বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এদিকে কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক উস্কানির জের ধরে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে সহিংসতায় নিহত আরও একজনের মৃতদেহ শনিবার (১৬ অক্টোবর) উদ্ধার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটে শনিবারও মন্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম থেকে পুলিশ ৮৪ জনকে আটক করেছে। ৬০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। নোয়াখালীতে বিক্ষুব্ধ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ করেছে।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে আরও ১ ব্যক্তির লাশ পানিতে ভাসমান অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করেছে। চৌমুহনী পৌরসভা এলাকার বাজারে প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। শনিবার প্রশাসনের দায়ের করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঐ ব্যক্তির লাশ নিয়ে নোয়াখালী-ফেনী আঞ্চলিক মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে এ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
সকাল থেকে বাজারের অধিকাংশ দোকান-পাট বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাড়তি র্যাব, বিজিবি, আমর্ড পুলিশসহ বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। তিনি সনাতন ধর্মালম্বী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ ঘটনার সুুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস প্রদান করেন।
এদিকে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্ব প্রাপ্ত) আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপির নেতৃত্বে এ প্রতিনিধি দলে রয়েছেন দলের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান প্রমুখ।
নোয়াখালী পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কিশোর চন্দ্র শীল জানান, সম্প্রীতি বজায় রাখতে বেগমগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল, ডিআইজি, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সনাতন ধর্মাবলম্বী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে আলোচনা সভাস্থলে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
উল্লেখ্য, কুমিল্লার পূজামন্ডপে সংগঠিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী বাজারের কয়েকটি মন্দির ও মন্ডপে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে একদল দুর্বৃত্ত। একই সময় হামলাকারীরা মন্ডপে আগুন দেয় ও বাজারের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালায়। ঘটনায় পুলিশসহ আহত হয় অন্তত ৫০ জন। হামলার সময় যতন কুমার সাহা (৪২) নামে এক ব্যক্তি মারা যান। অন্যদিকে শনিবার সকালে ইসকন মন্দিরের পুকুরে ভাসমান অবস্থায় প্রান্ত সাহা (২০) নামের একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। কুমিল্লার পূজা মন্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী বাজারে শনিবার ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শনিবার দুর্বৃত্তরা চৌমুহনী বাজারের কয়েকটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে। একই সময় হামলাকারীরা বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে। এতে পুলিশসহ ৩০ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় ৪৭ জনকে আটক করা হয়েছে। শনিবার ভোরে চৌমুহনী ইসকন মন্দিরের পুকুর থেকে সুবেল চন্দ্র সাহার লাশ উদ্ধার করে মন্দিরের লোকজন।
বেগমগঞ্জ থানার ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক আমেনা বেগম ৪৭ জন আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, শনিবারের ঘটনায় থানায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামছুন নাহার জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চৌমুহনী পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
চট্টগ্রামে পূজামন্ডপে হামলা : আটক ৮৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, কুমিল্লাকান্ডের রেশ ধরে চট্টগ্রামের জেএমসেন হলে পূজামন্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত ৮৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) দুপুরে জুমার নামাজের পর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে বের হয়ে কিছু মুসল্লি পাশের জেএমসেন হলের পূজামন্ডপের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় ব্যানার ছেঁড়ার পাশাপাশি প্রতিমা লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে বলেও অভিযোগ করেছে পূজা কমিটি।
এদিকে জেএমসেন হলে পূজামন্ডপে হামলার ঘটনায় অন্তত ৬শ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। শনিবার কোতোয়ালি থানার এসআই আকাশ মাহমুদ ফরিদ বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। এতে এজহার নামীয় ৮৪ জনের পাশাপাশি অজ্ঞাত আরও ৫শ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক বলেন, পূজামন্ডপে হামলার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অভিযান চলমান আছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত শনিবার চট্টগ্রামে আধাবেলা হরতালের ডাক দেন। হরতাল চলাকালে আন্দরকিল্লা এলাকায় যানবাহন চলাচল ছিল সীমিত।
হরতালের সমর্থনে সকাল থেকে জেএমসেন হল এলাকায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ, জাতীয় হিন্দু মহাজোট নেতাসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জড়ো হন। তারা সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার নিন্দা জানিয়ে নেতারা বলেন, হিন্দুরা শান্তিপ্রিয়। তারা সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু গুজব রটিয়ে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে, প্রতিমা ভাঙা হচ্ছে। এতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
এর আগে শুক্রবার হামলার প্রতিবাদে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিমা বিসর্জন দেয়া বন্ধ থাকলেও পরে প্রশাসনের আশ্বাসে সন্ধ্যা থেকে পতেঙ্গা সৈকত, কালুরঘাট ও অভয়মিত্র ঘাটে বিসর্জন দেয়া শুরু করে সনাতন ধর্মের লোকজন।
কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দীন বলেন, জেএমসেন হলে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। এ পর্যন্ত ওই মামলায় ৮৪ জন আসামিকে ভিডিও ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৫শ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই হামলার নেপথ্যে কারা তা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে বের করা হবে। আমরা দশজন করে আদালতের কাছে রিমান্ড চাইব। তখন তাদের আরও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার মাধ্যমে ঘটনার নির্দেশদাতা ও উদ্দেশ্য জানা যাবে।
চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য্য সাংবাদিকদের বলেন, প্রতি বছর ১১টা থেকে বিসর্জনের কাজ শুরু হয়। এবার সরকারি নির্দেশনা ছিল নামাজের জন্য বেলা আড়াইটার পর থেকে পূজামন্ডপ থেকে বিসর্জনের জন্য বের হওয়ার। সেজন্য আমরা মন্ডপে অপেক্ষা করে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করছিলাম। ঠিক এ সময় আমাদের এখানে হামলা হয়েছে।
২৩ অক্টোবর সারাদেশে গণঅনশন-বিক্ষোভ মিছিল
সারাদেশে পূজামন্ডবে হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ। শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এ সব কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আগামী শনিবার (২৩ অক্টোবর) সারাদেশে ভোর ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত গণঅনশন ও গণঅবস্থান এবং সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় এ কর্মসূচি পালিত হবে শাহবাগ চত্বরে এবং চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লা চত্বরে।
বাগেরহাটে প্রতিমা ভাঙচুর
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাট জেলার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত চিতলমারী উপজেলার শ্যামাপাড়া গ্রামের সার্বজনীন কালীমন্দিরে দুটি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে শনিবার সকালে উপজেলা চেয়ারম্যান অশোক কুমার বড়াল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লিটন আলী, থানার ওসি এইস এম কামরুজ্জামান খান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীযূষ কান্তি রায়সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ওই মন্দির পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। মন্দিরে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
শ্রামাপাড়া গ্রামের সার্বজনীন কালীমন্দির কমিটির সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বৈরাগী জানান, তাদের মন্দিরে গত ৭০ বছর ধরে পৌষ মাসে কালি পূজা করে আসছেন। এছাড়া ওই মন্দিরে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা আরাধনা করা হয়। শনিবার সকালে প্রতিবেশীরা কালীমন্দিরে দুটি কালী প্রতিমা ভাঙচুর অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে মন্দির কমিটির লোকজনকে জানায়। এ সময় তারা প্রশাসনকে খবর দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, শুক্রবার রাতের যে কোন সময় দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটাতে পারে। খবর পেয়ে প্রশাসনের লোকজনসহ জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। এ সময় তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বৈরাগী অভিযোগ করে বলেন, ৭ বছর আগেও রাতের আঁধারে ওই মন্দিরে হামলা চালিয়ে মন্দিরটি ভেঙে রেখে যায়।
এ বিষয়ে চিতলমারী থানার ওসি এইস এম কামরুজ্জামান খান জানান, রাতের বেলায় কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি সাধারণ ডায়েরি করার জন্য মন্দির কমিটিকে বলা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লিটন আলী জানান, মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১
বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এদিকে কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক উস্কানির জের ধরে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে সহিংসতায় নিহত আরও একজনের মৃতদেহ শনিবার (১৬ অক্টোবর) উদ্ধার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটে শনিবারও মন্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম থেকে পুলিশ ৮৪ জনকে আটক করেছে। ৬০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। নোয়াখালীতে বিক্ষুব্ধ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ করেছে।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে আরও ১ ব্যক্তির লাশ পানিতে ভাসমান অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করেছে। চৌমুহনী পৌরসভা এলাকার বাজারে প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। শনিবার প্রশাসনের দায়ের করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঐ ব্যক্তির লাশ নিয়ে নোয়াখালী-ফেনী আঞ্চলিক মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে এ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
সকাল থেকে বাজারের অধিকাংশ দোকান-পাট বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাড়তি র্যাব, বিজিবি, আমর্ড পুলিশসহ বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। তিনি সনাতন ধর্মালম্বী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ ঘটনার সুুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস প্রদান করেন।
এদিকে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্ব প্রাপ্ত) আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপির নেতৃত্বে এ প্রতিনিধি দলে রয়েছেন দলের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান প্রমুখ।
নোয়াখালী পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কিশোর চন্দ্র শীল জানান, সম্প্রীতি বজায় রাখতে বেগমগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল, ডিআইজি, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সনাতন ধর্মাবলম্বী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে আলোচনা সভাস্থলে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
উল্লেখ্য, কুমিল্লার পূজামন্ডপে সংগঠিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী বাজারের কয়েকটি মন্দির ও মন্ডপে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে একদল দুর্বৃত্ত। একই সময় হামলাকারীরা মন্ডপে আগুন দেয় ও বাজারের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালায়। ঘটনায় পুলিশসহ আহত হয় অন্তত ৫০ জন। হামলার সময় যতন কুমার সাহা (৪২) নামে এক ব্যক্তি মারা যান। অন্যদিকে শনিবার সকালে ইসকন মন্দিরের পুকুরে ভাসমান অবস্থায় প্রান্ত সাহা (২০) নামের একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। কুমিল্লার পূজা মন্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী বাজারে শনিবার ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শনিবার দুর্বৃত্তরা চৌমুহনী বাজারের কয়েকটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে। একই সময় হামলাকারীরা বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে। এতে পুলিশসহ ৩০ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় ৪৭ জনকে আটক করা হয়েছে। শনিবার ভোরে চৌমুহনী ইসকন মন্দিরের পুকুর থেকে সুবেল চন্দ্র সাহার লাশ উদ্ধার করে মন্দিরের লোকজন।
বেগমগঞ্জ থানার ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক আমেনা বেগম ৪৭ জন আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, শনিবারের ঘটনায় থানায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামছুন নাহার জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চৌমুহনী পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
চট্টগ্রামে পূজামন্ডপে হামলা : আটক ৮৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, কুমিল্লাকান্ডের রেশ ধরে চট্টগ্রামের জেএমসেন হলে পূজামন্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত ৮৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) দুপুরে জুমার নামাজের পর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে বের হয়ে কিছু মুসল্লি পাশের জেএমসেন হলের পূজামন্ডপের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় ব্যানার ছেঁড়ার পাশাপাশি প্রতিমা লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে বলেও অভিযোগ করেছে পূজা কমিটি।
এদিকে জেএমসেন হলে পূজামন্ডপে হামলার ঘটনায় অন্তত ৬শ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। শনিবার কোতোয়ালি থানার এসআই আকাশ মাহমুদ ফরিদ বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। এতে এজহার নামীয় ৮৪ জনের পাশাপাশি অজ্ঞাত আরও ৫শ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক বলেন, পূজামন্ডপে হামলার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অভিযান চলমান আছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত শনিবার চট্টগ্রামে আধাবেলা হরতালের ডাক দেন। হরতাল চলাকালে আন্দরকিল্লা এলাকায় যানবাহন চলাচল ছিল সীমিত।
হরতালের সমর্থনে সকাল থেকে জেএমসেন হল এলাকায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ, জাতীয় হিন্দু মহাজোট নেতাসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জড়ো হন। তারা সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার নিন্দা জানিয়ে নেতারা বলেন, হিন্দুরা শান্তিপ্রিয়। তারা সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু গুজব রটিয়ে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে, প্রতিমা ভাঙা হচ্ছে। এতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
এর আগে শুক্রবার হামলার প্রতিবাদে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিমা বিসর্জন দেয়া বন্ধ থাকলেও পরে প্রশাসনের আশ্বাসে সন্ধ্যা থেকে পতেঙ্গা সৈকত, কালুরঘাট ও অভয়মিত্র ঘাটে বিসর্জন দেয়া শুরু করে সনাতন ধর্মের লোকজন।
কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দীন বলেন, জেএমসেন হলে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। এ পর্যন্ত ওই মামলায় ৮৪ জন আসামিকে ভিডিও ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৫শ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই হামলার নেপথ্যে কারা তা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে বের করা হবে। আমরা দশজন করে আদালতের কাছে রিমান্ড চাইব। তখন তাদের আরও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার মাধ্যমে ঘটনার নির্দেশদাতা ও উদ্দেশ্য জানা যাবে।
চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য্য সাংবাদিকদের বলেন, প্রতি বছর ১১টা থেকে বিসর্জনের কাজ শুরু হয়। এবার সরকারি নির্দেশনা ছিল নামাজের জন্য বেলা আড়াইটার পর থেকে পূজামন্ডপ থেকে বিসর্জনের জন্য বের হওয়ার। সেজন্য আমরা মন্ডপে অপেক্ষা করে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করছিলাম। ঠিক এ সময় আমাদের এখানে হামলা হয়েছে।
২৩ অক্টোবর সারাদেশে গণঅনশন-বিক্ষোভ মিছিল
সারাদেশে পূজামন্ডবে হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ। শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এ সব কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আগামী শনিবার (২৩ অক্টোবর) সারাদেশে ভোর ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত গণঅনশন ও গণঅবস্থান এবং সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় এ কর্মসূচি পালিত হবে শাহবাগ চত্বরে এবং চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লা চত্বরে।
বাগেরহাটে প্রতিমা ভাঙচুর
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাট জেলার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত চিতলমারী উপজেলার শ্যামাপাড়া গ্রামের সার্বজনীন কালীমন্দিরে দুটি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে শনিবার সকালে উপজেলা চেয়ারম্যান অশোক কুমার বড়াল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লিটন আলী, থানার ওসি এইস এম কামরুজ্জামান খান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীযূষ কান্তি রায়সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ওই মন্দির পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। মন্দিরে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
শ্রামাপাড়া গ্রামের সার্বজনীন কালীমন্দির কমিটির সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বৈরাগী জানান, তাদের মন্দিরে গত ৭০ বছর ধরে পৌষ মাসে কালি পূজা করে আসছেন। এছাড়া ওই মন্দিরে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা আরাধনা করা হয়। শনিবার সকালে প্রতিবেশীরা কালীমন্দিরে দুটি কালী প্রতিমা ভাঙচুর অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে মন্দির কমিটির লোকজনকে জানায়। এ সময় তারা প্রশাসনকে খবর দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, শুক্রবার রাতের যে কোন সময় দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটাতে পারে। খবর পেয়ে প্রশাসনের লোকজনসহ জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। এ সময় তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বৈরাগী অভিযোগ করে বলেন, ৭ বছর আগেও রাতের আঁধারে ওই মন্দিরে হামলা চালিয়ে মন্দিরটি ভেঙে রেখে যায়।
এ বিষয়ে চিতলমারী থানার ওসি এইস এম কামরুজ্জামান খান জানান, রাতের বেলায় কে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি সাধারণ ডায়েরি করার জন্য মন্দির কমিটিকে বলা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লিটন আলী জানান, মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।