alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : বার

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

: রোববার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

শিল্পী : সমর মজুমদার

(পূর্ব প্রকাশের পর)

কায়েদে আযম মারা গিয়েছেন বহুত বছর আগে। তারপরও তাঁর নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমোদিত হয়। গ্রামের লোকদের পাকিস্তান প্রীতি দেখে তারা মুগ্ধ। তবে তাদের কমান্ডার সাবধান থাকে, তাদের নিজেদের পাহারা আরো জোরদার করে। বাঙালিদের কোনো বিশ্বাস নেই। যে চাষা ক্ষেতের আইলে বন্দুক লুকিয়ে রেখে হালচাষ করছে সেও সুযোগ পেলেই বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছে পাকিস্তানি সৈন্যদর দিকে। যে ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে তার থলেতেও যে একটা বোমা নেই তার নিশ্চয়তা কোথায়? সাবধানের মার নেই, অতএব সাবধান থাকাই ভালো।

গ্রামের লোকদেরকে কে বুদ্ধি দিয়েছিল রাতে মিছিল করার? যে-ই দিয়ে থাক এটি বেশ কাজ দিয়েছিল। কারণ, রাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়নি।

আমার মা ধানের গোলা থেকে নেমে এসে কখন যে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েছে জানি না। কতক্ষণ আর চোখ খোলা রাখা যায়। শেষ রাতের দিকে বাবাও বাড়িতে ফিরে আসলেন। রাতে যেহেতু কোনো কিছু ঘটে নাই সেহেতু আমরা কিছুটা নিরাপদ বোধ করি। আর বোধ হয় জ্বালাওপোড়াও হবে না। ভিতর থেকে ভয়টাও কিছুটা কমে যায়।

সকালে সাহস করে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হই। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে রঙ্গু চাচার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। রঙ্গু চাচার উঠানে বেশ কিছু মানুষের ভিড়। ভিড় দেখে আমার সাহস আরও একটু বেড়ে যায়। আমি ভিড়ের দিকে এগিয়ে যাই। দেখি ভিড়ের আকার গোলাকার। আর সেই গোলাকার বৃত্তের ভিতরে জল চৌকিতে বসে আছে দুই পাকিস্তানি সেনা। সেনাগুলো শুধু শুধু বসে নেই। তারা বেশ আয়েশ করে ডাব খাচ্ছে। বাড়ির ঘাটাতে বেশ উঁচু নারিকেল গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখি গাছের মাথায় আর কোনো নারিকেল কিংবা কোনো ডাব নেই। সেনাদের বখেদমতে সবগুলো নারিকেল আর ডাব পেড়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। সেনাগুলো বেশ আমোদেই মনে হলো। তারা কিছুটা রসিকতা করছিল। এক ছোট ন্যাংটার নুনু ধরে একটু টানাটানিও করল। আমরা হাসিতে ফেটে পড়ি। নিজেদের ইয়েতে অজাস্তেই হাত দিয়ে ধরে রাখি যাতে সেনারা আবার আমেদের ইয়েতে হাত দিয়ে না বসে। ডাব খাওয়া শেষ। এবার তারা উঠে পড়লো। পকেট থেকে বের করল কিছু টাকা। সে টাকা ডাবের মালিক রঙ্গু চাচাকে সাধল। রঙ্গু চাচা টাকা নেয়? দুদিকে মাথা নেড়ে রঙ্গু চাচা টাকা নিতে প্রচ- অনীহা প্রকাশ করে। সৈন্যগুলো দেখল রঙ্গু চাচা কোনো অবস্থাই টাকা নেবে না তখন টাকাগুলো আমরা যারা ছোট ছিলাম আমাদের মাঝে বিলিয়ে দিল। আমার ভাগে পড়ল দুই টাকা না এক টাকার একটা নোট। আট আনা দিয়ে তখন এক সের চাল পাওয়া যেতো। সে হিসেবে টাকাটা নিতান্ত ফেলনা ছিল না। আমি বেশ কিছুদিন টাকাটা আমার সংগ্রহে রাখি।

বাড়িতে ফিরে এসে দেখি আমাদের উঠোনে দুই সৈন্য। বাড়িতে মা আছেন কিন্তু বাবা নেই। আশে পাশে কোথায় কোথায় যেনো গিয়েছেন। উঠোনে দাঁড়িয়ে তারা কী যেনো একটা কিছু বলছে। কোনো দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সৈনিক দুটি ঘরের দিকে রওয়ানা দিল। মা সৈন্যদেরকে দেখেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। ভেজানো খিড়কি দিয়ে মা দেখলেন সৈনিক দুটি দরজার দিকে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এরা দরজার কাছে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মা তখন হতবুদ্ধি। কী করবেন! হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি এলো। উত্তর দিকের দরোজা দিয়ে পালাবেন। করলেনও তাই। মা সৈন্য দুটির চেখকে ফাঁকি দিয়ে পাশের রৌশন আলি চাচাদের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। সেখানে গিয়ে রৌশন আলি চাচার মা যাকে আমরা লক্ষ্মীপুরের দাদি বলে ডাকতাম তাকে পাঠালেন। কী চায় সৈন্যরা? মা এও বলে দিলেন এদেরকে যেনো মটকি থেকে কিছু চাল দেয়া হয়। মার কেনো মনে হলো সৈন্যদের চাল দেয়া দরকার আল্লাহ মালুম। দাদি কথা মতো সৈন্যদেরকে সের দুয়কে চাল দিল একটা গামছায় করে। অবাক কা-, সৈন্যরা আনন্দের সাথেই সে চাল গ্রহণ করল। চাল নিয়েই তারা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

আমার সাদা বড় মোরগটা তখন উঠোনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার কয়েকজন রাণীকে নিয়ে। সৈন্য দুটির দৃষ্টি আটকে যায় মোরগটার ওপর। আশে পাশে যারা ছিল সবাইকে ডাকল সৈন্য দুটি। সৈন্যদের ডাকে বেশ কয়েক চলে আসে। তারা হুকুম দেয় মোরগটাকে ধরার জন্য। হুকুম পেয়ে লোকজন আমার মোরগটার চারিদিকে একটা রিং তৈরি করে, মানব রিং। আমার বুক কাঁপতে থাকে। আমার প্রিয় মোরগটাকে এরা ধরে মেরে ফেলবে? কীভাবে মারবে? বন্দুক দিয়ে গুলি করে? হঠাৎ আমার মনে হলো না, এরা গুলি করে মোরগটাকে মারবে না। গুলি করে মারার ইচ্ছে থাকলে তো সরাসরি গুলিই করত। ধরে জবাই করে রান্না করে খাবে। আমাদের বাড়ির চাল দিয়ে আমারই প্রিয় মোরগের মাংস দিয়ে এরা ভাত খাবে! লক্ষ্মীপুরের দাদির উপর আমার রাগ লাগে। সে কেনো সৈন্য দুটিকে চাল দিতে গেলো? চাল না দিলে তো তাদের মাংসের দরকার হতো না আর মাংসের দরকার না হলে আমার মোরগটার দিকে সৈন্যদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ত না। আমার প্রিয় মোরগ চিতা মিয়া। তার গায়ে সাদার উপর কালো ফুটফুটে দাগ। বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে সে। আমি যতœ করে ভাত খাওয়াই তাকে। মাঝে মাথে উর্তুঙ্গা আর তুরখোলা মাটির নিচ থেকে উঠিয়ে খাওয়াই। কারণ এগুলি খেলে মোরগ তাড়াতাড়ি বড়ো হয় আর মোরগের গায়ে প্রচুর শক্তি হয়। আমার আশা, মিয়া বাড়ির সবুজের মোরগের সাথে কোনো একদিন আমার চিতা মিয়া লড়বে এবং সবুজের হাসলি মোরগটাকে হারিয়ে দিয়ে গ্রামে নাম করবে। সবুজের হাসলির বড় বাড় বেড়েছে। কারও মোরগই হাসলিটার সাথে পেরে উঠছে না। সবুজ না কি হাসলির পায়ে মাথা কামানোর ব্লেড লাগিয়ে দেয় গোপনে। ফলে বিপক্ষের কোনো মোরগই সবুজের হাসলিটার সাথে পেরে উঠছে না। আমি আল্লাহর নাম জপতে থাকি। আল্লাহ আমার চিতা মিয়া যেনো ধরা না পড়ে। আমি নিজেও বৃত্তে গিয়ে দাঁড়াই। যদি আমার দিকে চিতা মিয়া আসে তবে আমি আমার পায়ের ফাঁক দিয়ে তাকে চলে যেতে দিব কপালে যাই থাকুক।

আমাদের বৃত্ত ছোট হতে থাকে। চিতা মিয়া টের পেয়ে যায় তাকে ধরার ষড়যন্ত্র চলছে। সে কক্ কক্ করে মাথা উঁচু করে চারিদিক দেখে নেয়। এদিকে সৈন্য দুটি অবিরাম আমাদেরকে নির্দেশনা আর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। চিতা মিয়া বৃত্তের ভিতরে চারিদিকে ঘুরছে। আমাদের বৃত্ত যত ছোট হয়ে আসছে চিতা মিয়ার বেগ তত বাড়ছে। আমাদের দলের নেতা সৈয়দ মিয়া ভাই। লম্বা চওড়ায় পাকিস্তানি সেনাদেরকেও হার মানায়। সে আমার চাচতো ভাই মেমি বু’ ছোট ভাই। তার উপরও আমার রাগ বেড়ে যায়। আমার চিতাকে ধরতে তার কেনো এতো আগ্রহ! পাকিস্তানি সৈন্যরা কি খাওয়ার সময় চিতা মিয়ার একটা টুকরা দিবে? না কি যাওয়ার সময় মুক্তি যোদ্ধা ভেবে তাকে ধরে নিয়ে যাবে?

চিতা মিয়াকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই বোধ হয়। কারণ সৈয়দ মিয়া ভাইয়ের প্রায় হাতের মুঠোতে চলে এসেছে চিতা মিয়া। হঠাৎ করে চিতা মিয়া উত্তর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর চোখের পলকে দিল এক উড়াল। সে কি উড়াল! এতো বড়ো শরীর নিয়ে সে প্রায় একশ গজ দূরে উত্তরের রাস্তায় গিয়ে পড়ল। আমার আনন্দ দেখে কে। আনন্দের আতিশয্যে আমি প্রায় হাততালি দিতে দুই হাত একত্র করতে যাই। একটি সৈনিকের চোখের অগ্নিদৃষ্টি দেখে আমার হুশ হয়। আমি মুখ বেজার করে দুঃখের ভান করি। অপর সৈনিকটি সৈয়দ মিয়া ভাইকে কাছে ডাকে। সৈয়দ মিয়া ভাই অপরাধী ভঙ্গিতে সৈনিকটির কাছে গেলে সৈনিকটি তার পশ্চাতে কষে এক লাথি মেরে বিজাতীয় ভাষায় গালি দেয়। লাথি আর গালি হজম করে সৈয়দ মিয়া ভাই আস্তে আস্তে সরে পড়ে, সাথে আমরাও।

গত ২৪ ঘণ্টায় বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে আমি বেঁচে যাই, আমার মা বেঁচে যান, বেঁচে যায় আমার প্রিয় পোষা মোরগ চিতা মিয়া। এসব নিয়ে এখন যখন ভাবী তখন মনে হয় এর সবগুলিই ছিল একেকটা অলৌকিক ঘটনা। আমরা কত অলৌকিক ঘটনা নিয়েই না বেঁচে আছি!

কিছুক্ষণের মধ্য একটা সুখবর বাতাসে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে ওরা। আমাদের বিশ্বাস হয় না। এরা যেখানে যায় সেখানকার মাটি তামা বানিয়ে ফেলে। এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ওরা? আমাদের এতো সৌভাগ্য? এরা গ্রামে ক্যাম্প করেছে, কামান ফিট করে রেখেছ। গ্রাম থেকে তাদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের পাড়ার বড় মিয়া দাদা তার ঘরের কয়েকটি গরু দিয়ে দিয়েছেন। সৈন্যরাও বোধহয় দুয়েকটা গরু এদিক ওদিক থেকে থেকে সংগ্রহ করেছে। চাল ডাল দেয়া হয়েছে তাদেরকে শান্ত রাখার জন্য। রাত থেকে এরা বেশ শান্ত আছে বলেই মনে হয়। বড়রা আশংকা করছে পরের দিন ওরা নতুন কোনো পরিকল্পনা আর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে মেতে উঠবে। সে ক্ষেত্রে কী করবেন তারা? মনে হয় করার কিছুই নেই। যা করার ওরাই করবে। গ্রামের মুক্তি যোদ্ধা ছেলেরা কোথায়? এরা কি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে? নামা উচিৎ? মনে হয় না। মুক্তি যোদ্ধার সংখ্যা অল্প আর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্রও তেমন বেশি আর আধুনিক নয়। চোরাগুপ্তা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রাম দুটি জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করবে।

নানা ধরনের আশংকা মানুষের মনে কাজ করছে। এ অবস্থায় পাক আর্মি চলে যাচ্ছে এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে।

বেশ কয়েকটা গরু জবাই হয়েছে, মাংসও কাটা হয়ে গেছে। মাটির চুলায় চাল ডাল আর সেই মাংস বসানো হয়েছে। কুয়াশায় ভিজে যাওয়া লাকড়ি কোনো রকমে জ্বলছে। তখনই কি চলে যাওয়ার নির্দেশ পায় পাকিস্তানি আর্মি? এরা মনে হয় আশা করেছিল এখানে বেশ বড় ধরনের একটা যুদ্ধ হবে। যুদ্ধ তো দূরের কথা সামান্য কোনো প্রতিরোধ কোথাও থেকে এলো না। যারা খবর দিয়ে এদেরকে এনেছিল তাদের উপর নিশ্চয়ই পাকিস্তানি আর্মিরা ক্ষেপে যায়। অহেতুক শক্তি ক্ষয় করার সামর্থ আর নেই তাদের। সারা দেশেই তারা মুক্তি বাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে। সুযোগ পেলে সাধারণ বাঙালিরাও যেনোতেনো ভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে পিটিয়ে মারছে। এ অবস্থায় যেখানে সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করার কোনো মানে হয় না।

চাল-ডাল মোটামুটি ফুটেছে কিন্তু মাংস তখনও অর্ধসিদ্ধ। তাদের হাতে সময় নেই। এ অবস্থায় অর্ধসিদ্ধ মাংসই পরিবেশনার নির্দেশ দেয়া হয়। কোনো রকমে কাচা মাংস খেয়ে সৈনিক দলটি পাততাড়ি গুটায়। যাওয়ার সময় কিছু কিছু জিনিসপত্র দিয়ে যায় গ্রামবাসীকে। কেউ পায় মশারি কেউ বা গরু। জিনিসগুলো অবশ্যই লুটের।

গ্রাম থেকে তাদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের পাড়ার বড় মিয়া দাদা তার ঘরের কয়েকটি গরু দিয়ে দিয়েছেন। সৈন্যরাও বোধহয় দুয়েকটা গরু এদিক ওদিক থেকে থেকে সংগ্রহ করেছে। চাল ডাল দেয়া হয়েছে তাদেরকে শান্ত রাখার জন্য। রাত থেকে এরা বেশ শান্ত আছে বলেই মনে হয়। বড়রা আশংকা করছে পরের দিন ওরা নতুন কোনো পরিকল্পনা আর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে মেতে উঠবে

সৈন্যরা মার্চ করে সারি বেঁধে যাচ্ছে। কিছু বাঙালিকে দেখা গেল তাদের গুলাগুলির বাক্সপেটরা পিঠে, মাথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা দূর থেকে বাড়িঘর, গাছ-পালার ফাঁক গলিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। কাছাকাছি যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। যদি গুলি করে দেয়।

সৈন্যদের গন্তব্য চৈয়ারকুড়ি বাজার। বাজার সংলগ্ন সিংড়া নদীতে রাখা হয়েছে তাদের লঞ্চ। সেখান থেকে কোথাও চলে যাবে। যেখানেই যাক, যাক আপদগুলো। আবার ফিরে না আসলেই হলো। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আপাতত বাঁচি। (ক্রমশ...)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক রচনা : বার

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

শিল্পী : সমর মজুমদার

রোববার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

(পূর্ব প্রকাশের পর)

কায়েদে আযম মারা গিয়েছেন বহুত বছর আগে। তারপরও তাঁর নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমোদিত হয়। গ্রামের লোকদের পাকিস্তান প্রীতি দেখে তারা মুগ্ধ। তবে তাদের কমান্ডার সাবধান থাকে, তাদের নিজেদের পাহারা আরো জোরদার করে। বাঙালিদের কোনো বিশ্বাস নেই। যে চাষা ক্ষেতের আইলে বন্দুক লুকিয়ে রেখে হালচাষ করছে সেও সুযোগ পেলেই বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছে পাকিস্তানি সৈন্যদর দিকে। যে ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে তার থলেতেও যে একটা বোমা নেই তার নিশ্চয়তা কোথায়? সাবধানের মার নেই, অতএব সাবধান থাকাই ভালো।

গ্রামের লোকদেরকে কে বুদ্ধি দিয়েছিল রাতে মিছিল করার? যে-ই দিয়ে থাক এটি বেশ কাজ দিয়েছিল। কারণ, রাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়নি।

আমার মা ধানের গোলা থেকে নেমে এসে কখন যে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েছে জানি না। কতক্ষণ আর চোখ খোলা রাখা যায়। শেষ রাতের দিকে বাবাও বাড়িতে ফিরে আসলেন। রাতে যেহেতু কোনো কিছু ঘটে নাই সেহেতু আমরা কিছুটা নিরাপদ বোধ করি। আর বোধ হয় জ্বালাওপোড়াও হবে না। ভিতর থেকে ভয়টাও কিছুটা কমে যায়।

সকালে সাহস করে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হই। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে রঙ্গু চাচার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। রঙ্গু চাচার উঠানে বেশ কিছু মানুষের ভিড়। ভিড় দেখে আমার সাহস আরও একটু বেড়ে যায়। আমি ভিড়ের দিকে এগিয়ে যাই। দেখি ভিড়ের আকার গোলাকার। আর সেই গোলাকার বৃত্তের ভিতরে জল চৌকিতে বসে আছে দুই পাকিস্তানি সেনা। সেনাগুলো শুধু শুধু বসে নেই। তারা বেশ আয়েশ করে ডাব খাচ্ছে। বাড়ির ঘাটাতে বেশ উঁচু নারিকেল গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখি গাছের মাথায় আর কোনো নারিকেল কিংবা কোনো ডাব নেই। সেনাদের বখেদমতে সবগুলো নারিকেল আর ডাব পেড়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। সেনাগুলো বেশ আমোদেই মনে হলো। তারা কিছুটা রসিকতা করছিল। এক ছোট ন্যাংটার নুনু ধরে একটু টানাটানিও করল। আমরা হাসিতে ফেটে পড়ি। নিজেদের ইয়েতে অজাস্তেই হাত দিয়ে ধরে রাখি যাতে সেনারা আবার আমেদের ইয়েতে হাত দিয়ে না বসে। ডাব খাওয়া শেষ। এবার তারা উঠে পড়লো। পকেট থেকে বের করল কিছু টাকা। সে টাকা ডাবের মালিক রঙ্গু চাচাকে সাধল। রঙ্গু চাচা টাকা নেয়? দুদিকে মাথা নেড়ে রঙ্গু চাচা টাকা নিতে প্রচ- অনীহা প্রকাশ করে। সৈন্যগুলো দেখল রঙ্গু চাচা কোনো অবস্থাই টাকা নেবে না তখন টাকাগুলো আমরা যারা ছোট ছিলাম আমাদের মাঝে বিলিয়ে দিল। আমার ভাগে পড়ল দুই টাকা না এক টাকার একটা নোট। আট আনা দিয়ে তখন এক সের চাল পাওয়া যেতো। সে হিসেবে টাকাটা নিতান্ত ফেলনা ছিল না। আমি বেশ কিছুদিন টাকাটা আমার সংগ্রহে রাখি।

বাড়িতে ফিরে এসে দেখি আমাদের উঠোনে দুই সৈন্য। বাড়িতে মা আছেন কিন্তু বাবা নেই। আশে পাশে কোথায় কোথায় যেনো গিয়েছেন। উঠোনে দাঁড়িয়ে তারা কী যেনো একটা কিছু বলছে। কোনো দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সৈনিক দুটি ঘরের দিকে রওয়ানা দিল। মা সৈন্যদেরকে দেখেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। ভেজানো খিড়কি দিয়ে মা দেখলেন সৈনিক দুটি দরজার দিকে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এরা দরজার কাছে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মা তখন হতবুদ্ধি। কী করবেন! হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি এলো। উত্তর দিকের দরোজা দিয়ে পালাবেন। করলেনও তাই। মা সৈন্য দুটির চেখকে ফাঁকি দিয়ে পাশের রৌশন আলি চাচাদের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। সেখানে গিয়ে রৌশন আলি চাচার মা যাকে আমরা লক্ষ্মীপুরের দাদি বলে ডাকতাম তাকে পাঠালেন। কী চায় সৈন্যরা? মা এও বলে দিলেন এদেরকে যেনো মটকি থেকে কিছু চাল দেয়া হয়। মার কেনো মনে হলো সৈন্যদের চাল দেয়া দরকার আল্লাহ মালুম। দাদি কথা মতো সৈন্যদেরকে সের দুয়কে চাল দিল একটা গামছায় করে। অবাক কা-, সৈন্যরা আনন্দের সাথেই সে চাল গ্রহণ করল। চাল নিয়েই তারা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

আমার সাদা বড় মোরগটা তখন উঠোনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার কয়েকজন রাণীকে নিয়ে। সৈন্য দুটির দৃষ্টি আটকে যায় মোরগটার ওপর। আশে পাশে যারা ছিল সবাইকে ডাকল সৈন্য দুটি। সৈন্যদের ডাকে বেশ কয়েক চলে আসে। তারা হুকুম দেয় মোরগটাকে ধরার জন্য। হুকুম পেয়ে লোকজন আমার মোরগটার চারিদিকে একটা রিং তৈরি করে, মানব রিং। আমার বুক কাঁপতে থাকে। আমার প্রিয় মোরগটাকে এরা ধরে মেরে ফেলবে? কীভাবে মারবে? বন্দুক দিয়ে গুলি করে? হঠাৎ আমার মনে হলো না, এরা গুলি করে মোরগটাকে মারবে না। গুলি করে মারার ইচ্ছে থাকলে তো সরাসরি গুলিই করত। ধরে জবাই করে রান্না করে খাবে। আমাদের বাড়ির চাল দিয়ে আমারই প্রিয় মোরগের মাংস দিয়ে এরা ভাত খাবে! লক্ষ্মীপুরের দাদির উপর আমার রাগ লাগে। সে কেনো সৈন্য দুটিকে চাল দিতে গেলো? চাল না দিলে তো তাদের মাংসের দরকার হতো না আর মাংসের দরকার না হলে আমার মোরগটার দিকে সৈন্যদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ত না। আমার প্রিয় মোরগ চিতা মিয়া। তার গায়ে সাদার উপর কালো ফুটফুটে দাগ। বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে সে। আমি যতœ করে ভাত খাওয়াই তাকে। মাঝে মাথে উর্তুঙ্গা আর তুরখোলা মাটির নিচ থেকে উঠিয়ে খাওয়াই। কারণ এগুলি খেলে মোরগ তাড়াতাড়ি বড়ো হয় আর মোরগের গায়ে প্রচুর শক্তি হয়। আমার আশা, মিয়া বাড়ির সবুজের মোরগের সাথে কোনো একদিন আমার চিতা মিয়া লড়বে এবং সবুজের হাসলি মোরগটাকে হারিয়ে দিয়ে গ্রামে নাম করবে। সবুজের হাসলির বড় বাড় বেড়েছে। কারও মোরগই হাসলিটার সাথে পেরে উঠছে না। সবুজ না কি হাসলির পায়ে মাথা কামানোর ব্লেড লাগিয়ে দেয় গোপনে। ফলে বিপক্ষের কোনো মোরগই সবুজের হাসলিটার সাথে পেরে উঠছে না। আমি আল্লাহর নাম জপতে থাকি। আল্লাহ আমার চিতা মিয়া যেনো ধরা না পড়ে। আমি নিজেও বৃত্তে গিয়ে দাঁড়াই। যদি আমার দিকে চিতা মিয়া আসে তবে আমি আমার পায়ের ফাঁক দিয়ে তাকে চলে যেতে দিব কপালে যাই থাকুক।

আমাদের বৃত্ত ছোট হতে থাকে। চিতা মিয়া টের পেয়ে যায় তাকে ধরার ষড়যন্ত্র চলছে। সে কক্ কক্ করে মাথা উঁচু করে চারিদিক দেখে নেয়। এদিকে সৈন্য দুটি অবিরাম আমাদেরকে নির্দেশনা আর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। চিতা মিয়া বৃত্তের ভিতরে চারিদিকে ঘুরছে। আমাদের বৃত্ত যত ছোট হয়ে আসছে চিতা মিয়ার বেগ তত বাড়ছে। আমাদের দলের নেতা সৈয়দ মিয়া ভাই। লম্বা চওড়ায় পাকিস্তানি সেনাদেরকেও হার মানায়। সে আমার চাচতো ভাই মেমি বু’ ছোট ভাই। তার উপরও আমার রাগ বেড়ে যায়। আমার চিতাকে ধরতে তার কেনো এতো আগ্রহ! পাকিস্তানি সৈন্যরা কি খাওয়ার সময় চিতা মিয়ার একটা টুকরা দিবে? না কি যাওয়ার সময় মুক্তি যোদ্ধা ভেবে তাকে ধরে নিয়ে যাবে?

চিতা মিয়াকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই বোধ হয়। কারণ সৈয়দ মিয়া ভাইয়ের প্রায় হাতের মুঠোতে চলে এসেছে চিতা মিয়া। হঠাৎ করে চিতা মিয়া উত্তর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর চোখের পলকে দিল এক উড়াল। সে কি উড়াল! এতো বড়ো শরীর নিয়ে সে প্রায় একশ গজ দূরে উত্তরের রাস্তায় গিয়ে পড়ল। আমার আনন্দ দেখে কে। আনন্দের আতিশয্যে আমি প্রায় হাততালি দিতে দুই হাত একত্র করতে যাই। একটি সৈনিকের চোখের অগ্নিদৃষ্টি দেখে আমার হুশ হয়। আমি মুখ বেজার করে দুঃখের ভান করি। অপর সৈনিকটি সৈয়দ মিয়া ভাইকে কাছে ডাকে। সৈয়দ মিয়া ভাই অপরাধী ভঙ্গিতে সৈনিকটির কাছে গেলে সৈনিকটি তার পশ্চাতে কষে এক লাথি মেরে বিজাতীয় ভাষায় গালি দেয়। লাথি আর গালি হজম করে সৈয়দ মিয়া ভাই আস্তে আস্তে সরে পড়ে, সাথে আমরাও।

গত ২৪ ঘণ্টায় বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে আমি বেঁচে যাই, আমার মা বেঁচে যান, বেঁচে যায় আমার প্রিয় পোষা মোরগ চিতা মিয়া। এসব নিয়ে এখন যখন ভাবী তখন মনে হয় এর সবগুলিই ছিল একেকটা অলৌকিক ঘটনা। আমরা কত অলৌকিক ঘটনা নিয়েই না বেঁচে আছি!

কিছুক্ষণের মধ্য একটা সুখবর বাতাসে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে ওরা। আমাদের বিশ্বাস হয় না। এরা যেখানে যায় সেখানকার মাটি তামা বানিয়ে ফেলে। এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ওরা? আমাদের এতো সৌভাগ্য? এরা গ্রামে ক্যাম্প করেছে, কামান ফিট করে রেখেছ। গ্রাম থেকে তাদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের পাড়ার বড় মিয়া দাদা তার ঘরের কয়েকটি গরু দিয়ে দিয়েছেন। সৈন্যরাও বোধহয় দুয়েকটা গরু এদিক ওদিক থেকে থেকে সংগ্রহ করেছে। চাল ডাল দেয়া হয়েছে তাদেরকে শান্ত রাখার জন্য। রাত থেকে এরা বেশ শান্ত আছে বলেই মনে হয়। বড়রা আশংকা করছে পরের দিন ওরা নতুন কোনো পরিকল্পনা আর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে মেতে উঠবে। সে ক্ষেত্রে কী করবেন তারা? মনে হয় করার কিছুই নেই। যা করার ওরাই করবে। গ্রামের মুক্তি যোদ্ধা ছেলেরা কোথায়? এরা কি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে? নামা উচিৎ? মনে হয় না। মুক্তি যোদ্ধার সংখ্যা অল্প আর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্রও তেমন বেশি আর আধুনিক নয়। চোরাগুপ্তা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রাম দুটি জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করবে।

নানা ধরনের আশংকা মানুষের মনে কাজ করছে। এ অবস্থায় পাক আর্মি চলে যাচ্ছে এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে।

বেশ কয়েকটা গরু জবাই হয়েছে, মাংসও কাটা হয়ে গেছে। মাটির চুলায় চাল ডাল আর সেই মাংস বসানো হয়েছে। কুয়াশায় ভিজে যাওয়া লাকড়ি কোনো রকমে জ্বলছে। তখনই কি চলে যাওয়ার নির্দেশ পায় পাকিস্তানি আর্মি? এরা মনে হয় আশা করেছিল এখানে বেশ বড় ধরনের একটা যুদ্ধ হবে। যুদ্ধ তো দূরের কথা সামান্য কোনো প্রতিরোধ কোথাও থেকে এলো না। যারা খবর দিয়ে এদেরকে এনেছিল তাদের উপর নিশ্চয়ই পাকিস্তানি আর্মিরা ক্ষেপে যায়। অহেতুক শক্তি ক্ষয় করার সামর্থ আর নেই তাদের। সারা দেশেই তারা মুক্তি বাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে। সুযোগ পেলে সাধারণ বাঙালিরাও যেনোতেনো ভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে পিটিয়ে মারছে। এ অবস্থায় যেখানে সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করার কোনো মানে হয় না।

চাল-ডাল মোটামুটি ফুটেছে কিন্তু মাংস তখনও অর্ধসিদ্ধ। তাদের হাতে সময় নেই। এ অবস্থায় অর্ধসিদ্ধ মাংসই পরিবেশনার নির্দেশ দেয়া হয়। কোনো রকমে কাচা মাংস খেয়ে সৈনিক দলটি পাততাড়ি গুটায়। যাওয়ার সময় কিছু কিছু জিনিসপত্র দিয়ে যায় গ্রামবাসীকে। কেউ পায় মশারি কেউ বা গরু। জিনিসগুলো অবশ্যই লুটের।

গ্রাম থেকে তাদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের পাড়ার বড় মিয়া দাদা তার ঘরের কয়েকটি গরু দিয়ে দিয়েছেন। সৈন্যরাও বোধহয় দুয়েকটা গরু এদিক ওদিক থেকে থেকে সংগ্রহ করেছে। চাল ডাল দেয়া হয়েছে তাদেরকে শান্ত রাখার জন্য। রাত থেকে এরা বেশ শান্ত আছে বলেই মনে হয়। বড়রা আশংকা করছে পরের দিন ওরা নতুন কোনো পরিকল্পনা আর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে মেতে উঠবে

সৈন্যরা মার্চ করে সারি বেঁধে যাচ্ছে। কিছু বাঙালিকে দেখা গেল তাদের গুলাগুলির বাক্সপেটরা পিঠে, মাথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা দূর থেকে বাড়িঘর, গাছ-পালার ফাঁক গলিয়ে সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। কাছাকাছি যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। যদি গুলি করে দেয়।

সৈন্যদের গন্তব্য চৈয়ারকুড়ি বাজার। বাজার সংলগ্ন সিংড়া নদীতে রাখা হয়েছে তাদের লঞ্চ। সেখান থেকে কোথাও চলে যাবে। যেখানেই যাক, যাক আপদগুলো। আবার ফিরে না আসলেই হলো। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আপাতত বাঁচি। (ক্রমশ...)

back to top