করোনা : বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে
শ্রীলঙ্কায়ও সংক্রমণ চূড়ান্ত দিকে
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ কমছে। ৩৫ দিন পর দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশতকে নেমেছে। কিন্তু পাশর্^বর্তী দেশ ভারত সম্প্রতি করোনা সংক্রমণের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। দেশটির সীমান্ত সংলগ্ন নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও পিকের (চূড়ায়) দিকে রয়েছে সংক্রমণ। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সংক্রমণ বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ রাখলেও জরুরি প্রয়োজনে প্রতিদিন কিছু সংখ্যক মানুষ আসা-যাওয়া করছেন। ভারতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন-এমন বেশ কয়েকজন রোগীও দেশে চিকিৎসাধীন আছেন। এতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য অনুযায়ী আগের ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের স্থলবন্দর দিয়ে ৪৮০ জন দেশে প্রবেশ করেছেন। এর আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৩২৫ জন। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে চার থেকে পাঁচশ’ পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করছে। এসব ট্রাকপ্রতি দু’তিনজন চালক ও সহকারী প্রবেশ করছেন। তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খ্যাতিমান সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও বিএসএমএমইউ’র সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেছেন, ‘ভারতের সংক্রমণের প্রভাব নেপালে পড়েছে, শ্রীলঙ্কায়ও পড়ছে। আমাদের এখানেও এর প্রভাব পড়বে। তবে নেপালে বিপর্যয় নেমে আসার কারণ হলো তারা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত খোলা রেখেছে।’
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, এরপরও দেশে ভারতের সংক্রমণের প্রভাব কেন পড়বে, জানতে চাইলে এই ‘ভাইরোলজিস্ট’ বলেন, ‘আমাদের প্রায় সবদিকেই ভারতের সীমান্ত। তা বন্ধ থাকলেও নানাভাবে দুই দেশের মানুষ আসা-যাওয়া করে। অর্থাৎ সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ রাখা সম্ভব হয় না। এ কারণে একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ভারতের সংক্রমণের প্রভাব পড়বে।’
ভারতীয় সংক্রমণ রোধে করণীয় সর্ম্পকে প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, মাস্ক পরলে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে, আমরা অনেকেই তা মানছি না।’
হঠাৎ বিপর্যয়ের মুখে নেপাল
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর গত বছরের প্রথমদিকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব। মার্চে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এই তিন দেশেই করোনার প্রথম ঢেউ বয়ে যায়। ওই সময় ‘লকডাউন’ বা নাগরিকদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল হয় নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ।
কিন্তু গত মার্চে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে সংক্রমণের ‘হটস্পট’ (অতি-সংক্রমণ) হয়ে ওঠে ভারত। দেশটিতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারতে গত কয়েকদিন সাড়ে তিন থেকে পৌনে চার লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। দৈনিক মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয়েছে ‘বি.১.৬১৭’। এটি নেপালে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে দেশটির জনস্বাস্থ্যবিদরা ধারণা করছেন। যদিও ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং পরীক্ষার প্রযুক্তি নেপালে নেই বলে দেশটির সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে।
গতকাল নেপালের দ্য হিমালয়ান টাইমস পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ৪ মে দেশটিতে রেকর্ড ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিন দেশটিতে সর্বোচ্চ আট হাজার ছয় শতাধিক মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নেপালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেই ছিল। ওই সময় দেশটিতে দৈনিক কমবেশি একশ’ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এপ্রিলের প্রথম থেকেই বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশটিতে দৈনিক সাত হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। অথচ গত বছরের অক্টোবরে নেপালে একদিনে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছিল।
নেপালে এ পর্যন্ত তিন লাখ ৬০ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত এবং দেশটিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অক্সিজেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সংকটও প্রকট হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায়ও চূড়ার পথে সংক্রমণ
শ্রীলঙ্কায় গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণেই ছিল করোনা সংক্রমণ। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচ-সাতশ’র কাছাকাছি ছিল। মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সংক্রমণ কমতে থাকে। ওই সময় দৈনিক দুই থেকে আড়াইশ’ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে হঠাৎ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এখন প্রতিদিনই রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্ত হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। দৈনিক দেড় থেকে দুই হাজারের কাছাকাছি মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় গতকাল পর্যন্ত এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে করোনায় সাত শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ভারতে মৃত্যুর রেকর্ড
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিভাগের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে তিন লাখ ৮২ হাজার ৩১৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে রেকর্ড তিন হাজার ৭৮০ জনের। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় ওইদিন করোনা শনাক্তের হার ছিল ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত ২১ এপ্রিল থেকে ভারতে দৈনিক তিন লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে, অথচ করোনার প্রথম ধাক্কায় গত বছর দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ ৯৭ হাজার সাত শতাধিক মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় দুই কোটি সাড়ে সাত লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ভারতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে দুই ২৭ হাজার লোকের।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে কিনা, জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক প্রফেসর ডা. তাহমিনা শিরিন গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ঝুঁকি অবশ্যই আছে। কারণ সীমান্ত একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। জরুরি পণ্য আমদানি-রপ্তানি অব্যাহত আছে। আবার জরুরি প্রয়োজনে কাউকে কাউকে যেতে হচ্ছে আসতেও হচ্ছে।’
এখন পর্যন্ত করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে শনাক্ত হয়েছে কীনা জানতে চাইলে ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘আমার জানা মতে- এখনও তা শনাক্ত হয়নি।’
দেশে ২৪ ঘণ্টায় অর্ধশত রোগীর মৃত্যু
গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি গত পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর চেয়ে কম মৃত্যু হয়েছিল গত ৩০ মার্চ, সেদিন ৪৫ জনের মৃত্যুর তথ্য জানয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩৫ দিনে তা ৫০ এর নিচে নামেনি। গত একদিনে মৃত্যু হওয়া ৫০ জনকে নিয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১১ হাজার ৭৫৫ জনে।
গত একদিনে দেশে এক হাজার ৭৪২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো সাত লাখ ৬৭ হাজার ৩৩৮ জনে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে করোনা শনাক্তের দিক থেকে ৩৩তম স্থানে এবং মৃত্যুর সংখ্যায় রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত একদিনে সারাদেশে ৪২৭টি ল্যাবে ২০ হাজার ২৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫৫ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৮টি।
গত একদিনে নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ০২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে পুরুষ ৩২ জন এবং নারী ১৮ জন। এর মধ্যে ৩৫ জন সরকারি হাসপাতালে, ১২ জন বেসরকারি হাসপাতালে এবং তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বাসায়। মৃত্যু হওয়া ১১ হাজার ৭৫৫ জনের মধ্যে পুরুষ আট হাজার ৫৪৪ জন এবং নারী তিন হাজার ২১১ জন।
বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত একদিনে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে ৩০ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ১৩ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, পাঁচ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং দুইজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল।
করোনা : বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে
শ্রীলঙ্কায়ও সংক্রমণ চূড়ান্ত দিকে
বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ কমছে। ৩৫ দিন পর দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশতকে নেমেছে। কিন্তু পাশর্^বর্তী দেশ ভারত সম্প্রতি করোনা সংক্রমণের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। দেশটির সীমান্ত সংলগ্ন নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও পিকের (চূড়ায়) দিকে রয়েছে সংক্রমণ। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সংক্রমণ বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ রাখলেও জরুরি প্রয়োজনে প্রতিদিন কিছু সংখ্যক মানুষ আসা-যাওয়া করছেন। ভারতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন-এমন বেশ কয়েকজন রোগীও দেশে চিকিৎসাধীন আছেন। এতে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য অনুযায়ী আগের ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের স্থলবন্দর দিয়ে ৪৮০ জন দেশে প্রবেশ করেছেন। এর আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৩২৫ জন। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে চার থেকে পাঁচশ’ পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করছে। এসব ট্রাকপ্রতি দু’তিনজন চালক ও সহকারী প্রবেশ করছেন। তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খ্যাতিমান সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও বিএসএমএমইউ’র সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেছেন, ‘ভারতের সংক্রমণের প্রভাব নেপালে পড়েছে, শ্রীলঙ্কায়ও পড়ছে। আমাদের এখানেও এর প্রভাব পড়বে। তবে নেপালে বিপর্যয় নেমে আসার কারণ হলো তারা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত খোলা রেখেছে।’
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, এরপরও দেশে ভারতের সংক্রমণের প্রভাব কেন পড়বে, জানতে চাইলে এই ‘ভাইরোলজিস্ট’ বলেন, ‘আমাদের প্রায় সবদিকেই ভারতের সীমান্ত। তা বন্ধ থাকলেও নানাভাবে দুই দেশের মানুষ আসা-যাওয়া করে। অর্থাৎ সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ রাখা সম্ভব হয় না। এ কারণে একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ভারতের সংক্রমণের প্রভাব পড়বে।’
ভারতীয় সংক্রমণ রোধে করণীয় সর্ম্পকে প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, মাস্ক পরলে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে, আমরা অনেকেই তা মানছি না।’
হঠাৎ বিপর্যয়ের মুখে নেপাল
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর গত বছরের প্রথমদিকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব। মার্চে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এই তিন দেশেই করোনার প্রথম ঢেউ বয়ে যায়। ওই সময় ‘লকডাউন’ বা নাগরিকদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল হয় নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ।
কিন্তু গত মার্চে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে সংক্রমণের ‘হটস্পট’ (অতি-সংক্রমণ) হয়ে ওঠে ভারত। দেশটিতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারতে গত কয়েকদিন সাড়ে তিন থেকে পৌনে চার লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। দৈনিক মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয়েছে ‘বি.১.৬১৭’। এটি নেপালে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে দেশটির জনস্বাস্থ্যবিদরা ধারণা করছেন। যদিও ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং পরীক্ষার প্রযুক্তি নেপালে নেই বলে দেশটির সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে।
গতকাল নেপালের দ্য হিমালয়ান টাইমস পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ৪ মে দেশটিতে রেকর্ড ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিন দেশটিতে সর্বোচ্চ আট হাজার ছয় শতাধিক মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নেপালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেই ছিল। ওই সময় দেশটিতে দৈনিক কমবেশি একশ’ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এপ্রিলের প্রথম থেকেই বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশটিতে দৈনিক সাত হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। অথচ গত বছরের অক্টোবরে নেপালে একদিনে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছিল।
নেপালে এ পর্যন্ত তিন লাখ ৬০ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত এবং দেশটিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অক্সিজেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সংকটও প্রকট হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায়ও চূড়ার পথে সংক্রমণ
শ্রীলঙ্কায় গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণেই ছিল করোনা সংক্রমণ। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচ-সাতশ’র কাছাকাছি ছিল। মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সংক্রমণ কমতে থাকে। ওই সময় দৈনিক দুই থেকে আড়াইশ’ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে হঠাৎ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এখন প্রতিদিনই রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্ত হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। দৈনিক দেড় থেকে দুই হাজারের কাছাকাছি মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় গতকাল পর্যন্ত এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে করোনায় সাত শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ভারতে মৃত্যুর রেকর্ড
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিভাগের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে তিন লাখ ৮২ হাজার ৩১৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে রেকর্ড তিন হাজার ৭৮০ জনের। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় ওইদিন করোনা শনাক্তের হার ছিল ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত ২১ এপ্রিল থেকে ভারতে দৈনিক তিন লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে, অথচ করোনার প্রথম ধাক্কায় গত বছর দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ ৯৭ হাজার সাত শতাধিক মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় দুই কোটি সাড়ে সাত লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ভারতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে দুই ২৭ হাজার লোকের।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে কিনা, জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক প্রফেসর ডা. তাহমিনা শিরিন গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘ঝুঁকি অবশ্যই আছে। কারণ সীমান্ত একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। জরুরি পণ্য আমদানি-রপ্তানি অব্যাহত আছে। আবার জরুরি প্রয়োজনে কাউকে কাউকে যেতে হচ্ছে আসতেও হচ্ছে।’
এখন পর্যন্ত করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে শনাক্ত হয়েছে কীনা জানতে চাইলে ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘আমার জানা মতে- এখনও তা শনাক্ত হয়নি।’
দেশে ২৪ ঘণ্টায় অর্ধশত রোগীর মৃত্যু
গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি গত পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর চেয়ে কম মৃত্যু হয়েছিল গত ৩০ মার্চ, সেদিন ৪৫ জনের মৃত্যুর তথ্য জানয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩৫ দিনে তা ৫০ এর নিচে নামেনি। গত একদিনে মৃত্যু হওয়া ৫০ জনকে নিয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১১ হাজার ৭৫৫ জনে।
গত একদিনে দেশে এক হাজার ৭৪২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো সাত লাখ ৬৭ হাজার ৩৩৮ জনে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে করোনা শনাক্তের দিক থেকে ৩৩তম স্থানে এবং মৃত্যুর সংখ্যায় রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত একদিনে সারাদেশে ৪২৭টি ল্যাবে ২০ হাজার ২৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫৫ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৮টি।
গত একদিনে নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ০২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে পুরুষ ৩২ জন এবং নারী ১৮ জন। এর মধ্যে ৩৫ জন সরকারি হাসপাতালে, ১২ জন বেসরকারি হাসপাতালে এবং তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বাসায়। মৃত্যু হওয়া ১১ হাজার ৭৫৫ জনের মধ্যে পুরুষ আট হাজার ৫৪৪ জন এবং নারী তিন হাজার ২১১ জন।
বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত একদিনে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে ৩০ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ১৩ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, পাঁচ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং দুইজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল।