করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহের মানুষের স্বপ্নের তিস্তা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেতুটি ২৯২টি পাইলের মধ্যে ১০১টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।
এছাড়া, গাইবান্ধা অংশে এক কিলোমিটার সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি) এর পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
স্থানীয়দের আশা, সেতটিু চালু হলে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের অনেক দ্বার খুলে যাবে।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ঘাট থেকে তিস্তা নদীর ওপর দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী পর্যন্ত ১ হাজার ৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা নদীর ওপর ৩৬৭.৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৪৯০ মিটার ব্রীজের কাজ শুরু হয়েছে। এলজিইডির ব্যবস্থাপনায় নির্মিত সেতুটিতে নির্মাণ কাজ করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না স্টেট কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন(সিএসসিইসি)। সেতুটিতে পিলার ৩০টি, পাইল ২৯৩টি। এর মধ্যে ৩টি টেস্ট পাইল। ইতোমধ্যে ১০১টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। পিলারের সুন্দরগঞ্জ অংশের পিলারটি ৯টি পাইলের ওপর আর কুড়িগ্রাম অংশের পিলারটি ১২টি পাইলের ওপর বসবে।
সূত্র আরও জানায়, সেতুটিকে ঘিরে গাইবান্ধা অংশে ১০টি ব্রিজ, ৫৯টি কালভার্ট ও জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সেখানে তিস্তা ব্রিজসহ মোট ব্যায় ধরা হয়েছে ৬৫৩ কোটি টাকা, যা বাস্তবান করবে এলজিইডি গাইবান্ধা। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম অংশে সংযোগ সড়ক, জমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণে ব্যায় ধরা হহয়েছে একশ ৪৭ কোটি টাকা, যা বাস্তবায়ন করবে এলজিইডি কুড়িগ্রাম।
এলজিইডি সূত্রে আরও জানাগেছে, সেতুটির দুইপাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। হরিপুর সেতু সংলগ্ন এলাকা হতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহর পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি সেতুর সংযোগ সড়কে রূপান্তের কাজ পুরোদমে চলছে। যার কারণে বাঁধের দুই পাশেই অবৈধভাবে গড়ে উঠা বসতবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে অসহায় পরিবারগুলো। এছাড়া কুড়িগ্রামের সাথে ঢাকার সংযোগ করতে জেলার সাদুল্লাপুর-সুন্দরগঞ্জ-চিলমারী পর্যন্ত দুই পাশে ৮৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ হবে। সেতুর উভয় পাশে নদীশাসন হবে ৩ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করে। যা সম্পন্ন হলে গাইবান্ধা এবং কুড়িগ্রাম জেলার স্থানীয় জনগণ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে।
স্থানীদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, বৃহৎ এ সেতুটি গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা ছাড়াও কয়েক জেলার মানুষের ‘স্বপ্ন’ ও দীর্ঘদিনের ‘প্রাণের দাবি’ছিল। সুন্দরগঞ্জের চণ্ডীপুর ইউনিয়নের উত্তর চণ্ডীপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক শরিয়ত উল্লা ১১ বছর আগে তিস্তা সেতু নির্মাণের দাবি তোলেন। সেই ২০০১ সালে শুরু হওয়া আন্দোলন-সংগ্রামের পর সেতু নির্মাণ আলোর মুখ দেখতে পায় ২০১২ সালে। শরিয়ত উল্লা মাস্টারের ডাকে সুন্দরগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ সেতুর দাবিতে সে সময় একটি কমিটিও গঠন করে। যার নাম দেয়া হয় ‘তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন কমিটি’।
সরেজমিনে ঘুরে তিস্তাপারের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, সেতুর কাজ শেষ হলে এটি হবে উত্তরাঞ্চলের নদীপারের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। যোগাযোগের পথ সুগম হবে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুরের মানুষের। একই সঙ্গে এসব জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়া নদীপারের হাজারও মানুষের ব্যবসার প্রসার ঘটবে। চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পাবে। এদিকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ সেতুর দুই পাশে অসংখ্য দোকানপাট, খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছে।
হরিপুর ঘাট এলাকার কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, ‘নদীর ওই পাড় যাই সোতরিয়ে (সাঁতার)। নৌকে ভড়া (ভাড়া) ঘাটের ভড়া বাঁচপার তেকনে (জন্য)। ব্রিজ হইলে আর নদী সোতরার নাগবে নয়; আস্তা (রাস্তা) দিই (দিয়ে) যাতায়াত করতি পারমু।’একই এলাকার বজলুর রহমান বলেন, ‘এই সেতুটে হবি হবি (হবে) কতে কতে (বলা) বহু লোক চলি গেছি, তাও দেখপার পায় নাই। হামার বাপ-দাদা; আরও বহু গ্রামবাসিও চলি গেছি। এই সেতুটে যে হলি; হামার জেবনের (জীবনের) সাধনা পালন হলো। মনের আশা পূরণ হলো।’কাশেম বাজারের মাসুদ রানা বলেন, ‘নদীভাঙন থেকে বাঁচতিচি। আবার নদী যখন শাসন হবে; তখন এই এলাকার সব অকেজো (পতিত) জমি কৃষিকাজে ব্যবহার হবে। দেশের উন্নয়ন হবে।’
পাশের উজান বোচাগাড়ি গ্রামের শাকিল মিয়া জানান, তিস্তা সেতু নির্মাণের দাবি ছিল স্বপ্নের কাঙ্খিত দাবি। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর সেই দাবি বাস্তবায়ন হওয়ায় আনন্দে ভাসছেন তিস্তাপারের বাসিন্দাসহ গোটা গাইবান্ধাবাসী। অনেকেই আবার সেতু ঘিরে নতুন ‘স্বপ্ন’ বুনছেন। কেউ বা আবার অধিগ্রহণে জমির কাঙ্খিত দাম পেয়ে খুশি। সোহেল মিয়া বলেন, ‘গাইবান্ধা একটা অবহেলিত এলাকা। সেতুটা হলে এখানে অনেক উন্নয়ন হবে। সবদিকে সুযোগসুবিধা বাড়বে। হঠাৎ করি একজন অসুস্থ রোগীকে তড়িঘড়ি করে হসপিটালে নিয়ে যেতে পারি না। কাঁধে করে বাড়ি থেকে ঘাট পর্যন্ত আনতে হয়। এরপর নৌকায় করে ওপর পৌঁছাতেই রোগী মারা যায়।’
গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক প্রমতোষ সাহা সংবাদকে বলেন, ‘সেতুটি হলে উন্নয়নের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে জেলা শহরের সাথে কুড়িগ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তি এলাকাগুলোর যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও সচল হবে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হবে।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আবুল মুনছুর জানান, তিস্তা সেতু যাবতীয় কার্যক্রম গাইবান্ধা নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় হতে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫০০ মিটারের কম হওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। এটি এলজিইডির একটি বিরাট অর্জন। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।’
জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান কবির সংবাদকে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধা এলজিইডি’র আওতায় ৬৫০ কোটি টাকার কাজ হবে। এর মধ্যে আছে ১০টি ব্রিজ, ৫৯টি কালভার্ট আর ৮৬ কিলোমিটার রাস্তা। এছাড়াও জমি অধিগ্রহণে ব্যায় ধরা হয়েছ একশ কোটি টাকা। আমরা আশা করছি নিদিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজটি শেষ হবে।’
চায়না স্টেট কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন(সিএসসিইসি)পরিকল্পনা প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এ যাবৎ আমাদের ১০১ টি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। গাইবান্ধা হরিপুর সাইটে এক কিলোমিটার এপ্রোচ সড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছ। সব মিলিয়ে ১৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২৩ সালের মধ্যে জুনের আগেই সব কাজ শেস হবে।’
ব্রিজটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক(পিডি) মো. আব্দুল মালেক সংবাদকে বলেন, বর্তমানে নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে পাইলিংয়ের কাজ বন্ধ থাকলেও মাস খানেক পর শুরু করা যাবে। আর যদি করোনা ও সমগ্রীক অবস্থা ভালো থাকে তবে আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারব।
২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি নদীপারের লাখো মানুষের স্বপ্নের দ্বিতীয় এই তিস্তা সেতুর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৮ সালে উপজেলার হরিপুর-চিলমারী তিস্তা সেতু নির্মাণসহ সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দাতাদেশ সৌদি আরব প্রকল্পটি অনুমোদন দিতে দেরি করায় কাজ পিছিয়ে যায়। এমতাবস্থায় স্থানীয় সাংসদ ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ৬ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর-চিলমারী উপজেলা সদরের সঙ্গে সংযোগকারী সড়কে তিস্তা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প অনুমোদন দেয়। শিডিউল মোতাবেক কাজ এগিয়ে গেলে ২০২৩ সালের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার, ৩১ জুলাই ২০২১
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহের মানুষের স্বপ্নের তিস্তা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেতুটি ২৯২টি পাইলের মধ্যে ১০১টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।
এছাড়া, গাইবান্ধা অংশে এক কিলোমিটার সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি) এর পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
স্থানীয়দের আশা, সেতটিু চালু হলে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের অনেক দ্বার খুলে যাবে।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ঘাট থেকে তিস্তা নদীর ওপর দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী পর্যন্ত ১ হাজার ৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা নদীর ওপর ৩৬৭.৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৪৯০ মিটার ব্রীজের কাজ শুরু হয়েছে। এলজিইডির ব্যবস্থাপনায় নির্মিত সেতুটিতে নির্মাণ কাজ করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না স্টেট কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন(সিএসসিইসি)। সেতুটিতে পিলার ৩০টি, পাইল ২৯৩টি। এর মধ্যে ৩টি টেস্ট পাইল। ইতোমধ্যে ১০১টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। পিলারের সুন্দরগঞ্জ অংশের পিলারটি ৯টি পাইলের ওপর আর কুড়িগ্রাম অংশের পিলারটি ১২টি পাইলের ওপর বসবে।
সূত্র আরও জানায়, সেতুটিকে ঘিরে গাইবান্ধা অংশে ১০টি ব্রিজ, ৫৯টি কালভার্ট ও জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সেখানে তিস্তা ব্রিজসহ মোট ব্যায় ধরা হয়েছে ৬৫৩ কোটি টাকা, যা বাস্তবান করবে এলজিইডি গাইবান্ধা। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম অংশে সংযোগ সড়ক, জমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণে ব্যায় ধরা হহয়েছে একশ ৪৭ কোটি টাকা, যা বাস্তবায়ন করবে এলজিইডি কুড়িগ্রাম।
এলজিইডি সূত্রে আরও জানাগেছে, সেতুটির দুইপাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। হরিপুর সেতু সংলগ্ন এলাকা হতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহর পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি সেতুর সংযোগ সড়কে রূপান্তের কাজ পুরোদমে চলছে। যার কারণে বাঁধের দুই পাশেই অবৈধভাবে গড়ে উঠা বসতবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে অসহায় পরিবারগুলো। এছাড়া কুড়িগ্রামের সাথে ঢাকার সংযোগ করতে জেলার সাদুল্লাপুর-সুন্দরগঞ্জ-চিলমারী পর্যন্ত দুই পাশে ৮৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ হবে। সেতুর উভয় পাশে নদীশাসন হবে ৩ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করে। যা সম্পন্ন হলে গাইবান্ধা এবং কুড়িগ্রাম জেলার স্থানীয় জনগণ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে।
স্থানীদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, বৃহৎ এ সেতুটি গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা ছাড়াও কয়েক জেলার মানুষের ‘স্বপ্ন’ ও দীর্ঘদিনের ‘প্রাণের দাবি’ছিল। সুন্দরগঞ্জের চণ্ডীপুর ইউনিয়নের উত্তর চণ্ডীপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক শরিয়ত উল্লা ১১ বছর আগে তিস্তা সেতু নির্মাণের দাবি তোলেন। সেই ২০০১ সালে শুরু হওয়া আন্দোলন-সংগ্রামের পর সেতু নির্মাণ আলোর মুখ দেখতে পায় ২০১২ সালে। শরিয়ত উল্লা মাস্টারের ডাকে সুন্দরগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ সেতুর দাবিতে সে সময় একটি কমিটিও গঠন করে। যার নাম দেয়া হয় ‘তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন কমিটি’।
সরেজমিনে ঘুরে তিস্তাপারের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, সেতুর কাজ শেষ হলে এটি হবে উত্তরাঞ্চলের নদীপারের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। যোগাযোগের পথ সুগম হবে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুরের মানুষের। একই সঙ্গে এসব জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়া নদীপারের হাজারও মানুষের ব্যবসার প্রসার ঘটবে। চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পাবে। এদিকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ সেতুর দুই পাশে অসংখ্য দোকানপাট, খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছে।
হরিপুর ঘাট এলাকার কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, ‘নদীর ওই পাড় যাই সোতরিয়ে (সাঁতার)। নৌকে ভড়া (ভাড়া) ঘাটের ভড়া বাঁচপার তেকনে (জন্য)। ব্রিজ হইলে আর নদী সোতরার নাগবে নয়; আস্তা (রাস্তা) দিই (দিয়ে) যাতায়াত করতি পারমু।’একই এলাকার বজলুর রহমান বলেন, ‘এই সেতুটে হবি হবি (হবে) কতে কতে (বলা) বহু লোক চলি গেছি, তাও দেখপার পায় নাই। হামার বাপ-দাদা; আরও বহু গ্রামবাসিও চলি গেছি। এই সেতুটে যে হলি; হামার জেবনের (জীবনের) সাধনা পালন হলো। মনের আশা পূরণ হলো।’কাশেম বাজারের মাসুদ রানা বলেন, ‘নদীভাঙন থেকে বাঁচতিচি। আবার নদী যখন শাসন হবে; তখন এই এলাকার সব অকেজো (পতিত) জমি কৃষিকাজে ব্যবহার হবে। দেশের উন্নয়ন হবে।’
পাশের উজান বোচাগাড়ি গ্রামের শাকিল মিয়া জানান, তিস্তা সেতু নির্মাণের দাবি ছিল স্বপ্নের কাঙ্খিত দাবি। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর সেই দাবি বাস্তবায়ন হওয়ায় আনন্দে ভাসছেন তিস্তাপারের বাসিন্দাসহ গোটা গাইবান্ধাবাসী। অনেকেই আবার সেতু ঘিরে নতুন ‘স্বপ্ন’ বুনছেন। কেউ বা আবার অধিগ্রহণে জমির কাঙ্খিত দাম পেয়ে খুশি। সোহেল মিয়া বলেন, ‘গাইবান্ধা একটা অবহেলিত এলাকা। সেতুটা হলে এখানে অনেক উন্নয়ন হবে। সবদিকে সুযোগসুবিধা বাড়বে। হঠাৎ করি একজন অসুস্থ রোগীকে তড়িঘড়ি করে হসপিটালে নিয়ে যেতে পারি না। কাঁধে করে বাড়ি থেকে ঘাট পর্যন্ত আনতে হয়। এরপর নৌকায় করে ওপর পৌঁছাতেই রোগী মারা যায়।’
গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক প্রমতোষ সাহা সংবাদকে বলেন, ‘সেতুটি হলে উন্নয়নের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে জেলা শহরের সাথে কুড়িগ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তি এলাকাগুলোর যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও সচল হবে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হবে।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আবুল মুনছুর জানান, তিস্তা সেতু যাবতীয় কার্যক্রম গাইবান্ধা নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় হতে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫০০ মিটারের কম হওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। এটি এলজিইডির একটি বিরাট অর্জন। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।’
জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান কবির সংবাদকে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধা এলজিইডি’র আওতায় ৬৫০ কোটি টাকার কাজ হবে। এর মধ্যে আছে ১০টি ব্রিজ, ৫৯টি কালভার্ট আর ৮৬ কিলোমিটার রাস্তা। এছাড়াও জমি অধিগ্রহণে ব্যায় ধরা হয়েছ একশ কোটি টাকা। আমরা আশা করছি নিদিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজটি শেষ হবে।’
চায়না স্টেট কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন(সিএসসিইসি)পরিকল্পনা প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এ যাবৎ আমাদের ১০১ টি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। গাইবান্ধা হরিপুর সাইটে এক কিলোমিটার এপ্রোচ সড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছ। সব মিলিয়ে ১৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২৩ সালের মধ্যে জুনের আগেই সব কাজ শেস হবে।’
ব্রিজটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক(পিডি) মো. আব্দুল মালেক সংবাদকে বলেন, বর্তমানে নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে পাইলিংয়ের কাজ বন্ধ থাকলেও মাস খানেক পর শুরু করা যাবে। আর যদি করোনা ও সমগ্রীক অবস্থা ভালো থাকে তবে আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারব।
২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি নদীপারের লাখো মানুষের স্বপ্নের দ্বিতীয় এই তিস্তা সেতুর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৮ সালে উপজেলার হরিপুর-চিলমারী তিস্তা সেতু নির্মাণসহ সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দাতাদেশ সৌদি আরব প্রকল্পটি অনুমোদন দিতে দেরি করায় কাজ পিছিয়ে যায়। এমতাবস্থায় স্থানীয় সাংসদ ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ৬ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর-চিলমারী উপজেলা সদরের সঙ্গে সংযোগকারী সড়কে তিস্তা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প অনুমোদন দেয়। শিডিউল মোতাবেক কাজ এগিয়ে গেলে ২০২৩ সালের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।