শামীমা নাসরীন
বসন্ত বিদায়। সমাগত নতুন বছর- আর নববর্ষ সময়ের নতুন উদ্বোধন। নতুন মানেই নবসৃষ্টি। কালের নতুন বার্তা। জীবনের নতুন আয়োজনের উচ্ছ্বাস। নতুন পরিকল্পনা। নতুন কর্মের স্বপ্ন, নতুন স্বপ্নের অভিজ্ঞান। সময়ের প্রতিটি বিন্দু এই নতুনের আনন্দে উদ্ভাসিত, উল্লসিত, দ্বিধাহীন, উজ্জীবিত। এই উজ্জীবন মানুষের স্বপ্নের সীমানা দীর্ঘ করে তোলে। তাই মানুষ নতুন সময় থেকে নতুন স্বপ্নের রং খোঁজে। খোঁজে জীবনকে জাগানোর নতুন কোনো গতি। কেননা বৈশাখ আসে চির নতুনের বার্তা নিয়ে। আসে সাহসের ঝঞ্ঝা হয়ে, দ্বিধাহীন দ্রোহের রূপ নিয়ে। অবসাদের সমস্ত আলস্য, সমস্ত মালিন্য ঝেড়ে জাগিয়ে তোলে চাঞ্চল্যের ঘোড়া। জীর্ণতার সমস্ত শরীর ভেঙে সজীবতার প্রাবল্যে নতুন আনন্দে দুলে ওঠে চিরায়ত প্রকৃতি। জেগে ওঠে জীবনের চারিধার। পুরনো সময় থেকে নতুনের অভিযাত্রা এই বৈশাখের প্রতিটি মুহূর্তই নতুন গতির উন্মেষ।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এর ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হলো- ‘শুভ নববর্ষ’। এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আরবি চন্দ্র মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান এবং বাংলার ফসলি চক্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা সনের প্রচলন বা সংস্কার করেন। এরপর থেকে এভাবে সন গণনা স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রচলিত আছে। ইরান থেকে আগত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ‘ফতেহউল্লাহ সিরাজি’ বাদশাহ ‘আকবরের’ নির্দেশে হিজরি সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সন চালু করেছিলেন। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে মূলত বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। প্রথমে এ সন ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল এবং পরে নাম হয় বঙ্গাব্দ। তখন দিল্লি সরকারের অফিসিয়াল ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা ছিল হিজরি সন, আর বাংলায় চালু ছিল শকাব্দ। যা রাজা শশাঙ্ক চালু করেছিলেন। যদিও বর্তমানে ভারতের জাতীয় সন শকাব্দই রয়ে গেছে, তবুও রাজা শশাঙ্কের বর্ষপঞ্জি আর বর্তমান বাংলা সন এক নয়। জনসাধারণ এবং কৃষক-সমাজের সুবিধার্থে ‘শিরাজি’- সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বারো মাসের নাম আগের মতোই রেখে দিয়েছেন। যা ছিল স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি দিল্লির সম্মান প্রদর্শন। সেই থেকে বৈশাখ মাসে জমিদার, নবাব, তালুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামীরা খাজনা বা রাজস্ব আদায় করতেন। এখনও তহসিল অফিসগুলো ‘বৈশাখ-চৈত্র’ মাসের হিসাবে খাজনা আদায় করে থাকে।
এছাড়া পঞ্জিকা বর্ষ বা বঙ্গাব্দে মাস গণনার নির্ধারিত দিনক্ষণ উল্লেখ না থাকার ফলে সৌরবর্ষ বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের বেশ বড় রকমের গড়মিল ছিল। তদুপরি বাংলা সন গণনার কোনো লিপইয়ারও ছিল না। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বাংলা একাডেমি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে এই সমস্যার একটি বিজ্ঞানসম্মত সমাধান ও সংস্করণ করেন। যার ফলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ নির্ধারিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত।
নববর্ষ বাঙালির আত্মপরিচয় বহন করে। নানা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই সর্বজনীন উৎসবের একটি অর্থনৈতিক ভিতও দাঁড়িয়েছে। রূপ নিয়েছে বাঙালির চিরায়ত উৎসবে। একসময় বাংলা নববর্ষের প্রচলন শুরু হয়েছিল ঋতুধর্মিতাকে মাথায় রেখে। যা ছিল ফসলের সাথে সম্পর্কিত। পরে এর সাথে যোগ হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যবসার পুরনো হিসাব শেষ করে নতুন হিসাবের খাতা খোলার ‘হালখাতা’। সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো নতুন এই হিসাব খাতায় মুসলমান বাঙালিরা ‘এলাহী ভরসা’ লিখে অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার বন্দনা দিয়ে হিসাব শুরু করতেন। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসবই ছিল হালখাতা। ভোক্তা ব্যবসায়ী সকলকে এ দিনে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হতো। এ আপ্যায়ন একান্ত সৌজন্যমূলক হলেও ব্যবসায়ীরা এ দিনে বাকি-বকেয়া আদায় করে নিত। নেহাৎ অসমর্থ না হলে কেউ বাকির ঘরে নাম রাখতে চাইত না। কেননা তখন হালখাতায় ঋণ থাকা একটা অসম্মানজনক ব্যাপার ছিল। হালখাতা নববর্ষের একটি সর্বজনীন উৎসবমূলক আনুষ্ঠানিকতা। ভোক্তা এবং ব্যবসায়ী উভয়েই স্বচ্ছন্দে এ আচরণীয় রীতি পালন করতেন এবং দেশীয় রীতিতে যারা হিসাব-নিকাশ করেন, তাদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানটির প্রচলন এখনও রয়েছে।
বাংলা নববর্ষের আরও একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান ছিল পুণ্যাহ। ‘পুণ্যাহ’ অর্থ পুণ্যকর্ম সম্পাদনের পক্ষে জ্যোতিষ শাস্ত্রানুমোদিত শুভ দিন। কিন্তু বাংলায় এর অর্থ ছিল- জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে বছরের সূচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতীকী খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠান। লোক গবেষক ‘শামসুজ্জামান খান’-এর মতে- বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথমে ‘পুণ্যাহ’র রীতি চালু করেন। বাংলা নববর্ষে তখন জমিদার ও বড় বড় তালুকদারের কাছারিতে পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হতো। এদিনে প্রজারা ভালো কাপড় পরিধান করে জমিদার বা তালুকদার বাড়িতে খাজনা দিতে আসত এবং পান-সুপারি ও মিষ্ঠান্ন দিয়ে তারা আপ্যায়িত হতো। এ সময় তারা তাদের মধ্যকার সম্পর্কের দূরত্ব ঘুচিয়ে পরস্পর মিলিত হতেন এ আনন্দযজ্ঞে এবং পরস্পরের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতেন। এদিক থেকে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানও ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলাদেশ থেকে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম সন্ধান মেলে ১৯১৭ সালে। ১৯৩৮ সালেও এরূপ অনুষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায় নববর্ষের ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশে আধুনিক ধারার নববর্ষ চালু হয়েছে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। প্রবল বৈরিতা এবং বাধাবিপত্তির মধ্যেও বাঙালির যে মনোবল হারায়নি, তার প্রমাণ ১৯৪৯ সাল থেকেই ঢাকায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, অমর ভাষা শহিদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ সেদিনের যুব-সমাজ যেভাবে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল, তারই পরিণতি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়। ফজলুল-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে জাতির উদ্দেশ্যে বললেন-
“আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। এই উপলক্ষে আমি আমার একান্ত প্রিয় পূর্ব বঙ্গবাসীদের জানাচ্ছি আন্তরিক অভিনন্দন। ধূলিঝঞ্ঝা নিয়ে চৈত্র শেষ হয়েছে। অনতিবিলম্বে হবে প্রকৃতি মেঘমুক্ত, পরিবেশ হবে পরিচ্ছন্ন। নবঊষার নতুন আলো আর নির্মল বাতাস প্রাণভরে গ্রহণ করুন আমার পূর্ব পাকিস্তানী ভাতৃবৃন্দ।”
সেদিন তিনি বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন এবং ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে মহা-আড়ম্বরে, মহাসমারোহে তখন থেকেই বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। তবে এর পথযাত্রা শুরু হয়েছিল তারও পূর্বে। ১৯৪০ সালেই পরম শ্রদ্ধেয় মনীষী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধ লিখলেন। যার নাম- ‘বাঙালি জাতির এক বা একাধিক উৎসব চাই’। তিনি লিখলেন-
“পহেলা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় উৎসব হলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মিলিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।”
তবে মধ্যযুগেও যে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতো সে-সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আহমদ শরীফ বলেছেন-
“মধ্যযুগেও আমাদের দেশে নববর্ষের উৎসব হতো। শাসকগোষ্ঠীও উদযাপন করত নওরোজ। কিন্তু আমাদের মধ্যযুগীয় চেতনায় এর গুরুত্ব যতটা বৈষয়িক ছিল, মানবিক ছিল না ততটা এবং এর পার্বণিক প্রকাশ নিষ্প্রাণ রেওয়াজে ছিল সীমিত, কখনও তা মানস বিকাশের সহায়ক হয়ে ওঠেনি। স্থিতিশীলতার সঠিক মধ্যযুগীয় মানুষ তাই জন্মদিন পালন করত না, মৃত্যু দিবসই স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াসী ছিল। জন্মোৎসবে আমাদের আগ্রহ জাগে প্রতীচ্য প্রভাবে। জন্ম ও জীবনের মহিমা প্রতীচ্য প্রভাবেই আমাদের হৃদয়বেদ্য হয়ে ওঠে।”
এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, তখন নববর্ষ উৎসবে সর্বজনীনতা ছিল না। শাসক-শ্রেণি, অর্থনৈতিকভাবে সমাজ নিয়ন্ত্রক শ্রেণি বা ভূস্বামীরাই এ অনুষ্ঠানটি জাঁকজমভাবে পালন করতেন এবং সাধারণ প্রজাগণ নিমিত্ত হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ‘মুনতাসীর মামুন’ ডয়চে ভেলেকে বলেন-
“রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল আইয়ুব খানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায়। আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে শিল্পের প্রকাশ হিসেবে। যা এখন পরিণত হয়েছে বাঙালির জীবনে স্থায়ী এক সর্বজনীন উৎসবে।”
আমাদের জাতীয় জীবনে পরিবর্তন এসেছে নানা দিক থেকে। ৪০-৫০ হাজারের শহরটি আজ দেড় কোটি নর-নারীর বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলে প্রাদেশিক রাজধানী থেকে ‘ঢাকা’ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের রাজধানী। তাই উৎসবের ধরনও পাল্টাচ্ছে। বদল ঘটেছে উৎসব-ভাবনার মধ্যেও। উৎসব-ভাবনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-
“প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।... উৎসবের দিন শুধুমাত্র ভাবরস সম্ভোগের দিন নহে, শুধুমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহে- বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শক্তি উপলব্ধির দিন, শক্তি সংগ্রহের দিন।”
সেকালের এবং হাল আমলের উৎসবের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ সম্পর্কে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ‘যতীন সরকার’ বলেছেন-
“আজকে বাংলাদেশে যে নববর্ষ উৎসব পালিত হয় রবীন্দ্রনাথ কথিত উৎসবের এই অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসমূহ তাতে অনুপস্থিত। এ উৎসব যদিও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ নয়, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালিই একে আপন বলে ভাবতে পারে যদিও, তবু একটি বিশেষ শ্রেণির গণ্ডি অতিক্রম করে তা বৃহৎ ও মহৎ হয়ে উঠতে পারেনি।”
তবুও নববর্ষের উৎসব বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বিশেষ করে চিরায়ত বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এদিনটি তারা চিরকালীন বিশ্বাস এবং আড়ম্বরতার সাথে উদযাপন করে। ঘরবাড়ি ও ব্যবহার্যসামগ্রী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা থেকে শুরু করে নিজেদের পূত-পবিত্র করার প্রয়াস এদিনে মহা-আড়ম্বরে দেখা যায় তাদের মধ্যে। ভালো
খাওয়া-দাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি, পিঠা পায়েসসহ নানারকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলে এখন বহুল প্রচলিত রীতি।
নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাতসামগ্রী, শিশু-কিশোরদের খেলনা ইত্যাদি এই মেলাগুলোতে সচরাচর পাওয়া যায়। তাছাড়া বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন- চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, গজা, কদমা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। মেলাকে সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত করে রাখে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক এবং লোকনর্তকদের উপস্থিতি। যাত্রা, পালাগান, জারিগান, কবিগান, গম্ভীরা, গাজীর গান, বিভিন্ন লোকসংগীত, বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান মেলাপ্রাঙ্গণ মুখরিত করে রাখে সবসময়। এছাড়া লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও মেলায় উপস্থাপিত হয় মহাসমারোহে। শিশু-কিশোরদের জন্য মেলার প্রধান আকর্ষণ- পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস, বায়োস্কোপ ইত্যাদি অনুষঙ্গ। শহরাঞ্চলেও নগরসংস্কৃতির আমেজে বৈশাখী মেলা বসে, যা বাঙালির মনে এক আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এ বৈশাখী মেলা এক বিরাট আনন্দময় ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের রূপ নিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, দিনাজপুর, রংপুর, মহেশপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এ মেলা বসে। ঢাকার নিকটবর্তী শুভাঢ্যার বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর ¯œানকাটা মেলা, মিরপুর দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা, শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকুল মেলা, কুকুটিয়া মেলা, রাজনগর মেলা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কালের বিবর্তনে নববর্ষের সাথে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। আবার সেখানে সংযোগ ঘটেছে নতুন উৎসবের। যেমন- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। এছাড়া ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো, বিক্রমপুরের গরুর দৌড়সহ ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা উড়ানো, নৌকাবাইচ, বহুরূপী সাজ ইত্যাদি গ্রাম-বাংলার জনপ্রিয় খেলা এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। তবে চট্টগ্রামের বলীখেলা এবং রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা এখনও প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে নগরজীবনে নগর সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি ফুটানোর মধ্য দিয়ে মধ্যরাতেই ঘটে নববর্ষের শুভ উদ্বোধন। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। বাংলা বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজনে এবং বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা বাঙালির মনে এক মিলনমেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যানের চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে গড়ে ওঠে জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে (অশত্থ) রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান- ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ পুরনো অথচ যেন নতুন করেই বাজে। এ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নতুন বর্ষকে বরণ করে নেয় সমগ্র বাঙালি। নজরুলের গানে টগবগ করে প্রাণ- ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে/ কাল বোশেখীর ঝড়/তোরা সব জয়োধ্বনি কর।’ জয়ধ্বনি জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভীষণ প্রয়োজনীয় এক সুর। যাকে জীবনের পলে পলে সাজাতে হয় সুন্দরের আবাহনে। এভাবে জীবন পরিবর্তিত হয়, পরিবর্ধিত হয়, হয় পরিমার্জিত। এভাবেই পরিশোধিত হয় জীবন। ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়ানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালি বিদ্বেষ, রবীন্দ্র বিরোধিতা, নজরুলকে কেবল মুসলমানের কবি হিসেবে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার মনোবৃত্তি এবং নববর্ষ পালনকে হিন্দুয়ানি হিসেবে চিহ্নিত করার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় সংস্কৃতির জাগরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল ছায়ানটের উদ্যোগের মূল কথা। বস্তুত বাংলা নববর্ষ উদযাপনে এই উদ্যোগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতার পর এই উৎসব ঢাকার সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর সাথে অনিবার্যভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মিলনেই এটা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় উৎসবের রূপ নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের চারুশিল্পীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আয়োজিত বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহ্বানকে করে তোলে নয়নাভিরাম, মনোহর ও গভীর আবেদনময়। সারাশহর সেজে ওঠে অপরূপ সাজে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে যশোরে। যার পথিকৃৎ ছিলেন চারুশিল্পী মাহবুব জামান। বিভিন্ন সময়ে সংস্কৃতিবিরোধী কিছু অপশক্তি এ শোভাযাত্রায় বাঁধার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু উৎসব-প্রিয় বাঙালি বারবারই তা অতিক্রম করে গেছে দ্বিগুণ শক্তিতে, নতুন আলোয় বলীয়ান হয়ে। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে এবং বিশাল সূর্যের প্রতিকৃতি ধারণ করে বাঙালি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে মুখ ফিরিয়েছে। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বাঙালির ঐতিহ্য ও সর্বজনীন এক অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। শুধু গ্রাম বা শহরাঞ্চলেই নয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এই আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শিক্ষক-ছাত্র নির্বিশেষে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আনন্দ শোভাযাত্রার র্যালির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতে থাকে নাচ-গান, লোকসঙ্গীত, বাউলসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের নানা আয়োজন। এছাড়া দেশীয় পণ্য ও লোকজশিল্পের সমারোহে বিভিন্ন স্টল দিয়ে মেলার আয়োজনে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। প্রবন্ধ রচনা, আবৃত্তি এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলে। এভাবেই নববর্ষের আনন্দে বাঙালি চেতনায় এক নব মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
শামীমা নাসরীন
বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১
বসন্ত বিদায়। সমাগত নতুন বছর- আর নববর্ষ সময়ের নতুন উদ্বোধন। নতুন মানেই নবসৃষ্টি। কালের নতুন বার্তা। জীবনের নতুন আয়োজনের উচ্ছ্বাস। নতুন পরিকল্পনা। নতুন কর্মের স্বপ্ন, নতুন স্বপ্নের অভিজ্ঞান। সময়ের প্রতিটি বিন্দু এই নতুনের আনন্দে উদ্ভাসিত, উল্লসিত, দ্বিধাহীন, উজ্জীবিত। এই উজ্জীবন মানুষের স্বপ্নের সীমানা দীর্ঘ করে তোলে। তাই মানুষ নতুন সময় থেকে নতুন স্বপ্নের রং খোঁজে। খোঁজে জীবনকে জাগানোর নতুন কোনো গতি। কেননা বৈশাখ আসে চির নতুনের বার্তা নিয়ে। আসে সাহসের ঝঞ্ঝা হয়ে, দ্বিধাহীন দ্রোহের রূপ নিয়ে। অবসাদের সমস্ত আলস্য, সমস্ত মালিন্য ঝেড়ে জাগিয়ে তোলে চাঞ্চল্যের ঘোড়া। জীর্ণতার সমস্ত শরীর ভেঙে সজীবতার প্রাবল্যে নতুন আনন্দে দুলে ওঠে চিরায়ত প্রকৃতি। জেগে ওঠে জীবনের চারিধার। পুরনো সময় থেকে নতুনের অভিযাত্রা এই বৈশাখের প্রতিটি মুহূর্তই নতুন গতির উন্মেষ।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এর ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হলো- ‘শুভ নববর্ষ’। এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আরবি চন্দ্র মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান এবং বাংলার ফসলি চক্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা সনের প্রচলন বা সংস্কার করেন। এরপর থেকে এভাবে সন গণনা স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রচলিত আছে। ইরান থেকে আগত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ‘ফতেহউল্লাহ সিরাজি’ বাদশাহ ‘আকবরের’ নির্দেশে হিজরি সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সন চালু করেছিলেন। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে মূলত বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। প্রথমে এ সন ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল এবং পরে নাম হয় বঙ্গাব্দ। তখন দিল্লি সরকারের অফিসিয়াল ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা ছিল হিজরি সন, আর বাংলায় চালু ছিল শকাব্দ। যা রাজা শশাঙ্ক চালু করেছিলেন। যদিও বর্তমানে ভারতের জাতীয় সন শকাব্দই রয়ে গেছে, তবুও রাজা শশাঙ্কের বর্ষপঞ্জি আর বর্তমান বাংলা সন এক নয়। জনসাধারণ এবং কৃষক-সমাজের সুবিধার্থে ‘শিরাজি’- সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বারো মাসের নাম আগের মতোই রেখে দিয়েছেন। যা ছিল স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি দিল্লির সম্মান প্রদর্শন। সেই থেকে বৈশাখ মাসে জমিদার, নবাব, তালুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামীরা খাজনা বা রাজস্ব আদায় করতেন। এখনও তহসিল অফিসগুলো ‘বৈশাখ-চৈত্র’ মাসের হিসাবে খাজনা আদায় করে থাকে।
এছাড়া পঞ্জিকা বর্ষ বা বঙ্গাব্দে মাস গণনার নির্ধারিত দিনক্ষণ উল্লেখ না থাকার ফলে সৌরবর্ষ বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের বেশ বড় রকমের গড়মিল ছিল। তদুপরি বাংলা সন গণনার কোনো লিপইয়ারও ছিল না। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বাংলা একাডেমি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে এই সমস্যার একটি বিজ্ঞানসম্মত সমাধান ও সংস্করণ করেন। যার ফলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ নির্ধারিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত।
নববর্ষ বাঙালির আত্মপরিচয় বহন করে। নানা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই সর্বজনীন উৎসবের একটি অর্থনৈতিক ভিতও দাঁড়িয়েছে। রূপ নিয়েছে বাঙালির চিরায়ত উৎসবে। একসময় বাংলা নববর্ষের প্রচলন শুরু হয়েছিল ঋতুধর্মিতাকে মাথায় রেখে। যা ছিল ফসলের সাথে সম্পর্কিত। পরে এর সাথে যোগ হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যবসার পুরনো হিসাব শেষ করে নতুন হিসাবের খাতা খোলার ‘হালখাতা’। সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো নতুন এই হিসাব খাতায় মুসলমান বাঙালিরা ‘এলাহী ভরসা’ লিখে অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার বন্দনা দিয়ে হিসাব শুরু করতেন। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসবই ছিল হালখাতা। ভোক্তা ব্যবসায়ী সকলকে এ দিনে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হতো। এ আপ্যায়ন একান্ত সৌজন্যমূলক হলেও ব্যবসায়ীরা এ দিনে বাকি-বকেয়া আদায় করে নিত। নেহাৎ অসমর্থ না হলে কেউ বাকির ঘরে নাম রাখতে চাইত না। কেননা তখন হালখাতায় ঋণ থাকা একটা অসম্মানজনক ব্যাপার ছিল। হালখাতা নববর্ষের একটি সর্বজনীন উৎসবমূলক আনুষ্ঠানিকতা। ভোক্তা এবং ব্যবসায়ী উভয়েই স্বচ্ছন্দে এ আচরণীয় রীতি পালন করতেন এবং দেশীয় রীতিতে যারা হিসাব-নিকাশ করেন, তাদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানটির প্রচলন এখনও রয়েছে।
বাংলা নববর্ষের আরও একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান ছিল পুণ্যাহ। ‘পুণ্যাহ’ অর্থ পুণ্যকর্ম সম্পাদনের পক্ষে জ্যোতিষ শাস্ত্রানুমোদিত শুভ দিন। কিন্তু বাংলায় এর অর্থ ছিল- জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে বছরের সূচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতীকী খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠান। লোক গবেষক ‘শামসুজ্জামান খান’-এর মতে- বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথমে ‘পুণ্যাহ’র রীতি চালু করেন। বাংলা নববর্ষে তখন জমিদার ও বড় বড় তালুকদারের কাছারিতে পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হতো। এদিনে প্রজারা ভালো কাপড় পরিধান করে জমিদার বা তালুকদার বাড়িতে খাজনা দিতে আসত এবং পান-সুপারি ও মিষ্ঠান্ন দিয়ে তারা আপ্যায়িত হতো। এ সময় তারা তাদের মধ্যকার সম্পর্কের দূরত্ব ঘুচিয়ে পরস্পর মিলিত হতেন এ আনন্দযজ্ঞে এবং পরস্পরের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতেন। এদিক থেকে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানও ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলাদেশ থেকে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম সন্ধান মেলে ১৯১৭ সালে। ১৯৩৮ সালেও এরূপ অনুষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায় নববর্ষের ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশে আধুনিক ধারার নববর্ষ চালু হয়েছে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। প্রবল বৈরিতা এবং বাধাবিপত্তির মধ্যেও বাঙালির যে মনোবল হারায়নি, তার প্রমাণ ১৯৪৯ সাল থেকেই ঢাকায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, অমর ভাষা শহিদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ সেদিনের যুব-সমাজ যেভাবে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল, তারই পরিণতি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়। ফজলুল-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে জাতির উদ্দেশ্যে বললেন-
“আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। এই উপলক্ষে আমি আমার একান্ত প্রিয় পূর্ব বঙ্গবাসীদের জানাচ্ছি আন্তরিক অভিনন্দন। ধূলিঝঞ্ঝা নিয়ে চৈত্র শেষ হয়েছে। অনতিবিলম্বে হবে প্রকৃতি মেঘমুক্ত, পরিবেশ হবে পরিচ্ছন্ন। নবঊষার নতুন আলো আর নির্মল বাতাস প্রাণভরে গ্রহণ করুন আমার পূর্ব পাকিস্তানী ভাতৃবৃন্দ।”
সেদিন তিনি বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন এবং ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে মহা-আড়ম্বরে, মহাসমারোহে তখন থেকেই বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। তবে এর পথযাত্রা শুরু হয়েছিল তারও পূর্বে। ১৯৪০ সালেই পরম শ্রদ্ধেয় মনীষী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধ লিখলেন। যার নাম- ‘বাঙালি জাতির এক বা একাধিক উৎসব চাই’। তিনি লিখলেন-
“পহেলা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় উৎসব হলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মিলিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।”
তবে মধ্যযুগেও যে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতো সে-সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আহমদ শরীফ বলেছেন-
“মধ্যযুগেও আমাদের দেশে নববর্ষের উৎসব হতো। শাসকগোষ্ঠীও উদযাপন করত নওরোজ। কিন্তু আমাদের মধ্যযুগীয় চেতনায় এর গুরুত্ব যতটা বৈষয়িক ছিল, মানবিক ছিল না ততটা এবং এর পার্বণিক প্রকাশ নিষ্প্রাণ রেওয়াজে ছিল সীমিত, কখনও তা মানস বিকাশের সহায়ক হয়ে ওঠেনি। স্থিতিশীলতার সঠিক মধ্যযুগীয় মানুষ তাই জন্মদিন পালন করত না, মৃত্যু দিবসই স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াসী ছিল। জন্মোৎসবে আমাদের আগ্রহ জাগে প্রতীচ্য প্রভাবে। জন্ম ও জীবনের মহিমা প্রতীচ্য প্রভাবেই আমাদের হৃদয়বেদ্য হয়ে ওঠে।”
এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, তখন নববর্ষ উৎসবে সর্বজনীনতা ছিল না। শাসক-শ্রেণি, অর্থনৈতিকভাবে সমাজ নিয়ন্ত্রক শ্রেণি বা ভূস্বামীরাই এ অনুষ্ঠানটি জাঁকজমভাবে পালন করতেন এবং সাধারণ প্রজাগণ নিমিত্ত হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ‘মুনতাসীর মামুন’ ডয়চে ভেলেকে বলেন-
“রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল আইয়ুব খানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায়। আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে শিল্পের প্রকাশ হিসেবে। যা এখন পরিণত হয়েছে বাঙালির জীবনে স্থায়ী এক সর্বজনীন উৎসবে।”
আমাদের জাতীয় জীবনে পরিবর্তন এসেছে নানা দিক থেকে। ৪০-৫০ হাজারের শহরটি আজ দেড় কোটি নর-নারীর বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলে প্রাদেশিক রাজধানী থেকে ‘ঢাকা’ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের রাজধানী। তাই উৎসবের ধরনও পাল্টাচ্ছে। বদল ঘটেছে উৎসব-ভাবনার মধ্যেও। উৎসব-ভাবনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-
“প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।... উৎসবের দিন শুধুমাত্র ভাবরস সম্ভোগের দিন নহে, শুধুমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহে- বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শক্তি উপলব্ধির দিন, শক্তি সংগ্রহের দিন।”
সেকালের এবং হাল আমলের উৎসবের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ সম্পর্কে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ‘যতীন সরকার’ বলেছেন-
“আজকে বাংলাদেশে যে নববর্ষ উৎসব পালিত হয় রবীন্দ্রনাথ কথিত উৎসবের এই অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসমূহ তাতে অনুপস্থিত। এ উৎসব যদিও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ নয়, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালিই একে আপন বলে ভাবতে পারে যদিও, তবু একটি বিশেষ শ্রেণির গণ্ডি অতিক্রম করে তা বৃহৎ ও মহৎ হয়ে উঠতে পারেনি।”
তবুও নববর্ষের উৎসব বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বিশেষ করে চিরায়ত বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এদিনটি তারা চিরকালীন বিশ্বাস এবং আড়ম্বরতার সাথে উদযাপন করে। ঘরবাড়ি ও ব্যবহার্যসামগ্রী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা থেকে শুরু করে নিজেদের পূত-পবিত্র করার প্রয়াস এদিনে মহা-আড়ম্বরে দেখা যায় তাদের মধ্যে। ভালো
খাওয়া-দাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি, পিঠা পায়েসসহ নানারকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলে এখন বহুল প্রচলিত রীতি।
নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাতসামগ্রী, শিশু-কিশোরদের খেলনা ইত্যাদি এই মেলাগুলোতে সচরাচর পাওয়া যায়। তাছাড়া বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন- চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, গজা, কদমা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। মেলাকে সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত করে রাখে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক এবং লোকনর্তকদের উপস্থিতি। যাত্রা, পালাগান, জারিগান, কবিগান, গম্ভীরা, গাজীর গান, বিভিন্ন লোকসংগীত, বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান মেলাপ্রাঙ্গণ মুখরিত করে রাখে সবসময়। এছাড়া লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও মেলায় উপস্থাপিত হয় মহাসমারোহে। শিশু-কিশোরদের জন্য মেলার প্রধান আকর্ষণ- পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস, বায়োস্কোপ ইত্যাদি অনুষঙ্গ। শহরাঞ্চলেও নগরসংস্কৃতির আমেজে বৈশাখী মেলা বসে, যা বাঙালির মনে এক আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এ বৈশাখী মেলা এক বিরাট আনন্দময় ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের রূপ নিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, দিনাজপুর, রংপুর, মহেশপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এ মেলা বসে। ঢাকার নিকটবর্তী শুভাঢ্যার বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর ¯œানকাটা মেলা, মিরপুর দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা, শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকুল মেলা, কুকুটিয়া মেলা, রাজনগর মেলা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কালের বিবর্তনে নববর্ষের সাথে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। আবার সেখানে সংযোগ ঘটেছে নতুন উৎসবের। যেমন- চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। এছাড়া ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো, বিক্রমপুরের গরুর দৌড়সহ ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা উড়ানো, নৌকাবাইচ, বহুরূপী সাজ ইত্যাদি গ্রাম-বাংলার জনপ্রিয় খেলা এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। তবে চট্টগ্রামের বলীখেলা এবং রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা এখনও প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে নগরজীবনে নগর সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি ফুটানোর মধ্য দিয়ে মধ্যরাতেই ঘটে নববর্ষের শুভ উদ্বোধন। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। বাংলা বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজনে এবং বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা বাঙালির মনে এক মিলনমেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যানের চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে গড়ে ওঠে জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে (অশত্থ) রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান- ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ পুরনো অথচ যেন নতুন করেই বাজে। এ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নতুন বর্ষকে বরণ করে নেয় সমগ্র বাঙালি। নজরুলের গানে টগবগ করে প্রাণ- ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে/ কাল বোশেখীর ঝড়/তোরা সব জয়োধ্বনি কর।’ জয়ধ্বনি জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভীষণ প্রয়োজনীয় এক সুর। যাকে জীবনের পলে পলে সাজাতে হয় সুন্দরের আবাহনে। এভাবে জীবন পরিবর্তিত হয়, পরিবর্ধিত হয়, হয় পরিমার্জিত। এভাবেই পরিশোধিত হয় জীবন। ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়ানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালি বিদ্বেষ, রবীন্দ্র বিরোধিতা, নজরুলকে কেবল মুসলমানের কবি হিসেবে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার মনোবৃত্তি এবং নববর্ষ পালনকে হিন্দুয়ানি হিসেবে চিহ্নিত করার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় সংস্কৃতির জাগরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল ছায়ানটের উদ্যোগের মূল কথা। বস্তুত বাংলা নববর্ষ উদযাপনে এই উদ্যোগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতার পর এই উৎসব ঢাকার সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর সাথে অনিবার্যভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মিলনেই এটা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় উৎসবের রূপ নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের চারুশিল্পীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আয়োজিত বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহ্বানকে করে তোলে নয়নাভিরাম, মনোহর ও গভীর আবেদনময়। সারাশহর সেজে ওঠে অপরূপ সাজে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে যশোরে। যার পথিকৃৎ ছিলেন চারুশিল্পী মাহবুব জামান। বিভিন্ন সময়ে সংস্কৃতিবিরোধী কিছু অপশক্তি এ শোভাযাত্রায় বাঁধার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু উৎসব-প্রিয় বাঙালি বারবারই তা অতিক্রম করে গেছে দ্বিগুণ শক্তিতে, নতুন আলোয় বলীয়ান হয়ে। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে এবং বিশাল সূর্যের প্রতিকৃতি ধারণ করে বাঙালি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে মুখ ফিরিয়েছে। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বাঙালির ঐতিহ্য ও সর্বজনীন এক অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। শুধু গ্রাম বা শহরাঞ্চলেই নয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এই আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শিক্ষক-ছাত্র নির্বিশেষে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আনন্দ শোভাযাত্রার র্যালির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতে থাকে নাচ-গান, লোকসঙ্গীত, বাউলসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের নানা আয়োজন। এছাড়া দেশীয় পণ্য ও লোকজশিল্পের সমারোহে বিভিন্ন স্টল দিয়ে মেলার আয়োজনে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। প্রবন্ধ রচনা, আবৃত্তি এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলে। এভাবেই নববর্ষের আনন্দে বাঙালি চেতনায় এক নব মাত্রা যুক্ত হয়েছে।