ফেইসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গ ফাঁস হওয়া গবেষণার নথি আর সিনেট অধিবেশন প্রসঙ্গে অবশেষে মুখ খুলেছেন । তার প্রতিষ্ঠান মানুষের নিরাপত্তার থেকে মুনাফা অর্জনকে বেশি গুরুত্ব দেয়-- এই অভিযোগকে “অযৌক্তিক” বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
ফেইসবুকে পাবলিক পোস্ট দিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে এ কথা বলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট যে অভিযোগ ও প্রশ্নগুলো উঠেছে, তার সরাসরি কোনো উত্তর দেননি জাকারবার্গ, উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সিনেট সাবকমিটির কাছে হাউগেন যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, ওই একই কমিটি মার্ক জাকারবার্গকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকলেও তাতে সাড়া দেননি জাকারবার্গ, এক হাজার তিনশ শব্দের প্রতিক্রিয়া ফ্রান্সেস হাউগেনের নাম নেননি একবারও।
মঙ্গলবার সিনেট সাবকমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন হাউগেন। অধিবেশনের শুরুতেই হাউগেন বলেন “গনতন্ত্রকে দুর্বল ও শিশুদের ক্ষতি করছে ফেইসবুক”। জাকারবার্গ বলছেন, “মানুষকে রাগিয়ে তোলা বা বিষাদগ্রস্থ হওয়ার মতো পণ্য তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে এমন কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আমি জানি না”।
কিন্তু ফেইসবুকের এমএসআই এবং এনগেজমেন্ট র্যাংকিং নির্ভর অ্যালগরিদম যে সাধারণ মানুষকে বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট বেশি দেখিয়ে সহিংসতা উস্কে দিতে ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে সিনেট শুনানিতে, সেই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি জাকারবার্গ। সিনেটর ব্লুমেন্থাল ও তার দল তদন্তের খাতিরে ভুয়া ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রমাণ পেয়েছেন যে, শারীরিক গঠন নিয়ে হীনমন্যতার বাড়ানোর মতো কন্টেন্ট দেখাচ্ছে ফেইসবুকের অ্যালগরিদম; সেই বিষয়েও কিছু বলেননি জাকারবার্গ।
ফেইসবুক পোস্টে জাকারবার্গ লিখেছেন, “আমার মনে হয় ফেইসবুক নিয়ে যে ভুল চিত্র আঁকার চেষ্টা করা হচ্ছে আমাদের বেশিরভাগ সেটা চিনতে পারছে না। আমরা নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোরে উপর গভীরভাবে গুরুত্ব দেই”।
সিনেট অধিবেশনের শুরুতেই নিজের বক্তব্যে ফ্রান্সেস হাউগেন অভিযোগ তোলেন যে ফেইসবুক গনতন্ত্রকে দুর্বল করছে এবং শিশুদের ক্ষতি করছে। অভিযোগ তুলে এর সমাধানে কংগ্রেসের হস্তক্ষেপ দাবি করেন তিনি। অধিবেশনের পরবর্তী প্রশ্ন-উত্তর পর্বে হাউগেনের বক্তব্য থেকে উঠে আসে রাজনীতি ও সমজাব্যবস্থার উপর ফেইসবুকের বিরূপ প্রভাবের বিভিন্ন খুঁটিনাটি।
সিনেটর অধিবেশনে যে অভিযোগ উঠেছে তার বেশিরভাগের “কোনো মানে নেই” বলে দাবি করেছেন জাকারবার্গ। “আমরা যদি গবেষণায় পাত্তা না দিতে না চাইতাম, তাহলে শিল্পের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রকল্প কেন তৈরি করেছি আমরা?”, প্রশ্ন তুলেছেন জাকারবার্গ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, সিনেট অধিবেশনেও ফেইসবুকের গবেষণা বিভাগের সুনাম গেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মী হাউগেন। সিনেট অধিবেশনে গবেষণা প্রকল্পের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি; প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিকে ফেইসবুকের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও ফলাফল চেপে যাওয়ার প্রবণতা।
জাকারবার্গ আরও বলেছেন, “সামাজিক মেরুকরণের পেছনে যদি সামাজিক মাধ্যমগুলোর হাত থাকে, তবে আমরা কেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রে মেরুকরণ দেখতে পাচ্ছি যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি কমে আসছে বা সমান থাকছে?”।
জাকারবার্গ নিজস্ব বক্তব্যে দাবি করছেন ফেইসবুক যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে রাজনৈতিক বা সামাজিক মেরুকরণে ভূমিকা রাখে না। কিন্তু সিনেট শুনানিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক মেরুকরণ ও সহিংসতায় ফেইসবুকের ভূমিকার কয়েকটি উদাহরণ আলোচিত হয়েছে মার্কিন সিনেটর ও হাউগেনের প্রশ্ন-উত্তর পর্বে।
ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গায় ফেইসবুকের ব্যবহার বা ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য করেননি জাকারবার্গ। নিজের বক্তব্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মেরুকরণের কথা বললেও, ২০২০ সালের নির্বাচনের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো, ‘সিভিক ইন্টিগ্রিটি টিম’ কেন ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো এবং ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হিল দাঙ্গায় ফেইসবুকের ভূমিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
ফেইসবুকে গ্রাহকদের নিরাপত্তার বদলে টাকা কামানোকেই বেশি গুরুত্ব দেয় বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি “সত্যি নয়” বলে নিজের ফেইসবুক পোস্টে উড়িয়ে দিয়েছেন জাকারবার্গ। ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, “যে পদক্ষেপটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে সেটি হলো আমরা যখন নিউজ ফিডে মিনিংফুল সোশাল ইন্টার্যাকশন (এমএসআই) পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলাম। এই পরিবর্তনের ভাইরাল কন্টেন্টের বদলে বন্ধু ও আত্মীয়দের কন্টেন্ট বেশি দেখাতো। এতে মানুষ ফেইসবুকে কম সময় দেবে জেনেও আমরা এটি চালু করেছিলাম”।
২০১৮ সালে এমএসআই চালু করার সময়েও প্রায় একই বক্তব্য দিয়েছিলেন জাকারবার্গ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের বিচারের কন্টেন্টের গুরুত্ব নির্ধারণ করে এমএসআই। সিনেট অধিবেশনে হাউগেনের বক্তব্য অনুযায়ী, ফেইসবুকের অ্যালগরিদম একদিকে আক্রমণাত্মক কন্টেন্ট চিহ্নিত করতে পারে না, পারলেও তা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের বেশি নয়। অন্যদিকে, এমএসআইয়ের বিচারে অ্যালগরিদম যে কন্টেন্টগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিডে দেখায়, নেতিবাচক কন্টেন্ট চিহ্নিত করতে অ্যালগরিদমের ব্যর্থতার কারণে, ওই কন্টেন্টগুলোই ব্যবহারকারীদের আক্রমণাত্মক মনোভাব উস্কে দেয়। ফলে দিন শেষে, ব্যবহারকারীর নিউজ ফিডে বন্ধুদের পোস্টের বদলে সহিংসতা ও বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্টই বেশি গুরুত্ব পায়। সহিংস মনোভাব উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে এমএসআই বা অ্যালগরিদমের ভূমিকা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেননি জাকারবার্গ।
শিশুদের গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত করা, ইনস্টাগ্রামের নেতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে জাকারবার্গ বলেন, “এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা যাই বানাই না কেন সেটা যেন শিশুদের জন্য ভালো ও নিরাপদ হয়”।
জাকারবার্গ ইনস্টাগ্রাম কিডস-প্রসঙ্গে টেনে বলেন, “আমরা প্রকল্পটি স্থগিত রেখেছি যাতে আরও সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে এটা নিশ্চিত করার জন্য যে আমরা যাই করি না কেন, সেটা যেন ভালোর জন্যই হয়।”
সমালোচনা, বিতর্ক ও কংগ্রেসের চাপের মুখে ফেইসবুক ইনস্টাগ্রাম কিডস প্রকল্প পুরোপুরি বাতিল করবে কি না, সিনেট অধিবেশনে এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন মার্কিন সিনেটর ব্রায়ান শাটজ। হাউগেন উত্তর দিয়েছিলেন, “সেটা হলে আমি অবাক হবো। তাদের ইউজার লাগবে। বাচ্চারা প্ল্যাটফর্মে এলে, তাদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরাও প্ল্যাটফর্মে আসবেন। আর ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার শিশুদের অভ্যাসে পরিণত করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের ব্যবহারকারী নিশ্চিত করতে পারবে তারা।”
হাউগেনের সরবরাহ করা নথির ভিত্তিতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সিরিজ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জাকারবার্গ এতোদিন চুপ করে থাকলেও বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সিনেট, সংবাদমাধ্যম এবং সামজিক মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন অ্যান্টিগনি ডেভিস, মনিকা বিকার্ট, নিক ক্লেগ এবং অ্যান্ডি স্টোনের মতো ফেইসবুকের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মুখপাত্র। এর মধ্যে অ্যান্ডি স্টোন সিনেট অধিবেশন চলাকালীন হাউগেনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে টুইট করায় তাকে সরাসরি সিনেট কমিটির সামনে এসে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানান সিনেটর মার্শা ব্ল্যাকবার্ন।
অন্যদিকে অধিবেশনের পর বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ফেঁসে যান মনিকা বিকার্ট। ইনস্টাগ্রামের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে যে গবেষণা প্রতিবেদনটি আলোচিত হচ্ছে তাতে মাত্র ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন, এবং ওই গবেষণা অনুযায়ী ব্যবহারকারীদের উপর ইনস্টাগ্রামের ইতিবাচক প্রভাব বেশি বলে দাবি করে তিনি বলেন, “ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে গবেষণার ফলাফল”।
তার উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে পিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের একটি জরিপের প্রসঙ্গ টেনে আনেন বিবিসি’র প্রতিবেদক। ৭৫০ জন কিশোর বয়সী ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর উপর পরিচালিত ওই জরিপে ২৬ শতাংশ অংশগ্রহনকারী বলেছিলেন যে ইনস্টাগ্রাম তাদের নিজের জীবন নিয়ে হীনমন্যতা বাড়ায়। এমন অবস্থায় সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে, ফেইসবুক নিজেদের সেবা উন্নয়নে ও গ্রাহক নিরাপত্তা বাড়াতে কীভাবে গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে সেই ব্যাখ্যায় চলে যান বিকার্ট।
উল্লেখ্য, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইনস্টাগ্রামের প্রভাব নিয়ে ফেইসবুকের অভ্যন্তরীণ এক গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন নয়টি দেশের এক লাখের বেশি ব্যবহারকারী।
বৃহস্পতিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২১
ফেইসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গ ফাঁস হওয়া গবেষণার নথি আর সিনেট অধিবেশন প্রসঙ্গে অবশেষে মুখ খুলেছেন । তার প্রতিষ্ঠান মানুষের নিরাপত্তার থেকে মুনাফা অর্জনকে বেশি গুরুত্ব দেয়-- এই অভিযোগকে “অযৌক্তিক” বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
ফেইসবুকে পাবলিক পোস্ট দিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে এ কথা বলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট যে অভিযোগ ও প্রশ্নগুলো উঠেছে, তার সরাসরি কোনো উত্তর দেননি জাকারবার্গ, উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সিনেট সাবকমিটির কাছে হাউগেন যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, ওই একই কমিটি মার্ক জাকারবার্গকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকলেও তাতে সাড়া দেননি জাকারবার্গ, এক হাজার তিনশ শব্দের প্রতিক্রিয়া ফ্রান্সেস হাউগেনের নাম নেননি একবারও।
মঙ্গলবার সিনেট সাবকমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন হাউগেন। অধিবেশনের শুরুতেই হাউগেন বলেন “গনতন্ত্রকে দুর্বল ও শিশুদের ক্ষতি করছে ফেইসবুক”। জাকারবার্গ বলছেন, “মানুষকে রাগিয়ে তোলা বা বিষাদগ্রস্থ হওয়ার মতো পণ্য তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে এমন কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আমি জানি না”।
কিন্তু ফেইসবুকের এমএসআই এবং এনগেজমেন্ট র্যাংকিং নির্ভর অ্যালগরিদম যে সাধারণ মানুষকে বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট বেশি দেখিয়ে সহিংসতা উস্কে দিতে ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে সিনেট শুনানিতে, সেই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি জাকারবার্গ। সিনেটর ব্লুমেন্থাল ও তার দল তদন্তের খাতিরে ভুয়া ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রমাণ পেয়েছেন যে, শারীরিক গঠন নিয়ে হীনমন্যতার বাড়ানোর মতো কন্টেন্ট দেখাচ্ছে ফেইসবুকের অ্যালগরিদম; সেই বিষয়েও কিছু বলেননি জাকারবার্গ।
ফেইসবুক পোস্টে জাকারবার্গ লিখেছেন, “আমার মনে হয় ফেইসবুক নিয়ে যে ভুল চিত্র আঁকার চেষ্টা করা হচ্ছে আমাদের বেশিরভাগ সেটা চিনতে পারছে না। আমরা নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোরে উপর গভীরভাবে গুরুত্ব দেই”।
সিনেট অধিবেশনের শুরুতেই নিজের বক্তব্যে ফ্রান্সেস হাউগেন অভিযোগ তোলেন যে ফেইসবুক গনতন্ত্রকে দুর্বল করছে এবং শিশুদের ক্ষতি করছে। অভিযোগ তুলে এর সমাধানে কংগ্রেসের হস্তক্ষেপ দাবি করেন তিনি। অধিবেশনের পরবর্তী প্রশ্ন-উত্তর পর্বে হাউগেনের বক্তব্য থেকে উঠে আসে রাজনীতি ও সমজাব্যবস্থার উপর ফেইসবুকের বিরূপ প্রভাবের বিভিন্ন খুঁটিনাটি।
সিনেটর অধিবেশনে যে অভিযোগ উঠেছে তার বেশিরভাগের “কোনো মানে নেই” বলে দাবি করেছেন জাকারবার্গ। “আমরা যদি গবেষণায় পাত্তা না দিতে না চাইতাম, তাহলে শিল্পের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রকল্প কেন তৈরি করেছি আমরা?”, প্রশ্ন তুলেছেন জাকারবার্গ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, সিনেট অধিবেশনেও ফেইসবুকের গবেষণা বিভাগের সুনাম গেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মী হাউগেন। সিনেট অধিবেশনে গবেষণা প্রকল্পের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি; প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিকে ফেইসবুকের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও ফলাফল চেপে যাওয়ার প্রবণতা।
জাকারবার্গ আরও বলেছেন, “সামাজিক মেরুকরণের পেছনে যদি সামাজিক মাধ্যমগুলোর হাত থাকে, তবে আমরা কেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রে মেরুকরণ দেখতে পাচ্ছি যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি কমে আসছে বা সমান থাকছে?”।
জাকারবার্গ নিজস্ব বক্তব্যে দাবি করছেন ফেইসবুক যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে রাজনৈতিক বা সামাজিক মেরুকরণে ভূমিকা রাখে না। কিন্তু সিনেট শুনানিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক মেরুকরণ ও সহিংসতায় ফেইসবুকের ভূমিকার কয়েকটি উদাহরণ আলোচিত হয়েছে মার্কিন সিনেটর ও হাউগেনের প্রশ্ন-উত্তর পর্বে।
ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গায় ফেইসবুকের ব্যবহার বা ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য করেননি জাকারবার্গ। নিজের বক্তব্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মেরুকরণের কথা বললেও, ২০২০ সালের নির্বাচনের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো, ‘সিভিক ইন্টিগ্রিটি টিম’ কেন ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো এবং ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হিল দাঙ্গায় ফেইসবুকের ভূমিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
ফেইসবুকে গ্রাহকদের নিরাপত্তার বদলে টাকা কামানোকেই বেশি গুরুত্ব দেয় বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি “সত্যি নয়” বলে নিজের ফেইসবুক পোস্টে উড়িয়ে দিয়েছেন জাকারবার্গ। ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, “যে পদক্ষেপটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে সেটি হলো আমরা যখন নিউজ ফিডে মিনিংফুল সোশাল ইন্টার্যাকশন (এমএসআই) পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলাম। এই পরিবর্তনের ভাইরাল কন্টেন্টের বদলে বন্ধু ও আত্মীয়দের কন্টেন্ট বেশি দেখাতো। এতে মানুষ ফেইসবুকে কম সময় দেবে জেনেও আমরা এটি চালু করেছিলাম”।
২০১৮ সালে এমএসআই চালু করার সময়েও প্রায় একই বক্তব্য দিয়েছিলেন জাকারবার্গ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের বিচারের কন্টেন্টের গুরুত্ব নির্ধারণ করে এমএসআই। সিনেট অধিবেশনে হাউগেনের বক্তব্য অনুযায়ী, ফেইসবুকের অ্যালগরিদম একদিকে আক্রমণাত্মক কন্টেন্ট চিহ্নিত করতে পারে না, পারলেও তা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের বেশি নয়। অন্যদিকে, এমএসআইয়ের বিচারে অ্যালগরিদম যে কন্টেন্টগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিডে দেখায়, নেতিবাচক কন্টেন্ট চিহ্নিত করতে অ্যালগরিদমের ব্যর্থতার কারণে, ওই কন্টেন্টগুলোই ব্যবহারকারীদের আক্রমণাত্মক মনোভাব উস্কে দেয়। ফলে দিন শেষে, ব্যবহারকারীর নিউজ ফিডে বন্ধুদের পোস্টের বদলে সহিংসতা ও বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্টই বেশি গুরুত্ব পায়। সহিংস মনোভাব উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে এমএসআই বা অ্যালগরিদমের ভূমিকা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেননি জাকারবার্গ।
শিশুদের গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত করা, ইনস্টাগ্রামের নেতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে জাকারবার্গ বলেন, “এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা যাই বানাই না কেন সেটা যেন শিশুদের জন্য ভালো ও নিরাপদ হয়”।
জাকারবার্গ ইনস্টাগ্রাম কিডস-প্রসঙ্গে টেনে বলেন, “আমরা প্রকল্পটি স্থগিত রেখেছি যাতে আরও সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে এটা নিশ্চিত করার জন্য যে আমরা যাই করি না কেন, সেটা যেন ভালোর জন্যই হয়।”
সমালোচনা, বিতর্ক ও কংগ্রেসের চাপের মুখে ফেইসবুক ইনস্টাগ্রাম কিডস প্রকল্প পুরোপুরি বাতিল করবে কি না, সিনেট অধিবেশনে এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন মার্কিন সিনেটর ব্রায়ান শাটজ। হাউগেন উত্তর দিয়েছিলেন, “সেটা হলে আমি অবাক হবো। তাদের ইউজার লাগবে। বাচ্চারা প্ল্যাটফর্মে এলে, তাদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরাও প্ল্যাটফর্মে আসবেন। আর ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার শিশুদের অভ্যাসে পরিণত করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের ব্যবহারকারী নিশ্চিত করতে পারবে তারা।”
হাউগেনের সরবরাহ করা নথির ভিত্তিতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সিরিজ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জাকারবার্গ এতোদিন চুপ করে থাকলেও বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সিনেট, সংবাদমাধ্যম এবং সামজিক মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন অ্যান্টিগনি ডেভিস, মনিকা বিকার্ট, নিক ক্লেগ এবং অ্যান্ডি স্টোনের মতো ফেইসবুকের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মুখপাত্র। এর মধ্যে অ্যান্ডি স্টোন সিনেট অধিবেশন চলাকালীন হাউগেনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে টুইট করায় তাকে সরাসরি সিনেট কমিটির সামনে এসে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানান সিনেটর মার্শা ব্ল্যাকবার্ন।
অন্যদিকে অধিবেশনের পর বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ফেঁসে যান মনিকা বিকার্ট। ইনস্টাগ্রামের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে যে গবেষণা প্রতিবেদনটি আলোচিত হচ্ছে তাতে মাত্র ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন, এবং ওই গবেষণা অনুযায়ী ব্যবহারকারীদের উপর ইনস্টাগ্রামের ইতিবাচক প্রভাব বেশি বলে দাবি করে তিনি বলেন, “ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে গবেষণার ফলাফল”।
তার উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে পিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের একটি জরিপের প্রসঙ্গ টেনে আনেন বিবিসি’র প্রতিবেদক। ৭৫০ জন কিশোর বয়সী ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর উপর পরিচালিত ওই জরিপে ২৬ শতাংশ অংশগ্রহনকারী বলেছিলেন যে ইনস্টাগ্রাম তাদের নিজের জীবন নিয়ে হীনমন্যতা বাড়ায়। এমন অবস্থায় সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে, ফেইসবুক নিজেদের সেবা উন্নয়নে ও গ্রাহক নিরাপত্তা বাড়াতে কীভাবে গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে সেই ব্যাখ্যায় চলে যান বিকার্ট।
উল্লেখ্য, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইনস্টাগ্রামের প্রভাব নিয়ে ফেইসবুকের অভ্যন্তরীণ এক গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন নয়টি দেশের এক লাখের বেশি ব্যবহারকারী।