alt

সাময়িকী

পদাবলি : হেমন্ত প্রান্তরে

: রোববার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

সরণি
কামাল চৌধুরী

বাড়ি ফিরতে দেরি হলো; তুমি বললে ‘এটা বাড়ি নয়’
কেনো নয়? এ তো বাড়ি! ত্রিভুবন কুয়াশার গ্রাম?
হেমন্তে এসেছি আমি- পূর্ণ চাঁদ, কার্তিকের পথে
এখন আলোককণা ছুটতে ছুটতে বরফের দেশে
কাতর, অচেনা রাতে। সব বাড়ি বাড়ি নয় আজ।
পথেই স্মরণযোগ্য বুড়ো আংলা বটগাছ আছে
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে তেমাথায়; বোবা হেরিটেজ!
কতো কথা হলো পাখি, কতো ধার, ঋণ শোধ বাকি
কার বাকি? - শেকড়ে বাকড়ে লেখা এসব হিসেব।
ইস্টিশানে চা খেয়েছি- উবে গেছে চায়ের গরম
দুয়ারে দুয়ারে আজ খুঁজে ফিরছি গরম কাঁথাকে
কোনটা বাড়ির পথ? এখানে তো খোলা মাঠ ছিল
নাকি জাংলা, ধানক্ষেত? আমি বুঝি আগন্তুক কেউ।
এখানে ছিলাম কবে? এই প্রশ্নে নিরুত্তরকাল
অচেনা বাড়ির মুখে মধ্যরাতে কুয়াশায় ভেজা...
হেরিটেজ, বুড়োবট- একমাত্র জাগর সরণি।

খালি ঘর ধূলিঢাকা
শিহাব সরকার

দরজা খুলতে হয় সেই পুরনো অভ্যাসে
ঘরে স্মৃতির কূপে তলিয়ে যেতে যেতে ...
ফাঁকা উঠানে জমেছে হেমন্তের হিম
আসবাব ধূলিঢাকা, ছবিতে কুয়াশা

ঘাসফুল ফুটেছে শুধু বালিকাদের কারণে।
ব্রাত্যেরা কোন দূরে যায়, কীভাবে যায়
ভিড়ের হল্লায় স্মার্টফোন ট্যাব হাতে বিদেশিনী
একা হেঁটে যায় ধূলিপথে, মন উচাটন
ওদেশে হেমন্তের মাঠে তুষারঝড়।

সকল ছদ্মবেশ উড়ে যায় হিম বাতাসে
হেমন্তের মধ্যরাতে ঘোরকুয়াশায়
বসে ছিলাম আমি সন্ন্যাসীর পদ্মাসনে
কাঁথায় শিশু কাঁদে, কপালে চাঁদটিপ।

কান্না শেষে গহীনের বন উথালপাথাল
স্মৃতিরা সব ফাঁস, মায়াবী তন্তু
ভোরের রোদে বন-বনান্ত সব মিথ্যা,
ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত ফিরে আসা খোলা দুয়ারে,

ভিতরে সবই শূন্য, ইঁদুরে জমানো ধান
খালি ঘর ধূলিঢাকা, বিষণ্ন হাসেন কবি।

নিদানকাল
মাসুদ খান

সার ধরে এগোচ্ছে শিশুরা, হাজামের দিকে।
জমকালো পাগড়ি-পরা, দেখতে যমদূতের মতো, বছির হাজাম।
একজন একজন করে কাছে যাচ্ছে যেই,
অমনি মুখে ইষ্টনাম নিয়ে চোখ মুদে ফেলছে ভয়ে।

বাড়িটির ভাষ্য
রাজা হাসান

তোমাদের বাড়ির ছায়াময় ঝাকড়া গাছগুলো বিষাদে জড়ানো,
শ্যাওলার প্রচ্ছন্নতা বাড়িটিকে নির্জনতায় ডুবিয়ে রাখে।
কুয়াশার স্বীকারোক্তির সঙ্গে হয়তো বাড়িটিকে
মিলিয়ে দেয়া যেতো।
আমাদের বিচ্ছিন্নতা কোনো সান্ধ্যভাষ্য তৈরি করেনি,
যাকে কবিতার জন্য অনিবার্য করে তোলা যায়।
বাড়িটির জানালাগুলোর অবলোকন মনখারাপের শুরু,
ক্রমশ ঘুম ঘুম অনুরণন।
হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য থেকে গানের অন্তরা
কিছুতেই সরিয়ে রাখা গেলো না।
গুমরানো অস্বস্তিগুলো যে বিবৃতি রচনা করে,
তার ধারাবাহিকতায় বাড়িটির প্রাসঙ্গিকতা
জ্যোৎস্নায় হরিণের ত্রস্ত জলপান...

কার্তিক-সন্ধ্যায়
খালেদ হামিদী

ম্যামথের ভিড়ে ঢুকে কোন্ স্বরে আদিম পুরুষ ডাকে?
উচ্চ, মধ্য, নিম্ন ধ্বনির বিভ্রান্তির বাঁকে
গেলে ধরা খেয়ে নিরুপায়রূপে খাদ্যে বদলে যায়
আরও কতো ষাঁড়, গাভি, মেষ, ছাগ, শশক কি মৃগ হায়!
পশুর স্বরাণুকরণে ওভাবে মানবকণ্ঠে গান
উৎপত্তির ইতিহাস শুনে জুড়ায় কার সে প্রাণ?

মৃগীর করোটি মুখে পরে কেউ হরিণ শিকারে মাতে?
ক্ষুধা, কৌশল আরণ্যদের উৎরালে সঙ্গীতে
মানবীমুখোশে মুখ ঢেকে নর চায় কি নিকটে নারী?
না জেনে মরদ পাখি সুরে ডাকে সখীদের তাড়াতাড়ি।

সব সত্ত্বেও রই বসে একা বৃক্ষে হেলান দিয়ে।
দেখিনি কখন কার্তিক এসে সন্ধ্যা নামায়, মেয়ে!
জ্যোৎস্নায় পোড়ে গাছে গাছে পাতা, হয় না আমার খোঁজা।
আসছো তুমি কি দূর কাল হতে, শিরে শস্যের বোঝা?

হেমন্ত গান
তাপস গায়েন

এই অপস্রিয়মাণ অপরাহ্ণে, এই সঙ্গীতমুখর জলের প্রবাহে
ভেসে যায় প্রতিফলিত আকাশ, আর অনতিদূর দিগন্তের বর্ণিল পাহাড়
কে নির্ধারণ করে এই গতি, গতির ত্বরণ কিংবা মন্দনের অভিমুখ
জীবন শেষাবধি রয়ে গেল গ্রহের মতো অনির্ণীত, ভ্রাম্যমাণ; যদিও
বহুবর্ণের বৃক্ষরা স্বাধীন; তবে তাদের অস্তিত্বে নয়, বরং তাদের ব্যাপ্তিতে
মাধ্যাকর্ষণকে মান্য করে দ্বীপান্তরে পাখিরাও ব্যথিত স্বাধীন
অপ¯্রয়িমাণতা আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে,
লঘুসপ্তর্ষিম-লীর পথ ধরে আমার দৃষ্টি দীপ্যমান হতে চায়, কিন্তু
মহাজাগতিক ধূলি এসে আমাদের দিকভ্রান্ত করে!
অনতিদূর দিগন্তে বিস্তৃত পাহাড়ে মুখরিত বনাঞ্চল;
ক্যারোটিনয়েডে ব্যাপ্ত গাছের পাতা হলুদ, খয়েরি, কিংবা লাল
আর যা শ্রুতিগোচর তা হলো ধূমকেতুর নিঃশব্দ প্রস্থান...
আর তোমার অনুচ্চারিত ক্রন্দন...
স্বপ্নের গভীরে আমার হয়েছে মৃত্যু অনেক সহস্রবার
তবু পাতা ঝরার শব্দে জেগে উঠে দেখি
তোমার মুখাবয়ব মহাকালের মতো অদৃশ্যমান!

নাড়ার আগুন
মোহাম্মদ হোসাইন

খোলা পৃষ্ঠার মতো পড়ে থাকি
মাঝে মাঝে খোলামুখ, খোলাবুক
আঁধারকেও পড়ে ফেলা যায়
এমনকি অদেখা স্নায়ু, অদেখা তৃণমূল

ভালবাসা পাথরমুখী, ভালবাসা পোড়ামুখীও
যে যাকে ভালবাসে সে বড় লাজুক, সংকটে সংকটে
বিছিয়ে রেখেছি গালিচা, নুড়ি ও পাথর
তার কাছে আমরণ রয়ে যাই ফলিডল মলিডল

অঘ্রান এসে কড়া নেড়ে যায়
হেমন্তে, ধানের কাব্য লিখা হতে থাকে
ভাতঘুম শেষে জেগে ওঠে কবিতা
নাড়ার আগুনে ঝলসে ওঠে মুখ
পৃথিবী দেখা যায়!

তোমাকে ছাড়বে না, হেমন্ত
ওবায়েদ আকাশ

তানানা হরষে আর গাইতে পারি না গান
গান্ধর্ব কণ্ঠায় আর গাইবো না কোনোদিন
টানটান দ্বিধার চাদরে নিঃশেষিত হেমন্ত
জাগাতে জাগাতে ভোর হয়ে এলো

উদ্বেলিত শিশিরের ভার ঘনায়মান তামাটে হাওয়ায়
রূপনারায়নে ঝুপ করে স্নান সারবার মতো
ধানক্ষেতের কুয়াশা উজিয়ে দাঁড়াবার কালে
তুমি আজ হৃত, ক্ষিদেজর্জর কবি
তোমার সমগীত- সমাহিত অসাড় মলিন...

তবু দেখি নবান্ন এসেছে, ঋতু-
সাদা সাদা কাফনের ভাসা দাঁত
অসল নির্ভার ভরা মুখে অকাট সম্ভ্রান্ত হাসি

আতর লোবান বড়ইপাতা জল- তোমার কুৎসিত সম্বল-
কোঁদাল শাবল বাঁশের বুনন- বেআব্রু বিছানা-আদল
এই প্রথম অঘ্রান তোমাকে ধ্রুপদি শুভ্র বিয়ের শাড়িতে
সারাটি রাত্রি জাগিয়ে রেখেছি প্রেমে-
অযথায় তুমি জিতে যেতে পারো, বলা যায়-
তবু তোমাকে ছাড়বে না সুলতানপুর
মুয়াবিয়া, ওসমান, আলী ও উমর
ছেঁড়াদিগন্ত সন্তানের সাহস, সহিংস মায়া
সুধামানবীর বিপুল চিৎকার। যতই শুভ্রতা জানো হেমন্ত
তোমাকে ছাড়বে না তারা
প্রবল প্রতিরক্ষা নিও রাষ্ট্রের, কাটাকুটি বিষণœ সন্ধ্যায়

গাউগেরামের কবিতা
মুজিব ইরম

আমরা তো গাউগেরামের লোক...
মাকে আমরা মাই বলে ডাকতাম
বাবাকে বাবাজি...

মায়ের ছিলো হাঁসমুরগি
রান্নাঘর
পুত্রকন্যা...

বাবার ছিলো গোয়াল ভরা গরু
মাঠ ভরা ধান
পুকুর ভরা মাছ...

আমরা তো গাউগেরামের লোক...
বাবা যেন ধানি বিল, মা যেনবা পদ্মফোটা ঝিল।

সম্পর্কের চোখে আবছায়া ছানি
চয়ন শায়েরী

ঘরমুখো কাকের মতন

দ্রুত নেমে আসে সন্ধ্যা- অঘ্রানের চোখে আবছায়া ছানি- সম্পর্কের চোখে কুয়াশারহস্য;
তৃষা ছিল- ছিল মোহ; ঘোর ছিল- তবু ঘরমুখো তাড়া, ছন্নছাড়া কাটানো যায় কি জীবন? একাকী কাকের মতো ঘরে ফেরা;
কঠিন কথাও একদিন সহজে বলতে হয়- সব মুখোশের ওপাশেই এক মুখ আছে, সব মিথ্যার ওপারে সত্য থাকে, এ-ও সত্য যে, যে-ধ্রুপদী রহস্য ছিল, আমার প্রসঙ্গে- অঘ্রানের বিকেলের মতো, সন্ধ্যার কাকের মতো দ্রুত ঘরে ফেরা- তবু মন দূরযায়ী- তোমার আঁচলে বাঁধা, তা তুমিও জানো নি।
আমার মুখোশের ওপাশেই আমি ধ্রুপদী প্রেমিক- মননের ছানি ভেদ করে দেখতে পাও নি, দেখেছ কুয়াশারহস্য।

আইয়ো, এই হেমন্তে
ভাগ্যধন বড়–য়া

সন্ধ্যা দ্রুত হয় হেমন্তে, সূর্য মৃদু ঠাণ্ডার আদুরে ছোঁয়ায় লজ্জাবতী লতার মতো মুখ লুকাবে মাটিমুখি ভিন্ন গোলার্ধে! এমন সন্ধ্যায় খোলা মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো তালগাছটা জড়িয়ে কুয়াশা ঘনীভূত হয় আর আমার দৃষ্টিপথে সৃষ্টি করে অস্পষ্ট প্রাচীর। হেমন্তের এই কামার্ত হাওয়ায় তোমাকে বাসনা করি আর কল্পনায় নির্মাণ করি জড়াজড়ি ক্ষণ।
আইয়ো, সামনের শীতের আগেই ক’টা যৌথ দিন কাটাবো পাহাড়ি টঙঘরে, খাওয়াবো মাতামুহুরীর শোলমাছের ঝোল আর চরের বাতাসে বাড়ন্ত বোত্তা শাক।

বধূ আঁকে ধান-নকশি
জাফর সাদেক

বিয়ের প্রথম যামিনী, বধূর নামটি শুনি- ধান-খেয়ালি
শেষপ্রহরে বললো, লুকায়া আনতে পারবা পান্তার বাটি
ঘরের পাটখড়ির বেড়ার ফাঁক গলে বিকেলের রোদ
তার মুখে, গেরস্তালি শেষে বসেছে পান্তায়, দেহ ব্লাউজহীন
ভাবি, ও তো আমার পাহাড়-নদীর আঁকাবাঁকা সেই আশ্রম
চাইলে, হারিয়ে যেতে দেয় অতল উদাস মোহনায়

চৈত্রের ধানের খেতে রোদের জিহ্বায়
বসে থাকি বাবলাতলায়
জানি, ধান-সুন্দরী বেশে নেচে নেচে আসবে বধূ আমার
আসবে রোদের জিভ পাশ কাটিয়ে ধান-শিষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে গান
হাতের হাড়িতে ভাতের সৌরভ, পেছনে ফিঙের মাতাল দল
প্রতি দুপুরই ওর আঁচলে পাই উথালপাতাল আগরের বন

হেমন্তের জোছনায় ধান মাড়াইয়ের উঠোন
শুঁকি কাঁচা নাড়ার গন্ধ, দেখি ধনের গন্ধে ডোলের আড়াল
ইশারায় বধূর শিশিরভেজা স্তন
সন্ধের সুযোগে কোনও আঁধারে পুকুরপাড়, কিংবা বাঁশবন
নগ্ন ঊরুসন্ধিতে নামে চাঁদ- প্রতি ছন্দ তালে কাঁপে রাত
জোছনা-তরিতে কাঁপে চুম্বিত অধর, কাঁপে আমার ভাত-বউ

নতুন
মিলটন রহমান

ঘুঙুর বাজছে কোথাও, এই সোনালি সকালে বাজছে
ঘূর্ণির মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে জং ধরা হলুদাভ দিন
জলসার রুপোলি আলোয় আমি জেগে উঠছি মাতাল,
মন্দাকিনী তুমি নিজেকে আরো জলজ বিকর্ষিত করো
দেহের ভাঁজ থেকে উত্থিত আলোয় তুলে নাও অমসৃন
তোমার সম্মুখে সহস্র্র বছর বসে রইবো হে মথুরাদেবি।

ঘুঙুর আর মন্দাকিনী দুই মিলে এই সকালে হাসছে
ভাসছে তুমুল কুঞ্জাভিভূত টঙ্কাপতির সৌভিত দেরাজে
কোথায় কোন কালে জেগেছিলো নতুন নগর
সেই বার্তা এতোদিন জানানো হয়নি কোথাও
এই ভোরে নতুন নগর পত্তন করো হে মন্দাকিনী
মুছে দাও সকল পাপ ও পঙ্কিল রাষ্ট্রের নাম
নতুন নগর তোলো, মন্দাকিনী নগর
যেখানে শুধুই প্রেম রইবে, জেগে রইবে সোনালি ঘুঙুর।

হেমন্তের নাম দিয়েছি হস্তিনাপুর রাজসভা
আদিত্য নজরুল

হেমন্তকে আসতে দেখেছি দুর্যধনের বেশে।
উত্তরের হিমেল হাওয়া
স্বজনহৃদয়ে বেড়াতে আসে আমাদের গ্রামে
মুঠো করে নিয়ে আসে
শীও ও সন্ন্যাস।

হেমন্ত এলেই সকাল বেলায়
বালকের মতো শিশিরের শিশু
নারকেল পাতাকে কোশা নৌকা ভেবে
খেলতে খেলতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু আমার নিকট
হেমন্ত ঋতুকে-
বাংলার প্রান্তরকে হস্তিনাপুর রাজসভা মনে হয়;
পাশা খেলায় যেখানে
যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকেও বাজি রেখে হেরে যায়।

এবং দুর্যধনের হুংকারে
হেমন্ত ঋতুই
দ্রৌপদীর শাড়ি ভেবে খুলে ফেলে অরণ্যের বসন।

হেমন্ত এসে মিশে যায় শীতের শরীরে
মাহফুজ রিপন

পেয়ারি পাখির পালকে হেমন্ত আসে বাংলাদেশে
শ্বেত শুভ্রতায় শরতের আকাশ মলিন হয়ে ওঠে।
পাতা ঝরা বৈকালে মধ্য হেমন্তের আপন মহিমা
দেবচন্দন ছাতিম দইগোটা রাজঅশোক ফুটেছে।

ভোরের কুয়াশা ভেদ করে রুপোলি আলোর দেখা
হৈমন্তী দিন পালাবদলের গান গায় তারার মেলায়
কাস্তে হাতে মাঠে মাঠে জড়ো হয়- কিষান ভায়েরা
আমোদ ছড়িয়ে পড়ে ভরা ফসলের মাঠে, উঠোনে।
লাঙল জোয়াল ফেলে আমরা এখন নাগরিক মানুষ
কাচের ঘরের আরামে ষড়ঋতুর নামতা ভুলে গেছি।
পৃথিবীর ওজন স্তর ভারি হলো- মানুষের কৃতকর্মে
ডিজিটাল হেমন্ত এসে মিশে যায়- শীতের শরীরে।
টের পাই না প্রকৃতির কান্না হয়তো বুঝে ও বুঝি না!

হেমন্তে
হাদিউল ইসলাম

পিঠা বানানো হাতের প্রতিটা আঙুল
হাস্যোজ্জ্বল, উনুনের পাশে বসে দেখা
ঘোরলাগা তুরুপের তাস ছুঁড়ে দেওয়া পিঠা
তেলে ভাসছে বিভিন্ন সময়ে বিবিধ আদল
লোভাতুর, গোপন অরব শীৎকারে
এতো যে ম্যাজিক, এমন হেমন্তে-

নাড়ার আগুনে এতো উস্কানি, অবদমন
সবে তো শিশির ঝরেছে কাঁঠাল পাতা থেকে
কড়াইয়ে হাসছে তেল, রাঙাপ্রবণ পিঠার
জিল্লতি দেখে নতুন হৃদয় লতিয়ে উঠছে-
কুলগাছে আলোক লতার বিভা

উঠানে বাজছে রেডিও আহা বৃত্তের মধ্যমা
পল্লীগীতি আব্দুল আলীম, অথবা আব্বাস
অপূর্ণাঙ্গ চাঁদ সাধ্যমতো ছুঁড়ে দিচ্ছে নেপথ্য বেহাগ

ঘরহীন উপত্যকায়
শাহ বুলবুল

বিরাণ সভ্যতার নিচিহ্ন মোকাম
পরাজিত হেমন্তের খুব কাছে
বেহাত অন্ধকারে ডুবতে দেয়
গুমরে মরা অগণিত দুঃখের নিলাম।

মেঘঢাকা কার্তিকের নিঃস্ব আশ্রয়
বহুকাল চূড়ান্ত দখলের রোষানলে
এক যাযাবরী সংসারের কাছে
গচ্ছিত বৃষ্টির ধারাপাত হারিয়ে যায়।

পারাকাস দ্বীপে ফেরি করা স্বপ্নের
এক আকাশ চুমুতে কুঁকড়ে থাকা সুখ
খুঁজে নেয় হেমন্তের অচেনা উপকূল
ঘরছাড়া এক দুরারোগ্য সর্বনাশের পর।

ঘরহীন উপত্যকায় পুড়ে যাওয়া রাত
চিৎকার করে নিপীড়িত আত্মায়
আবার ফিরে আসুক কৃষাণির ধানে
মোয়ার পসরায় এক গুপ্তচর রাত।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

পদাবলি : হেমন্ত প্রান্তরে

রোববার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

সরণি
কামাল চৌধুরী

বাড়ি ফিরতে দেরি হলো; তুমি বললে ‘এটা বাড়ি নয়’
কেনো নয়? এ তো বাড়ি! ত্রিভুবন কুয়াশার গ্রাম?
হেমন্তে এসেছি আমি- পূর্ণ চাঁদ, কার্তিকের পথে
এখন আলোককণা ছুটতে ছুটতে বরফের দেশে
কাতর, অচেনা রাতে। সব বাড়ি বাড়ি নয় আজ।
পথেই স্মরণযোগ্য বুড়ো আংলা বটগাছ আছে
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে তেমাথায়; বোবা হেরিটেজ!
কতো কথা হলো পাখি, কতো ধার, ঋণ শোধ বাকি
কার বাকি? - শেকড়ে বাকড়ে লেখা এসব হিসেব।
ইস্টিশানে চা খেয়েছি- উবে গেছে চায়ের গরম
দুয়ারে দুয়ারে আজ খুঁজে ফিরছি গরম কাঁথাকে
কোনটা বাড়ির পথ? এখানে তো খোলা মাঠ ছিল
নাকি জাংলা, ধানক্ষেত? আমি বুঝি আগন্তুক কেউ।
এখানে ছিলাম কবে? এই প্রশ্নে নিরুত্তরকাল
অচেনা বাড়ির মুখে মধ্যরাতে কুয়াশায় ভেজা...
হেরিটেজ, বুড়োবট- একমাত্র জাগর সরণি।

খালি ঘর ধূলিঢাকা
শিহাব সরকার

দরজা খুলতে হয় সেই পুরনো অভ্যাসে
ঘরে স্মৃতির কূপে তলিয়ে যেতে যেতে ...
ফাঁকা উঠানে জমেছে হেমন্তের হিম
আসবাব ধূলিঢাকা, ছবিতে কুয়াশা

ঘাসফুল ফুটেছে শুধু বালিকাদের কারণে।
ব্রাত্যেরা কোন দূরে যায়, কীভাবে যায়
ভিড়ের হল্লায় স্মার্টফোন ট্যাব হাতে বিদেশিনী
একা হেঁটে যায় ধূলিপথে, মন উচাটন
ওদেশে হেমন্তের মাঠে তুষারঝড়।

সকল ছদ্মবেশ উড়ে যায় হিম বাতাসে
হেমন্তের মধ্যরাতে ঘোরকুয়াশায়
বসে ছিলাম আমি সন্ন্যাসীর পদ্মাসনে
কাঁথায় শিশু কাঁদে, কপালে চাঁদটিপ।

কান্না শেষে গহীনের বন উথালপাথাল
স্মৃতিরা সব ফাঁস, মায়াবী তন্তু
ভোরের রোদে বন-বনান্ত সব মিথ্যা,
ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত ফিরে আসা খোলা দুয়ারে,

ভিতরে সবই শূন্য, ইঁদুরে জমানো ধান
খালি ঘর ধূলিঢাকা, বিষণ্ন হাসেন কবি।

নিদানকাল
মাসুদ খান

সার ধরে এগোচ্ছে শিশুরা, হাজামের দিকে।
জমকালো পাগড়ি-পরা, দেখতে যমদূতের মতো, বছির হাজাম।
একজন একজন করে কাছে যাচ্ছে যেই,
অমনি মুখে ইষ্টনাম নিয়ে চোখ মুদে ফেলছে ভয়ে।

বাড়িটির ভাষ্য
রাজা হাসান

তোমাদের বাড়ির ছায়াময় ঝাকড়া গাছগুলো বিষাদে জড়ানো,
শ্যাওলার প্রচ্ছন্নতা বাড়িটিকে নির্জনতায় ডুবিয়ে রাখে।
কুয়াশার স্বীকারোক্তির সঙ্গে হয়তো বাড়িটিকে
মিলিয়ে দেয়া যেতো।
আমাদের বিচ্ছিন্নতা কোনো সান্ধ্যভাষ্য তৈরি করেনি,
যাকে কবিতার জন্য অনিবার্য করে তোলা যায়।
বাড়িটির জানালাগুলোর অবলোকন মনখারাপের শুরু,
ক্রমশ ঘুম ঘুম অনুরণন।
হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য থেকে গানের অন্তরা
কিছুতেই সরিয়ে রাখা গেলো না।
গুমরানো অস্বস্তিগুলো যে বিবৃতি রচনা করে,
তার ধারাবাহিকতায় বাড়িটির প্রাসঙ্গিকতা
জ্যোৎস্নায় হরিণের ত্রস্ত জলপান...

কার্তিক-সন্ধ্যায়
খালেদ হামিদী

ম্যামথের ভিড়ে ঢুকে কোন্ স্বরে আদিম পুরুষ ডাকে?
উচ্চ, মধ্য, নিম্ন ধ্বনির বিভ্রান্তির বাঁকে
গেলে ধরা খেয়ে নিরুপায়রূপে খাদ্যে বদলে যায়
আরও কতো ষাঁড়, গাভি, মেষ, ছাগ, শশক কি মৃগ হায়!
পশুর স্বরাণুকরণে ওভাবে মানবকণ্ঠে গান
উৎপত্তির ইতিহাস শুনে জুড়ায় কার সে প্রাণ?

মৃগীর করোটি মুখে পরে কেউ হরিণ শিকারে মাতে?
ক্ষুধা, কৌশল আরণ্যদের উৎরালে সঙ্গীতে
মানবীমুখোশে মুখ ঢেকে নর চায় কি নিকটে নারী?
না জেনে মরদ পাখি সুরে ডাকে সখীদের তাড়াতাড়ি।

সব সত্ত্বেও রই বসে একা বৃক্ষে হেলান দিয়ে।
দেখিনি কখন কার্তিক এসে সন্ধ্যা নামায়, মেয়ে!
জ্যোৎস্নায় পোড়ে গাছে গাছে পাতা, হয় না আমার খোঁজা।
আসছো তুমি কি দূর কাল হতে, শিরে শস্যের বোঝা?

হেমন্ত গান
তাপস গায়েন

এই অপস্রিয়মাণ অপরাহ্ণে, এই সঙ্গীতমুখর জলের প্রবাহে
ভেসে যায় প্রতিফলিত আকাশ, আর অনতিদূর দিগন্তের বর্ণিল পাহাড়
কে নির্ধারণ করে এই গতি, গতির ত্বরণ কিংবা মন্দনের অভিমুখ
জীবন শেষাবধি রয়ে গেল গ্রহের মতো অনির্ণীত, ভ্রাম্যমাণ; যদিও
বহুবর্ণের বৃক্ষরা স্বাধীন; তবে তাদের অস্তিত্বে নয়, বরং তাদের ব্যাপ্তিতে
মাধ্যাকর্ষণকে মান্য করে দ্বীপান্তরে পাখিরাও ব্যথিত স্বাধীন
অপ¯্রয়িমাণতা আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে,
লঘুসপ্তর্ষিম-লীর পথ ধরে আমার দৃষ্টি দীপ্যমান হতে চায়, কিন্তু
মহাজাগতিক ধূলি এসে আমাদের দিকভ্রান্ত করে!
অনতিদূর দিগন্তে বিস্তৃত পাহাড়ে মুখরিত বনাঞ্চল;
ক্যারোটিনয়েডে ব্যাপ্ত গাছের পাতা হলুদ, খয়েরি, কিংবা লাল
আর যা শ্রুতিগোচর তা হলো ধূমকেতুর নিঃশব্দ প্রস্থান...
আর তোমার অনুচ্চারিত ক্রন্দন...
স্বপ্নের গভীরে আমার হয়েছে মৃত্যু অনেক সহস্রবার
তবু পাতা ঝরার শব্দে জেগে উঠে দেখি
তোমার মুখাবয়ব মহাকালের মতো অদৃশ্যমান!

নাড়ার আগুন
মোহাম্মদ হোসাইন

খোলা পৃষ্ঠার মতো পড়ে থাকি
মাঝে মাঝে খোলামুখ, খোলাবুক
আঁধারকেও পড়ে ফেলা যায়
এমনকি অদেখা স্নায়ু, অদেখা তৃণমূল

ভালবাসা পাথরমুখী, ভালবাসা পোড়ামুখীও
যে যাকে ভালবাসে সে বড় লাজুক, সংকটে সংকটে
বিছিয়ে রেখেছি গালিচা, নুড়ি ও পাথর
তার কাছে আমরণ রয়ে যাই ফলিডল মলিডল

অঘ্রান এসে কড়া নেড়ে যায়
হেমন্তে, ধানের কাব্য লিখা হতে থাকে
ভাতঘুম শেষে জেগে ওঠে কবিতা
নাড়ার আগুনে ঝলসে ওঠে মুখ
পৃথিবী দেখা যায়!

তোমাকে ছাড়বে না, হেমন্ত
ওবায়েদ আকাশ

তানানা হরষে আর গাইতে পারি না গান
গান্ধর্ব কণ্ঠায় আর গাইবো না কোনোদিন
টানটান দ্বিধার চাদরে নিঃশেষিত হেমন্ত
জাগাতে জাগাতে ভোর হয়ে এলো

উদ্বেলিত শিশিরের ভার ঘনায়মান তামাটে হাওয়ায়
রূপনারায়নে ঝুপ করে স্নান সারবার মতো
ধানক্ষেতের কুয়াশা উজিয়ে দাঁড়াবার কালে
তুমি আজ হৃত, ক্ষিদেজর্জর কবি
তোমার সমগীত- সমাহিত অসাড় মলিন...

তবু দেখি নবান্ন এসেছে, ঋতু-
সাদা সাদা কাফনের ভাসা দাঁত
অসল নির্ভার ভরা মুখে অকাট সম্ভ্রান্ত হাসি

আতর লোবান বড়ইপাতা জল- তোমার কুৎসিত সম্বল-
কোঁদাল শাবল বাঁশের বুনন- বেআব্রু বিছানা-আদল
এই প্রথম অঘ্রান তোমাকে ধ্রুপদি শুভ্র বিয়ের শাড়িতে
সারাটি রাত্রি জাগিয়ে রেখেছি প্রেমে-
অযথায় তুমি জিতে যেতে পারো, বলা যায়-
তবু তোমাকে ছাড়বে না সুলতানপুর
মুয়াবিয়া, ওসমান, আলী ও উমর
ছেঁড়াদিগন্ত সন্তানের সাহস, সহিংস মায়া
সুধামানবীর বিপুল চিৎকার। যতই শুভ্রতা জানো হেমন্ত
তোমাকে ছাড়বে না তারা
প্রবল প্রতিরক্ষা নিও রাষ্ট্রের, কাটাকুটি বিষণœ সন্ধ্যায়

গাউগেরামের কবিতা
মুজিব ইরম

আমরা তো গাউগেরামের লোক...
মাকে আমরা মাই বলে ডাকতাম
বাবাকে বাবাজি...

মায়ের ছিলো হাঁসমুরগি
রান্নাঘর
পুত্রকন্যা...

বাবার ছিলো গোয়াল ভরা গরু
মাঠ ভরা ধান
পুকুর ভরা মাছ...

আমরা তো গাউগেরামের লোক...
বাবা যেন ধানি বিল, মা যেনবা পদ্মফোটা ঝিল।

সম্পর্কের চোখে আবছায়া ছানি
চয়ন শায়েরী

ঘরমুখো কাকের মতন

দ্রুত নেমে আসে সন্ধ্যা- অঘ্রানের চোখে আবছায়া ছানি- সম্পর্কের চোখে কুয়াশারহস্য;
তৃষা ছিল- ছিল মোহ; ঘোর ছিল- তবু ঘরমুখো তাড়া, ছন্নছাড়া কাটানো যায় কি জীবন? একাকী কাকের মতো ঘরে ফেরা;
কঠিন কথাও একদিন সহজে বলতে হয়- সব মুখোশের ওপাশেই এক মুখ আছে, সব মিথ্যার ওপারে সত্য থাকে, এ-ও সত্য যে, যে-ধ্রুপদী রহস্য ছিল, আমার প্রসঙ্গে- অঘ্রানের বিকেলের মতো, সন্ধ্যার কাকের মতো দ্রুত ঘরে ফেরা- তবু মন দূরযায়ী- তোমার আঁচলে বাঁধা, তা তুমিও জানো নি।
আমার মুখোশের ওপাশেই আমি ধ্রুপদী প্রেমিক- মননের ছানি ভেদ করে দেখতে পাও নি, দেখেছ কুয়াশারহস্য।

আইয়ো, এই হেমন্তে
ভাগ্যধন বড়–য়া

সন্ধ্যা দ্রুত হয় হেমন্তে, সূর্য মৃদু ঠাণ্ডার আদুরে ছোঁয়ায় লজ্জাবতী লতার মতো মুখ লুকাবে মাটিমুখি ভিন্ন গোলার্ধে! এমন সন্ধ্যায় খোলা মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো তালগাছটা জড়িয়ে কুয়াশা ঘনীভূত হয় আর আমার দৃষ্টিপথে সৃষ্টি করে অস্পষ্ট প্রাচীর। হেমন্তের এই কামার্ত হাওয়ায় তোমাকে বাসনা করি আর কল্পনায় নির্মাণ করি জড়াজড়ি ক্ষণ।
আইয়ো, সামনের শীতের আগেই ক’টা যৌথ দিন কাটাবো পাহাড়ি টঙঘরে, খাওয়াবো মাতামুহুরীর শোলমাছের ঝোল আর চরের বাতাসে বাড়ন্ত বোত্তা শাক।

বধূ আঁকে ধান-নকশি
জাফর সাদেক

বিয়ের প্রথম যামিনী, বধূর নামটি শুনি- ধান-খেয়ালি
শেষপ্রহরে বললো, লুকায়া আনতে পারবা পান্তার বাটি
ঘরের পাটখড়ির বেড়ার ফাঁক গলে বিকেলের রোদ
তার মুখে, গেরস্তালি শেষে বসেছে পান্তায়, দেহ ব্লাউজহীন
ভাবি, ও তো আমার পাহাড়-নদীর আঁকাবাঁকা সেই আশ্রম
চাইলে, হারিয়ে যেতে দেয় অতল উদাস মোহনায়

চৈত্রের ধানের খেতে রোদের জিহ্বায়
বসে থাকি বাবলাতলায়
জানি, ধান-সুন্দরী বেশে নেচে নেচে আসবে বধূ আমার
আসবে রোদের জিভ পাশ কাটিয়ে ধান-শিষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে গান
হাতের হাড়িতে ভাতের সৌরভ, পেছনে ফিঙের মাতাল দল
প্রতি দুপুরই ওর আঁচলে পাই উথালপাতাল আগরের বন

হেমন্তের জোছনায় ধান মাড়াইয়ের উঠোন
শুঁকি কাঁচা নাড়ার গন্ধ, দেখি ধনের গন্ধে ডোলের আড়াল
ইশারায় বধূর শিশিরভেজা স্তন
সন্ধের সুযোগে কোনও আঁধারে পুকুরপাড়, কিংবা বাঁশবন
নগ্ন ঊরুসন্ধিতে নামে চাঁদ- প্রতি ছন্দ তালে কাঁপে রাত
জোছনা-তরিতে কাঁপে চুম্বিত অধর, কাঁপে আমার ভাত-বউ

নতুন
মিলটন রহমান

ঘুঙুর বাজছে কোথাও, এই সোনালি সকালে বাজছে
ঘূর্ণির মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে জং ধরা হলুদাভ দিন
জলসার রুপোলি আলোয় আমি জেগে উঠছি মাতাল,
মন্দাকিনী তুমি নিজেকে আরো জলজ বিকর্ষিত করো
দেহের ভাঁজ থেকে উত্থিত আলোয় তুলে নাও অমসৃন
তোমার সম্মুখে সহস্র্র বছর বসে রইবো হে মথুরাদেবি।

ঘুঙুর আর মন্দাকিনী দুই মিলে এই সকালে হাসছে
ভাসছে তুমুল কুঞ্জাভিভূত টঙ্কাপতির সৌভিত দেরাজে
কোথায় কোন কালে জেগেছিলো নতুন নগর
সেই বার্তা এতোদিন জানানো হয়নি কোথাও
এই ভোরে নতুন নগর পত্তন করো হে মন্দাকিনী
মুছে দাও সকল পাপ ও পঙ্কিল রাষ্ট্রের নাম
নতুন নগর তোলো, মন্দাকিনী নগর
যেখানে শুধুই প্রেম রইবে, জেগে রইবে সোনালি ঘুঙুর।

হেমন্তের নাম দিয়েছি হস্তিনাপুর রাজসভা
আদিত্য নজরুল

হেমন্তকে আসতে দেখেছি দুর্যধনের বেশে।
উত্তরের হিমেল হাওয়া
স্বজনহৃদয়ে বেড়াতে আসে আমাদের গ্রামে
মুঠো করে নিয়ে আসে
শীও ও সন্ন্যাস।

হেমন্ত এলেই সকাল বেলায়
বালকের মতো শিশিরের শিশু
নারকেল পাতাকে কোশা নৌকা ভেবে
খেলতে খেলতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু আমার নিকট
হেমন্ত ঋতুকে-
বাংলার প্রান্তরকে হস্তিনাপুর রাজসভা মনে হয়;
পাশা খেলায় যেখানে
যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকেও বাজি রেখে হেরে যায়।

এবং দুর্যধনের হুংকারে
হেমন্ত ঋতুই
দ্রৌপদীর শাড়ি ভেবে খুলে ফেলে অরণ্যের বসন।

হেমন্ত এসে মিশে যায় শীতের শরীরে
মাহফুজ রিপন

পেয়ারি পাখির পালকে হেমন্ত আসে বাংলাদেশে
শ্বেত শুভ্রতায় শরতের আকাশ মলিন হয়ে ওঠে।
পাতা ঝরা বৈকালে মধ্য হেমন্তের আপন মহিমা
দেবচন্দন ছাতিম দইগোটা রাজঅশোক ফুটেছে।

ভোরের কুয়াশা ভেদ করে রুপোলি আলোর দেখা
হৈমন্তী দিন পালাবদলের গান গায় তারার মেলায়
কাস্তে হাতে মাঠে মাঠে জড়ো হয়- কিষান ভায়েরা
আমোদ ছড়িয়ে পড়ে ভরা ফসলের মাঠে, উঠোনে।
লাঙল জোয়াল ফেলে আমরা এখন নাগরিক মানুষ
কাচের ঘরের আরামে ষড়ঋতুর নামতা ভুলে গেছি।
পৃথিবীর ওজন স্তর ভারি হলো- মানুষের কৃতকর্মে
ডিজিটাল হেমন্ত এসে মিশে যায়- শীতের শরীরে।
টের পাই না প্রকৃতির কান্না হয়তো বুঝে ও বুঝি না!

হেমন্তে
হাদিউল ইসলাম

পিঠা বানানো হাতের প্রতিটা আঙুল
হাস্যোজ্জ্বল, উনুনের পাশে বসে দেখা
ঘোরলাগা তুরুপের তাস ছুঁড়ে দেওয়া পিঠা
তেলে ভাসছে বিভিন্ন সময়ে বিবিধ আদল
লোভাতুর, গোপন অরব শীৎকারে
এতো যে ম্যাজিক, এমন হেমন্তে-

নাড়ার আগুনে এতো উস্কানি, অবদমন
সবে তো শিশির ঝরেছে কাঁঠাল পাতা থেকে
কড়াইয়ে হাসছে তেল, রাঙাপ্রবণ পিঠার
জিল্লতি দেখে নতুন হৃদয় লতিয়ে উঠছে-
কুলগাছে আলোক লতার বিভা

উঠানে বাজছে রেডিও আহা বৃত্তের মধ্যমা
পল্লীগীতি আব্দুল আলীম, অথবা আব্বাস
অপূর্ণাঙ্গ চাঁদ সাধ্যমতো ছুঁড়ে দিচ্ছে নেপথ্য বেহাগ

ঘরহীন উপত্যকায়
শাহ বুলবুল

বিরাণ সভ্যতার নিচিহ্ন মোকাম
পরাজিত হেমন্তের খুব কাছে
বেহাত অন্ধকারে ডুবতে দেয়
গুমরে মরা অগণিত দুঃখের নিলাম।

মেঘঢাকা কার্তিকের নিঃস্ব আশ্রয়
বহুকাল চূড়ান্ত দখলের রোষানলে
এক যাযাবরী সংসারের কাছে
গচ্ছিত বৃষ্টির ধারাপাত হারিয়ে যায়।

পারাকাস দ্বীপে ফেরি করা স্বপ্নের
এক আকাশ চুমুতে কুঁকড়ে থাকা সুখ
খুঁজে নেয় হেমন্তের অচেনা উপকূল
ঘরছাড়া এক দুরারোগ্য সর্বনাশের পর।

ঘরহীন উপত্যকায় পুড়ে যাওয়া রাত
চিৎকার করে নিপীড়িত আত্মায়
আবার ফিরে আসুক কৃষাণির ধানে
মোয়ার পসরায় এক গুপ্তচর রাত।

back to top