রাজনৈতিক চাপে ইউনেসকোর কমিটি : অভিযোগ পরিবেশবাদীদের
সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত আগামী বছর নেয়ার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি। এবার আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ কমিটির দেয়া শর্তগুলো পূরণ না করলে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য বা লাল তালিকাভুক্ত করা হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের আশপাশে নানা স্থাপনা নিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির উদ্বেগ ছিল।
অতি সম্প্রতি কমিটির ৪৪তম সভায় কমিটির কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশকে ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়নের স্বার্থে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বেশি চাপ না দেয়ার পরামর্শ দেন।
তবে বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, বাংলাদেশ বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির শর্ত পূরণ করেনি। তবে কমিটি বিশ্ব রাজনৈতিক চাপে সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।
এদিকে সুন্দরবনকে রক্ষা, বনের প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচানোর স্বার্থ বাদ দিয়ে সরকার ভূরাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল।
সোমবার (২৬ জুলাই) বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। সুন্দরবন নিয়ে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৪তম সভার সুপারিশ নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ‘ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল’ সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগর উপকূলে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকায় ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত এই বনাঞ্চলটি বৈশ্বিক সম্পদ বিবেচনায় ১৯৮৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো।
পরিবেশ বিপর্যয় থেকে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষে পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করছে। তাদের দাবি এই বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আশপাশের অন্যান্য প্রকল্প সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি করবে। বিষয়টি আমলে নিয়ে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি সুন্দরবন রক্ষায় বেশকিছু শর্ত দিয়েছিল। শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে সুন্দরবনকে ‘বিপন্ন বা লাল তালিকা’ভুক্ত করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল কমিটি।
এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গত কয়েকবছর যাবত ইউনেস্কোর সঙ্গে দেন-দরবার করছে দাবি করে বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ বক্তা (পরিবেশবিদ) বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ওই সভার বিষয়ে তাদের হতাশা ব্যক্ত করেন। এই কমিটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে বলেও অভিমত দেন একাধিক বক্তা।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জানান, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত আগামী বছর নেয়ার সুপারিশ করা হয়। এবার আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ শর্তগুলো পূরণ না করলে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য বা লাল তালিকাভুক্ত করা হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের আশপাশে নানা স্থাপনা নিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির উদ্বেগ ছিল।
কিন্তু ইউনেসকোর বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের খসড়া প্রস্তাবে এ বছর সিদ্ধান্ত না নেয়ার সুপারিশ করে বলেছে, আগামী সম্মেলনের আগে বাংলাদেশকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। ওই সভায় চীন, রাশিয়া, মিসরসহ নানা দেশ বাংলাদেশের সমর্থনে কথা বলে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ায় বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির আগামী সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে আগামী বছর ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।
সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সুন্দরবন বিশ্বের সম্পদ। এটিকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সুন্দরবন ইস্যুতে সরকার বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেন-দরবার করেছে বলে মনে হয়। সেটির প্রমাণ গত ৪৪তম সভায় স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। এর পেছনে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করেছে। রাজনীতি দেশের ও জনগণের স্বার্থে হচ্ছে নাকি মুষ্টিমেয় মুনাফালোভীদের স্বার্থে হচ্ছে তাও জাতিকে বুঝতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন রক্ষায় লড়াই চালু থাকবে। এখানে দেশের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সমর্থন দরকার।’
ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সাম্প্রতিক সভায় সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক পরিবেশকর্মী তন্নী নওশীন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির গত ৪৪তম সভা আমাদের জন্য শুধুই ক্ষোভ ও কষ্টের বিষয় ছিল। কয়লা প্রকল্প যেন সুন্দরবনে করা না হয়, সেজন্য আমাদের বক্তব্য প্রদান করেছি। সভায় কমিটির কিছু কিছু সদস্য বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু নিম্ন আয়ের দেশ সেখানে উন্নত হওয়া দরকার তাই বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে বেশি চাপ দেয়ার প্রয়োজন নেই।’
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষে ওই সভায় ওয়ার্ড হেরিটেজ ওয়াচ-এর চেয়ারম্যান স্টিফান ডম্পকে এবং জেনেভায় জাতিসঙ্ঘে আর্থ জাস্টিসের স্থায়ী প্রতিনিধি ইভস লেডরও বক্তব্য রাখেন।
স্টিফেন ডমপকে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির অধিবেশন চলাকালীন আমরা কার্যত শক্তিহীন ছিলাম। সুতরাং আমাদের জনসাধারণের দ্বারা চাপ সৃষ্টি করা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন অবশ্য করণীয়।’ এই বিষয়টি আসন্ন কপ সম্মেলনে উত্থাপন করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় রাজনৈতিক প্রভাব কয়েক বছর যাবত প্রকট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ বছর তা কেবল সুন্দরবন নয়, অন্যান্য ঐতিহ্যের বেলায়ও প্রকটভাবে লক্ষ্য করা গেছে।’
ইভস লেডর বলেন, ‘জনগনের মতামত এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিরুদ্ধে গিয়ে ইউনেস্কোর মতো বৈশ্বিক মঞ্চে সরকারের পরিবেশবিরোধী কৌশল অবলম্বন করার কারণে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে রাজনীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনবে। বিজ্ঞানকে ভিত্তি করেই যেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেই সেখানে এ ধরনের বিজ্ঞান অবহেলিত কর্মকা-ের প্রবণতা আমাদের সবার চিন্তার কারণ।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দেশের মানুষের সমর্থন পায়নি সরকার। তারা বিশ্বের নানা দেশের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়েছে। এই লবিংয়ের টাকা তারা কোত্থেকে পাচ্ছে? প্রশ্ন রেখে রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে যখন ভারত, চীন বা রাশিয়া দাঁড়ায়, তখন এ নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কেননা, এসব দেশের প্রতিটিরই বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ আছে। এখানে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) ’ কারণে এসব দেশ সপক্ষে দাঁড়াতে পারে না।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির গত ৪৪তম সভায় বিশ্বের ১৯৯টি বিশ্ব ঐতিহ্য বিষয়ে বিশ্লেষণ ও আলোচনা করা হয় যার মধ্যে সুন্দরবন বিষয়টিও ছিল। কমিটি তার দুর্বল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সুন্দরবনের ঐতিহ্য সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে এর স্বপক্ষে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের খসড়া সুপারিশ এবং কমিটি সিদ্ধান্তের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা রাজনৈতিক বিবেচনাকে বিজ্ঞান এবং আদর্শের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
ড. সাজেদ কামাল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদান করছে। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিপন্থী এবং আত্মঘাতী। বাংলাদেশের সক্ষমতা রয়েছে পরিচ্ছন্ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করা। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা আমলে নেয়া প্রয়োজন।’
বাপার নির্বাহী সহসভাপতি ও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. আবদুল মতিন বলেন, ‘সরকার সুন্দরবনের বিষয়ে দেশের মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে না কিন্তু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেন-দরবার করছে, যা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার সামিল।’
সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের জন্য চলমান কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা সরকারি প্রভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে না করে নিরপেক্ষ, বিজ্ঞানভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলকভাবে সম্পন্ন করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে রামপাল, তালতলী ও কলাপাড়ার সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা এবং সুন্দরবনের ভেতরদিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য বহনকারী নৌযান চলাচল নিষিদ্ধের দাবিও তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল আজিজ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) সদস্য অধ্যপক ড. সাজেদ কামাল ও অধ্যাপক ড. খালেকুজ্জামান, ঢাবির অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, বাপার কোষাধ্যক্ষ মহিদুল হক খান এবং পশুর রিভার ওয়াটারকিপার নুর আলম শেখ প্রমুখ।
রাজনৈতিক চাপে ইউনেসকোর কমিটি : অভিযোগ পরিবেশবাদীদের
সোমবার, ২৬ জুলাই ২০২১
সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত আগামী বছর নেয়ার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি। এবার আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ কমিটির দেয়া শর্তগুলো পূরণ না করলে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য বা লাল তালিকাভুক্ত করা হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের আশপাশে নানা স্থাপনা নিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির উদ্বেগ ছিল।
অতি সম্প্রতি কমিটির ৪৪তম সভায় কমিটির কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশকে ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়নের স্বার্থে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বেশি চাপ না দেয়ার পরামর্শ দেন।
তবে বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, বাংলাদেশ বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির শর্ত পূরণ করেনি। তবে কমিটি বিশ্ব রাজনৈতিক চাপে সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।
এদিকে সুন্দরবনকে রক্ষা, বনের প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচানোর স্বার্থ বাদ দিয়ে সরকার ভূরাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল।
সোমবার (২৬ জুলাই) বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। সুন্দরবন নিয়ে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪৪তম সভার সুপারিশ নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ‘ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল’ সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগর উপকূলে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকায় ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত এই বনাঞ্চলটি বৈশ্বিক সম্পদ বিবেচনায় ১৯৮৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো।
পরিবেশ বিপর্যয় থেকে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষে পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করছে। তাদের দাবি এই বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আশপাশের অন্যান্য প্রকল্প সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি করবে। বিষয়টি আমলে নিয়ে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি সুন্দরবন রক্ষায় বেশকিছু শর্ত দিয়েছিল। শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে সুন্দরবনকে ‘বিপন্ন বা লাল তালিকা’ভুক্ত করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল কমিটি।
এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গত কয়েকবছর যাবত ইউনেস্কোর সঙ্গে দেন-দরবার করছে দাবি করে বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ বক্তা (পরিবেশবিদ) বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ওই সভার বিষয়ে তাদের হতাশা ব্যক্ত করেন। এই কমিটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে বলেও অভিমত দেন একাধিক বক্তা।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জানান, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত আগামী বছর নেয়ার সুপারিশ করা হয়। এবার আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ শর্তগুলো পূরণ না করলে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য বা লাল তালিকাভুক্ত করা হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের আশপাশে নানা স্থাপনা নিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির উদ্বেগ ছিল।
কিন্তু ইউনেসকোর বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের খসড়া প্রস্তাবে এ বছর সিদ্ধান্ত না নেয়ার সুপারিশ করে বলেছে, আগামী সম্মেলনের আগে বাংলাদেশকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। ওই সভায় চীন, রাশিয়া, মিসরসহ নানা দেশ বাংলাদেশের সমর্থনে কথা বলে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ায় বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির আগামী সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে আগামী বছর ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।
সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সুন্দরবন বিশ্বের সম্পদ। এটিকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সুন্দরবন ইস্যুতে সরকার বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেন-দরবার করেছে বলে মনে হয়। সেটির প্রমাণ গত ৪৪তম সভায় স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। এর পেছনে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করেছে। রাজনীতি দেশের ও জনগণের স্বার্থে হচ্ছে নাকি মুষ্টিমেয় মুনাফালোভীদের স্বার্থে হচ্ছে তাও জাতিকে বুঝতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন রক্ষায় লড়াই চালু থাকবে। এখানে দেশের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সমর্থন দরকার।’
ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সাম্প্রতিক সভায় সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক পরিবেশকর্মী তন্নী নওশীন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির গত ৪৪তম সভা আমাদের জন্য শুধুই ক্ষোভ ও কষ্টের বিষয় ছিল। কয়লা প্রকল্প যেন সুন্দরবনে করা না হয়, সেজন্য আমাদের বক্তব্য প্রদান করেছি। সভায় কমিটির কিছু কিছু সদস্য বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু নিম্ন আয়ের দেশ সেখানে উন্নত হওয়া দরকার তাই বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে বেশি চাপ দেয়ার প্রয়োজন নেই।’
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষে ওই সভায় ওয়ার্ড হেরিটেজ ওয়াচ-এর চেয়ারম্যান স্টিফান ডম্পকে এবং জেনেভায় জাতিসঙ্ঘে আর্থ জাস্টিসের স্থায়ী প্রতিনিধি ইভস লেডরও বক্তব্য রাখেন।
স্টিফেন ডমপকে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির অধিবেশন চলাকালীন আমরা কার্যত শক্তিহীন ছিলাম। সুতরাং আমাদের জনসাধারণের দ্বারা চাপ সৃষ্টি করা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন অবশ্য করণীয়।’ এই বিষয়টি আসন্ন কপ সম্মেলনে উত্থাপন করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় রাজনৈতিক প্রভাব কয়েক বছর যাবত প্রকট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ বছর তা কেবল সুন্দরবন নয়, অন্যান্য ঐতিহ্যের বেলায়ও প্রকটভাবে লক্ষ্য করা গেছে।’
ইভস লেডর বলেন, ‘জনগনের মতামত এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিরুদ্ধে গিয়ে ইউনেস্কোর মতো বৈশ্বিক মঞ্চে সরকারের পরিবেশবিরোধী কৌশল অবলম্বন করার কারণে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে রাজনীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনবে। বিজ্ঞানকে ভিত্তি করেই যেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেই সেখানে এ ধরনের বিজ্ঞান অবহেলিত কর্মকা-ের প্রবণতা আমাদের সবার চিন্তার কারণ।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দেশের মানুষের সমর্থন পায়নি সরকার। তারা বিশ্বের নানা দেশের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়েছে। এই লবিংয়ের টাকা তারা কোত্থেকে পাচ্ছে? প্রশ্ন রেখে রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে যখন ভারত, চীন বা রাশিয়া দাঁড়ায়, তখন এ নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কেননা, এসব দেশের প্রতিটিরই বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ আছে। এখানে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের (স্বার্থের দ্বন্দ্ব) ’ কারণে এসব দেশ সপক্ষে দাঁড়াতে পারে না।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির গত ৪৪তম সভায় বিশ্বের ১৯৯টি বিশ্ব ঐতিহ্য বিষয়ে বিশ্লেষণ ও আলোচনা করা হয় যার মধ্যে সুন্দরবন বিষয়টিও ছিল। কমিটি তার দুর্বল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সুন্দরবনের ঐতিহ্য সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে এর স্বপক্ষে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের খসড়া সুপারিশ এবং কমিটি সিদ্ধান্তের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা রাজনৈতিক বিবেচনাকে বিজ্ঞান এবং আদর্শের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
ড. সাজেদ কামাল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদান করছে। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিপন্থী এবং আত্মঘাতী। বাংলাদেশের সক্ষমতা রয়েছে পরিচ্ছন্ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করা। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা আমলে নেয়া প্রয়োজন।’
বাপার নির্বাহী সহসভাপতি ও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. আবদুল মতিন বলেন, ‘সরকার সুন্দরবনের বিষয়ে দেশের মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে না কিন্তু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেন-দরবার করছে, যা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার সামিল।’
সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের জন্য চলমান কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা সরকারি প্রভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে না করে নিরপেক্ষ, বিজ্ঞানভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলকভাবে সম্পন্ন করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে রামপাল, তালতলী ও কলাপাড়ার সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা এবং সুন্দরবনের ভেতরদিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য বহনকারী নৌযান চলাচল নিষিদ্ধের দাবিও তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল আজিজ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) সদস্য অধ্যপক ড. সাজেদ কামাল ও অধ্যাপক ড. খালেকুজ্জামান, ঢাবির অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, বাপার কোষাধ্যক্ষ মহিদুল হক খান এবং পশুর রিভার ওয়াটারকিপার নুর আলম শেখ প্রমুখ।