আট দিনে ১ কোটি ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা
স্বাস্থ্য বিভাগ আগামী বছরের প্রথম নাগাদ ২১ কোটি ডোজ করোনা প্রতিরোধক ‘টিকা’ পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। সরবরাহকারী দেশ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে টিকার সংকট হওয়ার কথা নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত টিকার সংকট দেখা যাচ্ছে না। তবে চ্যালেঞ্জ হবে টিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন। কারণ, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরও ১৮ থেকে ১৯ কোটি ডোজ টিকার পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে তিন কোটি ডোজ টিকা আসার কথা।
এই টিকার সংরক্ষণ, ‘কোল্ড চেইন’ রক্ষা, সারাদেশে বিতরণ ও প্রয়োগ এবং সর্বোপরি এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীদের ব্যবস্থাপনাকেই বড় বিষয় হিসেবে দেখছেন কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের ‘আইইডিসিআরের’ উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল (১ আগস্ট) বলেছেন, আটদিনে এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আমি মনে করি, মাসে এক-দুই কোটি ডোজ কিংবা আট দিনেও এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার ক্যাপাসিটি স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। সেটা নির্ভর করবে টিকা প্রাপ্তির ওপর।’
এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই এক দিনে এক কোটির বেশি শিশুকে আমরা ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে পারি, হাম-রুবেলার টিকা দিতে পারি। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই সপ্তাহে এক কোটি টিকা দেয়া কোনো ব্যাপার নয়। তবে টিকাদান ব্যবস্থাপনা সঠিক ও যথাযথ হতে হবে।’
স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে এ পর্যন্ত দুই কোটি ১৯ লাখ ২৭ হাজার ডোজ করোনা টিকা এসেছে। এর মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত এক কোটি ৩৪ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে। এ হিসেবে বর্তমানে সরকারের মজুদে টিকা রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ ডোজ।
এ পর্যন্ত পাওয়া মোট টিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এক কোটি ১২ লাখ ২৬ হাজার ২০০ ডোজ। কিন্তু এই টিকার প্রথম ডোজ নেয়া ১৫ লাখ ২২ হাজার মানুষ এখনও দ্বিতীয় পায়নি। আজ থেকে সারাদেশে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হচ্ছে।
সোমবার (২ আগস্ট) এক ভার্চুয়াল বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা প্রতিরোধী টিকা বিতরণ কমিটির সদস্য ও প্রকল্প পরিচালক ডা. শামসুল হক বলেন, ‘দেশে ১৫ লাখ ২১ হাজার ৯৪৭ জন অক্সফোর্ডের টিকার দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষা করছেন। ‘কোভ্যাক্সের’ আওতায় জাপান সরকারের সহযোগিতায় আমরা ইতোমধ্যে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৩২০ ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা পেয়েছি।’ এই টিকা দিয়েই দ্বিতীয় ডোজ পুনরায় শুরু হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ২৫ জুলাই ঢাকায় ‘বিএসএমএমইউ’তে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই মাসে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আমরা ২১ কোটি টিকার ব্যবস্থা করেছি।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার সিন্ধান্ত এখনও হয়নি। টিকা কিনতে যেসব চুক্তি হয়েছে সেই অনুযায়ী টিকা পাওয়া গেলে মাসে দুই কোটির বেশি টিকা দেয়ার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে।
সরকার বিভিন্ন ভ্যাকসিনের যে চুক্তি করেছে, তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ২১ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি’ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এই ২১ কোটি ডোজের মধ্যে চীনের সিনোফার্মের তিন কোটি, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি, বিশ^ব্যাপী দরিদ্র দেশগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি ‘কোভ্যাক্সের’র আওতায় সাত কোটি, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ১ কোটি এবং জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির সাত কোটি ডোজ। এই টিকা পর্যায়ক্রমে দেশে আসবে; তবে আগামী বছরের প্রথমদিকের মধ্যে দেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ২১ কোটি ডোজ টিকার মধ্যে কোভ্যাক্সের সাত কোটি উপহার হিসেবে আসছে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাকর্মসূচির প্রস্তুতি :
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় সারা দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার স্থায়ী টিকাকেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে হাম-রুবেলা বা অন্য কোন টিকা কর্মসূচিতে এক দিনে প্রায় ২ কোটি শিশুকে টিকা দেয়া হয়।
দেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি। শুরু থেকে মহানগর, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের এক হাজার পাঁচটি কেন্দ্রে টিকা দেয়া হচ্ছে। অনেক কেন্দ্রে একাধিক বুথ আছে। প্রতিটি বুথে দিনে অন্তত ১৫০ ডোজ দেওয়ার সক্ষমতা আছে। বর্তমানে দিনে প্রায় তিন লাখ মানুষকে করোনা টিকা দেয়া হচ্ছে।
মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষে ২৫ বছর পূর্ণ দেশের যেকোনো নাগরিককেই টিকার নিবন্ধনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান শুরু হবে। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া নাগরিকরা ৮ আগস্ট থেকে টিকা নিতে পারবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে টিকাদান কেন্দ্রের স্থান নির্ধারণ করবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট স্থানে টিকাদান কেন্দ্র হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ইপিআই) ডা. সামছুল হক সংবাদকে জানিয়েছেন, তারা তৃণমূল পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষে কাজ করছেন। প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যূনতম একটি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার টিকা কেন্দ্র হবে। এ ছাড়া পৌরসভার প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে এবং সিটি করপোরেশনের প্রতি ওয়ার্ডে তিনটি করে টিকাদান কেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রতিটি ইউনিয়নে সপ্তাহে তিন দিন টিকা কর্মসূচি চলার কথা উল্লেখ করে নির্দেশনা বলা হয়েছে, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত টিকা কর্মসূচি চলবে। টিকাদানের আগে আগ্রহী ব্যক্তিদের যাবতীয় তথ্য লিখে রাখবেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধনের পর টিকা কার্ড দেয়া হবে। এই কার্ড দেখিয়েই দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে।
একটি কেন্দ্রে দুজন টিকাদান কর্মী ও তিনজন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করবেন। তারা প্রতিদিন টিকাদান শেষে এক ঘণ্টা কেন্দ্রে অবস্থান করবেন। এই সময়ে তারা নিবন্ধন-সংক্রান্ত তথ্য অনলাইনে তুলে রাখবেন। দৈনিক প্রতিবেদন তৈরি করে তারা তা নিজ নিজ উপজেলা বা পৌরসভায় পাঠাবেন।
কোন টিকা কত ডোজ এসেছে :
সর্বশেষ জাপান সরকার গত ৩১ জুলাই উপহার হিসেবে সাত লাখ ৮১ হাজার ডোজ করোনা টিকা দিয়েছে বাংলাদেশকে। এ নিয়ে দেশে মোট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এসেছে ১ কোটি ১২ লাখ ২৬ হাজার ২০০ ডোজ।
১ আগস্ট পর্যন্ত এই টিকার প্রথম ডোজ ও দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে এক কোটি এক লাখ ২০ হাজার জনকে। তাদের মধ্যে প্রথম ডোজ ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৩৩ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৯ জন।
এখন পর্যন্ত ফাইজার-বায়োএনটেকের ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই টিকার মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত ৫০ হাজার ২৫৫ জনকে প্রথম ডোজ এবং দুই হাজার ২৫০ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে।
চীনের সিনোফার্মের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৭১ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত দুই লাখ ২৫ হাজার ৫২৫ জনকে প্রথম ডোজ এবং ৪৯ হাজার ৫৫৮ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার কাছ থেকে ইতোমধ্যে ৫৫ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া গেছে। এই টিকার মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত ৭৬ হাজার ৫৪৪ জনকে প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে। এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
সরকার দেশের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনতে চায়। এই হিসেবে ১৩ কোটি ৫২ লাখ আট হাজার মানুষকে টিকা দিতে হবে। সেজন্য দুই ডোজের টিকার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ২৭ কোটি চার লাখ এক হাজার ৬০০ ডোজ।
কিন্তু সবাইকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া হচ্ছে না। প্রায় সাত কোটি নাগরিককে এক ডোজের টিকা দেয়া হবে। এ কারণে মোট টিকার সংখ্যা কিছুটা কম হবে। সরকার যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের টিকা সাত কোটি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে মোট টিকার প্রয়োজন হতে পারে ২০ কোটি চার লাখ এক হাজার ৬০০ ডোজ।
দেশে প্রথম করোনা টিকা আসে গত ২১ জানুয়ারি। ভারত সরকার ওইদিন উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠায়। এই টিকা ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি হয়, যার নাম দেয়া হয় ‘কোভিশিল্ড’। এর চার দিন পর দেশে আসে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির আওতায় কেনা টিকার প্রথম চালান ৫০ লাখ ডোজ। পরবর্তীতে দ্বিতীয় চালানে সেরাম আরও ২০ লাখ ডোজ পাঠায়। গত ২৬ মার্চের পর ভারত থেকে আর কোনো টিকা আসেনি।
ভারত সরকার টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অন্য উৎস থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা চালায় সরকার। এরপর গত ১২ মে চীন বাংলাদেশকে সিনোফার্মের উদ্ভাবিত পাঁচ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠায়। দ্বিতীয় চালানে আরও ছয় লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয় চীন।
এ ছাড়া চুক্তির আওতায় কেনা আরও ৪০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র উপহার হিসেবে ‘কোভ্যাক্সের’ আওতায় এ মডার্নার ৫৫ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে। এর আগে ১ লাখ ৬২০ ডোজ ফাইজারের টিকা কোভ্যাক্সের আওতায় উপহার হিসেবে পাঠানো হয়।
আট দিনে ১ কোটি ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা
সোমবার, ০২ আগস্ট ২০২১
স্বাস্থ্য বিভাগ আগামী বছরের প্রথম নাগাদ ২১ কোটি ডোজ করোনা প্রতিরোধক ‘টিকা’ পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। সরবরাহকারী দেশ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে টিকার সংকট হওয়ার কথা নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত টিকার সংকট দেখা যাচ্ছে না। তবে চ্যালেঞ্জ হবে টিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন। কারণ, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরও ১৮ থেকে ১৯ কোটি ডোজ টিকার পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে তিন কোটি ডোজ টিকা আসার কথা।
এই টিকার সংরক্ষণ, ‘কোল্ড চেইন’ রক্ষা, সারাদেশে বিতরণ ও প্রয়োগ এবং সর্বোপরি এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীদের ব্যবস্থাপনাকেই বড় বিষয় হিসেবে দেখছেন কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের ‘আইইডিসিআরের’ উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল (১ আগস্ট) বলেছেন, আটদিনে এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আমি মনে করি, মাসে এক-দুই কোটি ডোজ কিংবা আট দিনেও এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার ক্যাপাসিটি স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। সেটা নির্ভর করবে টিকা প্রাপ্তির ওপর।’
এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই এক দিনে এক কোটির বেশি শিশুকে আমরা ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে পারি, হাম-রুবেলার টিকা দিতে পারি। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই সপ্তাহে এক কোটি টিকা দেয়া কোনো ব্যাপার নয়। তবে টিকাদান ব্যবস্থাপনা সঠিক ও যথাযথ হতে হবে।’
স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে এ পর্যন্ত দুই কোটি ১৯ লাখ ২৭ হাজার ডোজ করোনা টিকা এসেছে। এর মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত এক কোটি ৩৪ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে। এ হিসেবে বর্তমানে সরকারের মজুদে টিকা রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ ডোজ।
এ পর্যন্ত পাওয়া মোট টিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এক কোটি ১২ লাখ ২৬ হাজার ২০০ ডোজ। কিন্তু এই টিকার প্রথম ডোজ নেয়া ১৫ লাখ ২২ হাজার মানুষ এখনও দ্বিতীয় পায়নি। আজ থেকে সারাদেশে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হচ্ছে।
সোমবার (২ আগস্ট) এক ভার্চুয়াল বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা প্রতিরোধী টিকা বিতরণ কমিটির সদস্য ও প্রকল্প পরিচালক ডা. শামসুল হক বলেন, ‘দেশে ১৫ লাখ ২১ হাজার ৯৪৭ জন অক্সফোর্ডের টিকার দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষা করছেন। ‘কোভ্যাক্সের’ আওতায় জাপান সরকারের সহযোগিতায় আমরা ইতোমধ্যে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৩২০ ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা পেয়েছি।’ এই টিকা দিয়েই দ্বিতীয় ডোজ পুনরায় শুরু হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ২৫ জুলাই ঢাকায় ‘বিএসএমএমইউ’তে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই মাসে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আমরা ২১ কোটি টিকার ব্যবস্থা করেছি।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার সিন্ধান্ত এখনও হয়নি। টিকা কিনতে যেসব চুক্তি হয়েছে সেই অনুযায়ী টিকা পাওয়া গেলে মাসে দুই কোটির বেশি টিকা দেয়ার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে।
সরকার বিভিন্ন ভ্যাকসিনের যে চুক্তি করেছে, তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ২১ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি’ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এই ২১ কোটি ডোজের মধ্যে চীনের সিনোফার্মের তিন কোটি, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি, বিশ^ব্যাপী দরিদ্র দেশগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি ‘কোভ্যাক্সের’র আওতায় সাত কোটি, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ১ কোটি এবং জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির সাত কোটি ডোজ। এই টিকা পর্যায়ক্রমে দেশে আসবে; তবে আগামী বছরের প্রথমদিকের মধ্যে দেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ২১ কোটি ডোজ টিকার মধ্যে কোভ্যাক্সের সাত কোটি উপহার হিসেবে আসছে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাকর্মসূচির প্রস্তুতি :
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় সারা দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার স্থায়ী টিকাকেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে হাম-রুবেলা বা অন্য কোন টিকা কর্মসূচিতে এক দিনে প্রায় ২ কোটি শিশুকে টিকা দেয়া হয়।
দেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি। শুরু থেকে মহানগর, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের এক হাজার পাঁচটি কেন্দ্রে টিকা দেয়া হচ্ছে। অনেক কেন্দ্রে একাধিক বুথ আছে। প্রতিটি বুথে দিনে অন্তত ১৫০ ডোজ দেওয়ার সক্ষমতা আছে। বর্তমানে দিনে প্রায় তিন লাখ মানুষকে করোনা টিকা দেয়া হচ্ছে।
মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষে ২৫ বছর পূর্ণ দেশের যেকোনো নাগরিককেই টিকার নিবন্ধনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান শুরু হবে। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া নাগরিকরা ৮ আগস্ট থেকে টিকা নিতে পারবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে টিকাদান কেন্দ্রের স্থান নির্ধারণ করবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট স্থানে টিকাদান কেন্দ্র হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ইপিআই) ডা. সামছুল হক সংবাদকে জানিয়েছেন, তারা তৃণমূল পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষে কাজ করছেন। প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যূনতম একটি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার টিকা কেন্দ্র হবে। এ ছাড়া পৌরসভার প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে এবং সিটি করপোরেশনের প্রতি ওয়ার্ডে তিনটি করে টিকাদান কেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রতিটি ইউনিয়নে সপ্তাহে তিন দিন টিকা কর্মসূচি চলার কথা উল্লেখ করে নির্দেশনা বলা হয়েছে, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত টিকা কর্মসূচি চলবে। টিকাদানের আগে আগ্রহী ব্যক্তিদের যাবতীয় তথ্য লিখে রাখবেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধনের পর টিকা কার্ড দেয়া হবে। এই কার্ড দেখিয়েই দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে।
একটি কেন্দ্রে দুজন টিকাদান কর্মী ও তিনজন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করবেন। তারা প্রতিদিন টিকাদান শেষে এক ঘণ্টা কেন্দ্রে অবস্থান করবেন। এই সময়ে তারা নিবন্ধন-সংক্রান্ত তথ্য অনলাইনে তুলে রাখবেন। দৈনিক প্রতিবেদন তৈরি করে তারা তা নিজ নিজ উপজেলা বা পৌরসভায় পাঠাবেন।
কোন টিকা কত ডোজ এসেছে :
সর্বশেষ জাপান সরকার গত ৩১ জুলাই উপহার হিসেবে সাত লাখ ৮১ হাজার ডোজ করোনা টিকা দিয়েছে বাংলাদেশকে। এ নিয়ে দেশে মোট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এসেছে ১ কোটি ১২ লাখ ২৬ হাজার ২০০ ডোজ।
১ আগস্ট পর্যন্ত এই টিকার প্রথম ডোজ ও দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে এক কোটি এক লাখ ২০ হাজার জনকে। তাদের মধ্যে প্রথম ডোজ ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৩৩ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৯ জন।
এখন পর্যন্ত ফাইজার-বায়োএনটেকের ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই টিকার মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত ৫০ হাজার ২৫৫ জনকে প্রথম ডোজ এবং দুই হাজার ২৫০ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে।
চীনের সিনোফার্মের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৭১ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত দুই লাখ ২৫ হাজার ৫২৫ জনকে প্রথম ডোজ এবং ৪৯ হাজার ৫৫৮ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার কাছ থেকে ইতোমধ্যে ৫৫ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া গেছে। এই টিকার মধ্যে ১ আগস্ট পর্যন্ত ৭৬ হাজার ৫৪৪ জনকে প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে। এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
সরকার দেশের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনতে চায়। এই হিসেবে ১৩ কোটি ৫২ লাখ আট হাজার মানুষকে টিকা দিতে হবে। সেজন্য দুই ডোজের টিকার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ২৭ কোটি চার লাখ এক হাজার ৬০০ ডোজ।
কিন্তু সবাইকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া হচ্ছে না। প্রায় সাত কোটি নাগরিককে এক ডোজের টিকা দেয়া হবে। এ কারণে মোট টিকার সংখ্যা কিছুটা কম হবে। সরকার যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের টিকা সাত কোটি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে মোট টিকার প্রয়োজন হতে পারে ২০ কোটি চার লাখ এক হাজার ৬০০ ডোজ।
দেশে প্রথম করোনা টিকা আসে গত ২১ জানুয়ারি। ভারত সরকার ওইদিন উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠায়। এই টিকা ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি হয়, যার নাম দেয়া হয় ‘কোভিশিল্ড’। এর চার দিন পর দেশে আসে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির আওতায় কেনা টিকার প্রথম চালান ৫০ লাখ ডোজ। পরবর্তীতে দ্বিতীয় চালানে সেরাম আরও ২০ লাখ ডোজ পাঠায়। গত ২৬ মার্চের পর ভারত থেকে আর কোনো টিকা আসেনি।
ভারত সরকার টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অন্য উৎস থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা চালায় সরকার। এরপর গত ১২ মে চীন বাংলাদেশকে সিনোফার্মের উদ্ভাবিত পাঁচ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠায়। দ্বিতীয় চালানে আরও ছয় লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয় চীন।
এ ছাড়া চুক্তির আওতায় কেনা আরও ৪০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র উপহার হিসেবে ‘কোভ্যাক্সের’ আওতায় এ মডার্নার ৫৫ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে। এর আগে ১ লাখ ৬২০ ডোজ ফাইজারের টিকা কোভ্যাক্সের আওতায় উপহার হিসেবে পাঠানো হয়।