আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান
আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান
গাজার যুদ্ধবিরতির গ্যারান্টার বা জামিনদার কাতার, মিসর ও তুরস্ক ইসরায়েলকে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, এই ভঙ্গুর চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর করতে এই পদক্ষেপগুলো ‘অপরিহার্য’। একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সৌদি আরবও।
গতকাল শনিবার কাতারের রাজধানীতে দোহা ফোরাম সম্মেলনে এক প্যানেল আলোচনায় কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান আল-থানি জানান, মধ্যস্থতাকারীরা এখন যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপ এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। সেখানে এই ব্যবস্থাগুলোর রূপরেখা রয়েছে। ইসরায়েল এবং হামাস এখনো যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রাথমিক ধাপের পর কীভাবে এগোবে, সে বিষয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছায়নি।
প্রথম ধাপে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ভেতরের নির্দিষ্ট ‘হলুদ লাইন’-এর পেছনে সরে গিয়েছিল, আর হামাস তাদের হেফাজতে থাকা জীবিত সব জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল এবং একজন ছাড়া মৃত সকল বন্দীর মরদেহ ফিরিয়ে দিয়েছে। আল-থানি বলেন, ‘আমরা এখন সংকটাপন্ন মুহূর্তে রয়েছি। এখনো কাজটি সম্পূর্ণ হয়নি। আমরা যা করেছি, তা কেবলই একটি বিরতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি সম্পূর্ণ হবে না এবং গাজায় স্থিতিশীলতাও ফিরবে না।’
এদিকে শনিবার এক জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা গাজায় যুদ্ধবিরতির ‘সংজ্ঞা পুনর্বিবেচনা বন্ধ করতে’ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অনুমোদিত শর্তাবলি নিয়ে পুনরায় আলোচনা এড়াতে আহ্বান জানিয়েছেন। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মানাল রাদওয়ান দোহা ফোরামে বলেন, ‘আমরা যা নিয়ে ইতিমধ্যে একমত হয়েছি এবং যা নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব হিসেবে জারি হয়েছে এবং সব পক্ষ স্বাগত জানিয়েছে, তা পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা এবং পুনরায় আলোচনার জন্য আমরা উন্মুক্ত হতে পারি না।’
তিনি যোগ করেন, ‘সুতরাং আমরা যুদ্ধবিরতি বলতে কী বুঝি, এমনকি নিরস্ত্রীকরণ বলতে কী বুঝি, গাজা শাসনের জন্য ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন প্রক্রিয়া বলতে কী বুঝি—তাতে ফিরে গিয়ে নতুন করে সংজ্ঞা দিতে পারি না।’ রাদওয়ান বলেন, যে মূলনীতি পরিবর্তন করলে অঞ্চলটি ‘অন্য পথে’ চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়, যেখানে সংঘাতের মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে কৌশলগত বিবরণের ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়।
রাদওয়ান আরও বলেন, ‘আমরা এই বিষয়গুলোর বারবার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে এবং কী, কে, কখন—এই ধরনের বহু বিশদে প্রবেশ করে নিজেদের এমন এক পার্শ্ব পথে নিয়ে যেতে পারি না, যেখানে আমরা সামগ্রিক ও সংঘাতের মূল লক্ষ্য থেকে চোখ সরিয়ে ফেলি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই একমত যে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানই হলো একমাত্র সমাধান। যদি তা-ই হয়, তবে জনগণকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, এই বাস্তবায়ন সম্ভব করতে তারা কী করতে চলেছেন।’
অপর দিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের জন্য ইসরায়েলকে গাজায় তাদের অবস্থানগুলো থেকে সরে আসতে, একটি অন্তর্বর্তী শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা মিশন মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছে মিসর। দোহা ফোরামে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি বলেন, ‘আমাদের যত দ্রুত সম্ভব এই বাহিনীকে মাটিতে মোতায়েন করতে হবে। কারণ, ইসরায়েল একপক্ষীয়ভাবে প্রতিদিন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে।’
এদিকে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান এই সমাবেশে বলেছেন, স্থিতিশীলতা বাহিনী নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে এবং কে এর নেতৃত্ব দেবে এবং কোন কোন দেশ এতে অংশগ্রহণ করবে, সে সংক্রান্ত প্রধান অমীমাংসিত বিষয়গুলো রয়ে গেছে। ফিদানের দেশ তুরস্কও এই যুদ্ধবিরতির আরেক জামিনদার। তিনি বলেন, এই বাহিনীর প্রাথমিক মিশন ‘ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলিদের থেকে আলাদা করা।’ তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এরপর আমরা অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারি।’
আবদেলাত্তি এতে সম্মত হন এবং যুদ্ধবিরতি ‘যাচাই ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য হলুদ রেখা’ বরাবর এই বাহিনী মোতায়েন করার আহ্বান জানিয়েছেন। তুরস্ক এই স্থিতিশীলতা বাহিনীতে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে, কিন্তু ইসরায়েলি সরকার তাদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছে। ফিদান পরে বলেন, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ গাজায় শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘প্রক্রিয়াটিতে নিরস্ত্রীকরণ প্রথম কাজ হতে পারে না। আমাদের বিষয়গুলোকে সঠিক ক্রমে সাজাতে হবে, আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে।’
এদিকে, গাজায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত যুদ্ধবিরতিকে আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আলোচনা ‘গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে’ এসে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল-থানি। মধ্যস্থতাকারীরা এখন যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপ বাস্তবায়নে কাজ করছেন, শনিবার কাতারে দোহা ফোরাম সম্মেলনে এক প্যানেল আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর তেল আবিব ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সঙ্গে লম্বা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যে কয়েকটি দেশের মধ্যস্থতায় আপাতত দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে, কাতার তার অন্যতম।
চলতি বছরের ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর সহিংসতা কমে এলেও পুরোপুরি থামেনি। শনিবারও ভূখ-টিতে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। “আমরা গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে রয়েছি। বিষয়টি এখনো সেই পর্যায়ে (যুদ্ধ শেষ) পৌঁছেনি। এখন পর্যন্ত আমরা যা করেছি, তাকে কেবল বিরতি বলা যেতে পারে।
“আমরা এখনও একে যুদ্ধবিরতি গণ্য করতে পারি না। যুদ্ধবিরতি তখনই পূর্ণাঙ্গ হতে পারে যখন ইসরায়েলি সেনারা ?পুরোপুরি সরে যাবে, গাজায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, মানুষ ঢুকতে-বের হতে পারবে, এখনকার পরিস্থিতি তা নয়,” বলেছেন থানি। এদিকে ফিলিস্তিনি ভূখ-টিতে যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি এক প্রতিনিধি দল গাজা থেকে শেষ জিম্মির মরদেহ ফেরত আনতে কায়রোতে মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই মরদেহ ইসরায়েল ফেরত পেলেই ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম অংশটি শেষ হবে।
যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে হামাস তাদের কাছে থাকা ২০ জীবিত জিম্মির সবাইকে এবং ২৭ জিম্মির মরদেহ ফেরত দিয়েছে। ইসরায়েল বলেছে, তারা শিগগিরই মিশর দিয়ে বের হতে গাজার রাফা সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেবে। আর শেষ জিম্মির মরদেহ ফেরত পেলে রাফা দিয়ে গাজায় ঢুকতেও দেওয়া হবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় গাজায় একটি অন্তর্বর্তী টেকনোক্র্যাট ফিলিস্তিনি সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা দেখভালের দায়িত্বে থাকবে আন্তর্জাতিক একটি ‘শান্তি পর্ষদ’, আর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সহযোগিতা দেবে। তবে এই বাহিনীর গঠন ও দায়িত্বসীমা নিয়ে একমত হওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলেই মনে হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি এ ভূখ-টিতে সংঘাত অনেকটা কমে এলেও ইসরায়েলি হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত আছে। তেল আবিব বলছে, তারা হামাসের স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ধারাবাহিক অভিযোগও করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, শনিবার ইসরায়েলি হামলায় উত্তর গাজার বেইত লাহিয়া, জাবালিয়া ও জেইতুনে ৭ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ বছর বয়সী এক নারীও আছেন, যিনি ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, তথাকথিত ইয়োলো লাইন অতিক্রম করার দুটি পৃথক ঘটনায় উত্তর গাজায় মোতায়েন করা সেনারা ফিলিস্তিনি জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তিনজন নিহত হয়। যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার বাসিন্দাদের এই ইয়োলো লাইন অতিক্রম করার কথা না।
ওই লাইন থেকে তার পরবর্তী অংশের কর্তৃত্ব এখনও তেল আবিবের হাতে। শনিবার কোনো ড্রোন হামলার বিষয়ে সামরিক বাহিনী অবগত নয়, বলেছেন ইসরায়েলি বাহিনীর মুখপাত্র।
উল্লেখ্য, গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও ইসরায়েল অবরুদ্ধ এলাকায় এখনো বোমাবর্ষণ ও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটি প্রায় ৬০০ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে, যাতে ৩৬০ জনের বেশি নিহত ও ৯০০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, যা দুই বছরের ইসরায়েলি যুদ্ধের অবসান ঘটায়। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এই যুদ্ধে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু এবং প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার লোক আহত হয়েছে।