ডাক্তার ইশিতার প্রতারণা
ময়মনসিংহের একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে অনুশীলন না করে প্রতারনায় নামেন তিনি। ভূয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক,সহ নানা পরিচয়ে প্রতারণাই তার মূল পেশা। ফিলিপাইনের একটি সংস্থা থেকেও ভূয়া বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদবীও অর্জন করেন। ব্যবহার করতেন র্যাঙ্ক ব্যাজ। সাইবার ওয়ার্ল্ডে( অনলাইন প্লাটফর্মে) তার নানা বিষয়ে দেশী-বিদেশী সার্টিফিকের শেষ নেই। নানা পরিচয়ে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বেসরকারী টিভির টকশোতেও। বাংলাদেশের এমন এক তথাকথিত গুণী নারীকে নিয়ে রীতিমতো হৈচে। আসলে এসবের সবই ভূয়া। দেখতে সুন্দরী এ নারীর নাম ইশরাত রফিক ঈশিতা। র্যাবের অভিযানে সহযোগী শহীদুল ইসলামসহ গ্রেফতার এ চক্রের প্রতারণার নানা কাহিনী বেরিয়ে আসে।
র্যাব জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃতরা যোগসাজশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভূয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে- বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রয়েছে। তাদের আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে জানান র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর অভিযানে গতকাল সকালে রাজধানীর শাহ আলী থানার মিরপুর-১ থেকে ইশরাত রফিক ঈশিতাকে (আইপিসি) আটক করে। ঈশিতা কাফরুলের খন্দকার রফিকুল ইসলামের মেয়ে। আর তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদার দোহারের মোঃ হুমায়ন কবীরের ছেলে। অভিযানের উদ্ধার করা হয়, ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সীল, ভুয়া সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০পিছ ইয়াবা, ৫ বোতল বিদেশী মদ এবং মোবাইল ফোন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা তাদের প্রতারণার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে ইশিতার এ ধরনের প্রতারণার যাত্রা। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে সে বেশি সক্রিয় হয়। বাংলাদেশের নামীদামী বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে সার্টিফিকেট অর্জনকারী হিসেবে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, এমপি, বিশিষ্টজনদের সঙ্গে টকশোতে অংশ নিয়েছেন। সেখানে সে তার নানা অর্জনের যেসব তথ্য দিয়েছেন সবই ছিলো ভুয়া। চুরি করা আর্টিকেল নিজের নামের উপর চালিয়ে দিতেন তিনি।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা পেশায় একজন চিকিৎসক। যিনি বিভিন্ন মাধ্যমে একজন আলোচক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডি সম্পন্ন, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদ মর্যাদার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে ভূয়া পরিচয় প্রদান করে থাকেন। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভূয়া পরিচয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে তিনি ভূয়া নথিপত্র তৈরী ও প্রচার প্রচারণা করে থাকেন। তিনি ময়মনসিংহে অবস্থিত একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৩ সালে (সেশন ২০০৫-২০০৬) এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালের জুনের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। ওই বছর তিনি একটি সরকারী সংস্থায় চুক্তি ভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে ৪ মাস চাকুরী করার পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকুরীচ্যুত হন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা মূলত অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা এডিট করে বর্ণিত গবেষণাধর্মী প্রকাশনা প্রস্তুত করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা জানান, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদেশে প্রাপ্ত ভূয়া সাফল্য স্বীকৃতের প্রচারণা করতেন। যার মধ্যে রয়েছে, ২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডব্লিউ ২০২০) পেয়েছেন। যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে “বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী” হিসেবে পুরস্কার। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’; থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটষ্ট্যান্ডিং সায়েন্টিষ্ট এন্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ইত্যাদি। তিনি জানান যে, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ভূয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানীতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রচারণা করেন যে, তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে আন্তর্জাতিক ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এছাড়া তিনি অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন যথাক্রমে আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুডউইল ইত্যাদি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তিনি অ্যাওয়ার্ড বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এডিটিং করা ভূয়া ছবি ও সনদ তৈরী করে গণমাধ্যমে প্রেরণ ও ভার্চুয়াল জগতে প্রচারণা করতেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা করোনা মহামারীকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট প্রদান করে প্রচার-প্রচারণা করেছেন। সে বিভিন্ন বিদেশীদের ভূয়া সার্টিফিকেট প্রচারণা করে অন্যান্যদের অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট গ্রহণে আকৃষ্ট করতেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ইয়ং ওয়ার্ড লিডার ফর হিউমিনিটি নামক একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনার সাথে যুক্ত। অনলাইন প্লার্টফর্মে যার ফেইসবুক পেইজ এবং লিঙ্ককেড আইডি রয়েছে। সংস্থাটির সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত বলে প্রচারণা করা হয়েছে। ওই ফেসবুক পেজের কো-এ্যাডমিন গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা। এই ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরী করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে গ্রেফতারকৃত জানায়। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভূয়া অ্যাওয়ার্ড বিতরণের বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী গ্রহণ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যে বুরুন্ডি ও আফগানিস্তানে এ ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া সংগঠনের ব্যানারে ২০১৯ সালের এপ্রিলে রাজধানীর একটি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৩০ জন বাংলাদেশীকেও ইয়ং ওয়ার্ড লিডার ফর হিউমিনিটি এর সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে ইশরাত রফিক ঈশিতা সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন। এই সংগঠনে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের বা জনমনে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে এমন ব্যক্তিদের ছবি যুক্ত করে এ্যাডভাইজর, ভাইস চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানা পদে যোগদান করেছেন বলে ভূয়া প্রচারণা চালানো হয়।
তিনি ২০১৮ সালে নিরাপত্তা, চিকিৎসা, মানবাধিকার, নারী শিশু অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত বলে ভূয়া তথ্য প্রচার করেছেন। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে আমিরিকান সেক্সুয়াল হেলথ এসোসিয়েশেন(এসহা) ন্যাশোনাল সার্বিক্যাল ক্যানসার কোয়ালিশন, গ্লোবাল গুডউইয়ল ওর্গানাইজেমন ইউএসএ, ইয়ং ওয়ার্ড লিডার ফর হিউনিমিনিটি, গ্লোবাল পিচ চেইন, গ্লোবাল হিউম্যান রাইট প্রোজেক্ট, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টিলিজেন্ট ওর্গানাইজেশন, ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ কমিশন, ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন ইত্যাদি।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র্যাংক ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। সে ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট আইপিসি ফিল ডট কম (ওচঈ.চযরষ.পড়স) থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় “বিগ্রেডিয়ার জেনারেল” পদটি প্রাপ্ত হয় । এছাড়াও সে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সদস্য পদের ভূয়া সনদ তৈরী করে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা নিজস্ব ভূয়া ডিগ্রী, পদ ও পদবী প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আইপি চ্যানেল ব্যবহার করতেন। ক্ষেত্র বিশেষে গণমাধ্যমে তার টকশো, আলোচনা, সাক্ষাতকার ও সাফল্য সমূহ প্রচারিত হয়েছে। মূলত তিনি তার ভূয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সকলকে বিভ্রান্ত করতেন। বিভিন্ন স্থানে পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীনতা এড়াতে তার “বস” হিসেবে তার সহযোগী গ্রেফতারকৃত মোঃ শহিদুল ইসলাম দিদার ভূমিকা রাখতেন। যিনি টেলিফোন-অনলাইনে এবং ক্ষেত্র বিশেষে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ইশিতার পরিচয় বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতেন।
তার সহযোগী গ্রেফতারকৃত মোঃ শহীদুল ইসলাম দিদার ২০১২ সালে একটি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা (ইঞ্জিনিয়ার) সম্পন্ন করেন। পরে সে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমাও সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি গার্মেন্টেসে কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। সেও ফিলিপাইনে একই সাইট হতে অর্থের বিনিময়ে মেজর জেনারেল পদ ধারণ করেন বলে জানান। এছাড়া নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক); ইয়াং ওয়াল্ড লিডার ফর হিউমিনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের ফাউন্ডার (প্রতিষ্ঠাতা) বা কর্ণধার হিসেবে উপস্থাপন করেন। একইভাবে তিনি দূর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
ডাক্তার ইশিতার প্রতারণা
রোববার, ০১ আগস্ট ২০২১
ময়মনসিংহের একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে অনুশীলন না করে প্রতারনায় নামেন তিনি। ভূয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক,সহ নানা পরিচয়ে প্রতারণাই তার মূল পেশা। ফিলিপাইনের একটি সংস্থা থেকেও ভূয়া বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদবীও অর্জন করেন। ব্যবহার করতেন র্যাঙ্ক ব্যাজ। সাইবার ওয়ার্ল্ডে( অনলাইন প্লাটফর্মে) তার নানা বিষয়ে দেশী-বিদেশী সার্টিফিকের শেষ নেই। নানা পরিচয়ে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বেসরকারী টিভির টকশোতেও। বাংলাদেশের এমন এক তথাকথিত গুণী নারীকে নিয়ে রীতিমতো হৈচে। আসলে এসবের সবই ভূয়া। দেখতে সুন্দরী এ নারীর নাম ইশরাত রফিক ঈশিতা। র্যাবের অভিযানে সহযোগী শহীদুল ইসলামসহ গ্রেফতার এ চক্রের প্রতারণার নানা কাহিনী বেরিয়ে আসে।
র্যাব জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃতরা যোগসাজশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভূয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে- বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রয়েছে। তাদের আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে জানান র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর অভিযানে গতকাল সকালে রাজধানীর শাহ আলী থানার মিরপুর-১ থেকে ইশরাত রফিক ঈশিতাকে (আইপিসি) আটক করে। ঈশিতা কাফরুলের খন্দকার রফিকুল ইসলামের মেয়ে। আর তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদার দোহারের মোঃ হুমায়ন কবীরের ছেলে। অভিযানের উদ্ধার করা হয়, ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সীল, ভুয়া সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০পিছ ইয়াবা, ৫ বোতল বিদেশী মদ এবং মোবাইল ফোন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা তাদের প্রতারণার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে ইশিতার এ ধরনের প্রতারণার যাত্রা। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে সে বেশি সক্রিয় হয়। বাংলাদেশের নামীদামী বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে সার্টিফিকেট অর্জনকারী হিসেবে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, এমপি, বিশিষ্টজনদের সঙ্গে টকশোতে অংশ নিয়েছেন। সেখানে সে তার নানা অর্জনের যেসব তথ্য দিয়েছেন সবই ছিলো ভুয়া। চুরি করা আর্টিকেল নিজের নামের উপর চালিয়ে দিতেন তিনি।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা পেশায় একজন চিকিৎসক। যিনি বিভিন্ন মাধ্যমে একজন আলোচক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডি সম্পন্ন, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদ মর্যাদার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে ভূয়া পরিচয় প্রদান করে থাকেন। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভূয়া পরিচয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে তিনি ভূয়া নথিপত্র তৈরী ও প্রচার প্রচারণা করে থাকেন। তিনি ময়মনসিংহে অবস্থিত একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৩ সালে (সেশন ২০০৫-২০০৬) এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালের জুনের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। ওই বছর তিনি একটি সরকারী সংস্থায় চুক্তি ভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে ৪ মাস চাকুরী করার পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকুরীচ্যুত হন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা মূলত অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা এডিট করে বর্ণিত গবেষণাধর্মী প্রকাশনা প্রস্তুত করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা জানান, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদেশে প্রাপ্ত ভূয়া সাফল্য স্বীকৃতের প্রচারণা করতেন। যার মধ্যে রয়েছে, ২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডব্লিউ ২০২০) পেয়েছেন। যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে “বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী” হিসেবে পুরস্কার। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’; থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটষ্ট্যান্ডিং সায়েন্টিষ্ট এন্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ইত্যাদি। তিনি জানান যে, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ভূয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানীতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রচারণা করেন যে, তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে আন্তর্জাতিক ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এছাড়া তিনি অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন যথাক্রমে আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুডউইল ইত্যাদি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তিনি অ্যাওয়ার্ড বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এডিটিং করা ভূয়া ছবি ও সনদ তৈরী করে গণমাধ্যমে প্রেরণ ও ভার্চুয়াল জগতে প্রচারণা করতেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা করোনা মহামারীকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট প্রদান করে প্রচার-প্রচারণা করেছেন। সে বিভিন্ন বিদেশীদের ভূয়া সার্টিফিকেট প্রচারণা করে অন্যান্যদের অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট গ্রহণে আকৃষ্ট করতেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ইয়ং ওয়ার্ড লিডার ফর হিউমিনিটি নামক একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনার সাথে যুক্ত। অনলাইন প্লার্টফর্মে যার ফেইসবুক পেইজ এবং লিঙ্ককেড আইডি রয়েছে। সংস্থাটির সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত বলে প্রচারণা করা হয়েছে। ওই ফেসবুক পেজের কো-এ্যাডমিন গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা। এই ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরী করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে গ্রেফতারকৃত জানায়। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভূয়া অ্যাওয়ার্ড বিতরণের বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী গ্রহণ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যে বুরুন্ডি ও আফগানিস্তানে এ ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া সংগঠনের ব্যানারে ২০১৯ সালের এপ্রিলে রাজধানীর একটি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৩০ জন বাংলাদেশীকেও ইয়ং ওয়ার্ড লিডার ফর হিউমিনিটি এর সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে ইশরাত রফিক ঈশিতা সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন। এই সংগঠনে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের বা জনমনে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে এমন ব্যক্তিদের ছবি যুক্ত করে এ্যাডভাইজর, ভাইস চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানা পদে যোগদান করেছেন বলে ভূয়া প্রচারণা চালানো হয়।
তিনি ২০১৮ সালে নিরাপত্তা, চিকিৎসা, মানবাধিকার, নারী শিশু অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত বলে ভূয়া তথ্য প্রচার করেছেন। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে আমিরিকান সেক্সুয়াল হেলথ এসোসিয়েশেন(এসহা) ন্যাশোনাল সার্বিক্যাল ক্যানসার কোয়ালিশন, গ্লোবাল গুডউইয়ল ওর্গানাইজেমন ইউএসএ, ইয়ং ওয়ার্ড লিডার ফর হিউনিমিনিটি, গ্লোবাল পিচ চেইন, গ্লোবাল হিউম্যান রাইট প্রোজেক্ট, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টিলিজেন্ট ওর্গানাইজেশন, ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ কমিশন, ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন ইত্যাদি।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র্যাংক ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। সে ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট আইপিসি ফিল ডট কম (ওচঈ.চযরষ.পড়স) থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় “বিগ্রেডিয়ার জেনারেল” পদটি প্রাপ্ত হয় । এছাড়াও সে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সদস্য পদের ভূয়া সনদ তৈরী করে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।
গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা নিজস্ব ভূয়া ডিগ্রী, পদ ও পদবী প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আইপি চ্যানেল ব্যবহার করতেন। ক্ষেত্র বিশেষে গণমাধ্যমে তার টকশো, আলোচনা, সাক্ষাতকার ও সাফল্য সমূহ প্রচারিত হয়েছে। মূলত তিনি তার ভূয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সকলকে বিভ্রান্ত করতেন। বিভিন্ন স্থানে পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীনতা এড়াতে তার “বস” হিসেবে তার সহযোগী গ্রেফতারকৃত মোঃ শহিদুল ইসলাম দিদার ভূমিকা রাখতেন। যিনি টেলিফোন-অনলাইনে এবং ক্ষেত্র বিশেষে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ইশিতার পরিচয় বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতেন।
তার সহযোগী গ্রেফতারকৃত মোঃ শহীদুল ইসলাম দিদার ২০১২ সালে একটি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা (ইঞ্জিনিয়ার) সম্পন্ন করেন। পরে সে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমাও সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি গার্মেন্টেসে কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। সেও ফিলিপাইনে একই সাইট হতে অর্থের বিনিময়ে মেজর জেনারেল পদ ধারণ করেন বলে জানান। এছাড়া নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক); ইয়াং ওয়াল্ড লিডার ফর হিউমিনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের ফাউন্ডার (প্রতিষ্ঠাতা) বা কর্ণধার হিসেবে উপস্থাপন করেন। একইভাবে তিনি দূর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।