্যের কী অক্লান্ত পথ,
সম্মুখে সম্ভাবনার অবাধ প্রান্তর
গন্তব্যের শেষ কিংবা পরিণতির
পূর্বাভাস নেই। অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তির
মধ্যে দিয়ে প্রত্যুষের অনিশ্চয়তা
ছেড়ে, যখনমাত্র সকালের আত্মস্থ
আলোয় এসে দাঁড়ালাম-
দেখি, প্রতিভার অভাবনীয় উদ্ভব, সাহিত্যিকের
মহত্ত্ব প্রকাশের সুসময় ভাষার শৈশাবস্থায়
মহাকবিদের আবির্ভাব লগ্নসাপেক্ষ লীলাভূমি-
সফোক্লিস, লুক্রিশিয়াস, শেকসপিয়র,
গ্যেটে, কালিদাস, মাইকেল- এতজন
মহাকবি-প্রত্যেকে আসরে নেমেছিলেন;
বিশ্বকে মাতিয়েছিলেন তাঁদের স্ব স্ব ভাষার
বিরল রচনাশক্তির প্রাখর্যে, সেসবই ছিল
এপিক বা মহাকাব্য, ট্রাজেডি ও কমেডি,
চারণাভূমির চিত্রময় বর্ণাত্মক কাব্যগাথা, তীক্ষ্ণ
ব্যঞ্জনাময় শোকগাথা; বার্ধক্যের স্থবিরতা ছিলো কাল্পনাতীত,
সাহিত্যরচনায় গতানুগতিক শাসন তখনও অনারদ্ধ-
কবি-বৈচিত্র্যের পথ্য সংগ্রহে নেমে দেখি-
সাহিত্যের প্রহপতি-রত্নাকরেরা
একেকজন বিশ্ববান্ধব মহাকবি।
তাঁদের জয়যাত্রায় বিশ্ব-প্রকৃতি
কেবল ভাবের উপাদানে নির্মিত নয়,
রোমানযুগের কাব্যতত্ত্বের নিশানা
আছে, আছে দূরাগত মহাকর্ষের
দৌরাত্ম্য আর দৈবযোগ-
মহাকবিরা কবিতাকে চিরন্তনের অট্টালিকায়
ওঠালেন, বিশ্বও অমিত নয়, সেই অসীমের
তারায় তারায় ঘোষিত হয়ে চলেছে শ্রেষ্ঠত্বের
বিকীরণ। ঘটনার ঘুরন্ত চাকার অত্যাশ্চর্য গুণে
মহাকবিদের বিগতপ্রাণের আগমন যেমন বাঞ্ছনীয়, তেমনি
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যুর খতিয়ান
ওই ঘটনাচক্রের পুনরাবৃত্তি।
ছাইভস্মরা
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
পুড়ে যাওয়া আকাশের ভস্মগুলো উড়ে যাচ্ছে কাল হতে কালান্তরে
ভস্মরা অনন্তে গিয়ে জড়ো হতে থাকে কুরুক্ষেত্রের মহাসমরের রণব্যুহের মতো।
কে নেই সেখানে!
একদিকে আছে দ্বাদশ শতকে বখতিয়ার খিলজির হাতে দগ্ধ হওয়া
নালন্দার নব্বই হাজার অমূল্য গ্রন্থের পোড়া ছাই
আছে রামুর সীমা বিহারের দুশো বছরের
পুরানো পুঁথির পবিত্র ভস্ম
নাসিরনগরের রসরাজ-কাণ্ডের ভস্মেরা
দাঁড়িয়ে আছে সটান সপ্রতিভতায়
যশোরের অভয়নগর কিংবা গঙ্গাচরার টিটু-অধ্যায়ের ভস্মও তাতে পিছিয়ে নেই
পিছিয়ে নেই দিনাজপুরের সনাতনী ভস্মের ছোট্ট দলটিও
ক্রমশ তাতে মিছিল নিয়ে যোগ দিচ্ছে আরও নতুন নতুন ভস্ম
এইমাত্র উড়ে এলো ফেণী, চৌমুহনী আর রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপল্লির ব্রাত্য ভস্মগুলো
জলদাস পিতার জমানো টাকার ভস্মরাও যোগ দিয়েছে শেখ মুজিবের ছাই হওয়া ছবিসহ
যোগ দিয়েছে ফরিদগঞ্জের গুপ্টি গ্রামের অরক্ষিত ভস্মেরা
রামঠাকুরের সমাধি হতে ভস্মরা জেগে গিয়ে উড়তে উড়তে এইমাত্র যুক্ত হলো সমাবেশে
উখিয়ার বৌদ্ধ বিহারের অঙ্গার হওয়া প্রার্থনার বেদীও এসেছে মার্চপাস্ট করতে করতে
ছাইভস্মের লোকোত্তর সমাবেশে জননী দুর্গার পোড়ামুখের
ভস্ম এসে বোধনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে গেলো সমরের সমাবেশে
কিছুক্ষণ পরেই শোনা গেল জলদমন্দ্র কণ্ঠে স্রষ্টার গায়েবী বাণী-
ছাইভস্মেরা!
বলো তোমাদের অন্তিম অভিযোগ- আমি শুনি।
সমরমঞ্চে সমবেত ভস্মরা বলে উঠল সমস্বরে-
হে মহান স্রষ্টা!
তুমি মহাধোঁকা খেয়েছ মানুষ নির্মাণে
নকল খোলসে মানুষ বানাতে গিয়ে তুমি বানিয়ে ফেলেছো মর্ত্যকে পশুর বিচরণভূমি
এখনও সময় আছে
পারলে মানুষ বানাও! মানুষ!
রক্তাক্ত শারদ
শাহেদ কায়েস
বাতাসে মন ভাঙা আর্তনাদ
আগুনে ভেসে যায় উৎসব
ভয়ার্ত চোখের নোনা আর-
বৃষ্টির নোনায় একাকার সব
আগুনের সৌন্দর্যে ব্যস্ত সবাই
পাশে দাঁড়াবে এমন মানুষ কই!
ঘৃণার শিখা বিশ্বাস কাঁপায়
আজীবন আতঙ্ক নিয়ে-
বেড়ে উঠবে যে শিশুটি, তার
চোখে কীভাবে তাকাবে তুমি!
আর্দ্র হয়ে ওঠে চোখ ও হৃদয়
‘পুড়ছি আমিও তোমায়- সঙ্গে নিয়ে’।
ফরিদা-প্রতিমা
ফরিদা ইয়াসমিন সুমি
মানুষ-পোড়া গন্ধ
আগুনের লেলিহানে,
পুড়ছে ঘর, বিছানা-তোষক
চালের মটকা, তেলের বোতল
নেড়ে দেয়া শাড়ি
জমানো কিছু টাকা,
রতন, যতীন, পূজা-প্রতিমারা
পুড়ে খাঁক হয়, মায়ের সিঁদুর।
এদিকে ভাঙে মন্দির
ওদিকেতে মসজিদ
ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যায়
ফরিদা-ফাতিমার মন
আমীরের বাহুবল!
মানুষের আগে ধর্ম ছিল না কোনো
অমানুষের হাতে ধর্ম-খড়্গ নাচে-
কাটা যায় নাক
কাটা যায় কান
ফরিদা-প্রতিমার
ধর থেকে উদর
নিষ্প্রাণ সদর!
প্রতিপক্ষ সূর্য
শিবলী কায়সার
ইচ্ছে ডানায় ভেসে মন আজ জেমস হতে চায়
“আরো কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু?”
গান গেয়ে হবে না তো কোনো ব্যত্যয়
তাকে চলে যেতে হবে, হলে সূর্যোদয়।
এ নিশুতি রাতে সূর্যই প্রধান প্রতিপক্ষ
তার সাথে আরো কিছু কথা হতে
হলে, আটকাতে হবে সূর্যের কক্ষ।
চক্রবলয়
সুমন বনিক
অন্তর নীল হয়ে যায় বিষাদের বিষে
কষ্টের শিশির ঝুলে থাকে ধানের শিষে,
ঘোর-অমায় ভাসে জোসনামাতাল রাত
ইশারায় ডাকে ঐ অতল আঁধার খাদ।
নীড় ছেড়ে ডানামেলে অচিন এক পাখি
বর্ষার অঝোর ধারা কাজলরেখা আঁখি,
চরচরে বালুচর শূন্য মরূদ্যান
কাচহৃদয় চুরচুর; ভেঙে খানখান!
হলুদবনে মুঞ্জরিত সবুজপত্র
সে জীবন মুখরিত আবার যত্রতত্র,
ধূসর ক্যানভাসে আবির ছড়ানো দিন;
থেকে যায় আবেগমাখা কিছু কিছু ঋণ
বিপুল বেহাগ
অনুপমা অপরাজিতা
অথৈ নীলিমায় শরৎ আসে কার্পাস আকাশ
ধরে। লেপ্টে থাকা প্রণয় না ফেরা থেকে যায়
বোধের আর্দ্রতায় নিজেকে আড়াল করি,
মূল্যবান পরিধেয় নরনারী আপাত দৃষ্টিতে
সৌম্যকান্ত। সৌভাগ্যের সিঁড়ি খুঁজতে ব্যস্ত সবাই
নিখুঁত কংক্রিটের ভাঁজে ভাঁজে। নিসর্গ নগরায়নে
মানুষগুলোও যেন প্রাণহীন অন্তর্গত ক্ষয়িষ্ণু কশেরুকা।
একবারও না হেরে পুরোটুকু জেতায় মত্ত,
বঞ্চিত মানুষগুলো একা হতে থাকে বারবার।
ময়েইশ্চারাইজারে রাখা বোধগুলো নিঃস্ব হতে থাকে আমারও!
রিক্ততা নিয়ে পিপাসার্ত হরিণীর মতো লাফিয়ে
জলাধার খুঁজি। সমুদ্র কাছে থেকে
সমুদ্র দূরে চলে যায় লোনাজল বয়ে বয়ে বহুদূর
শিল্পী পাখি বাবুইয়ের মতো মস্তিষ্কের পরতগুলো
বুনতে থাকি। দূর্বাঘাস বনফুলের মতো অযত্নেও
বেঁচে উঠি কতোবার। বরফের গোলার ওপরে থেকেও
হাতড়াতে থাকি ঘুঙুরের শব্দ। গানে গানে সেই
ব্রতপাঠ তুমি যা শুনিয়েছিলে বিস্ময়ে অনিবার।
শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১
লম্বা হাত
গোলাম কিবরিয়া পিনু
হাতটা এত লম্বা হয়ে গেল!
দৈর্ঘ্যে ছিল ছোট
তা হঠাৎ লম্বা হয়ে গেল;
মনে হলো তা-আঙুলফুলে কলাগাছ!
যে-হাতে রাখেনি কেউ হাত
সেই হাতে হাত মেলানোর কাতরতা!
কী এক ম্যাজিক!
একসাথে দুটো হাত লম্বা হয়ে গেল!
তার স্তুতিপাঠে কতজন কী নিমগ্ন!
তার চকচকে বাড়ির বাইরেও ভিড়-
স্বর্ণকাররাও অলংকার তৈরি করে নিয়ে বসে আছে,
দর্জিরাও নানা ধরনের জামা নিয়ে উপস্থিত!
তার হাত স্পর্শ করতে না পারলেও-
পায়েয় ধুলোর জন্য কতজনের কী অধীরতা!
তার লম্বা হাত কোথায় না স্পর্শ করতে পারে?
কারো কারো গোপনাঙ্গেও!
সে কথাটা গোপন থাকছে না!
আছে শুধু শূন্যতা
(আমার প্রয়াত মা’কে নিবেদন)
হাইকেল হাশমী
তুমি চলে যাবার পর-
আত্মায় নেমে এসেছে গভীর শূন্যতা, গাঢ় শূন্যতা,
শূন্যতা যার কোন রং নেই আর নেই কোন আভা।
অদৃশ্য শূন্যতার চাদর
ঢেকে রেখেছে আমার সমস্ত অস্তিত্ব,
নিছিদ্র শূন্যতা, নিষ্ঠুর শূন্যতা, আত্মঘাতী শূন্যতা।
তুমি চলে যাবার পর-
শব্দহারা গল্প, কবিতা, গান
বিরাজ করে শুধু গভীর মৌনতা,
সব শব্দ হয়েছে আকৃতিহীন আর দিশেহারা
এখন নিঃশব্দ শব্দ আঁকে মনের আকাশে অদৃশ্য ইতিকথা
সারা অস্তিত্ব জুড়ে রয়েছে শূন্যতা আর খাঁ খাঁ শূন্যতা।
তুমি চলে যাবার পর-
কবিতার সব অক্ষর নিয়েছে স্বেচ্ছা নির্বাসন
গল্পের ভাবনা সবই তো এখন পথহারা
সংগীতর লয়, সুর, তাল সবই ছিন্নছাড়া
ছবির ক্যানভাস ফাঁকা
সব রঙে মিশে আছে মহাশূন্যতা।
তুমি চলে যাবার পর-
দেখো আমার হয়েছে কী যে দশা?
কবিচিরন্তনের চিত্রনাট্য
জামিরুল শরীফ
ভাষা ও ছন্দের স্বরূপে হেঁটে যাই
অপূর্ব ঐশ্বর্যের কী অক্লান্ত পথ,
সম্মুখে সম্ভাবনার অবাধ প্রান্তর
গন্তব্যের শেষ কিংবা পরিণতির
পূর্বাভাস নেই। অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তির
মধ্যে দিয়ে প্রত্যুষের অনিশ্চয়তা
ছেড়ে, যখনমাত্র সকালের আত্মস্থ
আলোয় এসে দাঁড়ালাম-
দেখি, প্রতিভার অভাবনীয় উদ্ভব, সাহিত্যিকের
মহত্ত্ব প্রকাশের সুসময় ভাষার শৈশাবস্থায়
মহাকবিদের আবির্ভাব লগ্নসাপেক্ষ লীলাভূমি-
সফোক্লিস, লুক্রিশিয়াস, শেকসপিয়র,
গ্যেটে, কালিদাস, মাইকেল- এতজন
মহাকবি-প্রত্যেকে আসরে নেমেছিলেন;
বিশ্বকে মাতিয়েছিলেন তাঁদের স্ব স্ব ভাষার
বিরল রচনাশক্তির প্রাখর্যে, সেসবই ছিল
এপিক বা মহাকাব্য, ট্রাজেডি ও কমেডি,
চারণাভূমির চিত্রময় বর্ণাত্মক কাব্যগাথা, তীক্ষ্ণ
ব্যঞ্জনাময় শোকগাথা; বার্ধক্যের স্থবিরতা ছিলো কাল্পনাতীত,
সাহিত্যরচনায় গতানুগতিক শাসন তখনও অনারদ্ধ-
কবি-বৈচিত্র্যের পথ্য সংগ্রহে নেমে দেখি-
সাহিত্যের প্রহপতি-রত্নাকরেরা
একেকজন বিশ্ববান্ধব মহাকবি।
তাঁদের জয়যাত্রায় বিশ্ব-প্রকৃতি
কেবল ভাবের উপাদানে নির্মিত নয়,
রোমানযুগের কাব্যতত্ত্বের নিশানা
আছে, আছে দূরাগত মহাকর্ষের
দৌরাত্ম্য আর দৈবযোগ-
মহাকবিরা কবিতাকে চিরন্তনের অট্টালিকায়
ওঠালেন, বিশ্বও অমিত নয়, সেই অসীমের
তারায় তারায় ঘোষিত হয়ে চলেছে শ্রেষ্ঠত্বের
বিকীরণ। ঘটনার ঘুরন্ত চাকার অত্যাশ্চর্য গুণে
মহাকবিদের বিগতপ্রাণের আগমন যেমন বাঞ্ছনীয়, তেমনি
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যুর খতিয়ান
ওই ঘটনাচক্রের পুনরাবৃত্তি।
ছাইভস্মরা
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
পুড়ে যাওয়া আকাশের ভস্মগুলো উড়ে যাচ্ছে কাল হতে কালান্তরে
ভস্মরা অনন্তে গিয়ে জড়ো হতে থাকে কুরুক্ষেত্রের মহাসমরের রণব্যুহের মতো।
কে নেই সেখানে!
একদিকে আছে দ্বাদশ শতকে বখতিয়ার খিলজির হাতে দগ্ধ হওয়া
নালন্দার নব্বই হাজার অমূল্য গ্রন্থের পোড়া ছাই
আছে রামুর সীমা বিহারের দুশো বছরের
পুরানো পুঁথির পবিত্র ভস্ম
নাসিরনগরের রসরাজ-কাণ্ডের ভস্মেরা
দাঁড়িয়ে আছে সটান সপ্রতিভতায়
যশোরের অভয়নগর কিংবা গঙ্গাচরার টিটু-অধ্যায়ের ভস্মও তাতে পিছিয়ে নেই
পিছিয়ে নেই দিনাজপুরের সনাতনী ভস্মের ছোট্ট দলটিও
ক্রমশ তাতে মিছিল নিয়ে যোগ দিচ্ছে আরও নতুন নতুন ভস্ম
এইমাত্র উড়ে এলো ফেণী, চৌমুহনী আর রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপল্লির ব্রাত্য ভস্মগুলো
জলদাস পিতার জমানো টাকার ভস্মরাও যোগ দিয়েছে শেখ মুজিবের ছাই হওয়া ছবিসহ
যোগ দিয়েছে ফরিদগঞ্জের গুপ্টি গ্রামের অরক্ষিত ভস্মেরা
রামঠাকুরের সমাধি হতে ভস্মরা জেগে গিয়ে উড়তে উড়তে এইমাত্র যুক্ত হলো সমাবেশে
উখিয়ার বৌদ্ধ বিহারের অঙ্গার হওয়া প্রার্থনার বেদীও এসেছে মার্চপাস্ট করতে করতে
ছাইভস্মের লোকোত্তর সমাবেশে জননী দুর্গার পোড়ামুখের
ভস্ম এসে বোধনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে গেলো সমরের সমাবেশে
কিছুক্ষণ পরেই শোনা গেল জলদমন্দ্র কণ্ঠে স্রষ্টার গায়েবী বাণী-
ছাইভস্মেরা!
বলো তোমাদের অন্তিম অভিযোগ- আমি শুনি।
সমরমঞ্চে সমবেত ভস্মরা বলে উঠল সমস্বরে-
হে মহান স্রষ্টা!
তুমি মহাধোঁকা খেয়েছ মানুষ নির্মাণে
নকল খোলসে মানুষ বানাতে গিয়ে তুমি বানিয়ে ফেলেছো মর্ত্যকে পশুর বিচরণভূমি
এখনও সময় আছে
পারলে মানুষ বানাও! মানুষ!
রক্তাক্ত শারদ
শাহেদ কায়েস
বাতাসে মন ভাঙা আর্তনাদ
আগুনে ভেসে যায় উৎসব
ভয়ার্ত চোখের নোনা আর-
বৃষ্টির নোনায় একাকার সব
আগুনের সৌন্দর্যে ব্যস্ত সবাই
পাশে দাঁড়াবে এমন মানুষ কই!
ঘৃণার শিখা বিশ্বাস কাঁপায়
আজীবন আতঙ্ক নিয়ে-
বেড়ে উঠবে যে শিশুটি, তার
চোখে কীভাবে তাকাবে তুমি!
আর্দ্র হয়ে ওঠে চোখ ও হৃদয়
‘পুড়ছি আমিও তোমায়- সঙ্গে নিয়ে’।
ফরিদা-প্রতিমা
ফরিদা ইয়াসমিন সুমি
মানুষ-পোড়া গন্ধ
আগুনের লেলিহানে,
পুড়ছে ঘর, বিছানা-তোষক
চালের মটকা, তেলের বোতল
নেড়ে দেয়া শাড়ি
জমানো কিছু টাকা,
রতন, যতীন, পূজা-প্রতিমারা
পুড়ে খাঁক হয়, মায়ের সিঁদুর।
এদিকে ভাঙে মন্দির
ওদিকেতে মসজিদ
ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যায়
ফরিদা-ফাতিমার মন
আমীরের বাহুবল!
মানুষের আগে ধর্ম ছিল না কোনো
অমানুষের হাতে ধর্ম-খড়্গ নাচে-
কাটা যায় নাক
কাটা যায় কান
ফরিদা-প্রতিমার
ধর থেকে উদর
নিষ্প্রাণ সদর!
প্রতিপক্ষ সূর্য
শিবলী কায়সার
ইচ্ছে ডানায় ভেসে মন আজ জেমস হতে চায়
“আরো কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু?”
গান গেয়ে হবে না তো কোনো ব্যত্যয়
তাকে চলে যেতে হবে, হলে সূর্যোদয়।
এ নিশুতি রাতে সূর্যই প্রধান প্রতিপক্ষ
তার সাথে আরো কিছু কথা হতে
হলে, আটকাতে হবে সূর্যের কক্ষ।
চক্রবলয়
সুমন বনিক
অন্তর নীল হয়ে যায় বিষাদের বিষে
কষ্টের শিশির ঝুলে থাকে ধানের শিষে,
ঘোর-অমায় ভাসে জোসনামাতাল রাত
ইশারায় ডাকে ঐ অতল আঁধার খাদ।
নীড় ছেড়ে ডানামেলে অচিন এক পাখি
বর্ষার অঝোর ধারা কাজলরেখা আঁখি,
চরচরে বালুচর শূন্য মরূদ্যান
কাচহৃদয় চুরচুর; ভেঙে খানখান!
হলুদবনে মুঞ্জরিত সবুজপত্র
সে জীবন মুখরিত আবার যত্রতত্র,
ধূসর ক্যানভাসে আবির ছড়ানো দিন;
থেকে যায় আবেগমাখা কিছু কিছু ঋণ
বিপুল বেহাগ
অনুপমা অপরাজিতা
অথৈ নীলিমায় শরৎ আসে কার্পাস আকাশ
ধরে। লেপ্টে থাকা প্রণয় না ফেরা থেকে যায়
বোধের আর্দ্রতায় নিজেকে আড়াল করি,
মূল্যবান পরিধেয় নরনারী আপাত দৃষ্টিতে
সৌম্যকান্ত। সৌভাগ্যের সিঁড়ি খুঁজতে ব্যস্ত সবাই
নিখুঁত কংক্রিটের ভাঁজে ভাঁজে। নিসর্গ নগরায়নে
মানুষগুলোও যেন প্রাণহীন অন্তর্গত ক্ষয়িষ্ণু কশেরুকা।
একবারও না হেরে পুরোটুকু জেতায় মত্ত,
বঞ্চিত মানুষগুলো একা হতে থাকে বারবার।
ময়েইশ্চারাইজারে রাখা বোধগুলো নিঃস্ব হতে থাকে আমারও!
রিক্ততা নিয়ে পিপাসার্ত হরিণীর মতো লাফিয়ে
জলাধার খুঁজি। সমুদ্র কাছে থেকে
সমুদ্র দূরে চলে যায় লোনাজল বয়ে বয়ে বহুদূর
শিল্পী পাখি বাবুইয়ের মতো মস্তিষ্কের পরতগুলো
বুনতে থাকি। দূর্বাঘাস বনফুলের মতো অযত্নেও
বেঁচে উঠি কতোবার। বরফের গোলার ওপরে থেকেও
হাতড়াতে থাকি ঘুঙুরের শব্দ। গানে গানে সেই
ব্রতপাঠ তুমি যা শুনিয়েছিলে বিস্ময়ে অনিবার।