alt

সাময়িকী

খালেদ হামিদী : জীবন-পিরিচে স্বপ্নের উৎসব

হাফিজ রশিদ খান

: রোববার, ২১ নভেম্বর ২০২১

সমাজ নামের বিমূর্ততা ব্যক্তিসত্তাকে আদৌ কার্যকর কোনো পরিচর্যা দেয় কি? বিশেষত ওই সত্তাটি যদি কাব্য কিংবা শিল্পমানসের অধিকারী হয়? এর উত্তরে কহিয়ে বা ওয়ায়েজারের মুখ ও দেহভঙ্গিমা মুহূর্তেই নানা ইতিনেতির বয়ানে ভুজঙ্গফণাসম সরব হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই। অর্থাৎ আমাদের মতো আধা-সামন্ত, আধা পুঁজিবাদী আর ক্ষীণতর সম-অধিকারবাদী সমাজে সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, ‘আপনি মোড়ল’গোছের লোকেদের আত্মপ্রসাদ বিতরণের ঢক্কানিনাদের কোনো খামতি থাকে না। আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এই বাস্তবতাতেই বাঁচি আর যেকোনো প্রকারে দুটো খেয়েদেয়ে মরি। অর্থাৎ বিধিলিপির মতোই এ স্বতঃসিদ্ধতার গাঢ়তিমিরে আমাদের কালক্ষেপণ চলছেই কপালে করাঘাত করতে-করতে।

এই পরিপ্রেক্ষায় বিগত শতকের আশি’র দশক থেকে এই দীর্ঘ সাহিত্য অভিযাত্রার কাল বেয়ে আজতক এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে, আমার ভেতরে এমন প্রতীতি জমা হলো না বলে সত্যি ভারি দুঃখ হয়। সেই অর্থে এই সমাজে শিল্পসাহিত্যচর্চাকারী মানুষেরা কঠিন স্রোতের বিরুদ্ধে এখনও শক্ত লড়াকু আর পেশল মাল্লাই রয়ে গেলেন। তাঁদেরই একজন খালেদ হামিদী- কবি-কথাকার ও অনুবাদক। হামিদী প্রায়শ সুস্মিত, অনলস সুজনমুখী আর সূক্ষ্মদর্শী বিশ্লেষক। এ উক্তির সমর্থন তার রচনাকর্মেই গ্রীবা উঁচিয়ে থাকে বিস্তৃত হাওরে ধবল বকের মতো।

হায়, সময়-স্রোতোস্বিনী থেকে প্রায় যুগাধিক কাল কখন যে পার হয়ে গেল! সেই ২০০৭ সালে ওর প্রবন্ধবই ‘কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে’র ব্লার্বে বেনামে লিখেছিলাম : ‘কবি ও কবিতাকে জীবনের জঙ্গম প্রবাহ থেকে গৌণ বা আলাদা করা যায় না বলেই শিল্পকলার ইতিহাসে এ-যমজের সগৌরব অধিষ্ঠান। জগতের সুন্দরের নিবিড় অনুধ্যানে মানবসত্তা যখন বিমোহিত হয়ে পড়ে, তখনই ঘটে কবির উত্থান, কবিতার বিস্তার ঘটে তাতে। ঠিক এ মশহুর ঘরানার দশকবিকে নিয়ে, তাঁদের কাব্যকৃতির বর্ণিল, আলো-আঁধারি ও সমুজ্জ্বল ভুবনে খালেদ হামিদী নিরন্তর ভ্রমিষ্ণু থেকে তুলে আনেন এ কালের কাব্যিক দ্যুতির স্বর্ণোজ্জ্বল সম্ভার। আশি’র দশকের মহীবুল আজিজ, হাফিজ রশিদ খান, শাহিদ আনোয়ার, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ফরিদ কবির, সাজ্জাদ শরিফ, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও জুয়েল মাজহার : এই দশ কবি তাঁর মেধাবী অবলোকন ও চেতনার আঁকশিতে খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন ওই গ্রন্থে। বলা সম্ভব, এরূপ সুবিপুল অধ্যয়ন, আশ্চর্য রকমের সুবেদী ও লজিক্যাল পোস্টমর্টেম স্মরণযোগ্য কালের সীমানায় পরিদৃষ্ট হয়নি তেমন- দীপ্তি ত্রিপাঠীর সেই ‘আধুনিক বংলা কাব্যপরিচয়’ (১৯৯৭)-এর পর।

দুই

খালেদ হামিদীর বেশ কিছুকাল কেটেছে ‘প্রবাসে দৈবের বশে’। মধ্যপ্রাচ্যের ওই ভিন ভূখ-ে অবস্থানকালে বিত্তবিভবের পার্থিব লোলুপতা ও ভোগবাদিতার ভয়াল প্যানোরমা তাঁর তরুণমননে বিরোধাভাস প্রথিত করে দেয়। তাঁর ওই সময়ের মনোভাব ছিল কবি ইকবালের সেই ধিক্কারের মতোই :

‘ভোগ-বিলাসেতে তন্ময় তুমি, অসাড় এখন তোমার প্রাণ,

তুমি মুসলিম? মুসলমানের এই আদর্শ? এই বিধান?

নাইকো আলীর ত্যাগের সাধনা, নাই সম্পদ ওসমানের,

কেমন করিয়া আশা করো তবে তাদের রুহানি-সংযোগের!

মুসলমানের তরেই তখন সে-যুগ করিত গর্ববোধ,

কুরআন ছাড়িয়া এখন হয়েছ যুগ-কলঙ্ক, হায় অবোধ!’

(শিকওয়া ও জবাব-ই-শিকওয়া, পৃ. ২৫, অনুবাদ : গোলাম মোস্তফা)

সেই গড্ডলের নুড়ি না-হয়ে বরং মরমে পরমের কুটির নির্মাণ করলেন হামিদী। অথচ তাঁর সুবিপুল সুযোগ ছিল লেবাসের সহজ ‘লবিয়তে’ (লবিয়ত : চাকমা শব্দ : আতিথ্য। এখানে জাঁকজমকতা অর্থে)। গতর ভাসিয়ে দেবার। এখানেই তাঁর নিষ্ঠতা, সাহিত্যপ্রিয়তার গভীর সুরভিত তটিনী-চঞ্চলতা দৃশ্যমান। খালেদ হামিদীর সৃষ্টিসম্ভারের দিকে তাকাই, কবিতাগ্রন্থ : আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো (১৯৯৯), হে সোনার এশীয় (২০০৪), মুখপরম্পরা (২০০৭), ধান থেকে শিশু হয় (২০১০), স্লামডগ, মিলিয়নার নই (২০১৩), তুমি কি রোহিঙ্গা মাছি (২০১৮), ঘুমোই চশমা চোখে (২০১৯)। গল্প : আকব্জিআঙুল নদীকূল (২০১২), প্রবন্ধ : ‘কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে (২০০৭), না কবিতা হাঁ কবিতা (২০১৬), চেনা কবিতার ভিন্নপাঠ (২০১৯), কিছুই যাবে না ফেলা (২০২১), সব্যসাচী (উপন্যাস, ২০১৭), ওঅল্ট হুইটম্যানের কবিতা (অনুবাদ, ২০১৬)।

সুবেদী জাতীয় ও আন্তার্জাতিক ইতিহাসচেতনা, সুশীল নারীসংবেদিতা, জীবনের জ্বলন্ত জরুলের দিকে প্রশ্নহীন-অনিমেষ তাকিয়ে থাকা, স্থানিক ঐতিহ্যের প্রতি কোমল চাহনি তাঁর সত্তাকে পরিপ্লাবিত করেছে অঢেল ঐশ্বর্যে। সেই অর্থে খালেদ হামিদীর সত্তা জীবন-পিরিচে স্বপ্নরই উৎসব যেন।

তিন

আশি’র দশকের বিভিন্ন কৌণিক ঘূর্ণাবর্তে, দর্শন ও কাব্যিকতার মৌলসংকট অনুধাবনে আমরা কতিপয় নিজস্ব একটা ডেরা বানিয়েছিলাম পাহাড়ে আর নগরের কন্দরে, বিভিন্ন মউজ তোলা কোলাহলের ভেতরেই। লাতিন সাহিত্যপাঠ, প্যালেস্টাইনিদের সংগ্রামী জীবনের প্রতি আমূল সংহতি আর আফ্রিকীয় আত্মার অভ্যন্তরে নিরন্তর পরিভ্রমণ ছিল এ মনোডেরার আসল খেয়াল। এ ঘরানায় ছিলেন মহীবুল আজিজ, হাফিজ রশিদ খান, আহমেদ রায়হান, খালেদ হামিদী আর এনামুল কাদের খান সারোয়ার। শেষোক্তজনের লেখালেখিতে ঝোঁক ছিল না বটে, তবে তাঁর সুরম্যকণ্ঠের রেশমি আবেশে ভর করে রবিঠাকুর তাঁর ঐশী জোব্বাটি পরে সহাস্যে আমাদের আড্ডায় প্রায়শ ভেসে আসতেন। মনে পড়ে, নিকোলাস গ্যিয়েন, রুবেনদারিও, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, অতো রেনে কাস্তিইয়ো, নিকানোর পারা, পল লরেন্স ডানবার, ল্যাংসটন হিউজেস, লিওপোল্ড সেদর সেংঘোর, গেব্রিয়েল ওকারা, অ্যাগোস্তিন হো নেটো, মাহমুদ দারবিশ, হুসেইন মারওয়ান, খালিদ আবু খালেদ, ফাদেল আলী আর রশীদ হুসেইনের দাবড়ানো সব কবিতার পংক্তির কথা। কবিতা-শরাবের সৌরস্বরাটে, মনে পড়ে এও, উচ্চারণ করছি যেন এখনও পল লরেন্স ডানবার :

মুখোশের মানুষজন অনর্গল মিথ্যে কথা বলে

হাসে, মুখোশের আড়ালে দৃষ্টি

আসল মুখোচ্ছবি লুকোনো থাকে

ওই চতুরতার জন্য সে ঋণ পরিশোধ করতে হয় আমাদের

রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়েও আমরা হাসি, মিথ্যে

ইমারত বানিয়ে চলি...

চার

একটু অন্যরকম গদ্যের সাজি নিয়ে উপস্থিত হামিদীর ‘কিছুই যাবে না ফেলা’ গ্রন্থটি। ফেলে আসা দিবস-রজনিগুলোর কুলুজি-ঠিকুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়া এ এক নতুন অভিসারই বটে। ‘অভিসার’ সে তো শুধুই প্রাণবল্লভ বা প্রাণবল্লভার জন্যে মোহন কোনো ইশারা বা পূর্ণিমা নিশীথিনীর মুরলী ডাক নয় কেবল। বাদল রাতের ত্রুুর বিজুরির ভয়, ঝোপের গ্রীবা উঁচানো কাঁটা, পথের অপ্রিয় কটাক্ষ আর অপ্রত্যাশিত, কুৎসিত গরিলাসদৃশ ঘটনার গরল মুখাবয়ব ও দেভঙ্গিমাও সেখানে প্রতুলতর। এসব উজিয়ে হামিদী বানিয়েছেন স্মৃতিজ বেদনা-আনন্দ, তার বিচিত্র সুধা আর হলাহলের এক নগররাষ্ট্র। এখানকার মোড়ে-বাঁকে ও কোণে কথা কয়ে ওঠে গোটা বাংলাদেশ ইতিনেতিভরা ইতিবৃত্ত, ইতিহাসসমেত। অতৃপ্তির ভেতর নিমজ্জিত ব্যক্তি ও সমষ্টি, প্রাপ্তির সমারোহেও লোলুপতায় একশ্রেণির ফাঁপা ঢেকুর ও বাঁকা হাসি এখানে চক্কর দিয়ে যায় বারবার।

আমাদের প্রায় সমসাময়িক কালের এই ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ প্রধানত ফেসবুককে অবলম্বন করে প্রায় দু-বছর ক্লান্তিহীনভাবে লিখেছেন অনেকটা আত্মকথা ধরনের এ গদ্যসম্ভার। কোথাও সান্দ্র-নমিত, কোথাও প্রেমানন্দে উল্লসিত, কোথাও স্বজনের-বান্ধবের-আত্মীয়ের যুগপৎ পরাক্সমুখতা ও সুনন্দ আচরণ এখানে যেমন মুখভার আনে, ধিকিধিকি জ¦লে তাপিত হিয়াতলে, তেমনি তা আলোও ছেটায় শুশ্রূষার মতো কিছু-কিছু। স্বতশ্চল এক গদ্যের রথে অধ্রুব নামের আড়ালে খালেদ হামিদী এখানে নিজেকে মেলে ধরেছেন সেইসব অনুষঙ্গের রাংতায়, যা হয়তোবা কবিতা কিংবা কথাসাহিত্য অথবা প্রাবন্ধিক গদ্যের আধারে আসতে চাইলেও মাধ্যমের নিজস্ব আভিজাত্যে এমন খোলতাই রূপ পরিগ্রহে বিরতি মানতো তারা। পঁচাত্তরটি ছোটোবড় কিস্তিতে এই গদ্যভঙ্গি বেগে নয়, সংবেদী আড়ষ্টে, ধীরে-অতিধীরেই লক্ষপানে গেছে।

একটু দীর্ঘ বটে, তবু চোখ বুলানো যাক ৪০-সংখ্যক কিস্তিতে। এখানে এদেশের সুশীল সমাজের মনোদেশে গৌণ থেকে গৌণতর হয়ে থাকা আদিবাসী সমাজ ও তাদের একটি মেয়ে, আরও কিছু পারিপাশির্^কতাসহ তার ও তাদের অন্দরের লুক্কায়িত সম্ভ্রম নিয়ে মুচড়ে ওঠে পাঠকের সুমুখে : ‘মমতাজের মাধ্যমে মেহরাজ ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে অধ্রুবর। মমতাজ ফের জানায়, সে মেহরাজের সঙ্গেও আরেক আবাসিক হোটেলে যায়। আবারও ব্যর্থ হয়। প্রথমবারের মতো সেখানে থেকেও যায়, বর্ষণমুখর রাতে। সেই শেষবার। তবে মেহরাজ ভাইয়ের একটি বৈশিষ্ট্য মনে রাখার মতো। তিনি অন্যের পয়সায় অন্যকিছু দূরে থাক, চাও খান না। কেবল সাহিত্যতত্ত্বের প্রশ্নে মতদ্বৈধতা মেনে নেন না। তৈরি করেন কতিপয় দলকানা অনুরক্ত। কিন্তু অধ্রুব তাঁর অনেক দিনের অসামান্য স্নেহ ও আতিথ্য ভুলতে পারে না। এক্ষেত্রে তবুও সে মমতাজের সমান্তরালেই একযুগ ধরে নির্দলীয় ও আড্ডাহীন। উভয়ের প্রত্যেকে এখনও মার্কসয়ি অর্থনীতির ওপর আস্থাশীল। অধ্রুব তো নিজেকে নিঃসঙ্গ দ্বীপই মনে করে যার চারদিকে আছড়ে পড়ে সমাজ, সভ্যতা ও সময়ের স্রোত। ... সেই তরঙ্গের অভিঘাতে অধ্রুবর প্রাগুক্ত অনুতাপ ক্রমশ বাড়ে। কেননা এক সন্ধ্যায় সে, ওর স্ত্রী ও কন্যার অনুপস্থিতিতে, নিজের বাসায় জুনিয়র ফ্রেন্ডটার সঙ্গে এক টিভি নাটক দেখে। এতে চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে প্রেমিক তার প্রেয়সীকে বলৎকার করে। জ্ঞান ফেরার পর ঘটনা টের পেয়ে ওই প্রেমিকার ভূমিকায় তমালিকা কর্মকার ‘ছি! ছি!’ বলে কাঁদতে থাকে। নারীর এই ক্রন্দন ও ধিক্কারের সময় সহদর্শককে অট্টহাসিতে পেটে পড়তে দেখে হতবাক হয় অধ্রুব। তবুও অমন ছোকরার সঙ্গ ছাড়তে আরও সময় নেয় সে। ছেলেটা আরেকবার অধ্রুবর অফিসে গিয়ে ওর আদিবাসী নারী সহকর্মী শিবানিকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কেননা অধ্রুবকে না পেয়েও সে রাঙামাটির তরুণীর দিকে আগ্রাসী দৃষ্টিতে এক নজরে তাকিয়ে থাকে। সাবেক সেই কলিগ পরে অধ্রুবকে কিছুই বলেন না। তবে অধ্রুব কারও আগমনের খবর জানতে চাওয়ায় শিবানির চোখেমুখে নিদারুণ বিরক্তি ফুটে ওঠে। শুধু এক বিভাগীয় প্রধানের আচরণ বিষয়ে কিছু কথা এক সময় তিনি অধ্রুবকে জানান। সেই ডিপার্টমেন্ট হেড তাঁকে কয়েকবার কীসব বলেন, ফুটফুটে তরুণী শিবানির কাছে যা খুবই অস্বস্তিকর ঠেকে। তাই তিনি অধ্রুবকে প্রশ্ন করেন : ‘আমি চাকমা বলেই কি উনি অমন কথা বলেন? কই, বাঙালি মেয়ে কলিগদের তো ও রকম ইঙ্গিত দেন না!’ (পৃ. ৭৩/৭৪)।

আদিবাসী মেয়েবাহিত এই মর্মভেদী প্রশ্নই শুধু নয়, আরও এন্তার কদর্য চরিত্র ও ঘটনা ১৮০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে পরিসর প্রণয়ন করেছে। আবার যেহেতু মানুষের স্বোপার্জিত সভ্যতা-সংস্কৃতির সুবিমল উচ্চতাও বিরল নয় এ দুনিয়ার রঙ্গালয়ে, তাই পাশাপাশি পাঠকের সঙ্গে দেখা মেলে আপাদশির সুশীল ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কিছু অনন্য মানবের কায়া ও ছায়ার সঙ্গেও। হামিদীর এই নিরন্তর গদ্যজলধির লহরির পর লহরির উত্থান-পতন আর বিস্তার পাঠককে বহুমাত্রায় মনোযোগী করে তুলতে সক্ষম তাঁর বয়ানকৃত বিষয়ে। একই কারণে এর প্রতিটি কিস্তিই উপভোগ্যতার দাবিদার। এও স্বীকার করা ভালো যে, এখানে ওসবের প্রতিটির বর্ণন সম্ভব নয়, শোভনতাও তাতে আহত হবার আশংকা থাকে বইকি। তাই সব মিলিয়ে বলা যায়, খালেদ হামিদীর এই প্রয়াসে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সংবেদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পাঠক হিশেবে আমি উপকৃত হয়েছি।

‘কিছুই যাবে না ফেলা’ পাঠশেষে গাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেজের শরণাপন্ন হতেই হয় : ‘Nobody deserves your tears, but whoever deserves them will not make you cry.

কিছুই যাবে না ফেলা। খালেদ হামিদী। প্রকাশক: অভিযান, ঢাকা। প্রকাশকাল: অমর একুশে বইমেলা ২০২১। প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। মূল্য : ৩২০ টাকা।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

tab

সাময়িকী

খালেদ হামিদী : জীবন-পিরিচে স্বপ্নের উৎসব

হাফিজ রশিদ খান

রোববার, ২১ নভেম্বর ২০২১

সমাজ নামের বিমূর্ততা ব্যক্তিসত্তাকে আদৌ কার্যকর কোনো পরিচর্যা দেয় কি? বিশেষত ওই সত্তাটি যদি কাব্য কিংবা শিল্পমানসের অধিকারী হয়? এর উত্তরে কহিয়ে বা ওয়ায়েজারের মুখ ও দেহভঙ্গিমা মুহূর্তেই নানা ইতিনেতির বয়ানে ভুজঙ্গফণাসম সরব হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই। অর্থাৎ আমাদের মতো আধা-সামন্ত, আধা পুঁজিবাদী আর ক্ষীণতর সম-অধিকারবাদী সমাজে সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, ‘আপনি মোড়ল’গোছের লোকেদের আত্মপ্রসাদ বিতরণের ঢক্কানিনাদের কোনো খামতি থাকে না। আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এই বাস্তবতাতেই বাঁচি আর যেকোনো প্রকারে দুটো খেয়েদেয়ে মরি। অর্থাৎ বিধিলিপির মতোই এ স্বতঃসিদ্ধতার গাঢ়তিমিরে আমাদের কালক্ষেপণ চলছেই কপালে করাঘাত করতে-করতে।

এই পরিপ্রেক্ষায় বিগত শতকের আশি’র দশক থেকে এই দীর্ঘ সাহিত্য অভিযাত্রার কাল বেয়ে আজতক এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে, আমার ভেতরে এমন প্রতীতি জমা হলো না বলে সত্যি ভারি দুঃখ হয়। সেই অর্থে এই সমাজে শিল্পসাহিত্যচর্চাকারী মানুষেরা কঠিন স্রোতের বিরুদ্ধে এখনও শক্ত লড়াকু আর পেশল মাল্লাই রয়ে গেলেন। তাঁদেরই একজন খালেদ হামিদী- কবি-কথাকার ও অনুবাদক। হামিদী প্রায়শ সুস্মিত, অনলস সুজনমুখী আর সূক্ষ্মদর্শী বিশ্লেষক। এ উক্তির সমর্থন তার রচনাকর্মেই গ্রীবা উঁচিয়ে থাকে বিস্তৃত হাওরে ধবল বকের মতো।

হায়, সময়-স্রোতোস্বিনী থেকে প্রায় যুগাধিক কাল কখন যে পার হয়ে গেল! সেই ২০০৭ সালে ওর প্রবন্ধবই ‘কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে’র ব্লার্বে বেনামে লিখেছিলাম : ‘কবি ও কবিতাকে জীবনের জঙ্গম প্রবাহ থেকে গৌণ বা আলাদা করা যায় না বলেই শিল্পকলার ইতিহাসে এ-যমজের সগৌরব অধিষ্ঠান। জগতের সুন্দরের নিবিড় অনুধ্যানে মানবসত্তা যখন বিমোহিত হয়ে পড়ে, তখনই ঘটে কবির উত্থান, কবিতার বিস্তার ঘটে তাতে। ঠিক এ মশহুর ঘরানার দশকবিকে নিয়ে, তাঁদের কাব্যকৃতির বর্ণিল, আলো-আঁধারি ও সমুজ্জ্বল ভুবনে খালেদ হামিদী নিরন্তর ভ্রমিষ্ণু থেকে তুলে আনেন এ কালের কাব্যিক দ্যুতির স্বর্ণোজ্জ্বল সম্ভার। আশি’র দশকের মহীবুল আজিজ, হাফিজ রশিদ খান, শাহিদ আনোয়ার, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ফরিদ কবির, সাজ্জাদ শরিফ, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও জুয়েল মাজহার : এই দশ কবি তাঁর মেধাবী অবলোকন ও চেতনার আঁকশিতে খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন ওই গ্রন্থে। বলা সম্ভব, এরূপ সুবিপুল অধ্যয়ন, আশ্চর্য রকমের সুবেদী ও লজিক্যাল পোস্টমর্টেম স্মরণযোগ্য কালের সীমানায় পরিদৃষ্ট হয়নি তেমন- দীপ্তি ত্রিপাঠীর সেই ‘আধুনিক বংলা কাব্যপরিচয়’ (১৯৯৭)-এর পর।

দুই

খালেদ হামিদীর বেশ কিছুকাল কেটেছে ‘প্রবাসে দৈবের বশে’। মধ্যপ্রাচ্যের ওই ভিন ভূখ-ে অবস্থানকালে বিত্তবিভবের পার্থিব লোলুপতা ও ভোগবাদিতার ভয়াল প্যানোরমা তাঁর তরুণমননে বিরোধাভাস প্রথিত করে দেয়। তাঁর ওই সময়ের মনোভাব ছিল কবি ইকবালের সেই ধিক্কারের মতোই :

‘ভোগ-বিলাসেতে তন্ময় তুমি, অসাড় এখন তোমার প্রাণ,

তুমি মুসলিম? মুসলমানের এই আদর্শ? এই বিধান?

নাইকো আলীর ত্যাগের সাধনা, নাই সম্পদ ওসমানের,

কেমন করিয়া আশা করো তবে তাদের রুহানি-সংযোগের!

মুসলমানের তরেই তখন সে-যুগ করিত গর্ববোধ,

কুরআন ছাড়িয়া এখন হয়েছ যুগ-কলঙ্ক, হায় অবোধ!’

(শিকওয়া ও জবাব-ই-শিকওয়া, পৃ. ২৫, অনুবাদ : গোলাম মোস্তফা)

সেই গড্ডলের নুড়ি না-হয়ে বরং মরমে পরমের কুটির নির্মাণ করলেন হামিদী। অথচ তাঁর সুবিপুল সুযোগ ছিল লেবাসের সহজ ‘লবিয়তে’ (লবিয়ত : চাকমা শব্দ : আতিথ্য। এখানে জাঁকজমকতা অর্থে)। গতর ভাসিয়ে দেবার। এখানেই তাঁর নিষ্ঠতা, সাহিত্যপ্রিয়তার গভীর সুরভিত তটিনী-চঞ্চলতা দৃশ্যমান। খালেদ হামিদীর সৃষ্টিসম্ভারের দিকে তাকাই, কবিতাগ্রন্থ : আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো (১৯৯৯), হে সোনার এশীয় (২০০৪), মুখপরম্পরা (২০০৭), ধান থেকে শিশু হয় (২০১০), স্লামডগ, মিলিয়নার নই (২০১৩), তুমি কি রোহিঙ্গা মাছি (২০১৮), ঘুমোই চশমা চোখে (২০১৯)। গল্প : আকব্জিআঙুল নদীকূল (২০১২), প্রবন্ধ : ‘কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে (২০০৭), না কবিতা হাঁ কবিতা (২০১৬), চেনা কবিতার ভিন্নপাঠ (২০১৯), কিছুই যাবে না ফেলা (২০২১), সব্যসাচী (উপন্যাস, ২০১৭), ওঅল্ট হুইটম্যানের কবিতা (অনুবাদ, ২০১৬)।

সুবেদী জাতীয় ও আন্তার্জাতিক ইতিহাসচেতনা, সুশীল নারীসংবেদিতা, জীবনের জ্বলন্ত জরুলের দিকে প্রশ্নহীন-অনিমেষ তাকিয়ে থাকা, স্থানিক ঐতিহ্যের প্রতি কোমল চাহনি তাঁর সত্তাকে পরিপ্লাবিত করেছে অঢেল ঐশ্বর্যে। সেই অর্থে খালেদ হামিদীর সত্তা জীবন-পিরিচে স্বপ্নরই উৎসব যেন।

তিন

আশি’র দশকের বিভিন্ন কৌণিক ঘূর্ণাবর্তে, দর্শন ও কাব্যিকতার মৌলসংকট অনুধাবনে আমরা কতিপয় নিজস্ব একটা ডেরা বানিয়েছিলাম পাহাড়ে আর নগরের কন্দরে, বিভিন্ন মউজ তোলা কোলাহলের ভেতরেই। লাতিন সাহিত্যপাঠ, প্যালেস্টাইনিদের সংগ্রামী জীবনের প্রতি আমূল সংহতি আর আফ্রিকীয় আত্মার অভ্যন্তরে নিরন্তর পরিভ্রমণ ছিল এ মনোডেরার আসল খেয়াল। এ ঘরানায় ছিলেন মহীবুল আজিজ, হাফিজ রশিদ খান, আহমেদ রায়হান, খালেদ হামিদী আর এনামুল কাদের খান সারোয়ার। শেষোক্তজনের লেখালেখিতে ঝোঁক ছিল না বটে, তবে তাঁর সুরম্যকণ্ঠের রেশমি আবেশে ভর করে রবিঠাকুর তাঁর ঐশী জোব্বাটি পরে সহাস্যে আমাদের আড্ডায় প্রায়শ ভেসে আসতেন। মনে পড়ে, নিকোলাস গ্যিয়েন, রুবেনদারিও, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, অতো রেনে কাস্তিইয়ো, নিকানোর পারা, পল লরেন্স ডানবার, ল্যাংসটন হিউজেস, লিওপোল্ড সেদর সেংঘোর, গেব্রিয়েল ওকারা, অ্যাগোস্তিন হো নেটো, মাহমুদ দারবিশ, হুসেইন মারওয়ান, খালিদ আবু খালেদ, ফাদেল আলী আর রশীদ হুসেইনের দাবড়ানো সব কবিতার পংক্তির কথা। কবিতা-শরাবের সৌরস্বরাটে, মনে পড়ে এও, উচ্চারণ করছি যেন এখনও পল লরেন্স ডানবার :

মুখোশের মানুষজন অনর্গল মিথ্যে কথা বলে

হাসে, মুখোশের আড়ালে দৃষ্টি

আসল মুখোচ্ছবি লুকোনো থাকে

ওই চতুরতার জন্য সে ঋণ পরিশোধ করতে হয় আমাদের

রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়েও আমরা হাসি, মিথ্যে

ইমারত বানিয়ে চলি...

চার

একটু অন্যরকম গদ্যের সাজি নিয়ে উপস্থিত হামিদীর ‘কিছুই যাবে না ফেলা’ গ্রন্থটি। ফেলে আসা দিবস-রজনিগুলোর কুলুজি-ঠিকুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়া এ এক নতুন অভিসারই বটে। ‘অভিসার’ সে তো শুধুই প্রাণবল্লভ বা প্রাণবল্লভার জন্যে মোহন কোনো ইশারা বা পূর্ণিমা নিশীথিনীর মুরলী ডাক নয় কেবল। বাদল রাতের ত্রুুর বিজুরির ভয়, ঝোপের গ্রীবা উঁচানো কাঁটা, পথের অপ্রিয় কটাক্ষ আর অপ্রত্যাশিত, কুৎসিত গরিলাসদৃশ ঘটনার গরল মুখাবয়ব ও দেভঙ্গিমাও সেখানে প্রতুলতর। এসব উজিয়ে হামিদী বানিয়েছেন স্মৃতিজ বেদনা-আনন্দ, তার বিচিত্র সুধা আর হলাহলের এক নগররাষ্ট্র। এখানকার মোড়ে-বাঁকে ও কোণে কথা কয়ে ওঠে গোটা বাংলাদেশ ইতিনেতিভরা ইতিবৃত্ত, ইতিহাসসমেত। অতৃপ্তির ভেতর নিমজ্জিত ব্যক্তি ও সমষ্টি, প্রাপ্তির সমারোহেও লোলুপতায় একশ্রেণির ফাঁপা ঢেকুর ও বাঁকা হাসি এখানে চক্কর দিয়ে যায় বারবার।

আমাদের প্রায় সমসাময়িক কালের এই ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ প্রধানত ফেসবুককে অবলম্বন করে প্রায় দু-বছর ক্লান্তিহীনভাবে লিখেছেন অনেকটা আত্মকথা ধরনের এ গদ্যসম্ভার। কোথাও সান্দ্র-নমিত, কোথাও প্রেমানন্দে উল্লসিত, কোথাও স্বজনের-বান্ধবের-আত্মীয়ের যুগপৎ পরাক্সমুখতা ও সুনন্দ আচরণ এখানে যেমন মুখভার আনে, ধিকিধিকি জ¦লে তাপিত হিয়াতলে, তেমনি তা আলোও ছেটায় শুশ্রূষার মতো কিছু-কিছু। স্বতশ্চল এক গদ্যের রথে অধ্রুব নামের আড়ালে খালেদ হামিদী এখানে নিজেকে মেলে ধরেছেন সেইসব অনুষঙ্গের রাংতায়, যা হয়তোবা কবিতা কিংবা কথাসাহিত্য অথবা প্রাবন্ধিক গদ্যের আধারে আসতে চাইলেও মাধ্যমের নিজস্ব আভিজাত্যে এমন খোলতাই রূপ পরিগ্রহে বিরতি মানতো তারা। পঁচাত্তরটি ছোটোবড় কিস্তিতে এই গদ্যভঙ্গি বেগে নয়, সংবেদী আড়ষ্টে, ধীরে-অতিধীরেই লক্ষপানে গেছে।

একটু দীর্ঘ বটে, তবু চোখ বুলানো যাক ৪০-সংখ্যক কিস্তিতে। এখানে এদেশের সুশীল সমাজের মনোদেশে গৌণ থেকে গৌণতর হয়ে থাকা আদিবাসী সমাজ ও তাদের একটি মেয়ে, আরও কিছু পারিপাশির্^কতাসহ তার ও তাদের অন্দরের লুক্কায়িত সম্ভ্রম নিয়ে মুচড়ে ওঠে পাঠকের সুমুখে : ‘মমতাজের মাধ্যমে মেহরাজ ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে অধ্রুবর। মমতাজ ফের জানায়, সে মেহরাজের সঙ্গেও আরেক আবাসিক হোটেলে যায়। আবারও ব্যর্থ হয়। প্রথমবারের মতো সেখানে থেকেও যায়, বর্ষণমুখর রাতে। সেই শেষবার। তবে মেহরাজ ভাইয়ের একটি বৈশিষ্ট্য মনে রাখার মতো। তিনি অন্যের পয়সায় অন্যকিছু দূরে থাক, চাও খান না। কেবল সাহিত্যতত্ত্বের প্রশ্নে মতদ্বৈধতা মেনে নেন না। তৈরি করেন কতিপয় দলকানা অনুরক্ত। কিন্তু অধ্রুব তাঁর অনেক দিনের অসামান্য স্নেহ ও আতিথ্য ভুলতে পারে না। এক্ষেত্রে তবুও সে মমতাজের সমান্তরালেই একযুগ ধরে নির্দলীয় ও আড্ডাহীন। উভয়ের প্রত্যেকে এখনও মার্কসয়ি অর্থনীতির ওপর আস্থাশীল। অধ্রুব তো নিজেকে নিঃসঙ্গ দ্বীপই মনে করে যার চারদিকে আছড়ে পড়ে সমাজ, সভ্যতা ও সময়ের স্রোত। ... সেই তরঙ্গের অভিঘাতে অধ্রুবর প্রাগুক্ত অনুতাপ ক্রমশ বাড়ে। কেননা এক সন্ধ্যায় সে, ওর স্ত্রী ও কন্যার অনুপস্থিতিতে, নিজের বাসায় জুনিয়র ফ্রেন্ডটার সঙ্গে এক টিভি নাটক দেখে। এতে চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে প্রেমিক তার প্রেয়সীকে বলৎকার করে। জ্ঞান ফেরার পর ঘটনা টের পেয়ে ওই প্রেমিকার ভূমিকায় তমালিকা কর্মকার ‘ছি! ছি!’ বলে কাঁদতে থাকে। নারীর এই ক্রন্দন ও ধিক্কারের সময় সহদর্শককে অট্টহাসিতে পেটে পড়তে দেখে হতবাক হয় অধ্রুব। তবুও অমন ছোকরার সঙ্গ ছাড়তে আরও সময় নেয় সে। ছেলেটা আরেকবার অধ্রুবর অফিসে গিয়ে ওর আদিবাসী নারী সহকর্মী শিবানিকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কেননা অধ্রুবকে না পেয়েও সে রাঙামাটির তরুণীর দিকে আগ্রাসী দৃষ্টিতে এক নজরে তাকিয়ে থাকে। সাবেক সেই কলিগ পরে অধ্রুবকে কিছুই বলেন না। তবে অধ্রুব কারও আগমনের খবর জানতে চাওয়ায় শিবানির চোখেমুখে নিদারুণ বিরক্তি ফুটে ওঠে। শুধু এক বিভাগীয় প্রধানের আচরণ বিষয়ে কিছু কথা এক সময় তিনি অধ্রুবকে জানান। সেই ডিপার্টমেন্ট হেড তাঁকে কয়েকবার কীসব বলেন, ফুটফুটে তরুণী শিবানির কাছে যা খুবই অস্বস্তিকর ঠেকে। তাই তিনি অধ্রুবকে প্রশ্ন করেন : ‘আমি চাকমা বলেই কি উনি অমন কথা বলেন? কই, বাঙালি মেয়ে কলিগদের তো ও রকম ইঙ্গিত দেন না!’ (পৃ. ৭৩/৭৪)।

আদিবাসী মেয়েবাহিত এই মর্মভেদী প্রশ্নই শুধু নয়, আরও এন্তার কদর্য চরিত্র ও ঘটনা ১৮০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে পরিসর প্রণয়ন করেছে। আবার যেহেতু মানুষের স্বোপার্জিত সভ্যতা-সংস্কৃতির সুবিমল উচ্চতাও বিরল নয় এ দুনিয়ার রঙ্গালয়ে, তাই পাশাপাশি পাঠকের সঙ্গে দেখা মেলে আপাদশির সুশীল ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কিছু অনন্য মানবের কায়া ও ছায়ার সঙ্গেও। হামিদীর এই নিরন্তর গদ্যজলধির লহরির পর লহরির উত্থান-পতন আর বিস্তার পাঠককে বহুমাত্রায় মনোযোগী করে তুলতে সক্ষম তাঁর বয়ানকৃত বিষয়ে। একই কারণে এর প্রতিটি কিস্তিই উপভোগ্যতার দাবিদার। এও স্বীকার করা ভালো যে, এখানে ওসবের প্রতিটির বর্ণন সম্ভব নয়, শোভনতাও তাতে আহত হবার আশংকা থাকে বইকি। তাই সব মিলিয়ে বলা যায়, খালেদ হামিদীর এই প্রয়াসে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সংবেদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পাঠক হিশেবে আমি উপকৃত হয়েছি।

‘কিছুই যাবে না ফেলা’ পাঠশেষে গাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেজের শরণাপন্ন হতেই হয় : ‘Nobody deserves your tears, but whoever deserves them will not make you cry.

কিছুই যাবে না ফেলা। খালেদ হামিদী। প্রকাশক: অভিযান, ঢাকা। প্রকাশকাল: অমর একুশে বইমেলা ২০২১। প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। মূল্য : ৩২০ টাকা।

back to top