alt

জাতীয়

সংক্রমণ নয়, লকডাউনেই বেশি চিন্তিত প্রান্তিক মানুষ 

নতুন করে দেড় কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে

রেজাউল করিম : বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১

হোসনে আরা বেগম, রাজধানীর কড়াইল বস্তির বাসিন্দা। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী। প্রায় ৭ বছর ধরে বস্তিতে বসবাস করেন। স্বামী, তিন সন্তান নিয়ে তার পরিবার। করোনা সংক্রমণ নিয়ে তিনি যতখানি না চিন্তিত তার চাইতে বেশি উদ্বিগ্ন লকডাউনের বিধিনিষেধ নিয়ে।

‘দশ কেজির মতো চাল আছে। আলু আছে প্রায় তিন কেজি। কিছু ডালও আছে। এগুলো দিয়ে কয়েকদিন চলতে পারব। এরপর কী হবে জানি না। আমি একজনের বাসায় বুয়ার কাজ করি। স্বামী রিকশা চালায়। লকডাউনে তো দুজনের কাজই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন না থাকবে আয়-ইনকাম, না পারব অন্য কাজের জন্য বের হতে। তখন আমরা কীভাবে চলব?’ বলছিলেন হোসনে আরা।

একই বস্তির আজহার উদ্দিন বাসিন্দা, একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক। মা-বাবা, স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে মোট আট সদস্যের পরিবার। লকডাউনে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তখন পরিবারের আটজনের মুখে খাবার কীভাবে তুলে দেবেন তা নিয়ে চিন্তিত তিনি। এ সময় সরকারি সাহায্য ছাড়া না খেয়ে থাকতে হবে বলেও জানান তিনি।

এ হলো দু’জন বস্তিবাসীর কথা। রাজধানীতে লাখ লাখ ছিন্নমূল বা ভাসমান মানুষ বসবাস করে। তাদের না আছে মাথাগোঁজার ঠাঁই, না আছে তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকার উপায়। স্বাভাবিক সময়েই তারা পেটপুরে খেতে পায় না। আর লকডাউনে তো একেবারে না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে আজ থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে যাচ্ছে সরকার। এ সময় জরুরি সেবা ও শিল্প কারখানা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময় এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে- জানতে চাওয়া হয়েছিল কয়েক অর্থনীতিবিদের কাছে।

একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ‘রেডি ফুড’ (রান্না করা অথবা শুকনো খাবার) এবং তাদের থেকে একটু উপরের শ্রেণীর জন্য আর্থিক সহায়তার সুপারিশ করেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদকে বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা একেবারে রাস্তায় বসবাস করে বা বস্তিতে থাকে, তাদের জন্য ‘রেডি ফুড’-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থা করোনার প্রথমদিকে পশ্চিমবঙ্গে করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, কিছু মানুষ রাস্তায় বসবাস করছে, সেখানে গিয়েই রান্না করা খাবার বা চাল-ডাল বিতরণ করা হলো, তারা সেখানেই খেয়ে পরে বেঁচে থাকল। এতে তাদের বাড়তি পরিশ্রম করতে হলো না, বা বাজারে যাওয়ারও প্রয়োজন হলো না।’

বস্তিবাসী আজহার উদ্দিনও বলছিলেন এই সময়ে যদি তারা খাবার পান বেঁচে থাকতে পারবেন। তাদের বাইরে বেরোতে হবে না।

প্রান্তিক পর্যায় থেকে একটু উপরের জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘লকডাউনের কারণে যেসব প্রান্তিক ব্যবসায়ীর ক্ষতি হবে, তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। তবে এরা হবে একেবারের প্রান্তিক পর্যায় থেকে একটু উপরে। যেমন পাড়ার দোকানদার, ফেরিওয়ালা, ছোট যানবাহন চালক ইত্যাদি। তাদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।’

একই পরামর্শ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এর আগে যেমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়েছিল, সেটা যেন দ্রুততার সঙ্গে দেয়া হয় সেদিকে জোর দিতে হবে সরকারকে। করোনা সংক্রমণের প্রথমদিকে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছিল। সেই অনুসারে আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে। এছাড়াও ঘনবসতি ও দরিদ্র এলাকায় খাবার বিতরণে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।’

লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের একটি খানা জরিপে দেখা গেছে, করোনার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গেছে। প্রায় ৭৯ শতাংশ পরিবার আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়েছে। তাদের মধ্য থেকে সাড়ে ৭৮ শতাংশ পরিবার এখনও সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছিলেন, এই সংকট কাটাতে গড়ে আরও ১৩ মাস সময় লাগবে তাদের। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে তাদের আরও গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। প্রথম ধাক্কায়ই এসব প্রান্তিক মানুষদের বড় অংশ ঋণের জালে আটকে পড়েছেন। করোনার মধ্যে টিকে থাকতে প্রায় ৬১ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করতে হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ করতে তাদের দুই বছর সময় লাগতে পারে।

এই বাস্তবতায়ই ক্রমাবনতিশীল করোনা সংক্রমণের কারণে ফের ‘লকডাউনে’ যাচ্ছে দেশ। এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘করোনার ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মোকাবিলার করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থনীতির বৃহৎ ঝুঁঁকি এড়াতে স্বাস্থ্যঝুঁঁকিকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। তবে এর প্রভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বৃহৎ স্বার্থে লকডাউনে গেছে সরকার।’

ত্রাণ সুবিধা ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় প্রান্তিক মানুষের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তবে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এসব সুবিধা ভোগ করতে পারেন না তারা। এই লকডাউনে সেই সুবিধাগুলো যেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পায় সেদিকে নজর দিতে হবে বলে জানান মোস্তাফিজ।

তিনি বলেন, ‘সরকারের যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আছে সেগুলো আরও শক্তিশালী করতে হবে। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়।’

গত বছর মার্চে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ‘লকডাউন’ শুরু হয়। এতে দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসে বড় ধস। দেশের অর্থনীতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মারাত্মক চাপে পড়েন। এতে যেসব জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল তারা চলে যায় অতি-দারিদ্র্যসীমার নিচে। আবার যারা নি¤œ মধ্যবিত্ত তারা নেমে যায় দারিদ্র্যসীমার নিচে। একাধিক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। গত বছর করোনা সংক্রমণের পর ২৬ মার্চ থেকে প্রায় দুই মাসের সাধারণ ছুটিতে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে যাওয়ায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে চার কোটি ৮০ লাখ মানুষ। গ্রামের চেয়ে শহরে এই হার বেশি। গ্রামে যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৭ শতাংশ, শহরে সেখানে ৩৫ শতাংশ।

গবেষণায় আরও বলা হয়, করোনার কারণে চার মাসে (মার্চ-জুলাই ২০২০) যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসতে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি তেমন কাজে আসবে না। কারণ বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির টার্গেট গ্রুপ ঠিক নেই।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় দারিদ্র্য ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪.৩ শতাংশ।

গত জুনে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, দারিদ্র্য দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে দেখা গেছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে যাদের আয় ছিল প্রতিদিন ১০০ টাকা। করোনার কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির (বিইএ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার ঘোষিত ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির কারণে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের চাকরিজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। করোনায় ৫ কোটি ৫৫ লাখ বাংলাদেশির আর্থ-সামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটেছে।

বিআইডিএসের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে। নতুন করে গরিব হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। আগে থেকেই আরও সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচেই বসবাস করত। ফলে সে সময় (জুলাই) মোট দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ওপরে ছিল।

করোনায় দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের কর্মীরাও ভালো নেই। টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের পোশাক কারখানাগুলো থেকে ৬০-৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।

তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, করোনাকালে কমপক্ষে দেড় লাখ শ্রমিক স্থায়ীভাবে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছাঁটাইয়ের শিকার এসব কর্মীও মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ছবি

একদিনে করোনায় আক্রান্ত ১৬ জন

ছবি

তাপপ্রবাহ নিয়ে ৭২ ঘণ্টার সতর্ক বার্তা আবহাওয়া অধিদপ্তরের

ছবি

বঙ্গবন্ধু টানেলে টোল ফ্রি সুবিধা পেল যেসব গাড়ি

ছবি

সারাদেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি

ছবি

জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাস আর নেই

ছবি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হবে : আরাফাত

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং মুজিবনগর দিবস সম্পর্কে নতুন প্রজন্মেকে জানাতে হবে

ছবি

স্থানীয় সরকার নির্বাচ‌নে ভোটার উপ‌স্থি‌তি সংসদ নির্বাচ‌নের ‌চে‌য়ে বে‌শি থাকবে

ছবি

প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

ছবি

থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

জুন-জুলাইয়ে দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার হার বেশি

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে বললেন প্রধানমন্ত্রী

এথেন্স সম্মেলনে দায়িত্বশীল ও টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় সম্মিলিত প্রয়াসের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

ছবি

কৃষকরাই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি: স্পিকার

ছবি

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর

ছবি

লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সাবেক ইউপি সদস্য গুলিবিদ্ধ

ছবি

তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় ভোট ২৯ মে

ছবি

এমভি আবদুল্লাহ : ২১ নাবিক দেশে ফিরবেন জাহাজে, বাকি দুজন বিমানে

ছবি

৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগে প্রক্রিয়া শুরু, আবেদনের নিয়ম

ছবি

ঢাকায় গ্রিসের দূতাবাস স্থাপন ও জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা

ছবি

টিসিবির তালিকা হালনাগাদ করতে চাই:বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী

ছবি

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে গমের আবাদ কম

ছবি

ভোজ্য তেলের দাম বাড়াতে চায় ব্যবসায়ীরা আপত্তি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর

ছবি

অনিবন্ধিত অনলাইনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবো : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত : মন্ত্রী

ছবি

দেশে ফিরতে আরও ১০ দিন সময় লাগবে নাবিকদের

ছবি

মুক্ত এমভি আবদুল্লাহর ৩ ছবি প্রকাশ

ছবি

২ মে বসছে সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন

ছবি

কারো যাতে ডেঙ্গু না হয় সেজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ছবি

মুক্তিপণ দেওয়ার ছবি নিয়ে যা বললেন নৌ প্রতিমন্ত্রী

ছবি

লঞ্চে বেড়েছে ঢাকায় ফেরা যাত্রীর চাপ

ছবি

নববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সমৃদ্ধ ও স্মার্ট ভবিষ্যৎ নির্মাণে একযোগে কাজ করার আহ্বান অর্থ প্রতিমন্ত্রীর

ছবি

জিম্মি জাহাজটি কীভাবে মুক্ত হলো, জানাল মালিকপক্ষ

ছবি

সোমানিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে এমভি আব্দুল্লাহ মুক্ত ২৩ নাবিক অক্ষত

ছবি

মুক্তিপণ নিয়ে তীরে উঠেই ৮ জলদস্যু গ্রেপ্তার

ছবি

দেশের প্রতি ভালোবাসার বার্তা এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের

tab

জাতীয়

সংক্রমণ নয়, লকডাউনেই বেশি চিন্তিত প্রান্তিক মানুষ 

নতুন করে দেড় কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে

রেজাউল করিম

বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১

হোসনে আরা বেগম, রাজধানীর কড়াইল বস্তির বাসিন্দা। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী। প্রায় ৭ বছর ধরে বস্তিতে বসবাস করেন। স্বামী, তিন সন্তান নিয়ে তার পরিবার। করোনা সংক্রমণ নিয়ে তিনি যতখানি না চিন্তিত তার চাইতে বেশি উদ্বিগ্ন লকডাউনের বিধিনিষেধ নিয়ে।

‘দশ কেজির মতো চাল আছে। আলু আছে প্রায় তিন কেজি। কিছু ডালও আছে। এগুলো দিয়ে কয়েকদিন চলতে পারব। এরপর কী হবে জানি না। আমি একজনের বাসায় বুয়ার কাজ করি। স্বামী রিকশা চালায়। লকডাউনে তো দুজনের কাজই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন না থাকবে আয়-ইনকাম, না পারব অন্য কাজের জন্য বের হতে। তখন আমরা কীভাবে চলব?’ বলছিলেন হোসনে আরা।

একই বস্তির আজহার উদ্দিন বাসিন্দা, একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক। মা-বাবা, স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে মোট আট সদস্যের পরিবার। লকডাউনে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তখন পরিবারের আটজনের মুখে খাবার কীভাবে তুলে দেবেন তা নিয়ে চিন্তিত তিনি। এ সময় সরকারি সাহায্য ছাড়া না খেয়ে থাকতে হবে বলেও জানান তিনি।

এ হলো দু’জন বস্তিবাসীর কথা। রাজধানীতে লাখ লাখ ছিন্নমূল বা ভাসমান মানুষ বসবাস করে। তাদের না আছে মাথাগোঁজার ঠাঁই, না আছে তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকার উপায়। স্বাভাবিক সময়েই তারা পেটপুরে খেতে পায় না। আর লকডাউনে তো একেবারে না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে আজ থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে যাচ্ছে সরকার। এ সময় জরুরি সেবা ও শিল্প কারখানা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময় এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে- জানতে চাওয়া হয়েছিল কয়েক অর্থনীতিবিদের কাছে।

একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ‘রেডি ফুড’ (রান্না করা অথবা শুকনো খাবার) এবং তাদের থেকে একটু উপরের শ্রেণীর জন্য আর্থিক সহায়তার সুপারিশ করেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সংবাদকে বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা একেবারে রাস্তায় বসবাস করে বা বস্তিতে থাকে, তাদের জন্য ‘রেডি ফুড’-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থা করোনার প্রথমদিকে পশ্চিমবঙ্গে করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, কিছু মানুষ রাস্তায় বসবাস করছে, সেখানে গিয়েই রান্না করা খাবার বা চাল-ডাল বিতরণ করা হলো, তারা সেখানেই খেয়ে পরে বেঁচে থাকল। এতে তাদের বাড়তি পরিশ্রম করতে হলো না, বা বাজারে যাওয়ারও প্রয়োজন হলো না।’

বস্তিবাসী আজহার উদ্দিনও বলছিলেন এই সময়ে যদি তারা খাবার পান বেঁচে থাকতে পারবেন। তাদের বাইরে বেরোতে হবে না।

প্রান্তিক পর্যায় থেকে একটু উপরের জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘লকডাউনের কারণে যেসব প্রান্তিক ব্যবসায়ীর ক্ষতি হবে, তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। তবে এরা হবে একেবারের প্রান্তিক পর্যায় থেকে একটু উপরে। যেমন পাড়ার দোকানদার, ফেরিওয়ালা, ছোট যানবাহন চালক ইত্যাদি। তাদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।’

একই পরামর্শ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এর আগে যেমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়েছিল, সেটা যেন দ্রুততার সঙ্গে দেয়া হয় সেদিকে জোর দিতে হবে সরকারকে। করোনা সংক্রমণের প্রথমদিকে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছিল। সেই অনুসারে আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে। এছাড়াও ঘনবসতি ও দরিদ্র এলাকায় খাবার বিতরণে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।’

লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের একটি খানা জরিপে দেখা গেছে, করোনার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গেছে। প্রায় ৭৯ শতাংশ পরিবার আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়েছে। তাদের মধ্য থেকে সাড়ে ৭৮ শতাংশ পরিবার এখনও সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছিলেন, এই সংকট কাটাতে গড়ে আরও ১৩ মাস সময় লাগবে তাদের। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে তাদের আরও গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। প্রথম ধাক্কায়ই এসব প্রান্তিক মানুষদের বড় অংশ ঋণের জালে আটকে পড়েছেন। করোনার মধ্যে টিকে থাকতে প্রায় ৬১ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করতে হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ করতে তাদের দুই বছর সময় লাগতে পারে।

এই বাস্তবতায়ই ক্রমাবনতিশীল করোনা সংক্রমণের কারণে ফের ‘লকডাউনে’ যাচ্ছে দেশ। এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘করোনার ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মোকাবিলার করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থনীতির বৃহৎ ঝুঁঁকি এড়াতে স্বাস্থ্যঝুঁঁকিকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। তবে এর প্রভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বৃহৎ স্বার্থে লকডাউনে গেছে সরকার।’

ত্রাণ সুবিধা ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় প্রান্তিক মানুষের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তবে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এসব সুবিধা ভোগ করতে পারেন না তারা। এই লকডাউনে সেই সুবিধাগুলো যেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পায় সেদিকে নজর দিতে হবে বলে জানান মোস্তাফিজ।

তিনি বলেন, ‘সরকারের যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আছে সেগুলো আরও শক্তিশালী করতে হবে। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়।’

গত বছর মার্চে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ‘লকডাউন’ শুরু হয়। এতে দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসে বড় ধস। দেশের অর্থনীতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মারাত্মক চাপে পড়েন। এতে যেসব জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল তারা চলে যায় অতি-দারিদ্র্যসীমার নিচে। আবার যারা নি¤œ মধ্যবিত্ত তারা নেমে যায় দারিদ্র্যসীমার নিচে। একাধিক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। গত বছর করোনা সংক্রমণের পর ২৬ মার্চ থেকে প্রায় দুই মাসের সাধারণ ছুটিতে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে যাওয়ায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে চার কোটি ৮০ লাখ মানুষ। গ্রামের চেয়ে শহরে এই হার বেশি। গ্রামে যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৭ শতাংশ, শহরে সেখানে ৩৫ শতাংশ।

গবেষণায় আরও বলা হয়, করোনার কারণে চার মাসে (মার্চ-জুলাই ২০২০) যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসতে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি তেমন কাজে আসবে না। কারণ বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির টার্গেট গ্রুপ ঠিক নেই।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় দারিদ্র্য ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪.৩ শতাংশ।

গত জুনে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, দারিদ্র্য দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে দেখা গেছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে যাদের আয় ছিল প্রতিদিন ১০০ টাকা। করোনার কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির (বিইএ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার ঘোষিত ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির কারণে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের চাকরিজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। করোনায় ৫ কোটি ৫৫ লাখ বাংলাদেশির আর্থ-সামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটেছে।

বিআইডিএসের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে। নতুন করে গরিব হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। আগে থেকেই আরও সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচেই বসবাস করত। ফলে সে সময় (জুলাই) মোট দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ওপরে ছিল।

করোনায় দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের কর্মীরাও ভালো নেই। টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের পোশাক কারখানাগুলো থেকে ৬০-৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।

তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, করোনাকালে কমপক্ষে দেড় লাখ শ্রমিক স্থায়ীভাবে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছাঁটাইয়ের শিকার এসব কর্মীও মানবেতর জীবনযাপন করছে।

back to top